![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখনী আমার প্রতিবাদের ভাষা, ব্লগ আমার স্বপ্নবোনার জমিন, আমি এক স্বাপ্নিক চাষা
“আপনি বলতে চাইছেন, আপনার স্ত্রী আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাইছেন, কারণ আপনি তাঁকে বেশি ভালবাসেন?” ডাক্তার সাহেবের চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
আমি বললাম, “জ্বী”।
ডাক্তার সাহেব তাঁর চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখছেন। আমি একটু অবাক হলাম; চশমার ফাঁক দিয়ে যদি তিনি বেশি ভাল দেখেন, তাহলে চশমা পরা কেন? আমাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন। আমি নার্ভাস বোধ করছি। কেউ আমাকে নিরীক্ষণ করছেন, বিষয়টা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়।
এবার তিনি মুখ খুললেন, “আমি কিছু বুঝছি না, ভাই। ডিভোর্স সংক্রান্ত বিষয়ে আপনি আমার কাছে কেন? আপনার উকিল দরকার, সাইকিয়াট্রিস্ট নয়।”
আমি বললাম, “আপনাকে তো বলেছি, আমি ডিভোর্স চাই না। উকিলের কাছে গেলে তো সে ডিভোর্সটাকে সফলভাবে করিয়ে দেবার চেষ্টা করবে।”
“ভুল। উকিল চাইবে, বিষয়টা যেন দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে; আপনি এবং আপনার স্ত্রী বারবার যেন তার কাছে যান, এতেই তার ফায়দা।”
“আপনি হয়ত ঠিক বলেছেন।” আমি একটু সহজ হবার চেষ্টা করলাম, “কিন্তু আমি এর একটা সুন্দর সমাধান চাইছি।”
“আপনি আপনার স্ত্রীকে বেশি ভালবাসেন, তাই তিনি আপনাকে ডিভোর্স দিতে চান, এমন কারণ দেখালে তো ডিভোর্স হবে না। আপনি এত চিন্তা করছেন কেন?”
“দেখুন, আমার স্ত্রী যে উকিল ধরেছে, সে বিষয়টাকে এভাবে দেখাবে না। সে দেখাবে আমি আমার স্ত্রীকে নির্যাতন করি।”
“আপনি কি তা করেন?”
“অবশ্যই না। অবশ্য আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে বলে, আমি তাকে মেন্টাল টর্চার করি।”
“সেটা কী রকম?”
“যেমন ধরুন, গতকাল; গতকাল শুক্রবার ছিল; আমি ভেবেছিলাম সারাটা দিন ওর সাথে বাসায় কাটাব। ও বলল, ওর এক বান্ধবীর বাসায় নাকি ওর যাবার প্ল্যান। সেটা আমি কী করে অ্যালাউ করি?”
“আপনি তাঁকে যেতে দেননি। তাঁকে জোর করে বাসায় আটকে রেখেছেন, রাইট?”
“হ্যাঁ”
“ঠিকই আছে। স্ত্রী তার স্বামীকে বাসায় রেখে বান্ধবীর বাড়িতে ছুটি কাটাবে, এ কেমন কথা?”
“সেটাই…”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ডাক্তার সাহেব প্রশ্ন করলেন “আপনাদের বিয়েটা অটো, না ম্যানুয়াল?”
“বিয়ের আবার অটো-ম্যানুয়াল কী? এটা কি গাড়ি নাকি?”
“মানে, প্রেমের বিয়ে, নাকি অ্যারেঞ্জড?”
ডাক্তার সাহেব তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, জানালার কাছে একটা ছোট্ট তাকে একটা অ্যাশ-ট্রে আর একটা সিগারেট কেস। আমি প্রায়ই দেখি, ডাক্তাররা রোগীদেরকে ধূমপান করতে নিষেধ করেন, কিন্তু নিজেরা নেশাটা ছাড়তে পারেননা। এই মনোবিজ্ঞানীর দেখছি নিজের মনের ওপরেই নিয়ন্ত্রণ নেই। ডাক্তার সাহেব এবার জানালায় দাঁড়িয়ে আমাকে নিরীক্ষণ শুরু করলেন, দূর থেকে দেখা। দূর থেকে অনেক কিছু একটু বেশি দেখা যায় বোধহয়, অনেকটা ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শট-এর মতো। আমিও আমার মনের কামেরায় একটা ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শট নিয়ে আমার অতীতকে দেখতে লাগলাম এবং একটু গুছিয়ে ডাক্তার সাহেবকে বললাম, “আগেই বলেছি, আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হলো, সন্তান নিইনি এখনও। সোহানা আমার এক বছরের জুনিয়র। ভার্সিটি ভর্তি কোচিং-এ সে আমার ছাত্রী ছিল। পরবর্তীতে আমার ভার্সিটিতে আমারই ডিপার্টমেন্টে সে ভর্তি হয়; এবং লেখাপড়ার সুবিধার্থে ভার্সিটি জীবনের পুরোটাই সোহানা লাইব্রেরীতে আমার সাথে বসে পড়াশোনা করেছে। এক মাসের মাথায় আমি তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলাম; প্রেমে অবশ্য আমি সেই কোচিং-এ থাকতেই পড়েছিলাম, প্রস্তাব দিতে একটু সময় নিলাম…। এরপর দীর্ঘ ৪ বছর প্রেম; দু’জনের বাড়িতেই আমরা বিষয়টা সময়মতো জানিয়েছিলাম; তাই পাশ করে আমি একটা চাকরিতে ঢোকার প্রায় সাথে সাথে দুই পক্ষ আমাদের বিয়ে দিয়ে দিলেন। আমাদের প্রেম অসাধারণ কিছু ছিলনা, আর দশটা প্রেমের মতোই ঝগড়া, মান-অভিমান, খুনসুটি আর মধুময় প্রেম - সবই ছিল এই ৪ বছরে। দাম্পত্যও ছিল অম্ল-মধুর। প্রথম এক বছর যেহেতু সোহানা ছাত্রী ছিল, আমি তাই অফিস শেষে ছুটে যেতাম ভার্সিটিতে। ওকে নিয়ে খানিক রিক্সা ভ্রমণ করে তারপর বাসায় ফিরতাম। ফুচকা ছিল ওর প্রিয় স্ন্যাকস…
“একটু শর্ট করবেন প্লিজ?” আমার কথায় ছেদ দিলেন ডাক্তার সাহেব। আমি সময়ভ্রমণ ফেলে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম। আমি বললাম “আমার সেই প্রেম বিয়ের পর আরো বেড়েছে, ওর কমেছে…”
“আচ্ছা, আপনার কী কী কারণে মনে হয় যে, আপনার স্ত্রী আপনাকে আগের মতো ভালবাসেননা?”
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত। আমি কোনটা রেখে কোনটা বলব একটু গুছিয়ে নিলাম, “শুরু করা যায় বিয়ের পর থেকে, যখন ও পড়ত, আমি চাকরি করতাম। আমি সারাদিন অফিসে ছটফট করতাম কখন ওর কাছে যাব, কিন্তু ও একবারও আমাকে ফোন করে বলত না, এই, তাড়াতাড়ি এসো। এরপর বলা যায় বিয়ের পর ওর প্রথম জন্মদিনের ঘটনা, আমি সারা মাস ধরে এই দিনটির অপেক্ষা করেছি, প্রস্তুতি নিয়েছি, ওর সাথে সারা দিন কী কী করব, ওকে নিয়ে কোথায় খাব, কোথায় বেড়াব, কী কী উপহার দিয়ে ওকে চমকে দেব ইত্যাদি। কিন্তু সেদিন ওর একটা পরীক্ষা পড়ে গেল। পরীক্ষা দিয়ে ও যখন ক্যাম্পাসে এলো… আমি সেখানে অপেক্ষাতেই ছিলাম, ওর সাথে ছিল ওর প্রিয় বান্ধবী টুম্পা। সারা দিন টুম্পা আমাদের সাথে রইল, ওকে আমি আমার মতো করে পেলাম না, সেভাবে উদযাপন করতে পারলাম না যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম।”
এইটুকু শুনে ডাক্তার সাহেব বললেন, “আপনার স্ত্রী কি টুম্পাকে জোর করে রেখেছিলেন, নাকি টুম্পাই থেকে গিয়েছিল?”
“আসলে টুম্পা চলে যাবার কথা বলেনি, বরং আমাদেরকে ও খাইয়েছিল। টুম্পার বাবার গাড়িতে আমরা সারাদিন ঘুরলাম, মজা করলাম; কিন্তু আমার বিষয়টা পছন্দ হয়নি। আমি চেয়েছিলাম শুধু আমি আর সোহানা থাকব, একটা স্মরণীয় জন্মদিন ওকে উপহার দিতে চেয়েও পারলাম না।”
ডাক্তার সাহেব ভ্রুকুটি করলেন; আমি থামলাম। উনি ইশারা করলেন কথা চালিয়ে যেতে। টেবিলে রাখা জলের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আমি বর্ণনা করলাম এর পরের ঘটনা, “সেই রাতে আমি সোহানার সাথে ভীষণ ঝগড়া করেছিলাম। টুম্পাকে আমি এমনিতেই সহ্য করতে পারতামনা। মেয়েটা চালচলনে উড়নচন্ডি, স্বভাবে বাচাল, সবচেয়ে বড় কথা সোহানা ওকে ভীষণ ভালবাসে। হোস্টেলে ওরা তিন বছর রুমমেট ছিল এবং একে অপরের আত্মার অংশ। টুম্পার কারণে সোহানার সাথে আমার বিয়ের আগেও ঝগড়া হয়েছে টুম্পার সাথে বেশি আড্ডা দেওয়া নিয়ে এবং ওর সাথে যখন তখন ঘুরতে বের হওয়া নিয়ে। এবার আমি সব শোধ তুললাম। টুম্পাকে আমাদের বাসায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করলাম। আমার এই ঘোষণা সোহানা যেদিন টুম্পাকে জানালো, ওরা দুজনেই খুব কেঁদেছিল, ওদের আরেক বন্ধুর কাছে সে কথা জেনেছি। তবে সোহানা আমার কথা শুনেছিল। আর এই কারণেই ওদের এতদিনের গাঢ় বন্ধুত্বটা একদিনেই শেষ হয়ে যায়।”
ডাক্তার সাহেব এবার মুখ খুললেন, “অনীক সাহেব, আপনার গল্পটি কি ঠিক ট্র্যাকে আছে? নাকি অপ্রাসঙ্গিক কথা বেশি আসছে?”
আমি একটু লজ্জা পেলাম, “আচ্ছা, আমি রিসেন্ট ঘটনায় আসি, যে ঘটনার পর থেকে সোহানা আমাকে ডিভোর্স করতে চাইছে।”
“দ্যাটস বেটার” ডাক্তার সাহেবকে একটু খুশি মনে হল।
আমি এবার সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনার কথা বলি, “প্রখম ঘটনাটি গত বছরের। সোহানার বাবার দুর্নীতি নিয়ে পত্রিকায় একটা খবর প্রকাশিত হয় এবং এ নিয়ে আমার পরিবারকে আমাদের আত্মীয়মহলে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়। অবস্থা এতই খারাপ হয়ে যায় যে আমি একদিন সোহানাকে বললাম ওর বাবা যেন আর কখনও আমাদের বাসায় না আসেন। শুনে খুব আহত হয় সোহানা, সারারাত কাঁদে, আমি কঠিন থাকি। অনেক গঞ্জনা আমাকে শুনতে হয়েছে আমার আত্মীয়দের কাছে; আর নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি বলে আমি আর কারও দিকে আঙ্গুলও তুলতে পারছিলাম না। আমার সমস্ত মানসিক চাপ আমি চাপিয়ে দিলাম সোহানার উপর। সোহানা এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওর নাকি এমনটা আগেই মনে হয়েছিল যে ওর সাথে ওর পরিবারের বন্ধনও আমি একদিন ছিন্ন করার চেষ্টা করব, বিশেষ করে টুম্পার ব্যাপারে আমি কঠোর হওয়ার পর থেকে…। সোহানার মন এরপর বেশ কিছুদিন বিষন্ন ছিল, ও আমার বাবা-মার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। এবং আমাকে জানালো, তাহলে আমার বাবা-মাও আমাদের বাসায় আসতে পারবেনা। তখন আমি ওর কষ্ট কিছুটা অনুধাবন করলাম এবং ক্ষমা চাইলাম। কিন্তু এটা ওর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল, তা ওর আচরণে আমি বুঝতাম।”
ডাক্তার সাহেব সব নীরবে শুনলেন। তারপর বললেন, “আচ্ছা আপনাদের কি জয়েন্ট ফ্যামিলি?”
“না। আমার বাবা-মা গ্রামে থাকেন।”
“ও। আপনি শুরুতে বলেছেন আপনার স্ত্রীর অভিযোগ আপনি তাঁকে বেশি ভালবাসেন, তার সাথে তো এর কোন মিল পেলাম না।”
“মিল হয়ত নেই, তবে আমার প্রতি ওর ভালবাসা কমে যাবার পেছনে এটা একটা কারণ। আমার মনে হয় ভালবাসা বিষয়টা আপেক্ষিক, একজনের তুলনার অন্যজনেরটা যদি কমে যায়, তখন যারটা স্বাভাবিক, তারটা বেশি মনে হয়।
“ভাল যুক্তি, এবার দ্বিতীয় ঘটনাটা শুনি।”
“দ্বিতীয় ঘটনাটি কিছুটা দীর্ঘ…” আমি একটু গুছিয়ে সংক্ষেপে বলতে শুরু করলাম, “এর শুরুটা এ বছরের গোড়ার দিকে, যখন সোহানা হঠাৎ করে আবার গান করা শুরু করল। ‘আবার’ বলছি, কারণ, সোহানা ছাত্রজীবনে গান করত, স্কুলে, কলেজে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ও স্টেজে খুব ভাল পারফর্ম করত। পুরো ক্যাম্পাস ছিল ওর গানের ভক্ত। আমার সাথে সম্পর্কটা দানা বাঁধতে বাঁধতে ওর গানের চর্চা কমে গেল। আমিই আসলে ওকে আর সুযোগ দিতাম না। ওর লেখাপড়াও আমার সাথে, অবসরও আমার সাথে। গান করার আর সময় পেত না। বিয়ের পরও একই অবস্থা। এরপর চাকরি শুরু করল, ব্যস্ততা বাড়ল। সংসার আর চাকরির বাইরে ওর জীবনে কিছুই রইলনা। এমনকি পুরনো বন্ধুরা ফোন করলেও ও বেশি কথা বলার সুযোগ পেতনা, কারণ ওর ফোন এলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যেত; মনে হত আমার ভালবাসায় কেউ ভাগ বসাচ্ছে। আমি আসলে চাইতাম ও দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা শুধু আমার থাকবে। আর কারো প্রতি ওর কোন মনোযোগ থাকতে নেই।”
“হমম। আপনার স্ত্রীর গান এবং বন্ধুমহল – দুটোই তাহলে আপনার প্রতিপক্ষ, রাইট?” ডাক্তার সাহেব কাগজে কী যেন লিখলেন। তারপর বললেন “এটা আসলে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা কমন প্রবলেম। সব পুরুষই খুব পজেসিভ। তারা নিজেরা অন্যের বউর সাথে আড্ডা দেবে কিন্তু তার বউ যেন শুধু তাকেই চেনে, এটাই চায়। ভেরি কমন। তারপর? উনি গান শুরু করলেন কেন হঠাৎ?”
“ও যেই স্কুলে চাকরি করে, সেখানে হঠাৎ করে গানের টিচার চাকরি ছেড়ে দেয়। সামনে ২৬ মার্চ। স্কুলে ফাংশন হবে, সব ঠিকঠাক। তখন হাল ধরল সোহানা। এবং সেই অনুষ্ঠানে নিজের লেখা একটা গান গেয়ে সোহানা চরম প্রশংসা পেল। আর তাকে কে ঠেকায়? সে হয়ে গেল স্টার।”
“কী রকম?”
“আর বলবেন না। এফ এম রেডিও-র এক আর জে সেখানে ছিল। সে ওর ফোন নাম্বার নিয়ে গেল। পরদিনই ফোন। তার পরদিন একটা অডিশন। তার পরের সপ্তাহে রেকর্ডিং। মিউজিক করেছেন বাপ্পা মজুমদার, কণ্ঠ দিয়েছে সোহানা। সেই গান রাতারাতি জনপ্রিয়। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। বিষয়টা আমার অনিচ্ছাতেই আমি সমর্থন করে আসছিলাম। কিন্তু এতদূর গড়াবে, তা বুঝিনি।“
“এতদূর মানে কী?”
“মানে সোহানা এবার গান নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমার জন্যে তার সময় নেই। স্কুল থেকে বাসায় এসে রেওয়াজ করতে বসে; কোন কোন দিন রেকর্ডিং-এ চলে যায় সরাসরি। আমি ওর জন্যে সেখানে গিয়ে বসে থাকি; কখনও কখনও বাসায় একা থাকি। এভাবে কাহাতক ভাল লাগে?”
“হমম। আসলেই তো? ঘরের বউ এভাবে বাইরে গেলে হবে? সংসারের প্রতি দায়িত্ব নেই? যা হোক। তারপর?”
“ও, বলতে ভুলে গিয়েছি, ফেইসবুক হলো আমার আরেক প্রতিপক্ষ। সোহানার ফেইসবুক ফ্রেন্ড প্রায় তিনশ। এদের নিয়ে সোহানা ইদানীং সাংঘাতিক রকমের উচ্ছ্বসিত; আমি ওর কাছে আর তেমন গুরুত্ব পাইনা।”
“হমম। এটা রিসেন্টলি বেশ ব্রেক আউট করেছে, লাইক অ্যান এপিডেমিক… কিন্তু আপনার কেন মনে হয় আপনি গুরুত্ব হারাচ্ছেন?”
“হারাচ্ছি না? আমি বাসায় ফিরে তো সোহানার সাথে সময় কাটাব, একসাথে টিভি দেখব, গল্প করব, এমন কি কিচেনেও আমি ওকে সঙ্গ দিতে চাই। অথচ ও রান্না করতে করতে মোবাইল ফোন দিয়ে হুট করে ঢুকে পড়বে ফেইসবুকে। টিভি দেখার পাশাপাশি চলে ফেইসবুক।ওর ছেলেবন্ধুর সংখ্যা আজকাল জ্যামিতিক হারে বাড়ছে…”
“এ নিয়েও আপনাদের ঝগড়া হয়েছে, তাই না?”
“বহুবার। সোহানা আমার ওপর রাগ করে কয়েকবার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করেছে। কিন্তু এটা ছাড়া ও থাকতেই পারে না। শি ইজ অ্যাডিকটেড।”
“হমম, আমার এখন এই জাতীয় পেশেন্ট অনেক। যা হোক, গান নিয়ে কী যেন বলছিলেন?”
“হ্যাঁ। গত সপ্তাহের কথা বলি, সেদিন ছিল শুক্রবার। আগের দিন ওর ফেইসবুক স্ট্যাটাসে দেখেছি ওদের রেডিও স্টেশনে একটা গেট টুগেদার আছে, মানে যাদের গান প্রচারিত হয় তারা একত্রিত হবে, গান নিয়ে ওদের কী একটা প্ল্যান ছিল, পথশিশুদের জন্যে ফান্ড রেইজিং চ্যারিটি কনসার্ট …”
“আপনি চাননি আপনার স্ত্রী সেখানে যাক, তাই তো?” ডাক্তার সাহেব আমার কথা সম্পূর্ণ করে দিলেন।
“ঠিক তাই। আপনিই বলুন, সাত দিনে একটা দিন ছুটি, ঐ দিন ও কেন বাইরে থাকবে? আমি তো সেখানে ইনভাইটেড নই। ও কেন যাবে?”
“টিপিক্যাল পুরুষতান্ত্রিক লোক আপনি” ডাক্তার সাহেব ফোঁড়ন কাটলেন। সেটা কাঁটার মত খচ করে বিঁধলো আমার বুকে।
আমি বললাম, “ঐ দিন ওর সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হয়। ও নাকি অনেকদিন ধরে প্ল্যান করেছে, লোকজনকে অর্গানাইজ করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং আমি ওর সাথে ঝগড়া করে ওকে বাসায় রেখে, বাইরে থেকে বাসা তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।”
“বলেন কী?” ডাক্তার সাহেবের চোখ যেন চশমা ভেদ করে আমার দিকে তেড়ে এলো।
“হ্যাঁ। সকালে বেরিয়েছি। নিউ মার্কেটে কয়েক চক্কর দিয়ে ওর জন্যে একটা শাড়ি কিনে বিকেলে ফিরেছি।”
“এর মধ্যে তার সাথে আপনার ফোনে কথা হয়েছে? মানে কেউ কাউকে ফোন করেছে?
“ও ঘন্টাখানেক পর থেকে আমাকে ফোন করেছে। আমি কখনও রিসিভ করেছি, কখনও করিনি।”
“আপনি এমনটা করলেন কেন?” ডাক্তার সাহেব এবার টেবিলের ওপার থেকে ঝুঁকে এসে আমার চোখে চোখ রাখলেন। তিনি আমাকে যে কত রকম ভাবে স্ক্যান করছেন, সেও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। এর জুতসই জবাব দিতে পারলাম না। এবার তিনি বললেন, “বুঝলাম, আপনি চাইছিলেন আপনার স্ত্রী যেন আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে সময় না দেয়। সেটা দোষের নয়। কিন্তু ওঁর উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিল না…”
“আপনি জানেন না; ওর চরিত্র সুবিধের নয়। কে জানে? ওখানে গিয়ে পরকীয়া শুরু করবে কি না…। তাছাড়া আমি চাইনা ও সংসার বাদ দিয়ে এসব সমাজসেবা করে বেড়াক।”
“কিন্তু যেভাবে আপনি তাঁকে বন্দি করে রেখে গেলেন, তা অমানবিক। যা হোক, বিকেলে আপনি বাসায় ফেরার পর কী হলো?”
“এরপর সে আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিলো। শাড়িটা গ্রহণ করেনি। আমি অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি আমি তাকে পাগলের মতো ভালবাসি এবং তাকে কাছে পাবার জন্যে আমি এটা করেছি। কিন্তু পরের দিন একটা চিঠি দিয়ে সে জানালো, আমার এই অসুস্থ ভালবাসায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছে; সে এর থেকে মুক্তি চায়।”
“নাহ।” মাথা নাড়িয়ে বললেন ডাক্তার সাহেব, “আপনার স্ত্রীর উচিত নয় আপনার অনিচ্ছায় কোথাও যাওয়া, এই সমাজে মেয়েদেরকে স্বামীর কথা মতো চলতে হয়। সেটাই নিয়ম।। আবার আপনারও উচিত হয়নি তাকে তালাবদ্ধ করে বেরিয়ে যাওয়া। আপনার এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার। সেজন্যেই বোধহয় আপনি উকিলের কাছে না গিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে এসেছেন…”
“আপনি ঠিক ধরেছেন। আমি দুইটি বিষয় জানতে চাই। আমি কি মানসিকভাবে অসুস্থ, আমার ভালবাসাটা কি সত্যিই অসুস্থ? নাকি আমার স্ত্রী যে আমার ভালবাসা সহ্য করতে না পেরে আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছে, সে অসুস্থ? চিকিৎসা কার প্রয়োজন?”
ডাক্তার সাহেব এবার তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ভদ্রলোক দেখছি স্থির হয়ে বেশিক্ষণ বসতেই পারেননা। সাইকিয়াট্রিস্টরাও নাকি একটু-আধটু পাগল হয়।
“অনীক সাহেব!” প্রয়োজনের চেয়ে একটু জোরেই হেঁকে উঠলেন তিনি। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, “আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে একবার আসুন। তারপর বলব কার কী চিকিৎসা প্রয়োজন। আসলে আপনাদের দুজনকে ই আলাদা করে কাউন্সেলিং করতে হবে। তার আগে আপনি তাকে একবার নিয়ে আসুন। তার কথাও শুনি…”
আমি এবার হা হা করে হেসে উঠলাম। অনেক কষ্ট হচ্ছিল এই হাসি চেপে রাখতে। কারণ, আমি অভিনেতা নই। এতক্ষণ ধরে যে অভিনয় আমি করলাম, তাতে নিজেই কিছুটা হাঁপিয়ে দম প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়। আমার হাসি শুনে মনে হল হকচকিয়ে গেলেন তিনি। বিব্রত চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
আমি বললাম, “আমার স্ত্রীর বক্তব্য শুনতে চান? সেটাই তো এতক্ষণ বললাম। হা হা হা।”
“মানে?” ডাক্তার সাহেব মনের ডাক্তার। এবার মনে হয় তিনি আমার মনের তল খুঁজে পাচ্ছেন না। এই কষ্টের মধ্যেও বেশ মজা পেলাম আমি।
আমি হাসি চেপে বললাম. “আমি এতক্ষণ আপনাকে যে গল্পটি বললাম, এবার একটু কষ্ট করে তার পাত্র-পাত্রী উল্টে দিন। তারপর বলুন, আমি পুরুষতান্ত্রিক, পজেসিভ, একচোখা…”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনার স্ত্রী নয়, আপনি চাইছেন ডিভোর্স দিতে? কারণ আপনার স্ত্রী আপনাকে বন্দি করে রেখেছেন, তিনি আপনাকে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসেন…”
“ঠিক তাই। এই মানসিক নির্যাতন অমানবিক পর্যায়ে চলে গেছে; এভাবে চললে আমি পাগল হয়ে যাব। গান আমার প্রাণ; সেই গান আমার জীবন থেকে সে মুছে দিতে চাইছে, যেমন করে আমার প্রিয় বন্ধু টুটুলকে, মানে যাকে আমি টুম্পা বলে গল্পটা সাজিয়েছি, ও আমার জীবন থেকে মুছে দিয়েছে। আমি তো এই বন্দি জীবন চাইনি। ও আমাকে খুব খুব ভালবাসে। আমিও বাসি ওকে। কিন্তু সেটা এমন নয়। ভালবাসা মানে তো বন্দিত্ব নয়। স্বামী-স্ত্রী হয়েছি বলে টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স তো জড়াজাড়ি করে থাকা যায় না, লাইফ নিডস্ সাম স্পেস।”
“আপনার কি মনে হয় না, আপনি প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি স্পেস চান?” ডাক্তার সাহেবের কন্ঠে কাঠিন্য। আমি একটু চমকালাম। তিনি বলে চললেন, “আমার মনে হয় আপনার ফেইসবুক আসক্তি, আপনার বাইরের জগতের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ, গান গেয়ে সেলিব্রেটি হবার প্রতি আপনার যে তুমুল বাসনা, এসবই আপনার সংসারিক সুখের পথে অন্তরায়। মনটা যদি ঘরের দিকে ফেরানো থাকত, তাহলে কি ভাল হতো না?”
“আপনি এসব কী বলছেন? আমার মন ঘরের প্রতি নেই?” আমার বিস্ময় আকাশ ছোঁয়।
“নেই তা বলছি না। তবে ছুটির দিন পরিবারকে না দিয়ে অন্যত্র দিতে চাওয়া, স্ত্রীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া, তার আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া, এগুলো কিন্তু আমাদের সমাজে আজকাল অনেক সংসার ভেঙ্গে দিচ্ছে।”
আমি কেমন যেন বোবা হয়ে গেলাম। ডাক্তার সাহেব বলে চললেন, “আপনার স্ত্রী কিছু অন্যায় করেছেন। আপনার বন্ধু বা পরিবার থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করাটা গর্হিত অপরাধ। কিন্তু আপনাকেও সব দিক ব্যালেন্স করে চলতে হতো, তাই না?”
আমি নীরব। কী বলব বুঝতে পারছি না। ডাক্তার সাহেব বললেন, “আপনার মোবাইল নাম্বারটা কি আমার জানার কথা?”
“জ্বী না।”
“দেখুন তো, এই নাম্বারটা আপনার কিনা?” টেবিল থেকে স্লিপ প্যাডের একটা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে আমার সামনে ধরলেন তিনি, সেটায় আমার মোবাইল ফোনের নাম্বার লেখা। হাতের লেখাটা সোহানার!!
“আপনার স্ত্রী কাল এখানে এসেছিলেন। উনি আমাকে সব বলেছেন এবং । উনিও জানতে চান কে আসলে অসুস্থ। আপনাদের দু’জনের গল্পে খুব বেশি অমিল নেই। তার মানে কেউ বানিয়ে কিছু বলছেন না। তবে তিনি অতীত নিয়ে একটু বেশি পড়ে আছেন, মানে প্রেম আর দাম্পত্য যে এক নয় সেটা উনি মানতে চাইছেন না বা পারছেন না। যা হোক, আপনি আমাকে বলেননি এমন একটা বিষয় আপনাকে বলি?”
“ব-বলুন…” আমি কি তোতলালাম?
“এই দেখুন” বলে একটা কাগজ তিনি ড্রয়ার থেকে বের করলেন। সেটা পড়ে আমি ফিরে গেলাম আমার অতীতে। যখন আমার পৃথিবীতে সোহানা ছাড়া আর সবকিছু ছিল মূল্যহীন। সেই সময়ে সোহানাকে লেখা একটা চিঠি এখন আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন এই সাইকিয়াট্রিস্ট। তার সাথে মাইন্ড-গেম খেলতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু এখন দেখছি চিত্র বিপরীত।
পুরো চিঠিটা পড়বার মত মানসিকতা নেই আমার। চিঠির শেষে বেগুনি রঙে লেখা কয়েকটা পংক্তি শুধু আমার চোখে পড়ল যা কোন এক কবির কবিতা থেকে ধার করে আমি সোহানাকে লিখেছিলাম:
তোমার হাতে বন্দি আমার ভালবাসার কাশ
তাইতো আমি এই শরতে তোমার ক্রীতদাস।
৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০১
কাজী মিতুল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ
২| ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:২১
তোমার গল্পের মৃত রাজকন্যা বলেছেন:
দারুণ একটা গল্প!!
এরকম টুইস্ট আসতে পারে ...বুঝতে পারিনি!
হা হা হা হা ...
ভালো লেগেছে অনেক ...
অনুসারিত ...
শুভেচ্ছা!
০১ লা মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১:৪৪
কাজী মিতুল বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
১৮ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৮
তাশফিকাল বলেছেন: ভাই খুব সুন্দর হয়েছে গল্পটা। অনেকদিন পর একটা চমতকার গল্প পড়লাম