![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবনে সফল হতে না পারি দুঃখ নেই...একজন ভাল মানুষ হিসেবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চাই...
--> ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক লেখা ছাপা হয়েছে এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে আলোচনার খই ফুটেছে। এসব লেখক-আলোচকের মধ্যে 'হঠাৎ লেখক' ও 'আকস্মিক খামাখা-আলোচক' যেমন আছেন, তেমনি আছেন কিছু নামিদামি মানুষও। এবার অধিকাংশ লেখা পড়ে ও আলোচনা শুনে মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একাই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। মস্কোপন্থি ন্যাপ-কমিউনিস্টদের কথা কেউ ছিটেফোঁটা ভুলে-ভালে উল্লেখ করলেও এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন ওরা 'লীগ-হিরো'দের ফুট-ফরমায়েশ পালনকারী। কেউ অবশ্য বলতে চান, ওরা তাতে মাইন্ড করেন না, তাতেই বরং 'প্রফুল্ল' বোধ করেন। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি, শক্তি এবং এককালে মাও সে তুংয়ের চীনের অনুসারী-খ্যাত মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও অন্য বাম-প্রগতিশীলদের স্বাধীনতা যুদ্ধে কোনো ভূমিকাই যেন ছিল না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। এ দুয়ের ভূমিকাকে অস্বীকার করে বা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হবে না। একটি মাত্র ঘোষণায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়নি। এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে 'স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী'র মূল্য ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে যাব আলোচনায়, তবে খুবই সংক্ষেপে। আগে আলোচনা করতে চাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যদের ভূমিকা নিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রথম সাফ কথা উচ্চারণ করেন এ দেশের বহু নেতার নেতা (এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও। মওলানা ভাসানীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর আনুগত্য, শ্রদ্ধা ও নিবিড় সম্পর্কের প্রকাশ দেখা যায় 'অসমাপ্ত আত্দজীবনী-শেখ মুজিবুর রহমান'-গ্রন্থে) মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি থাকাকালে জনাব শামসুল হকের মৃত্যুর পর শেখ সাহেব ছিলেন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তৎকালীন পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ওয়াদা ভঙ্গ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি_ বিশেষ করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়োটো-সেন্টো চুক্তি, বাগদাদ প্যাক্ট এবং পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তীব্র মতবিরোধের পটভূমিকায় ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভা ও বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হয় ৬ ফেব্রুয়ারি, সন্তোষ মহারাজার নাটমন্দিরে। ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি '৫৭ অনুষ্ঠিত হয় কাউন্সিল অধিবেশন। তা-ই ইতিহাসে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন নামে খ্যাত। ৭ ফেব্রুয়ারি সেই কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনেই মওলানা ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়োটো চুক্তি সংস্থা ও বাগদাদ চুক্তি সংস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কয়েক ঘণ্টা জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, "পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে ও সামরিক-বেসামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সংখ্যাসাম্য নীতি পালিত না হইলে পূর্ব পাকিস্তান আসসালামু আলাইকুম বলিবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে" (জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫-৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-২২৭)। সে জন্য অনেকেই মওলানা ভাসানীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে সম্মান প্রদান করেন। দুর্ভাগ্য, কোনো লেখকের লেখায় বা কোনো বিদগ্ধজনের আলোচনায় প্রসঙ্গটি এলোই না! এ লেখার উদ্দেশ্য কাউকে ছোট বা বড় করা নয়। নির্মোহচিত্তে সত্যের সন্ধান করা বা দেওয়া।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিশ্লেষণ করতে হবে ভিন্নভাবে। স্বাধীনতা আন্দোলন দীর্ঘ ২৩ বছরের আর স্বাধীনতা যুদ্ধ ৯ মাসের। ১৯৪৮ সাল থেকেই মূলত আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধতে থাকে। সাতান্নতে ঘটে প্রথম প্রকাশ্য বিস্ফোরণ কাগমারীতে। সেই থেকে দীর্ঘ সংগ্রামে অসংখ্য বীর রক্ত দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, অগণিত মানুষ স্বীকার করেছেন সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য লড়াই আমাদের জাতিসত্তাকে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে যেন খুঁচিয়ে জাগিয়ে দেয়। এরপর সামরিক ও স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের জাতীয়তাবাদী জাগরণ_ বাঙালি জাতীয়তাবাদী জাগরণ তুঙ্গে ওঠে ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। একই সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করতে হবে, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান (তখনো তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়নি) কর্তৃক ঘোষিত ছয় দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদী জাগরণের বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। মানুষের চেতনায়, আকাঙ্ক্ষায় স্বাধীনতার স্বপ্ন কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষে তখনো প্রকাশ্যে কোনো আওয়াজ ওঠেনি। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালি জাতির সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের প্রকাশ। তারপর একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও ভুট্টো চক্রের নানা টালবাহানায় পরিষ্কার হয়ে যায়, আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন না, তাকে তা হতে দিচ্ছে না পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত এককেন্দ্রিক বিজাতীয় শাসক-শোষক গোষ্ঠী। আশ্চর্যের বিষয়, তেমন একটি মহাসংকটকালেও ২৩ মার্চ পর্যন্ত জাতির কাছে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, এই সেদিনও কয়েকজন বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধু তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এও বলেছিলেন, তিনি সব প্রস্তুত করে রেখেছেন, কোথায় কি সাহায্য পাওয়া যাবে তাও বলে দিয়েছেন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দু-চার, পাঁচ-দশজন দলীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা-সংগঠকের কাছে বঙ্গবন্ধু তার নির্দেশনা দিয়েছিলেন, কিন্তু তার দলের ওই সব নেতার বাইরে অন্য দল বা দলের বাইরের অন্য কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামীর কাছে তা পেঁৗছেনি। এমনকি নিজ দলের সাধারণ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের কাছেও নয়। আমাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের যেসব নেতৃস্থানীয় বন্ধু ছিলেন, তারাও বিভ্রান্ত ছিলেন। স্বীকার করতে কারও দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তার অনুপস্থিতিতে কি করতে হবে তার ইঙ্গিত ছিল। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে যদি তিনি ২২ মার্চ পর্যন্ত আপস আলোচনা না চালাতেন বা তাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসতেন তা হলে ৭ মার্চের ভাষণের অর্থ দাঁড়াত ভিন্ন : জাতি কনফিউজড হতো না। জাতি ভিন্ন বার্তা পেয়ে যেত। যারা ৭ মার্চের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন, ইতিহাস তা সমর্থন করে না। এ ব্যাপারে আমরা একটু পরে আলোচনা করব।
মওলানা ভাসানীর পর ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও প্রকাশ্যে স্বাধীনতার দাবি উচ্চকিত হয়। এ দাবি উত্থাপন করেন এ দেশের বাম-প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কিছু পরীক্ষিত সৈনিক কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মোস্তফা জামাল হায়দার, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, মাহবুব উল্লাহ, হায়দার আনোয়ার খান জুনো, আতিকুর রহমান খান সালু প্রমুখ। পল্টন ময়দানে 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তারা স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের প্রত্যয় ঘোষণা করেন'। সভায় বলা হয়, 'পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের দ্বন্দ্ব মীমাংসার অযোগ্য স্তরে পেঁৗছে গেছে। এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙে এ ভূখণ্ডের স্বাধীনতাই ফয়সালার একমাত্র পথ। এই অপরাধে সামরিক আইন আদালতে কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখের বিচার হয় তাদের অনুপস্থিতিতে। সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্তসহ প্রত্যেককে সাড়ে সাত বছর জেল ও ১০ ঘা বেত্রদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে আরেক জনসভায় একই দাবি করা হয়। সেই অপরাধে চট্টগ্রাম ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল্লাহ-আল নোমান ও সাধারণ সম্পাদক এই লেখককে সামরিক আইন আদালতে তাদের অনুপস্থিতিতে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ ঘা বেত্রদণ্ডের সাজা ঘোষণা করা হয়। বাম-প্রগতিশীল-গণতন্ত্রীদের এই স্বাধীনতাকামী গ্রুপ সারা দেশে অনেকটা প্রকাশ্যেই (যেখানে সাংগঠনিক শক্তির ছিল) স্বাধীনতার পক্ষে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো আলোচনা যখন ভেঙে গেল, ইয়াহিয়া-ভুট্টো গোপনে চলে গেল পাকিস্তান, ২৫ মার্চ, '৭১ পল্টন ময়দানে আবারও জনসভা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ। সেদিন সেই জনসভায় স্বাধীনতার একটি ইশতেহারও পাঠ করা হয়। সেটি পাঠ করেছিলেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী শাহরিয়া আখতার বুলু। সেই কালরাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অপ্রস্তুত, অসংগঠিত নিরস্ত্র বাঙালি জনসাধারণের ওপর। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান সেদিন যারা জানিয়েছিলেন তারা একটি দলের-গ্রুপের নেতা ছিলেন, জাতির নেতা ছিলেন না। তাই তাদের আহ্বান ও সতর্কবাণী জনগণের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। প্রায় সবাই আশায় ছিলেন, আপস হবে, ফয়সালা হবে, পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে এবং সবকিছু মিটে যাবে_ আমাদের নির্বাচিত নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। ইয়াহিয়া-ভুট্টোদের আগমন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বৈঠকের পর বৈঠক, প্রেস ব্রিফিং এমন একটা ধারণারই সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের দোসররা আমাদের সমগ্র জাতিকে পরিকল্পিতভাবে প্রতারণার শিকার বানাল। একরাতেই বেঘোরে মারা গেল হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল_ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুষ্টিমেয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছাড়া দল, মত, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই একাট্টা হয়ে গেল দেশের স্বাধীনতার পক্ষে। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ইথারের স্রোতে ভেসে এলো এক সাহসী বজ্র কণ্ঠ_ 'আমি মেজর জিয়া বলছি...'। ছাত্র-যুব-তরুণ, কৃষক, শ্রমিক-জনতা-আবালবৃদ্ধবনিতার রক্তে বাজল অস্থিরতার সুর। এ যেন ঘোষণা নয়, আশা আর স্বপ্ন জাগানিয়া গান। এ প্রসঙ্গে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র'-এর তৃতীয় খণ্ডে উল্লেখ আছে, নিরাপত্তার কারণে জিয়াউর রহমানের প্রথম ঘোষণাটি নষ্ট করে ফেলা হয়। দ্বিতীয় ঘোষণাটি_ সেটি পরে বার বার প্রচারিত হয়_ তা সনি্নবেশিত আছে তাতে। ওই দ্বিতীয় ঘোষণায় তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। যে কোনো মানুষের_ যারা কোনো ঘোষণাই শোনেননি_ তাদের কৌতূহল থাকতেই পারে, জিয়ার প্রথম ঘোষণায় কি ছিল? উল্লেখ্য, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত দলিলপত্রেই তা উল্লেখ আছে। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত দলিলপত্র নিয়ে এ পর্যন্ত কেউ কোনো আপত্তি তোলেননি। স্বাধীনতার ঘোষক প্রসঙ্গটি আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং এ ব্যাপারে মহামান্য উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতার ঘোষক।' প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। লীগ নেতারা বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমরা বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনব। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি খ্যাতিমান ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে নিউইয়র্কের এনডবি্লউটিভি'র জন্য এই সাক্ষাৎকার দেন বঙ্গবন্ধু। ফ্রস্ট তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপনার কী ইচ্ছা ছিল, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন?' বঙ্গবন্ধুর জবাব : 'আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।' ফ্রস্ট আরও স্পষ্ট করে প্রশ্ন করেন, 'আপনি যদি বলতেন আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি তো কী ঘটত?'
বঙ্গবন্ধু : "বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল" (স্বাধীনতার ঘোষণা, মিথ ও দলিল, মাসুদুল হক, পৃষ্ঠা-২৪০)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুষ্টিমেয় দালাল ছাড়া দল, মত নির্বিশেষে সমগ্র জনগণই অংশগ্রহণ করেছিল। আমাদের দেশপ্রেমিক বীর সেনাবাহিনী যুদ্ধে পালন করেছে গৌরবদীপ্ত ভূমিকা। যুদ্ধের সামরিক নেতৃত্ব ছিল তাদের হাতে। সঙ্গে ছিল ইপিআর, পুলিশ। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীতে সব রাজনৈতিক দলের কর্মীর সংখ্যা কত ছিল? অনেক গবেষক বলেন, হার্ডলি ত্রিশ পার্সেন্ট। ধরলাম এর মধ্যে বেশির ভাগ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের। বাকি সত্তর পার্সেন্ট তো এ দেশের সাধারণ ঘরের, কৃষক-শ্রমিকের ছেলে। এরা দলের প্রেমে নয়, যুদ্ধে গেছে দেশের টানে। যে ত্রিশ লাখ শহীদের কথা জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, আওয়ামী লীগ একটা তালিকা প্রকাশ করুক তো তাতে তাদের দলের কতজনের নাম উল্লেখ করতে পারে। গবেষকরা বলেন, ৯৮ ভাগই দলীয় আনুগত্যহীন সাধারণ ঘরের দেশপ্রেমিক সন্তান মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাহলে আওয়ামী লীগ সমুদয় কৃতিত্ব দাবি করে কি করে? তবে এ কথা স্বীকার করতে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়, ভারতের সমর্থন, সুবিধা ও সত্তরের নির্বাচনে গণরায়ের ভিত্তিতে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। যুদ্ধটি ছিল প্রকৃতই জনগণের যুদ্ধ।
লেখাটি শেষ করব মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ প্রদত্ত একটি বিবৃতি দিয়ে। তাতে তিনি বলেছেন, "আজ আমি পূর্ব বাংলার সাত কোটি সাধারণ মানুষের কাছে এই জরুরি আহ্বান জানাতেই বাধ্য হচ্ছি যে, আপনারা দল-মত, ধর্ম ও শ্রেণী-নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ একত্রে এবং একযোগে একটি সাধারণ কর্মসূচি গ্রহণ করুন, যার মূল লক্ষ্য হবে ২৩ বছরের অমানুষিক শোষণকারী শোষকগোষ্ঠীর কবল থেকে পূর্ব বাংলাকে সমগ্র ও চূড়ান্তভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম করা। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা হস্তান্তরের ইতিবৃত্ত ও নির্গলিতার্থ এবং তার পরবর্তী অধ্যায়ে নবরূপে শোষণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে শতকরা ৯৮ ভাগ দেশবাসী অবহিত আছেন। সে জন্যই আজ আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন-সুখী দেশ প্রতিষ্ঠা করার নামে সমঝোতার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণীর বিদেশি শোষকদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে স্বাধীনতার যে প্রহসন সৃষ্টি করা হয়েছিল, আসুন, আজ আমরা একত্রিত হয়ে এই কপট স্বাধীনতাকে সত্যিকারের স্বাধীনতায় রূপান্তরিত করি। আসুন আজ আমরা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করি যে, পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের হাতে পূর্ণ গণতান্ত্রিক ক্ষমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরণ সংগ্রাম করে যাব। আসুন, আমরা ঘোষণা করি যে, পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।" বিবৃতি শেষ করেন একটি কাব্যাংশ দিয়ে_
'ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই তৈরি হও জোট বাঁধো
মাঠে কিষাণ কলে মজুর নওজোয়ান জোট বাঁধো
এই মিছিল সর্বহারার সব পাওয়ার এই মিছিল
হও শামিল, হও শামিল, হও শামিল'
(সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১২-৭১৩)।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]
মূল পোস্ট
০৭ ই এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৪:১০
টি-ভাইরাস বলেছেন: জি
২| ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৮
ওছামা বলেছেন: আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করোনা, আমাদের ধর্মবিশ্বাস বেচে দিওনা। আমাদের শ্বাস নিতে দাও।আমরা সাধারন মানুষ আজ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিভ্রান্ত।
©somewhere in net ltd.
১|
০৭ ই এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৩:২৬
আস্তবাবা বলেছেন: মি বহু আগে ফেবুতে লিখেছি, ব্লগেও লিখেছি, ৭ মার্চ ছাড়া ৭১ এর মার্চে কোন ভুমিকা তাদের ছিল না। তাই ২৬ মার্চ আসলেই তারা ৭ নার্চকে স্বরণ করে, কারন ২৬ মার্চ তাদের কোন ভুমিকা ছিলনা