| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এগুলো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
রিযিক, গুনাহ এবং বারাকাহ: তিন হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ:-
সাম্প্রতিককালের ঘটনাগুলো কি শুধুই বিচ্ছিন্নতা? মেট্রো রেলের বিয়ারিং প্যাডে জীবনহানি, ভৈরবে জেলা ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনকারী কর্তৃক ট্রেন অবরোধ ও পাথর নিক্ষেপ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মাঝে ভয়াবহ সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও বাসে অগ্নিসংযোগ—এই সমস্ত অস্থিরতা কি কেবলই আইন-শৃঙ্খলার অবনতি?
গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, এই সমস্ত ঘটনার পেছনে কাজ করছে এক অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী সংযোগ। সেই সংযোগ হলো হারাম উপার্জন, গুনাহের ব্যাপকতা এবং আমাদের জীবন থেকে বারাকাহ (বরকত) উঠে যাওয়া।
আসুন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তিনটি প্রামাণিক হাদীসের আলোকে সেই সম্পর্কটি বিশ্লেষণ করি।
** ১. হারামের ভয়ংকর পরিণতি: বারাকাহ্ শূন্য জীবন
হারাম উপার্জনের ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন:
হযরত ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, "কোনো বান্দাহ যদি হারাম মাল দ্বারা কোনো কিছু উপার্জন করে এবং তা থেকে দান করে, তবে তার দান গ্রহণ করা হয় না। আর যদি সে তা খরচ করে, তবে তাতে তার জন্য কোনো বরকত থাকে না। আর যদি সে তা রেখে যায়, তবে তা তার জন্য জাহান্নামে যাওয়ার পাথেয় হয়। আল্লাহ্ গুনাহর দ্বারা গুনাহকে দূর করেন না; বরং নেকির দ্বারা গুনাহকে দূর করেন। অবশ্য মন্দকে মন্দ দূর করে না।”
– (সহীহ ইবনু হিব্বান, হাদিস: ৩৩৬৭)
এই হাদীসটি হারামের তিনটি মারাত্মক প্রভাব স্পষ্ট করে:-
ক) দান ও ইবাদত কবুল হয় না: হারাম সম্পদ থেকে দান বা সদকা করলে আল্লাহ্ তা কবুল করেন না। আল্লাহ্ পবিত্র, আর তিনি কেবল পবিত্র জিনিসই গ্রহণ করেন।
খ) জীবন থেকে বারাকাহ্ লোপ: যদি সে তা নিজের প্রয়োজনে খরচ করে, তবে তাতে কোনো বারাকাহ্ থাকে না। আপনার অর্থের পরিমাণ হয়তো বাড়ে, কিন্তু সেই অর্থ জীবনে শান্তি আনে না। চাহিদা পূরণ হয় না, রোগ-শোক বাড়ে, পারিবারিক অশান্তি লেগেই থাকে—অর্থাৎ, অর্থ থেকেও অভাবী। এই বারাকাহ্ শূন্যতার ফলেই সমাজে তুচ্ছ কারণে মারামারি, কাটাকাটি, ধৈর্যহীনতা এবং নৈতিক অবক্ষয় দেখা যায়।
গ) জাহান্নামের পাথেয়: যদি সে এই হারাম সম্পদ জমা করে রেখে যায়, তবে তা তার জন্য জাহান্নামে যাওয়ার পথ তৈরি করে। লক্ষ্য করুন, যে সম্পদ সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়া হলো, সেই সম্পদই অনেক সময় পরিবারে বিবাদ, ঝগড়া এবং অবশেষে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার মতো ঘটনার জন্ম দেয়। রিযিকে বারাকাহ্ থাকলে সামান্য সম্পদেও যে শান্তি থাকে, হারাম আয়ের প্রাচুর্যে তা থাকে না।
**২. গুনাহের কারণে রিযিক থেকে বঞ্চিত হওয়া
গুনাহ কেবল আখিরাতের ক্ষতি করে না, বরং ইহকালেও আমাদের প্রাপ্য রিযিকে আঘাত হানে।
হযরত সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, "সৎকর্ম ছাড়া অন্য কোনো কিছু আয়ুষ্কাল বাড়াতে পারে না। আর দু'আ ছাড়া অন্য কোনো কিছু তাকদীর রদ করতে পারে না। এবং নিশ্চয়ই মানুষ তার পাপকাজের দরুন তার প্রাপ্য রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়।”
– (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪০২২)
আমরা যখন রাত-দিন পরিশ্রম করেও সচ্ছলতা পাই না, তখন এই হাদীসটিই এর কারণ স্পষ্ট করে দেয়। আমাদের ব্যক্তিগত পাপাচার (যেমন: মিথ্যা, অশ্লীল ভিডিও দেখা, অন্যের হক মারা, নামাজে অলসতা) আমাদের রিযিকের রাস্তাকে রুদ্ধ করে দেয়।
ক)রিযিক আটকে যাওয়া: হয়তো আল্লাহ্ আপনার জন্য একটি বড় রিযিকের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, কিন্তু আপনার পাপাচারের কারণে আপনার কাছ পর্যন্ত সে রিযিক আর পৌঁছাচ্ছে না।
খ) বারাকাহ্ চলে যাওয়া: রিযিকের পরিমাণ হয়তো ঠিকই থাকে, কিন্তু পাপের কারণে তার থেকে বারাকাহ্ চলে যায়। মন এমন অস্থির থাকে যে, হাজার টাকা থাকলেও জীবনে কোনো শান্তি বা তৃপ্তি আসে না।
**৩) সমষ্টিগত গুনাহের সামাজিক পরিণতি: শান্তি ও নিরাপত্তা লোপ
ব্যক্তিগত গুনাহের পাশাপাশি সমাজের সম্মিলিত পাপ কীভাবে সমষ্টিগতভাবে সকলের রিযিক ও শান্তি কেড়ে নেয়, তা এই হাদীসে সতর্ক করা হয়েছে:
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও…
১. যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি তারা তা ঘোষণা করতে থাকে, তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগ রোগ ও এমন সব ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায় নি।
২. যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কম দেয়, তখন তাদের ওপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসীবত এবং তাদের শাসকের তরফ থেকে অত্যাচার।
** ৩) যখন তারা তাদের সম্পদের যাকাত আদায় করে না, তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো, তাহলে তাদের ওপর আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না।
** ৪) যখন কোনো জাতি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ্ তাদের ওপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীল করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ কেড়ে নেয়।
**৫) যখন তাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ্ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন।"
– (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং: ৪০১৯)
এই হাদীসের দিকে দৃষ্টি দিলে আজকের সমাজের চিত্র স্পষ্ট হয়:-
ক) ওজন ও মাপে কম দেওয়া: ব্যবসায়িক অসততা আজ চরম আকার ধারণ করেছে। ফলস্বরূপ, হাদীসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী—দুর্ভিক্ষ, বিপদ-মুসীবত এবং চারিদিকে অভাব লেগেই আছে। জীবন ধারণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
খ) যাকাত আদায় না করা: সম্পদ পবিত্র করার এই কাজটি ত্যাগ করার ফল—বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাওয়া। অক্টোবর মাসেও অসহ্য গরম, বাতাসের অভাব। কৃষকের ফসল ফলানো কঠিন, সার্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
গ) আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা: আল্লাহকে রব এবং মুহাম্মদ (ﷺ)-কে রাসূল মানার অঙ্গীকার আজ ভঙ্গ হচ্ছে। কেউ আল্লাহ-রাসূলকে গালি দিচ্ছে, কেউ কুরআন পদদলিত করছে। এই গুনাহের ফলস্বরূপ, বিজাতীয় দুশমন আমাদের সম্পদ কেড়ে নিচ্ছে, আর আমরা গণতন্ত্রের নামে পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ। আমাদের উপার্জনের ওপরও আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।
ঘ) আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী মীমাংসা না করা: যখন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন থাকে না, গাইরুল্লাহ'র শাসন ও ক্ষমতার জন্য একদল আরেক দলের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি, সংঘর্ষ, ভাঙচুর লেগেই থাকে। এই অস্থিরতাই আমাদের রাস্তাঘাটের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকু কেড়ে নিয়েছে।
উপসংহারঃ--
আজকের সমাজ ও জীবনের করুণ চিত্রের দিকে তাকালে আল্লাহর কুরআন ও রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর হাদীসের সত্যতা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। মেট্রো রেলের দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে ট্রেন অবরোধ, ক্যাম্পাস সংঘর্ষ—সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের হারাম আয়ের দিকে ডুবে থাকা এবং ব্যাপক পাপাচারের সমষ্টিগত ফল।
মুসলিম ভাই ও বোনদের কাছে আবেদন:-
রিযিকের পরিমাণ নয়, গুনাহমুক্ত রিযিকের বারাকাহ্-ই আপনার জীবনে শান্তি, সচ্ছলতা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে পারে।
আসুন, হারাম উপার্জন এবং যাবতীয় গুনাহ থেকে দূরে থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি। তবেই ইন শা আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিগত জীবন এবং সমাজের সার্বিক শান্তি ফিরে আসবে। আল্লাহু আকবার! আল্লাহ আর তাঁর রাসূলের বাণী কতই না সত্য!
----RabAh✍️
---২৮১০২০২৫ইং
#rabahsকাব্যকথা
©somewhere in net ltd.