নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মানুষের কথা বলি। মানবতার কথা বলি। স্বপ্ন দেখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। নিরাপদ একটি ভূখন্ডের।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মত আমরাও পালন করি মে দিবস। আমরাও প্লাকার্ড ফেস্টুন হাতে মিছিল করি। দাবী তুলি শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। টেলিভিশনের টক শো’তে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনার ডাক পরে শ্রমিক নেতাদের। কখনো কখনো বিবর্ণ চেহারার শ্রমিকের। তারা বর্তে যান। চাই কি মাঝে মাঝে তর্কও জুরে দেন সহ আলোচকদের সাথে। অভ্যাসবশত কখনো কখনো শ্রমিকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দু’একটি দাবীও তুলে বসেন। তাই দেখে শ্রমিকরা হন আনন্দে আত্মহারা। ঘরে বসে টেলিভিশন সেটের সামনেই দিয়ে ওঠেন শ্লোগান। তারপর এক সময় ক্লান্ত দেহ সমর্পিত হয় শতচ্ছিন্ন বিছানায়। তলিয়ে যান ঘুমের রাজ্যে। পরদিন কাক ডাকা ভোরে উঠতে হবে। সকাল আটটার আগে যোগ দিতে হবে কাজে। বাধ্যতামূলক ওভারটাইম শেষে ফিরতে হবে রাত দশটায়।
কর্মব্যস্ত এই শ্রমিকের পরদিন আর মনেই থাকেনা গত দিনে দেয়া শ্লোগানের কথাগুলো। কেউ কেউ সাময়িক অবসরে প্রসঙ্গ টেনে এনে বয়োজ্যেষ্ঠের মতামত শুনতে চান। সারা জীবনের বঞ্চনার অভিজ্ঞতায় সেই পুরাতনের কণ্ঠে তখন ঝরে শ্লেষ-এ সবই নাটক। কেউ শ্রমিক খাটায়, কেউ শ্রমিক বিক্রি করে, আর কেউ শ্রমিকের দোহাই দিয়ে ফায়দা লোটে।
আজ থেকে ১২৫ বছর আগের আমেরিকার স্থানে আজো পৌছুতে পারেনি এ জাতি, বিশেষকরে মানসিক দিক বিচারে। এখনো আমরা প্রাগৈতিহাসিক মানসিকতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। বিংশ শতাব্দীর ছোঁয়ায় যা খোলসে লুকিয়ে রয় মাত্র।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা যে তিন শ্রেণির শ্রমিকের রক্তে ঘামে সচল থাকে তা হল- কৃষক, প্রবাসী আর গার্মেন্টস। কেমন আছেন তারা?
কৃষক পায় না উৎপাদন মূল্য। মধ্যসত্ত্ব ভোগীদের অবস্থা রমরমা।
প্রবাসী পারে না বৈধ সময়ের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার খরচ উঠাতে দালাল আর এজেন্সিগুলো বানায় টাকার পাহার।
আর গার্মেন্টস? এর তো মা-বাপই নেই। মালিকরা বড় বড় কথা বলেন। শ্রমিক পায় না ঠিক মত বেতন। মালিকদের কষ্টের কথা শুনে শ্রমিক পারে তো স্বেচ্ছাশ্রমই দিয়ে দেয়। কি করে যে তারা রাতারাতি শত কোটি টাকার মালিক বনে যান তা আল্লাহ মালুম। আবার একটা দুর্ঘটনা ঘটলে তখন এই মালিকরা হয়ে যান অবৈধ সন্তান এদের দায় আর কেউই নিতে চান না। তবু তো কৃষকদের-প্রবাসীদের জন্য একটি করে মন্ত্রণালয় রয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য সরকার সে প্রয়োজনটুকুও অনুভব করে না। তারা হয়ত ভাবেন, “নাইয়ার এক নাও নিনাইয়ার শতেক নাও”। মন্ত্রণালয় নেই বলেই তারা বাণিজ্য-শ্রম-শিল্প-অর্থ সবার নিয়ন্ত্রণে আবার কারোরই নিয়ন্ত্রণে নয়। এই শ্রমিকদের জন্য যারা যেটুকু করেন তা পড়শির মত। দায় থেকে নয়, দয়া থেকে।
মোট রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় অংশটি যে খাত থেকে আসে সে খাতের নেই কোন নির্দিষ্ট শিল্প এরিয়া। যে যার মত স্ব উদ্যোগে যেখানে ইচ্ছে বহুতল ভবনের ফ্লোর ভাড়া করে ১০ লাইন ২০ লাইনের গার্মেন্টস কারখানা চালু করে দিচ্ছে। যারা বড় আকারের বিনিয়োগকারী তারা কারখানা ভবন বানাচ্ছেন না। বানাচ্ছেন এক একটি মৃত্যুকূপ; এক একটি টর্চার সেল। গার্মেন্টস শ্রমিকদের পক্ষ হয়ে কথা বলবে কে? বিজিএমইএ মালিকদের সংগঠন। সব সরকার সর্বদাই এলিটদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চলে তা ছাড়া প্রতিটি সরকারে মালিকদের প্রতিনিধিও থাকে। বাকি থাকে শ্রমিক সংগঠন। তারাও বহুধা বিভক্ত। এ দেশের শ্রমিক নেতারা কবে কখনই বা শ্রমিকদের হয়ে কাজ করেছে। তারা শ্রমিকদের কথা বলে নিজেদের জন্য। শ্রমিকদের স্বার্থে নয়। দু’একজন যারা সত্যিই শ্রমিকদের হয়ে কাজ করে তারা আমিনুল হয়ে হারিয়ে যায়।
মে দিবস তাই আমাদের দেশে শ্রমিকদের জন্য প্রহসন ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনে না। মে দিবস মনে করিয়ে দেয়া হয় শ্রমিকদের ত্যাগের কথা। তাদের শ্রমের উপরই টিকে আছে বর্তমান সভ্যতা। শুধু মালিকদের মনে করিয়ে দিতে ব্যর্থ হয় শ্রমিকদের প্রাপ্য নিশ্চিত করার কথা। মে দিবস এলেই শ্রমিক শ্রেণীর রক্তঝরা সংগ্রাম আর শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, সভা-সেমিনার, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং রাজ পথের মিছিল-শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সারা দেশ। নিউইয়র্ক-ব্রাসেলসের আধুনিক প্রলেতারিয়েতদের বর্ণাঢ্য র্যারলির পাশাপাশি বাংলাদেশের আধুনিক শ্রমিক নামের ‘শ্রম দাস’রাও গতানুগতিক শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে রাজপথ। পার্থক্য হল আক্ষরিক অর্থেই তারা পরিবর্তনের সূচনা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা রত আর আমাদের কাছে এটা একটি লক্ষ হীন উপলক্ষ মাত্র। পালন করতে হয় বলেই করা।
আজো বাংলাদেশের সাধারণ শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা মজুরি পায় তা দিয়ে এই দুর্মূল্যের বাজারে তিন বেলা খাবার জোটানোই দায়। এদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা ত দুরের কথা ১৪ ঘণ্টা শ্রম দিয়েও যা বেতন পায় তা দৈনিক হিসেবে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। এই অপর্যাপ্ত কখনো কখনো অনিয়মিত মজুরি তাদের কাছে উনিশ শতকের মে দিবসের বিজয়কে আজ একুশ শতকে এসেও হাস্যকর বলে মনে হয়। আর তাই আমাদের “দুনিয়ার মজদুর এক হও” শ্লোগানটি পরিবর্তন করে বলতে হয় “বাংলাদেশের মজদুর এক হও”।
আমরা সকলের মাঝে থেকেও থাকি সকলের থেকে আলাদা হয়ে।
এ দেশে সরকার এলিট শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে চলে,
রাজনিতিবিদগন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেন,
ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্য ব্যবসা করেন,
নেতারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
ফলে শ্রমজীবী মানুষ এদেশে এখনো শ্রম দাস হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে। আজ সময় এসেছে সোচ্চার হওয়ার। আজ এই মে দিবসে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের দাবী-
• শ্রমিকের শ্রমের যথাযথ মূল্য দিতে হবে।
• শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে
• কৃষি উপকরণকে সহজলভ্য করতে হবে।
• মধ্যস্বত্ব ভোগিদের দৌরাত্বকমাতে হবে।
• ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এই যে ভাল অবস্থা, তার একটা বড় কারণ প্রতি মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো মোটা অংকের রেমিটেন্স। অর্থমন্ত্রীর কপালের ভাজ মোচনের মহান দায়িত্বটি যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাদের ভাল মন্দের খোজ টুকু পর্যন্ত আমাদের সরকার রাখে না। এই শ্রমিকদের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সরকারের দায়িত্ববোধ ও সদিচ্ছা। আমাদের দেশে অনেক ছোট ছোট রিক্রুটিং এজেন্সি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যারা বিদেশে জনশক্তি রফতানি করে। কিন্তু তাদের রেকর্ড নেই। ন্যূনতম মানদণ্ডের বালাই নেই। এ অবস্থায় প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ রাখা জরুরী।
• শ্রমিকদের ভাষা শিক্ষা নিশ্চিত করা।
• দালালদের দৌরাত্ব বন্ধ করা ।
• অদক্ষ মহিলা শ্রমিক প্রেরণ না করা।
• মহিলা শ্রমিকদের বয়স সীমা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ নির্ধারণ করা।
• শ্রমিক প্রেরণের পূর্বেই আগ্রহী দেশগুলোর সাথে যথাযথ চুক্তি স্বাক্ষর করে সে দেশের সরকারের দায়িত্বে এই শ্রমিকদের পাঠান উচিৎ। সে চুক্তির আওতায় নির্ধারিত থাকবে ন্যুনতম বেতন কাঠামো সাপ্তাহিক ছুটি, থাকবে চিকিৎসা বীমা। এছাড়া নিয়োগ কর্তা/ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রশিক্ষণ এবং যাওয়ার খরচের বিষয়টিরও সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।
• অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত নারী শ্রমিকদের বেলায়; স্বামী ছাড়া একা কোন নারী শ্রমিক বিদেশে যেতে পারবেনা এ ধরনের একটি বাধ্যবাধকতা আরোপ করলে একদিকে যেমন একই সাথে দুজনের কর্মসংস্থান হয়। তেমনি নারী শ্রমিকটির নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়। আর এটা জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাবও ফেলবে না কেননা জনশক্তি আমদানি কারক দেশগুলো নারী শ্রমিক এর পাশাপাশি হাউজ ড্রাইভার, কেয়ারটেকার, মালী হিসেবে পুরুষ শ্রমিকও নিতে চায়। প্রয়োজন সমন্বয় সাধন। সরকারের উচিৎ পূর্নাঙ্গ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে প্রত্যেক শ্রমিকের এই কেন্দ্র হতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা।
• সর্বোপরি বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকদের যতটা সম্ভব সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিদেশে পাঠানো উচিত। যেমনটি মালয়েশিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড সহ বেশ কয়েকটি দেশের সাথে করা হচ্ছে। যাতে অল্প খরচে শ্রমিকরা কোন প্রতারণার স্বীকার না হয়েই বিদেশে যেতে পারে।
দেশে পোশাক শিল্প কারখানা গুলিতে চলছে এক ধরনের দাসপ্রথা। যেখানে নিয়ত দাসত্বের অমানবিক চিত্রটি শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপনের অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তথাপিও মাঝেমাঝেই তার শরীর থেকে এই মেকি আবরণটুকু খসে পরে। তখন আমাদের চোখে কিছুক্ষণের জন্য বড় বেশি অমানবিক হয়ে তা ধরা পড়ে। তখন কর্তাব্যক্তিদের হাহুতাস সাধারণ মানুষের কষ্টের সাথে একাত্ম হতে চাওয়া কিংবা অর্থ দিয়ে মানুষ হত্যার দায় মেটানোকে মোটেই মানবিক মনে হয় না। বরং এটাকে এক ধরনের প্রহসন বলেই মনে হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষনে নিন্মোক্ত দাবিগুলো পূরন করা জরুরি-
• মেগা সিটির বাইরে গার্মেন্টস ভিলেজ তৈরি করে সকল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিকে সেখানে স্থানান্তর করতে হবে।
• কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তিন তলার উপরে করা যাবে না।
• গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ভবনগুলি ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের আওতায় এনে একটি জাতীয় কমপ্লায়েন্ট কমিশন গঠন করা। যতদিন না এই কমিশন গঠিত হয়। ততদিন এসজিএস বা অনুরূপ স্বীকৃত বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ছাড়পত্র গ্রহণ প্রতিটি শিল্পকারখানার জন্য বাধ্যতামূলক করা।
• প্রতিটি শিল্পকারখানায় ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কিছু সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক কর্মীর সার্বক্ষণিক দায়িত্বপালন নিশ্চিত করা।
• প্রতিটি ফ্লোরে একাধিক বড় জানালা লোহার গ্রিল না দিয়ে শুধুমাত্র গ্লাস দিয়ে তৈরি করা। যাতে তা ভেঙ্গে সহজেই বেড়িয়ে আসা যায়।
• ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রতি মাসে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া নিশ্চিত করা।
• প্রতিটি শিল্পকারখানার উপরের অংশ (সাদ) সার্বক্ষনিকভাবে ব্যাবহার উপযোগী রাখা।
• প্রতিটি কারখানা থেকে এর গোডাউন নিরাপদ দূরত্বে প্রতিস্থাপন।
• পর্যাপ্ত ফায়ার ডিস্টিংগুসার, বালতি, বালি ও জলের ব্যবস্থা।
• শ্রমিকদের তালাবন্ধ করে না রাখা।
• এলার্ম ব্যবস্থা জোরদার।
• কারখানায় শ্রমিক কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাবি জানাব প্রতিটি শ্রমিক কর্মচারীকে জীবন বীমার আওতায় আনার।
শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা নিশ্চিত হলে শিল্প রক্ষা পাবে। সেইসাথে এগিয়ে যাবে দেশ। তবে, সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা অপমৃত্যু ঘটাতে পারে অপার সম্ভাবনাময় এক একটি খাতের। যার বিরূপ প্রভাব শুধু অর্থনীতিতেই পড়বে না। ডেকে আনবে ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়ও
[email protected]১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মত আমরাও পালন করি মে দিবস। আমরাও প্লাকার্ড ফেস্টুন হাতে মিছিল করি। দাবী তুলি শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। টেলিভিশনের টক শো’তে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনার ডাক পরে শ্রমিক নেতাদের। কখনো কখনো বিবর্ণ চেহারার শ্রমিকের। তারা বর্তে যান। চাই কি মাঝে মাঝে তর্কও জুরে দেন সহ আলোচকদের সাথে। অভ্যাসবশত কখনো কখনো শ্রমিকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দু’একটি দাবীও তুলে বসেন। তাই দেখে শ্রমিকরা হন আনন্দে আত্মহারা। ঘরে বসে টেলিভিশন সেটের সামনেই দিয়ে ওঠেন শ্লোগান। তারপর এক সময় ক্লান্ত দেহ সমর্পিত হয় শতচ্ছিন্ন বিছানায়। তলিয়ে যান ঘুমের রাজ্যে। পরদিন কাক ডাকা ভোরে উঠতে হবে। সকাল আটটার আগে যোগ দিতে হবে কাজে। বাধ্যতামূলক ওভারটাইম শেষে ফিরতে হবে রাত দশটায়।
কর্মব্যস্ত এই শ্রমিকের পরদিন আর মনেই থাকেনা গত দিনে দেয়া শ্লোগানের কথাগুলো। কেউ কেউ সাময়িক অবসরে প্রসঙ্গ টেনে এনে বয়োজ্যেষ্ঠের মতামত শুনতে চান। সারা জীবনের বঞ্চনার অভিজ্ঞতায় সেই পুরাতনের কণ্ঠে তখন ঝরে শ্লেষ-এ সবই নাটক। কেউ শ্রমিক খাটায়, কেউ শ্রমিক বিক্রি করে, আর কেউ শ্রমিকের দোহাই দিয়ে ফায়দা লোটে।
আজ থেকে ১২৫ বছর আগের আমেরিকার স্থানে আজো পৌছুতে পারেনি এ জাতি, বিশেষকরে মানসিক দিক বিচারে। এখনো আমরা প্রাগৈতিহাসিক মানসিকতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। বিংশ শতাব্দীর ছোঁয়ায় যা খোলসে লুকিয়ে রয় মাত্র।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা যে তিন শ্রেণির শ্রমিকের রক্তে ঘামে সচল থাকে তা হল- কৃষক, প্রবাসী আর গার্মেন্টস। কেমন আছেন তারা?
কৃষক পায় না উৎপাদন মূল্য। মধ্যসত্ত্ব ভোগীদের অবস্থা রমরমা।
প্রবাসী পারে না বৈধ সময়ের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার খরচ উঠাতে দালাল আর এজেন্সিগুলো বানায় টাকার পাহার।
আর গার্মেন্টস? এর তো মা-বাপই নেই। মালিকরা বড় বড় কথা বলেন। শ্রমিক পায় না ঠিক মত বেতন। মালিকদের কষ্টের কথা শুনে শ্রমিক পারে তো স্বেচ্ছাশ্রমই দিয়ে দেয়। কি করে যে তারা রাতারাতি শত কোটি টাকার মালিক বনে যান তা আল্লাহ মালুম। আবার একটা দুর্ঘটনা ঘটলে তখন এই মালিকরা হয়ে যান অবৈধ সন্তান এদের দায় আর কেউই নিতে চান না। তবু তো কৃষকদের-প্রবাসীদের জন্য একটি করে মন্ত্রণালয় রয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য সরকার সে প্রয়োজনটুকুও অনুভব করে না। তারা হয়ত ভাবেন, “নাইয়ার এক নাও নিনাইয়ার শতেক নাও”। মন্ত্রণালয় নেই বলেই তারা বাণিজ্য-শ্রম-শিল্প-অর্থ সবার নিয়ন্ত্রণে আবার কারোরই নিয়ন্ত্রণে নয়। এই শ্রমিকদের জন্য যারা যেটুকু করেন তা পড়শির মত। দায় থেকে নয়, দয়া থেকে।
মোট রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় অংশটি যে খাত থেকে আসে সে খাতের নেই কোন নির্দিষ্ট শিল্প এরিয়া। যে যার মত স্ব উদ্যোগে যেখানে ইচ্ছে বহুতল ভবনের ফ্লোর ভাড়া করে ১০ লাইন ২০ লাইনের গার্মেন্টস কারখানা চালু করে দিচ্ছে। যারা বড় আকারের বিনিয়োগকারী তারা কারখানা ভবন বানাচ্ছেন না। বানাচ্ছেন এক একটি মৃত্যুকূপ; এক একটি টর্চার সেল। গার্মেন্টস শ্রমিকদের পক্ষ হয়ে কথা বলবে কে? বিজিএমইএ মালিকদের সংগঠন। সব সরকার সর্বদাই এলিটদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চলে তা ছাড়া প্রতিটি সরকারে মালিকদের প্রতিনিধিও থাকে। বাকি থাকে শ্রমিক সংগঠন। তারাও বহুধা বিভক্ত। এ দেশের শ্রমিক নেতারা কবে কখনই বা শ্রমিকদের হয়ে কাজ করেছে। তারা শ্রমিকদের কথা বলে নিজেদের জন্য। শ্রমিকদের স্বার্থে নয়। দু’একজন যারা সত্যিই শ্রমিকদের হয়ে কাজ করে তারা আমিনুল হয়ে হারিয়ে যায়।
মে দিবস তাই আমাদের দেশে শ্রমিকদের জন্য প্রহসন ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনে না। মে দিবস মনে করিয়ে দেয়া হয় শ্রমিকদের ত্যাগের কথা। তাদের শ্রমের উপরই টিকে আছে বর্তমান সভ্যতা। শুধু মালিকদের মনে করিয়ে দিতে ব্যর্থ হয় শ্রমিকদের প্রাপ্য নিশ্চিত করার কথা। মে দিবস এলেই শ্রমিক শ্রেণীর রক্তঝরা সংগ্রাম আর শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, সভা-সেমিনার, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং রাজ পথের মিছিল-শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সারা দেশ। নিউইয়র্ক-ব্রাসেলসের আধুনিক প্রলেতারিয়েতদের বর্ণাঢ্য র্যারলির পাশাপাশি বাংলাদেশের আধুনিক শ্রমিক নামের ‘শ্রম দাস’রাও গতানুগতিক শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে রাজপথ। পার্থক্য হল আক্ষরিক অর্থেই তারা পরিবর্তনের সূচনা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা রত আর আমাদের কাছে এটা একটি লক্ষ হীন উপলক্ষ মাত্র। পালন করতে হয় বলেই করা।
আজো বাংলাদেশের সাধারণ শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা মজুরি পায় তা দিয়ে এই দুর্মূল্যের বাজারে তিন বেলা খাবার জোটানোই দায়। এদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা ত দুরের কথা ১৪ ঘণ্টা শ্রম দিয়েও যা বেতন পায় তা দৈনিক হিসেবে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। এই অপর্যাপ্ত কখনো কখনো অনিয়মিত মজুরি তাদের কাছে উনিশ শতকের মে দিবসের বিজয়কে আজ একুশ শতকে এসেও হাস্যকর বলে মনে হয়। আর তাই আমাদের “দুনিয়ার মজদুর এক হও” শ্লোগানটি পরিবর্তন করে বলতে হয় “বাংলাদেশের মজদুর এক হও”।
আমরা সকলের মাঝে থেকেও থাকি সকলের থেকে আলাদা হয়ে।
এ দেশে সরকার এলিট শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে চলে,
রাজনিতিবিদগন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেন,
ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্য ব্যবসা করেন,
নেতারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
ফলে শ্রমজীবী মানুষ এদেশে এখনো শ্রম দাস হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে। আজ সময় এসেছে সোচ্চার হওয়ার। আজ এই মে দিবসে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের দাবী-
• শ্রমিকের শ্রমের যথাযথ মূল্য দিতে হবে।
• শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে
• কৃষি উপকরণকে সহজলভ্য করতে হবে।
• মধ্যস্বত্ব ভোগিদের দৌরাত্বকমাতে হবে।
• ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এই যে ভাল অবস্থা, তার একটা বড় কারণ প্রতি মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো মোটা অংকের রেমিটেন্স। অর্থমন্ত্রীর কপালের ভাজ মোচনের মহান দায়িত্বটি যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাদের ভাল মন্দের খোজ টুকু পর্যন্ত আমাদের সরকার রাখে না। এই শ্রমিকদের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সরকারের দায়িত্ববোধ ও সদিচ্ছা। আমাদের দেশে অনেক ছোট ছোট রিক্রুটিং এজেন্সি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যারা বিদেশে জনশক্তি রফতানি করে। কিন্তু তাদের রেকর্ড নেই। ন্যূনতম মানদণ্ডের বালাই নেই। এ অবস্থায় প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ রাখা জরুরী।
• শ্রমিকদের ভাষা শিক্ষা নিশ্চিত করা।
• দালালদের দৌরাত্ব বন্ধ করা ।
• অদক্ষ মহিলা শ্রমিক প্রেরণ না করা।
• মহিলা শ্রমিকদের বয়স সীমা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ নির্ধারণ করা।
• শ্রমিক প্রেরণের পূর্বেই আগ্রহী দেশগুলোর সাথে যথাযথ চুক্তি স্বাক্ষর করে সে দেশের সরকারের দায়িত্বে এই শ্রমিকদের পাঠান উচিৎ। সে চুক্তির আওতায় নির্ধারিত থাকবে ন্যুনতম বেতন কাঠামো সাপ্তাহিক ছুটি, থাকবে চিকিৎসা বীমা। এছাড়া নিয়োগ কর্তা/ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রশিক্ষণ এবং যাওয়ার খরচের বিষয়টিরও সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।
• অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত নারী শ্রমিকদের বেলায়; স্বামী ছাড়া একা কোন নারী শ্রমিক বিদেশে যেতে পারবেনা এ ধরনের একটি বাধ্যবাধকতা আরোপ করলে একদিকে যেমন একই সাথে দুজনের কর্মসংস্থান হয়। তেমনি নারী শ্রমিকটির নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়। আর এটা জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাবও ফেলবে না কেননা জনশক্তি আমদানি কারক দেশগুলো নারী শ্রমিক এর পাশাপাশি হাউজ ড্রাইভার, কেয়ারটেকার, মালী হিসেবে পুরুষ শ্রমিকও নিতে চায়। প্রয়োজন সমন্বয় সাধন। সরকারের উচিৎ পূর্নাঙ্গ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে প্রত্যেক শ্রমিকের এই কেন্দ্র হতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা।
• সর্বোপরি বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকদের যতটা সম্ভব সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিদেশে পাঠানো উচিত। যেমনটি মালয়েশিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড সহ বেশ কয়েকটি দেশের সাথে করা হচ্ছে। যাতে অল্প খরচে শ্রমিকরা কোন প্রতারণার স্বীকার না হয়েই বিদেশে যেতে পারে।
দেশে পোশাক শিল্প কারখানা গুলিতে চলছে এক ধরনের দাসপ্রথা। যেখানে নিয়ত দাসত্বের অমানবিক চিত্রটি শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপনের অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তথাপিও মাঝেমাঝেই তার শরীর থেকে এই মেকি আবরণটুকু খসে পরে। তখন আমাদের চোখে কিছুক্ষণের জন্য বড় বেশি অমানবিক হয়ে তা ধরা পড়ে। তখন কর্তাব্যক্তিদের হাহুতাস সাধারণ মানুষের কষ্টের সাথে একাত্ম হতে চাওয়া কিংবা অর্থ দিয়ে মানুষ হত্যার দায় মেটানোকে মোটেই মানবিক মনে হয় না। বরং এটাকে এক ধরনের প্রহসন বলেই মনে হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষনে নিন্মোক্ত দাবিগুলো পূরন করা জরুরি-
• মেগা সিটির বাইরে গার্মেন্টস ভিলেজ তৈরি করে সকল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিকে সেখানে স্থানান্তর করতে হবে।
• কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তিন তলার উপরে করা যাবে না।
• গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ভবনগুলি ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের আওতায় এনে একটি জাতীয় কমপ্লায়েন্ট কমিশন গঠন করা। যতদিন না এই কমিশন গঠিত হয়। ততদিন এসজিএস বা অনুরূপ স্বীকৃত বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ছাড়পত্র গ্রহণ প্রতিটি শিল্পকারখানার জন্য বাধ্যতামূলক করা।
• প্রতিটি শিল্পকারখানায় ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কিছু সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক কর্মীর সার্বক্ষণিক দায়িত্বপালন নিশ্চিত করা।
• প্রতিটি ফ্লোরে একাধিক বড় জানালা লোহার গ্রিল না দিয়ে শুধুমাত্র গ্লাস দিয়ে তৈরি করা। যাতে তা ভেঙ্গে সহজেই বেড়িয়ে আসা যায়।
• ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রতি মাসে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া নিশ্চিত করা।
• প্রতিটি শিল্পকারখানার উপরের অংশ (সাদ) সার্বক্ষনিকভাবে ব্যাবহার উপযোগী রাখা।
• প্রতিটি কারখানা থেকে এর গোডাউন নিরাপদ দূরত্বে প্রতিস্থাপন।
• পর্যাপ্ত ফায়ার ডিস্টিংগুসার, বালতি, বালি ও জলের ব্যবস্থা।
• শ্রমিকদের তালাবন্ধ করে না রাখা।
• এলার্ম ব্যবস্থা জোরদার।
• কারখানায় শ্রমিক কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাবি জানাব প্রতিটি শ্রমিক কর্মচারীকে জীবন বীমার আওতায় আনার।
শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা নিশ্চিত হলে শিল্প রক্ষা পাবে। সেইসাথে এগিয়ে যাবে দেশ। তবে, সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা অপমৃত্যু ঘটাতে পারে অপার সম্ভাবনাময় এক একটি খাতের। যার বিরূপ প্রভাব শুধু অর্থনীতিতেই পড়বে না। ডেকে আনবে ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়ও
[email protected]
©somewhere in net ltd.