নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঘুম থেকে জাগার চেষ্টা করছি। পারছি না। প্রচন্ড আকর্ষনে পিঠ বিছানায় চেপে আছে। উঠতে পারছি না। বিছানা নয়। চলন্ত কিছু। চলন্ত সিটে শুয়ে আছি। প্রাণপনে চোখ খুলে দেখি। একটা ট্রেন। চলন্ত ট্রেনের ভেতর আমি। এই ট্রেনে আমি সান্তাহার যাবার কথা। সান্তাহার। আমার কর্মস্থল।
একা। একা একটি সিটে বসে আছি। যেদিকে মুখ করে আছি, ট্রেন চলছে ঠিক উলটো দিকে। অদ্ভুত ব্যাপার। কোন যাত্রী নাই। প্রচন্ড বেগে ট্রেন চলছে। যেন পিছিয়ে যাচ্ছি। দ্রুত।
জানলা দিয়ে দৃশ্যপট পালটে যাচ্ছে। পূর্বের কর্মস্থল। বৌ বাচ্চা। বিয়ে। চাকরি পাওয়া। ভার্সিটি জীবন। কলেজ। স্কুল।
সব ছেড়ে ছুড়ে আমি কেন জানি পিছিয়ে যাচ্ছি। সময়ের পিছনে!
আমি সময়ের পিছন দিকে ছুটছি! এটা সময়-ট্রেন! আমাকে নিয়ে যাচ্ছে সময়ের পিছনের দিকে। আমি চোখ বন্ধ করলাম।
এতো দু:সহ দৃশ্যপট। আমি নিতে পারছি না। আমার ঘুম ভাঙ্গাতে হবে। আমাকে জাগতে হবে। একবার পিছনে চলে গেলে, ফের ফিরে আসতে পারবো না। হয়তো পিছনে যেতে যেতে, হয়তো শূণ্য হয়ে যাবো। চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে যাবো।
আমি নিজেকে থামানোর চেষ্টা করছি। প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
একটি আঁকাবাঁকা কাচা রাস্তা। গ্রামের দিকে গেছে। একটি নড়বড়ে ছাউনি বিহীন ভ্যান। একজন যুবক ভ্যানওলা। পায়ে ঠেলে ভ্যান এগুচ্ছে।
"বাহে, তিন ট্যাকার কম হবার নয় কিন্তুক।" ভ্যানওলা বলছে। আমাকে? আমি তো ভ্যানের এক সাইডে বসা। খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ঘটনা, এর আগেও আমার জীবনে ঘটেছে। ডেজা ভ্যু?
এই ভ্যানওলাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। ওই রাস্তা। ঐ তো সামনে মোড়!
একটা কাচা রাস্তার মোড়। সামনে একটা টিনের ঘর। রাস্তার দুপাশে দুটো বিশাল রেইন্ট্রি গাছ। এই মোড় আমার চিরচেনা। পাশেই আমাদের গ্রাম।
আমি এসে নামলাম সেই মোড়ে। পড়ন্ত বিকেল। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। আর পিপাসা।
ভ্যানওলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ভ্যান ভাড়া দেবার কথা।
সমস্ত পরিবেশ, আমাকে কী যেন বলে যাচ্ছে। আমার মনে পড়ছে। সেই ছোটবেলায়, ক্লাস সিক্সে থাকতে একবার এই ভ্যানে করে এখানে এসে নেমেছিলাম। ভাড়া দুই টাকা। সে আমার কাছে তিনটাকা চেয়েছিল। আমি দুই টাকাই দিয়ে বলেছিলাম, "আমার কাছে আর কোন টাকা নাই।"
ভ্যানওলা জেদ ধরেছিল। তিনটাকাই সে ভাড়া নিবে। সারাপথ এই বলে এসেছে। "তোমাক একলায় নিয়া আনু। মোক তিন ট্যাকা দেয়া লাগবে।"
আমারও জেদ ধরেছে। দুই টাকার ভাড়া আমি কোনমতেই একটাকা বেশি দিবো না।
আসলে, আমার পকেটে আরো এক টাকার কয়েন ছিল। আমি মিথ্যা বললাম, "আমার কাছে আর টাকা নাই।"
সেদিন ছিল রোজা। রোজা থেকেও আমি মিথ্যা বলেছিলাম।
ভ্যানওলার কথা স্পষ্ট মনে আছে। পরনে একটা লুঙ্গি একতা সাদা স্যাণ্ডো গেঞ্জি। দুবাহুতে পেশি ফুলে আছে। পচিশ ত্রিশ বছর বয়স।
সে আমাকে বলেছিল, "রোজায় খুব কষ্ট হচে বাহে। যদি তোমার কাছে পয়সা না থাকে, তাহলে কোন কথা নাই। কিন্তুক, যদি থাকে, কেয়ামত পর্যন্ত দাবি রাখনো।"
বলে সে চলে গিয়েছিল। সেই কাচা রাস্তা ধরে। আমি অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিলাম। তার শেষ কথাটি বুকে এসে এমন বাধলো!
ঠিক সেই জায়গায় এখন আমি দাঁড়িয়ে। আমি পকেটে হাত দিয়েছি। দেখি দুই টাকার একটা নোট। দোয়েলপাখি। সেটা ওকে দিলাম রোবটের মতো। ভ্যানওলাও সেই সেদিনের কথা বলছে, "কিন্তুক, যদি থাকে, কেয়ামত পর্যন্ত দাবি রাখনো।"
আশ্চর্য!
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। একই ঘটনা পুনরায় ঘটছে।
ভ্যানওলা চলে যাচ্ছে। সেই কাচা রাস্তা ধরে। আমি তাকিয়ে আছি। আর তার শেষ কথাটি বুকে বিধে গেল।একটা গভীর অপরাধবোধ!
আমার পকেটে এক টাকার কয়েন। আমার ওকে সেটা দিয়ে দেয়া উচিত। একটা তীব্র অপরাধবোধ, আমাকে আবার এখানে এনেছে। সময়-ট্রেনে করে।
এই কাচারাস্তা আর নেই। কবে পাকা হয়ে গেছে। রাস্তার ওপাশে খলিফা ভাইয়ের দর্জির দোকান। আর নেই। রেইনট্রি গাছ দুটো এখনো আছে। আরো বুড়ো হয়েছে। পাশেই আমাদের সবুজ শ্যামল গ্রাম।
এবং আমি আবার অতীতে ফিরে এসেছি!
ভ্যানওলা ভাইটিকে ডাকতে পারছি না। আবার ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছি। সেই এক টাকা আমার দিয়ে দেয়া উচিত। আমি দিতে পারছি না।
সেই ছোট্ট আমি, একটা অপরাধবোধ, একটা গভীর অপরাধবোধ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৩০
স্বাধীন আকন্দ বলেছেন: সঠিক বলেছেন❤️
©somewhere in net ltd.
১| ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:০২
রাজীব নুর বলেছেন: বিবেক জাগ্রত থাকলে অপরাধবোধ কাজ করে।