নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আম জনতার একজন।

ইছামতির তী্রে

I have a dream.

ইছামতির তী্রে › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, সুপন্ডিত অধ্যাপক পি. কে. হিট্টির দৃষ্টিতে মহানবী সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী-(১ম পর্ব)।

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০৬

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নাম উচ্চারিত হলে দরুদ শরীফ পড়া সকল মুসলমানদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।]

৫৭১ খ্রিস্টাব্দে বা ঐ সময় নাগাদ আরবের মক্কায় কোরাইশ বংশে জন্ম একটি পুত্র সন্তানের। মা আমিনা পুত্রের যে নাম দেন তা চিরকালের জন্যই ছিল নিরুপিত। তাঁর স্বজাতির লোকেরা তাকে আল-আমিন (বিশ্বাসী) বলে ডাকত। ‘আল-আমিন’ ছিল আপাতদৃষ্টিতে একটি সম্মানজনক উপাধি। কোরআনে (৩:১৩৮, ৩৩:৪০, ৪৮:২৯, ৪৭:২) তাঁর নামটি মুহাম্মদ রুপে উল্লেখিত হয় এবং এবং শুধু একবার (৬১:৬) আহমাদ বলে উল্লেখিত হয়েছে। মানুষের মুখে মুখে মুহাম্মদ (উচ্চপ্রশংসিত) নামটিই চালু ছিল। আর এই নামেই নামকরণ করা হতো অধিকাংশ পুত্রসন্তানের। মুহাম্মদের বাবা আব্দুল্লাহ তাঁর জন্মের আগেই মারা যান, আর মা আমিনা মারা যান যখন শিশুটির বয়স মাত্র ছ’বছর। ফলে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিবের উপরই শিশুটিকে লালন-পালনের দায়িত্ব এসে পড়ে। দাদার মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই এই দায়িত্ব এসে বর্তায় তাঁর চাচা আবু তালিবের উপর।

মুহাম্মদের বয়স যখন ১২ বছর, তখন তিনি তাঁর চাচা ও পৃষ্ঠপোষক আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়া অভিমুখে ব্যবসায় উপলক্ষ্যে যাত্রা করেন। এই যাত্রাপথেই তাঁর সঙ্গে একজন খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর সাক্ষাত হয় এবং প্রচলিত লোককাহিনী অনুযায়ী জানা যায় যে, তার নাম ছিল বাহিরা।

যদিও বিশ্বের ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে এই একজনই ইতিহাসের পরিপূর্ণ আলোকের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবুও তাঁর প্রথম জীবন আমাদের কাছে খুব অল্পই পরিচিত। জীবিকার জন্য তাঁর সংগ্রাম, আত্বার পরিপূর্ণতা লাভের জন্য তাঁর প্রচেস্টা, তাঁর জন্য অপেক্ষমান মহাদায়িত্ব সম্পর্কে তাঁর ক্রমাগত কস্টকর উপলব্দি সম্পর্কে খুব অল্প বিশ্বাসযোগ্য বিবরণই আমাদের কাছে আছে। যাইহোক, ২৫ বছর বয়সে মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর চেয়ে ১৫ বছরের বড় ধনবতী ও উদারমনা বিধবা মহিলা খাদিজার বিয়ে হয়। আর এরপরই মুহাম্মদ ইতিহাসের আঙ্গিনায় আবির্ভূত হন। খাদিজা ছিলেন কোরায়েশ বংশজাত একজন ধনী ব্যবসায়ীর বিধবা স্ত্রী। তিনি স্বাধীনভাবে ব্যবসা চালাতেন। তিনি যুবক মুহাম্মদকে তাঁর ব্যবসার কাজে নিয়োগ করেছিলেন। যতদিন সেই প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী ও মহান চরিত্রের অধিকারিণী মহিলা জীবিত ছিলেন, ততদিন মুহাম্মদের আর অন্য কোন স্ত্রী-র প্রয়োজন দেখা দেয়নি।

মুহাম্মদের জীবনে যে অর্থনৈতিক প্রাচুর্য দেখা দিল এবং কোরআনে যার উল্লেখ আছে, তা মুহাম্মদকে বেশ কিছুটা অবসরের সুযোগ এনে দিল। ফলে, মুহাম্মদ তাঁর নিজের ধর্মানুরাগের অনুশীলন করতে সক্ষম হলেন। তখন প্রায়ই তাঁকে নির্জনে বসে থাকতে দেখা যেত এবং মক্কার বাইরে হিরা নামের পাহাড়ের ওপর একটি ছোট গুহায় তিনি ধ্যানে বসতেন। সংশয়ের দ্বারা তাড়িত ও সত্যের আহবানে উদ্বুদ্ধ্ব হয়ে তিনি সংসার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন এবং এই বিচ্ছিন্ন জীবনকালের অধ্যায়গুলির একটিতে মুহাম্মদ ‘গারে হিরা’-তে বসে একটি আদেশ’ শুনলেনঃ

“যে আল্লাহ তোমার সৃষ্টিকর্তা তুমি তাঁর নামে পাঠ কর”।

এটাই ছিল তাঁর প্রথম প্রত্যাদেশ বা দৈববলে লব্ধ জ্ঞান। আল্লাহর প্রেরিত ধর্মপ্রচারক তাঁর আহবান শুনেছেন। ঐ দিনের রাতটির পরে নামকরণ হয়েছিল ‘ক্ষমতার রাত’ (লাইলাতুল ক্বদর), রমযান মাসের (৬১০) শেষদিকে এটি নির্দিষ্ট হয়েছিল। এই অকল্পনীয় ঘটনার অল্প কিছুদিন পরেই যখন আবার দ্বিতীয় প্রত্যাদেশ এল, প্রবল আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়ে মুহাম্মদ বিপদাশংকায় বাড়ি চলে এলেন এবং তাঁর স্ত্রীকে দেহটি আবরণের দ্বারা ঢেকে দিতে বললেন, যার ফলে নিম্নোক্ত শব্ধগুলি নেমে এলঃ

“তুমি আংরাখায় আবৃত হয়ে থেকো না? জাগো ও বিপদের আশঙ্কা সকলকে জানিয়ে দাও”।

কন্ঠের সেই আওয়াজগুলি কখনো জোরে, কখনও আস্তে ধ্বনিত হল, এবং সেই শব্দ কখনও ‘ঘন্টাধ্বনির’ (সালসালাত আল-জারাস) মতো প্রতিধ্বনিত হল। কিন্তু পরে মদিনায় সূরা-তে তা একটি আওয়াজে পরিণত হলো এবং সেই আওয়াজ জিব্রাইলের কন্ঠস্বর বলে প্রতিভাত হল।

ওল্ড টেস্টামেন্টের হিব্রু ধর্মপ্রচারকদের মতো আরবীয় নাগরিক মুহাম্মদ ও তাঁর আহবান বাণীর দিক থেকে প্রকৃত অর্থেই ছিলেন রাসূল। আল্লাহ এক। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনিই এই বিশ্বজগতের স্রস্টা। বিচারের একটি নির্দিষ্ট দিন আছে। যারা আল্লাহর আল্লাহর আদেশ আদেশ অমান্য করেন তাদের জন্য নরকে অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। এটাই ছিল তাঁর প্রথম দিককার বাণীর সারাংশ।

আল্লাহর রাসূল হিসেবে নতুন কাজে নিজেকে উতসর্গ করার পর মুহাম্মদ তাঁর নিজের মানুষদের মধ্যে নতুন বাণীর প্রচার, প্রসার ও শিক্ষার কাজে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তারা তাঁর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্রুপের বাণ হানতে লাগল। ফলে, তিনি নিজেকে নাযীর (কোরআন ৬৭.২৬; ৫১.৫০, ৫১), সতর্কতাকারী ও শেষ বিচারের তত্ত্ববাহকরুপে বেহেশতের মনোরম বর্ণনা এবং দোযখের ভীতিপ্রদ অবস্থা বর্ণনা করে তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তাঁর শ্রোতাদের আসন্ন বিপদের ভয় দেখিয়ে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের চেস্টা করেছিলেন। তাঁর প্রথম দিকের প্রত্যাদেশগুলি বা মক্কার সূরাগুলি ছিল সংক্ষিপ্ত, স্পস্ট, অভিব্যক্তময় ও প্রভাবশালী।

আল্লাহর আরাধক, তাঁর বান্দাদের সতর্ককারী, আল্লাহর দূত ও নবী হিসেবে মুহাম্মদ বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে ধর্মান্তরিত করেন। তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে-নওফেলের প্রভাবে মুহাম্মদের স্ত্রী খাদিজা আগেই ধর্মে অনুরাগী হয়ে পড়েছিলেন এবং মুহাম্মদের আহবানে প্রথমে যে কয়েকজন সাড়া দিয়েছিলেন, খাদিজা ছিলেন তার অন্যতম। মুহাম্মদের চাচাতো ভাই আলী ও তাঁর নিকটাত্বীয় আবু বকর তাঁর অনুসারী হলেন। কিন্তু কোরায়েশ বংশের উমাইয়া শাখার অভিজাত ও প্রভাবশালী প্রতিনিধি আবু সুফিয়ান এই ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান। তারা যাকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধিতা বলে গণ্য করত তা আসলে একটি প্যান-এর্যারবিয়ান তীর্থযাত্রার কেন্দ্র ও বহুসংখ্যক দেবতার মন্দির আল-কা’বার রক্ষক কোরায়েশদের চরম আর্থিক স্বার্থের বিরুদ্ধেই ছিল।

প্রধানত ক্রীতদাস ও নীচু শ্রেণীর মানুষদের মধ্য থেকেই ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা এই নতুন ধর্মবিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে লাগল। আর কোরায়েশ গোষ্ঠীর তরফ থেকে তাঁর সম্পর্কে বিরামহীনভাবে যে উপহাস ও ব্যঙ্গ ব্যবহত হচ্ছিল, তা আর অস্ত্র হিসেবে তেমন কার্যকরী ছিল না। ফলে প্রত্যক্ষ নির্যাতনই প্রয়োজন হিসেবে দেখা দিল। এর ফলে মক্কার ১১টি পরিবার আবিসিনিয়াতে গমন করল এবং একই পথ অনুসরণ করে আরো ৮৩টি পরিবার ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে দেশত্যাগ করে আবিসিনিয়াতে আশ্রয় নিল। উসমান-ইবনে আফফানের পরিবারটি ছিল তাদের মধ্যে প্রধান। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী নেগাস-এর রাজত্বে তারা শরণার্থীরুপে আশ্রয় নিল। এই আশ্রয়প্রার্থীদের তাদের অত্যাচারীদের হাতে তুলে দেবার অনুরোধ নেগাস অনমনীয় দৃঢ়তার সঙ্গে বার বার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নির্যাতনের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কালে সাময়িকভাবে তাঁর বহু অনুগামীকে হারালেও মুহাম্মদ ভয়ডরহীনভাবে তাঁর ধর্মপ্রচার চালিয়ে যেতে লাগলেন এবং মেকী দেবতার পূজা থেকে সরিয়ে এনে আলোচনার মাধ্যমে অনেক মানুষকে এক ও প্রকৃত ঈশ্বর অর্থ্যাৎ আল্লাহর অনুরাগীতে পরিণত করলেন। আল্লাহর প্রত্যাদেশ নেমে আসা বন্ধ হল না।

ইসলামি রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে ওমর-ইবনে-আল-খাত্তাব অগ্রণি ভূমিকা পালন করেছিলেন, শিগগীরই তিনি আল্লাহর সেবায় নিযুক্ত হলেন। হিজরতের তিন বছর আগে বিশ্বস্ত অনুগামিনী ও স্ত্রী খাদিজার মৃত্যু হল এবং তার অল্প কিছুদিন পরে আবু তালিব মারা গেলেন। যদিও আবু তালিব কখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি, তবু শেষ অবধি তিনি তার ভাইপো মুহাম্মদের পক্ষে দাড়িয়েছিলেন। হিজরত-পূর্ব এই সময়েই সেই নাটকীয় ইসরা (মিরাজ শরীফ) মানে সেই নৈশ অভিযান ঘটেছিল। বলা হয়, সপ্তম স্বর্গে আরোহণের সময় মুহাম্মদ নাকি চোখের পলকে আল-কা’বা থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। এই স্মরণীয় যাত্রার ক্ষেত্রে যেহেতু একটি পার্থিব স্টেশনের ভূমিকা পালন করেছিল, তাই ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মাঝে ইতিমধ্যেই পবিত্র শহর বলে পরিগণিত জেরুজালেম মুসলিম দুনিয়ায় মক্কা ও মদিনার পরে তৃতীয় পবিত্র শহর বলে গণ্য হল এবং আজও তার সেই স্থান বজায় আছে। নানা সাজে অলংকৃত এই অত্যাশ্চর্য যাত্রা এখনও পারস্য ও তুর্কির অলৌকিক কাহিনীকারদের কাছে অতি প্রিয় বিষয়বস্ত হিসেবে গণ্য হয়। একজন স্পেনীয় গবেষক মুহাম্মদের এই যাত্রাকেই দান্তে রচিত ডিভাইন কমেডির মূল উৎস বলে বর্ণনা করেছেন।

৬২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মূলত খাজরাজ উপজাতিভূক্ত বেশ কিছু ইয়াসরিবের অধিবাসী ওকাজ মেলায় মুহাম্মদের সঙ্গে দেখা করেছিল এবং তিনি যা বলতে চান তা শোনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। দু’বছর পরে প্রায় পঁচাত্তর জনের এক প্রতিনিধিদল তাকে ইয়াসরিবে (মদিনা) বাস করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আশা ছিল যে, এর মধ্য দিয়ে তারা পরস্পর বিরোধী আওস ও খাজরাজ উপজাতির মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে পারবে। মদিনার ইহুদিরা একজন মেসিয়া বা রক্ষাকর্তার অপেক্ষায় ছিল, তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসহীন স্বদেশবাসীর মধ্যে মুহাম্মদের মত আল্লাহর রাসূল বলে দাবিকারী এই ধর্মপ্রচারকের ধর্মীয় বিশ্বাসে পূর্বেই অনুরক্ত হয়েছিল। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে তায়েফে তার সফর ব্যর্থ হবার পর, ‘তার উদ্দেশ্য তার নিজের জন্মস্থানেই অসফল হয়েছে’ এই বিশ্বাসে মুহাম্মদ তাঁর দুশো অনুগামীকে কোরায়েশদের সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে পালাতে দিলেন এবং তিনি নিজেও চুপিসারে মদিনায় চলে গেলেন। মদীনার সঙ্গে তাঁর মায়ের দিক থেকে ক্ষীণ সম্পর্কে ছিল। তিনিও বেরিয়ে পড়লেন এবং ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর সেখানে পৌছলেন। এই হল বিখ্যাত হেজিরা (হিজরত)। ১৭ বছর পর খলিফা ওমর সেই চন্দ্র বছর (১৬ জুলাই তার শুরু) অর্থ্যাৎ যে বছরে হিজরত ঘটেছিল, তাকেই মুসলিম যুগের আনুষ্ঠানিক সূচনাবর্ষ বলে আখ্যা দেন।

হিজরতের সঙ্গে মক্কা অধ্যায়ের সমাপ্তি ও মদীনা অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল এবং তা মুহাম্মদের জীবনে এক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। অসম্মানিত হিসেবে তাঁর জন্মস্থান পরিত্যাগ করে তিনি এমন এক শহরে প্রবেশ করেছিলেন, যারা তাঁকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে গ্রহণ করে। তাঁর অন্তর্নিহিত ভবিষ্যতদ্রস্টার সত্তা এখন পেছনে চলে গেল এবং সামনে এগিয়ে এল রাজনীতির জ্ঞানসম্পন্ন ও বাস্তব বুদ্ধির অধিকারী এক মানবসত্তা। আল্লাহর রাসূলের ভূমিকাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিল রাস্ট্রনীতিকের কার্যকলাপ।

পবিত্র যুদ্ধের সাময়িক বিরতির সুযোগ গ্রহণ করে মোহাজিরদের অস্তিত্ব রক্ষায় উদ্ভিগ্ন মদিনার মুসলিমরা, তখন আনসার বলে পরিচিত, তাদের নতুন নায়কের নেতৃত্ব সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরে আসার পথে গ্রীস্মকালের এক মরুযাত্রীদলের গতিরোধ করেন। আর এইভাবেই তারা ঐ বাণিজ্য-শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঘাত হানেন। মরুযাত্রীদলের নেতা আবু সুফিয়ান এই পরিকল্পনার গন্ধ পেয়ে সাহায্যের জন্য মক্কার কাছে অতিরিক্ত সৈন্য চাইলেন। সেই অতিরিক্ত সেনাবাহিনী ও মদিনার মুসলিম ও আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের রমযান-এ মদিনার ৮৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বদরে এই সংঘর্ষ ঘটে। মুহাম্মদের উদ্দীপ্ত নেতৃত্ব তিনশো মুসলিম এক হাজার মক্কাবাসীর সঙ্গে প্রবল বিক্রমে লড়াই করে সম্পূর্ণরুপে জয়লাভ করেন। সামরিক অভিযান হিসেবে যত কম গুরুত্বপূর্ণই হোক-না-কেন, এই গাযওয়াত বদর-ই মুহাম্মদের রাজকীয় শক্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইসলাম তার প্রথম ও অমোঘ সামরিক বিজয় অর্জন করল। এই বিজয়কে নতুন ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আল্লাহর অনুমোদন বলে আখ্যা দেওয়া হলো। ইসলামের এই প্রথম সশস্ত্র অভিযানের মধ্যে দিয়ে শৃংখলার শক্তি ও মৃত্যুর প্রতি যে ঘৃণার মানসিকতা প্রকাশ পায় তা ইসলামের সহজাত বৈশিস্ট্য পরবর্তীকালের আরও বড় বিজয় অভিযানের মধ্যদিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এটা সত্য যে, পরবর্তী বছর (৬২৫ খ্রীঃ), মক্কার অধিবাসীরা আবুসুফিয়ানের নেতৃত্ব ওহদ প্রান্তরে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ তুলতে মুহাম্মদকে আঘাত করারও চেস্টা চালিয়েছিল। তবে তাদের বিজয় স্থায়ী হয়নি। ইসলাম তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায় এবং ক্রমশ রক্ষা থেকে আক্রমণের পথে এগিয়ে যায়। ইতিপূর্বে রাস্ট্রীয় ভিত্তি ছাড়া ইসলাম শুধু ধর্মমাত্র ছিল। এখন থেকে ইসলাম একটি রাস্ট্রের ধর্মে পরিণত হয়; বদর-এর পরে মদিনাতে ইসলামী ধর্ম রাস্ট্রীয় ধর্মের থেকেও বড় ভূমিকা পালন করে নিজেই একটি রাস্ট্রে পরিণত হয়েছিল। সে সময় এবং সেখান থেকেই ইসলাম পরিণত হয় উদ্দেশ্যসাধনে আক্রমণাত্বক মনোভাবসম্পন্ন একটি সংঘটিত রাস্ট্রে এবং সারা বিশ্ব থেকে সে সেভাবে স্বীকৃতি পায়।

৬২৭ খ্রিস্টাব্দে মক্কার অধিবাসী, বেদুইন ও আবিসিনিয়ার ভাড়াটে সেনাদের মিত্রসংঘ মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছিল। আল্লাহর বিরুদ্ধে শাসিত এই বর্বর আক্রমণকে আবার সুবিন্যস্ত করা হয়েছিল। তখন সালমান নামে এক পারসীয় অনুগামীর পরামর্শে মদিনার চারদিকে মুহাম্মদ একটি পরিখা খনন করালেন। যুদ্ধ চালনার ক্ষেত্রে এই নতুন আবিষ্কারটি বেদুইনদের সম্মিলিত সেনাবাহিনীর কাছে কোন দিক থেকেই যোদ্ধাসুলভ নয় বলে মনে হল এবং উভয়পক্ষের জনা কুড়ি মানুষ নিহত হবার পর শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে অবরোধকারীরা তাদের অবরোধ তুলে নেয়। অবরোধ উঠে যাবার পর মিত্রসঙ্ঘে যোগ দেবার জন্য ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুহাম্মাদ সামরিক অভিযানে নামলেন। এর ফলে তাদের মধ্যকার অগ্রণী উপজাতি বনু-কুরাইজার ৬০০ শক্ত-সমর্থ মানুষ প্রাণ হারাল এবং বাকীদের বহিষ্কার করা হল। এই ভাবে যে খেজুর বাগানগুলি মালিকহীন হয়ে পড়ল, মোহাজিরগণ সেখানেই আবাস গড়ে তুলল। বানু-কুরাইজা ছিল ইসলামের শত্রুদের মধ্যে প্রথম উপজাতি যাদের স্বধর্ম ত্যাগ করতে অথবা বিকল্প হিসেবে মৃত্যুকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল। মুহাম্মদ আগের বছরেই মদীনার অন্য এক ইহুদি উপজাতি বানু-আল-নাজির কে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। মদীনার উত্তরে অবস্থিত শক্তিশালী দূর্গবেস্টিত মরুদ্যান খাইবার-এর ইহুদিরা ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে আত্মসমর্পণ করেছিল এবং কর দিতে শুরু করেছিল।

এই লেখাটি নেয়া হয়েছে জনাব প্রফেসর পি কে হিট্টির 'দ্য হিস্ট্রি অব আরবস' অবলম্বনে খন্দকার মাশহুদ-উল-হাছান অনূদিত 'আরবের ইতিহাস' গ্রন্থ থেকে। বইয়ের মূল লেখক এবং অনুবাদক উভয়ের প্রতি রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা।

আগামীকাল এর শেষ পর্ব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। আশা করি সাথেই থাকবেন।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:২৬

প্রামানিক বলেছেন: অনেক সুন্দর একটি পোষ্ট। ধন্যবাদ

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৩২

ইছামতির তী্রে বলেছেন: কস্ট করে পড়েছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ। এসব পোস্ট পড়ার লোক খুব কম।

২| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৫

কল্লোল পথিক বলেছেন: চমৎকার পোষ্ট ধন্যবাদ ।

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৪৬

ইছামতির তী্রে বলেছেন: চমৎকার পোষ্ট পড়ার লোকের বড় অভাব!
আপনি পড়েছেন জেনে ভাল লাগল। আজকে এর শেষ অংশ দিব ইনশাআল্লাহ। আশা করি পড়বেন।

মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.