নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মানুষের কথা বলি। মানবতার কথা বলি। স্বপ্ন দেখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। নিরাপদ একটি ভূখন্ডের।
বরাবরই আমি পড়ালেখায় ভীষণ অমনোযোগী ছিলাম। যত উপরের ক্লাসে উঠেছি অমনোযোগিতার মাত্রা কেবলই বেড়েছে। তার প্রধান কারণ ছিল গল্পের বইয়ের নেশা। পাঠ্য বইয়ের মলাট খুলে গল্পের বইয়ে লাগাতাম। তারপর রাত ভর পরতাম। এমন ও হয়েছে বিদ্যুৎ চলে গেছে, মোমের আলোয় পরতে পরতে ঘুমিয়ে পরেছি। চুল পুরে গেছে সে আগুনে। এমনই নেশা ছিল। ফলাফল যা হবার তাই। টেনে টুনে পাশ।
এর মধ্যে আবার অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা। বইয়ের নেশায় তা আর কখনই পাকতে পারল না। শেষ পর্যন্ত এসএসসি টেস্ট পরীক্ষার খাতা দেখে শাহ আলম স্যার বললেন তুই তো অংকে ফেল করবি। আমার বাসায় আশিস, আমি দেখিয়ে দেব। তখন পরীক্ষার মাস কয়েক বাকি। আম্মার পিড়াপীড়িতে স্যারের কাছে গেলাম। স্যার কি যত্নে করে শেখালেন! শুধু অংক না, স্যার সবগুলো বিষয়ের খোঁজ নিতেন।
কোনদিন কোণ ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি কত টাকা দিতে হবে। এমনকি কোনদিন কোণ ছাত্র তার হাতে টাকাও দিতে পারে নি। আমরা ব্যাচের সবাই টাকা এক জায়গায় করে ভাবির কাছে অথবা তার ছোট্ট ছেলেটার হাতে দিয়ে দৌড়ে পালাতাম। স্যার জানতেও পারতেন না কে কত দিল। তার সে আগ্রহও ছিল না।
অদ্ভুত একজন মানুষ, আমরা অবাক হয়ে দেখতাম অনেক বড় ভাইয়ারা হঠাত হঠাত স্যারের সাথে দেখা করতে আসতেন, স্যার ভারী গলায় এক একজনকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব নামে ডাকতেন তারা ভীষণ খুশি হত। স্যার জানতে চাইতেন,
এখানে কি?
স্যার কিছু না, এই গাধার দল কিছু না হলে ওদের পড়ার ডিস্টার্ব করছিস ক্যান? এক লাথি খাবি।
শুনে ভাইয়ারা আমোদে আহ্লাদিত হতেন, কেউ কেউ এগিয়ে এসে বলতেন, স্যার একটা লাথি দিবেন! এমনভাবে বলতেন যেন স্যারের লাত্থি বহু আকাঙ্ক্ষিত কিছু।
স্যার হাতের লাঠিটা নিয়ে তাড়া করতেন। আর ভাইয়ারা সব দৌড়ে পালাত। ফিরে আসতেন ঠোটের কোনে এক অপার্থিব হাসি ছড়িয়ে। স্যারের সেই হাসিমুখটা চোখ বুঝলে এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই।
স্যার থাকতেন স্কুল হোস্টেলের নিচতলায়। খুব সাধারণ জীবন যাপন ছিল এই অসাধারণ মানুষটির। গোলাপ খুব ভালবাসতেন, নিজ হাতে জানালার পাশে লাগিয়েছিলেন একটা গোলাপ চাড়া। একদিন স্যারের কাছে পড়তে গিয়ে দেখি বিশাল এক গোলাপ ফুটেছে। পড়া শেষে মাথায় ভূত চাপল ফুলটি চুরি করব। চুরিও করলাম কিন্তু পালাতে গিয়ে পরে গেলাম, হাতে ভীষণ চোট পেলাম।
আব্বু হাসপাতালে নিয়ে গেলেন ডাক্তার তার বন্ধু মানুষ, দেখে জানতে চাইলেন ওর না পরীক্ষা?
হ্যাঁ।
তাহলে?
কি তাহলে?
হাতে তো ফ্র্যাকচার হয়েছে, ব্যান্ডেজ করতে হবে।
কি বল? পনের দিন পর ওর পরীক্ষা।
কিচ্ছু করার নেই, আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি, পরীক্ষার আগে একবার দেখিয়ে যেও। আল্লাহ ভরসা।
পরের দিন হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে স্যারের কাছে গেলাম।
এই হারামি তোর হাতে কি হয়েছে?
স্যার পরে গিয়েছিলাম (কেঁদেই ফেললাম)
আয় আমার কাছে বলে কাছে টেনে নিলেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত কণ্ঠে বললেন, ফুল ছিঁড়েছিস ঠিক আছে দৌড়ে পালাতে গেলি ক্যান?
আমি তখন লজ্জায়, দুঃখে মরে যাই অবস্থা। পিঠে সন্তান স্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ভয় নেই কিচ্ছু হবে না, মন দিয়ে লেখাপড়া কর। নদীর ঘাটে (নামটা মনে নেই) বাক্সে একশ টাকা দিস।
স্যার কি বলব?
গাধা তোর কিছু বলতে হবে না।
অদ্ভুত বিষয়, পরীক্ষার তখনও পাঁচ দিন বাকি। আমার পীড়াপীড়িতে আব্বু ডাক্তার আংকেলকে দিয়ে জোর করে ব্যান্ডেজ খোলালেন।
আব্বু এবং ডাক্তার সাহেব যার পর নাই অবাক হলেন, আমার হাত সম্পূর্ণ ঠিক।
এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলাম, আমি প্রথম বিভাগ পেলাম।
মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যেটা ব্যাখ্যাতীত। কিন্তু শাহ্ আলম স্যার ব্যখ্যাতীত নন। একজন মহান মানুষ। স্যারকে শ্রদ্ধা করতাম, আজো করি।
কিছুদিন আগে বাড়িতে গিয়ে স্যারের সাথে দেখা হল। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। আশ্চর্য স্যার লজ্জা পেলেন। কেন লজ্জা পেলেন? এখনকার সময়ে কি এটা ব্যকডেটেড? হবে হয়ত কিন্তু স্যার যে শ্রদ্ধা যে ভালবাসা তার ছাত্রদের কাছ থেকে পেয়েছেন সে অর্জনটা তো তারই।
ঝালকাঠি সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের আমি ছাত্র, তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম এর মধ্যে কতজন স্যারের কাছে পরেছি এখনো বেশ কজনের কথা মনে পরে। দু একজনের সাথে দু একবার দেখাও হয়েছে। সালাম জানিয়েছি কুশল বিনিময় করেছি। কিন্তু শাহ্ আলম স্যারের মত আর কোণ স্যার অন্তরের অন্তঃস্থলে এতটা গভীর করে আসন পেতে বসতে পারেন নি।
স্যার আপনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন।
[email protected]
©somewhere in net ltd.