![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিদ্যুৎ উৎপাদনের রূপকল্প ২০৪১:
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বলছে, স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ আগামী দিনে কমে যাওয়া ছাড়া বাড়ানোর কোনো তথ্য দিচ্ছে না। বরং ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ৮ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে মাত্র ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে পেট্রোবাংলা বিদ্যমান গ্যাস মজুত দ্রুত নিঃশেষ করার সংকেতই দিচ্ছে। আগামী দুই বছরে আমদানি করে আনা তরল গ্যাস (এলএনজি) যদি দেশের গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় সংযুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলেও জ্বালানি গ্যাসের ব্যাপক চাহিদার সামান্যই পূরণ হবে।
পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১০’-এর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, সুতরাং তার নবায়ন, বাস্তবানুগ পরিবর্তন নিশ্চয়ই করা দরকার। সরকার জাপানের পরামর্শকদের সহায়তায় সে কাজটি করছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আগামী মাসেই (জুন ২০১৬) ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬’ প্রকাশ করার কথা।
২০১০ সালের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, এ সময়ের অর্জন এবং অবাস্তবায়িত পরিকল্পনার অংশগ্রহণমূলক ও নিবিড় বিশ্লেষণ করার পর নতুন পরিকল্পনা নিলে তা যৌক্তিক হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বিদ্যমান সীমাবদ্ধতাগুলো থেকে উত্তরণের কৌশল নিরূপণ করা। ২০০৯ সালে যখন ২০১০ সালের মাস্টারপ্ল্যানটি নিয়ে কাজ চলছিল, তখন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণব্যবস্থা যেমন অনির্ভরযোগ্য ও ভঙ্গুর পর্যায়ে ছিল, তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। প্রধানত তেলভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে বিদ্যুৎব্যবস্থার আরও উন্নতি করতে হলে কিছু সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আরও টেকসই বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা গড়ার প্রয়োজনীয়তা এখন অনুভূত হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের মূল্য দুই বছর ধরে ‘অস্বাভাবিক’ কম। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্রমেই বেশি পরিমাণে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল হয়েও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় সীমার মধ্যেই রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গত এপ্রিলের রেকর্ডভাঙা গরম ও বৃষ্টিহীন সময়ে সবাই যেন হঠাৎ টের পেতে শুরু করল, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণব্যবস্থায় গুরুতর কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। লোডশেডিং আবারও নিয়মিত এবং প্রলম্বিত হতে শুরু করেছে। এর আপাতত কারণগুলোর একটি হিসেবে নৌপথে তেল পরিবহন ধর্মঘটের কয়েক দিন গত এপ্রিলের বিঘ্ন উসকে দিয়েছিল। সেই ধর্মঘট কেটে যাওয়ার পরও লোডশেডিং গত বছরের গ্রীষ্মের পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়নি।
ইতিমধ্যে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে বলা হলেও কার্যত ৮ হাজার থেকে ৮ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে। নাজুক বিতরণব্যবস্থায় (৫ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজের দরকারি অক্সিলারি পাওয়ারে, ৩ শতাংশ সঞ্চালন ও ১০ শতাংশ বিতরণ পর্যায়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ হারিয়ে যাচ্ছে) ব্যাপক চাহিদার সময়ও গ্রাহকের জন্য কার্যত ৬ হাজার ৬৩৫ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরবরাহকৃত বিদ্যুতের সঙ্গে অন্তত আরও ২ হাজার মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ যুক্ত করা গেলে দেশে আপাতত সন্তোষজনক একটা বিদ্যুৎব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বলছে, স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ আগামী দিনে কমে যাওয়া ছাড়া বাড়ানোর কোনো তথ্য দিচ্ছে না। বরং ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ৮ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে মাত্র ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে পেট্রোবাংলা বিদ্যমান গ্যাস মজুত দ্রুত নিঃশেষ করার সংকেতই দিচ্ছে। আগামী দুই বছরে আমদানি করে আনা তরল গ্যাস (এলএনজি) যদি দেশের গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় সংযুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলেও জ্বালানি গ্যাসের ব্যাপক চাহিদার সামান্যই পূরণ হবে।
দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় ২০৪১ সালের জন্য এখন বিদ্যুতের জোগান নিয়ে পরিকল্পনা করার বদলে ২০২১-এর রূপকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে অধিকতর মনোযোগী হওয়াকে অনেকে যৌক্তিক ভাবছেন
সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সালে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর মহৎ উদ্যোগের জন্য দেশবাসী চেয়ে আছে। সে লক্ষ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব করতে হবে ২০২১ সালে। ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১০’-এর অন্যতম নির্দেশনা ছিল দেশি ও আমদানি করা কয়লা ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুতের গুরুত্বপূর্ণ অংশের উৎপাদন নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য প্রাথমিক জ্বালানির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার বাড়ানো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশীয় প্রাথমিক জ্বালানি (গ্যাস ও কয়লা) অনুসন্ধান ও উত্তোলন আশানুরূপ মনোযোগ পায়নি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের সাময়িক স্বল্পমূল্য ব্যবস্থাপকদের মধ্যে আত্মপ্রসাদের ভ্রান্তিবিলাস তৈরি করেছে বলে মনে হয়। এখন আমদানি করা তরল জ্বালানি গ্যাস ও কয়লা দিয়ে প্রাথমিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম জোগান নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু এ জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগিয়ে নেওয়া যায়নি। আমদানিনির্ভর প্রাথমিক জ্বালানি তরল গ্যাস, তেল ও কয়লা ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য কত হবে, তার নির্মোহ বিশ্লেষণও করা হয়নি। সে আলোকে ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬’-এর লক্ষ্য ও করণীয় নির্ধারণ যৌক্তিক। ইতিমধ্যে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬-তে অনুমান করা হয়েছে ২০৪১ সালে বিদ্যুতের মোট চাহিদা হবে ৫২ হাজার মেগাওয়াট, এর বিপরীতে ৫৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার জন্য প্রধানত আমদানি করা প্রাথমিক জ্বালানি ও আমদানি বিদ্যুতের ওপর ভরসা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ কয়লা (১ শতাংশ স্থানীয় উৎপাদনসহ), ৩৫ শতাংশ গ্যাস (গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমদানি করা তরল গ্যাসসহ), ৫ শতাংশ তরল (আমদানি) জ্বালানি এবং অবশিষ্ট পরমাণু বিদ্যুৎ, আমদানি বিদ্যুৎসহ অন্যান্য উৎস থেকে জোগানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
"অতিরিক্ত আমদানিনির্ভর পরিকল্পনা জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কা ও জিজ্ঞাসা জাগিয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় ২০৪১ সালের জন্য এখন বিদ্যুতের জোগান নিয়ে পরিকল্পনা করার বদলে ২০২১-এর রূপকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে অধিকতর মনোযোগী হওয়াকে অনেকে যৌক্তিক ভাবছেন। কেননা বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনক্ষম করা, ২০২১-এর আগেই আরও প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা—এসব চ্যালেঞ্জ আছে। সেই সঙ্গে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ ভোক্তার জন্য সহনীয় মূল্যে সরবরাহ করাও এক বড় চ্যালেঞ্জ। নির্মাণাধীন বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অগ্রগতি, জ্বালানি সরবরাহের অবকাঠামোর উন্নয়ন পরিস্থিতির আরও নিবিড় বিশ্লেষণ এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের স্বরূপ অনেকটাই স্পষ্ট করবে।"
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশ–বিষয়ক লেখক।(সর্বসত্ব)
©somewhere in net ltd.