নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার পরিচয় একজন ব্লগার, আমি সাহসী, আমি নির্ভীক, আমি আপোষহীন । যা বিশ্বাস করি তাই লিখি তাই বলি ।
( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।) ( গল্পের ধারা বজায় রাখায় জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক কিছু সংলাপ ও মুহূর্ত উঠে এসেছে । সকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন । )
দশম পর্ব
অনুরাধা বেশ কয়েকটি পদ রেঁধেছে কিন্তু আমি কিছু খেতে পারছি না। সবকিছু ক্যামন বিস্বাদ আর তোতো তোতো লাগছে । প্লেটে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম । গলার ভেতরটা ক্যামন একটা খসখসে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কণ্ঠ নালির কাছাকাছি কিছু একটা বিঁধে আছে । ঢোক গিলতে পারছি না। আমাকে উসখুস করতে দেখে অনুরাধা বলল, কি হয়েছে তোমার , খাচ্ছো না কেন ?
আমি বললাম, "ভালো লাগছে না । বোধ হয় জ্বর আসবে । "
অনুরাধা খাওয়া বন্ধ করে বা হাত দিয়ে আমার কপাল ছুঁয়ে, চিন্তিত গলায় বলল, ওমা শরীর তো দেখি বেশ গরম হয়ে আছে ।
আমি প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম, "এ তেমন কিছু না । দু'টো প্যারাসিটামল খেলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে ।"
অনুরাধা বলল, " এই রাত বিরাতে অফিস থেকে ফেরা বন্ধ করতে হবে । কত কিছু আছে পথে ঘাটে । বলা তো যায় না কখন কি হয়ে যায় ।
অনুরাধার কথায় আমি খাওয়া বন্ধ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কি হলো এমন করে তাকিয়ে আছো কেন ?
আমি বললাম, " তুমি কি বলছ এসব? কর্পোরেট চাকরি করি । ওয়ার হাউজ, শোরুম ফ্যাক্টরিতে ফ্যাক্টরিতে দিনরাত দৌড়াতে হয় ; আমাদের জন্য এটা তেমন একটা রাত নয় সোনা ।
এবার অনুরাধা আমার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বললো, "তাই বলে রাত আড়াইটা তোমার কাছে তেমন একটা রাত না ?"
অনুরাধার কথায় আমি চমকে উঠে বললাম, আড়াইটা ? আড়াইটা কোথায় পেলে তুমি ?
অনুরাধা এবার কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো ক'টা বাজে । " তারপর বাটি গোছাতে গোছাতে আবার বলল, "এখন শুলে কতক্ষণই বা তুমি ঘুমাতে পারবে ? সকালে আবার অফিস যেতে হবে , এমন করলে শরীর টিকবে কি করে ?
অনুরাধার কথা শেষ হতে আমি বালিশের পাশ থাকা টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম । সত্যি সত্যি রাত পৌণে তিনটা বাজে । ভেবে পেলাম না, এতরাত কিভাবে হলো । যতদূর মনে পরে অফিস থেকে যখন বের হয়েছিলাম, তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজেছিল । এতোটুকু পথ আসতে এতো সময় লাগলো কিভাবে ? সত্যিই আজ একটু বেশিই রাত হয়ে গেছে । মনে মনে অনুরাধার উদ্দেশ্যে বললাম, আর এমন রাত হবে না সোনা । কিছুতেই না ।
চেরাগ আলী
প্রচণ্ড ভিড়ে গাদাগাদি করে বাসে চড়ে অফিসে যাচ্ছি । বনানী থেকে সোজা উত্তরা হলে সমস্যা হতো না। অল্প একটু পথ।হেসে খেলে পৌঁছে যেতাম । কিন্তু আজ ফ্যাক্টরি ভিজিটে গাজীপুর যেতে হচ্ছে। দূরত্ব খুব একটা কম নয়। অবশ্য আমি চাইলে অফিসে পৌঁছে অফিসের গাড়ি নিয়ে বের পারতাম । কিন্তু সেটা করলে দেরী হয়ে যেতো । তাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে আবারো সেই রাত হয়ে যাবে । গতরাতের অভিজ্ঞতার পর মনে মনে ঠিক করেছি, পারতো পক্ষে কিছুতেই আর রাত করে বাসায় ফিরবো না। তাতে চাকরি থাকুক বা না থাকুক ৷
সকাল সকাল ফ্যাক্টরির কাজটা শেষ করে দুপর ১২টা নাগাদ অফিসে ফিরতে পারলে সন্ধ্যার আগেই সব কাজ শেষ করে অফিস হতে বের হয়ে যেতে পারবো ।
এ অফিসে কাজ করার সুবিধা এটা যে, হাতে কাজ না থাকলে পাঁচটার পর যখন ইচ্ছে, বের হয়ে যাওয়া যায় । কাউকে বলতে হয় না । গতকাল রাতে রাস্তায় লোকজন ছিলো না অথচ আজ লোকজনের যন্ত্রণায় ফুটপাতে হাটা যাচ্ছে না । অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর এ বাসটা পেয়েছি । সেটাও যাত্রীতে ঠাসা । ধাক্কাধাক্কি করে ঠেলেঠুলে বাসে উঠে বাসের মাঝামাঝি এসে রড ধরে দাঁড়ালাম। দু'পাশের মানুষের চাপে,ঘামের গন্ধে চোখ কান বুঝে কোনরকম দাঁড়িয়ে রইলাম ।
হোটেল রেডিসন ক্রস করার পর কিছু যাত্রী নেমে যাওয়ায় একটু আরাম করে দাঁড়ানো গেলো। সিট ধরে দাড়িয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে কখনো বাহিরের দৃশ্য আবার কখনো যাত্রীদের উঠানামা দেখছি । হঠাৎ একসময় খেয়াল করলাম, সামনের আসনে জানালার পাশে বসে থাকা লোকটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে । অনেক দিন পর পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে আমরা যেভাবে হাসি, অনেকটা সেরকম। ফর্সা মুখে কাচা, পাকা দাড়ি। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা বাবরি চুল । পরনে লালচে রং এর ফতুয়া জাতিয় শট পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটিকে দেখে আমারও ক্যামন পরিচিত পরিচিত বলে মনে হলো । কিন্তু কোথায় দেখেছি সেটা মনে করতে পারলাম না ।
এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আসতেই লোকটার পাশের সিটের যাত্রী নেমে যাওয়ায় তিনি আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন । আমি এগিয়ে যেতে তিনি সরে জানালার পাশে বসে আমার জন্য সিট ছেড়ে দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিতান্ত পরিচিতের ন্যায় মৃদু হেসে বললেন,"বসুন ।"
হাসির প্রতিউত্তরে আমিও মৃদু হেসে বসতে বসতে বললাম,"আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি; কিন্তু কোথায় দেখেছি তা মনে করতে পারছি না।"
আমার কথার জবাবে, ভদ্রলোক এবার সামান্য হেসে গম্ভীর ভাবে বললেন, "পৃথিবীটা খুবই ছোট । আমাদের সবার সঙ্গে সবার, কখনো না কখনো দেখা হয়ে যায়। শুধু পরিচিত নই বলে আমরা কেউ কারো চেহারা মনে রাখতে পারি না বা রাখি না ।"
সস্তা টাইপের ফিলোসোফি হলেও কথাটা বেশ নাড়া দিয়ে গেলো আমার মনকে।
আমি তাই বললাম, "বাহ! দারুণ বলেছেন। সত্যিই তো । চলতি পথে, প্রতিদিন কত শত মানুষের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় । তাদের ক'জানার কথাই বা আমরা মনে রাখি বা রাখতে পারি ?"
কোন কারণ ছাড়াই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো বুক চিড়ে ।
ভদ্রলোক এবার হেসে বললেন,"সকলকে মনে রাখা জরুরী নয় বলেই সকলের মুখ আমাদের মনে থাকে না। তাই এ নিয়ে দু:খ করার কিছু নেই ।"
ভদ্রলোকের কথার জবাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চুপ করে বসে রইলাম । তবে মনে মনে আকাশ পাতাল নানান কিছু ভাবতে লাগলাম। বারবার মনের ভেতর যে প্রশ্নটা উকি দিয়ে যেতে লাগলো সেটা হতে লাগলো সে হলো, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আগে কোথায় দেখা হয়েছে । কোথায় দেখেছি তাকে?
এবার ভদ্রলোক যেন অন্তর্যামী হয়ে সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে বললেন, " মনে মনে এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন,তাই না ?
আমি মুখে কিছু না বলে তার দিকে মৃদু হাসে হেসে চোখ সরিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম ।
ভদ্রলোক আবার বললেন, "আচ্ছা আমিই বলে দিচ্ছি আমাকে আপনি কোথায় দেখেছেন ।
আমি এবার কৌতুহল নিয়ে তার দিকে তাকালাম , "তিনি হেসে বললেন, আমাকে আপনি দেখেছেন গত পরশু দিন রাতে। আপনার বাসার সামনের গলিতে পায়চারি করতে। কি মনে পড়েছে ?"
ভদ্রলোক কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেলো, আরে তাই তো ! এই লোককেই তো পরশু রাতে বাসার সামনে হাটাহাটি করতে দেখেছিলাম ।
ভদ্রলোক'কে চিনতে পারায় এবার আমার ভেতরে ভেতরে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিলো । চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, কে এই লোক, কি চায় সে আমার কাছে ? আমাকে ফলো করছে না তো ?
নানান প্রশ্ন মনের ভেতরটা তোলপাড় করে তুললো ।
কথায় আছে , মানুষের মনের ভাব নাকি তার মুখে ফুটে উঠে । ভদ্রলোক আমার চিন্তিত মুখ দেখে হেসে বললেন, "এতো চিন্তিত হবার কিছু নেই ভাই । আজ আপনার সাথে আমার দেখা হয়ে যাওয়াটা সম্পূর্ণ কাকতালীয় । হঠাৎ বাসে আপনাকে চড়তে দেখে শুরুতে আমার ও মনের অবস্থা আপনার মতো মনে হয়েছিল । আপনাকে কোথায় দেখেছি সেটা ভাবতে ভাবতে আমিও আপনার মতো ভেতরে ভেতরে বেশ অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই মনে পরে গেলো সব। সে জন্যই আপনার দিকে তাকিয়ে ওমন মিটি মিটি হাসছিলাম । মানুষ প্রকৃতই খুব অস্থির প্রাণী । অল্পতেই অস্থির হয়ে উঠে । কথাটা বলে লোকটা এমন হো হো করে হেসে উঠলো যে বাসের সবাই আমাদের দিকে তাকালো। তাতে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।
ভদ্রলোক আবার বলতে শুরু করলেন, "আপনি যে বাসায় থাকেন তার শেষ মাথায় আমার এক বন্ধুর বাসা । আমি প্রায়ই ওখানে যাওয়া আসা করি । সেদিন রাতে বন্ধু বাসায় গিয়ে দেখি সে বাসায় নেই । দরজায় তালা দেওয়া । অথচ জরুরী একটা দরকার ছিলো তার কাছে । দেখা না করলেই নয় । তাই তার ফেরার অপেক্ষায় রাস্তায় পায়চারি করছিলাম ।
কিছুক্ষন পরেই দেখলাম আপনি গেট থেকে বের হয়ে মেইন রাস্তার দিকে যাচ্ছেন । একটু পর ফিরেও এলেন । কি মনে পড়েছে ?"
আমি লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম ।
এবার লোকটা তার ডান হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, "বাই দ্যা ওয়ে আমার নাম, চেরাগ আলী ।"
আমি লোকটার নাম শুনে কিছুটা অবাক হলেও বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে বললাম, চেরাগ আলী ?
উনি আবারো হো হো করে হেসে বললেন, "একটু সেকেলে ধরনের নাম, তাই না ? কি আর করা বলুন; মা বাবার দেওয়া নাম । চাইলেই তো আর বদলে ফেলতে পারিনা । কথাটা বলে চেরাগ আলী আবারো হো হো করে হেসে উঠলেন । তার হাসিতে আশেপাশে বসা লোকজন বিরক্তি নিয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে ।
তবে চেরাগ আলীর কথা বলার ধরনের মধ্যে এমন আন্তরিকতা ছিলো যে, আমিও হেসে ফেললাম । হাসতে হাসতে বললাম , আমার নাম, "বাবন ।"
উনি এবার আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, "আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো, বাবন।"
এরপর অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আলাপ চারিতা জমে উঠলো আমাদের । নানা বিষয় নিয়ে কথা বলার এক ফাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, " তা কোথায় যাচ্ছেন আপনি ?"
চেরাগ আলী এবার বিষন্ন দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে বললেন, "যাচ্ছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ষ্টাফ কোয়াটারে । একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে ।
কেউ অসুস্থ শুনলে আমরা যেমন দুখী দুখী ভাব করি ঠিক তেমন করে আমি দু:খ প্রকাশ করে জিজ্ঞাসা করলাম, " কে অসুস্থ , কি হয়েছে তার?"
চলবে ..........
©somewhere in net ltd.