নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খোলাকথা

প্রতীক ওমর

কবি ও সাংবাদিক

প্রতীক ওমর › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন নাজিম স্যার ও রাস্ট্রিয় যাতাকল

০১ লা ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:২০

প্রতীক ওমর

টুং শব্দে হোয়াটসঅ্যাপে নোটিফিকেশন বেজে উঠলো। মুঠোফোনটি জিন্স প্যান্টের খাড়া পকেটে। শব্দ অনূভূত হওয়ার সাথে সাথে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনটি বের করি। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ভেসে উঠে একটি ছবি। অসুস্থ্য মানুষ। স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে আদালতের বাড়ান্দায় হাটছেন। শামীম নামের একজন দর্শনার্থী ছবিটি ফোন ক্যামেরায় ধারণ করে পাঠান। তিনি ছবির নিচে দুই লাইনে লিখে দিলেন একজন বর্ষিয়ান নেতা প্যারালাস্ট হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসা চলছি। এর মধ্যেই রাজনৈতিক মামলার তারিখ এসে যায়। তিনি চিকিৎসারত অবস্থায় চলে আসেন হাজিরা দিতে। স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন আদালাতের সাত তলায়। সহযোদ্ধারা বলেছিলেন পিটিশন দিতে। কিন্তু পিটিশন দিলে মামলার দেখাশোনা করা ছেলেদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হয় বিধায় তিনি কষ্ট করে হাজিরা দিতে এসেছেন। তার জন্য কেউ ঝামেলা পোহাক সেটি তিনি চাননা। ছবিটা দেখে বুকের মধ্যে একটা নাড়া দিয়ে উঠলো। বৃদ্ধ বয়সে একজন সম্মানিত মানুষ কতভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। রাস্ট্র ক্ষমতাধরদের মতের বাইরে রাজনীতি করাই তার অপরাধ। কপালে জুটেছে ৪২টি মামলা। সপ্তাহের কোন না কোন দিন তাকে এভাবেই আদালতের সিঁড়ি বেয়ে কখনো সাত তলা, কখনো পাঁচতলায় ওঠানাম করতে হয়। রাস্ট্রিয় যাতাকলে পিষ্ট হয়েও সত্যেও পথ থেকে বিন্দুমাত্র সরেননি। তার নাম অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন। নাজিম স্যার বলেই সবাই সম্ভোধন করেন, ডাকেন। রাজনীতি করেন অথবা রাজনীতি প্রত্যক্ষ করেন এমন মানুষতো বটেই সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক পরিচিত ওই বর্ষিয়মান রাজনীতিকে। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বগুড়া জেলা পূর্ব’র আমীর।
তার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হলো খুব। তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে দু’কলম লিখলে মনটা শান্তি পাবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম বেশ অসুস্থ্য। কথা বলার শক্তি নেই। মনটা খারপ হয়ে গেলে। সুস্থ্যতার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। প্যারালাইজড হয়ে শরীরের এক পাশ অবশ হয়েছে।
সপ্তাহখানেক আগে বগুড়া শহরের মফিজ পাগলার মোড়ে একটি থেরাপি সেন্টারে নিজের সেবা নেয়ার জন্যই যাই। বাইক দুর্ঘটনায় মাস পাচেক আগে আহত হয়েছিলাম। ডান পায়ের হটু বরাবর আঘাতটা আজো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। ডাক্তারের পরামর্শেই সেখানে থেরাপি নিতে যাই। মাগরিব শেষে থেরাপি রুমের বেডে শুয়ে পড়েছি। থেরাপি চলছে। এর কিছুক্ষণ পরেই স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে স্ত্রীর সহযোগিতায় নাজিম স্যারের প্রবেশ। আমি বিছানা থেকে নেমে স্যারকে ধরে বিছানায় শুয়ে দিতে সাহায্য করলাম। স্যার আমাকে চেনেন না। আমি পরিচয় দিলাম। মানবজমিনের সাংবাদিক আমি। স্যারের মাথার পাশে প্লাস্টিকের একটি টুলে বসলাম। তার শরীরের খোঁজ নিলাম। কথা বলার চেষ্টা করলাম। বললাম স্যার আপনার একটা ছবি সেদিন একজন আদালতের বারান্দা থেকে তুলে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে ছবিটা দেখতে চাইলেন। বললাম স্যার এই শরীর নিয়ে কেন আপনি সেদিন আদালতে গিয়েছিলেন? তিনি উত্তরে বললেন, আমাদের মামলা দেখাশোনার জন্য দলীয় ছেলেরা অনেক পরিশ্রম করে। আমি যদি হাজিরা না দেই তাহলে ওই ছেলেদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। সেজন্যই কষ্ট হলেও হাজিরা দিতে গিয়েছিলাম। খুব সহজ সরল উত্তর। তার জন্য কেউ কষ্ট পাক সেটি তিনি চান না কখনো। স্যারকে বললাম যদি একটু সময় দেন তাহলে আপনার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলতাম। তিনি বললেন কোন সমস্যা নেই আমি এখন কথা বলতে পারবো।
প্রথমেই জানতে চাইলাম আপনার নামে এখন মামলা কতগুলো। তিনি বললেন ৪২টি। তার মধ্যে ৪/৫টি মামলায় খালাস পেয়েছি। সেগুলো নিস্পত্তি হয়েছে। কি কারণে মামলার শিকার হলেন? স্যারের আবারো সহজ-সরল উত্তর, মানুষরে কল্যাণের জন্য রাজনীতি করি। দেশের, সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে চাই। দেশের রাস্ট্র ক্ষমতা অবৈধভাবে দখল করে আছে একটি দল তাদের অবৈধ গণবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। এজন্যই মামলা দিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখতে চায় তারা। দেশের এই ক্রন্তিকাল থেকে উত্তরণের পথ কী? কী ঘটতে পারে আগামীর বাংলাদেশে? স্যার বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর তোমরা সাংবাদিকরাই ভালো দিতে পারবা। তোমরা দেশের অনেক গভীরের বিষয় জানো। অনেক তথ্য থাকে তোমাদের কাছে। তারপর বলি দীর্ঘদিন কোন অবৈধ শাসক টিকতে পারে না। ঠিকে থাকতে পারে না। দেশের মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষা স্বাস্থ্য বাণিজ্য সব খাতেই আজ ধসে পড়তে বসেছে। এমন অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না। আমরা অপেক্ষা করছি ভালো কিছুর।
কথার ফাঁকে স্যার আরো বললেন, এই সরকারের মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই নির্যাতন পোহাতে হয়। কত পরিবারকে ধ্বংস করেছে, কত মানুষকে গুম, খুন করেছে এই সরকার সেই হিসাবও হয়তো কেউ রাখেনি। কত বাড়ির কর্তা আজ ঘর ছাড়া। স্ত্রী সন্তানদের মুখ দেখে না কতদিন। গ্রেপ্তার, গুমের ভয়ে বাড়ি ছাড়া। কত শিশু তাদের পিতার আদর বঞ্চিত হয়ে শোকে কাতরাচ্ছে। নীরবে কত মায়ের চোখের পানি ঝরছে। কত নারী তার স্বামীর চিন্তায় নির্ঘুম রাত পোহাচ্ছে সেই খোঁজও কেউ রাখে না। তবে সৃষ্টিকর্তা এসব অসহায়দের নীরব আর্তনাদ সহ্য করবেন না। আমরা আল্লাহর দিকে চেয়ে আছি। তার ফয়সালা দেখে যেতে চাই।
স্যারের কাছে তার শিক্ষা জীবন, কর্ম জীবন এবং রাজনৈতক জীবনের পুরো কাহিনী মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলাম।
১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বাজিত নগর গ্রামে অধ্যপক নাজিম উদ্দিন জন্ম গ্রহণ করেন। বাজিতনগর সরকারি প্রাথকিম বিদ্যালয় তার প্রথম শিক্ষালায়। এরপর বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলার সোনাতলা পাইলট উচ্চ বিদ্যাল থেকে ১৯৭০ সালে এসএসসি পাস করেন। তারপর তৎকালী রাজশাহী মহাবিদ্যালয় বর্তমান রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইংরেজি বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করে। এরপর মহিমাগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮১ সালে। একই বছর তিনি চলে যান সোনাতলার নাজিরা আখতার কলেজে। এরপর ১৯৮৪ সালে কলেজটি জাতীয়করণ হয়। তারপর ১৯৮৮ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে অধ্যপনা করেছেন। শেষে ২০১০ সালে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন ছাত্র রাজনীতি করেন না করেলও মূল রাজনীতিতে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই দায়িত্বশলী হয়ে যান। ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম জামায়তে ইসলামীর সহযোগী সদস্যপদ গ্রহণ করেন। এরপর রোকন শপথ নেন ১৯৮৪ সালে। তারপর ইউনিয়ন আমির, সোনাতলা থানা আমিরের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়ীত্বপালন করেন। এরপর ১৯৮৬ সালে বগুড়া জেলা জামায়াতের সেক্রেটারী হিসেবে ৫ বার দায়িত্বপালন করেন। বর্তমানে তিনি বগুড়া জেলা পূর্ব’র আমির হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। সেই সাথে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির শুরা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং দায়িত্বপালন করছেন।
অধ্যপক নাজিম উদ্দিনের মত নেতারা আজ রাস্ট্রিয় শক্তির কাছে অসহায় হয়ে আছেন। বাক স্বাধীনতা, নিজের অধিকার, সমাজের অধিকারের কথা বলা অঘোষিতভাবে নিষেধ। এমন নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়েও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে নাজিম উদ্দিন স্যারদের মত মহান নেতারা। রাস্ট্রিয় নির্যাতনকে উপেক্ষা করে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন অনেকে। সরকারের সমালোচনা, জনঅধিকার আদায়ের জন্য কথা বলায় জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে শহীদ করা হয়েছে। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে জেলের অন্ধকারে আবদ্ধ হয়ে আছেন। বর্তমান জামায়াতের বিরুদ্ধে সরকারে দেয়া মোট মামলা সংখ্যা ১৫ হাজার, আসামী সংখ্যা ৫ লাখ। বর্তমানে জেলে আছেন ৩৫০০। ঘরছাড়া ৫০ হাজার। শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা করাই এই মানুষগুলোর অপরাধ। দেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে কেউই আজ কথা বলতে পারছে না। নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত দেশের বেশিরভাগ মানুষ। নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক। কর্ম সংস্থান নেই। উদ্যোক্তাদের জন্য রাস্ট্রিয় সহযোগিতা নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও চলছে নানা ষড়যন্ত্র। কীভাবে চলবে বাংলাদেশের আগামীর দিনগুলো? সেই সংশয় দিনদিন সংকটাপন্ন হচ্ছে। দিশেহারা হয়ে পড়ছে আপামর জনতা। অস্ত যাওয়া সূর্য বাংলাদেশের আকাশে কবে উঠবে সেই প্রহর গুণছে এখন মানুষ।

প্রতীক ওমর, বগুড়া
০১৭১৭৮৫২৬৮২

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.