নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাতসাগর

সাতসাগর › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘আত্ম পরিচয়গত’ সংকট

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৪

‘আত্ম পরিচয়গত’ সংকট কোনভাবেই স্থির কোন প্রপঞ্চ নয়। বরং পরিচয় নির্মাণে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ নিরন্তরভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হচ্ছে, দ্বান্দ্বিকতায় পড়ছে। তবুও এর সহজ সমাধানের পথ বাতলাতে পারছে না কেউ। সা¤প্রতিক কালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১.২ শতাংশ মানুষের পরিচিতি দানের ক্ষেত্রে একটা বহুমাত্রিক সংকটের রুপরেখা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এখানে সুস্পষ্ট তিন পক্ষ (সরকার/রাষ্ট্র, ‘আদিবাসী’ পরিচয় দাবিকারী দল, দেশের ‘সুশীল’/‘পন্ডিত’ মহল) বিদ্যমান। আবার ‘সুশীল’/‘পন্ডিত’ মহল দুইটি পক্ষে বিভাজিত। একদল সরকারের পক্ষে, অপরদল ‘আদিবাসী’ পরিচয় দাবিকারী দলের পক্ষে। এই সকল পক্ষই নানা তর্ক-যুক্তির দ্বারা নিজ অবস্থানকে সঠিক বলে উপস্থাপন করার চেষ্টায় ব্রত রয়েছে।



বাংলাদেশে কি কোন আদিবাসী আছে? যদি থাকে তাহলে কারা আদিবাসী? এই প্রশ্ন দেশের চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক মহলে নিত্য আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একপক্ষ (রাষ্ট্র) পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলতে গররাজি, আর অপরপক্ষ (পার্বত্য নৃগোষ্ঠী, কিছু বুদ্ধিজীবী) নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে পরিচিত করতে বদ্ধপরিকর। তবে আজ যে সমস্যার জাল ঘনীভূত হয়েছে তার যাত্রা বাংলাদেশ নামক দেশের জন্মলগ্ন থেকে। ১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদের চাকমা সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে বার সদস্যের ‘পাহাড়ী’ প্রতিনিধি তাদের দাবি সম্বলিত দলিল নিয়ে যখন তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান, তখন শেখ মুজিবর রহমান তাদের দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “না, আমরা সবাই বাঙালি, আমাদের দুই ধরনের সরকার ব্যবস্থা থাকতে পারে না। তোমরা তোমাদের জাতীয় পরিচয় ভুলে যাও এবং বাঙালি হয়ে যাও” (জীবন আমাদের নয়, ২০০১)। তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্র প্রধানরা। তারা পার্বত্য অঞ্চলকে নিরাপত্তা বলয়ে মুড়িয়ে দিতে তৈরি করেছেন সামরিক জেলখানা। আর পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীর মানুষগুলোর পরিচিতি নির্মাণ করেছেন ‘ভয়ংকর’, ‘বন্য’, ‘অন্য’ হিসেবে (ত্রিপুরা, ১৯৯৮)। যারা সমতলের মানুষ থেকে ভিন্ন (চেহারা, আচরণ, ধর্ম, সংস্কৃতি সবক্ষেত্রে) অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলের ঐ মানুষগুলোর পরিচিতি নির্মাণের যে বর্তমান সংকট তা কোনভাবেই সমসাময়িক নয়। বরং কালক্রমে তা নতুন নতুন দ্যোতনা দ্বারা নতুন নতুন ইস্যুর প্রবর্তন করেছে মাত্র। তবে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষগুলোর সংকটের ইতিহাস সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। যা অবশ্যই পৃথক আলোচনার দাবি রাখে। তাই দেখা যাচ্ছে, ২০১১ সালে এসে ‘আদিবাসী’ যে বিতর্ক তা নতুন কিছু নয়, বরং তা পুরাতন সংকটের নতুন অবতারণা মাত্র। তবে প্রত্যয়গত ভিন্নতা তর্কের ভিন্নতা তৈরি করলেও “ক্ষমতা”, “পরিচয় নির্মাণ প্রক্রিয়া”, ‘অবদমনের’ যে রাষ্ট্রীয় চরিত্র তাকে কোন নতুন আদল দেয়নি। বরং রাষ্ট্র তার স্বভাব সুলভ ক্ষমতাশীল জাতির আধিপত্যের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছে।



বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ‘অন্য’ মানুষগুলোকে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে বলা হয়েছে। আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। বরং বাঙালিরাই এই অঞ্চলের আদিবাসী’ (২৭ জুলাই, ২০১১)। যার প্রমাণ মিলেছে উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত নিদর্শনে। বলা হচ্ছে চার হাজার বছর পূর্বে এদেশে বাঙালিরা বসবাস শুরু করেছিল। এখন প্রশ্ন হলো, উয়ারি বটেশ্বর নামক প্রতœতাত্ত্বিক স্থানের সন্ধান মিলেছে বেশ পূর্বেই। কিন্তু এখন কেন এই স্থানটিকে বাঙালি জাতির পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ল? আর প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন দ্বারা আধিপত্যশীল শ্রেণীর গৌরব গাঁথা প্রচারের/নির্মাণের প্রচলনটা বহু পুরাতন। এই বাঙালি জাতির পরিচয়ের এ দলিলটির সম্পর্কে প্রশ্ন রাখা যায় বলে আমি মনে করি। তাছাড়াও বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রথা, কৃষি ব্যবস্থার উপকরণ, চাষ পদ্ধতি, কৃষিপণ্য (আদা, কচু) নিজের নয় বরং তা পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিকট থেকে প্রাপ্ত (ম্যালোনী, ১৯৮৪)। অন্যদিকে হাজার বছরের বাঙালি বলে যে কথা প্রচলিত তার শক্ত ভিত্তি কোথায়? কারণ বাংলা ভাষা আদি কোন ভাষা নয়, বরং তা বিভিন্ন সময়ের অপভ্রংশ দ্বারা তৈরি। তাই বাঙালিরা যে আদিবাসী নয় এটা বলা যায়।



আবার ‘আদিবাসী’ বলতে আইএলও কনভেনশনে যা বোঝানো হয়েছে তার সাথে বাঙালি জাতির পরিচয় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বরং তা পাহাড়ে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ। অন্যদিকে সস্যুর তার ভাষা বিষয়ক ব্যাখ্যায় বলেন যে, শব্দের অর্থের বদল ঘটে (সস্যুর, ১৯৬০)। তাই পূর্বে যাদের ‘পাহাড়ী’, ‘উপজাতি’, ‘হিলম্যান’ বলে অভিহিত করা হত তারাই আজ ‘আদিবাসী’ পরিচয় চায়। এতে দোষের কিছু দেখি না। কারণ অর্থের বদল ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। আর এই পরিবর্তিত অর্থের দ্বারা যদি কোন স¤প্রদায় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যদি সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় তবে স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের এহেন হস্তক্ষেপ বেশ দৃষ্টিকটু বিষয়ই বটে। তাছাড়া ভুলে গেলে চলবে না যে, আমারাও (বাঙালি) একদিন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী দ্বারা বাঙালিত্বের পরিচয় দাবিতে আন্দোলন করেছি। যেখানে পাকিস্তানী সরকারের অহমিকা, গোড়ামী তাদের পতন ঘটিয়েছে। এখন নতুন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশও যদি ১.২ শতাংশ মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চায় তবে তার পরিনামটা ভাল নাও হতে পারে। এখনকার রাষ্ট্র চরিত্র আর পাকিস্তানী রাষ্ট্র চরিত্রের মধ্যে কোন অমিল দেখা যায় না। গত ২রা আগষ্ট এক সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি বলেন, দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা বজায় রাখার দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যাতে কোন ধরনের ভুল না হয়, সে জন্যই সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে প্রশ্ন উঠে যে, দেশের এই অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা বলে গৃহীত পদক্ষেপ আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করছে কিনা? কারণ ১৯৯৩ সাল থেকে ‘আদিবাসী’ বর্ষ ঘোষণা হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দরা আদিবাসী দিবসে বক্তব্য দিয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবাসী’র উল্লেখ্য লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ২০০০ ও ২০০৯ সালে, বেগম খালেদা জিয়া ২০০৩ সালে এবং ফখরুদ্দিন আহমদ ২০০৮ সালে ‘আদিবাসী দিবসে’ ‘আদিবাসী’ উল্লেখ্যপূর্বক বাণী প্রদান করেন। তাহলে বর্তমানে কি এমন রাজনৈতিক/সাংস্কৃতিক বিধিব্যবস্থার কম্পন ঘটলো যেখানে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয় ‘বাঙালি’/‘বাংলাদেশী’ জাতিসত্ত্বাকে প্রকম্পিত করলো? না এটা কোন দেশ প্রেমিক মহলের (আদতে সেনাবাহিনী) আত্ম উপলব্ধি?



অবশ্য আমরা বাঙালিরা (আদতে বাংলাদেশীও বটে) আমাদের নিজেদের জাতীয়তাবাদী ধারণার এককত্ত্বকে এখনো স্থিরকরণ করতে পারি নাই। পাঁচ বছর ‘বাঙালি’ তো পরের পাঁচ বছর ‘বাংলাদেশী’। এমন নড়বড়ে অবস্থানে থেকে আমরা কিভাবে অপর জাতিসত্ত্বার নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ‘সভাপতিত্ব’ (কর্তৃত্ব) করি তা আসলে ভাবার বিষয়।



তবে জাতীয়তাবাদী প্রশ্নে আমার কিছুটা ভয় হয় ‘পাহাড়ী’ অঞ্চলের আদি নিবাসীদের জন্য। কারণ এখন যারা ‘আদিবাসী’ দাবি আদায়ে সমস্ত আদিবাসীদের একই পাটাতনে দেখতে চান তারা কিন্তু ঐ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ। তারা বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় গড়ে ওঠা একটা ‘মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণী’ যাদের শিকড় পাহাড়ে থাকলেও বেড়ে ওঠা শহরে। তাই তাদের হাতে যদি এই আন্দোলনের পরিণতি ঘটেও তবে তার সুফলভোগী কারা হবে তা প্রশ্ন থেকে যায়।



তাই একথা বলা যায়, বাঙালিদের ‘আদিবাসী’ বললে তার শ্র“তিমধুরতা যেমন লোপ পাবে তেমনি জাতি হিসাবে বাঙালিদের অবমূল্যায়িত করা হবে। বরং ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়ের শাব্দিক অর্থের বিচার না করে বৈশিষ্ট্যগত বিচারের আলোকে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত। তবে এই সংকট কোনভাবেই আর একমাত্রিকতার মধ্যে নেই, বরং তার রূপ বহুমাত্রিক। এজন্য বহুমাত্রিক সংকটের ব্যবচ্ছেদ ছাড়া ‘বাঙালি’ বা ‘আদিবাসী’ সংকট উত্তরণের পথ খোলা নেই বলে মনে করি

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:১০

মামুন রশিদ বলেছেন: সুলিখিত চমৎকার পোস্ট । বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরও আলোচনা গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে । আর জটিল এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে আলোচনা হওয়া উচিত । কারণ উত্তর দক্ষিন আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসি প্রেক্ষাপট আর আমাদের বাস্তবতা এক নয় ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.