নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুকান্ত কুমার সাহা

I like to seek knowledge.

সুকান্ত কুমার সাহা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইয়াঙ্গুনে কয়েকদিনঃ ৪র্থ পর্ব

০৯ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:৩৩

বায়ারদের সাথে জরুরী মিটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওদের ফ্যাক্টরি ভিজিটের পাশাপাশি অফিসে যাব বলে আমি, আমার বস, মামুন ভাই আর আমাদের দোভাষী মিস সাইদা একটা শপিং কাম অফিস কমপ্লেক্সের নিচে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছি। সোনালি রোদে ঝলমল করছে চারদিক। হটাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। রোদ বৃষ্টি একসাথে চলছে, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গুলোতে রোদ পড়ায় মনে হচ্ছে আকাশ থেকে স্বর্ণের মার্বেল পড়ছে। ছোট বেলায় এই রকম দেখলে আমরা চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলতাম, “রোদ-বৃষ্টির ইয়ে, শিয়াল মামার বিয়ে”।

পাশে দাঁড়িয়ে একদল টিন এজ মেয়ে আড্ডা দিচ্ছে, ওয়েস্টার্ন স্টাইলের নেভি ব্লু রঙের একরকমের মিনিস্কার্ট আর টপস পরিহিতাদের দেখে মনে হল, কোন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী ওরা। হেসে, চেঁচিয়ে আশপাশ গরম করে ফেলেছে!



ওদের প্রতি আশেপাশের স্থানীয় যুবকরা কোন আগ্রহই দেখাচ্ছে না, মেয়েরা মাঝে মধ্যে যদিওবা তাকাচ্ছে কিন্তু তাতে নেই কোন মেয়েলি ঈর্ষা, আছে কেমন যেন ভয় ভয় ভাব। কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না দেখে, আমিও ওদের প্রতি কোন আগ্রহ দেখালাম না!



অসম্ভব রূপবতী যে মেয়েটি আড্ডায় সবচেয়ে বেশী চেঁচাচ্ছে, যার নগ্ন উরু থেকে সবচেয়ে বেশী সোনালী আলো ছড়াচ্ছে, তাকে নেওয়ার জন্য সিকিউরিটিসহ একটা ঝাঁ চকচকে কালো BMW গাড়ী এলো এবং নিয়ে চলে গেল। তার পরপরই এক এক করে জার্মান ব্র্যান্ডগুলোর লেটেস্ট মডেলের কালো চকচকে গাড়ীগুলো আসতে থাকলো আর এক একটা মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে থাকলো।



এদেশে কালো রঙের দামি গাড়ীগুলো শুধুমাত্র সরকারি আমলা ও সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা গন ব্যবহার করতে পারেন। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হল এখানকার সবচেয়ে উচ্চবিত্তের ঘরের সন্তান এরা এবং এদের মুষ্টিমেয় বাবা-মা’রাই এদেশের নিয়ন্ত্রক।



মেয়েগুলোর আচরণ ও তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থাই বলে দিচ্ছিল তারা অন্য ক্লাসের মানুষ, যাকে সাধারণত: বলা হয়ে থাকে “আপার ক্লাস”।; ক্ষমতাবান, ভোগী, লোভী, অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত-কারী, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোই এই ক্লাসের সদস্য। আর এই জন্যই এই লোকগুলো নিজেদের চারপাশে সবসময় একটা নিরাপত্তা বলয় গড়ে রাখে; সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর পাশাপাশি নিজেদের ভয়টাকে চেপে রাখার জন্য, যাতে ক্ষমতাসহ তাদের ঠাটবাট চিরদিন অটুট থাকে। কিন্তু ইতিহাস বলে এটা ক্ষণস্থায়ী! “ক্ষমতাবানরা কখনো ইতিহাসকে পাত্তা দেয়না” এটাই ইতিহাসের বিধান, ফলে পরবর্তীতে এরা নিজেরাই ইতিহাস হয়ে যায়। যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে!



সাইদা তার ছাতাখানা মাথায় দিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল আগে থেকে ঠিক করে রাখা আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্যাক্সি নিয়ে এসেছে কিনা দেখার জন্য। একটু খুঁজেই তাকে রাস্তায় পার্কিং করা অবস্থায় পেয়ে, ইশারায় তাকে ডেকে চলে আসতে বলল। ট্যাক্সি চলে আসতেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমরা তাতে ঝটপট উঠে পড়লাম।



ট্যাক্সি ঠিক করার সময় আপনাকে কিছুটা সাবধানতা গ্রহণ করতে হবে। এখানকার বেশির ভাগ ট্যাক্সিই অনেকদিনের পুড়নো এবং এদের বেশির ভাগেরই ফ্লোরগুলো জং ধরে খয়ে গেছে, কোন কোনটার ক্ষয় এত বেশী হয়েছে যে পা রাখার জায়গা পেতে আপনাকে কষ্ট করতে হবে। গাড়ী চলন্ত অবস্থায় আমাদের সবারই রাস্তার ডনে-বামে, সামনে–পিছনে এবং কখনো কখনো হয়তবা উপরের আকাশ দেখার সুযোগ হয়েছে কিন্তু চলন্ত গাড়ীর নীচের গতিময় রাস্তা দেখার সুযোগ বোধহয় এদেশেই পাবেন। তবে ট্যাক্সির ড্রাইভার’রা ভাল, জায়গার নাম এবং লোকেশন ঠিকমত বললে বা কার্ড দেখালে ওরা ঠিকই আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিবে। ভাড়াটা আগে মিটানোই ভাল। রাস্তার পাশে দাঁড়ালেই খালি ট্যাক্সি এসে পাশে দাঁড়াবে। আমাদের ঢাকার ট্যাক্সি আর সিএনজি অটো ড্রাইভারদের মত না, ওরা; আমাদের গুলোকে তো কোন জায়গায় যাওয়ার জন্য বললে, আগে ভাড়ার সাথে বকশিস কত দিবেন তা মিটানোর পাশাপাশি ফাও হিসাবে পা ধরতে হয়।

ট্যাক্সি নিয়ে ইয়াঙ্গুনের কিছুটা অদূরে সম্ভবত সমুদ্রের ধারে নতুন স্থাপিত শিল্প জোনে চলে এলাম আমাদের এপয়েন্টমেন্ট লিস্টের প্রথম বায়ারের সাথে দেখা করার জন্য। এটা একটা ফ্যাক্টরি কাম অফিস। একটু খুঁজেই এর মালিককে আমরা ফ্যাক্টরির সামনে একটা ঝুপড়িতে খালি গায়ে বসে সিগারেট টানা অবস্থায় পেলাম। ঝুপড়িটি একটা রেস্টুরেন্ট কাম শপ আমরা যাদের মজা করে “হোটেল ছালা দিয়া” বলি অনেকটা সেই ধরনের। টেবিলে টেবিলে কয়েকজন স্থানীয় মেয়ে-পুরুষ খাবার খাচ্ছে। অধিকাংশই ভাত সবজির সাথে মাংস খাচ্ছে। মাংসটা গরু বা শুকুরের বা অন্য কোন কিছুরই হতে পারে, সেটা আমি বুঝতে পারলাম না। বেশ ভূষায় একেবারেই সাধারণ বা গরিব মানুষ বলে মনে হলেও প্রায় সবারই লুঙ্গির ট্যাঁরে একটা করে মোবাইল গোঁজা। ওদের লুঙ্গি পড়ার ধরনের কারণে ফোনগুলো সহজেই দেখা যাচ্ছে।

এখানে মোবাইল ফোন খুব একটা সহজ বিষয় না। একটা স্থায়ী ফোন নম্বর পেতে হলে আপনাকে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার পাশাপাশি প্রায় ৮-১০ লাখ চাট পর্যন্ত খরচ করতে হবে। আর যদি অস্থায়ী ফোন নম্বর চান তাহলে ২০-২৫ হাজার চাট লাগবে। এই নম্বর সাধারণত একমাস মেয়াদী হয় যাতে একটা নির্দিষ্ট টক-টাইম লোড করা থাকে এবং ব্যালাঞ্চ শেষ হয়ে গেলে পুনরায় চাট রিচারজ করা যায় না। অর্থাৎ টক-টাইম শেষ হয়ে গেলে প্রতিবার একটা করে নতুন নম্বরসহ সিম কিনতে হবে। মোবাইল ফোনের দাম ও নিয়মটা আমার কাছে যথেষ্ট অদ্ভুত লেগেছে। আমার ধারণা এদেশের সরকার তার সাধারণ জনগণকে স্থায়ী কোন ফোন নম্বর দিতে চায় না কারণ তাহলে সবার একটা পৃথক আইডেন্টি হবে, একে অপরের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারবে, ফলে সরকার বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধবে।



ঝুপড়ির একপাশে প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিলে বসে আমরা মিটিং করলাম, ওদের পণ্যের মাসিক চাহিদা, প্রত্যাশিত দাম, স্পেসিফিকেশন সম্পর্কে ধারনা নিলাম এবং আমরা কি পারবো তা বললাম। আমি উপযাজক হয়ে ওদের ফ্যাক্টরিটা দেখতে চাইলাম কিন্তু ওরা বিনয়ের সহিত “না” করল। অর্থাৎ আমাদের ফ্যাক্টরিতে ঢুকতে দিলো না বরং ফটো সেশনের নামে আমাদের ছবি তুলে রাখল। অতএব বাইরে থেকে দেখেই ওদের ফ্যাক্টরি সম্পর্কে আমাদের ধারণা নিতে হল। মিটিং-এ কথা যা বলার তা সাইদাই বলল কারণ ওরা ইংরেজি কিছুই জানে না। ওদের সাথে কাজ সেরে আমরা অন্য গন্তব্যে চললাম পরবর্তী এপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে।



পর পর আরও কয়েকটি মিটিং সারলাম। অধিকাংশ মিটিংই হলো মেয়ে পরিচালকদের সাথে তাদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে। যেহেতু আমরা সরাসরি কথা বলতে পারছিনা এবং সব কথা সারতে হচ্ছে আমাদের দোভাষীর মাধ্যমে সেহেতু আলোচনায় একটা শূন্যতা সব সময় থেকে যাচ্ছে। চেহারায় মিল থাকার দরুন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিকানা মিয়ানমারের অধিবাসীদের তথা বর্মীদের না চাইনিজদের এটা বোজা খুবই কঠিন। পরে আমি ঘরে ঝুলানো ছবি দেখে এর একটা বিহিত বের করলাম। চিনা মালিকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে ঝুলানো ছবিগুলো অধিকাংশই কেশ বিন্যাস করা গায়কী ঢঙ্গে মেয়েদের ছবি আর চাইনিজ ভাষার বিভিন্ন ওয়াল পেপার। আর বর্মীদের প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে একটা হলেও গৌতম বুদ্ধের ছবি আছে আর তাদের ভাষার বর্ণমালাও ভিন্ন। “অধিকাংশ ব্যবসা চিনাদের” এই শোনা কথাটি সত্যি হল। একটা ব্যাপার সব জায়গায় কমন ছিল আর সেটা হলো, সব মিটিঙেই আমাদের ছবি তোলা হয়েছে, কোথাও কোথাও আমাদের সকল মুভমেন্ট ভিডিও পর্যন্ত করা হয়েছে। এটা দেখে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, “তবে কি আমরা ওয়াচড”!



কাজ সেরে হোটেলে ফিরে, রেস্টুরেন্টে চা খেতে খেতে এক চাইনিজ বন্ধুকে হেসে বাংলায় বললাম, “বন্ধু অন্যের মুড়ি-গুড় মেখে মোয়া ভালই বানাচ্ছ আর খাচ্ছ! এবার অন্যকেও একটু ভাগ দাও!” গত কয়েকদিনের পরিচয়ে ইতিমধ্যে আমার বন্ধু হয়ে যাওয়া মিঃ লি কিছু না বুঝেই হাসলো। সেও তার ভাষায় আমাকে কিছু একটা বলল, আমিও না বুজেই হাসলাম!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.