![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুহম্মদ আসাদ্দর আলী
দার্শনিকদের দেশ হিসাবে সুখ্যাত বাংলা-আসামের আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটকে, বাংলাদেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানী এবং গীত-গীতিকা বারমাসীর লীলাভূমি হিসেবে একটা সম্মানিত আসনের হকদার বলে বিবেচনা করা হয়। এমনিভাবে ভূমির প্রাচীনত্ব, ধর্মীয় ঐতিহ্য, আঞ্চলিক ভাষা এবং সাহিত্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকারসহ সিলেটের আর যেসব গুরুত্বপূর্ণ ¯^াতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট রয়েছে তন্মধ্যে সিলেটি নাগরি লিপির প্রসঙ্গটি অত্যন্ত তাৎপর্যবহ বলে
এ নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলার ন্যায় সংগত দাবী রাখে।
সিলেটী নাগরী লিপি কি, কবে কেন এবং কাদের দ্বারা এর উদ্ভব ঘটেছিল এমন কি ঐ লিপিতে বিধৃত ফসলেরইবা নিদর্শন কি ইত্যাদি বিষয়ে কিছু কিছু প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করা বর্তমান প্রজন্মের কাছেও খুবই দরকারী বলে বিবেচিত হচ্ছে।
শিলালিপির সা¶্য অনুসারে ১৩০৩ খৃীস্টাব্দে দিল্লীর মুসলমান বাদশার সামরিক বাহিনী এবং হজরত শাহজালাল মুজর্রদ (রহঃ) ও তাঁর সংগী-সাথী কথিত ৩৬০ আউলিয়া বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় বিনা রক্তপাতে সিলেট বিজয় সমাধা হওয়ার পর সিলেটের বুকে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হতে শুরু করে। এর পর পরই বিজয়ী মুসলমানদের ¯^াতন্ত্রিক প্রয়োজনে খৃীস্টীয় চৌদ্দ শতকের প্রথমার্ধের ভিতর “বাংলা লিপির বিকল্প লিপি হিসাবে”“সিলেটী নাগরী লিপি” সৃষ্টির আবশ্যকতা দেখা দিয়েছিল।
সিলেটি মুসলমান ভাষা বিজ্ঞানীর দ্বারা সৃষ্ট বাংলার ঐ বিকল্প লিপিমালাটা ব্যবহারের ¶েত্রেও প্রধানতঃ সিলেটের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমিত থেকেছে সময় সময়। হাতের লেখা পর্যায় পর্যন্ত এর কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। ছাপাখানা জন্মের পর ঐ লিপিতে মুদ্রিত পুথি-পত্র সিলেটের বাইরেও বেশ কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিল বলে তথ্য মিলে। কোন বিদ্যালয়ে না গিয়েও অতি সহজে এবং খুব অল্প সময়ের ভিতর ঐ লিপির মাধ্যমে পঠন পাঠনের ব্যাপারটি আয়ত্বে আনা সম্ভব। সেজন্যে মুসলমান নারী সমাজে পর্যন্ত ঐ লিপি ব্যাপক প্রসার লাভ করতে পেরেছিল। ¯^ল্প সময়ে ঐ লিপি আয়ত্ব করা সংক্রান্ত এক বা একাধিক প্রবাদও জন্ম নিয়েছিল সিলেট। যেমন- “কাজীর ঘরর বাইন্দেও যেলান আড়াই হরফ জানে, অলান নাগরীও হিকা যায় মাত্র আড়াই দিনে।” এখানে ‘নাগরী’ বলতে “সিলেটি নাগরী হরফ” কেই বুঝানো হয়েছে,- ‘নাগরী’ নামীয় কোন ভাষাকে নয়। লিখতে না জানলেও সিলেটের অনেক মুসলমান নরনারী এই লিপি পড়তে পারতো।
আঞ্চলিক ভাষার ন্যায় সাহিত্য সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যের ¶েত্রে সিলেটবাসীর এককভাবে গর্ব করার বিষয় হলো তাদের নিজ¯^ লিপিমালা। নাগরী হরফের সাথে আকৃতিগত মিলের প্রে¶িতে এ লিপিমালাকে “সিলেট নাগরী লিপি” বা ছিলটী নাগরী হরফ বলা হয়। আবার মুসলমান ভাষা বিজ্ঞানীর দ্বারা উদ্ভূত এবং মুসলমান সমাজে ব্যাপক ব্যবহারের সীমাবদ্ভতা থেকে হিন্দু পণ্ডিতগন এ লিপিমালাকে “মুসলমানী নাগরী” বলেও অভিহিত করেছেন। এ লিপি আলাদা কোন ভাষার জন্য আলাদা কোন লিপি নয়, বাংলারই বিকল্প হলো “সিলেটী নাগরী লিপি।” পৃথিবীতে এমন বহু ভাষা রয়েছে সেগুলোর আসলে নিজ¯^ কোন লিপিমালাই নাই। এক লিপিতে একাধিক ভাষায় কাজ চলার নিদর্শন কম নয় এ পৃথিবীতে। তবে, একটি মাত্র বাংলা ভাষাকে লিখিতভাবে প্রকাশ করার জন্যে সার্থক দুটো লিপিমালার উদ্ভব ও বিকাশকে দুনিয়ার ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসে একটা নজিরবিহীন ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে।
সংবেদনশীল তাজা মনের সু¶্ণ অনুভূতি সমূহের শিল্প সুষমামণ্ডিত বৈচিত্রময় যে প্রকাশ সং¶েপে তারই নাম হলো সাহিত্য। জীবন্ত ও বিকশিত মনের যুগোপযোগী সাহিত্য পদবাচ্য সেসব তরতাজা ফসলাদিকে মনান্তরে পাঠানোর ব্যাপারে মানুষের ভিতর যে এক অদম্য স্পৃহা ক্রিয়াশীল কালান্তরে তার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব নয় কাগজ কলমের সাহায্য ব্যতিরেকে। অর্থাৎ চাই লেখা। এছাড়া আরো অনেক প্রয়োজনীয় কারণ রয়েছে লেখার পেছনে। এসব নানা কারণ এবং চিরন্তন তাগিদ থেকে যে কোন লিপিমালার উদ্ভব ও বিকাশ হয়ে থাকলেও- কবে, কেন, কিভাবে এবং সিলেটের কোন মুসলমান ভাষা বিজ্ঞানীর দ্বারা “ছিলটী নাগরী হরফ”-এর জন্ম ও বিকাশ সাধন সম্ভব হয়েছিল তার সঠিক কোন তথ্য এ পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব হয়নি। সেজন্যে এদেশের অনেক বিজ্ঞ পণ্ডিতকে ওসব প্রয়োজনীয় ব্যাপারে বহু আনুমানিক সিন্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে। যৌক্তিকতার নিক্তিতে সেসব অনুমানের সাফল্য ও সার্থকতা এখনো সুধীবৃন্দের বিবেচনাধীন।
বাংলা বর্ণমালার তুলনায়- “ছিলটী নাগরী হরফ”-এ ধ্বনির প্রতীক¯^রূপ বর্ণের সংখ্যা অনেক কম গ্রহণ করা হয়েছে। “একটি ধ্বনির জন্যে একটি মাত্র সংকেত চিহ্ন”- ভাষাতত্ত্বের এমন উন্নত ধরণের ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্টের ভিত্তিতে সৃষ্ট বাংলা লিপির বৈমাত্রিক ভ্রাতৃপ্রতিম “ছিলটী নাগরী হরফ”-কে নিঃসন্দেহভাবে একটি যৌক্তিক ও বলিষ্ঠ ধরণের বৈজ্ঞানিক সিদ্ধি হিসাবে গণ্য করা চলে। বিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলা লিপির সংস্কার সাধনের যে চেষ্টা চলেছে, আষ্চর্য হলেও একথা সত্য যে, সে কাজটাকেই চৌদ্দ শতকের প্রথমার্ধের ভেতর সমাধা করে রেখেছেন সিলেটের অমর ভাষা বিজ্ঞানী পণ্ডিতগণ। ভাষা বিজ্ঞান সম্মতভাবে ধ্বনির ভিত্তিতে সৃষ্ট এবং জটিল কঠিন যুক্তা¶রের ঝামেলা থেকে অধিকতর মুক্ত-“ছিলটী নাগরী হরফ” নামের বর্ণমালাটি কেবল তত্ত্বীয় পর্যায়েই সীমিত থাকেনি, বাস্তব প্রয়োগের সফল নিদর্শন ¯^রূপ ঐ লিপিমালার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় যুগোপযোগী সাহিত্য সৃষ্টির ধারাও প্রাণবন্ত থেকেছে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত।
প্রচলিত বাংলা লিপির কাঠিন্য ও জটিলতার হাত থেকে নিস্কৃতি লাভের সক্রিয় মানসিকতা থেকেই সং¶িপ্ত ও সহজ সরল “ছিলটী নাগরী হরফ” জন্ম নিয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। আসলে মুসলমানদের প্রচেষ্ঠাতেই অনুরূপ সংস্কার সাধন সম্ভব হয়েছিল। বলা বাহুল্য- বাংলা ভাষার মাধ্যমে দ্রুততর গতিতে ইসলাম ধর্মের চর্চা এবং বাংলা ভাষায় মানবিক গুণসম্পন্ন সাহিত্য সাধনার গরজেই নতুন নামের এই বর্ণমালার বলতে গেলে অনেকটা রাতারাতিই জন্মলাভ করেছিলো। সেজন্যে, আমাদের বিবেচনায় “ছিলটী নাগরী হরফ” সৃষ্টির অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হলো-ঐতিহ্যসচেতন সিলেটী মুসলমানদের ¯^াতন্ত্রবোধ। সম্ভবতঃ এটাই একমাত্র বিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হওয়ার সংগত দাবী রাখে। বহিরাগত সিলেটী মুসলমানগণ সিলেটে প্রচলিত বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞার সাথে “হিন্দুয়ানী ভাষা” কিংবা “হিন্দুয়ালী ভাষা” বলে নামাঞ্চিত করলেন এবং আরবী-ফারসী শব্দ মিশ্রিত যতদুর সম্ভব সহজ সরল মুসলমানী বাংলার চর্চার জন্যেই নতুন নামের নতুন এক বর্ণমালা তৈরী করে নিয়ে লিখন ক্রিয়ার মাধ্যমে পঠন-পাঠন শুরু করে দিলেন। সেকালের সিলেটবাসীদের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যাপারে দুটো লিপিমালার চর্চা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। হিন্দুগণ লিখতেন বাংলা লিপিতে, মুসলমানগণ ব্যবহার করতেন “ছিলটী নাগরী হরফ”। এমনকি সিলেটের হিন্দুগণ অবজ্ঞেয় মুসলমানের লিপি হিসেবে “ছিলটী নাগরী হরফ”-এর ধার কাছ দিয়েও যেতেন না। প্রকৃতপ¶ে মুসলমানদের দ্বারা সিলেট বিজয়ের পর মুসলমান ভাষাবিজ্ঞানীর দ্বারা উদ্ভাবিত হয়ে ব্যবহারের দিক থেকেও মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থেকেছিল বিধায়- সত্যিকার অর্থে মুসলমানদের নিজ¯^ ¯^াতন্ত্র্যবোধ থেকে “ছিলটী নাগরী হরফ” জন্ম নিয়েছিল বলে অনুমান করাটা অত্যন্ত ¯^াভাবিক ও ইতিহাস সম্মত বলে বিবেচিত হয়।
কিভাবে এবং কোন কারণে “ছিলটী নাগরী হরফ” জন্মলাভ করেছিল সেসব ব্যাপারে আনুমানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকলে যেমন একমত নন, ঠিক তেমনি ঐ লিপিমালার জন্মকাল নিয়েও পণ্ডিত মহরর মতানৈক্য কম নয়। উপমহাদেশের খ্যাতিমান ভাষাতত্ত্ববিদ “ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় খৃীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীকে সিলেটে এই লিপির প্রচলনকাল বলে অনুমান করেন; অপরপ¶ে ডক্টর আহমেদ হাসান দানী এই প্রচলন কালটাকে আরো দুই তিন শতাব্দী পিছিয়ে দিতে চান।” এতটুকু লিখার পর অধ্যাপক শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী মহাশয় যথেষ্ঠ দ¶তার সাথে ডঃ দানীর অনুমান যে যুক্তিযুক্ত নয় সেটি দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। কিছুদিন আগে মুহাম্মদ গুলাম হুছন কৃত “তালিব হুছন” নামক একখানা প্রাচীন পুঁথির অনুলিপি পাওয়া গেছে। “ছিলটী নাগরী হরফ”-এে খা ঐ “তালিব হুছন” পাণ্ডুলিপির রচনাকাল ১৫৪৯ খৃীষ্টাব্দ। এরও অনেক অনেক আগে যে ঐ লিপিমালার সাহায্যে বাংলা সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়েছিল সেকথা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। ১৫৪৯ খৃীষ্টাব্দে লেখা “তালিব হুছন” প্রসংগটি যে সুনীতি বাবুর অনুমানের সম্পুরক হিসেবে বিবেচিত হয় সেকথা আর বলার অপে¶া রাখে না। আমাদের বিবেচনায় খৃীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথথমার্ধের ভেতরই সিলেটের মুসলমান ভাষা বিজ্ঞানীগণ “ছিলটী নাগরী হরফ” চালু করেছিলেন। বাংলা লিপির ন্যায় “ছিলটী নাগরী হরফ”ও ছাপাখানা স্থাপিত হওয়ার অনেক অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল।
আজ থেকে প্রায় ৮৪ বছর আগে অর্থাৎ ১৩১৫ বাংলায় সিলেটের প্রখ্যাত পণ্ডিত পদ্মনাথ দেবশর্মা মহাশয় “ছিলটী নাগরী হরফ”-এর পরিচয়দান প্রসংগে লিখেছিলেন “সিলেট নাগরীতে ৩২ মাত্র অ¶র, পাঁচটি ¯^র এবং ২৭ ব্যঞ্জন। আকার, একটি ঈকার (ী), একটি উকার (ু), একার ও ঐকার। ... অ¶রগুলির প্রতি অনুধাবন করিলে দেখা যাইবে যে আ, ও, খ, ছ, ঝ, ল এবং হ এইগুলির আকৃতি নাগরা¶র হইতে ¯^তন্ত্র হইয়া পড়িয়াছে। ¯^র চিহ্নগুলি ঠিক দেব নাগরের মতোই। সমস্ত অনুনাসিক বর্ণ-মধ্যে ন এবং স ই-আছে। ন ও স এক একটি এবং অন্তঃস্থ ‘য’ লোপ পাইয়াছে। অথছ এত কাট-ছাটের মধ্যে অতিরিক্ত ‘ড়’ একটি নিতান্ত আবশ্যকভাবে রাখা হইয়াছে; ইহার কাজ ‘ড’ কিংবা ‘র’ দ্বারা অনায়াসে চলিতে পারিত। ¯^রবর্ণের সং¶েপটা কিছু বেশী; অ, ঈ, ঊ, ঋ, ঐ, ঔ এই অত্যাবশ্যক ¯^রগুলি বর্জিত হইয়াছে।”
মাত্র ১৬টি সংযুক্ত বর্ণ রাখা হইয়াছে; তন্মধ্যে প্রথমটি বংগ বা সংস্কৃত ভাষার কোথাও পাওয়া যাইবে না; ইহা আলেফ্-লাম-আল্, কেবল ‘আল্লা’ শব্দটি লিখিতেই ইহার প্রয়োজন দেখা যায়। বাকী ১৫টি পরী¶া করিলে দেখা যাইবে যে সাধারণতঃ আরবী বা পারসী শব্দে সচরাচর যে সকল সংযুক্ত বর্ণের প্রয়োগ আছে তাহাই মাত্র রাখা হইয়াছে। ..... বাংগালায় সংযুক্ত বর্ণের সংখ্যা প্রায় দ্বিশত হইবে; এই গুলি শি¶া করাই বংগভাষা-ধ্যায়ীর প¶ে বড় সুকঠিন কাজ। ইহার সংখ্যা মাত্র ১৫-তে পরিণত হওয়ায় এই নাগরী সাধারণ মুসলমানের প¶ে সুগম হইয়াছে, তাই ইহার আদর দিন দিন বাড়িতেছে। ..... ¯^রের প্রধান অ-কারের কার্য ‘ও’ দ্বারা সাধিত হইতেছে। ও-কারের ¯^র চিহ্ন (াে) না থাকিলেও উহার কার্য উকার দ্বারা (যথা লোকের পরিবর্তে লুক) নিষ্পন্ন হয়। ঐ-কার থাকিলেও সচরাচর ইহার স্থানে ‘অই’ এবং ঔ-কারের স্থানে ‘অউ’ ব্যবহৃত হয়। ফল কথা আরব্য পারস্য যদি জের-জবর-পেশ এই তিনটি মাত্র ¯^র চিহ্ন দ্বারা কাজ চলিতে পারে, যদি ঐ তিনটিরই মাত্র সহায়তায় হিন্দিকে উর্দুতে পরিণত করা যাইতে পারে তবে এই স্থলেও কাজ না চলিবার কোন কারণ দেখা যায় না। ব্যঞ্জন বর্ণ স¤^ন্ধেও ঐকথা। আরব্য বর্ণমালাকে মুলাধার করিয়া দুই চারিটি মাত্র অতিরিক্ত (যথা পারস্য চ, গ, প এবং উর্দু ট,ড) বর্ণ নাক্তা মুড়িয়া তৈয়ার করিয়া যদি তৎসাহায্যে হিন্দি ভাষাটা লিখিতে পারা যায়, তবে এই ¯^ল্প ব্যঞ্জনের সহায়তায় বাংগালা ভাষা লিখিতে বিশেষ অসুবিধা হইবার কোন কারণ নাই। বিশেষতঃ ইহাতে মাত্র মুসলমানী বাংগালা লিখিবারই প্রয়াস হইতেছে; এই বাংগালায় সচরাচর আরব্য-পারস্য শব্দেরই বহুল ব্যবহার দেখা যায়, সংস্কৃত শব্দ অতি কমই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। সংসাকৃত শব্দের বিরলতায় দুটি বিষয়ে সুবিধা হইতেছেঃ এক, বর্ণাশুদ্ধি হইলেও তেমন বাধে না, অপর, সংযুক্ত বর্ণের অল্পতায়ও কোনরূপ অসুবিধা হয় না।”
“ছিলটী নাগরী হরফ”-এর গুণ, বৈশিষ্ট ও সার্থকতা সম্পর্কে এর আগে আর কোন পণ্ডিত কোন কিছু লিখেছিলেন বলে আমাদের নজরে পড়েনি। অধ্যাপক শিব প্রসন্ন লাহিড়ী বাবু তার প্রাগুক্ত প্রবন্ধের এক জায়গাতে লিখেছেন- “সিলেটী নাগরীর বর্ণমালা ভাষায় ব্যবহৃত উচ্চারণের দিকে ল¶্য রেখে প্রস্তুত বা গৃহীত হয়েছে। ‘একটি উচ্চারণের জন্য একটি বর্ণ’- অনেকটা এই ধ্বনি বিজ্ঞান সম্মত নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। তাই ঈ, ঊ, ণ, ষ, অন্তঃস্থ ব, ষ, স, ঢ় বর্ণগুলি বর্জিত হয়েছে। আধুনিক সংস্কারপন্থী পণ্ডিতগণ যে কারণে বংগলিপি এবং ভাষা থেকে ঋ, ঠ, ঔ, ঃ, ঙ, ্ঞ, বর্ণগুলি পরিত্যাগ করতে চান, সম্ভবত সেই কারণেই সিলেটী নাগরীতে অপ্রয়োজনবোধে ঐ বর্ণগুলি ত্যাগ করা হয়েছে।” প্রকৃত প¶ে ছ’ সাতশ’ বছর আগে ঐ লিপিমালার সৃষ্টি হয়ে থাকলেও “ছিলটী নাগরী হরফ”-এর সে অমর স্রষ্টা আধুনিক বাংলালিপি সংস্কারকদের পথিকৃত হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
যে ৩২টি বর্ণের ভিত্তিতে “ছিলটী নাগরী হরফ”-এ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সার্থকভাবে বাংলা ভাষায় সাহিত্য সাধনা চলেছে সে বর্ণগুলি এই- আ, ই, উ, এ, ও, ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, র, ল, শ, হ, ড। ছাপা অবস্থায় “ছিলটী নাগরী হরফ”-এর সংযুক্ত বর্ণ এবং ছাপাখানা শুরু হওয়ার আগের পর্যায়ের সংযুক্ত বর্ণের মধ্যে বেশ কিছুটা তারতম্য রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সিলেটের মুসলমানগণ “সিলটী নাগরী হরফ”-এর মাধ্যমে সার্থকভাবে বাংলা ভাষায় সাহিত্য সাধনা চালিয়েছেন। তবে বাংলালিপিও তাদের কাছে নিষিদ্ধ ছিলনা। কেহ কেহ প্রথম দিকে বাংলালিপি মোটেই ব্যবহার করেননি কেহ কেহ আবার উভয় লিপিতে সাহিত্য সাধনা করেছেন। শেষ দিকে অনেকে কেবল বাংলা লিপি ব্যবহার করেছেন বলে নিদর্শন মিলে। সময়ের প্রয়োজনের সাথে বেশীর ভাগ ¶েত্রে মিল রেখেই সিলেটের কবি সাহিত্যিকগণ “ছিলটী নাগরী হরফ”-এর মাধ্যমে ধর্ম ও সাহিত্য চর্চা করেছেন। আসলাম ধর্মের বিধি-বিধান, মরমী মারফতি-সুফীতত্ত্ব ইত্যাদি সংক্রান্ত নানারূপ আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথা এবং গল্প-উপন্যাস-সমাচিত্র-চরিত্র কথা সহ অনেক কিছুরই নিদর্শন রয়েছে “ছিলটী নাগরী হরফে”-লেখা সম্পদরাজির ভিতর। ঐ লিপিতে গদ্যের মাধ্যমে কথাসাহিত্য বিকশিত না হলেও রক্ত-মাংসে গড়া মানুষকে নিয়ে সৃষ্ট মানবিক প্রাজ্ঞ উপাখ্যানের দ্বারা যথার্থভাবে সে অভাব পূরণ করা হয়েছে।
মুসলমানগন কর্তৃক সিলেট বিজয় সংগঠিত হওয়ার পর বাংলা আসামের মধ্যে সিলেটেই সর্ব প্রথম সূফী শাস্ত্র চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। সিলেটের মুসলমানগণ “ছিলটী নাগরী হরফ”-এ বহু সূফী শাস্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ পর্যন্ত “ছিলটী নাগরী হরফ”-এ কতটি গ্রন্থ রচিত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা মিলেনি। চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্য ভূষণ তাঁর “সিলেটী নাগরী পরিক্রমা” গ্রন্থে ১১২ খানা গ্রন্থের এক তালিকা পেশ করেছেন। অবশ্য- এ তালিকাটাই চূড়ান্ত নয়। আমাদের জানামতে যে সব গ্রন্থ ঐ তালিকাতে আসেনি সেগুলো হলো- গুলাম হুছন কৃত (১) তালিব হুছন, সৈয়দ শাহ হুছন আলম কৃত (২) রিছালত, সৈয়দ শাহানূর কৃত (৩) নূরের বাগান, (৪) সাত কইন্যার বাখান, (৫) মনিহারি, মুনসী সাদেক আলী কৃত (৬) রদ্দুল হিন্দ, (৭) পান্দেনামা, (৮) পুথি দাপেউল হুজত, শাহ আছদ আলী কৃত (৯) এবাদতে মগজ, মুনসী নছিম আলী কৃত (১০) হরুফুল খাছলত, অধম আজম কৃত (১১) গাফিল নসিহত, পীর মজির উদ্দিন আহমদ কৃত (১২) ভেদজহুর, (১৩) প্রেমমালা ১ম খন্ড, (১৪) প্রেমমালা ২য় খন্ড, (১৫) প্রেম রতন, (১৬) শাহাদাতে বুজুর গান, (১৭) জারী জংগ নামা, শিতালং কৃত (১৮) রাগ শিতালং, মুনসী সাদেক আলী কৃত অন্য আরেকখানি গ্রন্থ (১৯) কশফুল বেদাত, স্নেহ ভাজন আব্দুল হামিদ মানিকের নিকট আছে (২০) কেয়ামতনামা, স্নেহ ভাজন সেলিম আউয়ালের নিকট আছে (২১) ইউসুফ জুলেখা এবং কোলকাতার যাদবপুরে অবস্থিত “যতীন্দ্র মোহন সংগ্রহ শালা”-তে কয়েকখানার মধ্যে এমন ১৭ খানা গ্রন্থ রয়েছে যেগুলো গোলাম আকবর সাহেবের তালিকাতে আসেনি। সবগুলো একত্র করলে সংখ্যাটা আপাততঃ (১১২+২১+১৭)=১৫০ হয়। গ্রন্থের নিদর্শন আর যদি নাও মিলে তথাপি প্রাপ্ত সংখ্যাটাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ সেকথা সবাই ¯^ীকার করবেন।
এ পর্যন্ত “ছিলটী নাগরী হরফ”-এ বাংলা সাহিত্য চর্চার মূল্যায়ন সম্পর্কে আমাদের জানামতে একটিমাত্র কাজ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের প্রখ্যাত অধ্যাপক ডঃ কাজী দীন মুহম্মদ সাহেবের অধীন ধর্মপাশা থানার চামারদানী গ্রামনিবাসী বন্ধুবর জনাব গোলাম কাদির “সিলেটী নাগরী লিপিঃ ভাষা ও সাহিত্য” শিরোনামে থিসিস রচনা করে ১৯৮৩ খৃীষ্টাব্দে পি, এইচ, ডি, ডিগ্রী লাভ করেছেন। তাঁর থিসিসটি প্রকাশিত হলে এ প্রসঙ্গে অনেক কিছুই অবগত হওয়া যাবে। বলা বাহুল্য- ¶েত্রটি অনেক বিশাল। সেজন্যে এখানে আরো একাধিক থিসিস লেখার অবকাশ রয়েছে।
তথ্যসূচী:
১. শিব প্রসন্ন লাহিড়ী : সিলেটী নাগরী লিপির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ : বাংলা একাডেমী পত্রিকা, ৩য় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বৈশাখ-শ্রাবণ ১৩৬৬ : পৃষ্ঠা-৩২
২. মুহম্মদ আসদ্দর আলী : প্রাচীন পুথি তালিব হুছন : দৈনিক সিলেটের ডাক ৪, ৬, ৭-১৯ নভে¤^র ১৯৮৮
৩. আই, সি, এস, গুরুসদয় দত্ত এবং ডঃ নির্মলেন্দু ভৌমিকের সম্পাদনায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ খৃীষ্টাব্দে প্রকাশিত “শ্রীহট্টের লোক সংগীত” গ্রন্থের ১৩-১৫ পৃষ্ঠার ভেতর পদ্মনাথ দেবশর্মা মহাশয়ের কথাগুলো ছাপানো হয়েছে অন্য স্থান থেকে।
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৫৬
হামোম প্রমোদ বলেছেন: মূল্যবান লেখা। ধন্যবাদ পোষ্ট দেয়ার জন্য।