নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সঙ্ঘস্থান: “শাখা”
যেখানে “সদস্যদের” সামরিক ধরনের রীতিতে দীক্ষিত করা হয়
গ্রীষ্মকাল। বিকেল পাঁচটা। উত্তর কলকাতার একটি পাড়ার বৃক্ষহীন, তৃণহীন, ধুলোয় ভরা পার্ক। বাতাসে গোবর, উনুনের ধোঁয়া আর ঘামের গন্ধ। পার্কের বেঞ্চিগুলো চুরি হয়ে গেছে, দোলনা আর সড়সড়িও নেই—তবে সেগুলোর লোহার ফ্রেমগুলি মনে করিয়ে দেয় যে শহরের মেয়র এক সময এখানে একটা পার্ক বানিয়েছিলেন। এখানে-ওখানে কিছু বাচ্চা আর বড় ছেলের দল ফুটবল খেলছে। ফুটবল মাঠের মাপের একটা জমিতে ফুটবল খেলছে অনেকগুলো দল। কোনও গোলপোস্ট অবশ্য নেই। কখনো ছিলও না। রবারের চপ্পলগুলো জড়ো করে গোলপোস্টের কাজ চলছে। এক কোণে ছোট ছোট মেয়েরা “মেয়েদের খেলা” খেলছে, আর মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে এসে পড়া বল থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সন্ধে হওয়ার আগেই এই মেয়েরা ঘরে ফিরে যাবে।
পার্কের আর এক কোণে কিছু বালক ও কিশোর ঠিক কী করছে সেটা কেউ বুঝছে না। পাড়ার কিছু বাচ্চা আর কয়েকজন ফুটপাথবাসী অবশ্য ভিড় করে দেখছে তাদের। জায়গাটা পার্কের একটা নির্জন কোণে—চপ্পল আর জামা দিয়ে একটা লাইন বানিয়ে আলাদা করা। একদিকে ইট দিয়ে একটা বেদী বানানো হয়েছে, তার ওপর বাঁশ দিয়ে একটা গেরুয়া পতাকা টাঙানো হয়েছে। ঐ চপ্পল আর জামা যাদের, তারা বয়স অনুসারে লাইন করে দাঁড়িয়ে পতাকাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। এর পর খেলা শুরু হবে। খেলা মানে কিন্তু ফুটবল, ক্রিকেট বা হকির মতো জনপ্রিয় খেলা নয়—কারণ ঐ খেলাগুলো তো ঠিক “ভারতীয় খেলা” নয়। এরা খেলছে কবাডি, লেম-ম্যান (এই ইংরাজি নামটাই চলত), রুমালচোর, খো-খো, আর এমন কতকগুলো খেলা যেগুলো অন্য কোথাও খেলা হয় না—এই খেলাগুলো তৈরি করা হয়েছে কিছু হিন্দু পৌরাণিক পুরুষ চরিত্রকে কেন্দ্র করে—‘ভস্মাসুর’, ‘রাম-রাবণ’ ইত্যাদি। কতকগুলো খেলায় আবার চিৎকার করে স্লোগান দিতে হয়—‘হিন্দুস্থান হিন্দু কা, নহি কিসি কা বাপ কা’ বা ‘হর হর ব্যোম ব্যোম। ছেলেদের মধ্যে যারা একটু বড়ো তাদের আবার বাঁশের ও বেতের লাঠি, চামড়ার ঢাল, নকল ছোরা ও ঊনবিংশ শতকের স্মৃতিবাহী নানা হাতিয়ার ব্যবহারে অভ্যাস করানো হয়।
হ্যাঁ, এই হল আরএসএস-এর একটা “শাখা”—রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্থানীয় শাখার প্রতিদনিককার একঘন্টাব্যাপী জমায়েত। আজকের জমায়েতে এসেছে জনা পচিঁশ সদস্য বা “স্বয়ংসেবক”। এটা “সায়ম” বা সন্ধ্যাবেলার “শাখা” (এ এলাকায় সকালের “প্রভাত” শাখায় আসে এর চেয়ে কম লোক, তারা মূলত বয়স্ক মানুষ—ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী, হয়ত বা দু-একজন ডাক্তার, কম্পাউন্ডার, বা শিক্ষক) সান্ধ্য শাখার এই পচিঁশ জনকে তিন চারটে দলে ভাগ করা হয়েছে—শিশু (৬ থেকে ১০ বছর), বালক (১১ থেকে ১৬ বছর), তরুণ (১৬ বছরের চেয়ে বড়ো)। অবশ্য কে কোনভাগে পড়বে সেটা অনেক সময় চেহারা দিয়েও ঠিক করা হয়। এদের একজন হলেন “মুখ্য শিক্ষক”। প্রতিটি দলের একজন করে নেতা আছে—তাকে বলা হয় “গটনায়ক”। মুখ্য শিক্ষক এদের নির্বাচন করেন। মাঝামাঝি বয়স বা মাঝামাঝি চেহারার কাউকে কাউকে কখনও কখনও ওপরের দলে তুলে দেন বা নিচের দলে নামিয়ে দেন মুখ্য শিক্ষক—তা নিয়ে আপিলের প্রশ্নই ওঠে না।
শিশু স্বয়ংসেবকরা এখন লেম-ম্যান খেলছে। বালকরা খেলছে “কবাডি”। তরুণরা মার্চ করছে, বাঁশের “ডান্ডা” দিয়ে লাঠিখেলা অভ্যাস করছে, আর ছোটরা ঈর্ষার সঙ্গে তাদের দেখছে। এদের সবার পরনে সঙ্ঘের হাফপ্যান্ট, বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই মার্কামারা খাকি হাফপ্যান্ট। এটা সঙ্ঘের ইউনিফর্ম। বড় বড় ছেলেদের এটা ঠিক মানায় না—কিন্তু ফুলপ্যান্ট পরে এলে “অভক্তি” প্রদর্শনের জন্য শিক্ষকদের বকুনি খেতে হবে। এইসব শারীরিক কসরত চলবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
সকালের শাখায় অবশ্য শারীরিক কসরতের ব্যাপারটা খানিক অন্যরকম—তখন মূলত যোগব্যায়াম আর ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করানো হয়—তিরিশ বছরের ওপরের শহুরে ভারতীয় পুরুষরা বেশি শারীরিক পরিশ্রম করতে পারে না। প্রভাত শাখায় তাই আধ ঘন্টা ধরে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করা হয়, হিন্দু ভারতের গরিমা নিয়ে সংস্কৃত শ্লোক পাঠ করা হয়, একাত্মতা স্তোত্র পাঠ করা হয়—আগের প্রাতঃস্মরণ স্তোত্রের নতুন রূপ এটি। কিন্তু বিকেলের শাখায় ব্যাপারটা অন্যরকম।
শিক্ষকরা নির্দেশ দেন সংস্কৃতে— যা কেউ ভাল বোঝে না। দর্শকরাও এত অবাক হয়, মজা পায়, হাসিঠাট্টা করে। তাতে অবশ্য শিক্ষক বা পুরনো স্বয়ংসেবকদের কিছু যায় আসে না। তারা গম্ভীর। তারা মনে করে যে সংস্কৃত নির্দেশ তাদের একসূত্রে বাঁধে—তাদের চিন্তার “অখন্ড ভারত”-এর ভাষা এটি। তাই শিক্ষক হাঁক দেন “মন্ডলঃ”, আর স্বয়ংসেবকরা গোল হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষক নির্দেশ দেন “উপবেশ”, তারা বসে পড়ে। শিক্ষক বলেন “উত্তিষ্ঠ”, সবাই উঠে দাঁড়ায়। তিনি বলেন “সংখ্যা”, সবাই “এক”, “দুই” করে নিজেদের গুনতি করে। এবার নির্দেশ আসে “প্র চল”, সবাই মার্চ করতে থাকে। নেতা এবার নির্দেশ দেন “স্তভ”, সবাই থেমে যায়। “কুরু” বললে খেলা শুরু হয়। শিক্ষকের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে খেলা শেষ করতে হয়—খেলা আর একটু চালাতে চাইলে সে ইচ্ছা কড়া ভাবে দমন করা হয়। এ্যাটেনশন-কে বলা হয় “দক্ষ”, স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ হয় “আ-রাম”। এরকম সবকিছু। আরও কঠিন ও জটিল নির্দেশ দেওয়া হয় বিশেষ অনুষ্ঠানে, শীতকালীন শিবিরে আর অফিসার্স ট্রেনিং ক্যাম্পে। এছাড়া “আনক” (ড্রাম), “বংশী” ও “শঙ্খ” (বিউগুল) ইত্যাদি বাজনা শেখানোরও ক্লাস হয়।... (ক্রমশ)
২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:৪৯
গায়েন রইসউদ্দিন বলেছেন: ধন্যবাদ রাজীব নুর ভাই, আপনার সঙ্গত প্রশ্নটির জন্য। আমি জানি অনেক পাঠকের কাছে, খুব বেশি পর্ব পড়াটা হয়তো বিরক্তিকর। তাই, হয়তো আপনি এমন প্রশ্ন করেছেন। এই গ্রন্থটি মোট ১৭৬ পৃষ্ঠার। কিন্তু আমি মাত্র ৪১ পৃষ্ঠা প্রকাশ করতে পেরেছি। তাহলে, অনুমান ক'রে নিন, কত(?) পর্বে শেষ করা সম্ভব হবে। অথচ এই বইটি বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 'দানব' কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বলা হয়নি। এটা একটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক সাংস্কৃতিক চক্রান্ত, যা এই শুধু ভারতে নয়, আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলি ছাড়াও, পুরো উপ-মহাদেশেও শুধু নয়, সারা বিশ্বে এর দুষ্প্রভাব পড়বেই। তাই দানবরূপী এই অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা ঐক্যবদ্ধ মানবিক শক্তির প্রয়োজন। এসব কথা ভেবেই এই গ্রন্থের উপস্থাপনা। আশা করি, আপনি সহমত পোষণ করবেন। আর তা' যদি সম্ভব না হয়, তাহলে একটু বিস্তারিত লিখে আমার ব্লগে আলোচনা করবেন। শুভেচ্ছা!!
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১:৪৩
রাজীব নুর বলেছেন: কত পর্বে শেষ হবে?