![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মা,আম্মা গো! ভালো করে দেখে নাও তোমার ছেলের তাজা মুখখানা।তোমার ছেলের প্রিয় মুড়োঘণ্ট, পোলাও রেঁধে খাওয়াতে চাইলে, খাইয়ে দাও যত্নসহকারে। ছেলে বড় হয়ে গেছে।তবু মায়ের কাছে কখনও বড় হয় না।চিবুক ধরে আদর করতে ইচ্ছে হলে, সেটাও করে নাও।কপালে দিয়ে দাও তোমার স্নেহচুম্বন।এতকিছু?কারণ,তোমার ছেলে ঘরের বাইরে যাচ্ছে।হ্যাঁ,মা।কাছেই,মুদির দোকানে,রেশন আনতে,ঈদের বাজার করতে শহরে,পড়াশুনা করতে একটু দূরে। মা ,নিশ্চয়তা নেই।তোমার ছেলের ঘরে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা নেই।তোমার কোলে সে ফিরতেও পারে,না ফিরতেও পারে।রক্তাক্ত লাশ হয়ে ফিরতে পারে সে।ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলা হতে পারে তোমার আদরের সন্তানের লাশ।গাড়ি থামিয়ে টেনে নামানো হতে পারে তোমার ছেলেকে।তারপর লাঠি,অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে উন্মত্ত মাতালরা।তুমি ভাবছ,আশেপাশের লোকের কথা।না মা,তারা কেউ কিছু করতে পারবে না।হিংস্রতার সামনে, নরখাদকদের সামনে অনুরোধের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে। তোমার ছেলে জোড়হাত করে ক্ষমা চাইবে,প্রাণভিক্ষা চাইবে।তবু তারা শুনবে না।পিটিয়ে মেরে ফেলবে। যাকে তুমি মারতে দিতে না কক্ষনো, বাঁচাতে আব্বার হাত থেকে।আম্মু,দেখে নাও। না ফিরতেও পারি।
মা,ভয়ে ভয়ে রাস্তায় বের হই।তোমাকে বললে দুশ্চিন্তা করবে,তাই কিছু বলি না।রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় দেখি চারপাশ, কেউ আমাকে ফলো করছে না তো।মাগরিবের নামায পড়তে মসজিদে গিয়েছিলাম , কেউ দেখে ফেলল না তো।মুসলিম বলে কেউ চিনে ফেলল না তো! আমার সেই বন্ধুর কথা মনে আছে? গতবার ঈদে যে আমাদের বাড়ি এসেছিল,সিমাই-লাচ্চা খেয়ে তোমার রান্নার হাতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিল,সেই সুদীপ্তকে এবার ঈদে ডাকতে পারিনি।ভয়ে,আতংকে।ওদের পাড়ায় ঢুকতে ভয় লাগে।যদি উন্মত্তরা ধরে বলে,ওই তুই গরু খাস।তোর মরে যাওয়া উচিৎ। তাহলে কী হবে মা? তখন তো সুদীপ্ত কিছু করতে পারবে না। হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাকে বাঁচাতে,কিন্তু পারবে কি! মৃত্যুর পর মোমবাতি জ্বালিয়ে মিছিল করতে পারে।'নট ইন মাই নেম' লিখে ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার পালটাতে পারে,কিন্তু আমি তো ফিরব না তাতে।আর যে বা যারা বলবে,আমি ওই হিংস্রদের দলে নই।সে তো তোমার মৃত ছেলের দলে,মা ! আরেক মা হারাবে তার সন্তান,আরেক বোন হারাবে খুনসুটি ভাই,আরেক স্ত্রী হারাবে প্রিয়তম ।
দেশের নেতারা মিটিং করছে,আশ্বাস দিচ্ছে।তবু বেরোতে ভয় হয়।কে জানে, এটা কোনো চাল নয়! হতেও তো পারে।যে-দেশে দাঙ্গাকারী ক্ষমতার মসনদ পেতে পারে,সে-দেশে কিছুই অসম্ভব না। গত দু'বছরে প্রায় ত্রিশ জন ছেলে কেড়ে নিয়েছে তোমার কোল থেকে।তাই তোমার ফরিয়াদ,যে-ছেলে ক্যাম্পাস থেকে পড়তে গিয়ে আর ফেরেনি তার মায়ের ফরিয়াদ,যে-ছেলে স্বপ্ন দেখতে দেখতে সিলিং থেকে ঝুলে পড়ে,তার মায়ের ফরিয়াদ প্রতিধ্বনিত হয়ে ইথারে মিলিয়ে যাবে,ওই আদালতে পৌঁছবে না।শত মোমবাতির মাঝেও অন্ধকার থেকে যাবে।
মা তারা ভোজনালয়ের সবজি আমার খুব প্রিয়।এদের মতো সবজি কেউ রাঁধে না।কলাপাতায় সবজিভাত যে কি অমৃত।অথচ ওখানে গেলেই ওরা সব কেমন করে তাকায়,আমার পাঞ্জাবি দেখে,দাড়ি-গোঁফের অনুপাত,কাটিং স্টাইল দেখে বুঝে নিতে চেষ্টা করে মুসলিম হোটেলে গিয়ে আমি বিফ খাই কিনা।অথচ তুমি ভালো করেই জানো, মুরগির মাংস ছাড়া অন্য কোনো মাংস আমি খেতে পারি না।অথচ,ওরা তোমার ছেলেকে মারার পর চারপাশে গরুর মাংস ছড়িয়ে দিতে পারে।যে-ছেলে গরুর মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারত না,সে মরে পড়ে থাকবে গরুর মাংসের টুকরোর মধ্যে।গরু শব্দটা উচ্চারণ করতে ভয় হয়।এই বুঝি কেউ গরুখোর বলে তেড়ে আসে।অথচ,যেবার আমাদের গাইয়ের ধলা বাছুরটা মারা গেল, সেবার আমার কী কান্না,তুমি তো জানো মা।
জানো মা,কলেজে আমাকে একজন বলেছে,আমাকে দেখতে নাকি টেররিস্টদের মতো।আমি বুকে গভীর ব্যথা নিয়ে হেসে উড়িয়ে দিয়েছি।ভেবেছি,প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে তো এই ছবিই তুলে ধরা হয় টেররিস্টদের।ও তো ভাবতেই পারে।কিন্তু,মনটা খুঁতখুঁত করে,যার সঙ্গে রোজ ক্লাস করছি,একটা রোল দুজনে ভাগ করে খাচ্ছি,একই বোতলে জল-পানি খাচ্ছি,সে বলছে আমাকে দেখতে টেররিস্টদের মতো।তাহলে আমাকে টেররিস্ট হিসেবে দেগে দিতে দু'বার ভাববে না।অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম।না,তাই বলে আমি কিন্তু ইটের বদলে পাটকেল ছুঁড়ব না।সুদীপ্তকে কখনই ভাবব না,ও আর দশজনের মতো,আমি গরু খাই বলে তেড়ে মারতে আসবে।সবাই হিংস্র নয়,সবাই উগ্র নয়,সবাই গোরক্ষক নয়,যেমন সব মুসলিম টেররিস্ট নয়।
জুনেইদের মা,নাজিবের মা,রোহিতের মা কোনোদিন ছেলে ফিরে পাবে না। তোমাদেরকে এখন জেগে উঠতে হবে মা।সোচ্চার হতে হবে।আওয়াজ ওঠাতে হবে। কাঁপিয়ে দিতে হবে অরাজকতা, স্বৈরতন্ত্রের ভিত। তোমরা তো মা। মা ভক্তরা,মাকে রক্ষাকারীরা নিশ্চয় তোমাদের সম্মান করে। তোমাদের অশ্রুতে নিশ্চয় তাদের পাষাণ হৃদয় ভিজে যাবে। অতএব তোমরাই পারো আমাদের রক্ষা করতে। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরে নিরাপত্তা দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছ। শৈশবে দিয়েছ সুরক্ষা। এখন তোমরাই এগিয়ে এস আবার,তোমাদের সন্তানদের বাঁচাতে। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বাঁচতে চাই,হাত ধরাধরি করে বাঁচতে চাই।বিদ্বেষ,ঘৃণা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শান্তির সমাজ চাই।
তোমাদের উপর ভরসা আছে মা। অগ্নিযুগে, যুগে যুগে তোমরাই বীর ছেলেদের যুদ্ধে পাঠিয়ে পুজোয় বসেছ ,নামায পড়েছ, হাত তুলেছ ভগবান-আল্লাহর কাছে। জুনেইদকে যখন ফেলে দেওয়া হয়, তোমার মতোই এক নারী, এক মা,এক বোন এগিয়ে এসেছিল বাঁচাতে। সে মুসলিম ছিল না , মা।এই দৃশ্যই আশার আলো দেখায়। বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। তোমরা এগিয়ে এস মা। ঘরে ঘরে গড়ে উঠুক সম্প্রীতি রক্ষা বাহিনী। তোমরা তো দশভূজার শক্তি ধরো, তোমাদের সামনে সবকিছু উড়ে যাবে খড়কুটোর মতো। (গোলাম রাশিদ)
(কলম পত্রিকা থেকে সংগৃহীত একটি প্রতিবেদন)
©somewhere in net ltd.