নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভিজিটিং কার্ড, পাঁশুটে ধূসর চশমা, হেয়ার স্ট্রেটনার, গলায় বাঁধার কয়েকটা রংচঙে বাঁদনা আর রেকর্ডিং করার কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে আমেদাবাদ পৌঁছলাম । মাইক আসবে দু’দিন পরে । মৈথিলী ত্যাগীর নামে চটপট একটা সিম কার্ড জোগাড় করে নিলাম । আমেদাবাদে আমার তথাকথিত ‘অভিভাবক পরিবার’-এর দেওয়া নথিপত্রের সাহায্যে এত সহজে সিম কার্ডটা পেয়ে গেলাম দেখে বেশ অবাকই লাগল । অন্তর্তদন্ত দীর্ঘ সময় ধরে চলবে । কোনো দামি হোটেলে থাকার বিলাসিতা করা আমার বা আমার সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয় । তাছাড়া আমি একজন উঠতি চলচ্চিত্রকারের ভূমিকায় অভিনয় করছি যার আর্থিক সামর্থ্য সীমিত । এ-রকম একজন মানুষের থাকার বন্দোবস্ত একমাত্র স্থানীয় কেউই করতে পারে । এবার সাহায্য পেলাম এক শিল্পী-বন্ধুর কাছ থেকে, আমেদাবাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি মহলে যার ভালো যোগাযোগ আছে । বেশি প্রশ্ন করে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেনি সে । আমি একজন সাংবাদিক, যার অন্তর্তদন্তের জেরে গুজরাতের গৃহমন্ত্রীকে জেলে যেতে হয়েছিল—এটুকুই তার কাছে যথেষ্টই ছিল ।নিজের প্রভাব খাটিয়ে ‘নেহরু ফাউন্ডেশন’ নামক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিল সে ।
ফাউন্ডেশনের হস্টেলের ওয়ার্ডেনের কাছে একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমার পরিচয় দিল বন্ধুটি । ওয়ার্ডেন আমার প্রায় তাকালেনই না, হাত-পা নেড়ে বন্ধুটির সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন । লাগোয়া বাথরুম-সহ ২৫০ বর্গফুটের একটা ঘর জুটল, ভাড়া দিনপিছু ২৫০ টাকা । পরে হস্টেলের অন্য বাসিন্দারা আমার অন্তর্তদন্তের কাজে অনেক সাহায্য করেছিল । এরা ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছাত্র—জার্মানি, গ্রিনল্যান্ড আর লন্ডনের ।
প্রথম পরিচয় হল হস্টেলের ডিন বা ম্যানেজার মানিকভাই (নাম পরিবর্তিত)-এর সঙ্গে আমার বন্ধুটি তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘গুজরাত নিয়ে একটা সিনেমা বানানোর জন্য ম্যাডাম এখানে এসেছেন’। মানিকভাই বললেন, ‘বাঃ দারুণ । আমার শহর আর আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা বলুন । এই আমেদাবাদ একটি চমৎকার শহর’। সেইসঙ্গেই জানালেন শহরটা আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন । আমার ঘরে একটা একশয্যার খাট, একটা লেখার টেবিল আর একটা বুক স্ট্যান্ড রাখার বেশি জায়গা ছিল না । কিন্তু হস্টেলের অবস্থানটা জায়গার অভাব পূরণ করে দিল । গুজরাতের সবথেকে অভিজাত এবং মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত এই হস্টেলটা পরবর্তী ছ’ মাসে আমার বাড়ির-বাইরে বাড়ি হয়ে উঠেছিল ।
পরের দিন সকালে মাইক এসে পৌঁছল । মাত্র ১৯ বছর বয়সী উজ্জ্বল, লম্বা ফরাসী তরুণ, একমাথা এলোমেলো চুল । আমার বন্ধুর বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করলাম । আমার সঙ্গে হস্টেলে যাওয়ার আগে অল্পকথায় বুঝিয়ে দিলাম, তাকে ঠিক কী করতে হবে ।
আমার ঘরের লাগোয়া একটা ঘর পরবর্তী এক মাসের জন্য মাইককে ছেড়ে দিলেন মানিকভাই । এর পিছনে মাইকের তাঁকে ‘কেমোছো’ বলার অবশ্যই একটা ভূমিকা ছিল । মাইকের শেখার ইচ্ছে ছিল, বিভিন্ন সংস্কৃতিকে জানতে-বুঝতে চাইত, তবে তার সবথেকে প্রিয় জিনিস ছিল খাবার । সেদিন রাতে আমাদের প্রথম যৌথ নৈশভোজনে ছিল আমেদাবাদের ‘পাকওয়ান’ নামে পরিচিত জনপ্রিয় থালি । এখন আমি আর মাইক স্মৃতিচারণ করতে গেলে মনে পড়ে—সে রাতে অন্তত দু’ডজন পুরি আর ছ’বাটি হালুয়া উড়িয়ে দিয়েছিল ও, যা দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম আমি ।
খাওয়া সেরে হস্টেলের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মাইক জিজ্ঞেস করল, ‘যখন শুধু আমরা দু’জনই থাকব, তখন কি আমি তোমাকে রানা বলে ডাকতে পারি ?’
‘না । তুমি এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তোমার কাছে আমি মৈথিলী হয়েই থাকব’। মাইক কথা রেখেছিল । প্যারিস রওনা হওয়ার আগে আমাকে পাঠানো বিদায়ী কার্ডে হিন্দিতে সে লিখেছিল, প্যারী মৈথিলী, আপনা খেয়াল রাখনা—মাইক’। (ক্রমশঃ)
©somewhere in net ltd.