নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খোলাকথা

প্রতীক ওমর

কবি ও সাংবাদিক

প্রতীক ওমর › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘দীঘির জলে আগুন’

০৩ রা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:৪০


প্রতীক ওমর

ইয়ার চোখে টলটল করছে পানি। গাল বেয়ে ভিজে যাচ্ছে গলা ও বুক। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে হয়তো দম বন্ধ হয়ে যাবে। মরে যেতে পারে পরিবারের সব চেয়ে আনন্দের এই দিনেই। মাটি হতে পারে বাবা মার আশা। চোখ বন্ধ করে খিল আটকানো ঘরে বসে টানা পাঁচ মিনিট ভাবে ইয়া। গত রাত থেকে মুখে একটি দানাও দেইনি। না খাওয়া শরীরে আজ সে অনেক ক্লান্ত। তার উপর সারারাত ঘুমায়নি। বিকেলের মধ্যেই বাড়িতে শুরু হবে আনুষ্ঠানিকতা। ইয়া নিজেকে সামলে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মনের সাথে তুমুল যুদ্ধ করছে সে।

ফেলে আসা বিকেলগুলো, জোস্নারাত, বৃষ্টিভেজা আষাঢ়, এসব স্মৃতিময় মহুর্ত্বগুলো নিমিষেই হাজির হয় চোখের সামনে। আনমনে অবলকন করে মধুময় সময়গুলো। ভাবনার অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। বাঁধাহীন পথচলা আজ থেকেই হয়তো শেষ হয়ে যাবে ইয়ার। মাথা নিচু করে পড়ার টেবিলে মাথা ঠুকিয়ে আছে অনেকক্ষণ। ইয়ার চোখে ভাসছে লম্বা চুলের লিকলিকে চেহারার বন্ধু শরীফের অবয়ব। অল্প সময়ের পরিচয় হওয়া বন্ধুটি ইয়ার মন কেড়েছে। কোথায় যেন একটা দুর্বলতার কাজ করে ইয়ার মধ্যে। কল্পনার জগতে অনেক কিছুই ভেবেছিলো তাকে নিয়ে। শরীফও ঠিক ইয়ার মতই নানা পরিকল্পনা এঁটেছিলো তাকে নিয়ে। প্রতিদিন কথা হতো। বহুবার। কারণ ছাড়াই ঘন্টারপর ঘন্টা কথা চলতো তাদের মধ্যে। মুঠোফোনে। কখনো স্যোসাল মিডিয়ার লাইনে। দেখা হতো মাঝেমধ্যে। ক্যাম্পাসে। ঘাসের উপরে বসে পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকতো। মনের সাথে মনের বিনিয়ম চলতো। চোখের ভাষায় কথা হতো। জীবনকে সাজাতে হারিয়ে যেতো কল্পনার রাজ্যে। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দে ইয়ার চেতনা ফেরে। চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে দেয়। ভাবী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন।

ইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবী বুঝতে পারেন। এমন সময় সব মেয়েদের মনখারাপ থাকে। ভাবী আস্তে করে ইয়ার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। ইয়া নড়েচড়ে ওঠে। ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে। ভাবী খেতে বলে। ইয়া মাথা নেড়ে না বলে দেয়। খাবার পেটে যাবে না এখন। তারপরও ভাবী খাওয়ার জন্য জোর করে। গোসল দিয়ে সাজতে বলে। ইয়া মাথা নিচু করে ভাবীর কথা শুনে যায়। চেয়ার থেকে ওঠে না। একটু পরে বের হবে, ইয়া ভাবিকে জানিয়ে দেয়।

বাইরে মায়ের দৌড়ঝাপ অজানা উৎফুল্লতায়। মেয়ে বড় হয়েছে। বিএ পড়া শেষ। ভালো ঘরের সন্ধান করছেন অনেক দিন ধরেই। বাবা তেমন মাথা ঘামায়না। মেয়ে বড় হয়েছে বাবার চোখে কখনোই মনে হয়নি। পাশের উপজেলার একটি গ্রাম থেকে সমন্ধ এসেছে। উচ্চ শিক্ষিত ছেলে। একটি নামকরা এনজিওতে পরিচয় দেয়ারমত ভালো একটি পোস্টে চাকরি করে। ইয়ার পরিবার থেকে আগেই খোঁজ নিয়েছে। মায়ের পছন্দ। ওই ঘরে মেয়েকে দিতে কোন আপত্তি নেই তার। বরং মনে মনে একটু খুশিই তিনি। বাবা অনেকটা নির্বাক। ভালোমন্দ কোন কিছু এই মহুর্ত্ব তার মাথায় নেই। সহজ মনের মানুষ। মনের ভিতর কোথাও কোন বক্রতা নেই। ধর্মভীরু। মসজিদে আজান হলে আগেভাগেই নামাজে চলে যান। ইবাদত শেষে সংসারের খুটিনাটি কাজ করেন। জমিতে বিভিন্ন ধরণের ফসল চাষ হয়। আয়ের একমাত্র উৎস এসব ফসল। আজ মেয়েকে দেখতে আসবে বর পক্ষের লোকজন। সকালে বাজার করেছেন। অনাগত আত্মীয়দের আপ্যায়নের জন্য হরেক রকম আয়োজন চলছে বাড়িতে। ইয়ার মা, ভাবী এবং পরশিদের অনেকেই এসেছেন আয়োজনে সহযোগীতা করতে। সকাল দশটা তখন। প্রকৃতি থেকে গরমের তীব্রতা কমেছে মাত্র। শীতের শুরু। আকাশে জ¦লজলে সূর্য। তাপহীন। আছর নামাজের পরে আসার কথা বর পক্ষের দল।

আয়োজন বেশ গতিতেই চলছে। পাড়ার মহিলারা একেএকে ইয়াদের বাড়ি আসছে। বাংলাদেশী সংস্কৃতির মধ্যে এটি একটি অন্যতম। এখনো গ্রামে কোন বাড়িতে বিয়েসাদীর আয়োজন হলে পরশিরা স্বত:স্ফূর্তভাবে দেখতে আসে। বিয়ের গীত গায়। নাচ হয়। ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক হয়ে আনন্দ করে। যদিও শহুরে পরিবেশে এমনটা খুব বেশি চোখে পড়ে না। দিন বাড়তে থাকে। ইয়াদের বাড়িতেও মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। আয়োজন চলছে বাহির থেকেও বোঝা যাচ্ছে।
দুপুর পার হয়েছে। ভাবিরা ইয়াকে সাজাতে ব্যস্ত। শ্যামলাবরণ গায়ে মিস্টি রঙের শাড়ী পড়িয়ে ঘরের মধ্যে বসে আসে ইয়া। পাড়ার বান্ধবীরা ইয়াকে ঘিড়ে বসে আছে। মজা করছে। ইয়ার গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নানা রকম ঠাট্টা করছে। ইয়া চুপ হয়ে সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছে।
শরীফের কথা মনে পড়ছে ভীষণভাবে। গতরাতে ঘন্টাখানেক কথা হয়েছে মোবাইল ফোনে। শরীফেরও মন খারাপ। কেউ কাউকে কোন কিছু বলতে পারেনি শেষ কথাতেও। আকাড়ে ইঙ্গিতে মানসিক কষ্টের কথা বলেছে ইয়া। আজকে বরপক্ষের লোকজন দেখতে আসবে। কথা আগেই ঠিকঠাক হয়েছে। সম্ভবত দেখাদেখির বৈঠকেই বিয়েও পার করবে তারা। আমার পরিবারও রাজি। শরীফকে আমন্ত্রণ করে ইয়া। তবে আসতে নিষেধ করে। শরীফকে বলে দেয় তুমি আসলে হয়তো আমি বরের বাড়িতে যেতে পারবো না। তোমাকে ফেলে আমি হয়তো গাড়ীতেও উঠতে পারবো না। দয়া করে তুমি আমার বিয়েতে এসো না।

শরীফ সব বুঝেছে। কিন্তু শেষ সময়ে কিছুই করার নেই তার। ইয়া অনেক কেঁদেছে ফোনে। বিয়েটা ভেঙ্গে দিলে তার বাবার সম্মানহানী হবে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ইয়া চুপ হয়ে আছে। মনের মধ্যে পুষিয়ে রাখা স্বপ্নটা ভেঙ্গে যেতে বসেছে। উপায় বের করার হাজারো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। শরীফকে কোন দিন ভালোলাগার কথাটা বলতে পারেনি। আবেগ অনুভূতিগুলো কেবলি বাতাসে উড়িয়েছে। ফেসবুকে যত্নকরে লেখা আদান প্রদানগুলো এখন ইয়ার সামনে স্মৃতি হয়ে ভেসে উঠছে। সময় পেলেই ভিডিও কলে কথা বলা আর হয়তো হবে না। ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে বসে বাদাম আইসক্রীম কোনটাই হয়তো এক সাথে খাওয়া হবে না। এসব ভাবতে দম বন্ধ হয়ে আসছে ইয়ার। ফুফিয়ে কাঁদছে। দুই হাটুর নিচে মাথা দিয়ে অঝরে চোখের পানি ঝরাচ্ছে ইয়া। বান্ধবীরা গায়ে হাত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মনের অবস্থার পরিবর্তন কোন ভাবেই আনতে পারছে না ইয়া।

শরীফও শহরের বাসায় ছটফট করে সময় পার করছে। বারবার মুঠোফোনের দিকে তাকাচ্ছে। ফোন আসছে না। সকাল থেকে একবারও ইয়ার ফোন আসেনি। অথচ এতোক্ষণে কতবার যে ক্ষণেক্ষণে ফোন আসতো, কথা হতো তার ঠিক নেই। মনটা বিষন্নতায় মলিন হয়ে উঠছে। হাজারো ভাবনা ভর করছে শরীফের মাথায়। কুলকিনারাহীন ভাবনা। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সমাধাণ নেই। ইয়ার সাথে বন্ধুত্বের স্মৃতিগুলো কেবলি ঘুরপাক খাচ্ছে। কোথায় যেন দুর্বল হয়ে আছে শরীফের মন। ভালোলাগার কথা একটি বারও কেউ মুখ খুলে বলেনি। দুজনের মধ্যে অন্যভাবে ভাবের বিনিময় হয়েছে। পরস্পরকে ভালোভাবে জেনেছে। ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এর বাইরে কেউ কিছু প্রকাশ করেনি। অথচ আজকের দিনে ইয়া এবং শরীফ দুজনেই অজানা শোকে কাতর হয়ে পড়েছে। শরীফ হাজারো ভাবনা মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বাইরে যায়। শহরের রাস্তায় বাইক নিয়ে গন্তব্যহীন পথ চলে। মনটাকে ফ্রেস করার চেষ্টা করে। হয় না। আরো অস্থির হয়ে ওঠে। শহরের বাইরে ফাঁকা রাস্তায় বাইক থামায় শরীফ। ছোট্ট একটি পাকুর গাছ। ছাতার মত ছায়া দিচ্ছে সড়কে। সেই ছায়ায় বসে পড়ে শরীফ। পকেট থেকে ফোন বের করে। ইয়ার নম্বরে কল দেয়। দু:খিত শব্দ ভেসে আসে ওপাশ থেকে। ইয়ার ফোন বন্ধ। মাথা কাজ করে না শরীফের। আবারো ফোন দেয়। নাহ। ফোন বন্ধ। রাস্তার পাশে চুপ করে বসে থাকে শরীফ। দুপুরের সূর্য পশ্চিমে গড়িয়ে বিকেল হয়। শরীফ উঠে না। বসে থাকে। ফোনের দিকে তাকায়। ফোন আসে না।

পাঁচটা বাজার ঠিক দুই মিনিট আগে শরীফের ফোন বেজে ওঠে। তড়িঘড়ি করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে। স্ক্রীনে ভেসে উঠছে ইয়ার মুখ। আনন্দে চোখ মুখ নিমিষেই ঝলমলে হয়ে ওঠে। ফোন রিসিভ হয়। অস্পষ্ট কণ্ঠ ভেসে আসে ওপাশ থেকে। বর পক্ষ এসেছে। আমাকে দেখার পালা শেষে করেছে। তারা আজ রাতেই বিয়ের কাজ সারতে চায়। সেভাবেই তারা এসেছে। আমি মনে হয় আর তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না। এই বলে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়ে ইয়া। আর কথা বলতে পারে না। ঘর ভর্তি মানুষ। ইয়াকে ঘিরে রেখেছে। সেখান থেকে একটু আড়ালে গিয়ে ফোন চালু করে শরীফকে ফোন দিয়েছে ইয়া। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা আছে। মাত্র দুই মিনিট সংযোগ ছিলো। শরীফের শরীরও বরফ হয়ে যায় ইয়ার কাঁন্নায়।
মাগরিব গড়িয়ে যায়। বিয়ের আয়োজন চলে। কাজি এসে উপস্থিত হয়েছে একটু আগে। মসজিদের ইমামও হাজির। পরশিদের উপস্থিতি ইয়াদের বাড়ির আঙ্গিনা টইটম্বুর। রাত গভীর হওয়ার আগেই আয়োজন শেষ করার তাগিদ দেয় বর পক্ষের কর্তারা। ইয়ার বাবাও নতুন অতিথিদের কথামত সব কাজ দ্রুত করছেন।

ইয়ার ফোন কেটে যাওয়ার পর শরীফ শহর থেকে রওনা দেয় ইয়াদের বাড়ির দিকে। পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ। বেপরোয়া গতিতে বাইক চালায় শরীফ। রাত নেমে আসে রাস্তায়। মাঝপথ পাড় হয়ে ইয়াদের বাড়ির ব্যবধান আরো কমে আসে। আনমনা শরীফ। কিছুই ভালোলাগছে না। সড়কে মনোযোগ নেই। বাইকের গতি নম্বই কিলোমিটার। সামনে বাঁক। শরীফ বুঝে ওঠার আগেই অপর দিক থেকে আসা মিনিট্রাকের মুখোমুখি হয়। হার্ড ব্রেক করে। কিন্তু কাজ হয়না। ট্রাকের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে শরীফ। মাথার মগজ বেরিয়ে যায়। ট্রাক দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। শরীফের দেহ পড়ে থাকে রাস্তার পাশে। নিথর দেহ। পথচারিরা উদ্ধার করে মৃত শরীফকে।
ইয়ার তখন কবুল শেষ। বিদায়ের পর্ব চলছে। মায়ের গলা জড়িয়ে কাঁদছে ইয়া। বরের হাতে মেয়ের হাত এক দিয়ে বিদায় জানায় ইয়ার মা। তার চোখেও পানি। বাবা আড়ালে চোখ মুছছে। মেয়েকে চোখের পানি দেখতে দিচ্ছে না। গুটিগুটি পায়ে ইয়া গাড়ির দিকে যায়। বরের পাশের সিটে বসে পড়ে। একটু পরে মাইক্রোর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। চাকা ঘুড়তে থাকে। সাদা গ্লাসের জানালা দিয়ে ঝাপসা চোখে ইয়া বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। গাড়ির গতি বারে। আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় আলোঝলমলে বাড়িটা। পরের দিন ভোর হয়। নতুন বাড়িতে ইয়া। সবাই ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই ইয়া বিছানা ছাড়ে। রাতে মোটেও ঘুমায় নি ইয়া। আস্তে করে ফোন চালু করে। শরীফের ফোনে কাল দেয়। বন্ধ। নেট অন করে। সেখানেও নেই। একটু পড়ে ফেসবুকে ভেসে আসে শরীফের ছবি। ক্ষত-বিক্ষত দেহ। মৃত শরীফ। ইয়া আতকে উঠে। বিশ^াস হচ্ছে না। আবারো ভালো করে দেখে। এটিই শরীফ। শোকাহত বন্ধুরা পোস্ট দিয়েছে ফেসবুকে। ইয়া কষ্টের দুমরে মুছরে যায়। তার ভালোবাসার দীঘির জ¦লে আগুন জ¦লে ওঠে। অঝরে কাঁদতে থাকে ইয়া। নি:শব্দে।

প্রতীক ওমর
কবিও সাংবাদিক। ০১৭১৭৮৫২৬৮২ [email protected]





















মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.