নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লন্ডনে তৃতীয় পর্ব
অধ্যাপক আব্দুল কাদির সালেহ এবং মুফতি আব্দুল মুনতাকিমের সাথে কিছু সময়
লন্ডনে আরো দু বার এসে গেলাম কিন্তু আমার বোন কিংবা চাচাতো বোনদের ঘরে যাওয়া হয়নি। লন্ডনে তৃতীয় সফর করলাম তাদের ঘরে যাওয়ার নিয়তে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আল্লাহ আল্লাহ বলে লন্ডনের দিকে ড্রাইভ শুরু করি। আস্তে আস্তে ড্রাইভ করে রাত ১০টার দিকে লন্ডনের আল-হুদা সেন্টারে এসে পৌঁছি। আমার ভগ্নিপতি মাওলানা অধ্যাপক আব্দুল কাদের সালেহ এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান। সালেহ ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালিন সময় বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। ছাত্র জীবন শেষে সাংবাদিকতা পেশায় দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন। তিনি ঢাকার জাতীয় দৈনিক আল-মুজাদ্দিদের সহ-সম্পাদক এবং ঢাকা রেডিও-এর সাথেও কিছুদিন ছিলেন। বিয়ের পর লন্ডনে আসেন। বর্তমানে খেলাফত মজলিস যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি। সালেহ ভাইয়ের অফিসে চা পানের ফাঁকে তাঁর মোবাইল থেকে ফোন দিলাম মুফতি আব্দুল মুনতাকিমকে। সে ফোন পেয়েই বললো তার ঘরে যেতে এবং খাওয়া-দাওয়া সেখানে করবো। আমরা খাবো না, তবে যাবো, এই বলে ফোন রেখে যাত্রা শুরু করি। মুফতি আব্দুল মুনতাকিম আমার কৈশোরের বন্ধু। আমরা দরগা মাদরাসায় এক সাথে কিছুদিন পড়েছি। তাঁর নানা সিলেটের বিশিষ্ট্য আলেম এবং ওলী হযরত মাওলানা আব্দুল গাফ্ফার শায়খে মামরুখানী (র.)। শায়েখ মামরুখানি ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সৈনিক শায়খুল ইসলাম মাওলানা সৈয়দ হোসেন আহমদ মাদানী (র.) এর শিষ্য। তাঁর বাবাও একজন বড় আলেম এবং তিনি বর্তমানে মামরুখানি মাদরাসার প্রিন্সিপাল। আব্দুল মুনতাকিমকে সিলেটের দরগাহ মাদরাসায় রেখেই আমি মা-বাবার সাথে ইংল্যান্ড চলে আসি। সে সেখান থেকে পাকিস্তানে লেখাপড়ার জন্য চলে যায়। পাকিস্তানের এক সময়ের প্রধান বিচারপতি মুফতি তক্বি উসমানির মাদরাসায় সে ইফতা (ইসলামি আইন বিষয়ে ডিগ্রী লাভ) করে। লেখাপড়ার পর সে মুফতি তক্বী সাহেবের সাথে ইফতা বিভাগে কিছুদিন কর্মরতও ছিলো। আব্দুল মুনতাকিম খুব ভালো উর্দু জানে। সে এক সময় পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক জং ইত্যাদিতে নিয়মিত কলাম লিখতো। এখনও হয়তো লেখে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসলে সে দরগাহ মাদরাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করে। অতঃপর খালাতো বোন অর্থাৎ মরহুম মাওলানা আব্দুস সোবহান সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করে লন্ডন আসে। আমরা এশার নামাজ পড়ে আব্দুল মুনতাকিমের ঘরে যাই। ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত অনেক স্মৃতিচারণমূলক আলাপ হয়। সে আমাদের মাদরাসার চিন্তাকে স্বাগত জানায়। পরামর্শ দেয় এই চিন্তার আরো প্রচার প্রয়োজন। অবশেষে জামিআ সিদ্দিকিয়ার চিন্তাকে সামনে নিয়ে লন্ডনে একটি সেমিনার করার সিদ্ধান্ত হয়। খাওয়া-দাওয়া করি। তার ঘর থেকে বের হতে হতে রাত ৩টা হয়ে যায়। সালেহ ভাই সহ তাঁর ঘরে চলে আসি। আজ এখানে অর্থাৎ আমার দ্বিতীয় বোন সৈয়দা তাসলিমা বেগম লিমার ঘরে থাকা হবে। ঘুমানোর কোন চেষ্টাই সালেহ ভাইয়ের মধ্যে লক্ষ্য করা গেলো না। তিনি বেশ কিছু ফল কেটে আনলেন খাওয়ার জন্য। সাথে জাইতুনের আসার। জায়তুন আমার খুব প্রিয় ফল। আমি একটা একটা করে প্রায় ২০/২৫ টা খেয়ে ফেলি। দু জনে মিলে জামায়তে ফজরের নামাজ পড়ি। আকাশ পরিস্কার হয়ে সূর্যের আলো উন্ডরের কটনকে ফাঁক করে ঘরে ডুকলে আমাদের কথা বন্ধ হয়।
কবি ফরীদ আহমদ রেজার সাথে কিছু সময়
ঘুম থেকে জেগে প্রথমে আমার ছোট ভাই সৈয়দ ফখরের ঘরে যাই। সেখানে তাদেরকে দেখে মেঝ মামার ঘরে যাই। নানির সাথে কিছু সময় গল্প করি। নানিকে নিয়ে এক সাথে খাওয়া-দাওয়া করি। মেঝ মামা সহ চলে আসি সালেহ ভাইয়ের অফিসে। মেঝ মামাকে নিয়ে সালেহ ভাই সহ আমরা জামিআ সিদ্দিকিয়ার সেমিনারের পরিকল্পনা নেই। একটা ব্যানারের অর্ডার করা হয়। মেঝ মামা চলে গেলেন তাঁর একটা মিটিং আছে বলে। কিছু সময় পর বড় মামা (কবি ফরীদ আহমদ রেজা) ফোন দিয়ে জানালেন তিনি নানির ঘরে আছেন। আমি সালেহ ভাইয়ের অফিস থেকে নানির ঘরে চলে যাই। বড় মামার সাথে আমাদের শিক্ষা প্রদ্ধতি, মাদরাসার অবস্থা, এবং সেমিনার নিয়ে আলাপ করি। তিনি খুশি হলেন এবং সেমিনারে নিজে উপস্থিত থাকার আশ্বাস দিলেন।
শাহনাজ সুলতানার ঘরে দাওয়াত খাওয়া
আজ ১ লা জুন ২০১৩। আমার যেতে হবে কবি শাহনাজ সুলতানার ঘরে দাওয়াত খেতে। এই দাওয়াত শাহনাজের মায়ের পক্ষ থেকে। খালাম্মা আমাকে খুবই আদর করেন। শাহনাজ আমাকে বেশ ক’বারই বললো-আম্মা বলেছেন আপনি আসতে হবে। শাহনাজ চাকুরী করেন। চাকুরীর ফাঁকে আবার তাকেই রাঁধতে হবে। আমি খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলায় না যেতে অনুরোধ করলেও তিনি মানতে রাজি না। খেতেই হবে। তবে জানিয়ে গেলে তিনি খুশি। শেষ পর্যন্ত আমি আসবো জানালে তিনি তার আরো কিছু লেখক বন্ধুকে দাওয়াত করেন। এই বন্ধুরা আর কেউ নয়, আমারই ছোট মামা আহমদ ময়েজ, আমার অতি আপনজন কবি আব্দুল কাইয়ূম এবং মাই ডিয়ার চাচা কবি শাহ সোহেল। আমি, ছোট মামা এবং কাইয়ূম ভাই আমার গাড়ি দিয়ে যাবো। যাওয়ার সময় আমার দুই মামাকে তাদের ঘরে দিয়ে যেতে হবে। তাদের একজন হলেন ফরীদ আহমদ রেজা, যিনি আমার বড় মামা। আরেকজন সাকিব, যার বড় মামা হলাম আমি নিজে। ছোট মামার ঘরের সামনে গিয়ে মোবাইলের মাধ্যমে জানা গেলো তিনি এখনও সাওয়ার করছেন। দেরি হবে, তাই তিনি শাহ সোহেলের গাড়িতে আসবেন। তাই আমাদের চলে যেতে হলো। কাইয়ূম ভাই শাহ সোহেলকে ফোন দিলে জানা গেলো তার সাথে গাড়িতে আছে ক্লোজাপওয়ানের পুরস্কারপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পি নোলক। আমরা শাহনাজের ঘরে গিয়ে মাগরিবের নামাজ শেষ করে বসলে ফোন আসে নজরুল ইসলাম বাসনের কাছ থেকে। শাহনাজ তাঁকে দাওয়াত করলেন। তিনি রাজি হলে শাহ সোহেলকে অনুরোধ করা হয় বাসন ভাইকে সাথে নিয়ে আসার জন্য। তারা সবাই এক সাথে আসেন। দীর্ঘ আড্ডা হয়। খাওয়া-দাওয়া হয়। নোলক সরঞ্জাম ছাড়াই দুটা গান গেয়ে আমাদেরকে শোনান। সেখান থেকে বিদায় হয়ে আবার আসি সালেহ ভাইয়ের সেন্টারে। সেখান থেকে সালেহ ভাইকে নিয়ে ঘরে আসি।
২ জুন পূর্ব লন্ডনের আলহূদা একাডেমি মিলনায়তনে ইসলামী ও জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়ে এক অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিআ সিদ্দিকিয়া বালুচরের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি এবং জামিআ সিদ্দিকিয়ার চিন্তা‘ শীর্ষক এক সেমিনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কবি ফরিদ আহমদ রেজার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে লন্ডনের বিশিষ্ট আলেম, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসার বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা অংশ গ্রহণ করেন।
জামিআ সিদ্দিকিয়ার সেমিনার
২ জুলাই ‘ বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা প্রদ্ধতি এবং জামিআ সিদ্দিয়িার চিন্তা’ শীর্ষক এক সেমিনার আয়োজন করা হয় আল-হুদা সেন্টারে। উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলাম আমি। উক্ত সেমিনারে বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বক্তাগণ অভিমত প্রকাশ করে বলেনÑবাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি জাতির সামনে কোন সুনির্দিষ্ট পথ উপস্থাপন করতে পারেনি। দ্বি-মুখি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একই বৃত্তে ঘূড়পাক খাচ্ছে। সরকার আলিয়া পদ্ধতির পৃষ্টপোষকতা করলেও স্বর্থিক কারণে তাকে স্বাধীন এবং সতন্ত্র কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সুযোগ করে দিচ্ছে না। উন্নত গবেষণা, বিশ্বমানের লোক তৈরির লক্ষ্যে এফিলিয়েটেড ক্ষমতা সম্পন্ন একটি স্বাধীন আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী দীর্ঘদিনের হলেও তা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামক একটি প্রতিষ্ঠান হলেও রাজনৈতিক কারণে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে চলেছে।
কওমী মাদরাসা ইসলামী শিক্ষার ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারের ধারক হলেও এর কারিক্যুলামের মধ্যে সময়ের চাহিদা পূরনের যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হয়নি। সময়ে সময়ে শিক্ষা সংস্কার এবং উন্নয়নের বিচ্ছিন্ন চেষ্টা দেখা গেলেও তা সমগ্র ব্যবস্থার উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। আর জাতীয় শিক্ষা নামে যে ব্যবস্থার অধিনে একটি জাতী গড়ে উঠেছে এটি নিতান্তই উদ্বেগজনক। শিক্ষার লক্ষ্যটি কি তা আজও সুস্পষ্ট নয়। আমরা অতীতে দেখেছি সরকার বদল হলে কারিক্যুলাম ও পাঠ্যবই বদল হয়। আর মন্ত্রী পরিবর্তন হলে শিক্ষার লক্ষ্য পরিবর্তন হয়ে যায়। এই ধরণের শিক্ষা একটি উন্নত জাতি উপহার দিতে পারে কি না এই প্রশ্ন রেখে বক্তাগণ বলেনÑইসলামী ও জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়ে ত্রিধারার শিক্ষার বিপরীতে একমূখী ও বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার। স্থিতিশীল উন্নত জাতি গঠনে ইসলাম ও জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়ে শিক্ষিত প্রজন্ম প্রয়োজন। আর ক্ষেত্রে জামিআ সিদ্দিকিয়া বিগত প্রায় এক যুগ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
সেমিনারে বক্তব্য রাখেন ইমাম জাকারিয়া একাডেমির রেক্টর বিশিষ্ট্য আলেমে দ্বীন মুফতি শাহ সদরুদ্দিন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল কাদের সালেহ, ইব্রাহিম কলেজেন শরিয়াহ কনসালটেন্ট মুফতি আব্দুল মুনতাকিম, গবেষক ওমর ফারুক, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবু সুফিয়ান চৌধুরী, দারুল হাদিস লতিফিয়ার উস্তাদ গবেষক মাওলানা আব্দুল আউয়াল হেলাল, তরুণ আলেমে দ্বীন মাওলানা সৈয়দ নাঈম আহমদ, আল-কোরআন রিচার্স ফান্ডেশনের সেক্রেটারী মাওলানা নুফাইস আহমদ, কমিউনিটি সংগঠক আহমদ কুতুব, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মানিকুর রহমান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলী আহমদ মিলন, হাফিজ সৈয়দ মোকাররাবিন, মাওলানা আনিসুর রহমান, এশায়াতুল ইসলাম মাদরাসার উস্তাদ মাওলানা হুমায়ূন রশীদ নূরী, আলহুদা একাডেমির প্রধান শিক্ষক মুফতি হোসাইন মোহাম্মদ সুলতান, বিশ্বনাথ জামেয়া মাদানিয়ার পরিচালক ও আলফারুক পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হাফিজ মাওলানা হোসেন আহমদ, মাওলানা হুমায়ূন রশীদ, মুফতি আব্দুর রাজ্জাক ও মাওলানা সোহেল আমিন প্রমূখ।
কবি ফরিদ আহমদ রেজা বলেনÑআমাদের দেশে আন্তর্জাতিকমানের কোন শিক্ষা নীতি আজও প্রণয়ন হয়নি। যে সরকার যখন এসেছে সে তার ইচ্ছে মতো একটা শিক্ষা কমিশন এবং শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছে। যদি সরকার ইসলাম ও জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতো তবে আজ বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে এত ঘাটতি দেখা দিতো না। হযরত মুহাম্মদ (স.) এর মদিনার মসজিদে নববীর পাঠশালায় যারা পড়েছেন তারা গোটা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রমাণ করেছেন তা ছিলো আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষানীতি। ইসলাম ও জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত জামিআ সিদ্দিকিয়ার শিক্ষানীতি যদি কোন সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করে তবে তা একদিকে যেমন স্থিতিশীল উন্নত জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে এই জাতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দানের যোগ্যতাও অর্জন করবে। এই প্রতিষ্ঠানের পাশে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হবে।
মুফতি শাহ সদরুদ্দিন তার বক্তবে বলেনÑদারুল উলূম দেওবন্দ কাসেম নানতবী (র.) তৈরি করেন নি শুধু মসজিদের ইমাম আর মাদরাসার শিক্ষক তৈরি করার জন্য। তিনি তা তৈরি করে ছিলেন মুসলমানদের হারানো রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা ফিরিয়ে এনে নেতৃত্ব গ্রহণের মতো নেতা তৈরির জন্য। কিন্তু আমরা আজ নিজদেরকে দেওবন্দী দাবী করে বৈরাগ্য জীবনকে বুজুর্গী মনে করি এবং দুনিয়াবী শিক্ষা থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখছি। জামিআ সিদ্দিকিয়া ইসলামী ও জাতীয় শিক্ষার সমন্বয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করে আমাদের বিগত একশ বছরের অভাব দূর করেছে বলে আমি মনে করি।
অধ্যাপক আব্দুল কাদের সালেহ বলেনÑআমাদের এখন সময় এসেছে যে, আমাদের দ্বীনি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার অবতারণা করা। কারণ মাদারিসে দ্বীনিয়া এবং উলামায়ে কেরামের কাছে দেশ এবং জাতির প্রত্যাশা অনেক। সেই প্রত্যাশা পূরণে আমাদের চলমান শিক্ষা কারিক্যুলাম এবং ট্র্যাডিশ্যানাল পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে। বিচ্ছিন্নভাবে কথা অনেক হচ্ছে, কেউ বলছেন কওমী মাদরাসার সরকারী স্বীকৃতির কথা, কেউ বলছেন দু চারটা বইয়ের পরিবর্তনের কথা, কিন্তু কোন পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা আজ আসেনি। জামিআ সিদ্দিকিয়া আমাদের সামনে এই আলোচনাটা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। আমি তাদেরকে স্বাগত জানাই।
মুফতি আব্দুল মুনতাকিম বলেÑ‘বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা এবং জামিআ সিদ্দিকিয়ার চিন্তা’ বইটা পাঠের পর থেকেই জামিআ সিদ্দিকিয়ার প্রতি আমার মনে আগ্রহ জেগে উঠে। দীর্ঘদিন থেকে আমরা বাংলাদেশের মাদরাসাগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যে চিন্তা বিচ্ছিন্নভাবে মনে লালন করছি তার সমন্বয় জামিআ সিদ্দিকিয়ায় দেখা যাচ্ছে। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠনগুলোর ইসলাম ও জাতীয় সিলেবাসের সমন্বয়ের সফলতা তুলে ধরে বলেনÑআমাদেরকেও বর্তমান ট্র্যাডিশ্যানাল প্রদ্ধতির মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে।
৩ জুন বিকালে লিমার ঘর থেকে মিলন ভাইয়ের ঘরে যাই। সেখান থেকে বড় মামার ঘরে। মামা মসজিদে আসরের নামাজে ছিলেন। বড় মামানি অনেক কিছু খাওয়ার জন্য দিলেন। আমি খাওয়া-দাওয়া করলাম। মামা আসলেন। মামার সাথে বেশ কিছু গল্প হলো। অতঃপর মিলন ভাই আসেন। আমরা এখন যাবো রাজু আপা এবং রেখার বাসায়।
রাজু আপা এবং রেখার বাসায়
রাজু আপা, মানে ডাক্তার সৈয়দা রাজনা বেগম। রেখা মানে, সৈয়দা রেখা বেগম। তারা আমার চাচাতো বোন, কিন্তু আমাদের পরিবারে চাচাতো বোন-ভাই বলতে কিছু নেই, সবার উপর সবার অধিকার নিজের ভাই- বোনের মতোই। আমরা যৌথ পরিবারে সবাই বড় হয়েছি। আমাদের মা-চাচিরা কখনও আমাদেরকে পৃথক করে দেখেননি। আমি আমার মায়ের উপর যে অধিকার রাখি, সেই অধিকার রাখি চাচির উপর। আমার মা-চাচিকে কোনদিন ঝগড়া করতে দেখিনি। মা-চাচির মিলটা আমাদের চাচাতো ভাই-বোনদের মধ্যেও রয়েগেছে। রাজু আপা আমার থেকে দু তিন বছরের বড়। আর রেখা পাঁচ মাসের ছোট। ছোটবেলা রেখার সাথে আমার প্রচুর ঝগড়া হতো, আমি তাকে প্রচুর মারতাম। তবে মাইর খেয়েও সে আমার কাছে আসতো। তার সাথে আমার অনেক বন্ধুত্বও ছিলো। আর রাজু আপার কথা কি বলবো। নিজের তো কোন বড় বোন নেই। রাজু আপাকেই বড় বোনের মতো পেয়েছি। আমার বড় চাচা সৈয়দ আব্দুল হান্নান পরিবার নিয়ে গ্রামে থাকতেন। চাচাতো ভাই-বোনরা সৈয়দ পুর হাইস্কুল থেকে মেট্রিক দিয়ে এক এক করে সিলেট আসেন আমার মায়ের কাছে। রাজু আপা মেট্রিক দিয়ে সিলেট মহিলা কলেজে যখন ভর্তি হলেন তখন আমি সিলেট দরগাহ মাদরাসায় পড়ি। আমাদের তখন একটা রিক্সা ছিলো। আমরা সেই রিক্সায় এক সাথে যাওয়া-আসা করতাম। আপা আমাদেরকে দরগাহ গেইটে নামিয়ে দিয়ে যেতেন। আমি তখন কোথাও গেলে মন চাইতো কতো দ্রুত বাসায় এসে আপার সাথে গল্প করবো কোথায় কি করেছি। আপা ছিলেন আমার গল্পের নীরব শ্রুতা। আপা যখন মেডিকেলের ছাত্র তখন অনেক রাত পর্যন্ত পড়তেন। তখন আমি কৈশোরে। মাঝেমধ্যে গভীর রাত পর্যন্ত চক্কর দিতাম, বিশেষ করে রমজান মাসে। আমার বাবা খুব রাগি মানুষ, ধরতে পারলে খবর ছিলো। কিন্তু ভরসা ছিলো রাজু আপা। গভীর রাতে ঘরে ফিরে রাজু আপার দোয়ারে ডাক দিতাম, তিনি দরজা খুলে দিতেন, মাঝেমধ্যে না খেয়ে এলে ভাতও এনে দিতেন। ইতোমধ্যে রেখাও মেট্রিক দিয়ে সিলেট এসে মহিলা কলেজে ভর্তি হয়। রেখাকে মহিলা কলেজে এবং রাজু আপাকে সিলেট মেডিকেলে পড়ায় রেখে আমার মা-বাবার সাথে ইংল্যান্ড চলে আসা। এরই মধ্যে রাজু আপার বিয়ে হলো ডাক্তার মুজিবুল হকের সাথে। আপাকে নিয়ে দুলা ভাই ইংল্যান্ডে পড়তে আসেন। এর কিছুদিন পর রেখারও বিয়ে হয়ে যায় আমাদেরই সম্পর্কে চাচাতো ভাই সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুকের সাথে। ফারুক ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকতে বাকশাল ছাত্রলীগের সেক্রেটারী ছিলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বোমার আঘাতে মারা যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রউফুন বসোনিয়া ছিলেন ফারুক ভাইয়ের রোমমেইট। যেদিন এই ঘটনা ঘটে সেদিন ফারুক ভাই বাড়িতে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান (আমার শোনা কথা)। লেখাপড়ার শেষে ফারুক ভাই ইংল্যান্ড চলে আসেন। দীর্ঘদিন লন্ডনের এক স্কুলে শিক্ষাকতা করেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী।
আমি মিলন ভাইকে নিয়ে প্রথমে রাজু আপার বাসায় যাই। আপা সন্ধ্যা ছয়টায় হাসপাতাল থেকে ডিউটি শেষ করে এসেছেন। আমাকে পেয়ে আপা এবং দুলাভাই খুব খুশি হলেন। তাদের ধারণা ছিলো আমি রাতে থাকবো। কিন্তু থাকতে পারছি না বলে মনে হলো কষ্ট পেলেন। কিছু খাবো না বললে তিনি ধমক দিয়ে বললেনÑমাতিছ না, একেবারে কুন্তা না খাইয়া যাইবে কিলা? আমি বললামÑচা দিলাও। আপা চার সাথে চিকিন ফ্রাই, ফিস ফিংগার ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন। খেতে হলো। আপার ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাই রেখার ঘরে। রেখা তখন সিটিতে নকশি কাঁথা গায়ে দিয়ে টেলিভিশন দেখছিলো। তার বড় ছেলে ফাইয়াজ দরজা খুলে দিলো। রেখা আমাকে দেখে এমন ভাবে হাত এগিয়ে দিলো যেনো মা তার সন্তানকে দীর্ঘদিন পর পেয়ে হাত এগিয়ে বলেÑআয় ছেলে, বুকে আয়, বাবা এতোদিন কোথায় ছিলে। আমার চোখে জল এসে যায়। ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসের মধ্যেই ফারুক ভাই ফোন দিলেন তিনি রেল স্টেশনে, তাঁকে গিয়ে আনতে। রেখা আমাকে বললোÑভাই তুই ব, আমি তানরে লইয়া আই। রেখা গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে যায়। ফাইয়াজ আমাকে জিজ্ঞেস করে-মামা, চাতে চিনি কয় চামাচ দিতাম? আমি চা খাবো না বললে, সে হাসতে হাসতে বললো-চা তো খাইতা অইবা। চিনি কয়টা দিতাম কউকা। আমি বললামÑমামা তোমার জয়টা ইচ্ছা দিলাও। ফাইয়াজ খুব হাসলো। আমরা চা খেতে খেতে রেখা এবং ফারুক ভাই এসে গেলেন। কিছুক্ষন তাদের সাথে কথা বলে আমি বিদায় চাইলে ফারুক ভাই বললেনÑভাই থাকি যাউকা। আমি আরেকদিন থাকার জন্য আসবো বলে বিদায় নিলাম।
ড. আবুল কালাম আজাদের বাসায়
ড. আবুল কালাম আজাদের সাথে আমার পূর্ব কোন পরিচয় নেই। ৪ জুন বাদ আছর সালেহ ভাই আমাকে নিয়ে ড. আবুল কালাম আজাদের বাসায় গেলেন। ডক্টর সাহেব সালেহ ভাইকে গুরু গুরু বলে অত্যন্ত সম্মান দেখালেন। সালেহ ভাইয়ের সিলেটি ভাষায় সন্দিক কিংবা যশোহরী ভাষায় বড় শালা হিসেবে আমাকেও বেশ খাতির করলেন। ভাবির সাথে নাকি আমার বোন লিমার (সালেহ ভাইয়ের স্ত্রী) বেশ সম্পর্ক। খুব স্বাদের নুডুস করে ভাবি খাওয়ালেন। দীর্ঘ আলাপ হলো। আমি আমার কিছু বই তাঁকে উপহার দিলে তিনি খুব খুশি হলেন। ড. আবুল কালাম আজাদ লন্ডনের প্রসিদ্ধ চেরেটি সংগঠন গ্লোবাল এইডের ডাইরেক্ট। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গরীব ছাত্রদেরকে সহযোগিতা করে থাকেন। আমি আমাদের মাদরাসার কথা বললে তিনি অবশ্য-ই অবশ্যই বলে আশ্বাস দিলেন। অতঃপর অফিসের অফিসার জনাব এরশাদুল্লাহের সাথে ফোনে আলাপ করে আমাকে বলেনÑকাল সকালে আপনি আমাদের অফিসে গিয়ে কিছু গরীব ছাত্রের তালিকা দিয়ে আসবেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার আসি সালেহ ভাইয়ের সেন্টারে। অতঃপর চলে যাই মিলন ভাইয়ের বাসায়।
গ্লোবাল এইডের অফিসে
ইস্ট লন্ডন মসজিদ থেকে একটু সামনে গেলেই আফতাব আলী পার্ক। পার্কের সামনে রাস্তার অপর পাশে গ্লোবাল এইডের অফিস। গোটা ইস্ট লন্ডন এলাকায় সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সকাল আটটা থেকে বিকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত গাড়ির পার্কিং এক বিরাট সমস্যা। সারা এলাকা-ই ডাবল কিংবা সিংগেল এলো লাইনের ভেতর। ডাবল এলো লাইনে যে কোন সময় গাড়ি রাখা নিষেধ। সিংগেল এলো লাইনে সকাল আটটা থেকে বিকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত গাড়ি রাখা যাবে না। আমরা সকাল এগারোটায় যাবো। আমার গাড়ি মিলন ভাইয়ের ঘরের সামনে রেখে আমি মিলন ভাইকে নিয়ে প্রথমে সালেহ ভাইয়ের অফিসে আসি। সালেহ ভাইকে সাথে নিয়ে আমরা আফতাব আলী পার্কের কাছে গিয়ে নেমে যাই। মিলন ভাই গাড়িতেই থাকবেন। পুলিশ দেখলে সরে যাবেন। আমরা গ্লোবাল এইডের অফিসে গিয়ে মুহাম্মদ এরশাদুল্লাহকে চাইলাম। আমাদেরকে তার রোমে নিয়ে যাওয়া হলো। ভদ্রলোক তখন কম্পোউটারে কাজ করছিলেন। আমাদেরকে দেখে উঠে আসেন। সালেহ ভাই তাঁর পূর্ব পরিচিত। দীর্ঘ কথা হলো। আমাদেরকে তারা তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীর খবর দিলেন। তারা প্রচুর ছাত্রদেরকে সহযোগিতা করেন এবং দেশে প্রচুর কোরবানি দেন। তবে ছাত্রদেরকে তারা সহযোগিতা করেন স্পন্সর পেলে। কথা হলো তারা চেষ্টা করবেন আমাদের পাঁচ-সাতজন ছাত্রের জন্য স্পন্সর আনতে পারেন কি না। আর কোরবানির ব্যাপারেও আমি বললাম, যদি তারা সহযোগিতা চান তবে আমি দেশে তা করতে পারি। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় তাদের সাথে কথা হলো। সেখান থেকে বেরিয়ে মিলন ভাইকে নিয়ে সালেহ ভাইয়ের অফিসে আসি।
©somewhere in net ltd.