![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার পরিচয় একজন ব্লগার, আমি সাহসী, আমি নির্ভীক, আমি আপোষহীন । যা বিশ্বাস করি তাই লিখি তাই বলি ।
এটি কোন নাটক বা উপন্যাসের চিত্র নাট্য নয়। নয় কোন সিনেমার দুর্দান্ত রোমান্টিক প্লট ৷ কিছু কিছু কথা আছে যা একান্ত ব্যক্তিগত ৷ যা কোনদিন কারো সাথে শেয়ার করা যায় না । যেসব কথা হৃদপিণ্ডের ছোট কুঠরে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো লুকিয়ে থাকে যুগের পর যুগ৷ অতি নিকটের মানুষও যার হদিস পায় না কোনদিন ৷
আজ এতোগুলি বছর পর সে কথাগুলি বলতে বসে বারবার কেপে কেপে উঠছে প্রাণ ৷ আজ দৃষ্টিপটে ভেসে উঠছে সেই মুখ, সেই মায়াবী চোখের চাহনি। যা এতোগুলো বছর পরেও বারংবার আমায় অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে।
আমি কোন লেখক বা উপন্যাসিক নই । তাই তাদের মতো হয়তো গুছিয়ে লিখতে বা বলতে পারবো না । কিন্তু তবুও আজ এই বাদল ঝরা দিনে সে কথাগুলো খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে সবাইকে। মনে হচ্ছে, কথাগুলো বলে ফেললে অনেকটাই লাঘব হবে বুকের ভেতর জমাট বাধা কষ্ট ।
আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি।
প্রতিদিন সকাল ৭টার ব্যাচে দল বেধে অংক প্রাইভেট পড়তে যাই বেলায়েত হোসেন স্যারের বাসায়।
স্যার যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সে বাসাতে আরো অনেকগুলো ফ্যামিলি ভাড়া থাকতো। বাড়িটি ছিলো, চারপাশে দেয়াল ঘেরা। গেট দিয়ে ঢুকতেই সারিবদ্ধ ফ্লোর পাকা চৌচালা ঘর। তার প্রথমটায় স্যার ছাত্র পড়াতেন। বাদ বাকি ঘরগুলোতে অন্য কয়েকটি ফ্যামিলি ভাড়া থাকতো৷
একদিন এমনি এক বৃষ্টি মুখর সকাল বেলা ছাতি মাথায় স্যারের বাসায় গিয়ে আমাদের ব্যাচের কেউ আসেনি। বৃষ্টির তোড় বেশি থাকায় ছাতি থাকার সত্ত্বেও অনেকটা ভিজে গিয়েছিলাম।
কেউ না থাকায় বেঞ্চিতে ব্যাগ রেখে দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি আর ভেজা চুল মুছছি৷
এমন সময় দেখতে পেলাম তাকে৷ স্যারের ঘরের ঠিক অপর পাশে একটি দরজায় দাড়িয়ে সে আমারি মতো বৃষ্টি দেখছে। আর ক্ষণে ক্ষণে আমার দিকে তাকাচ্ছে৷ এর আগেও বেশ কয়েক বার তাকে দেখেছি, কিন্তু আজকের মতো এমন পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো হয়নি তার দিকে৷ মেয়েটি গায়ের রং কুচকুচে কালো৷ আমাদের এই এশিয়ান সাব কন্টিনেন্টে সচরাচর এমন শরীরের রং সাধারণত দেখা যায় না।
শরীরের রং কালো হলেও অদ্ভুত এক সৌন্দর্য যেনো তাকে ঘিরে বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো ৷ তার উপর মাথা জুড়ে ওমন ঝাকড়া কোঁকড়ানো কালো চুলের বিন্যাস আর নীল দু' টো চোখের চাহনি কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত করে দিলো আমায় ।
সরাসরি কারো দিকে তাকানো অসভ্যতা জেনেও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার মুখ পানে । মনে মনে ঈশ্বরের সৃষ্টির প্রশংসা না করে পারলাম না । কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবছিলান এতো সুন্দর করে তিনি কিভাবে সৃষ্টি করেন !
মেয়েটিকে দেখার পর থেকে, মাথার ভেতর সর্ক্ষবণ রবি ঠাকুরের একটি কবিতাই ঘুরে ফিরে বাজছিল,"কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি; কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।"
রবী ঠাকুর হয়তো মেঘলা দিনে এমন কোন মানষিকে দেখে সে সৌন্দর্যে আমার ই মতো মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন তার সেই কবিতা খানি ।
হাসন রাজার মতো আমি ও পেয়ারির প্রেমে মজে গেলাম । গেয়ে উঠলাম,
"নেশা লাগিলো রে
বাকা দু নয়নে নেশা লাগিলো রে..
হাসন রাজা পেয়ারির প্রেমে মজিলো রে
নেশা লাগিলো রে... "
কচি হৃদয় প্রেমের জোয়ারে ভেসে যেতে লাগলো ।
ছোট মনের পাটাতনে নিত্য নতুন রূপে ধরা দেয় সে । প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায় কল্পনার নানা ফুলে রং ছড়িয়ে । আমার তখন পাগল প্রায় অবস্থা, কখনো গলা ছেড়ে গান গাই; আবার কখনো আপন মনে হেসে উঠি । কখনো বিষণ্ণতা ডুবে যাই আবার শুশুকের মতো ফুশ করে ভেসে উঠি। ঘুমে জাগরনে সর্বক্ষণ ভেসে বেড়ায় তার মুখশ্রী।
আজ এতোগুলো বছর পর বলতে , লজ্জা নেই । সেই প্রথম দেখার দিন থেকেই আমি মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলাম। সেটাই ছিল আমার কৈশোরের প্রথম প্রেম।
সেদিনের পর থেকে যখন ই স্যারের বাসায় যেতাম সকলের চোখ ফাকি দিয়ে আমার চোখ খুঁজে ফিরতো তাকে ৷ ভাগ্য ভালো হলে মাঝে মাঝে তার দেখা পেতাম ৷ সে ঠোটের কোণে মৃদু হাসি এনে নীল চোখ তুলে তাকাতো আমার দিকে । সে হয়তো বুঝতো আমি পছন্দ করি তাকে । তা না হলে ওমন করে তাকাতো কেন ? বেশির ভাগ দিন তার ঘরের দরজা থাকতো বন্ধ । যেদিন তার দেখা পেতাম বেশ ফুরফুরে থাকতো মন।
গলা ছেড়ে গান গাইতাম। ফুল পাখির পেছনে ছুটতাম৷ জটিল জটিল সব বীজ গণিত, পাটি গণিতে অংক সূত্র ছাড়াই চোখের নিমিষেই কষে ফেলতাম ৷
এর মধ্যে আমার চাল চলন, বেশ বুশায় বেশ পরিবর্তন এলো । পরিপাটি পোশাকের সাথে বাবার পারফিউম শরীরে মেখে স্যারের স্যারের বাসায় যেতাম । সর্বদা মনের ভেতর এক গোপন বাসনা থাকতো মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের । যখনই সে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতো কসম করে বলছি , স্বর্গ যেনো কয়েক মুহূর্তে নেমে আসাতে ধরায় ।
যেহেতু অনেকগুলো মধ্যবিত্ত পরিবার সে বাড়িটিতে থাকতো । তাই প্রতিদিনই টুকটাক ঝগড়া ঝাটি লেগে থাকতো। সবগুলোই রান্না ঘর কেন্দ্রিক । মেয়েটির মাকে ও মাঝে মাঝে দেখতাম নিচু গলায় প্রতিবেশীদের সাথে ঝগড়া করতে । মেয়েটি তখন করুণ মুখে অসহায়ের মতো দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকতো । ঝগড়া ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে তাদের ঘরে প্রবেশ করতো । মা অকারণেই মেয়েটিকে বকাঝকা শুরু করতো । সব কথা কানে না এলেও বেশ বুঝতে পারতাম বকা ঝোঁকার এক পর্যায়ে মা মেয়েটির শরীরের রং নিয়ে নানা কথা বলতে ছাড়ত না ।
কল্পনার মেয়েটির মনে অবস্থা বুঝতে পেরে ভেতরটা আমার ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত । মাঝে মাঝে ইচ্ছে, হতো ছুটে গিয়ে মেয়েটির মাকে দু'কথা শুনিয়ে দিতে । একদিন এমন এক বকাঝকার দিনে , কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলাম। মনে মনে একেবারে ঠিক করে ফেললাম, বড় হয়ে এই মেয়েটিকেই বিয়ে করে উদ্ধার করবো মায়ের সকল যন্ত্রণা থেকে । তাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না । বউ করে নিয়ে গিয়ে রাণীর মতো সাজিয়ে রাখবো তাকে ।
মাত্র পনেরো বছরের এক বালকের এমন সংকল্পের কথা অনেকের কাছে আজ হয়তো হাস্যকর মনে হবে । আমার জন্য সেটা ছিল জীবনের এক কঠিন সিদ্ধান্ত । "কিছু কিছু কথা হয় পর্বতের মতো , মানুষ নড়ে কিন্তু কথা নড়ে না।" আমি আজও সে সংকল্পে অটুট আছি ।
দেখতে দেখতে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা নিকটে চলে এলো । আমার তখন তুমুল ব্যস্ততা । খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে , বড় হতে হবে , বড় চাকরি করতে হবে , তবেই না তাকে বিয়ে করতে পারবো। সবাই পড়ে ভালো রেজাল্টের জন্য আমি পড়ি তাকে পাবার জন্য । কি হাস্যকর তাই না ?
সারাদিন বাসায় বসে গাদা গাদা প্রশ্ন ব্যাংক সলভ করা । চলে রিভিশনের পর রিভিশন। খুব একটা প্রয়োজন না হলে , স্যারের বাসায় যাওয়া হয় না। কিন্তু তারপরেও তাকে দেখার জন্য মাঝে মাঝে নানা বাহানা বানিয়ে স্যারের বাসায় যেতাম । ভাগ্য ভালো হলে তার দেখাও পেয়ে যেতাম ।
পরীক্ষার কয়েকদিন আগে এক সকাল বেলা , স্যারের বাসায় গিয়ে দেখি , পুরো বাড়ি সময়েত স্যারের বাসায় ঢুকার গলিটা লোকজনে গিজগিজ করছে । এখানে সেখানে ছোট ছোট জটলা করে লোকজন দাড়িয়ে আছে । ঘটনা কি দেখার জন্য ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে গেলাম । বাসায় ভেতরে ঢুকার দরজার সামনে দু তিনজন পুলিশকে দেখতে পেলাম বন্দুক হাতে দাড়িয়ে আছে ।
আমি বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম মেয়েটির মা বারান্দায় বসে গলা ছেড়ে কাঁদছেন আর নিজের কপাল চাপড়াচ্ছেন । অনেক মহিলারা ঘিরে রেখেছে তাকে । সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে ।
মেয়েটির ঘরের দরজায় ও অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে । অজানা এক আশংকায় ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার ।
কি করবো বুঝতে না পেরে স্যারের রুমের ভেজানো দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম । স্যার চেয়ারে বসে খাতায় কিছু লিখছিলেন, দরজায় শব্দ পেয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে আমাকে দেখে বললেন , "কি রে; কি মনে করে ?"
স্যারের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "কি হয়েছে স্যার , এতো লোকজন কেন ?
স্যার আমায় বসতে বললেন , আমি স্যারকে ফের জিজ্ঞাসা করলাম, "কি হয়েছে স্যার ?"
স্যার তখন একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, "গতরাতে ও বাসার বড় মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে রে।"
মুর্হুতে যেনো আমার আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো । কয়েক মুহূর্তের জন্য সবকিছু নিশ্চল হয়ে গেলো আমার। আমি চিৎকার করে উঠতে গিয়ে ও পারলাম না । বুকে হাত চাপা দিয়ে বসে পড়লাম ।
স্যার নিচু গলায় বলতে লাগলেন ,"কি আর করবে বল; মা'টা সারাদিন মেয়েরটার সাথে খিটখিট করতো । আজে বাজে কথা বলতো । বাজে মহিলা বুঝলি; খুব বাজে মহিলা । তা না হলে আপন মা হয়ে কেউ নিজের মেয়ের গায়ের রং নিয়ে খোটা দেয় । মেয়েটা আর সহ্য করতে না পেরে গতরাতে এমন কাণ্ড করে বসলো । আরে বাবা ; কেউ কি ইচ্ছে করে কালো রং নিয়ে জন্মায় ? স্যার আপন মনে গজগজ করতে লাগলেন। বুকে শত সমুদ্র কান্না চেপে উদভ্রান্তের মতো স্যারের বাসা থেকে সেই যে বের হয়ে এলাম আর কোনদিন সে বাসায় যাইনি।
এখনো মাঝে মাঝে আমি মেয়েটির দেখতে পাই ৷ বৃষ্টি হলেই সে এসে দাঁড়ায় আমার ঘরের বারান্দায়। ঠোটের কোণে মিষ্টি হাসি মেখে আড় চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে । জগতের সবটুকু সৌন্দর্য এসে তখন ভর করে মুখ জুড়ে । আমি বিমুগ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে সে সৌন্দর্যে হারিয়ে যাই ।
শেষ।
০৮.০৭.২০২৫
০৮ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৫:১২
সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: পড়ে ফেললেন ? ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য ।
২| ০৮ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৫:১৭
সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
আপনি তাকে এখনো ভুলতে পারেননি।
০৮ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৫:৩০
সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: ঘরেতে এলো না সে , মনে তার নিত্য আসা যাওয়া ...।
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৪৯
সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: ভালোই তো লিখেছেন।