নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে চাওয়া নকল মানুষ। নিজ ধর্মে বিশ্বাসী ধার্মিক। নিজ কাজে নির্ভরশীল শ্রমিক। দেশকে ভালবাসা এক দেশপ্রেমিক।মানুষে মানুষে সচেতনতা বাড়ুক, দেশ হোক উন্নত, সমৃদ্ধশালী। মানবতা আশ্রয় নিক হৃদয়ে।

রিফ্রাক্শন

আমি ঠিক আমার মতো। আমার ভাবনার মত। ভাবনাগুলোর যুক্তির মত। আমি যেগুলো তে বিশ্বাস করি সেই বিশ্বাস এর মত। আমি আমার রচিত সংবিধানের মত। আমি প্রেমিকা পাগল প্রেমিকের মত। কাজ পাগল শ্রমিকের মত। দায়িত্ব নিতে চাওয়া নেতার মত। অবশেষও আমি মানুষ আপনাদের মতই, আপনাদের মধ্যেই একজন।

রিফ্রাক্শন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বপ্নের পরিণতি

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:০৯

‘’জনি, তোর ভাইটাকে নিয়ে আজ নাপিতের কাছে নিয়ে যাস। দেখতে পুরো জঙ্গলি লাগছে। চুল গুলো আর্মি কাটিং আর ক্লিন শেভ করিয়ে নিয়ে আসবি। যতক্ষন নাপিত কাজ করবে পুরো দাঁড়িয়ে থাকবি। আজ বাদে কাল বাড়িতে একটা বড় অনুষ্ঠান অথচ দেখতে পুরো অসুস্থ লাগছে।‘’

‘’আচ্ছা বাবা, নিয়ে যাব।‘’

‘’খাওয়া শেষেই নিয়ে যাবি। সামনে এক সপ্তাহ ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিবি।‘’

আমি মাঝে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘’ কিসের কাজ আবার সামনে?’’

‘’ কি কাজ সেটাও জানোনা? কয়েকদিন বাদে বাড়িতে যে বিয়ে সে বিষয়ে তোমার কোন খোঁজই নেই?’’

আমি আর কিছু না বলে চুপ করে গেলাম। বাবা আবার বলা শুরু করলেন, ‘’ কিরে নিজের ছোট একটা ভাই অথচ নিজের বিয়ের কথা কিছুই জানাস নি? বিকেলে দুজনে বসে বিয়েতে কি কি খরচ হবে সব হিসেব আমাকে দিয়ে টাকা নিয়ে যাবি। আর কিভাবে কি করবি তা বলে যাবি। দুজনেই আসবি।‘’

‘’আচ্ছা বাবা। আসব। ‘’

জনি, আমার রক্তের সম্পর্কের বড় ভাই। সকালে খাবার টেবিলে বসে কথা গুলো বাবা বলছিলেন। অনেকদিন পর একটা ব্যাপারে ভালো লাগছে এই যে, বাবা আমার সাথে কথা বলছে। অনেকদিন হলো বাবা আমার সাথে কথা বলে না। আমাদের কথার মাধ্যম হলো আমার মা অথবা ভাই।

ভাই আমার থেকে ৩ বছরের বড়। বেশ সিরিয়াস ছাত্র। খুব পরিশ্রমী ছিলো। সে হিসেবে ফলও পেয়েছে। এখন নামকরা এক ডাক্তার। সচারচার এত অল্প বয়সে এত ভালো ডাক্তার হওয়া খুব কমই দেখা যায়। শুধু ভালো ছাত্রই নয় বলা যায় সংসারী ছেলে। সে হিসেবে আমি সম্পূর্ণ বিপরীত।

যদিও গর্বের বিষয় না তবুও বলছি, আমি কখনও নিজের প্লেট ধুয়েও খাইনি আবার খাওয়া শেষে ধুইও নি। অন্যদিকে মা কখনও বাড়িতে না থাকলে ভাই সব রান্না বান্না করত। আজকে সকালের রান্নাও ভাই করেছে। মা গেছেন তার মায়ের বাড়িতে। যতদিন থাকবে ঘরের কাজ নিয়ে চিন্তা নেই।

আমাদের সম্পর্কটা আর কয়েকটা পরিবারের ভাইদের মত স্ট্রং কিংবা দুর্বল না। এটা হওয়ার কারন, আমি যখন নিজেকে বুঝতে পারলাম তখন থেকেই ওর আর আমার মতাদর্শে মিলে না। হয়ত তখন ওর টাই ভালো ছিলো বলে আজ এত সফল, আর আমি!

বড় ছেলে কিংবা ছোট ছেলে বলে পরিবারে তেমন কখনও বিভেদ আমার চোখে পড়েনি। তবে, ভাই যখন মেডিকেল চান্স পেল তখন আমি সবে এস এস সি পাশ করেছি। রেজাল্টও তেমন ভালো হয়নি। তবে এ নিয়ে আমার টেনশন কখনই ছিলো না।

তবে একসাথে মাঝে মাঝে ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে ওর ক্লাসে সামনে গিয়ে দড়িয়ে ওকে জোর করে বেরিয়ে নিয়ে এসে যেতাম নদীর ধারে। ছুটিতে দুজনেই গেছিলাম আজনা পথে। ঘুরেছিও অনেক। তবে ও ওর পড়ালেখা টা ঠিক রেখেছিলো।

খাওয়া শেষে বাবার কথা মত ভাই আমাকে নিয়ে গেলো। আমি কোন কথা না বলে চুপ চাপ নাপিতের কাছে মাথা পেতে দিয়ে বসে থাকলাম। নাপিতের কাজ শেষ হলে ভাই জিজ্ঞেস করল, ‘’ কত হইছে?’’

-দেন ভাই, যা মনে চায়।

-১০ টাকা দেই?

-সে কাল কি আছে ভাই?

-তাইলে আপনিই বলেন।

-সব জায়গায় তো চুল কাটা আর শেভ করা নেই ৭০ টাকা, তবে এখন লাগবে ১১০ টাকা। যত চুল ছিলো মাথায়, কাটতেই ডাবল সময় লেগেছে।

আমি শুনে তো অবাক হয়ে গেলাম। যাই হোক কোন মতে বিল মিটিয়ে বাসায় এসে আয়নায় নিজেকে দেখতেই কেমন নিজের কাছে অচেনা অচেনা লাগছিলো। অজান্তেই বাচ্চা বাচ্চা লাগছিলো। বয়স ১০ বছর কমে গেলো এমন একটা ভাব। তবে অনেক দিন পর নিজেকে হালকা হালকা লাগতে ছিলো।

দুপুরের খাওয়া শেষে ভাই আমাকে ওর রুমে ডাকল। আমি বাধ্য ছোট ভাইয়ের মত গেলাম। বিস্তারিত সব কাহিনী শুনলাম। গত ৬ বছর পরিবার থেকে এতো বিচ্ছিন্ন ছিলাম যে বড় ভাই আমার একটা প্রেম করে, মেয়েটা কে এটাও জানিনা। আচ্ছা ও কি আমার কথা ওর প্রেমিকাকে কখনও বলেছে? জানিনা।

বিস্তারিত সব শোনার পর মনে হলো আসলে ডাক্তারদের লাইফ ই এমন। আরেকটা ডাক্তারকে বিয়ে করার জন্যই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে হয়ত, ওসব মানব সেবা দিয়ে যেসব ‘এইম ইন লাইফ’ রচনা লিখে নাম্বার পেয়েছে সে সব নাম্বার ঘুরিয়ে নেয়া উচিত।

তারপর ভাই বলল, ‘’ তোর একটা প্ল্যান বল বিয়ে নিয়ে?’’

-বিয়ে কবে?

-সামনে শুক্রবার।

-সময় কম। একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টকে দায়িত্ব দিয়ে দেই ওরা সব কাজ করবে। আমি দেখা শোনা করব। আর সবাইকে ইনভাইট করার জন্য একটা লিস্ট বানাতে হবে। সব আমি দেখব। তুমি এ কদিন রিলিফ থাকো। আমি সব সামলে নেব। শুধু শেষ বারের মত জমিয়ে প্রেম করে নাও বিয়ের আগে।

-তোর বন্ধু বান্ধব?

-আসবে। সমস্যা নেই বলে দেব।

-ওদের কি আলাদা কিছু লাগবে?

-কি যে বল ভাই, আমি এখন ওসব ছেড়ে দিয়েছি।

-তাই । ভালো তাহলে। মানুষ হ। বাবা মা তোর জন্য কত কষ্ট করেছে, এটাই কি প্রাপ্য ছিলো ওদের? যা নানির বাসায় থেকে মাকে নিয়ে আস। আমি এদিকে বাবার সাথে কথা বলছি।

-চাবি কই?

-টেবিলের ওপর। অখানে না থাকলে গাড়ির সাথেই আছে। আর শোন গাড়ি ধীরে চালাবি।

-আচ্ছা।



ধুমধাম করে বিয়ে টা হয়ে গেলো। কয়েকদিন ধরে অনেকদিন পরে পরিবারের মানুষের সাথে আবার খুব কাছে থেকে মিশতে পারলাম। আসলেই পরিবারের বাইরে সব কিছুই অনর্থক। তবুও আমরা সবাই কত না কতদিকের মোহে ছুটে চলেছি। পরিবারের কথা না ভেবেই গেছি অন্ধকারের পথে। ভরসা হারিয়েছে আশায় থাকা মানুষ গুলো।

আপাতত নতুন বউয়ের এদিক ওদিক বিভিন্ন দিকে ঘোরা শেষ। ঘরের বউ ঘরে এখন। নিয়ম হিসেবে পুরোনো হয়েছে। তবে আমার সাথে ঠিক এখনো ভাব হয়ে ওঠেনি। ঐ যে আগেই বলেছিলাম সবার সাথে সম্পর্ক গাড় হতে বেশ সময় লেগে যায়। আমার নিজে থেকে পরিচয় হওয়া হয়ে ওঠে না।

সেদিন বিকেলে বাসায় বাবা মা নেই। ভাই আর ভাবী দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাচ্ছে দেখে ছাদে আসলাম সিগারেট খেতে। অন্যান্য অভ্যাস গুলো বাদ গেলেও এটা এখনো আছেই। হয়ত এখান থেকেও একদিন বেরিয়ে আসব।

সিগারেটের ঠিক মাঝামাঝি, ঠিক এই সময় পেছন থেকে ক্যামারা ক্লিক করার শব্দ পেলাম। কিছুটা ভয় পেয়েই জলন্ত সিগারেট টা মাটিতে পড়ে গেল। আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি, আমার নতুন ভাবী। মনে মনে বললান, যাহ প্রথম থেকেই ব্যাড ইম্প্রেশন হয়ে গেল।

-কি ? দিনে কয়টা?

-না মানে?

-মানে বুঝনা?

মনে মনে ভাবলাম, এ কি এখন সেভাবে কথায় হয়নি আর আমাকে তুমি বলা শুরু করে দিলো, একটা ফরমালিটির তো দরকার ছিলো?

-এই তো ২/৩ টা।

-আচ্ছা।

ভাবী এবার একটু সামনে এসে নিজের সিগারেটের আগুন টা পা দিয়ে এমন ভাবে নিভালো অনেক চেইন স্মোকারও সেভাবে পারে না।

ধোঁয়া নিভিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘’ অবাক হলে নাকি?’’

-একটু।

-তোমার সব কিছুই শুনেছি। তাই তোমাকে তুমি করেই বললাম। কারন আমি তোমার চেয়ে বড়ও না আবার ছোটও না। তবে এখন বড়। আর ভাবী দেবরের সম্পর্কে এতো ফর্মালিটি থাকে না।

– না ঠিক আছে।

-আমার নাম জানো?

-জানি। তবে ভাবীকে ভাবী বলেই ডাকব, নাম জেনে কাজ নেই।

– কাউকে পরিচয় করানোর জন্য?

-ওরাও আমার ভাবী হিসেবে জানবে। যে আকাশের একটা ফুটফুটে সুন্দরী ভাবী আছে।

-কি ইয়ারকি হচ্ছে?

-না না সত্যই।

-সামনা সামনি এত বলতে নেই। চল নিচে যায়। কফি খাও?

-খাই। কিন্তু তুমি রান্না ঘরে ঢুকবে জানলে মা রাগ করবে। নতুন বউ বলে কথা?

-তা ঠিক কিন্তু আর কয়েকদিন গেলে মা আরো রাগ করবেন।

-তাহলে চল যাওয়া যাক।

-আমি কিন্তু কফি খারাপ বানাই না।

-ওহ তাই। ভাইয়া উঠছে নাকি?

-না উঠে যাবে।

দিন পনের যেতেই একটা অসম্ভব সুন্দর অনুভুতি কাজ করছিলো। সবার সাথে কত আপন হয়ে গেলাম আবার। ভাবী এসে সবাই কে আবার নতুন করে মাতিয়ে রেখেছে। সবাই যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে, ঠিক পাতাঝরা গাছে নতুন পাতা জন্মানোর মত।

নিজেকে নিয়ে আবার ভাবতে ইচ্ছা হলো। লাইফ নিয়ে নিজে বিস্তর ভেবে ঠিক করলাম, না ব্যাকলগ গুলো ক্লিয়ার করে নিতে হবে দ্রুত।

রাতে খাবার টেবিলে বসে বাবাকে বললাম, ‘’বাবা, কাল রাজশাহী যাব। ভর্তি হতে নতুন করে। কিছু টাকা লাগবে।‘’

-যাক শুভবুদ্ধি উদয় হলো। যাও তবে সাবধান। ওসবের দিকে আবার পা বাড়িও না। তাহলে এবার আর রক্ষা নেই।



নতুন করে ভর্তি হয়ে এসেছি কয়েকদিন আগে। কাল আবার যেতে হবে। পরশু থেকে ক্লাস শুরু। বাসার সবাইকে ছেড়ে যেতে কেমন জানি লাগছিলো। হয়ত এটাই অভ্যাস। নতুন করে বাচার প্রেরণা। রাতে খাবার সময় বাবা কিছু দিক নির্দেশনা দিলেন আবার। এর পর মা আর ভাইও কিছু দিলো। শেষে ভাবী বলে উঠল, ‘’ বাবা, আকাশের একটা বিয়ে দেয়া উচিত। তাহলে হয়ত ও আর ওসব দিকে যাবে না। মেয়েটা ওকে দেখে রাখবে। ‘’

বাবা বললেন,’’ এত দ্রুতই সংসারে ভাগীদার নিয়ে আসতে চাও?, তবে তোমার কথা ঠিক। তাহলে একটা মেয়ে দেখো।‘’

-মেয়ে তো বাবা দেখাই আছে। আপনি মত দিলে আমরা আগাব।

আমি আর মেনে নিতে না পেরে বললাম, বিয়ে করার বয়স হয়নি, আমি আর অন্য কিছু করব না। দেখে নিও।

এক কথা শুনতেই হাসির রোল পরে গেল সবার মাঝে।

সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমি যখন খেলা দেখতে লাগলাম, ভাবী এককাপ কফি বানিয়ে নিয়ে পাশে বসল।

-কি মন খারাপ?

-না।

-কত দিন লাগতে পারে যদি টানা ক্লিয়ার করতে পারো।

– ১ বছর।

-যাও, সুন্দর মত পড়ালেখা কর। আর প্রতিদিন কিন্তু বাসায় ফোন দেবে। বিশেষ করে আমাকে ফোন দিতে ভুলো না কিন্তু। কি হয় জানাবা।

– আচ্ছা ভাবী।

– আচ্ছা, ঐ মেয়েটার খবর কি?

-জানিনা।

-তাহলে কি নতুন কোন মেয়ে খুঁজব? নাকি আর কেউ আছে।

মনে মনে বললাম, এই প্রশ্ন যদি বন্ধুরা করত তাহলে বলতাম, ‘’ ও যাওয়ার পরে মাগী মানুষের এই বুক কিংবা পশ্চাতদেশ আমাকে আর টানেনা।‘’

-না ভাবী।

-মেয়টার নাম কি ছিলো?

– নিতু। উচ্চ সিজিধারী। হয়ত টিচার হয়ে গেছে।

-আচ্ছা যাই হোক, সকালে ট্রেন আছে, ঘুমিয়ে পড়।



ট্রেনে উঠতেই এক জুনিয়র ফোন দিয়ে বলল, ভাই রুটিন আপনাকে মেইল করেছি চেক করে নিয়েন।

সেই প্রথম বর্ষের কথা মনে পড়তে লাগলো। সেরকম ভালো ছাত্র না থাকা সত্ত্বেও ইঞ্জিনিয়ারিং এ সুযোগ হয়েছিলো। তবে এ দিকে নিজের কিছু প্যাশন ছিলো। সব মিলেয়ে সব মিলে যাচ্ছিলো।

সেদিন পৌঁছে কোনমতে খাওয়া দাওয়া করে সকালে ক্লাস চেক করে ঘুমালাম। অনেকদিন পরে সকাল ৮টাই ক্লাসে যাওয়া লাগবে।

পরের দিন ঠিকই উঠে গেলাম। কিন্তু অভ্যাস আর বদলালো না। পেছনে বসে গেলাম। স্যার আসতে দেরী দেখে হেড ডাউন দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

কখন যে টিচার চলে এসেছে তাও খেয়াল করি নি। রুটিন ও সেভাবে দেখিনি কার ক্লাস ছিলো। পরিচিত কোন স্যার হলে সমস্যা।

একটু পরেই দেখি, কে যেন এসে আমাকে ডাকছে। আমি বারবারই সেভাবে নিচ্ছি না।

-এই ছেলে যাও ফ্রেশ হয়ে আস। ক্লাস ঘুমানোর জায়গা না।

-ক্লাসই আসল ঘুমানোর জায়গা।

এর পর চোখে পানির ছিটা পেয়ে দাঁড়িয়ে কিছু না বুঝেই বলে উঠলাম, ইয়েস স্যার।

ক্লাসে হাসির রোল উঠে গেল। বন্ধুরা হলে এটেনডেন্স দেয়ার আগে ডেকে দিত। এরা নতুন জুনিয়র বুঝে উঠতে পারে নি।

চোখ মুছেই সামনে দেখি নিতু। নিতুও আমাকে দেখে অবাক। কিছুক্ষন পরস্পরের দিকে চেয়ে থেকে নিতু চোখ ছড়িয়ে নিলো। কতদিন পর সে অনুভুতি। মেয়েটার চোখে একসময় প্রচুর মায়া বৃষ্টি হয়ে পড়ত, কিন্তু তারপরে তা শিলা বৃষ্টি হয়ে গেলো।

নিতু সামনে যেয়ে বলল, আজ তো প্রথম ক্লাস। আমি কিভাবে বলে দেই। আর আমার ক্লাসে ঘুমানো যাবে না। ক্লাস ভালো না লাগলে চলে যাবে। এটেন্ডেন্স এর ভয় নেই। এটা শুধুই দেখানোর জন্য।

নিতু বের হয়ে যাওয়ার সময় বললাম, ম্যাম আমার প্রেজেন্ট টা?

-আমার রুমে এসো

পৃথিবীতে কত পরিণতি হতে পারে। এক সময় যার চোখে চোখ রেখে মায়ার বৃষ্টিতে ভিজেছি, হাতে হাত রেখে কত পথ হেঁটে গেছে, কত চুম্বনে গৌধুলি পার করেছি তার সাক্ষী আছে আমার সৃষ্টিকর্তা আর রাজশাহীর উদম পদ্মা, তাকেই আজ ম্যাম বলে ডাকা লাগছে। যদিও প্রেমের সে ক্ষনে কত কিছু বলে ডেকেছি। তবে এ ডাক আর সে ডাকের মধ্যে বিস্তর তফাত।

নিতু ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে আমি পিছু হাঁটা শুরু করলাম।



নিতুর সাথে আমার পরিচয় সেই পিচ্চি কাল থেকে। পিচ্চি কাল মানে হাইস্কুল থেকে। যদিও এক স্কুলে পড়তাম না, কোচিং ক্ষেত্রে পরিচয় হয়েছিলো। কোচিং শেষে এক সাথে বাসায় ফিরতাম। আমাদের দুজনের বাসা ছিলো দুদিক। তবুও আমি ঘুরে ওরা বাসার রাস্তার ওদিকে দিয়ে আসতাম। সত্য কথা বলতে প্রেম ভালোবাসা কি তখন বুঝিও নাই। বা আমার মনে প্রেম করার মত যে ব্যাপার আসবে সে দিকেও কখনও ভাবি নাই। ওর সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মত।

ওর প্রথম রজচক্র থেকে শুরু ব্রা’ এর সাইজ পরিবর্তন সবই আমি জানতাম। মাঝে মাঝে অবাক হতাম যে একটা মেয়ে যে কথা গুলো মেয়েদের বলবে, কিংবা মেয়েলি কিছু ব্যাপারে মা কে জানাবে কিন্তু আমি তো ওর ছেলে বন্ধু, একটা ছেলে বন্ধুকে এসব বলে কিভাবে? তাহলে আমার ভেতরে কি মেয়েলি ব্যাপার আছে নাকি? জানিনা, তবে ধীরে ধীরে যখন বড় হতে থাকলাম, আমাদের সম্পর্কটা অন্যরুপ নিলো। একই কলেজ থেকে একই সাথে একই ভার্সিটি এমনকি একই ডিপার্টমেন্টের ওর সাথে পথচলা হয় কাকতালীয় মনে হয়।

ক্যাম্পাসে প্রথম একবছর আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক টা হঠাত করেই চেঞ্জ হয়ে গেলো। আমরা কিভাবে যে দুজন দুজনের কাছাকাছি চলে আসলাম তা মনের অগচরে চলে গেছিলো। তখন একটা বিষয় ছিলো ও আমার পাশে আছে। সারাজীবন ওকে পাশে পাওয়ার এক স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু সে স্বপ্ন আমার এক মুহূর্তে ভেঙ্গে গেলো ৩য় বর্ষের প্রথম।

আমি ঠিক ভাবে ক্লাসে যেতাম না, সারা রাত ঘরে বসে নিজের আবাগের কিছু কাজ করতাম, বিকেলেও ঘুমাতাম। ওকে যেখানে সপ্তাহে আগে প্রতদিন ১০/১২ ঘন্টা সময় দিতাম, তার একটা র‍্যাপিড চেঞ্জ হয়ে গেছিলো। রেজাল্টও খারাপ হয়ে গেছিলো। অন্যদিকে নিতুর ছিলো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

এরকম কিছুদিন চলার পর নিতু আমাকে অনেক বুঝিয়েছে, আমি ওকে দোষ দেব না। বিয়ে হওয়ার আগে একটা মেয়ে কেন এতো দায়িত্ব নেবে আমার? ওরও জীবন আছে।

একসময় আমাদের জীবনের একটা সম্পর্কের টানাপোড়ানে সম্পর্কটা আর থাকলো না।

আমি তখন এমনিতেই হতাশ ছিলাম, তারপরে এতোদিনের প্রিয় মানুষ টা আর সাথে থাকছে না। তখন ওর প্রতি খুব রাগ হচ্ছিলো। এই একটু একটু রাগে রাগে চলে গেলাম অন্ধকার পথে।

একসময় আমি যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নেশার পথে চলে যেত তাকে অনেক গালমন্দ করতাম কিন্তু তখন আমিও সেই পথেই গেলাম। ধীরে ধীরে পরিবারের সাথে দূরত্ব, মন থেকে সব আবেগ চলে গেছিলো। তখন মনে হত এক বোতল মদ যে পরিমান স্বস্তি দিতো, প্রেমিকার চুম্বনেও সে প্রশান্তি টা দিতো না। একদম নিজের থেকে হারিয়ে গেছিলাম।



নিতুর রুমে যেয়ে নিতু আমাকে বসতে বলল।

-ম্যাম আমার এটেন্ডেন্স?

-বস। রোল কত?

-রোল টাও ভুলে গেছেন?

-না ভুলিনাই। তাহলে এতোদিন পর কি মনে হলো?

-জুনিয়র দের মুখে তোমার অনেক নাম শুনলাম, তুমি অনেক সুন্দর ক্লাস নাও। তাই তোমার ক্লাসের জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম।

-তুমি আর শুধরালে না।

-শুধরে গেলে আজ তোমার অফিসে না, তোমার বেড্রুমে থাকতাম।

-বাদ দাও ওসব কথা।

-আচ্ছা দিলাম।

-বর্তমান অবস্থা বলো কি করছ?

আমি আমার বর্তমান অবস্থা বললাম।

-বিকেলে ফ্রি আসো?

-আছি।

-তাহলে আমার বাসায় আসো।

-কেন? তোমার বাসায় যাব কেন?

-এখন তো আর তোমার সাথে ঘুরতে যাব না তাই না? এখন তুমি আমার স্টুডেন্ট। তাই বাসায় আসো।

-আচ্ছা।

নিতুর রুম থেকে ফিরে নিজেকে কেন জানি আবার নিতুর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে হলো। আবারো সেই হাত ধরে হেঁটে যেতে চাই বহুদুর, আবারো পদ্মাকে সাক্ষী রেখে গৌধুলিতে ওর ঠোট কলঙ্ক আঁকতে চাই।

বিকেল বেলা নিতুর দেয়া শার্ট টা পরে ওর বাসায় গেলাম। ওর সাথে যখন সম্পর্ক ছিলো না, তখনও পরতাম কিন্তু এভাবে আবেগ আসত না।

নিতুর বাসায় ঢুকেই ও আমাকে বসতে দিয়ে ও ভেতরে গেল। সুন্দর ছিমছাম গোছানো একটা বাড়ি। যে কেউই এরকম একটা বাড়িতে থাকতে চাইবে।

পেছন থেকে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে আমাকে দিলো নিতু।

আমি বললাম, ‘’আমাকে ডাকছিস কেন?’’

-পুরনো প্রতিশোধ নেব তাই। বাহ কি সুন্দর চেঞ্জ। সকাল বেলা আপনি তুমি?এখন হঠাত করে আগের মত হয়ে গেলি?

-ওহ। না তেমন কিছু না। যাই হোক, তোর মনের ভেতরে যে স্বার্থপর ব্যাপারটা ছিলো? সেটা কি আছে?

-জানিনা। পরে আর কেউ বলেনি।

-তুই তখন আমাকে না ছেড়ে গেলেও পারতি।

-তোকে ছাড়া আমার ক্লাস, লেখাপড়া, একা একা বিকেল গুলো কত কষ্টে গেছে তা তোকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু তখন তোকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। একা থাকা টা যে কত কষ্টের সেটা সেন তুই বুঝিস।

-কিন্তু আমি বুঝি নাই।

-আমি কিন্তু তোর অপেক্ষায় ছিলাম। পরেরদিনই হয়ত তুই এসে আমাকে বলবি চল হেঁটে আসি। কিন্তু না দিন গেছে তুই আর আসিস নাই।

-তখন তোর চেয়ে বড় সঙ্গী পেয়ে গেছিলাম। সঙ্গী মানে আবার মেয়ে মনে করিস না।

-তোকে যে কোন মেয়ে ভালোবাসবে না এটা আমি জানি। আর এও বলতে পারি তোর এখনো কারো সাথে কোন সম্পর্ক নেই।

-আচ্ছা বাদ দে।

-আচ্ছা। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

এটা বলে নিতু হাতে ফোন নিয়ে কাকে যেন টেক্সট করল। মনের ভেতরে অজান্তেই ভয় হয়ে গেলো।

নিতু বলল,’’ তোর ফোন আসবে এখনি’’

নিতুর কথা মতই আমার ফোনে ফোন আসল। ভাবী ফোন দিয়েছে?

-হ্যাঁ ভাবী?

-কি ভাইয়া কোথায়?

-এইত বাসায়।

-নিজের বাসায় নাকি …

-না মানে…

-ওটাই কি নিজের বাসা বানিয়ে নিচ্ছ?

-আরে কি যে বল ভাবী!

– শোন, তোমাদের কাবাবে আর হাড্ডী না হই। নিতু আমার ক্লোজ বান্ধবীর বোন। আমার খুবই ক্লোজ। তোমরা কথা বলো। রাতে ফোন দিও, কি হয় জানিও।

তারপর নিতুর সাথে আবেগ, অনুভুতি, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা বলে আসছিলাম। জীবনে যেন সব কিছু পূর্ণতা পেয়ে যাচ্ছিলো।

একবছর পর

আগামীকাল ১ টা পরীক্ষা দিলে, আপাতত ৭ বছরের ভার্সিটি লাইফ শেষ হবে। বাকি গুলোতে নিতুর কাছে দেখিয়ে নিয়ে পাশ করে গেছি। আমাদের সম্পর্কটাও আগের মত হয়ে গেছে। কালকের পরীক্ষা নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। কালকের পর থেকে সব বাস্তবায়ন করব।

পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে দেখি নিতু আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সাথে ব্যাগ। দূর থেকে ভাবলাম, আমার সাথে ট্যুরে যাবে নাকি? কিন্তু সেটা আজকে কেন? তাহলে কি কোন দুর্ঘটনা? কিন্তু নিতু কিছুই বলল না।

কোন কথা না বলেই বাড়ির উদ্দেশ্য নিয়ে বাসে উঠলাম। ওকে যতই জিজ্ঞেস করি না কেন কিছুই বলে না। আমিও কিছু বললাম না। কিছু ক্ষণ পর নীতু ঘুমিয়ে গেল। আমার কাছে যে ফোন নেই তা তখনও আমার মনে নেই। আবার নীতুর ফোনেও দেখি চার্জ নেয়।

বাস থেকে নেমে নীতু বলল, ‘’অটো নে, তোর বাসায় যেতে হবে আগে।‘’

অটো থেকে নেমে বাসার সামনে দেখি ভীষণ লোক সমাগম। মনের ভেতরে কয়েকটা প্রশ্ন, বাবা, মা নাকি ভাবী? অথচ মন যাকে কল্পনায় আনেনি সেই আমার ভাই।

ওর মুখটা দেখার সময় ওর ‘’গাড়ি ধীরে চালাস’’ কথা টি কানে বাজতেছিলো, অথচ আজ একই কারনে চলে গেল ও।



দাফন কাফন শেষে বাসায় ফিরে আসলাম। এলাকার কিছু মহিলা এসেছে ভাবিকে সাদা শাড়ি পরাতে। এই সময়ে এত কুসংস্কার মেনে চলে। এ নিয়ে কিছুটা হট্টগল হয়ে গেলো।

সেদিন ভাবীর কথা খুব মনে হচ্ছিলো। কত স্বপ্ন নিয়ে এক বছর আগে ফুটফুটে একটা মুখ নিয়ে এসেছিলো। আজ এক বছরে সে মুখে অনেক দায়িত্বের ছাপ পরে গেছে, চঞ্চলতা কমে গেছে। শেষবার যখন বাড়িতে এসেছিলাম, ভাবী আমার বিয়ে নিয়ে কত প্ল্যান করে রেখেছিলো। অথচ সব শেষ হয়ে গেলো। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ভাবীর এই মুখটা, মেনে নিতে পারছিলাম না।

চোখের সামনে শুধু একরাশ স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার দৃশ্য। ঠিক যেমন ভুমিকম্পের সময় চোখের সামনে বড় কোন বিল্ডিং ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।

তাহলে কি আমাদের স্বপ্ন দেখা দোষ যদি সৃষ্টিকর্তা এমন খেলাই খেলবেন।

আমি একটা সুন্দর পরিবারের স্বপ্ন দেখেছিলাম। বাবা মা ভাই ভাবী আমি আর নিতু। সাজানো গোছানো সংসার হবে। বাবা মা হয়ত নাতিদের নিয়ে স্বপ্ন দেখত। ভাবী হয়ত পরিবারের গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন দেখত। সবাইকে নিজের করে আগলে রাখত। কিন্তু এইত কয়দিন পরেই একটা সাদা শাড়ি পরে নেবে, সমরেশের কথা অনুযায়ী, রঙ্গিন শাড়ি নাকি বিধবার মনে চঞ্চলতা তৈরি করবে তাই সাদা শাড়ি পরতে হবে।

একবার যে স্বপ্ন আমাকে বাঁচিয়েছে , হয়ত নতুন কোন স্বপ্ন দিয়ে ভাবীকে বাচিয়ে রাখব। স্বপ্নই তো আমাদের কে বাঁচিয়ে রেখেছে।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৫:১১

মা.হাসান বলেছেন: খুব ভালো লেগেছে। মৃত্যুতে জীবন থেমে থাকে না, ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে আসা জীবনের বড় দিক। সকলের জীবন সুন্দর হোক।

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১২:০৪

রিফ্রাক্শন বলেছেন: সবার জীবন সুন্দর হোক এটাই কামনা।

২| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:১৯

রাজীব নুর বলেছেন: আহারে----

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১২:০৫

রিফ্রাক্শন বলেছেন: ধন্যবাদ। অনেকদিন ধরে এখানে ঢুকতে পারছিলাম না। যাই হোক শেষে ঢুকতে পারলাম।

৩| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:২৭

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: স্বপ্ন যে সব সময় স্বপ্নের মতো হয় না!, তাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এমন ঘটনা!


ভাল লাগলো।

+++

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১২:০৬

রিফ্রাক্শন বলেছেন: ধন্যবাদ। স্বপ্ন ভাঙ্গা গড়ার খেলায় আমরা খেলনা মাত্র।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.