নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খোলাকথা

প্রতীক ওমর

কবি ও সাংবাদিক

প্রতীক ওমর › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্কুলে যায় না, ক্ষ্যাপে যায় ওয়াজকুরুনী

১৯ শে জানুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৫:১১

প্রতীক ওমর:
সূর্য ওঠার আগেই বিছানা ছাড়তে হয়। চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘুমের ভাব দূর করে। রাতের বেচে যাওয়া ঠাণ্ডা ভাত তড়িঘড়ি মুখে দেয়। খাওয়া শেষে হাত মুছতে মুছতে ঘরের বাইরে চলে আসে। উঠোনের একপাশের গোয়াল ঘর থেকে গরু আর ছাগল বের করে বাইরে আনে। খড় খেতে দেয়। তারপর ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ে যমুনার ঘাটে। শীত কিংবা গরম একই নিয়মে চলে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার বানিয়াপাড়া চরের উজ্জ্বল মণ্ডলের ছেলে ওয়াজকুরুনী। বয়স ১২ অথবা ১৩ হবে।
পিতা জমিতে কাজ করেন। ফসল ফলান। সংসার দেখাশোনা করেন। ওয়াজকুরুনী পালের ঘোড়া নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন চরের দুর্গম পথে। যমুনার পশ্চিম তীরের শহর থেকে নিয়ে আসা ভারী পণ্য ঘাট থেকে ঘোড়ার পিঠে নিয়ে বিভিন্ন চরে পৌঁছে দেয় ওয়াজকুরুনী। দিনভর কাজ করে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পকেটে ঢোকে। সন্ধ্যা নামার আগেই নদীতে গোসল দিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফেরে। মাসখানেক আগে নৌকাযোগে সারিয়াকান্দির ডাকাতমারী এলাকায় নেমে বালির পথে হাঁটছিলাম। একটি গুচ্ছগ্রাম দেখার জন্য। সেখানকার বাসিন্দাদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। ঘাট থেকে মিনিট চল্লিশেক হাঁটার পর ওই গ্রামের দেখা মেলে। সেখানে ঘণ্টা তিনেক সময় কাটিয়ে ফেরার পথে বানিয়াপাড়া চরে দেখা হয় ওয়াজকুরুনীর সঙ্গে। তখন পড়ন্ত বিকাল। ঘোড়া এবং ওয়াজকুরুনী নদীর শান্ত পানিতে গোসল সেরে মাত্র উঠে এসেছে। ঘোড়ার দড়ি হাতে নিয়ে জমির ধার দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসছে। ঘোড়া ক্লান্ত। ক্লান্ত ওয়াজকুরুনীও। ওদের পথ দিয়ে আমিও ফিরছি ঘাটে। দেখছি ঘোড়ার সঙ্গে ওয়াজকুরুনীর মিতালী। মনের কথা একে অপরে বুঝতে পারে। দুই বন্ধু হাত ধরে গল্প করতে করতে পথ চলার মতো দৃশ্য।
কাছে আসতেই থামিয়ে দেই ওয়াজকুরুনীকে। কথা বলতে চাই। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে ওয়াজকুরুনী রাজি হয়। নাম জিজ্ঞেস করি। বাড়ি কোথায়? ওয়াজকুরুনী সব বলে দেয়। স্কুল সময়ে ঘোড়া নিয়ে রাস্তায় কেন জানতে চাইলে ওয়াজকুরুনী বলে, আমি স্কুলে যাই না, ক্ষ্যাপে যাই। স্কুল, পড়ালেখা আমার ভালোলাগে না। সকালে ঘোড়া নিয়ে নদীর ঘাটে যাই। সেখান থেকে বিভিন্ন চরে মালামাল বহন করি। যেদিন ঘোড়া নিয়ে বাহির হই না সেদিন বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করি। কাজ করতেই আমার ভালোলাগে। দিন গেলে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পাই। মায়ের হাতে টাকাগুলো তুলে দেই। মা খুশি হয়। সংসারের উন্নতির জন্য কাজে লাগে। পড়ালেখা করলে জীবনকে অনেক ভালোভাবে উপভোগ করা যায়, তোমার কি এমন জীবন উপভোগের ইচ্ছে করে না? উত্তরে ওয়াজকুরুনী বলে, না। আমি এভাবেই ভালো আছি। পড়ালেখা করে ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না। নিজের মানুষ থাকতে হয়। আমার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকেই পড়ালেখা করে বেকার হয়ে বসে আছে।
পরিবারের বোঝা এখন তারা। আমি কিন্তু কমবেশি রোজগার করছি। তাছাড়া আমাদের মতো গরিব মানুষদের পড়ালেখার সুযোগটাই বা কোথায়? আমাদের চরে ভালো স্কুল একটিও নেই। কিছু স্কুল আছে সেখানে নিয়মিত শিক্ষকের দেখা মেলে না। শহরে গিয়ে কীভাবে পড়ালেখা করবো বলেন? আমাদের মতো দুর্গম চরের শিশুরা কোথায় শিখবে? ছোট্ট ওয়াজকুরুনীর কথায় উঠে আসে বর্তমান সমাজব্যবস্থার চিত্র। চরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ন্যায্য অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের জীবন মানের পরিবর্তন আজও দেখা যায় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান কোনো কিছুতেই তাদের রাষ্ট্রীয় সুবিধা চোখে পড়ার মতো নয়। শরীর রক্ত পানি করে তারা বালির জমিতে নানা রকম ফসল ফলায়। তাদের সেই ফসলের ন্যায্যমূল্যটুকুও দেয়া হয় না। রাস্তা ঘাটের দুরবস্থার কারণে সহজে বহন করে শহুরে হাটেও নিতে পারে না তাদের কৃষিপণ্য। ফলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের কবলে কমদামে এসব পণ্য বিক্রি করতে হয়। এক কথায় তাদের দেখার কেউ নেই।
তাদের পাশেও কেউ নেই। নিজেদের মতো করেই চরের মানুষগুলো বেঁচে আছেন। স্থানীয় কর্ণিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন দীপন বলেন, চরের মানুষরা তাদের নাগরিক সুবিধাগুলো থেকে বরাবরেই বঞ্চিত। কোনোভাবেই তারা এগোতে পারছে না। তাদের শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ সেভাবে কাজ করছে না। ফলে চরের মানুষদের মনোভাব এমন হয়েছে যে, ঘরের একটি শিশুকে লেখাপড়া শিখে মানুষ করার চেয়ে একটি গরু কিংবা ছাগলকে যত্ন করে বড় করাই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গবাদি পশু লালন-পালনে তাদের অর্থের সংকট দূর হয়। সেই চিন্তা থেকেই তারা সন্তান মানুষ না করে গবাদি পশুপালনে মনোযোগ দেয়। আর সন্তানরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এসব কাজ শিখে নেয়। এভাবেই চরের মানুষরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম জীবনযুদ্ধে পরাজয় বরণ করে আজও টিকে আছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.