নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খোলাকথা

প্রতীক ওমর

কবি ও সাংবাদিক

প্রতীক ওমর › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাহায্য চাইতে সাদ্দামের মিথ্যার আশ্রয়! কিন্তু কেন?

০৮ ই জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১:২৭

প্রতীক ওমর:
ঠান্ডায় জুবুথুবু শহর। শৈত্যপ্রবাহ চলছে। রাত নয়টা। রাস্তারধারে দাঁড়িয়ে শহুরে মানুষ চয়ের কাপে চুমু দিচ্ছে। ভীর নেই। স্বাভাবিক শহর। পিছন থেকে একটি ছেলের টোকা। ফিরে তাকিয়ে দেখি হাতে ছবি নিয়ে সাহায্যের হাত পেতে আছে ছেলেটি। বয়স ১১ কি ১২ হবে। নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় সাদ্দাম তার নাম। গ্রামের বাড়ি সুখানপুকুর নতুন পাড়া। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মধ্যে। বাবা মারা গেছে কিছু দিন আগে। বোনের ছবি ল্যামিনেশন বাঁধাই করা। নিচে লেখা তার দুটি কিডনি নষ্ট। চিকিৎসার জন্য সাহায্য করুন। বোনের নাম শাকিলা। মলিন চেহারার সাদ্দাম। এখনো শিশু। ঠিকমত কথা উপস্থাপন এখনো আয়ত্বে আসেনি। সরাসরি পথচারিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি দেখিয়ে টাকা চায়। কেউ দেয় আবার কেউ দেয় না। মিনিট পাঁচেক কথা হয় সাদ্দামের সাথে। একই কথা। বোনের কিডনি নষ্ট। চিকিৎসা করতে টাকা প্রয়োজন। হাসপাতালের অধিনে চিকিৎসা চলছে। বাবা নেই। মারা গেছেন। কষ্টের সংসারে হাবুডুবু খাচ্ছে মাসহ পরিবারের সদস্যরা। সন্ধ্যার আগে তাদের রেল স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা একটি লোকাল ট্রেনে বগুড়া শহরে আসে সাদ্দাম। হাত বাড়িয়ে শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ায়। সাড়ে দশটার পর সিএনজিতে ফিরে যায় বাড়ি। এভাবেই সপ্তাহে তিন চার দিন শহরে এসে টাকা কালেকশন করে। কথা বলার ফাঁকে পকেট থেকে ১০০ টাকার একটি নোট বের করে হাতে দেই। সাদ্দামের কাছে ওদের পরিবারের মোবাইল ফোন নম্বর চাইলে সে বলে তাদের কেউ ফোন ব্যবহার করে না। পকেট থেকে তখন ভিজিটিং কার্ড বের করে সাদ্দামকে তাদের এলাকার যে কারো ফোন থেকে কথা বলতে বলি। উদ্দেশ্য সাদ্দামের কথাগুলোকে যাচাই করা। সে মিথ্যে বলছে না সত্য বলছে সেটি জানার জন্য এলাকার যে কারো সাথে কথা বলা প্রয়োজন। যদি সত্যি বলে থাকে তাহলে সাদ্দামকে নিয়ে একটা মানবিক স্টোরি লিখবো। ওদের আরো কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করবো। এমন উদ্দেশ্য নিয়েই ওর সাথে এতোক্ষণ সময় দেয়া। মোবাইল ক্যামেরায় একটা ছবিও তুলে রাখলাম। ভিডিও ক্লিপে ওর সাক্ষাৎকার ধারণ করলাম। এরপর সাদ্দাম চলে যায়। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমু দেয়া মানুষদের কাছে টাকা চাইতে চাইতে সামনের দিকে পা বাড়ায়। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকানো সাদ্দামের দিকে চোখ পড়লেই মন গলে যাবে বেশির ভাগ মানুষের। কমবেশি সবাই দুই চার টাকা ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। দৃষ্টির আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত সাদ্দামের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে কোন ভনিতা চোখে পড়েনি। তবুও সন্দেহ হলো। আসলেইকি ওর বোনের কিডনি নষ্ট? আসলেই কি সাদ্দামের বাবা বেঁচে নেই? সেকি সত্যি কথা বলছে? এমন সন্দেহ দূর করার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম ফোনের। পর দিন সকালে ফোন দেয়ার কথা। না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো। কোন ফোন আসলো না। মনে মনে ধরেই নিলাম হয়তো পরিবার থেকে সাদ্দামকে মিথ্যেকথা শিখিয়ে রাস্তায় নামিয়েছে। অভাব আছে ঠিক, হয়তো বোনের কোন অসুখ নেই। মানুষের সিমফিতি নেয়ার জন্যই হয়তো সাদ্দামের হাতে বোনের ছবি ধরে দেয়া হয়েছে।
ফোন না পেলে সাদ্দামের ঠিকানা অনুযায়ী ওদের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক করলাম। এক দুই দিনের মধ্যেই যাবো। মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে সাদ্দামের চেহারা। দিনে শেষে সন্ধ্যা নামে। একটু পরেই মাগরিবের আজান হবে। এমন সময় অপরিচিত একটা নম্বরে ফোন আসে। রিসিভ করতেই ওপার থেকে ভেসে আসে সাদ্দামের কণ্ঠ। আমি সাদ্দাম বলছি। গত রাতে সাতমাথায় আপনার সাথে কথা হয়েছিলো। আপনি ফোন দিতে বলেছিলাম। আমি সাদ্দামকে সহজেই চিনতে পারলাম। ওকে ফোনের মালিককে ফোন টি দিতে বললাম। একজন দোকানী। আব্দুল কাদের। সুখানপুকুর বাজারে তার দোকান। আমার পরিচয় আব্দুল কাদেরকে জানালাম। এরপর আব্দুল কাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম সাদ্দামকে চেনেন কিনা? তিনি বললেন সেভাবে চিনি না, তবে মাঝেমধ্যে সাহায্যের জন্য দোকানে আসে। আমার সাধ্য অনুযায়ী তাকে সাহায্য করি। সেই সুবাদে চেহারায় চিনি। বিস্তারিত কিছুই জানি না। সাদ্দামের দেয়া তথ্যগুলো সঠিক কিনা খোঁজ নেয়ার জন্য আব্দুল কাদেরকে অনুরোধ করলাম। তিনি ঘন্টাখানেক সময় চাইলেন বিস্তারিত জানানোর জন্য। আবারো অপেক্ষায় থাকলাম। সময় মত আব্দুল কাদেরের আবারো ফোন। তিনি জানালেন সাদ্দামের বাবা মারাগেছেন ঠিক আছে কিন্তু বোনের কিডনির কোন সমস্যা নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর সাদ্দামের মা আবারো বিয়ে করেছেন। সেই পক্ষের বাবার সাথেই ওরা থাকে। আব্দুল কাদের আরো জানান, সাদ্দামের বোনের কোন অসুখ না থাকলেও পরিবারে অভাব আছে। আব্দুল কাদেরের দেয়া তথ্য পেয়ে পুরো বিষয়টা খোলাসা হয়ে গেলো।
সাহায্য চাইতে এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া অভাবির সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বিত্তবানদের দানের হাত গুটিয়ে নেয়া, সামাজিক অবস্থার অবক্ষয় নাকি সামগ্রিক অভাব বৃদ্ধি এর পিছনে কারণ? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যপক মোস্তফা কামাল সরকারের সাথে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধিপায় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সামগ্রিক আচার আচরণের উপর নির্ভর করে। আমাদের এখানে উচ্চবিত্তদের দান খয়রাতের হাত খুবই দুর্বল। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের চিন্তার জায়গাগুলো আলাদা হয়ে গেছে। তারা সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে ধনি হওয়ার চিন্তায় মগ্ন হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে তারা যে পন্থায় ধনি হওয়ার চেষ্টা করছে সেই পন্থা নীতি নৈতিকার মাধ্যমে নাকি নীতিহীনভাবে করছে সেই ভাবনার ধারের কাছেও তারা যাচ্ছে না। তিনি উদাহরণ হিসেবে রিক্স, অটোচালকদের কথা উল্লেখ করেন। তারা মেঘের গর্জন শুনলেও দশ টাকার ভাড়া বাড়িয়ে বিশ টাকা চায় আবার একটু রোদ বেশি হলেও ভাড়া দ্বিগুন চেয়ে বসে থাকে। এটা খুবই নীতিহীন কাজ। তিনি নীতিহীন কাজ করছেন তার আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখে। কারণ আমরা কমবেশি এখন সবাই নীতিহীন হয়ে উঠেছি। অধ্যপক মোস্তফা কামাল সরকার আরো বলেন, বাজারে যেদিন মাছের আমদানী বেশি হয় সেদিন মাছ ব্যবসায়ীরা তাদের কেনা দামের চেয়ে কম টাকায় বিক্রি করতে বাধ্যহন। আমরা কিন্তু তখন দেখি না ওই ব্যবসায়ী লোকসান দিয়ে মাছ বিক্রি করলো। আমরা কমদামে কিনে জেতার উল্লাসে মেতে উঠি। এটাও একটা নীতিহীন কাজ করেবসি আমরা। সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে মিথ্যা ছেয়ে গেছে। কেউ কারো কথা বিশ্বাস করতে পারিনা। সাদ্দাম আসলেই গরীব অসহায় একটি শিশু। তার বোনের কিডনির সমস্যা হয়নি। কিন্তু মিথ্যে না বললে হয়তো কেউ তাকে সাহায্য করবে না, এজন্যই সে ওইটুকু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। রাষ্ট্রকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনার মাধ্যেমে ওই ইয়াতিম শিশুর দায়িত্ব নেয়ার কথা থাকলেও কোন কারণে নিতে পারেনি। তাকেতো জীবন জীবিকা চালাতে হবে। সে অনেকটা বাধ্য হয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছে দারেদারে। অপর দিকে আরেক শ্রেণির মানুষ আছে তারা ধনি হওয়ার জন্যই মিথ্যা বলে মানুষের কাছে হাত পাতে। কিছুদিন আগে এক কোটিপতির খবর কমবেশি সবাই জেনেছে। মায়ের ক্যান্সারের মিথ্যা গল্প সাজিয়ে দানের টাকায় সে এখন কোটিপতি। সামাজিকভাবে হেয় হলেও ধনি হওয়ার নেশা তাকে নীতিহীন করে তুলেছে। সামগ্রিকভাবে পুরো সমাজকেই এমন পরিস্থির জন্য দায়ী করেন ওই সমাজগবেষক।  

০৮.০১.২০২৩
প্রতীক ওমর, বগুড়া
০১৭১৭৮৫২৬৮২ 

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.