নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে চাওয়া নকল মানুষ। নিজ ধর্মে বিশ্বাসী ধার্মিক। নিজ কাজে নির্ভরশীল শ্রমিক। দেশকে ভালবাসা এক দেশপ্রেমিক।মানুষে মানুষে সচেতনতা বাড়ুক, দেশ হোক উন্নত, সমৃদ্ধশালী। মানবতা আশ্রয় নিক হৃদয়ে।

রিফ্রাক্শন

আমি ঠিক আমার মতো। আমার ভাবনার মত। ভাবনাগুলোর যুক্তির মত। আমি যেগুলো তে বিশ্বাস করি সেই বিশ্বাস এর মত। আমি আমার রচিত সংবিধানের মত। আমি প্রেমিকা পাগল প্রেমিকের মত। কাজ পাগল শ্রমিকের মত। দায়িত্ব নিতে চাওয়া নেতার মত। অবশেষও আমি মানুষ আপনাদের মতই, আপনাদের মধ্যেই একজন।

রিফ্রাক্শন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সেন পাড়া লেন ২৪/৩

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৩১

১।

অনেক বছর ধরে সেন পাড়া লেনের চব্বিশ বাই তিন নাম্বার বাড়িতে একাই থাকেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বয়স প্রায় ৭০ পার। দেহে তেমন রোগ বালায় নেই। রোজ সকালে উঠে ১ কিলো হেঁটে বাড়ি ফিরেন। কি তীব্র গরম, কি শীত! তিনি হাটবেন। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর ছবির টা একবার মুছবেন, আর বলবেন, ‘’কি দোষ করেছিলাম আমি?’’ এই বলে আবার ছবিটা ছবির জায়গায় টাঙ্গিয়ে চলে যান স্নান ঘরে। বয়স কাল থেকে বেশ টাকা জমিয়েছেন। কিন্তু বাড়ির পরিবেশ আর ঠিক হয়নি। তাই সেটাকে সেই নিম্ন মানের স্নান ঘরই বলা যায়।

স্নান শেষে পূবের জানালার ধারে চেয়ারে বসে দুলতে থাকেন, হাতের ডান পাশেই থাকে অডিও রেকর্ডার, হালকা করে রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে সকালের সূর্যের বেড়ে ওঠা দেখতেন। সামনে গাছে থাকায় আলোর তাপ এমন লাগত না।

ঐ লেনেরই দুই বাড়ি পরের এক মেয়ে এসে রান্না-বান্না করে, ঘর ঝাড়ু দেয়, বাসন-কোসন পরিস্কার করে। মাস গেলে তিন বেলা বিনে পয়সায় খাওয়া, হাত খরচের কিছু টাকা, দুপুর বেলা স্যাটেলাইটে বাংলা সিনেমা, এই নিয়ে কেটে যেত।

মেয়েটার নাম নীলা। কাজের চেয়ে খাওয়া বেশি হওয়াতে গায়ে গোতরে বেশ চর্বি জমেছে। গায়ের রঙ কালো আর সংসারে অভাব বলে
এখনো বিয়ে টা হয় নি।

নীলা যখন সতেন্দ্রনাথের সামনে আসে, কখনও কাজে কখনও ইচ্ছায়, সত্যেন্দ্রনাথ তখন আড় চোখে নীলার দিকে তাকায়, নীলা কিছুটা বুঝে, কিছু বলে না। সত্যেন্দ্রনাথের মনে কামনা জাগে, পুরুষ মানুষ বলে কথা, এদের বয়স বাড়ে, শরীরে জোর কমে কিন্তু কামনা কমে না। মাঝে মাঝে সত্য মনে মনে ভাবে নীলা কে বিয়ে করবে, কিন্তু বিয়ের কথা ভাবলে ওর স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায়। খুব ভালোবাসত কিনা! এছাড়া লেনে মানুষ পাছে কিছু লটাই, সত্য মনে করেও কিছু করেনা, সত্য ভাবে সমাজে এমন মানুষ থাকবেই।

তাছাড়া সত্য এখন এক ছেলের বাপ, সস্ত্রীক বিদেশ থাকে, একটা কন্যাও আছে বছর তিন বয়স। সব কথা ভেবেই সত্য নিজেকে সংযত করে। ফিরে আসে বাস্তবে।

সত্যের খাওয়া দাওয়া বেশ নিয়ম অনুযায়ী হয়। এককালে দেশ সেরা ফুটবলারে ছিলো। এই সেন পাড়া লেন থেকে মিনিট দশেক দূরে স্কুলের মাঠে শুরু হয় সত্যের ফুটবলের নেশা। সেখান থেকে দর্শক মাতিয়ে ধাপে ধাপে সত্য ন্যাশনাল টিমে জায়গা পাই।

লোক মুখে শোনা যায়, ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলে তাঁর একবার ডাক পড়েছিলো,বিশেষ কারনে যাওয়া হয়নি। তবুও দেশে থেকে সে কম কামায়নি । পুরো ক্যারিয়ার জুরে চুলের মত টাকা কামিয়েছে। তবে সে টাকা কোথায় আছে সত্য কাউকে বলে না।

লোকের উসকানিতে একদিন সত্যের ছেলে শিবু এসে বলে, ‘’আর কদিন পরে তো চিতায় উঠবা, তোমার কামানো টাকাগুলো আমাকে দিয়ে দাও।‘’ সত্য তখন দিতে নারাজ থাকায় একটা ছোট খাটো ঝড় শুরু হয়। লেনের মানুষ গুলো ছুটে এসে জড় হল। লোকজন দেখে
সত্য আর সত্যর ছেলে শিবু দুজনেই শান্ত হল।

‘’ছেলে হয়ে বাপের সাথে জোরে কথা?’’, ‘’কেমন বাপ? বুইড়া হইছে এখন তো ছেলের হাতে সব বুঝায় দিবে? কেন নিজের কাছে রাখছে সব?’’,”বাপ ছেলে মিলা থাকত পারো না?”, ’’ছেলের বউ খারাপ বইলা আজকে ছেলে বাপের সাথে এমন করে?’’…… এরকম আর অনেক প্রশ্ন সত্য আর শিবুর সামনে উপস্থাপন করে সরসর করে মানুষ গুলো সরে পড়ল।




রোজকার মত আজকেও সত্য পূবের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আজ সূর্যের বেড়ে ওঠা নয়, তাকিয়ে আছে সেন পাড়া লেনের একদম শেষ বাড়িটার দিকে। বাড়ি নাম্বার ২৪ বাই ১২। এই বাড়িটায় থাকত সত্যের বন্ধু কল্লা। যদিও বন্ধু সম্পর্কের বিশালতা অনেক তবুও বলা যায় সত্য আর কল্লার সম্পর্কটা বন্ধুর থেকে একটু বেশি। শ্রোনিদেশে চুল গজাবার আগেই দুজনে আশে পাশের সকল অলি গলি নখদরপরনে এনেছে। কোন কোন দিন সত্য দেখা গেছে বাড়ি না ফিরে কল্লার বাড়িতেই ঘুমুচ্ছে, আবার কল্লাও তেমনি।

তেমনি কোন কোন দিন আবার কল্লার মায়ের সাথে যদি সত্যর মায়ের কথা যুদ্ধ বেধে যেত ‘ছেলে বখে যাচ্ছে’ এই দোষ নিয়ে তখন আবার সেন পাড়ার এর ২৪ নাম্বার লেনের সকল মানুষ জড় হয়ে যেত। যুদ্ধ শেষ হলে দুজনের মা দুজনে কে প্রতিজ্ঞা করিয়ে ছাড়াত এই বলে যে ‘ওর সাথে আর মিশব না’। কিন্তু সে কেবল মুখে বলা প্রতিজ্ঞায় ছিলো মাত্র। কাজের নয়। সকালের আলো ফুটবার আগেই দুজনে মিলে যেত। বাসা থেকে বেরিয়ে চরিয়ে বেড়াত চরনক্ষেত্র । এভাবেই মাঝে মাঝে রাতে প্রতিজ্ঞা হত, সকালে ভাঙত।

ঐ বয়সে একজন দুরন্তপনা ছেলের যা ইচ্ছা হয়, কিংবা বিখ্যাত লেখকগণ ঐ বয়সের ছেলেদের যে সব গুনে গুণান্বিত করেছেন সেসব সকলই ছিলো সত্য এবং কল্লার মাঝে। তবে ওরা কাজ করত লক্ষ্য নিয়ে। কিছুটা এমন, কোন একটা বাগানের একটা গাছের কোন আমগুলোকে পাকার সুযোগ পেত দিত না, কোন খেজুর বাগানে শীতের সকালে একটি রসের হাড়ি থাকত না…।। এরুপ।

অনেকদিন ধরা পরেও পরে নি। তবে একদিন লিচু চুড়ি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে বাঁধা পড়েছিলো সারারাত। এমন বয়সে এমন একটু হবেই বলে সত্য আর কল্লা কিছু মনে করত না।

বাড়িতে ওদের এসব দুষ্টামির কারনে নালিশ আসলেও কোনদিন মেয়ে ঘটিত বেপারে নালিশ আসে নি। সত্যর বাবা বরং এটা নিয়ে বরাই করে। ব্যপার টা সত্য যে, প্রতি রাস্তায় কয়টা বাড়ি কিংবা কোন গলির দৈর্ঘ্য কতটুকু এসব নিমিষে মনে রাখলেও কোন মেয়ের বাড়ি কোন টা এসব জানার ওদের সময় ছিলো না।

এভাবেই সত্য আর কল্লা বড় হতে ছিলো, ধীরে ধীরে দুরন্তপনা কমে আসল, যেদিন থেকে সত্য ফুটবল কে ভালোবাসল। প্রতিদিন বিকেলে ফুটবলের নেশায় ছুটে যেত মাঠে, দিনের আলো নিভে গেলে বাড়ি ফিরত।

সত্য ছিলো রাইট উইঙ্গার, গতি ছিলো চিতা বাঘের মত, একবার যদি বল পেয়েছে ডান সাইডে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের বুকে কাঁপুনি শুরু হয়ে যেত।

সেই ভালো খেলা দিয়ে পাড়ার দলে কিংবা স্কুলের দলে কম বয়স হলেও সত্য ছিলো প্রথম পছন্দ। ওকে দলে পেয়ে পাড়া জিতল প্রথম বারের মত ইউনিয়ন কাপ, স্কুল জিতল অন্তস্কুল কাপ। চারিদিকে তখন সত্যর নাম মুখে মুখে। কি বন্ধু কি সিনিয়র কি জুনিয়র সবাই মাঠে যখন সত্য বল টানত তখন লেফট-রাইট এর মত সুরে ধ্বনিত হত, সত্যওওওওওওওও, সত্যওওও।

তারপরে শুধু পাড়ায় না সত্যর নাম ছড়িয়ে গেলো চারিদিকে। ভাড়ায় খেলা শুরু করল। এখানে ওখানে ভ্রমণ হল। সঙ্গী ছিলো বন্ধুবর কল্লা।





সত্য হয়ত জানেনা সে এখন কত জনপ্রিয়, জানেনা নিষিদ্ধপল্লীর একটা মেয়ে পেপার হতে শিরোনামে লেখা বড় হরফে নাম, সাদা কালো ছবি কেটে ঘরে টাঙ্গিয়ে রেখেছে। আসলেই সত্য জানেনা।

মেয়েটার নাম রিমা। বংশ নিয়ে বললে রিমা রায়। ছোট থেকেই এই পল্লী তে ওর বসবাস। বয়সে ১৮ বছরে যুবতি। রিমার মা দেহ বিক্রি করে দুজনের সংসার চালায়। চলে ভালো, বড় খদ্দের পেলে ভালোই চলে কয়েকদিন। রিমা আর রিমার মা যে খুপড়িতে থাকত সেখানেও দুইটা কক্ষ, যখন কাস্টমার আসত রিমার মা তখন রিমাকে ঐ একটা ঘরে তালা মেরে দিত।

কেননা, রিমা দেখতে বেশ সুন্দরী, নায়িকাদের থেকে কম যায় না, সবসময় পরিপাটি হয়ে চলে, পরিচয় লুকিয়ে স্কুল পাশ করেছে। চলাফেরায় বেশ স্মার্ট।

রিমার মা স্বপ্ন দেখত, বড় একটা বাড়িতে রিমাকে বিয়ে দিবে, কিন্তু একজন পতিতার মেয়েকে বিয়ে করে আত্মীয় বানাবে কারা? চলাফেরা করতে পরিচয় না লাগলেও সম্পর্কে জড়াতে পরিচয় চলে আসে আগে। জাত, কুলের কথা বাদই দিলাম। এজন্যই রিমা এখন অবিবাহিত।

অন্যদিকে এই ভয়েও থাকে কোনদিন যদি কোন খদ্দের রিমাকে দেখে ফেলে, যদিও আজ পর্যন্ত রিমা কুমারী। কিন্তু সেদিন কি হবে? সেদিন কোন অনুরোধ শুনবে? ওদের কাছে তো এখানকার সবাই পতিতা। রিমার মায়ের চোখে পুরুষ মানুষ বড় অমানুষ। কেননা, বিয়ের আগে যখন বাবার বন্ধু এমনকি, বিয়ের পর স্বামীর বন্ধুদের কাছে অসহায়ত্ব হয়েছে, শেষে ওরা ছুড়ে ফেলেছে এই নর্দমায়।

তবে রিমা জানে ওর বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, মায়ের বাম-পায়ে খুত থাকায় ইনকাম করতে পারত না বলে এই খানে। তবুও রিমা মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদে, ওর মাকে দোষ দেয় মনে মনে, ‘এখানে না আসলে কি বাঁচতাম নাহ?’, যদিও এর হাজার উত্তর থেকেও নেই। হয়ত রিমার জীবন টা আরো অন্যরকম হত।



তখন সত্যের নাম যশ, হাতে বেশ টাকা, সাথে ছোটবেলার বন্ধু, দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিলো। বেশি টাকা হলে মানুষ যেমন পথভ্রষ্ট হয় ঠিক তেমনি সত্য ও কল্লাও হল। দূরে দূরে ফুটবল ম্যাচ খেলতে যেয়ে মাঝে মাঝে যেত সেই বয়সের কৌতূহলে থাকা নিষিদ্ধপল্লীতে।
ওরা যেন এক নেশায় মেতে উঠলো। এ নেশা ঝরনার জলের কিংবা সমুদ্রের স্রোতের মত, ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। তবুও সত্য প্রতি রাত শেষে কি যেন খুঁজত, সাথে থাকা সঙ্গীকে বলত, তোমার মাঝে সেই আকর্ষণটা নেই যেটা আমি ফুটবলে পাই। সঙ্গী তখন অবাক হয়ে ভাবত, ‘এ আবার কেমন খদ্দের, আগে তো দেখিনি।’

এমনি এক যাতায়াতের দিনে এক পল্লীতে একজনের মরার খবর পাওয়া গেলো। সেদিন আর পল্লীতে কেউ যাবে না, জানার পরেও সত্য কেন জানি গেলো। গিয়ে দেখে এক মেয়ে বেশ রূপবতী লাশের পাশে বসে কাঁদছে, আশেপাশের অন্যরা তাকিয়ে দেখেছে।
মেয়েটাকে দেখে সত্যর কেমন জানি খুব মায়া হলো, সত্য মনে মনে ভাবল, মায়া কি প্রকাশ করবে? নাকি থাকবে? অসময়ে মায়া দেখালে অনেকে করুণা মনে করতে পারে। এই ভেবে ওখান থেকে সেদিন চলে আসল।

এরপর বেশ কয়েকদিন ওখানে গিয়ে শুধু ঐ রুমের পাশে থেকে ঘুরে এসেছে, এখন আর সত্য খদ্দের হিশেবে যায় না, এখন সত্য একজন প্রেমিক হিসেবে যায়, যে মনে করে প্রেম দিয়ে ঐ মেয়েটাকে শুধুই তাঁর করে রাখে।

কয়েকদিন পরে মেয়েটার সাথে একদম গেটের সামনে দেখা হয়। সত্য অনেক চেষ্টা করে বলে, ‘আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?’
-বলুন

-এখানে না। একটু বাইরে আসুন।

-আচ্ছা আপনি আমার রুমে আসুন। বাইরে যাওয়া যাবে না।

সত্য ঐ মেয়ের পিছু পিছু যেতে লাগলো। এ দেখে আর সবাই বলাবলি শুরু করল, ‘’এই ছিলো ঐ মেয়ের মনে? মা এত দিন কত আগলে রাখলো আর আজ মা মরা দুদিন না হতেই ঘরে এক মিনশি তুলল?”

এসব কথায় কান না দিয়ে ওরা রুমে চলে গেল।

-এবার বলুন কি বলবেন?

-আপনার নাম?

-রিমা। রিমা রায়।

-আমি সত্য, সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

ঘরে মিটিমিটি আলো জ্বলে, চেহারা ভালো করে এতো ক্ষনে খেয়াল করা হয়নি, নাম শুনে রিমা তাই বাতি একটু উঁচু করে তুলে দেখে এ যে সত্য দা, যার খেলার ভক্ত, সারা ঘরে যার ছবি টাঙ্গানো। এত কাছে পেয়ে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

-আসলেই? সত্যদা?

-হ্যাঁ।

তারপর কিছু বলার আগেই নিজের শখের ঘরটা দেখালো। দেখানো শেষে হলে রিমা বলে উঠলো,

-আপনি এখানে কেন? আমার সাথেই বা কি দরকার?

-আসলে! আসলে!

-আসলে আসলে করছেন কেন? লজ্জা লাগছে বলতে যে আপনি এখানে আসেন?

-মানে, আমি সেদিন এসেছিলাম, হয়ত আপনার কেউ মারা গেছিলো, তাই আজ আবার আসলাম খবর নিতে?

-হ্যাঁ আমার মা মারা গেছে। এখন কি করুণা দেখাতে এসেছেন?

-না ঠিক তা নয়। তোমাকে সেদিন খুব ভালো লেগে যায়, এইটাই বলতে এসছি।

-তো?

-আমাকে বিয়ে করবে?

কথা শুনে থমকে গেলো রিমা রায়। এই প্রথম সব কিছু জানার পরে কেউ রিমাকে প্রস্তাব দিচ্ছে। কিছুক্ষন পরে রিমা বলে উঠলো, “আমকে কেন বিয়ে করবে? একজন পতিতার মেয়েকে?”

-জানিনা। হয়ত আকর্ষণ, যে টা আমি ফুটবল আর তুমি ছাড়া অন্য কারো কাছে পাই নি?

- একদিন তো আকর্ষণ কমে যাবে? তখন?

-দেখ সময় হলে একদিন আমাকে আর ফুটবল খেলতেও ডাকবে না, তখন আমাকে শুধু আমার অতীতের খ্যাতি নিয়েই বাঁচতে হবে। ঠিক তোমার আকর্ষণ টাও যদি কমে যায়, তখন অতীতের স্মৃতি নিয়েই চালিয়ে নেব,যাবে?

-জানিনা।

-আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

-এখান থেকে সহজে তো বের হতে পারব না। একটু দাড়ান আমি আমার ব্যাগ গুছিয়ে আপনাকে দিয়ে দেই, আপনি বাইরে থাকুন একটু দূরে, আমি আসছি।

কথামত তাই হলো। মুক্ত জিবনে ফিরে এলো রিমা। এরই মধ্যে রিমা কল্পনা করছে, তাঁর একটা স্বামী হবে, তাকে সেবা করবে, কিছুদিন পর একটা বাচ্চা হবে, সাজানো গোছানো একটা সংসার।

রিমা আর সত্য চলে এলো হোটেলে। পরেরদিন একটা ফুটবল ম্যাচ আছে, খেলে রওনা দিবে সেই সেনপাড়ার ২৪ নাম্বার লেনে।
সেদিন দুজনের মিলনের সময় সত্য রিমাকে বলে, ‘’আচ্ছা, তুমি আমার ভালো-মন্দ না জেনেই চলে আসলে?’’

-হুম।

-আমি তো অনেক মে……

রিমা ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, এখন তোমার চোখে আমার জন্য ভালবাসা আছে।‘’

-ওটা তো কামনারও হতে পারে?

-না, এ ভালোবাসার চোখ। এ চোখের ভাষা আমি এত দিন খুঁজেছি।

- আচ্ছা তোমার কি মনে হয় আমি প্রেমিক?

-বেশ্যার ঘরে যার বসবাস আর যার যাতায়াত সবাই প্রেমিক, তবে সেখানে কেউ প্রেমের খোঁজে প্রেমিক হয়ে যায় যায় না, যেখানে প্রেম থাকে না সেখানে মানুষ থাকে না, মানুষের পুরো শরীর টাই তো প্রেম।

-বাহ! আমার প্রেমবিদ বউ।

-যাও দুষ্টু।

পরের দিন সত্য আর রিমার সেন পাড়া ফিরে এলো। কয়েকদিন পর বিয়ে হলো। যে সত্য এতদিনে ভগবানের নাম গন্ধ করেনি সেই সত্য আজ ভগবান কে সাক্ষী করে সাত পাক ঘুরে বিয়ে করল।


বেশ সুখে যেতে ছিলো। কিন্তু ঐযে সত্যর এক খ্যাতি ছিলো। এতো বড় খ্যাতি যার পেছনে অনেক নিন্দুক থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেই নিন্দুকেরাই ছড়িয়ে দিল রিমার বংশ পরিচয়। তারপর আর ও পাড়ায় থাকা হয়নি সত্যর, সুপুরুষের মত বউ কে নিয়ে বের হয়ে এসেছে।

কল্লার সাথে অনেকদিন দেখা নেই।তবুও না দেখা করেই চলে যেত হল, সত্যকে।




ভালোবাসার মানুষের সাথে বেশ ভালোই দিন কাটছিলো, শুধু মাঝে মাঝে কল্লার কথা খুব মনে পড়ত। তবে বাবা হবার খবরে বেশ খুশিতেই ছিলো। আগ্রিম ছেলের জন্য জামা কাপড় থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়জনীয় সব কিছু কেনা শুরু করে দিলো।
হঠাত একদিন প্রসব ব্যাথায় কাতর হলে হাসপাতালে নিয়ে যায় সত্য। অপারেশন হয়, ফুটফুটে একটা ছেলে হয়, কিন্তু রিমার অবস্থা খারাপ।

সত্য রিমার সাথে দেখা করল।শেষে রিমা শুধু একটা কথা বলতে পারল, ‘’তোমায় পরিপূর্ণ ভাবে ভালবাসতে পারলাম না। সত্য।’’ বলেই কাঁদতে কাঁদতে নিশ্বাস ত্যাগ করল।সত্যর যেন চোখের সামনে অন্ধকার লাগলো।

হঠাতই পাশে পেল সেই বন্ধু কল্লাকে। হাসপাতেলের দপ্তরে কাজ করে।

কল্লা এখন কল্লল চৌধুরী। বিয়ে সাদি করে বেশ ভালোই ছিলো। আজ অনেক দিন পরে আবার সত্যর সাথে দেখা কিন্তু বড় এক অসময়ে। অসময়ে হলেও এই সময়েই কল্লাকে খুব দরকার ছিলো সত্যর।

শেষ কৃত্য সেরে, ১দিনের বাচ্চা সহ আবার হাজির হল সেন পাড়ার ২৪ নাম্বার লেনে।বাচ্চার নাম রাখলো শিবু। শিবাদত্ত বসু।

শিবার যখন ৫ তখন দাদা, আর ১০ এ দাদী গেল। সত্য বড় একা হয়ে গেলো। এদিকে শিবু বেড়ে উঠতে লাগলো অবাধ ভাবে।




এখন সত্যের পাশে কেউ নেই, একাই দিন কাটে, ছেলে বিদেশে। কল্লাও আর কল্লা নেই। কল্লল চৌধুরী হয়ে গেছে।
সকালে ১ কিলো হাঁটা, তারপর পুব জানালায় সূর্য দেখা সাথে রবীন্দ্রনাথ, এভাবেই দিন চলে যায়।

২৪ নাম্বার লেন বদলে গেছে সময়ের বিবর্তনে। পরিচিত মানুষ গুলো পিছে পড়ে গেছে। আজ আর সত্যর খ্যাতি নেই নিন্দুক নেই, কেবল অমর হয়ে থাকা টাইপ কিছু একটা আছে। তারপরেও সত্য একা।

সত্য এখন খুঁজে ফেরে রিমা রায় কে, অপূর্ণ ভালোবাসাকে, একমাত্র ছেলেকে, শৈশবের বন্ধু কল্লাকে… কিন্তু আজ কোথাও কেউ নেই…।

এভাবেই মানুষ গুলো একা হয়ে যায়, খ্যাতিমান মানুষ গুলো আরো বেশি একা হয়ে যায়।



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৯:০১

নীল-দর্পণ বলেছেন: কাহিনী কয়েকবার অভাবনীয় ভাবে মোড় নিলেও শেষ পর্যন্ত একদম সাবলীল ছিল। ভাল লেগেছে অনেক।

০১ লা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৪৭

রিফ্রাক্শন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:৪২

মাইনুল ইসলাম আলিফ বলেছেন: সহমত।
দক্ষতার সাথেই মোড় নেয়া গল্পের বাঁকগুলোকে খুব বেশি এলোমেলো হতে দেননি।


ভাল লেগেছে।শুভ কামনা।

০১ লা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৪৬

রিফ্রাক্শন বলেছেন: তেমন দক্ষ নই। তবুও চেষ্টা করেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.