![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই বাংলার স্বাধীনতা। এদেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে যারা শহীদদ হয়েছিলো তাদের আত্মত্যাগের মিছিলের সহযাত্রী হিসেবে আমার দুই চাচা ও এক ফুপাও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই যাদের আমরা হারিয়েছিলাম। যারা আর কখনোই আমাদের মাঝে ফিরে আসেনি।
মোঃ আব্দুল জব্বার, আমার বড় ফুপা। ১৯৭১ সালে তিনি কুমিল্লার ইস্পাহানি স্কুল এন্ড কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। এই স্কুলটি ছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে। তাই চাকরীর সুবাদে তিনি সপরিবারে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টেই থাকতেন।
এ.কে. এম. শামসি (বার্জু) - আমার ছোট চাচা । ১৯৭১ এ তিনি ছিলেন নবম শ্রেণীর ছাত্র। মানিক মিয়া এভিনিউ সংলগ্ন রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ে তখন তিনি অধ্যায়নরত ছিলেন।
মঞ্জুর মুরশেদ (তরু)-আমার বড় চাচা। ১৯৭১ সালে তিনি শেরেবাংলা কৃষি ইনিষ্টিটিউটে (বর্তমানে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ডিপ্লোমা কোর্সের ছাত্র ছিলেন।
১৯৭১ এর মার্চে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তখন ঢাকার অনেক স্কুল-কলেজ প্রায় বন্ধ। সেই সুযোগে বার্জু চাচা (ছোট চাচা) কুমিল্লায় আমার বড় ফুপুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনি কুমিল্লায় গিয়েছিলেন ১০ই মার্চ।
তখন আমার বড় ফুপু ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। বাসার কাজে সহযোগিতার জন্য একটা কাজের ছেলের প্রয়োজন ছিল। সেই কাজের ছেলেকে পৌঁছানোর জন্য তরু চাচা (বড় চাচা) মার্চের ২৩ তারিখে কুমিল্লায় আমার ফুপুর বাসায় গিয়েছিলেন। তরু চাচার উদ্দেশ্য ছিল যে ঐ কাজের ছেলেকে কুমিল্লায় রেখে আসবে আর সার্বিক পরিস্থিতি যদি খুব একটা অনুকূল না হয় তাহলে বড় ফুপুকে সাথে নিয়ে ঢাকায় ফিরবে।
২৩শে মার্চ, ১৯৭১ কুমিল্লা যাওয়ার জন্য তরু চাচা ও আমার আব্বা দুজনেই বাসা থেকে রওনা হয়। কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেলো কোন বাস নেই। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর একটি বিআরটিসি বাস আসলো। সেই বাসেই দুজনে রওনা হল। কিন্তু বাসটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গিয়ে হটাৎ অচল হয়ে গেলো। সেখানে প্রায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষার পরেও যখন বাস চালু হবার কোন আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন আব্বা অনেকটা বিরক্ত হয়েই তরু চাচাকে বাসায় ফিরে যাবার প্রস্তাব করে। কিন্তু চাচা রাজি হলেন না। ফলে আব্বা একাই সেদিন বাসায় ফিরে এসেছিলেন হয়তো নিজের অজান্তেই বেচে থাকার ভাগ্যটাকে সাথে নিয়ে। অতঃপর তরু চাচা একাই কুমিল্লা রওনা হলেন। তরু চাচা ২৩সে মার্চ বিকালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে। আর ওই দিন রাত থেকেই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে স্থানীয় ভাবে কার্ফু জারী করা হয়। ফলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার সব সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর মাঝে ২৫সে মার্চ দিবাগত রাত থেকে সারা বাংলায় শুরু হয় “অপারেশন সার্চ লাইট” নামের গণহত্যা। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
সেদিন ছিল ২৭শে মার্চ। সময় বিকাল প্রায় ৪ টা। প্রায় ১৪/১৫ জনের মতো পাক আর্মি বড় ফুপুর বাসায় এসে দরজায় আঘাত করে। ভয়ে প্রথমে কেও দরজা না খুললেও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে দরজা খোলা হয়। পাক আর্মিরা এসে উর্দুতে বলল যে জব্বার সাহেব (বড় ফুপা) কোথায়? তাকে কর্নেল সাহেব ডেকেছেন। স্কুলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জরুরি মিটিং আছে। তখন কর্নেল ইয়াকুব ছিলেন স্কুলের চেয়ারম্যান। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। তরু চাচা পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পেরে একটি মাদুরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। দেখে যেন মনে হয় যে একটি মাদুর গোটানো অবস্থায় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে। পাক আর্মিরা বার্জু চাচাকে দেখে ফুপার সাথে তাকেও নিয়ে যেতে চায়। বড় ফুপু বাধা দিয়ে বললেন, “ওকে কেন নিয়ে যাবেন? ও তো এই স্কুলে চাকুরী করেনা। আর ওতো মাত্র এক নবম শ্রেণীর ছাত্র।” আর্মিরা বলল, “ও জব্বার সাহেবের সাথেই আবার চলে আসবে।” কিন্তু সেটাই ছিল তাদের শেষ যাওয়া। ২৯শে মার্চ আর্মিরা ঐ বাসায় আবার আসে এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তারা এবার তরু চাচাকে পেয়ে যায় এবং তাকেও সাথে করে নিয়ে যায়। ফুপু তার দুই সন্তান- একজনের (সোহেল) বয়স ২ বছর ৪ মাস আর আরেকজনের (ইভা) বয়স ১ বছর ও কাজের ছেলেকে নিয়ে ৩১সে মার্চ পর্যন্ত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ঐ ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই দিন কাটিয়েছেন। এর মাঝে একাধিকবার আর্মিরা আসতো কোন দুষ্কৃতিকারী আছে কিনা সেই খোঁজ নিতে। তারা বিভিন্ন সময় এসে টাকা-পয়সা, ৫ ভরির মতো স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য সব জিনিসপত্র নিয়ে যায়। ঐ কলনীতে পানির সাপ্লাইও বন্ধ করে দেয়া হয়। এরকম একই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলো আশেপাশে থাকা অন্যান্য বাঙ্গালি পরিবারগুলোও। সেদিন ঐ স্কুলের মোট ১১ জন শিক্ষককে মিটিঙের কথা বলে বাসা থেকে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তারা কেওই আর কখনো ফিরে আসেনি। ক্যান্টনমেন্টে এরকম পরিস্থিতিতে মহিলাদের একা একা থাকাটা ছিল খুব বিপদজনক। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের এই কঠিন নিরাপত্তাবলয় ভেদ করে বের হয়ে আসা ছিল প্রায় অসম্ভব। একজন পাঞ্জাবি সুবেদার যার সাথে পারিবারিক ভাবে ফুপুদের আগে থেকেই বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তার সহায়তায় ১লা এপ্রিল ভোর বেলায় আমার ফুপু, তার ২ সন্তান ও আশেপাশের আরও কয়েকটি পরিবারের মহিলারা অবশেষে বের হতে সক্ষম হয়। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটে চান্দিনা বাজার পর্যন্ত এসে তারা স্থানীয় চেয়ারম্যানের বাসায় উঠে। সেখান থেকে জানা যায় যে ঢাকা যাবার সব পথ বন্ধ। পরে উপায় না পেয়ে সবাই পায়ে হেঁটেই যার যার গন্তবে রওনা হয়। ফুপুদের সাথে এক শিক্ষকের স্ত্রী ছিলেন, যার বাড়ী ছিলো নোয়াখালীর রায়পুর উপজেলার পানপারা গ্রামে। ফুপু উপায় না দেখে তার সাথেই নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। অবশেষে তিনদিন পায়ে হেঁটে চলার পর তারা সেখানে পৌছায়। আমার দাদা খবর পেয়ে ১৭ই এপ্রিল নোয়াখালীর সেই বাসায় আসেন। ফুপু সব ঘটনাই দাদাকে খুলে বলেন। আমার দাদার একটা আন্তরিক বিশ্বাস ছিলো যে তার ২ ছেলে আর মেয়ের জামাইকে হয়তো খোঁজ করলে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। অনেক ভাবেই তাদের খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিলো। এমনকি রেডক্রসের মাধ্যমেও তাদের খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা আর কখনোও আমাদের মাঝে ফিরে আসেনি। পরে জানা গিয়েছিলো যে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তাদের সবাইকে ৩১ সে মার্চ পাক আর্মিরা ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলেছিলো। যেই শিক্ষকদের সেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তাদের মধ্যে সোলেমান সাহেব নামের একজন অবাঙ্গালী শিক্ষক ছিলেন। ব্রাশ ফায়ারের শেষ মুহূর্তে তিনি চিৎকার করে পাক আর্মিদের বলছিলেন যে তিনি বাঙ্গালী নন। ভাগ্যক্রমে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। যদিও তিনি গুলিতে আহত হয়েছিলেন। সেই সোলেমান সাহেবই আমার ফুপা আর চাচাদের মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেছিলেন। সেই মৃতদেহেগুলোর কি ব্যবস্থা হয়েছিলো সেটা আমরা আর জানতে পারিনি। হয়তো কুমিল্লারই কোন গণকবরে তাদের শেষ আশ্রয় হয়েছিলো। এটা কেবল মাত্র একটি পরিবারের ঘটনা। কিন্তু সেই ১৯৭১ এ এরকম হাজারো পরিবারের লাখো মানুষ হটাৎ করে কিছু বুঝে ওঠার আগে এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিলো। যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। যে দেশ স্বাধীনের জন্য সেদিন এতো মানুষ প্রাণ দিয়েছিলো। সেই লক্ষ্য পূরণে কিন্তু আমরা আজ ব্যর্থ। এদেশের সকল মানুষের মৌলিক অধিকার আজও নিশ্চিত হয়নি। আজও আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে আমরা বের হতে পারিনি। যুদ্ধের পরবর্তি সময়ে যুদ্ধাপরাধীরা সামাজিক ভাবে এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে পুনর্বাসিত হয়েছিলো। অনেক দেরীতে হলেও বর্তমানে তাদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। যেদিন আমরা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে, ঐক্যবদ্ধ ভাবে দুর্নীতিমুক্ত একটি সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়তে সক্ষম হব সেদিনই কেবল সেই শহীদদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে এবং তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো হবে।
"মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে৷
কত বিপ্লবি বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙা
তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।"
২৬ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:৪৫
Tareq Imtiaz বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার চাচার প্রতিও রইলো শ্রদ্ধা ও সালাম।
২| ২৬ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:৪৭
অরুদ্ধ সকাল বলেছেন: গভীর শ্রদ্ধা।
৩| ২৭ শে মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:১৬
শরৎ চৌধুরী বলেছেন: অন্তর থেকে গভীর শ্রদ্ধা।
৪| ২৭ শে মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:৫৬
আমিনুর রহমান বলেছেন:
বিনম্র শ্রদ্ধা ।
৫| ২৭ শে মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১:২৮
অনাহূত বলেছেন: অন্তর থেকে গভীর শ্রদ্ধা।
৩০ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ৯:৪৪
Tareq Imtiaz বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৪:০০
কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: আপনার পরিবারের শহীদের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা। আমার এক চাচাও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।