নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাজু সিদ্দিকের মননভুবন

আমার অনুমতি ব্যতীত কেহ আমার গল্প বা গল্পের অংশ এবং নাটক বা নাটকের দৃশ্য বা সংলাপ বা সংলাপের অংশ কোখায়ও ছাপাতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না। -- রাজু সিদ্দিক

রাজু সিদ্দিক

আমার অনুমতি ব্যতীত কেহ আমার গল্প বা গল্পের অংশ এবং নাটক বা নাটকের দৃশ্য বা সংলাপ বা সংলাপের অংশ কোখায়ও ছাপাতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না। -- রাজু সিদ্দিক .

রাজু সিদ্দিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

কী খোঁজো তুমি ঘাসের বনে

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:০৯

বাবলীরা আগামী মাসে যাত্রাবাড়ির এ বাসা ছেড়ে চলে যাবে। বাবলীর বাবা রজব আলী, এখন অবশ্য তিনি রজব আলী না, রজব সাহেব। রজব সাহেব রামপুরায় একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনেছেন। সামনের মাসের এক তারিখ রামপুরায় চলে যাবেন। এখন সেই বাসায় ইন্টেরিয়র ডেকরশনের কাজ চলছে। যাত্রাবাড়ির এ বাসাটা ভালই তবে সমস্যা একটা আছে, সমস্যাটা হলো, এ বাসার সামনে রিক্সা আর সিএনজি আসে গাড়ি আসে না। গাড়ি গলির মাথায় রেখে ত্রিশ গজের মত হেঁটে বাসায় আসতে হয়। রজব আলী কয়েক দিন আগে গাড়ি কিনেছেন। যদিও গাড়ি কেনার সামর্থ্য তাঁর পাঁচ বছর আগেই হয়েছিল কিন্তু কেনেন নি। বৃষ্টির দিন যদি গলির মাথা থেকে ভিজে ভিজেই বাসায় ঢুকতে হয়, তাহলে আর গাড়ি কিনে লাভ কী ? তাই এতোদিন গাড়ি কেনেন নি। কিন্তু ব্যবসার এখন যে রমরমা অবস্থা এ অবস্থায় ক্যাবে বা সিএনজিতে যাতায়ত করা প্রেষ্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাছাড়া মুরাদ ভাইয়ের ছেলে সাগরের সাথে বাবলীর এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে। মুরাদ ভাই তার মত চার, পাঁচটা রজব আলীকে প্রতিদিন হাটে বিক্রি করে আবার কিনতে পারবেন। মেয়ে জামাইয়ের গাড়ি শ্বশুর বাড়ির সামনে আসবে না, রজব আলীর কাছে এটা দ্বিতীয় প্রেষ্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই বাবলীর এঙ্গেজমেন্টের পরদিন যখন রামপুরার ডুপ্লেক্স বাড়িটার খোঁজ পান সাথে সাথে কিনে ফেলেন এবং এর দু’দিন পর কেনেন গাড়ি।

কিন্তু বাবলীর এ বাসা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এ বাসায় কত স্মৃতি ! বাসার প্রতিটি কোণায় স্মৃতি জড়িয়ে আছে ? যে দিকেই তাকায় কিছু না কিছু মনে পড়ে যায়, মনটা হু হু করে ওঠে। বাবলী ছাদে একা বসে আছে হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে ফিরে তাকায়, দেখে সাগর হাসি মুখে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

‘কেমন আছো ?’

‘ভাল,’ বাবলী কণ্ঠে বিষণ্নতা।

‘মুখে বলছ ভাল কিন্তু চোখ বলছে অন্য কিছু।’

‘জানেন আগামী এক তারিখ এ বাসাটা ছেড়ে চলে যাব।’

‘হ্যাঁ আন্টি বলেছেন। আমার ইচ্ছা ছিল তোমাদের নতুন বাসাটা দেখার কিন্তু এ মাসে কাজের চাপটা অনেক বেশি, যেতে পারব না। তোমরা যাও তখন যাব।’ বাবলী বিষণ্ন মনে দূরে তাকিয়ে থাকে। সাগর নীরবে কিছুক্ষণ বাবলীকে দেখে প্রশ্ন করে,‘মন কি খুব বেশি খারাপ ?’

‘কতগুলো বছর ! কত সময়, কত স্মৃতি ?’ বাবলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,‘এই যে কার্নিসে শেওলা জমে আছে, এটার জন্যও মায়া লাগছে।’

‘হু-উ,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বাবলীর কথায় সায় দিয়ে সাগর প্রসঙ্গ ঘুরায়,‘আচ্ছা বাবলী, আমাদের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে কত দিন ?’

‘ছাব্বিশ দিন,’ বাবলী মুখ না ফিরিয়েই বলে।

‘ছাব্বিশ দিন! ছাব্বিশ দিনে আমরা একবারের জন্যও কোথায়ও বেড়াতে যাই নি ? স্ট্রেঞ্জ ! চলো কোথা থেকে ঘুরে আসি।’

‘আজ না।’

‘কেন ? চলো তোমার মনটা ভাল হয়ে যাবে, চ-লো,’ সাগর বাবলীর হাত ধরে।

বাবলী হাত ছাড়িয়ে নেয়,‘আজ না, অন্য কোনদিন, যে কয়দিন এ বাসায় আছি পরিচিত পরিবেশটাকে প্রাণ ভরে দেখে নি।’ বাবলী পশ্চিম দিকের ক’টা বিল্ডিং পরে একটা কাঁঠালগাছ দেখিয়ে বলে,‘ওই যে কাঁঠালগাছটা দেখছেন, আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন কাঁঠালের মুঁচি চুরি করতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।’

‘তাই নাকি, কোন গাছটা ?’ সাগর এগিয়ে আসে।

‘ওই যে অনেক সজীব গাছটা দেখছেন না, ওইটা,’ বাবলী আবার হাত তুলে দেখায়।

সাগর কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে গাছটার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে,‘ওই গাছটা আর দশটা গাছের মতই সজীব কিন্তু ওটার সাথে তোমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে বলে ওই গাছটা তোমার কাছে বেশি সজীব মনে হচ্ছে।’

‘মোটেও না, ওই গাছটা অন্য সব গাছ থেকে বেশি সজীব, আপনি বোঝেছেন না,’ বাবলী একটু রেগেই বলে।

‘তাও হতে পারে,’ সাগর মাথা দোলায়,‘একবার কী হয়েছে জানো, গত বছর ইটালী ট্রেডফেয়ারে এক স্টলে কিছু ঘাস দেখি, সুন্দর, খুবই সুন্দর, এত সুন্দর যে ছুঁতে ইচ্ছা করে। স্টলের লোকদের জিজ্ঞেস করাতে বলে ঘাষগুলো নাকি কৃত্রিম। সংগে সংগে সিদ্ধান্ত নেই আমার বেডরূমে এ ঘাস এনে লাগাব। কোন ময়লা নেই, ধুলোবালি নেই, ভাল হবে না ?’

বাবলী একটু ভেবে বলে,‘ধরলে বোঝা যায় না যে কৃত্রিম ?’

‘মোটেও না, আমি ছুঁয়ে দেখেছি।’

‘তাহলে বেডরূমে না বারান্দায় লাগাব, বারান্দায় এসে আকাশের দিকে তাকালে মনে হবে ঘরে না মাঠে দাঁড়িয়ে আছি।’ আইডিয়াটা সাগরেরও পছন্দ হয়, সে মাথা দোলায়। বাবলী অনমনে জিজ্ঞেস করে,‘আচ্ছা, সেই ঘাসে ফুল ছিল ?’

সাগর সিরিয়াস কণ্ঠে বলে,‘না ! মনে হয় সিজন ছিল না।’ বাবলী ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। সাগর হা, হা করে হেসে ওঠে। সাগরের সাথে সাথে বাবলীও হাসে। হাসতে হাসতে ভাবে, হাসলে মানুষটাকে কত সুন্দর দেখায় ! মানুষটার সাথে জীবনটা মন্দ কাটবে না ! সাগর আবার বাবলীর হাত ধরে। বাবলী এবার হাত ছাড়িয়ে নেয় না। সাগর ফিস্ ফিস্ করে বলে,‘ম্যাডাম, আপনি কি আমার সাথে ঘুরতে যাবেন ?’ বাবলী এবার হেসে মাথা ঝাঁকায়। ‘তাহলে তুমি যাও রেডি হয়ে এসো, ততক্ষণ আমি আন্টির সাথে গল্প করি।’

আধাঘন্টার মধ্যে সাগর ও বাবলী বাসা থেকে বের হয়। গাড়িতে উঠে সাগর বাবলীকে জিজ্ঞেস করে,‘কোথায় যাবে ?’ যদিও সাগরের সিদ্ধান্ত নেয়া আছে কোথায় যাবে, তারপরেও বাবালীকে জিজ্ঞেস করে, ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করে। বাবলীকে নিয়ে সাগর সোজা ঢাকা ভার্সিটির মাঠে চলে আসে, এসে মাঠের একপাশে ঘাসে বসে বাবলীকে বসতে বলে। বাবলী কৌতূহল নিয়ে প্রথমে সাগরের দিকে তারপর মাঠের চার দিকে তাকায়। এই কাঠফাঁটা রোদে কয়েকটা গরু ছাড়া মাঠে আর কোন প্রাণী নেই। সাগর চোখের ইশারায় বাবলীকে আবার বসতে বলে। বাবলী একটু বিরক্তি নিয়ে সাগরের মুখোমুখি বসে। ‘আমি জানি তুমি অবাক হয়ে ভাবছ, তোমাকে এই ভর দুপুরে এখানে কেন নিয়ে এলাম ?’

‘সেটাইতো স্বাভাবিক, তাই না ?’ বাবলীর কণ্ঠে বিরক্তি।

‘তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। প্রতিদিন বিকেলে এই মাঠে ফুটবল খেলতে আসতাম। বিকেলে নানা বয়সের অনেকেই এই মাঠে বেড়াতে আসতো, এখনো হয়তো আসে। বেশির ভাগই ভার্সিটির শিক্ষকদের বা আশেপাশে বসবাসকারীদের পরিবার। একদিন বিকেলে এক দম্পতি বেড়াতে আসে। স্বামীটা যেমনতেমন তবে তার স্ত্রী ছিল আগুন। যেন পড়ন্ত বিকোলর লাল সূর্যটা এই মাঠে এসে থমকে আছে। এতো সুন্দর কোন মানুষ হতে পারে, তা আমার একার না যারা দেখেছিলাম তাদের সবারই কল্পনার অতীত ছিল। তারপর থেকে প্রতি বিকেলেই ওই দম্পতি এখানে আসতো। আর মজার ব্যাপার কি জানো ? ওই দম্পতি মাঠে আসার সাথে সাথে আমাদের খেলার গতি কমে যেত। তখন কারো দৃষ্টিই ফুটবলে থাকতো না, থাকতো ওই মহিলার দিকে। ম্যানেজমেন্টের বসিরের অবস্থাতো ছিল খুবই কাহিল, সে সারাক্ষণই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতো, কেউ যদি তাকে বল পাস দিত সে লাথি দিয়ে বল সাইড লাইনের বাহিরে পাঠিয়ে দিয়ে আবার তাকিয়ে থাকত। এ নিয়ে কত হাসাহাসি।’

বাবলী হাসে কিন্তু তার মনে শঙ্কা জাগে, বুক দুরদুর করে। সে হাসতে হাসতে হঠাৎ তার বসার জায়গা দেখিয়ে প্রশ্ন করে,‘মহিলা কি এসে মাঠের এই যায়গাটায় বসতো ?’

‘না, ওই দিকটায় বসত, বসত মানে, স্বামী একাই বসতো আর স্ত্রী হেঁটে বেড়াতো। স্বামী বসে বসে স্ত্রীর হেঁটে বেড়ানো দেখতো। তখন স্বামীর চোখে মুখে কী যে আনন্দ, কী সুখ মেখে থাকতো, বলে বোঝাতে পারব না। স্ত্রী আলতো আলতো পায়ে সারা মাঠে হেঁটে বেড়াতো। দেখে মনে হতো হাঁটছে না ঘাষের আগায় আগায় উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঠের যে দিকে যেতো সে দিকের ছেলেরাই খেলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতো।’

‘কেউ বিরক্ত হতো না ?’

‘না।’

‘কেন?’

‘সে অন্ধ ছিল।’

অন্ধ শুনে বাবলী থমকে তাকায়, মহিলার প্রতি তার মায়া জাগে কিন্তু তার মনের শঙ্কা কাটে না। সে মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করে,‘তারপর ?’

‘তারপর !’ সাগর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,‘তারপর, হঠাৎ এক বিকেল থেকে তারা আর আসে না। আমরা প্রতিদিনই খেলতে আসি কিন্তু খেলায় কেন যেন আর আগ্রহ পাই না। বার বার চোখ চলে যায় গেটের দিকে। পনের ষোল দিন পর এক বিকেলে বসির ছুটতে ছুটতে এসে বলে, শেষ যে দিন তারা মাঠে এসেছিল সেদিন যাওয়ার পথে সাহবাগের মোড়ে বাসের নিচে চাপা পড়ে মহিলাটা মারা যায়। তবে আশপাশের দোকানদারদের ভাষ্য, স্বামীই নাকি স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে বাসের নিচে ফেলে দিয়েছিল।’ এতটুকু বলে সাগর চুপ করে থাকে। বাবলীর ভিতরে কী যে হয়, তার মুখে কথা আসে না। ‘সে দিন অনেক রাত পর্যন্ত আমরা ছয় বন্ধু মাঠে বসে ছিলাম, ওই যে ওই দিকটায়,’ সাগর আঙুল তুলে আবার দেখায়,‘মাঠ ছেড়ে যাবার আগে আমরা পণ করি আমরা প্রত্যেকে যার যার প্রিয় মানুষকে নিয়ে প্রথমে এই মাঠে আসব, এসে একজন অতন্ত সুন্দর অন্ধ দুঃখী মানুষকে সম্মান জানাব। আজ আমাকে নিয়ে আমরা চারজন এখানে আসলাম।’ হঠাৎ সাগর হেসে ওঠে, হাসতে হাসতে বলে,‘বসির সালা বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায়। গতবছর প্রথম বউ নিয়ে দেশে আসে, এসে প্লেন থেকে নেমেই বউ নিয়ে সোজা চলে আসে এই মাঠে তারপর যায় বাসায়।’

এতটুকু বলে সাগর বাবলীর মুখের দিকে তাকায়, বাবলী মুখ নিচু করে ফেলে। তার নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। সে ভেবেছিল সেই অন্ধ স্ত্রী বুঝি ছিল সাগরের ব্যর্থ প্রেম আর সেই ব্যর্থ প্রেমের কষ্ট ভোলার জন্যই সাগর এই ভরদুপুরে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। বাবলীর নিজেকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে, সে মাথা নিচু করেই ফিস্ ফিস্ করে বলে,‘সরি।’

সাগর এক পলক বাবলীকে দেখে নীরবে হাসে,‘আমি জানি তুমি কেন সরি বললে, আমার কাহিনী শোনার আগে তুমি কী ভাবছিলে আমি তাও অনুমান করেছি। আমি তাতে কিছু মনে করিনি, তোমার জায়গায় থাকলে আমিও তাই ভাবতাম। ইটস্ ওকে।’

সাগরের কথা শুনে বাবলীর নিজেকে কিছুটা ভার মুক্ত মনে হয়, সে পুরোপুরি ভার মুক্ত হওয়ার জন্য মুখ তুলে জানতে চায়, সেই মহিলা মাঠে বসে কখনো বাদাম খেতো না ?’

‘হ্যাঁ, খেতো।’

‘আপনি বাদাম আনুন, আমি বাদাম না খেয়ে এখান থেকে যাব না।’

‘এই দুপুরে আমি বাদাম পাব কোথায় ?’ সাগর অবাক।

‘আমি কী জানি? আমি বাদাম খাব, ব্যস !’

‘তুমি সত্যিই খাবে ?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে একটু বসো, দেখি পাই কিনা।’ এ কথা বলে সাগর উঠে যায়। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে দৌড়ে ফিরে এসে,‘থ্যাঙ্কস,’ বলে আবার দৌড়ে চলে যায়, বাদামের খোঁজে যায়, তার প্রিয় মানুষটা বাদাম খেতে চেয়েছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.