![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভূমিকা
ইভটিজিং এর সাধারণ কোন সংজ্ঞায়ন বা ব্যাপ্তিকে চিহ্নিত করা অনেক সমস্যাজনক। কোন বিষয়টাকে ইভটিজিং বলা যাবে আর কোন বিষয়টাকে ইভটিজিং বলা যাবে না সে বিষয় সম্পর্কে একক মানদন্ড তৈরি সমস্যাজনক। কারণ বয়স, লিঙ্গ, শ্রেণীভেদে ইভটিজিং এর যে আচরণগুলোকে চিহ্নিত করা হয় তার মধ্যে কোন সমরূপী ক্যাটাগরিকে মানদন্ড হিসেবে উপস্থাপন করা যায়না।
একজন পুরুষ যেভাবে ইভটিজিং কে সংজ্ঞায়িত করেন, যেভাবে ইভটিজিং এর আচরণগুলোকে ক্যাটাগরি করেন তার ভাবনার সাথে একজন নারীর ইভটিজিং সম্পর্কিত যে ভাবনা চিন্তা তার মধ্যে প্রবল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। একজন যুবক / কিশোর যে ধরনের আচরণগুলোকে শুধুমাত্র নির্ভেজাল আনন্দ / মজা এ সকল প্রত্যয় দ্বারা ক্যাটাগরিকৃত করে থাকেন সেই বিষয়গুলোই আবার একজন নারীর কাছে নারীত্বের অপমান সূচক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হতে দেখা যায়।
আবার পুরুষদের মধ্যে তার সামাজিক অবস্থান ,বয়স ভেদে এই ইভটিজিং সম্পর্কিত ভাষ্যগুলো ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন পিতা যিনি একজন পুরুষ তার ইভটিজিং সম্পর্কিত ভাবনার সাথে একজন কিশোর / যুবক বয়সী যিনিও একজন পুরুষ তার চিন্তার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত পুরুষদের ইভটিজিং সম্পর্কিত ভাবনা তাদের অবস্থাগত ভিন্নতার জন্য পার্থক্যের আনয়ন করে থাকে। তবে একথাও সত্য যে, ইভটিজিং এর একমাত্র শিকার নারীরা। আর এই ইভটিজিং কারীরা হয়ে থাকে পুরুষরা। তাই সমাজের আধিপত্যশালী শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে পুরুষদের শ্রেণী, বয়স, অবস্থানের প্রেক্ষিতে যে ধরনের পার্থক্যকে নির্দেশ করা হয়া তা খুবই সূক্ষ্ম।
প্রত্যয়গত অর্থায়ন
ইভটিজিং প্রত্যয়টির অর্থায়ন করা সহজসাধ্য / সাধারন বিষয় নয়। এই প্রত্যয়টির যথোপযুক্ত অর্থ কি দাঁড়ায় তা নিয়েও যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। সুলতানা ও খাতুন (২০০৬) তাদের উপস্থাপনকৃত একটি প্রবন্ধে বলেন, ‘রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় নারীর প্রতি ছুঁড়ে দেয়া পুরুষের (সাধারনত: অচেনা, অনাতœীয়) যৌনগন্ধী, আক্রমণাতœক ও সহিংস মন্তব্য ও আচরণকে বোঝানোর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার কথ্য ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় এই বাগধারাটা প্রচারিত ও প্রচলিত হয়ে পড়েছে। ইভটিজিং এর বাংলা প্রতিশব্দ প্রস্তাবনা করা যেতে পারে “হাওয়া বিবির হয়রানি” (সুলতানা ও অন্যান্য,২০১০) ।
আবার ‘ইভটিজিং’ প্রত্যয়টা নিজেই সমস্যাজনক। ইভটিজিং প্রত্যয় দ্বারা যে ধরনের অপরাধ কে বোঝানো হয় তার প্রত্যয় গত অর্থের কারণে অনেক খানি লঘুতায় পর্যবসিত হয়। আমরা যদি ‘ইভটিজিং’ এর সরাসরি শাব্দিক অর্থ করি তাহলে দেখবো যে, এখানে ‘ইভ’ বলতে মানব জাতির আদি মাতা বা হাওয়াকে বোঝায় আর ‘টিজিং’ বলতে বিরক্ত করাকে বোঝায়। কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রেক্ষিতে এত সহজভাবে প্রত্যয়টির প্রত্যয়গত অর্থকে মর্মোধ্বার করা সম্ভব নয় কারন এর অর্থ আরো ব্যাপক আরো বি¯তৃত।
ইভটিজিং কে প্রত্যায়িত করার ক্ষেত্রে ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ বলা হচেছ ইভটিজিং এর ক্ষেত্রে ভাষা হচ্ছে এমন একটা উপাদান যার মাধ্যমে নারীর অধস্তনতাকে নিশ্চিত করা হয়। বলেন যে, এই আক্রমণ ভাষাগত। হাওয়ার হয়রানি একটি হালকা ওজনের অস্ত্র দ্বারা ভাষার সাহায্যে মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদাকে লঙ্ঘন করে। প্রত্যাঘাতের আশংকা ছাড়াই প্রত্যহ তাকে তার হীনতার অবস্থান কে মনে করিয়ে দেয়া যায়, তার অধস্তনতাকে প্রতিদিন নিশ্চিত করে তোলা যায়, নতুন করে তৈরি করা যায় (সুলতানা ও খাতুন,২০০৬: সুলতানা ও অন্যান্য,২০১০) ।
চিত্র:১ রাস্তায় ইভটিজিং এর স্বরূপ
ইভটিজিং কে চিহ্নিত করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে নারীর আত্ম (ঝবষভ) কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ নারীর কখনও কোন আচরনকে টিজিং মনে করবেন তা নির্ভর করছে তার উপর। মহিলা পরিষদের আইনজীবী মাসুদা আক্তার লাইলী বলেন, “অশোভন আচরণ কিংবা অঙ্গভঙ্গি করলে নারী যদি অসম্মান বোধ করে তবে তাই ইভটিজিং” (সাপ্তাহিক, ২০০০)। কিন্তু এই সংজ্ঞায়নে সমস্যা দেখা যায় আর তা হল নারীভেদে মানসিকতা ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই একজন নারীর নিকট যেটা অশোভন আচরন তা আবার অন্য নারীর নিকট অশোভন নাও হতে পারে।
ইভটিজিং কে সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে একজন (শেলী) বলেন, নারীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে তাদের প্রতি বাজে মন্তব্য করা, শিষ দেয়া, অশালীন অঙ্গ ভঙ্গি করা, শরীরের বিশেষ কোন অংশের দিকে তাকিয়ে থাকা অথবা হাত দিয়ে ধাক্কা দেওয়া প্রভৃতি আচরণকে ইভটিজিং বলা যেতে পারে। তবে অন্য একজন এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষন করেন। তিনি (রোজিনা) বলেন, ইভটিজিং বলতে শুধুমাত্র মৌখিক অশালীনতা বা নিপীড়নকে (ঠবৎনধষ ধনঁংব) বোঝায়। আর এই অশালীনতা যখন শারীরিক পর্যায়ে হয়ে থাকে তখন তাকে বলা যেতে পারে যৌন হয়রানি (ঝবীঁধষ যধৎধংংসবহঃ) । ইভটিজিং ও যৌন হয়রানিকে তিনি পৃথক করেন শারীরিক ও মৌখিক নিপীড়নের মধ্যদিয়ে।
ইভটিজিং মূলত একটি ভাষাগত আক্রমণ। যেখানে ভাষার মাধ্যমে পুরুষরা নারীদের উপর তার কর্তৃত্বের বর্হিপ্রকাশ ঘটায়। ভাষার দৈনন্দিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যখন সরাসরি হয়রানিমূলক, সহিংস শব্দ বা বাক্য ব্যবহৃত হয় তখন আমরা বৈষম্যের কিংবা অবদমনের চেহারাটা সহজেই ধরতে পারি। পথে-ঘাটে অথবা কর্মক্ষেত্রে নারীকে লক্ষ্য করে ‘মাল’ ‘মাগী’ বলা হলে কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ধর্ষণের হুমকি দেয়া হলে (দিমু নাকি ঝোপে টান?), ক্লাসরুমে, টয়লেটের দরজায়, দেয়ালে, ব্লাকবোর্ডে নারীকে ছবি, বাক্য, কার্টুনে যৌন বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হলে সেই যৌনজ ভাষাকে চিনতে আমাদের কোন অসুবিধা হয় না (ফেরদৌস এবং ইসলাম: ২০০০: ২৯৯)।
আবার ভাষা শ্রেণীভেদেও ভিন্ন হতে পারে। এক শ্রেণীর লোক যে ভাষায় তাদের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করে ঠিক একই ভাষা অন্য শ্রেণীর লোকের কাছে অপরিচিত না হলেও ব্যবহার সিদ্ধ নয় (চৌধুরী: ২০০১)। ভাষার মাধ্যমে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা শাসক শ্রেণীর মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। যেখানে শাসক শ্রেণী (ইউরোপীয়ান) আফ্রিকায় তাদের শাসনকার্য পরিচালনার সময় স্থানীয় ভাষাকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের মতাদর্শ ভাষার মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে প্রবেশ করায় (ঈড়সধৎড়ভভ ধহফ পড়সসধৎড়ভভ; ১৯৯২)। তাই ইভটিজিং এর ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষরা ভাষার মাধ্যমে নারীদের অধস্তনতার বিষয়টিকে মনে করিয়ে দেয়। আর এক্ষেত্রে দেখা যায় নারীকে উত্ত্যক্ত করার ভাষাগুলো সকল শ্রেণীর পুরুষদের একই রকম হয়ে থাকে অর্থাৎ সকল ভাষায় নারীর শরীর কিংবা যৌনতা কেন্দ্রীক।
বয়সভেদে ধারণায়ন
গবেষণার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বয়স ভেদে ইভটিজিং এর যে আচরণিক প্রত্যয়ন তা ভিন্ন হয়। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন বয়সের পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ইভটিজিং কে প্রত্যয়ন করেন। একজন উত্তরদাতা (সুমন) যার বয়স ২৪ বছর । তিনি বলেন যে, “মেয়েদের দোষেই মূলত এধরনের (ইভটিজিং) কাজ করা হয়ে থাকে। কারণ তারা একভাবে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের টিজ করার জন্য। কারণ আমাদের সমাজ তাদেরকে (নারী) যতটুকু স্বাধীনতা দেয় তার বাইরে গেলে তাদেরকে তো কথা শুনতে হবেই”। আবার অপর উত্তরদাতা (জনি) যার বয়স ২৫ বছর । তিনি বলেন, “কথা বলা যদি হয় মেয়েদের উত্ত্যক্ততা করা তবে তো কথা বলাই ছেড়ে দিতে হবে। একজন মেয়েকে সুন্দর বলা যাবে না এ কেমন কথা ? আর আমরা তো স্রেফ মজা করার জন্য এসব কথা বলে থাকি”। অপর উত্তরদাতা (মাসুদ) যার বয়স ২৪ বছর। তিনি ইভটিজিং এর জন্য মেয়েদের পোশাককে দায়ী করেন। তিনি বলেন, “আজকাল মেয়েরা যে ধরনের পোষাক পরে তাতে কথা না বলে পারা যায় না”।
কিন্তু একজন উত্তরদাতা (আকবর হোসেন) যার বয়স ৪৫ বছর। তিনি একজন পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও বলেন যে, “ইভটিজিং বিষয়টা নিয়ে বর্তমানে বেশ আলোচনা হচ্ছে । আর এর জন্য দায়ী আসলে বর্তমান সময়। এখনকার ছেলেরা সব ইচড়ে পাকা। অল্প বয়সী ছেলেরা রাস্তায় মেয়েদের সাথে যে ধরনের আচরণ করে তা আসলেই খারাপ লাগার মত। তাদের মত বয়সে আমরা এসব করার সাহস পেতাম না”। আজকাল মেয়েরাও রাস্তায় যেভাবে বের হয় তা সমস্যাজনক। আমাদের সমাজ মেয়েদের কে এভাবে চলাফেরা করার অনুমতি দেয় না। অর্থাৎ তিনি কিন্তু একভাবে ইভটিজিং এর জন্য নারীকেও দায়ী করেন।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, একজন বয়স্ক পুরুষ ইভটিজিং এর জন্য বর্তমান প্রজন্মকে দায়ী করেন। একজন পুরুষ হয়েও তিনি পুরুষকে দায়ী করছেন ইভটিজিং এর জন্য। কিন্তু যুবক বয়সী উত্তরদাতারা ইভটিজিং বিষয়টাকে মজা করা, নারীর দোষ বলে অবহিত করে। তাই দেখা যায় যে, বয়স ভেদে খোদ পুরুষের মধ্যে ইভটিজিং এর ধারণায়নে ভিন্নতা রয়েছে।
শ্রেণীভেদে ধারণায়ন
ইভটিজিং সম্পর্কিত যে ধারণায়ন তার মধ্যে শ্রেণীগত কারনেও তফাত ঘটে থাকে। একজন উত্তরদাতা (কবির), যিনি একজন রিক্সা চালক, তার কাছে ইভটিজিং অর্থটাই পরিস্কার নয়। তবে তার রিক্সায় মেয়েরা উঠলে রাস্তায় ছেলেরা মাঝে মাঝে খারাপ কথা বলে। তাকিয়ে থাকে এসব বিষয় তিনি লক্ষ্য করেছেন। তিনি বলেন, “মেয়েগে যে করে কথা কওয়া হোতেচে তা কারুর দোষ না। দেশে মেয়ি-ছেলে বেড়ে গেছে। তাই ছেলিরা তো ও রকম করবে। তিনি আরও বলেন যে, এগুলো হল কেয়ামতের আলামত।”
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, একজন দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ যে কিনা দিন আনে দিন খায় তার চিন্তার সাথে একজন মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের পাথ্যক্য রয়েছে। কবির তার ধারণাকে একভাবে ধর্মের সাথে মিলিয়ে দেখছে। আর মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষরা ইভটিজিং কে একটা সামাজিক সমস্যা
হিসেবে চিহ্নিত করছেন। তাই দেখা যাচ্ছে যে, একজন মানুষ একটি শ্রেণীতে বসবাস করার কারণে সেই শ্রেণীর মূল্যবোধকে ধারণ করে যা তার চিন্তার মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হয়।
ইভটিজিং সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা সকল শ্রেণীর নারীর ক্ষেত্রে আবার এক রকম নয়-
“রেহানার বয়স ১৩ বছর, সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। তার বাবা একজন মুদি দোকানদার। তার মা একজন গৃহিণী। তার আর দুইটি বোন ও একটি ছোট ভাই আছে। সে তার ভাইবোনদের মাঝে দ্বিতীয়। তার বড় বোন দশম শ্রেণীতে পড়ে । তার ছোট বোনটা তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। আর তার ভাই স্কুলে যায় না। রেহানা গান গাইতে ও শুনতে ভালবাসে। তাদের পাড়ায় এক ছেলে আছে, তার নাম রহিম। সে রেহানার চাইতে পাঁচ বছরের বড়। সে পড়াশুনা করে না। সে কাপড়ের দোকানে কাজ করে। সে ভাল গান করে। সেই সুবাদে রেহানার সাথে রহিমের একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রেহানা রহিম কে ভাই বলে ডাকে।
রেহানার বাইরে বেড়াতে যেতে ভাল লাগে। কিন্তু তার মা এসব পছন্দ করে না। তার পরও রোহানা মায়ের অগোচরে রহিমের সাথে কয়েকবার ঘুরতে গেছে। রহিমের সাথে ঘুরতে গেলে রহিম তাকে গান শুনাতো। যেটা রেহানার ভাল লাগত। সর্বশেষ যেবার রেহানা রহিমের সাথে ঘুরতে যায় তখন রহিম তাকে কয়েকটা গান শোনায়। গানগুলো রেহানার ভাল লাগায় সে রহিমকে অনুরোধ করে কয়েকটা গান তার খাতায় লিখে দেওয়ার জন্য। রহিম তার খাতায় পাঁচটি গান লিখে দেয়। কিন্তু গান লেখার পাশাপাশি ঐ খাতার পৃষ্ঠায় সে ইংরেজীতে তার নাম ও রেহানার নাম (জধযরস+জবযধহধ) লিখে দেয়।
রেহানার কাছে এবিষয়টা ভাল লাগে না। রেহানার বাইরে বেড়াতে যেতে ভাল লাগে, ঘুরতে ভাল লাগে এমনকি রহিমের গানও ভাল লাগে কিন্তু সে রহিমের এই বিষয়টা মেনে নিতে পারে না। রেহানাকে রহিম জানায় যে সে রেহানার সাথে প্রেম করবে। কিন্তু এই প্রেম, খাতায় নাম লেখার বিষয়গুলো রেহানার কাছে খারাপ লাগে।”
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, রোহানা এমন সময়ে এধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে যখন তার বয়সটা একটা বড় বিষয়। এই সময়টা হল বয়:সন্ধিকাল। এই সময়ে নর-নারীর ভেতরে পরিবর্তন শুরু হয়। পরিবর্তনের এই সময়ে ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বা হীনমন্যতাও কাজ করে। যা এক ভাবে ব্যক্তির মধ্যে দ্বৈততার তৈরি করে। ঠিক এই বিষয়টা লক্ষ্য করা যায় রেহানার মধ্যে সে একভাবে স্বাধীনভাবে চলতে চায় কিন্তু এই চলার ক্ষেত্রে যে সমস্যার তৈরি হয় তাকে মানতে চায় না বা মানতে পারেনা। তাই দেখা যায়, মায়ের বাধা সত্ত্বেও সে রহিমের সাথে বাইরে বেড়াতে যাচ্ছে কিন্তু নারী হওয়ার কারনে তার প্রতি রহিমের যে টান সে বিষয়টিকে রোহানা ভালভাবে নিতে পারে না। অর্থাৎ তার মধ্যে যে নারী সত্ত্বা (ংবষভ) আছে তার পূর্ণ বিকাশ তখনও হয়নি। তার মধ্যে শিশুসুলভ উচ্ছ্বলতা কাজ করছিল তখনও। যেটা রেহানার মধ্যে একটা দ্বৈততার (ফঁধষরঃু) সৃষ্টি করে। ফলে রহিমের আচরণগুলোকে সে কোন একটা নির্দিষ্ট প্রত্যয় দ্বারা বুঝতে পারেনি। তার পরও রহিমের আচরনগুলো তার খারাপ লেগেছে বলে সে জানায়।
অর্থাৎ ইভটিজিং এর বিষয়টা তার কাছে উপস্থিত “খারাপ লাগা” অনুভূতির মধ্যদিয়ে। কিন্তু রহিমের আচরণগুলো তার খারাপ লাগলেও তার (রহিম) সাথে বেড়াতে যেতেও রেহানার ভাল লাগে। তাই এখানে বলা যায় যে, প্রেমের প্রস্তাব বা খাতার পৃষ্ঠায় লেখাগুলো রেহানার ভেতর বিরক্তি বা বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করলেও পাশাপাশি তার মধ্যে কিছুটা ভাল লাগার বিষয়ও পরিলক্ষিত হয়। যা একভাবে তার ক্ষেত্রে ইভটিজিং এর ধারনায়ণকে / বিষয়গুলোকে দ্বিধাদ্বন্ধের উদ্রেক করে। অন্যভাবে দেখলে বলা যায়, রেহানা নারী হয়েও তার মধ্যে ও ইভটিজিং এর যে ধারণা তা একক কোন প্রত্যয়নকে সংজ্ঞায়নকে তুলে ধরে না। তাই বলা যায় নারী ভেদে ইভটিজিং এর অবগাহনের প্রক্রিয়াটা ভিন্ন হতে পারে।
ইভটিজিং এর ধরন
এতদসত্ত্বেও গবেষণার দ্বারা কতগুলি বিষয়কে/আচরন/বহি:প্রকাশ/ ভঙ্গিকে চিহ্নিত করা হয়েছে ইভটিজিং হিসেবে। তবে এই আচরণগুলো কোন সাধারণীকরন ক্যাটাগরিকে নির্দেশ করেনা। বরং ইভটিজিং বলে অবিহিত আচরণ/বহি:প্রকাশ/ভঙ্গিগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষিত, ভিন্ন আঙ্গিকের আনায়ন করতে পারে। পথে ঘাটে পুরুষ একা বা দলবদ্ধ সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে বা অপ্রাকাশ্যে নারীদের প্রতি যে ধরনের বিদ্বেষমূলক হয়রানিমূলক আচরণগুলো করে তাকে মোটামুটি ভাবে চিহ্নিত করা যায় এভাবে-
(১) নারীদের প্রতি অহেতুক তাকিয়ে থাকা।
(২) নারী শরীরের বিশেষ স্থানে দৃষ্টি দেয়া (বুক, নিতম্ব)।
(৩) নারীকে রাস্তায় বা বাসে ইচ্ছাকৃত ধাক্কা দেয়া ।
(৪) রাস্তা আগলে দাড়ানো।
(৫) নারীর পিছু নেয়া, অনুসরণ করা।
(৬) নারীকে ঘিরে ধরা।
(৭) নারীর প্রতি অশ্লীল মন্তব্য ছোড়া।
(৮) উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান গাওয়া ছড়া কাটা।
(৯) ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বা শব্দ করা (নারী শরীর ও যৌনতা)।
(১০) পোশাকের কোন অংশ ধরে টান দেয়া (ওড়না, শাড়ির আচল)।
(১১) বাজে ইশারা করা (হাতের মধ্যম আঙ্গল দেখানো)।
(১২) শারীরিকভাবে বাজে অঙ্গভঙ্গি করা।
(১৩) কুরুচিপূর্ণ ,যৌন ইঙ্গিত পূর্ণ, নারী শরীর কেন্দ্রীক লেখা ও ছবি আঁকানো (পাবলিক টয়লেট, বাসের সিটে, পাবলিক গ্রন্থাগার, স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঞ্চ/টেবিল/চেয়ার, বাড়ির দেয়াল প্রভৃতি স্থানে)।
(১৪) টেলিফোন বা মোবাইলে বিরক্ত করা (বাজে কথা বলা, যৌনইঙ্গিত পূর্ণ বার্তা, যৌনতা সমৃদ্ধ ছবি, সেক্সের প্রস্তাব দেওয়া)।
(১৫) নারীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দেয়া।
(১৬) শিষ বাজানো।
(১৭) বাজে ভাষায় গালাগালি করা ।
(১৮) জিব দিয়ে ভ্যাংগানো।
(১৯) নারীর অপরিচিত হয়েও কথা বলতে চাওয়া / গায়ে পড়ে আলাপ করা ।
(২০) পুরুষ দেহের বিশেষ অঙ্গ প্রদশন করা।
(২১) হঠাৎ করে হালকাভাবে নারীর শরীর স্পর্শ করা, ভিড়ের মধ্যে পিছন থেকে কোন নারীর নিতম্বে হাত দেওয়া, রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে কোন নারীর বুকে আলগা স্পর্শ করা।
(২২) নারীর শরীরের কোন বিশেষ অঙ্গের সাইজ জিজ্ঞাসা করা।
(২৩) কোন কিছু দিয়ে নারী শরীরে খোঁচা দেয়া।
(২৪) পেছন থেকে নারীর চুলে হাত দেয়া, টান দেয়া।
(২৫) অনাকাঙ্খিতভাবে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া ও তার জন্য চাপ বা বল প্রয়োগ করা।
(তথ্যসূত্র: মাঠকর্ম, ২০১০)
সর্বোপরি পুরুষ কর্তৃক এমন কোন কাজ বা আচরণ যা নারীকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত করে তাই ইভটিজিং বলে গন্য হবে। একভাবে দেখলে দেখা যায় যে, এই সকল আচরণের মধ্যে অনেক আচরণই সেই অনাদি কাল থেকে নারীর সাথে হয়ে আসছে। কিন্তু পূর্বে দেখা যায় ,এধরনের আচরণের সাথে পুরুষের হিংসাতœক/ধ্বংসাতœক মনোভাব জড়িত ছিল না। একজন উত্তরদাতা (রাশেদা) যার বয়স ৪৫ বছর। তিনি বলেন, আমাদের সময়ও স্কুলে যাওয়ার পথে ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকত। তারা আমাদের পেছনে স্কুলের গেট পর্যন্ত আসত। আবার স্কুল ছুটি হলে আমাদের পিছু নিত। কিন্তু কোন রকম উত্ত্যক্ত মূলক কাজ তারা করত না। বরং আমাদের মনে হতো তার আমাদের গার্ড দিয়ে স্কুল নিয়ে যেত এবং নিয়ে আসত। অর্থাৎ এখানে দেখা যাচ্ছে যে, মেয়েদের পিছু নেওয়ার মত কাজ ছেলেরা আগেও করত। তবে এর চেয়ে বেশি কিছু (রাস্তায় প্রকাশ্যে অশ্লীল কথা বলা, চড় মারা) করার সাহস তারা পেত না । তাই এ বিষয় নিয়ে তেমন কথা বলার দরকার হয়নি । অন্যদিকে এটাও হয়ত সত্য যে, বর্তমান সময়ে কিছু ঘটনায় মেয়েদের আত্মহত্যার কারনে নারীরা সকল ধরনের আচরণকে ইভটিজিং এর সাথে মিলিয়ে ফেলে। তাই কোনটা ইভটিজিং আর কোনটা ইভটিজিং না তাকে চিহ্নিত করাও সমস্যাজনক।
ইভটিজিং এর স্থান ও মাধ্যম
ইভটিজিং নামক সামাজিক ব্যাধি কোথায় সংঘটিত হয় তার কোন একক স্থানকে নির্দিষ্ট করা কঠিন। বরং বলা ভাল যেখানে নারীর বিচরন সেখানেই ইভটিজিং সংঘটিত হয়। আমাদের সমাজে নারীর চলার পথের সকল পরিক্রমায় ইভটিজিং এর সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি পরিবারের মধ্যেও নারীকে এই টিজিং এর শিকার হতে হয়। তাই কোন নির্দিষ্ট স্থানকে কেন্দ্র করে ইভটিজিং কে বোঝা সম্ভব নয়। তবুও যে সকল স্থানে এধরনের ঘটনা (ইভটিজিং) বেশি হয়ে থাকে সে সকল স্থানগুলোকে মোটামুটি ভাবে চিহ্নিত করা যায়-
(১) জনসাধানের চলাচলের রাস্তা।
(২) মেয়েদের স্কুল/কলেজের সামনে।
(৩) স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে।
(৪) বাস স্টপেজ, রেল ষ্টেশন, লঞ্চঘাট।
(৫) বিভিন্ন পাবলিক যানবাহনে।
(৬) মার্কেটের ভীড়ের মধ্যে।
(৭) শপিংমল, অফিস, কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেখানে নারীরা চাকুরি/ কাজ করে।
(৮) বিভিন্ন উৎসবের ভীড়ে ও অনুষ্ঠানে (বিয়ে, পূজা, মেলা)।
(তথ্যসূত্র: মাঠকর্ম, ২০১০)
বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল গুলোতে ইভটিজিং এর ভিন্ন ভিন্ন ধরন পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন দোকানের (শাড়ি, গহনা, কসমেটিকস, বই) কর্মচারী বা সেলস বয়রা বিভিন্নভাবে নারী ক্রেতাদের উত্ত্যক্ত করে থাকে। ওয়ারা (ছদ্মনাম)একদিনের ঘটনা বললেন “একটি বই খুঁজতে তিনি নীলক্ষেত মার্কেটের ভেতরে গিয়েছিলেন । এক পর্যায়ে বইটি খুঁজেও পেলেন। তবে বইটিতে একটু ত্রুটি থাকায় তিনি বইটি নিতে অস্বীকার করলে বইয়ের দোকানদার তাকে অশ্রাব্য ভাষায় কিছু বলল। আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি। দ্রুত চলে এলেন ওখান থেকে। মনটা তার এত খারাপ হয়ে গেল যে, মার্কেটে ঘুরে আর বই খোঁজার ইচ্ছা হল না। বই না কিনেই বাসায় চলে এলেন তিনি”। আবার একটু ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করেন শিমু। “ছোট ভাইকে নিয়ে বই কিনতে এসেছিলেন। বই খুঁজতে খুঁজতে মার্কেটের ভেতর চলে যাওয়ায় হঠাৎ দোকানের একটা লোক বাজে কিছু মন্তব্য করে। কিন্তু ঐ মন্তব্য টা শিমু হজম করতে না পেরে বলেন যে, বইয়ের দোকানের মতো পবিত্র জায়গায় বসে মেয়েদের দিকে বাজে মন্তব্য ছুড়লেন কেন? দোকন ছেড়ে রাস্তায় এসে শুরু করেন সেটা ভাল মানাবে”। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই মে, ২০১০)
এখানে দেখা যায় যে, একজন ব্যবসায়ী হয়েও ক্রেতা হিসেবে নারীকে পাওয়া ঐ ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ সুলভ মনোভাব জেগে ওঠে। অর্থাৎ নারী সবখানেই নারী আর পুরুষ সব খানেই পুরুষ। নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্কটা এখানে অদৃশ্যমান। আর শিমু ও ওয়ারা উভয়ই টিজিং এর শিকার হলেও শিমু হয়তো কিছুটা প্রতিরোধ করতে পেরেছেন। তবুও এধরনের ঘটনা নিত্যদিনকার একটা সাধারন বিষয়েরই প্রতিচ্ছবি।
অন্যদিকে বিক্রেতা (সেলস গার্ল) যদি কোন নারী হয়ে থাকে তবে তাকেও পুরুষ ক্রেতার দ্বারা ইভটিজিং এর শিকার হতে হয়। পুরুষ ক্রেতারা দোকানের অন্যান্য পন্যের মত সেখানে কর্মরত নারীকে পণ্য হিসেবে গন্য করে। সেখানে ক্রেতা বিক্রেতার সম্পর্ক আর থাকে না বরং পরিলক্ষিত হয় আধিপত্যশালী পুরষ ও ক্ষমতাহীন নারীর সম্পর্ক। আর এই ধরনের হয়রানির বিরুদ্ধে সেখানে নারীরাও কিছু বলতে পারেনা। কারণ একে তো সমাজে নারী হিসেবে নিগৃহ তার উপর দোকানের কর্মচারি হওয়ার তার আর কিছু বলার থাকে না।
বিভিন্ন শাড়ি, গহনার দোকানগুলোতে একই রকম চিত্র পরিলক্ষিত হয়। সেখানকার পুরুষ কর্মচারিরা পণ্য বিক্রয়ের সময় বিভিন্ন উটকো মন্তব্য করে থাকে। বিশেষ করে নারী শরীর সৌন্দর্য (আপা তো দেখতে সুন্দর, গায়ের রঙের সাথে শাড়ি মানাবে, আপার সাইজের সাথে এটা পুরো খাপ খাবে) নিয়ে তারা মন্তব্য করে থাকে। আবার দোকানে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন নারী ‘ডামি’ মাঝে মাঝে নারীদের বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে দোকানের পুরুষ কর্মচারিরা এধরনের কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে করে থাকে।
অন্যদিকে বিভিন্ন পাবলিক যানবাহনে (ট্রেন, বাস, লঞ্চ, ফেরি) ইভটিজিং হয়ে থাকে। এগুলো হয়ে থাকে প্রকাশ্যে আবার কথনও অপ্রকাশ্যে । মতিঝিল গামী একটি পাবলিক বাসে আবাহনী মাঠে ও পনের নম্বর হতে স্কুল ড্রেস পরা কয়েকজন ছাত্র গাড়িতে উঠে। তারা পেছনের ছিটগুলোতে বসে। খানিক বাদেই তারা গাড়ির মধ্যে গান বাজনা শুরু করে। এক পর্যায়ে বাসের মহিলা যাত্রীদের শুনিয়ে প্যারোডি ও অশ্লীল কথাবার্তা শুরু করে। বাসের একজন যাত্রী (মামুন) তাদের নিষেধ করলে তারা তাকে (মামুন) মারতে উদ্যত হয়। গাড়ির অন্য যাত্রীরা তাকে কোনমতে রক্ষা করেন। এরপরও টিজিং বন্ধ হয় না। বরং তারা দ্বিগুন উৎসাহে আবার গান বাজনা শুর করে । রাজধানীর বিভিন্ন রুটে বাস যাত্রীদের এ রকম ঘটনার শিকার হতে হচেছ হরহামেশাই। পুরষ যাত্রীরা প্রতিবাদ করতে এলে তাদের লাঞ্ছিত হতে হচেছ। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে বয়স্ক যাত্রীদের । (দৈনিক যুগান্তর, ১২ এপ্রিল, ২০০৯)
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ইভটিজিং এর ক্ষেত্রে কিশোর বয়সীরা খুব ক্রিয়াশীল । তারা দলবদ্ধ থাকলে পাবলিক পরিসরে ও এধরনের আচরণগুলো করে থাকে অবলীলায়।
আবার পাবলিক বাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত যেসব আসন রয়েছে তাতে পুরুষরা বসে থাকে। নারীরা এসব আসন ছেড়ে দিতে বললে অনেক সময় তাদের অশ্লীল কথা (সমান অধিকার চাও তাহলে আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা কোথায়, তোমরা কি বাড়ির বউ যে তোমাদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেব) শুনতে হয়।
এ ধরনের প্রকাশ্য টিজিং ছাড়াও দেখা যায় বাসের সিটের গায়ে ,ট্রেনের টয়লেটে, ফেরির টয়লেটে, বিভিন্ন রকম অশ্লীল বাক্য লেখা থাকে যা একজন নারীকে মানসিকভাবে হেনস্থা করতে পারে। পুরুষদের এহেন কাজগুলোও যেহেতু নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তাই এগুলোও এক ধরণের ইভটিজিং। আর সেখানে নারী শরীর ও যৌনতা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, নারীকে উত্ত্যক্ত কতে পুরুষরা সর্বক্ষেত্রে প্রায় একই রকম ভাষা ব্যবহার করে থাকে।
ইভটিজিং এর পরিবর্তিত মাধ্যম
তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষের সময়ে এসে দেখা যায় ইভটিজিং এর ক্ষেত্রে ধরন (ভাষা, আচরণ) না বদলালেও তার মাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে বেশ খানিকটা। বিশেষ করে মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ই-মেইল প্রভৃতি ইলেকট্রনিক মাধ্যম দ্বারা নারীদের উত্ত্যক্ত করা হচেছ। এর মধ্য সবচেয়ে সহজলভ্য প্রযুক্তি হল মোবাইল, যার মাধ্যমে নারীদের উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
মোবাইলে টিজিং এর বিষয়টা নিয়ে এক উত্তরদাতা বলেন, ছেলেরা মজা করার জন্য অপরিচিত নম্বরে ডায়েল করে, অপর প্রান্ত থেকে কোন মেয়ে কন্ঠ শুনলে সেই নম্বরে ছেলেরা অনবরত কল করতে থাকে এবং ঐ মেয়েটিকে বিরক্ত করতে থাকে। এটা করে তারা মজা পায়। আবার এও দেখা যায় যে, ছেলেরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে মেয়েদের নম্বর আদান প্রদান করে থাকে। যার ফলে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
একজন নারী উত্তরদাতা তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, মূলত রাত বারোটার পর এধরনের অযাচিত ফোন কলগুলো আসতে থাকে। ফোন ধরলে কথা বলতে চায় কথা না বললে তখন অপর প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রকম বাজে ম্যাসেজ পাঠায়। ম্যাসেজের ভাষা মাঝে মাঝে এতই কুরুচিপূর্ণ তা মুখে আনা যায় না। অপর নারী উত্তরদাতা বলেন, ছেলেরা যখন খুশি তখন বিরক্ত করে। ছেলেদের কাছে অনেক গুলো সিম থাকে বিধায় একটা নম্বর রিসিভ না করলে অন্য নম্বর থেকে কল করে। তাই বাধ্য হয়ে মেয়েদের ফোন বন্ধ রাখতে হয় না হলে সিম বদলে ফেলতে হয়।
ইভটিজিং এর ক্ষেত্রে মোবাইলের অন্য আর একটি ব্যবহার হল এর মাধ্যমে লুকিয়ে মেয়েদের ছবি তোলা হয়। বিশেষ কায়দায় মেয়েদের অসতর্কতার মুহুর্তের ছবি তোলা হয় এর মাধ্যমে, যে ছবি আবার ছেলেদের একজনের মোবাইল থেকে অন্যজনের মোবাইলেও পাঠানো হয়। এ ভাবে একটি মেয়ের ছবি বিভিন্ন জনের হাত বদল হতে থাকে কিন্তু মেয়েটি হয়ত কিছুই জানে না। একজন নারী উত্তরদাতা বলেন যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তাদের ক্লাসে একজন সুন্দরী সহপাঠী আছে। যার সাথে ক্লাসের ছেলেরা বিভিন্ন সময় ফাজলামো (টিজ) করে। এমনকি এক দিন তারা কয়েকজন বন্ধু ক্লাসে বসেই তার ঐ সহপাঠীর বুকের ছবি তোলে লুকিয়ে কিন্তু তার সহপাঠী কিছুই জানে না।
এধরনের টিজের ঘটনা অহরহ ঘটছে। ছেলেদের জন্য বার বার সিম বদলানো, ফোন বন্ধ রাখা বা কোন কোন ক্ষেত্রে মেয়েরা ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দিচ্ছে। আর অযাচিতভাবে মেয়েদের যে বিশেষ মুহুর্তের ছবি তোলা হয় তা অনেক ক্ষেত্রে মেয়েটির জন্য সমস্যার তৈরি করছে। আবার দেখা যায় মেয়েদের নম্বর গুলো বিভিন্ন পাবলিক টয়লেট, পাবলিক যানবাহনের সিটে লেখা থাকে। যেখান থেকে নম্বর নিয়েও অনেকে মেয়েদের বিরক্ত করতে থাকে। ফলে বার বার সিম বদল করেও নারীরা এধরনের টিজের থেকে রেহাই পচ্ছেনা।
অন্যদিকে ফেসবুকের মাধ্যমে নারীদের হয়রানি বা উত্ত্যক্ত করার ঘটনাও আশংকাজনক হারে বাড়ছে। তিথি (ছদ্মনাম) নামে একজন নারীর ক্ষেত্রে এধরনের ঘটনা ঘটে। তার বাবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একনজ কর্মকর্তা। তিথি কলেজে পড়াশুনা করে। হঠাৎ করেই তার নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে ফেলে কারা যেন; তার ছবি ব্যবহার করা হল সেখানে। গ্রুপের নাম “তিথির প্রেমিক আমরা সবাই”। গ্রুপটিতে তার সম্পর্কে ভয়াবহ রকমের বাজে তথ্য দিয়ে সামাজিক ভাবে হেয় করার যত চেষ্টা সবই চলতে থাকল।
আবার গনমাধ্যমের সাথে যুক্ত এক তরুণ তার নিজের ফেসবুক অ্যালবামে পরিবারের ছবি আপলোড করেন। কিন্তু ছবি আপলোড করার পরের দিনই তিনি দেখতে পান তার স্ত্রীর ছবিতে শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় ফেসবুকের একজন সদস্য ট্যাগ করে অশ্লীল মন্তব্য করেছে। তরুণ গনমাধ্যমকর্মী খুঁজে বের করেন এই অপকর্মের হোতার বাড়ি বগুড়ায় এবং ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালায়। ছবি থেকে ট্যাগ মুছে তার মোবাইল নম্বর খুজে বের করে তাকে ফোন করা হলে সে জানায় তার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড অন্য এক বন্ধুর কাছে ছিল। কাজটি সে করেছে এবং এর জন্য সে দুঃখ প্রকাশ করে। এর চেয়ে বেশি কিছু করার কোন উপায় ঘটনার শিকার গনমাধ্যম কর্মীটিও পেলেন না। শুধু ফেসবুকে তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করলেন। কিন্তু সেই সদস্য এখনও ফেসবুকে বহাল তবিয়তে রয়েছে। (সাপ্তাহিক ২০০০, সংখ্যা; ১১)
উপরের ঘটনা দুইটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও পরিচিত সামাজিক যূথবদ্ধতা সংক্রান্ত সাইট ফেসবুকের। এ দুইটি ঘটনা প্রমান করে ফেসবুকে প্রতিদিন নীরবে কিভাবে ঘটে চলছে নারীর উপর মানসিক নির্যাতন। জনপ্রিয় এই সাইটে আমাদের দেশের হাজার হাজার মানুষও নিয়মিত আন্তর্জাতিক বন্ধু খোঁজেন। নিজের নাম গোপন রেখে শুধু ই-মেইল পরিচিতি ব্যবহার করে ছদ্মনামে ফেসবুকে ঢুকে নারীদের নাম ছবি ব্যবহার করে তাদের সামাজিকভাবে বিব্রত করার জন্য গ্রুপ খোলা হয়। সেখানে জুড়ে দেয়া হয় নারীদের অসর্তক মুহুর্তে তোলা ছবিও। যেহেতু ফেসবুকে ব্যবহৃত নাম ধরে সদস্য খুজে বের করা দুস্কর তাই নিজ নাম ব্যবহার করে অনেকেই নারীদের ছবিতে আজেবাজে মন্তব্য ও নানা অশ্লীল ট্যাগ জুড়ে দেয়। ফেসবুকে ব্যবহার কারীকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘসূত্রতায় আক্রান্ত । ফলে বারবার রিপোর্ট করার পরও এ ধরনের ব্যবহারকারী বহাল তবিয়তেই রয়ে যান।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা
ইভটিজিং কে বুঝতে শুধুমাত্র তার সংজ্ঞায়ন, তার আচরণ, ভঙ্গিকে বুঝলে চলবে না। তার সাথে ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধী ব্যবস্থা আছে তাকেও আমাদের বুঝতে হবে। কারণ ইভটিজিং এর জন্য বর্তমানে জনমত, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। এই প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে না বুঝলে ইভটিজিং বিষয়টির বোঝাবুঝিতে অসম্পূর্ণতা রয়ে যাবে।
প্রতিরোধ হল এমন একটা ব্যবস্থা যা প্রতিদিনকার কাজ কর্মের মধ্যদিয়ে সংঘঠিত হয় (ঝপড়ঃঃ, ১৯৮৬)। অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন কাজের মধ্যদিয়েই আমরা যে কোন আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে থাকি। তবে ১৯৭০ সালের আগে যে সকল প্রতিরোধমূলক এথনোগ্রাফি রচিত হয়েছে সেগুলোতে ইরহধৎু ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ এর মধ্যদিয়ে প্রতিরোধ বিষয়টাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রপঞ্চ হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে (ঙৎঃহবৎ, ২০০৬)। কিন্তু প্রতিরোধ বিষয়টাকে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্যে শুধুমাত্র আধিপত্যের (উড়সরহধঃরড়হ) বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিসেবে দেখলে চলবে না বরং এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার নিত্যদিনকার অপ্রাতিষ্ঠানিক রুপকেও আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রতিরোধকে বুঝতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চাইতে ব্যপ্তিশীলতা ও প্রতিদিনকার ক্ষমতা কাঠামোর প্রতি (ঋড়পধঁষঃ, ১৯৭৮) এবং সংবদ্ধতার তুলনায় ব্যপ্তিশীলতা ও প্রতিদিনকার প্রতিরোধ ব্যবস্থার ধরণের প্রতি (ঝপড়ঃঃ, ১৯৮৫) নজর দেয়া উচিত। তবে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দেখতে আবার প্রতিরোধকারীদের উদ্দেশ্যকেও (রহঃবহঃরড়হ) গুরুত্ব দেয়া উচিত (ঋবমধহ; ১৯৮৬)। কারণ কোনটা প্রতিরোধ আর কোনটা বেঁচে থাকার কৌশল (ঝঁৎারাধষ ঝঃৎধঃধমু) তাকে পৃথক করতে না পারলে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বোঝা সম্ভব নয় (ঙৎঃহবৎ, ২০০৬) ।
ইভটিজিং এর প্রতিরোধের বিষয়টা এখন হরহামেশাই লক্ষ্যণীয়। একটা সময় পর্যন্ত নারীরা আত্মহত্যার মাধ্যমে ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় (উরহধ, ২০০২)। নারীরা এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তাদের প্রতিরোধকে তুলে ধরতে পারে না। আবার প্রতিরোধী হয়ে উঠলেও এই প্রতিবাদের কন্ঠ সমাজের কর্ণ কুঠরে প্রবেশ করে না। তখন তারা আত্মগ্লানিতে ভোগে। সমাজের ব্যবস্থার উপর তারা আস্থা হারিয়ে ফেলে। ফলে তারা আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রতিবাদের পথকে বেছে নেয়। অন্যদিকে নারীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে নীরবতাকেও বেছে নেয় (ঞযড়সধং ধহফ শরঃুরহমবৎ, ১৯৯৭)। অর্থাৎ রাস্তায় পুরুষদের নানা কটুক্তির কোন উত্তর তারা করে না। তারা নীরব থাকে। আর এই নীরবতাই নারীর প্রতিবাদের অস্ত্র হয়ে উঠে। আমেরিকায় গৃহিনীদের নীরবতার মাধ্যমে পুরুষ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় (ঝধঃঃবষ; ১৯৮৩)। আবার ঋড়ঁপধষঃ বলেন অনেক ক্ষেত্রে জেলখানায় যখন পুলিশরা আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তখন তারা নীরব থাকে। এটা আসামীদের একধরনের প্রতিবাদ (১৯৭৮;৬১)। তাই দেখা যায় নীরবতাও দূর্বলের একটা প্রতিবাদের অস্ত্র হতে পারে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে পুরুষতান্ত্রিক এহেন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পুরুষরাই প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। আর এই প্রতিরোধ করতে গিয়ে অনেকের মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে।
“মিজানুর রহমানের বয়ষ ৩৬ বছর। তিনি একজন কলেজ শিক্ষক। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় লক্ষীপুর গ্রামে। তিনি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর কলেজের রসায়নের একজন শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় দুই বখাটে যুবক আসিফ আলী ও রাজন ঐ কলেজের একাদশ শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করত। অশালীন আচরণ করত। ছাত্রীরা বিষয়টি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমানকে জানায়। মিজানুর রহমান ঘটনাটি অধ্যক্ষ ও ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জানায়। তিনি অভিযুক্ত ঐ যুবকদের সতর্ক করে দেন।এতে ঐ যুবকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে ১২ অক্টোবর দুপুরে বখাটে যুবকেরা স্থানীয় কৃষ্ণা কৃষি খামারের সামনে প্রভাষক মিজানুর রহমানের উপর মোটর সাইকেল তুলে দেয় এবং মাথা, বুক, চোখে গুরুতর আঘাত করে।
স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বাগাতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেয়া হয়। গত ২৪ শে অক্টোবর রাতে ঐ হাসপাতালেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (দৈনিক প্রথম আলো, ২১ শে অক্টোবর , ২০১০) ।
উপরের ঘটনায় দেখা যায় , ইভটিজিং এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে শিক্ষক মিজানুর রহমান বখাটেদের হাতে নিহত হন। ইভটিজিং এর প্রতিবাদের বিষয়টি শুধুমাত্র এখন আর নারীদের একক বিষয় নয় বরং এটা সার্বজনীন বিষয়য়ে পরিণত হয়েছে। পূর্বে দেখা যেত নারীরা ইভটিজিং এর প্রতিবাদ স্বরূপ আত্মহত্যার পথ বেছে নিত (সিমি, রিংকি)। কিন্তু বর্তমানে পুরুষরাও এই ইভটিজিং এর প্রতিবাদে এগিয়ে আসছে। কারণ এটা একটা সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই সমাজের সদস্য হিসেবে একজন পুরুষও এর প্রতিরোধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যা একভাবে পুরষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পুরুষ পক্ষপাতের বাইরে আসতে আমাদেরকে ভাবাই। তাই ইভটিজিং কে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সামনে নতুন দিকের উন্মোচন আমরা লক্ষ্য করি । ইভটিজিং এর প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে বোঝার মধ্য দিয়ে সামাজিক অন্যান্য উপাদানগুলোর পরিবর্তন প্রক্রিয়াকেও ভালভাবে বোঝা যায় ।
মাগুরায় সহকর্মী শিক্ষিকাদের ইভটিজিং এর ঘটনার প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে বখাটেদের একটি গ্রুপ শহরের প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণরত এক শিক্ষককে (শরিফুজ্জামান) বেদম মারধর করে তার গায়ে ঢেলে দেয় গরম ডাল। আবার ইভটিজিং এ বাধা দেয়ায় ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়ার বিজয়নগরে এক স্কুলছাত্রী (রেশমা) ও তার মাকে বেধড়ক মারধর করেছে বখাটেরা। বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার কচুড়িয়া গ্রামে ইভটিজিং এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে মেয়ের বাবা আহত হন বখাটেদের হাতে। (দৈনিক সমকাল, ২২শে অক্টোবর, ২০১০)।
ইভটিজিং এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এধরনের সহিংস ঘটনাগুলো অহরহ ঘটে চলেছে। যার ফলে অস্থিতিশীল সামাজিক অবস্থার তৈরি হচ্ছে। আর এই অবস্থার থেকে উত্তোরণের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন অভিমত প্রদান করেন। এ্যাডভোকেট সালমা খান (২০১০) বলেন, প্রতিরোধের ব্যাপারে মেয়েদের আরো সাহসী হতে হবে। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক অনুপম সেন (২০১০) বলেন, সমাজে মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে মানুষের প্রতি মেয়েদের প্রতি মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান (২০১০) বলেন, ইভটিজিং এর কারণে আত্মহত্যা বেড়ে গেছে আশংকাজনক হারে। ইভটিজিং হঠাৎ বেড়ে যায়নি। এখন এটিকে প্রতিরোধ করতে হবে। পরিবারের সাবাইকে সচেতন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের দিক থেকেও অনুশাসনের প্রয়োজন রয়েছে। পরিবারের সব সদস্যদের পাশাপাশি সমাজ নেতাদেরও এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক (২০১০) বলেন, আমি সব সময় মেয়েদের বলি তোমরা নিজেদের আত্মরক্ষা নিজেরা করো। মেয়েরা সব সময় এমনকি যে স্কুলে যাত্তয়ার সময় বোরকা পরে, সে সঙ্গে একটা লাঠি রাখে না কেন? শক্ত একজোড়া জুতো রাখতে পারে না কেন? তোমাকে যে বিরক্ত করবে তাকে জুতো মারতে পার না কেন? তোমার আত্মরক্ষা তুমি করবে না? বাবা মাকে বলি, আপনি কি একা? আরো মেয়েদের অভিভাবক নেই? আপনারা প্রতিরোধ করতে পারেন না ? একদিন সবাই মিলে প্রতিবাদ করুন। সবাই মিলে মারলে দুয়েকটা হয়তো মরে যেতেও পারে। মরুক সবাই মিলে মারলে কোন ক্ষতি নেই। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী (২০১০) বলেন, এটা ইভটিজিং নয় এটাকে আমি সন্ত্রাস বলেই সংজ্ঞায়িত করছি। এর জন্য নারী শিশু নির্যাতন দমন আইন আছে। কিন্তু এখানে পুরুষতান্ত্রিক মাইন্ড সেট হয়ে গেছে বলেই “ল অ্যান্ড অর্ডার মিস হচ্ছে”। ২০০৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে অধিকাংশ ছাত্র এটাকে কোন অপরাধই মনে করছে না। অন্যদিকে আমাদের মেয়েরা লজ্জায় ভয়ে কুঁকড়ে থাকে বলেই এর সুযোগ নিচ্ছে ওরা। এর আরো একটি কারণ হচ্ছে সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে সমান গুরুত্ব দেয়া হয় না। অনেক বিজ্ঞাপন নাটকে দেখা যায় নারীর সৌন্দর্যকে হাইলাইট করা হচ্ছে ব্যক্তিত্বকে নয়। এগুলো সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। আমাদের সমাজে প্রতিশোধ পরায়নতা এত বেড়ে গেছে যে এখানে প্রতিবাদী হত্তয়ার পরিবেশ নেই। অথচ সমাজের একটা বড় দায়িত্ব থাকা উচিত যেটা হচ্ছে না।
চিত্র:২ মানববন্ধনের মাধ্যমে প্রতিরোধ
এখানে দেখা যাচ্ছে যে ইভটিজিং এর প্রতিরোধ বলতে গিয়ে কেউ সমাজের কথা, পরিবারের কথা, আইনের কথা বা রাষ্ট্রের কথা তুলে ধরেন । কেউ আবার সামাজিক সচেতনতার কথা বলেন। তাই দেখা যায় ইভটিজিং এর প্রতিরোধ বিষয়কে বুঝতে গিয়ে আমাদের পুরো সামাজিক বিষয়াবলির প্রতি নজর দিতে হবে। সেখানে ব্যক্তিক পর্যায়ে থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সকল ব্যবস্থার মতাদর্শিক পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে। যেটা আবার ইভটিজিং এর ধারণায়নের ক্ষেত্রে পুরো সামাজিক প্রেক্ষিতকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে।
উপসংহার
ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র্যতা, সামাজিক স্বাতন্ত্র্যতা, ভিন্ন ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা, ভিন্ন বয়স, লিঙ্গভেদে ইভটিজিং এর ধারণায়ন ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। যার ফলে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিক, সামাজিক অভিজ্ঞতাগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। ইভটিজিং এর এই রকমারি বোঝাবুঝিগুলো একভাবে ইভটিজিং এর ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটকে আমাদের সামনে হাজির করে। যেটা একভাবে ভিন্ন ভিন্ন পরিসরগুলোতে ইভটিজিং এর ধরন, ধারণ কেমন হয় সে বিষয়টাকে আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দেয়।
©somewhere in net ltd.