![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রতীক ওমর
তখন প্লে-নার্সারি ছিলো না। ছোট ওয়ান বড় ওয়ান ছিলো। গ্রামের স্কুল টিন সেডের ছিলো। বিল্ডং খুব কমই চোখে পড়তো। ওয়ানের জন্য স্কুলের কক্ষ বরাদ্দ থাকলেও ছোট ওয়ানের জন্য কোন কক্ষ বরাদ্দ ছিলোনা। নব্বই সালের কথা। আমি আব্বার হাতধরে সবেমাত্র স্কুলের যাতায়াত করি। আব্বা তখন সাঘাটা উপজেলার বটতলাবাজারের কমলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। দশটার মধ্যে স্কুলে যেতাম। আগেই বলেছি শ্রেণি কক্ষ বরাদ্দ ছিলো না ছোট ওয়ানের জন্য। বিশাল বটগাছের নিচে গোল হয়ে বসে নামতা পড়তাম। একের পিঠে এক দিলে এগারো হয়, এগারোর এক নামে হাতে এক রয়। একের পিঠে দুই দিলে বারো হয়, বারোর দুই নামে হাতে দুই রয়। বিমল স্যার এভাবে অংক শেখাতেন। তিনি অনেক আগেই দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছেন আব্বাও।
আমাদের প্রাইমারি স্কুল আর মথরপড়া উচ্চবিদ্যালয় (তখন নিম্নমাধ্যমিক ছিলো) একই মাঠের এপাশ ও পাশ। দুই স্কুলের একই মাঠ। আমাদের স্কুলের ঘন্টা ছিলো রেলাইনের এক টুকরো অংশ। আর মথরপড়া উচ্চবিদ্যালয়ের ঘন্টা ছিলো পিতলে গোল থালার মত। আমাদের স্কুলের ঘন্টা বাজাতো শিক্ষার্থীদের কেউ অথবা স্যারদের কেউ একজন। কারণ তখন প্রাইমারিতে দপ্তরি ছিলো না। পাশের স্কুলের দপ্তরি ছিলেন মন্টু দা। এলাকার সবাই তাকে মন্টু দা বলেই চিনতো। তিনি ওই স্কুলের দপ্তরি থাকাকালীন শতশত শিক্ষার্থী ওই স্কুলে পড়া লেখা করে বেরিয়ে গেছেন। প্রতিবছরে নতুন শিক্ষার্থীর আগম ঘটেছে। সবাই মন্টু দাকে চিনেছেন। বছর বেড়েছে মন্টু দার পরিচিতিও বেড়েছে। ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন । অনেক বছর পরপর হয়তো তারা এলাকায় আসেন। মন্টু দার মত মানুষদের সাথে হয়তো দেখা হয়, হয়তো হয় না। সবাই নিজ নিজ জায়গায় ব্যস্ত। আমি যদিও ওই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম না, তারপরও মন্টু দাকে প্রতিদিন দেখেছি ঘন্টা বাজাতে। ছোট বেলার স্মৃতিগুলোর সাথে মন্টু দার ঘন্টার ধনি জড়িয়ে আছে। আমারো এখন এলাকায় যাওয়া হয় খুব কম। গেলেও অল্প সময়ের জন্য যাই। সবার সাথে তেমন সাক্ষাৎ হয় না। বহু বছর পর গেলো ২৯ ডিসেম্বর বটতলাবাজারে চায়ের দোকানে মন্টু দার দেখা। বিশ পচিশ বছর আগে যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমনটাই আছেন। চাদর মুড়ি দিয়ে স্টলের ব্রেঞ্চে বসে। তাকে বললাম মন্টু দা নাকি? উত্তর দিলেন হ্যা। জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন? ভালো আছেন উত্তর দিলেন। বললাম দাদা আমাকে চিনতে পেরেছেন? কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো হ্যা চিনতে পেরেছি। বহু দিন ধরে তোমাকে দেখি না। কোথায় কি করছি সেকথা জানতে চাইলেন দাদা। আমি বিস্তারিত বললাম। রঙ চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প হলো। দাদা বললেন অনেক দিন আগে চাকরি থেকে অবসর গেছেন। হঠাৎ করে পথ ঘাটে অনেকেই পিছন থেকে দাদা বলে ডাক দেয়। সাবাইকে সহজেই চিনতে পারি না। মথরপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দিলে তখন ঠাওর করতে পারি। মেয়েদের একেবারেই চিনতে পারি না। বিয়ের পর মেয়েদের চেহারা দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়। মন্টু বললেন একদিন এলাকা থেকে বেশ দূরে অন্য একটি এলাকায় কোন কাজের জন্য যাচ্ছিলাম। গ্রামের পথ দিয়ে। পথের মধ্যে একজন মহিলা দৌড়ে সামনে এসে দাদা বলে ডাক দেয়। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমাকে বলে দাদা দেখেনতো চিনতে পারেন কিনা? আমি বলি না। তখন মনখারাপ করে ওই মহিলা বলে দাদা আমি ওই গ্রামের মেয়ে এখানে বিয়ে হয়েছে। মথরপাড়ার ছাত্রী ছিলাম। আপনি না আমাকে তখন খুব করে চিনতেন? পরিচয় দেয়ার পর তাকে চিনতে পারেন দাদা। এমন অসংখ্য ভক্ত মন্টু দার রয়েছেন। যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন রিজিকের সন্ধ্যানে। দাদা বলেন এইযে তোমরা এখনো আমাকে মনে রেখেছো, দেখা হলে দাদা বলে ডাকো এতেই আমার আত্মা জুড়িয়ে যায়। মনটা ভরে যায়। তোমাদের ভালোবাসা নিয়েই বাঁচতে চাই।
এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলছিলো। তখনো পাঁচ ছয়টা কেন্দ্র পরিদর্শন বাকি। গল্পের ইতিটেনে দাদার কাছে বিদায় নিয়ে পথে নামি পেশাগত দায়িত্বপালনের জন্য।
©somewhere in net ltd.