নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আম জনতার একজন।

ইছামতির তী্রে

I have a dream.

ইছামতির তী্রে › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি ‘রক্ত সম্পর্কীয় আত্বীয়তা’র গল্প।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৩০

এক
ওর নাম সাদাব। বয়স ৫/৬ বছর। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর ছেলে ও। শান্ত ও নিরীহ গোছের ছেলেটি সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করেছে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে সে বাবার হাত ধরে এদিকে বেড়াতে আসে। আমরা দু’বন্ধু স্থানীয় মাঠে আড্ডায় মশগুল হই। আর ও এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করে। উন্মুক্ত জায়গা পেলে বাচ্চারা স্বভাবতই দাপাদাপি করে বেড়ায়। কিন্তু ও কেমন যেন আড়স্ট থাকে। বেশীরভাগ সময়েই সে বিরস বদনে ওর বাবার কাছে-পিঠেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আমার বন্ধু ছেলেকে দৌড়াতে বলে; সে নড়ে না। আমি ওকে কাছে ডাকি, কোলে নিতে চাই; কিন্তু কাছে আসে না। নাম জিজ্ঞেস করি, বলে না। খালি মুখ লুকায়। একটু পীড়াপীড়ি করলে চোখ জলে ভরে যায়। অগত্যা হাল ছেড়ে দেই। ও কেন যে আমায় দেখে এত আড়স্টতা বোধ করে ভেবে পাই না। অথচ শিশুদের প্রতি আমার ভালবাসা প্রবল। শিশুদের এক টুকরো মায়াময় চাহনিই আমাকে কিনে নিতে যথেস্ট। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে শিশুদের থেকে অগাধ ভালবাসা পেয়েছি। কিন্তু এই ছেলেটিকেই কেন যে বশে আনতে পারছি না! অথচ আমি ওকে গভীরভাবে অনুভব করি। মাঝে মাঝে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠে না। যাইহোক, ওর বাবা, মানে আমার বন্ধু মাঝে মাঝে ছেলের এহেন আচরণে ভীষণ কস্ট পায়, বিব্রত বোধ করে, রাগ করে, ওর কাছে আমার প্রশংসা করে। কিন্তু ফলাফল তথৈবচ। ও শুধু আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ লুকায়।

আমি তখন বন্ধুকে বলি, ‘ছাড় ওকে। দেখিস ও একদিন ঠিকই আমাকে খুব ভালবাসবে। আরে! ও যে আমার রক্তেরই একজন!’। আমার বন্ধু মাথা নেড়ে সায় দেয়।

দুই
প্রায় সাতাত্তর বছর বয়সী অভিজাত চেহারার এক সুদর্শন ভদ্রলোক তিনি। দেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন ছিলেন বহু বছর। অবসরের পর আমাদের এখানেও উচ্চপদেই আছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতার মত আচরণগত দিক দিয়েও তিনি যথেস্ট রাশভারী। তার হাঁটা-চলা, কথা-বার্তা, ব্রিটিশ এ্যাকসেন্ট-এ ইংরেজী বলা তথা সমস্ত কিছুতেই ব্যক্তিত্বের প্রবল প্রকাশ থাকে। যাইহোক, অফিসিয়াল কাজে ভীষণ ডিসিপ্লিনড এই মানুষটির রুমে ঢোকার সময় অনেকেরই ধরে পানি থাকে না। ইদানিং বয়সের ভার তাকে কাজে কিছুটা শ্লথ করে দিলেও এখনও উনার ঔজ্জ্বলতা চোখে পড়ার মত। অতি প্রয়োজন ছাড়া উনার টেবিলে সচরাচর কেউ যায় না। তবে সবাই উনাকে সমীহ করে চললেও কিন্তু আমি সেই দলে নেই। আমি তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করি। তার টেবিলে বসে অফিসিয়াল নানা বিষয় নিয়ে লম্বা সময় ধরে আলাপ-আলোচনা করি। আনঅফিসিয়াল কিংবা ব্যক্তিগত নানা ব্যাপারেও উনার সাথে কথা বলি, উনার মূল্যবান পরামর্শ নেই। তিনিও সাগ্রহে আমাকে প্রশ্রয় দেন। মোটকথা, তার সাথে মিশতে কোন ভীতি, আড়স্টতা গ্রাস করে না আমায়। বরং উনাকে অফিসের বসের বাইরেও খুব কাছের একজন মানুষ বলে আমি মনে করি। তার ভাল-মন্দ যেকোন প্রকার খবরে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। বিশেষত স্যার যখন অসুস্থ্য থাকেন বা পারিবারিকভাবে সমস্যায় পড়েন তখন আমি তার পাশে দাঁড়াতে সচেস্ট থাকি। ফলে কোন অতিথি আসলে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বেশীরভাগ সময়ে তিনি এই কথাটি বলেন ‘ও আমার ছেলের মত’। আমি যুগপত অভিভূত, বিস্মিত ও আনন্দিত হই।

বয়স এবং পদবিগত দিক দিয়ে বিশাল দুরত্ব থাকা সত্ত্বেও উনার সাথে আমার এহেন গভীর সম্পর্ক দেখে অন্যান্য কলিগরা আমায় জিজ্ঞেস করে, ‘কি ব্যাপার, বলুন ত’? আমি ওদের হেসে বলি, ‘উনি যে আমার রক্তের আত্বীয়’। ওরা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি শুধু মুচকি হাসি।

তিন
হাসপাতালের পরিপাটি বিছানায় শুয়ে আছেন চল্লিশোর্ধ বয়সের একজন ভদ্রমহিলা। চোখ দুটো ভাবলেশহীন, মুখটা মলিন। উনি আমার কাজিনের মামি শাশুরি। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেই তিনি বিছানা থেকে তরিঘরি করে উঠে বসতে চাইলেন। আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে থামালাম। তিনি একটু মুচকি হাসি দিলেন। হাসিটাও কেমন যেন প্রাণহীন মনে হল। এবার গভীরভাবে তাকে লক্ষ করলাম। আমার মনে হলো এক সময় তিনি যথেস্ট সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু মাথার সমস্ত চুল ফেলে দেয়ার কারণে তাকে এমন বিধ্বস্ত লাগছে। আমি তার সমস্ত খবরাখবর জানলাম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আমি তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেয়ার চেস্টা করলাম। এতে তিনি কতটা আশ্বস্ত হলেন বোঝা গেল না। আসলে উনার দুরারোগ্য ক্যান্সার হয়েছে। একেবারে ‘লাস্ট স্টেজ’-এ আছেন তিনি। কেমো দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। পানির মত টাকা-পয়সা খরচ হচ্ছে। শেষমেষ লাভ কি হবে আল্লাহই ভাল জানেন। ভদ্রমহিলার দু’টি সন্তান। একটা ছেলে একটা মেয়ে। ওরা এখনো বেশ ছোট। ছেলেটিকে হাসপাতালেই দেখলাম। মনের আনন্দে গোটা হাসপাতাল দাবড়ে বেড়াচ্ছে সে। অথচ ছোট্ট এই শিশুটিই জানেই না তার মমতাময়ী মা কি এক ভয়ানক মুসিবতে পরেছেন। সে হয়ত জানেই না কি এক বিভীষিকাময় ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।

হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি এই পরিবারটিকে রক্ষা করো। ওরা যে আমার রক্তের আত্বীয়।

চার
রুমে বসে জাবর কাটছি। হঠাৎ ঝড়ের বেগে আমার বন্ধু রুমে ঢুকেই ‘এক্ষুণি চল’ বলে তাড়া দিল। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে সে শুধু বলল, ‘পরে আলাপ হবে’। আমি কথা না বাড়িয়ে দ্রুত রেডি হয়ে ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। ও আমাকে ধানমন্ডিস্থ একটা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে এল। বন্ধুবর একজন লোকের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি উনাকে চিনতে পারলাম না। তবু হাসিমুখে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। মধ্যবয়স্ক, ধুলি-ধুসরিত, জরাজীর্ণ পোশাক পরিহিত, ঘামে ভেজা শরীরের বিধ্বস্ত চেহারার এই লোকটির সাথে আমার কি কাজ তা একটু পরেই টের পেলাম। টুকটাক আলাপ-সালাপে জানা গেল লোকটি পেশায় একজন রিকশাচালক। কোনমতে টেনেটুনে সংসার চলে। ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’য়ের মত কঠিন এক রোগ নিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন তার স্ত্রী। তারা বেসরকারি হাসপাতালে কেন- এটা আমার মাথায় ঢুকল না। যাইহোক, কিছুক্ষণ পরে আমরা সবাই মিলে তার স্ত্রীকে দেখতে গেলাম। একে ত চরম টানাপোড়েনের সংসার তার উপর বেজায় অসুস্থ্য। মনে হল যেন এক হাড্ডিসার কংকাল যেন শুয়ে আছে।
আমার কাজ শেষ হলো। বিদায় নিয়ে যখন ফিরে আসছিলাম তখম বুকের ভেতরটায় মোচরানি অনুভব করলাম। এই মানুষগুলোকে চিনি না, জানি না। ভবিষ্যতে আর কোনদিন দেখা হবে কি না তাও জানি না। কপালের ফেরে যদি দেখা হয়েও যায় তখন চিনতে পারব কি না তাও জানি না। আমি চিনলেও হয়ত তারা চিনবে না। অথচ বিদায়ের সময় কেমন যেন লাগছে! আসতে মন সায় দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে আরো কিছুক্ষণ তাদের পাশে বসে থাকি, সুখ-দুঃখের কথা বলি। কিন্তু জীবন ত থেমে থাকার নয়। প্রয়োজনের তাগিদে সামনের দিকে এগুতে হয়। আমি সামনের দিকে পা বাড়ালাম। হয়ত নতুন কোন ডাক আসবে শীগ্রই, অন্য কোনখানে, অন্য কোন জনে।

আপাতত গল্প শেষ। এখন আসল কথায় আসা যাক। বন্ধুর ছেলে, অফিসের বস, কাজিনের মামি শাশুরি এবং একজন রিকশাচালকের বউ কিভাবে আমার রক্ত সম্পর্কীয় আত্বীয় হল-এই প্রশ্ন হয়ত অনেকের মনেই জেগেছে। প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। আসলে রক্ত সম্পর্কীয় আত্বীয় বলতে আমরা যাদেরকে বোঝাই উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ হয়ত তাদের মধ্যে পরে না। তাহলে তাদের সবাইকে রক্ত সম্পর্কীয় আত্বীয় বলার হেতু কি? একটা কারণ অবশ্যই আছে। আর তাহলো, বিভিন্ন সময়ে আমি উল্লেখিত চারজনকেই ‘রক্তদান’ করেছি। আর নিজের রক্ত যখনই অন্য কোন শরীরের ঢোকে, আমার রক্ত যখন একজন মুমূর্ষু রোগীর সুস্থতার কারণ হয়, আমার নিজের রক্ত যখন একজন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে নিতে কাজে লাগে তখনই সে/তারা আমার রক্তের কেউ হয়ে যায়। অন্তত আমি তেমনটাই বিশ্বাস করি। হ্যা, আমি আবারো বলছি, ‘ওরা সবাই আমার রক্ত সম্পর্কীয় আত্বীয়’।

নিঃসন্দেহে রক্তদান একটি মহৎ কাজ। এক ব্যাগ রক্ত একজন মুমূর্ষু রোগীর নতুন জীবন দান করতে পারে। রক্ত দেয়ার মাধ্যমে মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি হতে পারে, তারা হয়ে উঠতে পারে আপনার সম্পর্কীয় আত্বীয়।

সবাই বলে ‘রক্তদান করুন’। আমি একটু ভিন্নভাবে বলতে চাই। আর তাহলো, ‘রক্ত বিনিয়োগ করুন’। কেননা, আজকে অন্যের প্রয়োজনে আপনি যদি এগিয়ে যান, নিশ্চিত থাকুন আপনার বিপদেও সে এগিয়ে আসবে। কাজেই, বিপদের সময় রক্ত পাবার জন্য অন্যের শরীরের নিজের রক্ত রিজার্ভ রাখুন!

‘নিজে রক্তদান করুন- অন্যকে রক্তদানে উৎসাহিত করুন’।

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

বিঃদ্রঃ অতি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, তিন নম্বর গল্পে উল্লেখিত আমার কাজিনের মামি শ্বাশুরি গত শুক্রবার সকালের দিকে মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মহান আল্লাহ উনার সকল গোনাহ ক্ষমা করুন, তাকে বেহেশত নসীব করুন। উক্ত পরিবারকে হেফাযত করুন। আপনারাও উনার জন্য দোয়া করবেন।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৫৮

স্বপ্নচারী গ্রানমা বলেছেন:
নিজের রক্ত যখনই অন্য কোন শরীরের ঢোকে, আমার রক্ত যখন একজন মুমূর্ষু রোগীর সুস্থতার কারণ হয়, আমার নিজের রক্ত যখন একজন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে নিতে কাজে লাগে তখনই সে/তারা আমার রক্তের কেউ হয়ে যায়। অন্তত আমি তেমনটাই বিশ্বাস করি।

আপনার লেখাটি মনকে নাড়া দিয়ে গেল প্রিয় ভ্রাতা।

মানব জীবন এমনি এক আজব ভ্রমণ, যেটাকে অবশই
আনন্দময়, সুন্দর এবং অর্থবহ করে তুলতে হবে আমাদের।

আপনার রক্ত দেয়ার অভ্যাসকে স্যালুট জানাই ++++ ভালো থাকুন।

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:১০

ইছামতির তী্রে বলেছেন: অবশেষে কাউকে পেলাম! তবে আপনাকে পেয়ে দুঃখ ঘুচে গেল।
আমি বেশ কয়েকবার রক্ত দিয়েছি। অথচ বিশ্ববদ্যালয়ে আসার আগে আমি ইনজেকশনও নিতে পারতাম না। এরও কারণ ছিল। একবার ছোটবেলায় কুকুরকে লাত্থি মারতে গিয়ে কুকুরের দাত পায়ের আঙ্গুলে বিধে গিয়েছিল। জলাতঙ্কের ভয়ে গুণে গুণে ১৪টি ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। সে ভীতি আমাকে এতই পেয়ে বসেছিল যে, নেক্সট ১২ বছর একটা ইনজেকশনও নেইনি। দায়িত্ব বোধ থেকেই রক্ত দেই।

আপনার মন ভাল করা মন্তব্য করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.