![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভবিষ্যত প্রজন্ম অনেক কিছুর জন্য অতীত প্রজন্মকে (বর্তমানে যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ও বাস্তবায়ন করছেন) তিরস্কার করবে, অভিশাপ দিবে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে জলাশয় ভরাট।
পৃথিবীতে এমনিতেই সুপেয় মিঠা পানির হাহাকার (০.৭৬%); অপরিকল্পিতভাবে বসতিস্থাপন, শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের জন্য মানুষ একই সাথে নিজের খাদ্য ও পানির ভবিষ্যতকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে। আবাদি জমির সংখ্যা কমে গেলে, উদ্ভিদ ও শস্যের আবাসস্থল যদি মানুষের আবাসস্থলে পরিণত হয়, তবে সেই আবাসে বসে ভবিষ্যতের মানুষ কি ওয়াইফাই ইন্টারনেট আর ক্যাবল টিভি খাবে?
আমার এই লেখাটা লেখার ইচ্ছে অনেক দিনের। সময়ের কারণে হয়ে উঠে নি। আজকে একটু আগে ফেসবুকে অনলাইন কেনাবেচার এক গ্রুপে দেখলাম চট্টগ্রামের মোহরা এলাকার ১১ গন্ডা একটি পুকুরের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এটি দেখেই লিখতে বসে গেলাম। উল্লেখ্য যে, মোহরা চট্টগ্রাম মূল শহরের বাইরে, শহরতলিতে। শহরে হাতে গোনা কয়েকটি জলাশয় আছে, যেগুলো মৃতপ্রায়, যেকোন দিন ভরাট হয়ে যাবে। মানুষের চোখ এখন শহরতলি ও গ্রামের দিকে। গ্রামের খাদ্যশস্যের ভূমিগুলো ভাগ-বাটোয়ারার সময় পুকুর-দীঘির মত পানির আধারগুলোও ভাগ-বন্টন হচ্ছে; অর্থের বিনিময়ে হাত বদল হচ্ছে। যে হাতেই থাকুক না কেন, এই জলাশয়গুলোর ভবিষ্যত মাটি, বালি ও আবর্জনা দিয়ে মৃত্যুবরণ করা, যেটা পরোক্ষভাবে মানবজাতিরই মৃত্যুর কারণ হবে নিকট-ভবিষ্যতে।
বেশ কিছুদিন আগে রাঙ্গুনীয়ায় এক বন্ধুর ভাই-এর বিয়েতে গিয়েছিলাম। এই আশা করে গিয়েছিলাম, দূষিত শহর থেকে পবিত্র-বিশুদ্ধ গ্রামে যাচ্ছি। প্রাণ খুলে বিশুদ্ধ বাতাস নিব, মন জুড়িয়ে নীল-সবুজ দেখব। কিন্তু, এ কি দেখে আসলাম। শহর থেকে এত্ত দূরে এসেও শান্তি নেই। গ্রামের অশিক্ষিত মানুষেরা যেন শহরের অশিক্ষিতদের সাথে পাল্লা দিয়ে হত্যাযজ্ঞে মেতেছে। কোন প্রসঙ্গে গর্ব করে তারা বলে, "আমাদের গ্রাম এখন শহরের মতই!" এই কথা বলতে তারা কি বুঝাতে চায়, জানি না। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই শহরের মত যেখানে সেখানে আবর্জনার ভাগাড়, বাসাবাড়ীর ফাঁকে ফাঁকে ডোবাভর্তি দূষিত শিল্পকারপখানার আবর্জনা, পুকুর ভরাট করে মার্কেট-বাজার আর রাজনৈতিক দলের অফিস-আড্ডাখানা, ইত্যাদি দেখে তাদের কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। খুব আশ্চর্য হলাম, সেই বন্ধুর বাড়ীর দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোন পুকুর না দেখে। কোনটা ভরাট হয়ে গিয়েছে, কোনটা ভরাট হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসা-চাকরীর টাকা দিয়ে একে একে আবাদী জমি ও পুকুর কিনে সেগুলোকে বসতভিটায় পরিণত করা হচ্ছে। হয়তো বা তারা, এই সবুজ-শ্যামল দেশে এসে সুদুর মধ্যপ্রাচ্যের নিষ্প্রাণ মরুভূমিকে খুব "মিস" করে!
খাল-নদী-পুকুর ভরাটের কারণে এখন শুধু মেগাসিটিগুলোতে না, এমনকি ছোটখাট শহর ও গ্রামগুলোতে স্বল্পবর্ষণেই জলাবদ্ধতা ও বন্যা হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে অশিক্ষিত মানুষ এই ভেবে আশ্বস্ত হচ্ছে যে, ভূ-গর্ভস্থ পানি পানির যোগান দিয়ে যাবে। কিন্তু ভূ-অভ্যন্তরস্থ অন্যান্য সব প্রাকৃতিক সম্পদের (কয়লা, তেল, গ্যাস, ইত্যাদি) মত গভীর নলকূপের পানির-ও একটা "সমাপ্তি বিন্দু" আছে।
তাছাড়া, ভূ-গর্ভস্থ পানি আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহারের পরেও "রিফিল"-এর একটা সুযোগ আগে ছিল। কিন্তু এখন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে জলাশয়গুলো ভরাটের কারণে মাটির নিচে বৃষ্টির পানি যেতে পারছে না। এতে একই সাথে জলজটের মত ভোগান্তি হচ্ছে, এবং মাটির নিচে পানি প্রবেশে ব্যাহত হওয়ার কারণে পানির স্তর ধীরে ধীরে কমছে। এই কারণেই এখনকার নলকূপগুলো আগের চেয়েও গভীরে খুঁড়তে হচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় সেসব নলকূপের হাতল ঘুরালে প্রাকৃতিক গ্যাসের লেলিহান শিখা বের হচ্ছে!
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে ঘন ঘন মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে এটা ধারণা করা হচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্পে দেশের শহরগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এই ক্ষতি খুব বেশি হত না, যদি মাটি একটি নির্দিষ্ট মাত্রার শক্তি ধারণ করত। দেশে এমন অসংখ্য বসতবাড়ীর জমি আছে, যেগুলো পূর্বে জলাশয় ছিল। জলাশয়ে মাটি ভরাট করে সেখানে বাড়ীঘর নির্মাণ করা হলে, সেইসব বাড়ীর ভিত্তি ততটা স্থায়ী হয় না, যদি না মাটি শক্ত হওয়ার জন্য প্রচুর সময় দেওয়া হয়।
এসব সমস্যার সমাধান-ও এত সহজ না। যেখানে সেখানে সুউচ্চ দালান নির্মাণে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আছে, যানজটের সম্ভাবনা আছে, পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহের ঘাটতি হতে পারে। অনেকে ভাববেন, তাহলে এর সমাধান কোথায়? সমাধান বিকেন্দ্রীকরণে, গ্রামায়নে, রুরালাইজেশনে। নতুন বাংলাদেশের স্লোগান হওয়া চাই- "গ্রামে ফিরে চলো!"
গ্রামগঞ্জ শুধু ঈদে-পুজায় ছুটি কাটানোর জন্য না। যে মানুষের যে জেলায় জন্ম সে জেলার প্রতি তার কোনই দায়িত্ব নেই? শিক্ষা অর্জনের শেষে যার যার পেশা অনুযায়ী একজন মানুষ কি পারে না তার নিজ জেলার সর্বোচ্চ নিকটে বসবাস করতে? সরকার চাইলে, জনগণের সদিচ্ছা থাকলে একটা দেশের সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আর, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক সব সমস্যা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা, পেশাজীবি মহলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, ব্যবসায়ীরা সবাই এগুলো কমবেশি বুঝেন। সবাইকে শুধু একটু স্বার্থপর ও লোভী হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
দেশের ৬৫টি-টি জেলায় জেলা সদরগুলোতে শহরের সব সুযোগ সুবিধা রাখলে, ব্যক্তিগত যানবাহনের বদলে গণপরিবহনকে (রেল, নৌপথ) গুরুত্ব দিলে, সেবাখাতের চেয়ে উৎপাদন খাতকে বেশি প্রাধান্য দিলে, কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিলে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করলে, "পরিবার পরিকল্পনা" বাস্তবায়ন করে জনসমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করলে, বেকারত্ব দূরীকরণে কৃষিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল।
সভ্যতার শুরুতে আদিম মানুষ বসতি গড়ে তুলে নীল ও সবুজকে কেন্দ্র করেই; অথচ আজ অনুন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশে চলছে নীল-হত্যা, সবুজ-হত্যা। উন্নত বিশ্বের অনেক অদ্ভুত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচারকে বাহবা দেওয়া হয়, যা গ্রহণযোগ্য নয় তা জোর করে গলাধকরণ করা হয়, কিন্তু তাদের ভালোদিকগুলোর প্রতি আমাদের নজর-ও পরে না। তাদের প্রতিটা আবাসিক এলাকায় থাকে বিশাল সবুজ পার্ক, ঠিক আমাদের দেশের বনাঞ্চলের মত; ছোটখাট হ্রদগুলো যোগান দেয় প্রতিদিনের ব্যবহারের পানি। ছবির মত সুন্দর তাদের শহর ও গ্রামগুলো। আমরা কি পারি না নিজেদের ভবিষ্যতকে সেরকম আবাসস্থল উত্তরাধিকারসূত্রে দিয়ে যেতে?
©somewhere in net ltd.