![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদাত করার জন্য। ইবাদাতের মূল ব্যাখায় আল্লাহ্র হক আদায়ের পর পিতা-মাতার হক আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এই পৃথিবীতে পিতা-মাতার চেয়ে বড় আপনজন আর কেউ নেই। মা-সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। দশমাস দশদিন পেটে রাখেন। গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় সন্তান মায়ের দেহ থেকে নাভি দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করে। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার সময় প্রসবকালীন কি যন্ত্রণা মাকে সহ্য করতে হয় তা ভূক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। জন্মের পর সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব মাকেই পালন করতে হয়। তখন মায়ের দুধই হয় শিশুদের প্রধান খাদ্য। পবিত্র কুরআনে দুই বছর পর্যন্ত শিশুদের দুগ্ধদানের জন্য আল্লাহ সকল মাকে নির্দেশ দিয়েছেন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব মানুষ জন্মের পর বড়ই অসহায় থাকে। এক অসহায়ত্বের মেয়াদ হবে বেশ কয়েক বছর। এহেন অসহায় অবস্থায় প্রধান সাহায্যকারী থাকে মা। মা-অতি আদর যতেœ শিশুকে লালন-পালন করেন। সব সময় তার পরিচর্যা করেন। অসুখ-বিসুখে বিনিদ্র রজনী যাপন করে সেবা শুশ্রƒষা করেন। কনকনে শীতের রাতে পর্ণকুটিরে কুপি জ্বালিয়ে অসুস্থ শিশুকে পাহারা দেন। মমতার চাদর দিয়ে রৌদ্রের প্রখর উত্তাপ থেকে রক্ষা করেন। শৈশবে লালন-পালন এবং মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অবদান অপরিসীম। তাদের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসা ব্যতীত পৃথিবীতে কোনো সন্তানের জীবনযাপন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। একজন মা তার স্নেহের পরশ দিয়ে তার সন্তানকে অতি ক্ষুদ্র এক খ- রক্তপি- থেকে বড় করে তোলেন। কুরআনে বার বার আল্লাহর ইবাদাতের পর পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। পিতা-মাতা প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদের সাথে উত্তম আচরণ করার যে নির্দেশ সন্তানকে দেয়া হয়েছে তাকে যদি কেউ গুরুত্বহীন মনে করে কিংবা হালকাভাবে গ্রহণ করে তাহলে ইসলামের সঠিক পথ থেকে সে ছিটকে পড়বে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যর্থ হবে। পিতা-মাতাকে সম্মান করা এবং তাঁদের ভরণপোষণ দেয়া ইবাদতের অংশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হালাল উপার্জন দিয়ে পরিবারের জন্য যেই ব্যয় নির্বাহ করা হয় তা আল্লাহ্র নিকট সদকা হিসেবে বিবেচিত হয়।” মুসলমান হিসেবে আমরা আল্লাহ্তায়ালার সকল নবী-রাসূলের উপর বিশ্বাস রাখি। কুরআন মাজিদ আমাদেরকে বলে যে, অন্যান্য নবীগণও তাদের পিতা মাতার প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদেরকে দোয়ার মধ্যে স্মরণ করতেন। বলা বাহুল্য, পিতা-মাতার যথাযথ অধিকার প্রদান ও তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করাও অপরিহার্য কর্তব্য। সন্তানের নিকট পিতা-মাতার প্রাপ্য অধিকারই তাদের হক। সৃষ্টি জগতে মানুষের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী ব্যক্তি হচ্ছে পিতা-মাতা। তাই পিতা-মাতাই তার সর্বাপেক্ষা আপনজন। আর সন্তানের নিকট পিতা-মাতার প্রাপ্যই সর্ববৃহৎ প্রাপ্য। পিতা-মাতার প্রতিই সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য সর্বাধিক। সন্তানের জন্য অবধারিত পিতা-মাতার প্রতি অবশ্য পালনীয় এ সকল দায়িত্ব কর্তব্যই পিতা-মাতার হক রূপে আখ্যায়িত হয়। কুরআনুল কারীমে পিতা-মাতার হক সমূহকে আল্লাহ্তায়ালার ইবাদত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে বান্দা তার জীবদ্দশায় সার্বিক সতর্কতা বজায় রেখে অকৃত্রিমভাবে পিতা-মাতার ন্যায়সঙ্গত অধিকার পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। অবশ্য বান্দার নিকট আল্লাহ্র হক অত্যন্ত ব্যাপক। কিন্তু সন্তানের নিকট পিতা-মাতার হক সীমাবদ্ধ। যেমন পিতা তার সন্তানকে শরীয়াত বিরোধী কোন কাজের আদেশ করলে, সন্তান তা প্রত্যাখ্যান করলেও কোন দোষ হবে না। আল্লাহ্র হক আদায়ের পর একজন মানুষের জন্য সবচেয়েবড় ও গুরুতপূর্ণ হক হলো পিতা-মাতার হক। আল্লাহ্র এবাদাতের পর সবচেয়ে উত্তম কাজ হলো পিতা-মাতার খেদমত করা। পিতা-মাতা হলো সন্তানদের জান্নাত লাভের মাধ্যম পিতা-মাতার অবাধ্য হলে, তার জন্য জান্নাত লাভ সুদুল পরাহত। আমরা অনেকে পিতা-মাতার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সমূহ না জানার কারণে তা পালন করতে পারি না। তাই আলোচনার সুবিধার জন্য পিতা-মাতার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সমূহকে তিনটি পর্বে ভাগ করা করা হয়েছে।-
প্রথম পর্ব: মৃত্যুর পূর্ববর্তী ( জীবিত থাকা অবস্থায়) অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য,
দ্বিতীয় পর্ব: মৃত্যুর পরবর্তী (মৃত্যুর পর) অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য,
তৃতীয় পর্ব: অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য আদায়ের পুরস্কার ও অনাদায়ের শাস্তি।
প্রথম পর্ব: মৃত্যুর পূর্ববর্তী (জীবিত থাকা অবস্থায়) অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য, কুরআনে পিতা-মাতা সম্পর্কে যে সব আয়াত এসেছে তা তিনভাগে ভাগ করা যায়।
১. পিতা-মাতার দায়িত্ব সম্পর্কিত আয়াত;
২. পিতা-মাতা ও অন্যান্যদের অধিকার সম্পর্কিত আয়াত;
৩. পিতা-মাতার অধিকারের সীমা সম্পর্কিত আয়াত।
১. পিতা-মাতার দায়িত্ব সম্পর্কিত:
পবিত্র কুরআনের বাণীগুলোকে পরম শ্রদ্ধা ও বিনয়াবনত অন্তঃকরণে মূল্যায়ন করতে হবে। এখানে কোন দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণ করা হতে বিরত থাকতে হবে। আয়াতগুলোতে সাধারণভাবে মানুষকে আল্লাহ্র আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি অবিচল থাকা ও সাথে সাথে পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, তাদের সেবা-যতœ ও আনুগত্যের নির্দেশও দান করা হয়েছে। অবশ্য আয়াতের প্রারম্ভেই পিতা-মাতা উভয়ের সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মাতার কষ্টের কথা উল্লেখ করার তাৎপর্য এই যে, মাতার পরিশ্রম ও কষ্ট অপরিহার্য ও জরুরী। গর্ভধারণের সময় কষ্ট, প্রসব বেদনার কষ্ট সর্বাবস্থায় ও সব সন্তানের ক্ষেত্রে মাতাকেই সহ্য করতে হয়। পিতার জন্য লালন-পালনের কষ্ট সহ্য করা সর্বাবস্থায় জরুরী হয় না।
প্রথম ধরনের আয়াত গুলোর (শুধু পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দ্বায়িত্ব সম্পর্কিত) মধ্যে পড়ে সূরা বনি ইসরাইলের ২৩ ও ২৪ নং আয়াত, সূরা লুকমানের ১৪ নং আয়াত, সুরা আহ্কাফের ১৫ নং আয়াত ও আনকাবুতের ৮ নং আয়াত।
১.আর তোমার প্রতিপালক এ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাকে ভিন্ন অপর কারো ইবাদত করো না। আর পিতা মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করো। যদি তাদের একজন কিংবা উভয়ে পিতা-মাতার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের উদ্দেশ্যে কখনো ‘উফ’ পর্যন্ত বলবে না। তাদেরকে ধমক দিও না, বরং তাদের সাথে মার্জিত ভাষায় কথা বল। আর তাদের উদ্দেশ্যে অনুগ্রহে বিনয়ের বাহু অবনমিত কর। আর বল, হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়কে অনুগ্রহ কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছেন। (বনী ইসরাইল-১৭ আয়াত: ২৩ ও ২৪)
২. আর আমি মানুষকে তার পিতা মাতা সম্পর্কে আদেশ করেছি। তার মাতা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভধারণ করেছেন। দুই বছর পর্যন্ত তাকে স্তন্য দান করেছেন। এ মর্মে যে, তোমরা আমার এবং তোমাদের পিতা মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আমার দিকেই তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (লোকমান-৩১ আয়াত: ১৪)
৩. আমি মানুষকে পথ নির্দেশ দিয়েছি যে, তারা যেন নিজেদের পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে। তার মাতা কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে রেখেছে এবং কষ্ট স্বীকার করেই তাকে প্রসব করেছে। তার গর্ভধারণে ও দুধ পান ত্যাগ করানো ত্রিশ মাস অতিবাহিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে যখন স্বীয় পূর্ণ শক্তি অর্জন করল এবং চল্লিশ বৎসরের হয়ে গেল, তখন সে বলল হে আমার খোদা! তুমি আমাকে তৌফিক দাও আমি যেন তোমার সেই সব নিয়ামতের শোকর আদায় করি যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা মাতাকে দান করেছ। (আহকাফ-৪৬ আয়াত: ১৫)
৪. আর আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার সাথে সদাচারণ করতে, তবে যদি তারা প্রচেষ্টা চালায় আমার সাথে এমন কিছুকে শরিক করাতে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করবে না। আমার দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (আনকাবুত-২৯ আয়াত: ৮)
হাদীস:
১. হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি একবার রাসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, ‘সন্তানের ওপর পিতা-মাতার হক কী?’ তিনি বললেন, ‘তারা উভয়ই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ এ হাদীস দ্বারা পরোক্ষভাবে এ কথাই বলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করলে সন্তান জান্নাতে যাবে অন্যথায় তার জন্য জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত। (ইবনে মাযাহ্)
২. হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি রয়েছে। (জামে আত তিরমিযী)
৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন আমি নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম-কোন আমল আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ঠিক সময়ে নামায পড়া। সে বলল অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, অতঃপর পিতা-মাতা খেদমত করা। সে বলল তার পর কোনটি? তিনি বললেন, তারপর আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ করা। (সহীহ্ আল বুখারী ও জামে আত তিরমিযী)
৪. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল হে আল্লাহ্র রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার কে? হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার মা। লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করল অতঃপর কে? হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার মা! লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল অতঃপর কে? হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবারও জবাব দিলেন তোমার মা। লোকটি পুনঃ জিজ্ঞেস করল অতঃপর কে? এবারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জওয়াব দিলেন যে, তোমার বাবা। (সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ্ মুসলিম)
৫. হযরত মুগীরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ্তায়ালা মায়েদের নাফরমানী করা, হকদারের হক না দেয়া এবং কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া, তোমাদের উপর হারাম করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ্তায়ালা তোমাদের জন্য গল্প গুজবে মত্ত হওয়া অতিরিক্ত সওয়াল করা এবং মাল সম্পদ নষ্ট করাকে অপছন্দ করেছেন। (সহীহ্ আল বুখারী)
৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন এক ব্যক্তি তার পিতা মাতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় ত্যাগ করে হিযরতের উদ্দেশ্যে বাইয়াত করার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে এসে হাজির হয়। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন ফিরে যাও তোমার পিতা মাতার কাছে এবং তাদের খুশী করে এসো যেমনি তাদের কাঁদিয়ে এসেছিলে। (আদাবুল মুফরাদ)
৭. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞাস করলো, আমি কি জিহাদ করবো? তিনি বললেন তোমার পিতা মাতা আছে কি? লোকটি জবাব দিল হ্যাঁ আছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তবে তাদের দু’জনের মধ্যে জিহাদ কর। অর্থাৎ তাদের দু’জনের খেদমত কর। (সহীহ আল বুখারী)
৮. রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে কবীরা গুনাহ সমূহের আলোচনা করা হলে, তিনি বলেন কবীরা গুনাহ হলো আল্লাহর সাথে শরিক করা, পিতা-মাতার নাফরমানি করা, তিনি হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন, এই কথা বলে উঠে বসেন এবং বলেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।
৯. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “হে মুসলমানগণ! তোমরা তোমাদের পিতা-মাতা সাথে সদাচরণ কর, যাতে তোমাদের সন্তানেরাও তোমাদের সাথে সদাচারণ করে”। (আল-আদাবুল মুফরাদ)।
১০. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আমি মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন নেক আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়? মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যে নামাজ সময়মতো পড়া হয়।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এরপর কোন কাজ সবচেয়ে বেশি প্রিয়? তিনি বললেন, ‘পিতা-মাতা সাথে সুন্দর আচরণ’ (সহীহ্ আল-বুখারী ও সহীহ্ মুসলিম)।
১১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলমান হওয়ার পরও দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁর মা শিরকে নিমজ্জিত ছিলেন। তিনি মাকে সর্বদা শিরকের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতেন এবং ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিতেন। আর তাঁর মাও সর্বদা অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। তা সত্ত্বেও আবু হুরায়রা ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিতেন। একদিন আমি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি রাসূলুল্লাহের সম্পর্কে আমাকে এমন কিছু কথা শুনালেন, যাতে আমার অন্তর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আমি ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসুলের খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলাম, হে আল্লাহ রাসূল! আমি সব সময় আমার মাকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকি, তিনি সব সময় তা অস্বীকার করতে থাকেন। আজ আমি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি রাগান্বিত হয়ে আপনার শানে বেয়াদবি করে বসেন এবং আপনাকে গালমন্দ করেন। আমি তা সহ্য করতে পারিনি। আপনি আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করুন, যেন তিনি আবু হুরায়রার মাকে হেদায়াত নসীব করেন। রাসূলুল্লাহ দোয়া করলেন: হে আল্লাহ্! আপনি আবু হুরায়রার মাকে হেদায়াত করুন। আমি রাসূলুল্লাহের দোয়ার সুসংবাদ নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমি বাড়ি পেঁৗঁছে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ। তিনি আমার পায়ের শব্দ শুনে ভেতর থেকে বললেন, আবু হুরায়রা অপেক্ষা কর। তিনি তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে দোপাট্টা পরিধান করে ওড়না পরা ছাড়াই দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর বললেন, আবু হুরায়রা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ আল্লাহ্র বান্দা ও আল্লাহ্র রাসূল। আমি আনন্দে ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসূলুল্লাহের খেদমতে হাজির হয়ে বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল আমি আপনাকে সুসংবাদ শুনাতে এসেছি। আল্লাহ্তায়ালা আপনার দোয়া কবুল করেছেন। তিনি আবু হুরায়রার মাকে হেদায়াত নসীব করেছেন। একথা শুনে তিনি খুশি হলেন এবং আল্লাহ্র প্রশংসা ও গুণগান করলেন এবং আমাকে নসীহত করলেন। এরপর আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি দোয়া করুন যেন আল্লাহ্ আমাকে ও আমার মাকে সকল মুমিনের প্রিয় বানিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ দোয়া করলেন: ইয়া আল্লাহ! আবু হুরায়রা ও তার মায়ের প্রতি ভালোবাসা সকল মুমিনের অন্তরে সৃষ্টি করে দিন। এ দোয়ার পর সে মুসলমানই আমাকে দেখেছে অথবা আমার কথা শুনেছে সেই আমাকে ভালোবেসেছে। (সহীহ্ মুসলিম)
১২. হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহতায়ালার নিকট পিতা-মাতা সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার চাইতে অধিক প্রিয় আর কোনো আমল হতে পারে তা আমার জানা নেই।
২. পিতা-মাতা ও আন্যান্যদের অধিকার সম্পর্কিত:
কুরআন মাজিদ বারংবার ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ্তায়ালার হকের পরেই পিতা-মাতার হক। মহান আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয়তম রাসূল মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর পিতা ও মাতার অধিকারই সর্বাধিক। পবিত্র কুরআনের স্থানে স্থানে মহান আল্লাহর অধিকারের সাথে সাথে পিতা-মাতা অধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের সাথে সাথে পিতা-মাতা প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ারও নির্দেশ রয়েছে। যদি আমরা তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি তবে আল্লাহ্তায়ালার আদেশেরই আনুগত্য করি। যদি আমরা তাদের অসম্মান করি তবে আমরা আল্লাহ্র আদেশকেই অমান্য করি। অতঃপর তার ফলে পরিণামস্বরূপ জাহান্নামে যেতে পারি। আল্লাহ্র কৃতজ্ঞতা আদায় করা যেমন অতীব জরুরি অনুরূপভাবে পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করাও সন্তানের জন্য জরুরি। ইসলামে পিতা-মাতার অসংখ্য অধিকার ও সীমাহীন মর্যাদা রয়েছে। একজন সন্তান পৃথিবীতে আগমনের একমাত্র মাধ্যম হলো পিতা-মাতা। তাই সন্তানের ওপর পিতা-মাতার মর্যাদা ও অধিকার অনেক বেশি।
দ্বিতীয় ধরনের আয়াতে অন্যান্যদের অধিকারের সাথে সাথে পিতা-মাতার অধিকারের কথাও বলা হয়েছে:
১. তুমি বল, ‘আসো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করেছেন তা বলে দেই, তোমরা আল্লাহ্র সাথে কোনো শরিক করবে না, পিতা মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, দারিদ্র্যের আশংকায় কখনও তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না। (আনআম-৬ আয়াত: ১৫১)
২. তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তার সাথে শরীক করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, অভাব গ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-অহংকারীকে। (নিসা-৪ আয়াত: ৩৬)
৩. অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর।’ (নাহল-১৬ আয়াত: ৭৮)
৪. তাছাড়া পবিত্র কুরআনে পাকে মায়ের কষ্টের এসব কারণের কথা উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহ্ পাক বলেন, মাতা তাকে বড় কষ্টে গর্ভধারণ করেছে এবং অতিকষ্টে তাকে প্রসব করেছে, আর তাকে গর্ভে ধারণ করা ও দুধ ছাড়ানো ত্রিশ মাস। (লোকমান-৩১ আয়াত: ১৪)
হাদীস:
দ্বীনের অন্যতম স্তম্ভ নামায পড়ার পর আল্লাহ্র নিকট সর্বাধিক প্রিয় কাজ হলো পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা।
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার সাহচর্যে সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি কে? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! বললেন, তোমার মাতা। সে আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কে? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার পিতা। অতঃপর ধারাবাহিকভাবে নিকটাত্মীয়। (সহীহ আল বুখারী)
২. এক ব্যক্তি একবার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, ‘সন্তানের ওপর পিতা-মাতার হক কী?' তিনি বললেন, ‘তারা উভয়ই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ এ হাদীস দ্বারা পরোক্ষভাবে এ কথাই বলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্র নির্দেশানুযায়ী পিতা-মাতার সাথে ব্যবহার করলে সন্তান জান্নাতে যাবে অন্যথায় তার জন্য জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত।
৩. আল্লামা ইবনে কাছীর রাহ. এ হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সন্তানের ওপর মাতার অধিকার পিতার চেয়ে তিন গুণ বেশি। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতার কথা তিনবার উল্লেখ করেছেন, চতুর্থবারে পিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া মাতার অধিকার বেশি হওয়ার স্বতন্ত্র কয়েকটি কারণ রয়েছে। এক. গর্ভধারণের কষ্ট। দুই. প্রসবকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গর্ভ প্রসবের কষ্ট। তিন. দুগ্ধপান করাণো এবং সন্তানের সেবা-যতেœ নিয়োজিত থাকার কষ্ট। (তাফসীরে কুরতুবী)
৪. যাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে আল্লাহ্তায়ালা তার মৃত্যুকে সহজ করবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর তা হল, দুর্বলদের প্রতি দয়া, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও দাস-দাসীদের (চাকর চাকরাণীদের) প্রতি ভাল আচরণ। (বায়হাকী)
৫. আল্লাহ্র রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরশাদ হলো, তোমরা তোমাদের পিতা ও পিতামহের সাথে কখনও বেপরোয়ামূলক আচরণ করবে না। পিতা-মাতার সাথে বেপরোয়ামূলক আচরণ করা আল্লাহ্র প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ার শামিল।
৩. পিতা-মাতার অধীকারের সীমা সর্ম্পকিত:
আর তৃতীয় ধরনের আয়াতে পিতা মাতার অধিকারের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে বলা হয়েছে কোথায় কোথায় পিতা-মাতার অধিকার নেই।
প্রথমত: পিতা মাতা আল্লাহ্র সাথে কোনো কিছু শরিক করতে বললে তাদের আনুগত্য করা যাবে না।
১. আমি মানুষকে তার পিতা মাতার সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। আর যদি তোমার পিতা মাতা তোমাকে আমার সাথে শিরক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করো না। (আন কাবুত-২৯ আয়াত : ৮)
২. যদি তাঁরা (পিতা-মাতা) তোমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে আমার সাথে কাউকে শরীক করার জন্য যা (শিরক) তোমার বোধগম্য নয়, তাহলে তুমি তাঁদের কথা অমান্য করো, (অর্থাৎ আমি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না) আর পার্থিব জীবনে উৎকৃষ্ট পন্থায় তাঁদের সাথে সৎ সম্পর্ক বজায় রেখো। আর তুমি তাঁদের পথ অনুসরণ করো যারা (আমি এক) আমার প্রতি অবিচলভাবে আকৃষ্ট রয়েছে। (লুকমান-৩১ : আয়াত ১৫)
দ্বিতীয়ত: অন্যায় কাজে সন্তানের সমর্থন পাবার অধিকার পিতা-মাতার নেই, সে অন্যায় যে কারো ক্ষেত্রেই হক না কেন।
১. হে ঈমানদারগণ, তোমরা সর্বদাই ইনসাফের ওপর দৃড়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকো এবং আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষী থেকো যদি তা তোমার নিজের, নিজ পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়দের বিপরীতে যায় তবুও। (নিসা-৪ আয়াত : ১৩৫) অর্থাৎ পিতা-মাতা অন্যায় করলে বা অন্যায় দাবী করলে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন তার বিরোধিতা করার এবং ন্যায়ের পক্ষে থাকার; তবে মনে রাখতে হবে তাদের সঙ্গে ব্যবহার ভালো করতে হবে এবং ধমক দেয়া যাবে না।
কুরআনের তিন ধরণের আয়াত সমূহ ও হাদীস থেকে এটা সুস্পষ্ট যে পিতা মাতার প্রতি “সদ্ব্যবহার বা ভালো ব্যবহার” এর কথা বার বার বলা হয়েছে এবং এখনে এটাও লক্ষণীয় যে একই ভালো ব্যবহারের কথা আরো অনেকের প্রতিও করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পিতা-মাতার অধিকারের সীমা রেখার কথাও বলা হয়েছে। কুরআনের আয়াত ও হাদীসগুলোতে যা বলা হয়েছে তা হলো-
প্রথমত: পিতা-মাতার সাথে ইহসানপূর্ণ আচরণ করার ব্যাপারে সাধারণ নির্দেশনা প্রদান করে। অতঃপর তা আমাদেরকে কিছু বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করে। তা বলে, যখন আমাদের পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপণীত হয় তখন তাদের প্রতি আমাদের এতই সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে হবে যে, তাদের প্রতি এমনকি উফ’ শব্দ পর্যন্ত বলা যাবে না। উল্লেখ্য যে, পিতা-মাতা তাদের বৃদ্ধ বয়সে অর্থনৈতিক ও শারীরিক প্রয়োজনে স্বভাবতই তাদের সন্তান সন্ততির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অধিকন্তু, বৃদ্ধ বয়সে মানুষ সাধারণত অধিক আবেগপ্রবণ ও মুখাপেক্ষী থাকে। কুরআন মাজিদ আমাদেরকে বলে যে, যখন আমাদের পিতা-মাতা বয়সের এই পর্যায়ে উপণীত হবেন তখন তাদের প্রতি আমাদের এতই সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে হবে যে, তাদের সামনে বিরক্তিসূচক একটি সাধারণ শব্দও উচ্চারণ করা যাবে না। হাসান ইবনে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এটি পিতা-মাতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের সর্বনিম্ন পর্যায়। এর নিচেও যদি কোন স্তর থাকত, তবে আল্লাহতায়ালা তা-ই উল্লেখ করতেন।
দ্বিতীয়ত: পিতা-মাতার সাথে সম্মান ও মর্যাদার সাথে কথা বলতে হবে।
তৃতীয়ত: পিতা-মাতার সাথে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও বিনয়ের সাথে আচরণ করতে হবে।
চতুর্থ: আমাদের দোয়ার মধ্যে পিতা-মাতাকে স্মরণ করতে হবে।
পঞ্চম: পিতা-মাতাকে ‘উফ’ শব্দও বলবে না। এখানে ‘উফ’ শব্দ বলে এমন শব্দ বোঝানো হয়েছে, যা দ্বারা বিরক্তি প্রকাশ পায়। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, পীড়া দানের ক্ষেত্রে ‘উফ’ বলার চাইতেও কম কোনো স্তর থাকলে তাও অবশ্যই উল্লেখ করা হতো। সারকথা, যে কথায় পিতা-মাতার সামান্য কষ্ট হয়, তাও নিষিদ্ধ।
৬ষ্ঠ: পিতা-মাতাকে ধমক দেয়া যাবে না।
৭ম: পিতা-মাতা কাউকে শরিক করতে বললে তার আনুগত্য করা যাবে না।
৮ম: পিতা-মাতা অন্যায় করলে বা অন্যায় দাবী করলে তার বিরোধিতা করতে হবে।
৯ম: পিতা-মাতা ছাড়া ও পিতা-মাতার আত্মীয়স্বজনদের ও প্রতিবেশিদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়াও আরো কিছু অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে যা নি¤œরূপÑ
দুধমায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন:
হযরত আবু তুফায়েল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি দেখলাম, নবী জিয়রানা নামক স্থানে গোশত বণ্টন করছিলেন। এমন সময় একজন মহিলা এসে সরাসরি নবীর নিকটে চলে গেলেন। তিনি তাঁর জন্য নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন। অতঃপর ভদ্র মহিলাটি তার ওপর আসন গ্রহণ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি লোকদের কাছে জানতে চাইলাম, ইনি কে? তারা বললেন, ইনি হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুধমা হযরত হালীমা সাদিয়া। তিনি তাঁকে দুধ পান করিয়েছিলেন।
অমুসলিম পিতা-মাতার প্রতি আচরণ:
যে ব্যক্তি আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাস করে সে কখনো অন্যকে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করতে আদেশ করতে পারে না। পিতা-মাতা যদি আমাদেরকে আল্লাহ্র সাথে শরিক করতে চাপ প্রয়োগ করে তবে তা মানা যাবে না। তবে তখনো তাদের সাথে ইহসানের সাথে আচরণ করতে হবে।
১. আর আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার সাথে সদাচারণ করতে, তবে যদি তারা প্রচেষ্টা চালায় আমার সাথে এমন কিছুকে শরিক করাতে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করবে না। আমার দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (আনকাবুত-২৯ আয়াত: ৮)
২. এ সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা বলেন, পিতা-মাতা যদি আমার কাউকে শরিক করার জন্য তোমার ওপর চাপ প্রয়োগ করে যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই তাহলে অবশ্যই তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ার জীবনে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহবস্থান করবে। আর তাদের আনুগত্য করবে যারা আমার দিক প্রত্যাবর্তনকারী। (লুকমান-৩১ আয়াত: ১৫)
এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, পিতা-মাতা যদি ছেলে-মেয়েকে কোন পাপ কাজ করার আদেশ প্রদান করে তবে তা পালন করা যাবে না, তবে তাদের প্রতি ভালোবাসা অব্যাহত রাখতে হবে এবং দয়া ও সহানুভূতির সাথে আচরণ করতে হবে।
হাদীস :
১. হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তার মাতা অমুসলিম অবস্থায় তাকে দেখতে মদীনায় আসেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমার মা অমুসলিম। কিন্তু তিনি আমার কাছে কিছু পেতে আশা করছেন। আমি কি তাকে সন্তুষ্ট করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ্ মুসলিম)
আসমা ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহিয়সী স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বৈমাত্রেয় বড় বোন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলমান হওয়ার পুর্বে তাকে (তার মাকে) তালাক দিয়েছিলেন। সে ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির পর অমুসলিমরা যখন মদীনায় আসার অনুমতি পায়, সে তখন তার মেয়েকে দেখতে মদীনায় আসে। যখন আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি তার মায়ের সাথে কেমন আচরণ করবেন? তিনি তার মায়ের প্রতি সদয় ও বিবেচক হতে নির্দেশ দিলেন, সে একজন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও।
বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার প্রতি বিশেষ যতœবান হওয়া:
পিতা-মাতার খেদমত, আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা সর্বাবস্থায় সন্তানের ওপর ওয়াজিব। তবে যখন পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হয়, তখন তারা বেশি সন্তানের খেদমতের মুখাপেী হয়। আল্লাহ্ পাক কুরআন মাজিদে পিতা-মাতা বার্থক্যে উপনীত হলে, পিতা-মাতার সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে, সে সম্পর্কিত কতিপয় নির্দেশনা সন্তানদেরকে প্রদান করে বলেন-
১. আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচারণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপণীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে ন¤্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো, হে প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (বনি ইসরাইল-১৭ আয়াত: ২৩-২৪)
২. আমি মানুষকে (তাদের) পিতা-মাতার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। কেননা তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দুই বছর পরই সে বুকের দুধ খাওয়া ছেড়েছে। তুমি তোমার নিজের সৃষ্টির জন্য আমার শোকর আদায় করো এবং তোমার লালন-পালনের জন্য পিতা-মাতারও কৃতজ্ঞতা আদায় করো। তোমাদের সবাইকে আমাদের কাছেই ফিরে আসতে হবে। (লোকমান-৩১ আয়াত: ১৪)
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তাঁর সাহাবীদের সাথে আলাপ করছিলেন। এমন সময় এক বৃদ্ধা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। নবীজি বৃদ্ধাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং তঁাঁর গায়ের চাদরটি মাটিয়ে বিছিয়ে তাকে বসতে দিলেন। তারপর অত্যন্ত দরদ দিয়ে বৃদ্ধার সাথে কথাবার্তা বললেন। বৃদ্ধা চলে গেলে সাহাবীরা বিস্মিত হয়ে নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন,‘ কে এই মহিলা যার জন্য আপনার এতো দরদ, এতো আন্তরিকতা?' নবীজি উত্তরে বললেন, তিনি আমার দুধমাতা হালিমা। যিনি আমাকে দুধ পান করিয়েছিলেন। তিনি আরো জানালেন যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পরেই মায়ের স্থান এবং মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেশত। (আবু দাউদ)
কোরআন মাজিদের বিভিন্ন আয়াতে যা বলেছেন তা নিম্মরূপ:
প্রথমত : পিতা-মাতার প্রতি এমনকি উফ’ শব্দ পর্যন্ত বলা যাবে না। উল্লেখ্য যে, পিতা-মাতা তাদের বৃদ্ধ বয়সে অর্থনৈতিক ও শারীরিক প্রয়োজনে স্বভাবতই তাদের সন্তান সন্ততির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অধিকন্তু, বৃদ্ধ বয়সে মানুষ সাধারণত অধিক আবেগপ্রবণ ও মুখাপেক্ষী থাকে। কুরআন মাজিদ আমাদেরকে বলে যে, যখন আমাদের পিতা-মাতা বয়সের এই পর্যায়ে উপনীত হবেন তখন তাদের প্রতি আমাদের এতই সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে হবে যে, তাদের সামনে বিরক্তিসূচক একটি সাধারণ শব্দও উচ্চারণ করা যাবে না। হাসান ইবনে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এটি পিতা-মাতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের সর্বনিম্ন পর্যায়। এর নিচেও যদি কোন স্তর থাকত, তবে আল্লাহতায়ালা তা-ই উল্লেখ করতেন। সারকথা, যে কথায় পিতা-মাতার সামান্য কষ্ট হয়, তাও নিষিদ্ধ।
দ্বিতীয়ত : তাদেরকে ধমক দিবে না। এটি যে বেদনাদায়ক তা সকলের কাছে স্পষ্ট।
হাদীস :
১. এক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ মাতাকে হারাম শরীফে নিয়ে আসে। সে তাকে তার কাঁধে নিয়ে কাবা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ করতে থাকে। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি এখন আমার মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করেছি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তর দিলেন, তুমি তোমার মায়ের একটি শ্বাস-প্রশ্বাসের হকও আদায় করনি। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আছ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করল এবং বলল, আমি আপনার কাছে হিযরত ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের বায়আত হতে এসেছি। তিনি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চাইলেন, তার পিতা-মাতা বেঁচে আছে কিনা। লোকটি উত্তর করল, হ্যাঁ, উভয়েই বেঁচে আছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তোমার পিতা-মাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের সেবা কর। (সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জিহাদের উদ্দেশ্যে ইয়ামেন থেকে মদীনায় হিযরত করে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়ামেনে তার কোন আত্মীয়-স্বজন আছে কিনা? লোকটি উত্তর করল, সেখানে সে তার পিতা-মাতার অনুমতি নিয়ে এসেছে কিনা? লোকটি উত্তর করল, না। তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি তোমার পিতা-মাতার কাছে ফিরে যাও। হিজরতের জন্যে তাদের অনুমতি নিয়ে আস। যদি তারা তোমাকে অনুমতি দেয় তবে জিহাদে গিয়ে শরিক হও। যদি তারা তোমাকে অনুমতি না দেয় তবে তাদের সাথে অবস্থান কর এবং ভালভাবে তাদের সেবা যতœ কর। (আবু দাউদ, আহমদ)
৪. হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে ইসলামের জন্যে জিহাদে শরিক অনুমতি চাইল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার মা জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি উত্তরে বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ বললেন, ফিরে যাও এবং তোমার মায়ের কাছে থাক। কেননা, বেহেশত তার পায়ের নিচে। (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী, নাসায়ী)
৫. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, কিছু দিন আবু হুরায়রার রাদিয়াল্লাহু আনহু মা এক বাড়িতে এবং আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু অল্প দূরে ভিন্ন এক বাড়িতে বসবাস করতেন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু যখনই বাইরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করতেন তখন মায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলতেন, ইয়া আম্মাজান! আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। তাঁর মা ভেতর থেকে বলতেন, প্রিয় পুত্র! ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। অতঃপর হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, আম্মাজান, শৈশবকালে যেভাবে আপনি স্নেহ ও মায়া মমতাসহকারে আমাকে লালন-পালন করেছিলেন। তেমনিভাবে যেন আল্লাহতায়ালা আপনার প্রতি রহম করেন। জবাবে তিনি বলতেন, প্রিয় পুত্র! এ বৃদ্ধ বয়সে তুমি আমার সঙ্গে যেমন সুন্দর ও সদাচরণ করছ তেমনি আল্লাহও যেন তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করেন।
হিযরত ও জিহাদ আল্লাহ্তায়ালার কাছে দু’টি প্রিয়তম বস্তু। বস্তুত, যদি কারও পিতা-মাতা অসুস্থ কিংবা বৃদ্ধ হয়ে যায় তবে তাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন পিতা-মাতার সেবা করাই তার প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এবং এর ফলে হিযরত ও জিহাদকারীদের সমতুল্য সওয়াব সে প্রাপ্ত হবে। এসব হাদীস থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যদি কেউ পিতা মাতার বৃদ্ধ বয়সে বা তাদের অসুস্থতার সময় কোন জাগতিক ইচ্ছা কিংবা প্রয়োজনে তাদের উপেক্ষা বা অবহেলা করে তবে সে গুরুতর পাপের অপরাধী বিবেচিত হবে।
এ জন্য আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ্ ব্যতীত যদি কাউকে সেজদা করার নির্দেশ হতো, তবে সন্তানকে নির্দেশ দেয়া হতো তার মাকে সেজদা করার জন্য। মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের জান্নাত।
পিতা-মাতাকে গালি দেয়া:
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে বড় গুণাহ হলো কোন লোক তার পিতা মাতার উপর লা’নত করা। জিজ্ঞেস করা হলো হে আল্লাহ্র রাসূল! কিভাবে একজন লোক তার পিতা-মাতাকে গালি দেয়? তিনি বললেন, কোনও ব্যক্তি অপর ব্যক্তির পিতাকে গালি দিল, তারপর সে তার পিতাকে গালি দিল। কেউ অপরের মাকে গালি দিল, আবার সে তার মাকে গালি দিল।
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একটি বড় পাপ হল, কোন ব্যক্তির, তার পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয়া। তারা জানতে চাইলেন, কেউ কি তার পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয়? তিনি উত্তর করলেন, কোন ব্যক্তি অন্যের পিতাকে অভিশাপ দেয়। ফলে সেও তার পিতাকে অভিশাপ দেয় এবং সে অন্যের মাকে অভিশাপ দেয়, তখন সেও তার মাকে অভিশাপ দেয়। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
ইসলামের সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব যে, তা কেবল নিজের পিতা মাতাকেই ভালোবাসতে ও সম্মান জানাতে শিক্ষা দেয় না, বরং অন্যদের পিতা-মাতার সাথেও অনুরূপ আচরণ করতে শিক্ষা দেয়।
কার অধিকার বেশী পিতা না মাতার :
ইসলামে পিতা-মাতার মর্যাদা আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরেই। আনুগত্যে ও খিদমতে পিতা-মাতা উভয়েরই অধিকার আছে। এর মধ্যে মায়ের অধিকার পিতার চেয়ে বেশি। বস্তুত, মায়ের মর্যাদা পিতার মর্যাদার চেয়ে তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ চার ভাগের তিন ভাগই মায়ের জন্য আর এক ভাগ পিতার জন্য। তিনটি বিশেষ কষ্টের কারণেই মাতার এই মর্যাদা যথা: এক. গর্ভধারণের কষ্ট। দুই. প্রসবকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গর্ভ প্রসবের কষ্ট। তিন. দুগ্ধপান করাণো এবং সন্তানের সেবা-যতেœ নিয়োজিত থাকার কষ্ট।
১. আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুবছরে; সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। (লোকমান-৩১ আয়াত: ১৪)
হাদীস :
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করে, কে আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, অত:পর কে? তিনি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, অত:পর কে? আর তিনি উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি চতুর্থবারের মত জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, তোমার পিতা। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
১. এক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ মাতাকে হারাম শরীফে নিয়ে আসে। সে তাকে তার কাঁধে নিয়ে কাবা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ করতে থাকে। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি এখন আমার মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করেছি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তর দিলেন, তুমি তোমার মায়ের একটি শ্বাসে-প্রশ্বাসের হকও আদায় করনি। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
৩. পিতা মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সšুÍষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টি। (জামে আত তিরমিযি)
৪. রাসূলে খোদা মায়ের মর্যাদা দিতে গিয়ে বলেছেন, জান্নাত মায়ের পদতলে। পিতার মর্যাদা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, পিতার সন্তুষ্টির ওপর আল্লাহ্র সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টির ওপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি নির্ভর করে। পিতা-মাতার সাথে অসৎ আচরণের পরিণাম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ কী তা কি আমি তোমাদের জানাব? তা হচ্ছে- আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা ও পিতা-মাতার সঙ্গে অসদাচরণ। কাজেই বেহেস্তে যেতে হলে অবশ্যই তাঁদের সেবা করতে হবে এবং তাদের অনুগত থাকতে হবে।
৫. হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি কোনো নেক সন্তান স্বীয় পিতা-মাতার দিকে রহমতের সাথে দৃষ্টিপাত করে, তাহলে আল্লাহ্ তাকে প্রতিটি দৃষ্টির জন্য একটি কবুল হজ্বের সওয়াব দিয়ে দেন। সাহাগাবীগণ বললেন, যদি কেই প্রতি দিন একশত বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে? রাসূল বললেন, হ্যাঁ তাহলেও; আল্লাহ্ মহান ও পবিত্র। (মেশকাত)
৬. এক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ মাতাকে হারাম শরীফে নিয়ে আসে। সে তাকে তার কাঁধে নিয়ে কাবা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ করতে থাকে। সে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি এখন আমার মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করেছি? রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তর দিলেন, তুমি তোমার মায়ের একটি শ্বাস-প্রশ্বাসের হকও আদায় করনি। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
৭. আবু মূসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একবার আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু দেখলেন, জনৈক ইয়ামেনী স্বীয় মাতাকে পিঠে বসিয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফ করছিল। অতঃপর সে হযরত আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি মনে করেন, আমি আমার মায়ের বদলা দিয়েছি? ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, মায়ের বদলা! এটা তো তার এক আহ্ শব্দের বদলাও হয়নি।
৮. একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহের খেদমতে হাজির হয়ে অভিযোগ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা বদমেজাজি মানুষ। একথা শুনে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন তোমাকে গর্ভে ধারণা করে একাধারে নয় মাস সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেছেন, তখন তো তিনি খারাপ মেজাজের ছিলেন না? লোকটি বলল, হযরত আমি সত্য বলছি, তিনি বদমেজাজি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার খাতিরে তিনি যখন রাতের পর রাত জাগতেন, তোমাকে দুধ পান করাতেন, তখন সে তো তিনি বদমেজাজি ছিলেন না। লোকটি বলল, আমি আমার মায়ের সে সব কাজের প্রতি দান দিয়ে ফেলেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সত্যিই প্রতি দান দিয়ে ফেলেছ? সে বলল, আমি মাকে আমার কাঁধে চড়িয়ে হজ্জ করিয়েছি। নবী বললেন, তুমি কি তাঁর সেই কষ্টের বদলা দিতে পারো, যা তোমার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় তিনি সহ্য করেছেন।
৯. হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে ইসলামের জন্যে জিহাদে শরিক অনুমতি চাইল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার মা জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি উত্তরে বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ বললেন, ফিরে যাও এবং তোমার মায়ের কাছে থাক। কেননা, বেহেশত তার পায়ের নিচে। (আহমদ, বায়হাকী, নাসায়ী)
১০. বর্ণিত আছে যে, একদা সাহাবী জারীহকে তার মা ডাকেন, যখন তিনি নামাজরত ছিলেন। কিন্তু, তিনি নামাজ অব্যাহত রাখেন। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পারলেন, তিনি বললেন, যদি জারীহ জানত যে, মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া আল্লাহতায়ালার কাছে নামাজ পড়া থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। (ফতহুল বারী, শরহুল বুখারী)
১১. হযরত আবু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তানের উপর পিতা-মাতার হক কি? তিনি বললেন তারা দু’জন (পিতা-মাতা) তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম। (ইবনে মাযাহ্)
১২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত। (জামে আত তিরমিযী)
১৩. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমার এক স্ত্রী ছিল যাকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু, আমার পিতা ওমর তাকে অপছন্দ করতেন। তিনি আমাকে বললেন তাকে তালাক দিতে। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখান করি। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গেলেন এবং এ বিষয়টি তাকে অবহিত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন এবং তাকে তালাক দিয়ে দিতে বললেন। (আবু দাউদ, তিরমিযী) (বর্ণিত আছে, এরপর তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন।)
১৪. হযরত বশির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে লোক মায়ের কাছে অবস্থান করে তার নির্দেশ মতো চলে, সে তরবারী নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। মায়ের দিকে ভক্তি সহকারে তাকানোর চেয়ে মহৎ কাজ আর নেই।
পিতা-মাতার জন্যে অর্থ ব্যয় করা:
যেভাবে সন্তানের ওপর পিতা-মাতা অধিকার রয়েছে তেমনিভাবে সন্তানের সম্পদের ওপরও তাদের অধিকার রয়েছে। আমরা যা কিছুই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্যে খরচ করি না কেন, পরিবার কিংবা সমাজের অন্যান্য লোকের পূর্বে প্রথমে পিতা-মাতার জন্যেই আমাদেরকে খরচ করতে হবে। অতএব, যদি কেউ তার পরিবারের সদস্যদের উপর ব্যয় করে কিংবা সমাজের কোন মহৎ কাজে ব্যয় করে, কিন্তু পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে বেখবর থাকে, সে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ লঙ্ঘন করে। আমাদের প্রথম কর্তব্য হল, পিতা-মাতার প্রয়োজনের প্রতি যতœবান হওয়া এবং তাদের সাথে ইহসানের আচরণ করা, এমনকি অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রেও। কুরআনে বলা হয়েছে,
১. হে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে। আপনি বলুনÑ কল্যাণকর যে ব্যয় তোমরা করবে, তা করবে পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, ইয়াতিম, মিসকিন ও পথচারীদের জন্য। (বাকারা-২ আয়াত : ২১৫)
হাদীস :
১. এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহের কাছে স্বীয় পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলল, তিনি যখনই ইচ্ছা করেন আমার সম্পদ নিয়ে নেন। রাসূলুল্লাহ তার পিতাকে ডাকলেন। লাঠি ভর করে এক দুর্বল বৃদ্ধ হাজির হলেন। তিনি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। বৃদ্ধালোকটি জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এক সময় আমার এ ছেলে দুর্বল, অসহায় ও কর্পদহীন ছিল। আমি তখন ছিলাম শক্তিশালী ও বিত্তশালী। আমি কখনো তাকে আমার সম্পদ নিতে বাধা দেইনি। আজ আমি দুর্বল ও কপর্দকহীন, সে শক্তিশালী ও বিত্তশালী। এখন সে তার সম্পদ আমাকে দেয় না। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ বললেন, তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার।
২. পিতা-মাতা সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা সম্পর্কে হাসান বসরী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমার মালিকানাধীন সম্পদ তাদের প্রয়োজন মাফিক ব্যয় করবে। তাঁরা যা আদেশ করেন তা যদি গুনার কাজ না হয়, তবে তা মেনে চলবে।
৩. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো সন্তান পিতার স্নেহ-ভালোবাসা, লালন-পালন এবং কষ্টের হক আদায় করতে বা তার বদলা দিতে সক্ষম নয়। তবে সে যদি তাঁকে কারো দাসরূপে পায়, অতঃপর তাঁকে খরিদ করে মুক্ত করে দেয়, তাহলে কিছু হক আদায় হয়।
৪. যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করেন এবং তার পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, আমার পিতা আমার সম্পদ নিয়ে যেতে চান। তিনি বললেন, তোমার পিতাকে নিয়ে আস। এমন সময়ই জিবরাঈল আগমন করলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, তার পিতা আসলে আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, ঐ বাক্যগুলো কি, যেগুলো সে মনে মনে বলেছে এবং স্বয়ং তার কানও শুনতে পায় নি। যখন লোকটি তার পিতাকে নিয়ে হাজির হল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যাপার কি, আপনার পুত্র আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল কেন? আপনি কি তার আসবাবপত্র ছিনিয়ে নিতে চান? পিতা বলল, আপনি তাকে এ প্রশ্ন করুন, আমি তার ফুফু, খালা ও নিজের জীবন রক্ষার প্রয়োজন ব্যতিত তা কোথায় ব্যয় করি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যাস! অভিযোগ ব্যাখ্যার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট। এরপর তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঐ বাক্যগুলো কি, যেগুলো এখন পর্যন্ত স্বয়ং আপনার কানও শোনেনি? ইয়া রাসূলুল্লাহ! প্রত্যেক ব্যাপারেই আল্লাহতায়ালা আপনার প্রতি আমাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে দিন। (যে কথা কেউ শুনেনি তা আপনার জানা হয়ে গেছে। এটা একটা মুজিজা। অতঃপর সে বলল, এটা ঠিক যে, আমি মনে মনে কয়েক লাইন কবিতা বলেছিলাম, যেগুলো আমার কানও শুনে নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কবিতাগুলো আমাকে শুনান। তখন সে নিম্নোক্ত পঙ্ক্তিগুলো আবৃত্তি করল, আমি শৈশবে তোমাকে খাবারের ব্যবস্থা করেছি এবং যৌবনেও তোমার দায়িত্ব বহন করেছি। তোমার যাবতীয় খাওয়া-পরা আমারই উপার্জন থেকে ছিল। কোন রাতে যখন তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ, তখন আমি সারা রাত জেগে কাটিয়েছি। যেন তোমার রোগ আমাকেই স্পর্শ করেছে, তোমাকে নয়। ফলে সারা রাত আমি ক্রন্দন করেছি। আমার অন্তর তোমার মৃত্যুর ভয়ে ভীত হত; অথচ আমি জানতাম যে, মৃত্যুর জন্য দিন নির্দিষ্ট রয়েছে- আগে পিছে হতে পারবে না। অতঃপর যখন তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছ এবং আমার আকাঙ্খিত বয়সের সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেছ, তখন তুমি কঠোরতা ও রুঢ় ভাষাকে আমার প্রতিদান করে দিয়েছ, যদি তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ ও কৃপা না করতে, আফসোস! যদি তোমার দ্বারা আমার পিতৃত্বের হক আদায় না হয়, তবে কমপক্ষে ততটুকুই করতে যতটুকু একজন ভদ্র প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীর সাথে করে থাকে। তুমি কমপক্ষে আমাকে প্রতিবেশীর হক তা দিতে এবং আমার সম্পদে আমার সাথে কৃপণতা না করতে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিতাগুলো শুনার পর ছেলের জামার কলার চেপে ধরলেন এবং বললেন, যাও, তুমি ও তোমার সম্পদ সবই তোমার পিতার। (তাফসীরে কুরতুবী)
সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দোয়া :
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তিন ব্যক্তির দোয়া ফেরত পাঠানো হয় না। পিতা-মাতার দোয়া মজলুম ব্যক্তির দোয়া এবং মুসাফির ব্যক্তির দোয়া সন্তানের প্রতি পিতা-মাতা বদ-দোয়া ।
পিতা-মাতার আনুগত্য :
পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবাযতœ জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাদের সাথে অসৎ আচরণ ও তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। পিতা-মাতার খেদমত, আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা সর্বাবস্থায় সন্তানের ওপর ওয়াজিব। পিতা-মাতার আনুগত্যের ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশ-
১. আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচারণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে ন¤্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো, হে প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (বনি ইসরাইল-১৭ আয়াত : ২৩-২৪)
২. এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, পিতা-মাতা যদি আমার কাউকে শরিক করার জন্য তোমার ওপর চাপ প্রয়োগ করে যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই তাহলে অবশ্যই তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ার জীবনে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। আর তাদের আনুগত্য করবে যারা আমার দিক প্রত্যাবর্তনকারী। (লুকমান-৩১ আয়াত : ১৫)
হাদীস :
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে পিতা-মাতার আনুগত্য করে, তার জন্য জান্নাতের দু'টি দরজা খোলা থাকবে এবং যে ব্যক্তি তাদের অবাধ্য হবে, তার জন্য জাহান্নামের দু’টি দরজা খোলা থাকবে।’
২. হযরত আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি তার নিকট এসে বললেন, আমার স্ত্রীকে আমার মা তালাক দেয়ার জন্য আদেশ দিচ্ছেন, তখন আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বর্ণনা করতে শুনেছি, পিতা-মাতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা। এখন তোমাদের ইচ্ছে, এর হেফাজত করো অথবা একে বিনষ্ট করে দাও। (জামে আত তিরমিযী)
৩. হযরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই এরশাদ করতে শুনেছি, "পিতা জান্নাতের দরজা সমূহের মধ্য হতে উত্তম দরজা। অতএব, তোমার ইচ্ছা (তার অবাধ্যতা করে ও তার মনে কষ্ট দিয়ে) এ দরজাকে ধ্বংস করে দিতে পার। অথবা (তার বাধ্যগত থেকে এবং তাকে সন্তুষ্ট রেখে) এ দরজাকে রক্ষা করতে পার”(তিরমিযী)।
৪. হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম.কে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, তা হল- আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, তাদের সাথে অসদাচারণ করা কিংবা তাদের আঘাত দেওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (সহীহ আল বুখারী)
দ্বিতীয়ত : মৃত্যুর পরবর্তী (মৃত্যুা পর) অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলামে পিতা-মাতার অধিকার এতই স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ যে, তা কখনো শেষ হয় না, এমনকি তাদের মৃত্যুর পরও কিছু অধিকার থেকে যায়। আমাদের অনেকেই মনে করে পিতা-মাতা মারা যাওয়ার পর তাদের আর খেদমত করার সুযোগ থাকে না। আসলে এ ধারণা সঠিক নয়। পিতা-মাতা মারা যাওয়ার পরও তাদের খেদমত করার সুযোগ থাকে। একজন ব্যক্তি ইচ্ছা করলে তার পিতা-মাতা মৃত্যুর পরও তাদের খেদমত করতে পারে। তাদের জন্য দোয়া করা, তাদের অসাপ্ত কর্মগুলো সমাপ্ত করা এবং তাদের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ভালো ব্যবহার ও তাদের সম্মান করা। এগুলোই হলো, পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের খেদমত। সন্তানের উপর তাদের মৃত্যু পরবর্তী কিছু অধিকারের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন মানুষ মারা যায়, তখন তিনটি আমল ছাড়া সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম এবং নেক সন্তান যারা তার জন্য দোয়া করবে।
২. হযরত আবু উসাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো হে আল্লাহ্র রাসূল ! পিতা-মাতা মৃত্যুর পরও কি এমন কোন পদ্ধতি সম্ভব যে, আমি তাদের সাথে সুন্দর আচরণ অব্যাহত রাখতে পারি। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জ্বী হাঁ। চারটি সুরত রয়েছে (১) পিতা-মাতা জন্য দোয়া এবং ইসতিগফার, (২) তাদের কৃত ওয়াদাসমূহ এবং বৈধ ওসিয়ত পূরণ, (৩) পিতার বন্ধু-বান্ধব এবং মাতার বান্ধবীদের ইজ্জত ও খাতিরদারী ও (৪) তাঁদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় ও সুন্দর আচরণ করা যাতে পিতা-মাতা দিক থেকে তোমাদের আত্মীয় হন। (আদাবুল মুফরাদ)।
৩. হযরত আবু উসাই রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন একদা আমরা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে বসা ছিলাম। হঠাৎ বনী সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! পিতা মাতার ইন্তেকালের পরেও কি তাদের হক আমার উপর আছে, যা পূরণ করতে হবে? হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ তাদের জন্য দোয়া ইসতেগফার করবে, তাদের কোন অসীয়ত থাকলে তা পূরণ করবে, পিতৃ ও মাতৃকূলের আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করবে এবং পিতা মাতার বন্ধু বান্ধবকে সম্মান করবে। (আবু দাউদ)
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতা-মাতার প্রতি সর্বাধিক উত্তম আনুগত্য হল তাদের মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গী সাথীদের সাথে সদ্ব্যবহার করা। (সহীহ মুসলিম)
৫. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সাদ ইবনে আছ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি (মৃত্যুর পূর্বে) একটি অঙ্গীকার করেছিলেন, যা তার পালন করা উচিৎ ছিল। অথচ তিনি তা করেন নি। উত্তরে তিনি বললে, তার পক্ষ থেকে তুমি তা পালন কর। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
৬. আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রায়ই এমনটি হয়ে থাকে যে, কোন ব্যক্তির পিতা-মাতার একজন কিংবা উভয়েই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সে তাদের জীবদ্দশায় যথাযথ সেবা যতœ করতে পারে নি। এভাবে নিজেকে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন থেকে বঞ্চিত করে। অতঃপর সে তার দোয়ার মধ্যে তাদেরকে স্মরণ করে এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহতায়ালা তার নাম পিতা-মাতা নাফরমানদের তালিকা থেক পরিবর্তন করে অনুগতশীলদের তালিকাভুক্ত করে নেন। (বায়হাকী)
এই হাদীস টি তাদের জন্যে শুভ সংবাদ বহন করে যারা পিতা-মাতার উভয়কে কিংবা তাদের একজনকে হারিয়েছে। কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, সে তার পিতা-মাতার প্রতি যথাযথ হক আদায় করেছে। অতএব, আমাদের উচিৎ হবে তাদের জীবদ্দশায় সাধ্যমত তাদের হক আদায় করার চেষ্টা করা এবং মৃত্যুর পরে তাদেরকে আমাদের দোয়ায় স্মরণ করা। তা কেবল তাদের জন্যেই উপকারী হবে না, বরং তাদের জীবদ্দশায় তাদের সেবা যতœ করার ক্ষেত্রে আমাদের ক্রুটি ও দুর্বলতাকেও মোচন করে দেবে।
মাইয়েতের মর্যাদা বুলন্দ :
নামাযের পর এবং অন্য সময় আল্লাহর নিকট কেঁদে কেঁদে দোয়া করুন যে, হে আল্লাহ্ ! আমার পিতা-মাতাকে ক্ষমা করুন। তাঁদেরর গুনাহসমূহকে ঢেকে দিন এবং তাঁদেরকে আপনি তাই দান করুন যা আপনি নেক বান্দাহ-বান্দীকে দিয়ে থাকেন। হে আল্লাহ্! যখন আমরা তাঁদেরও সাহায্য, হের লালন-পালনের মুখাপেক্ষি ছিলাম তখন তারা সবকিছু আমাদের জন্য ত্যাগ করেছিলেন। দিনে আয়েশ এবং রাতের আরাম আমাদের জন্য ত্যাগ করেছিলেন। পরওয়ারদিগার! এখন তাঁরা তোমার নিকট সমুস্থিত। শৈশবকালে অসহায় অবস্থায় আমরা তাঁদেরও মুখাপেক্ষি ছিলাম। এখন তাঁরা সেই সময়ের চেয়ে বেশী তোমার রহমাত ও সুদৃষ্টির মুখাপেক্ষি। পরওয়ারদিগার! তুমি তাঁদেরকে নিজের রহমাতের ছায়া দান করো এবং নিজের সন্তুষ্টির ঘর জান্নাতে তাঁদেরও আশ্রয় দাও।
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, মৃত্যুর পর যখন মাইয়েতের মর্যাদা বুলন্দ হয় তখন সে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে এটা কেমন করে হলো ? তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় যে, তোমার সন্তানরা তোমার জন্য দোয়া ও মাগফিরাত কামনা অব্যাহত রেখেছে এবং আল্লাহ্ তা কবুল করে নিয়েছেন।
পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনের সাথে আচরণ :
পিতা-মাতা ওফাতের পর তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুন্দর আচরণ করা। মাতামহের পক্ষের আত্মীয় যেমন খালা, মামা, নানা-নানী প্রভৃতি এবং পিতামহের পক্ষেও আত্মীয় যেমন চাচা, ফুফু, দাদা-দাদী ইত্যাদি। এ সকল আত্মীয় থেকে মুখাপেক্ষীহীনতা থাকা এবং বেপরোয়া ভাব প্রদর্শন প্রকৃতপক্ষে পিতা-মাতা প্রতি মুখাপেক্ষীহীন থাকার নামান্তর এবং একজন মুমিন ও মুমিনা পিতা-মাতা সাথে বেপরোয়ামূলক আচরণ করতে পারে না। পিতা-মাতা বন্ধুদের সম্মান করা পিতা-মাতা বন্ধুদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, তাদেরকে দেখতে যাওয়া, তাদেরকে হাদিয়া দেয়া।
১. আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে’। (সহীহ ইবন হিববান)
২. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একটি বড় পূণ্য কাজ হল পিতার বন্ধুদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা। (সহীহ মুসলিম)
৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি পাপ করেছি। আমার ক্ষমা পাওয়ার কোন পথ আছে কি? তিনি জানতে চাইলেন, তাঁর মাতা জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি বলল, না’। তিনি জানতে চাইলেন, তার মাতার ভগ্নি জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তাকে ভালভাবে সেবা যতœ কর। (জামে আত তিরমিযী)
এই হাদীসটি আমাদেরকে দুটি বুনিয়াদি বিষয় শিক্ষা দেয়।
প্রথমত : যদি কোন ব্যক্তি কোন পাপ কাজ করে বসে এবং এর দ্বারা আল্লাহতায়ালাকে অসন্তুষ্ট করে, সে তার মায়ের সেবা করার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ফিরে পেতে পারে।
দ্বিতীয়ত : যদি তার মাতা মৃত্যুবরণ করে তবে সে তার মায়ের ভগ্নির সেবার মাধ্যমেও আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি ফিরে পেতে পারে।
৪. আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের এরশাদ হলো, তোমরা তোমাদের পিতা ও পিতামহের সাথে কখনও বেপরোয়ামূলক আচরণ করবে না। পিতা-মাতা সাথে বেপরোয়ামূলক আচরণ করা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ার শামিল।
৫. আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এক বেদুঈন এর সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন যে গাধায় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আব্দুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিলো তা তাকে প্রদান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রাহেমাহুল্লাহ বললেন, তখন আমরা আব্দুল্লাহকে বললাম : আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ: সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায়-(এতসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?) উত্তরে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভাল ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ”। (সহীহ মুসলিম)
৬. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন বকরী যবেহ করতেন, তখনই তিনি বলতেন, এর কিছু অংশ খাদীজার বান্ধবীদের নিকট পাঠিয়ে দাও। (সহীহ মুসলিম)
৭. বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মায়ের ভগ্নি মায়ের সমতুল্য। (জামে আত তিরমিযী)
দান-ছাদকাহ করা, বিশেষ করে সাদাকায়ে জারিয়াহ প্রদান করা :
মা-বাবা বেঁচে থাকতে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেন নি বা বেচে থাকলে আরো দান-সদকাহ করতেন, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে সন্তান দান-সদকাহ করতে পারে। হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই কোন অছিয়ত করতে পারেন নি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-ছাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে ছাদকা করলে তিনি কি এর ছাওয়াব পাবেন ? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।” (সহীহ মুসলিম)
তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সাদাকায়ে জারিয়া বা প্রবাহমান ও চলমান সাদাকা প্রদান করা। যেমন পানির কুপ খনন করা, নলকুপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কোরান শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা ইত্যাদি।
পিতা-মাতা পক্ষ থেকে সিয়াম পালন :
মা-বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তাদের কোন মানতের সিয়াম কাযা থাকে, সন্তান তাদের পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করলে তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমতাবস্থায় যে তার উপর রোজা ওয়াজিব ছিল। তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিসগণ রোজা রাখবে”। (সহীহ আল বুখারী)।
অধিকাংশ আলেমগণ এ হাদীসটি শুধুমাত্র ওয়াজিব রোজা বা মানতের রোজার বিধান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে নফল সিয়াম রাখার পক্ষে দলীল নাই।
হজ্জ বা উমরাহ করা :
পিতা-মাতা পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং তারা উপকৃত হবে। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, “জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা হজ্জ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ্জ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ কর। তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না ? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা আল্লাহর দাবী পরিশোধ করার অধিক উপযোগী”। (সহীহ আল বুখারী)
তবে পিতা-মাতা পক্ষ থেকে যে লোক হজ্জ বা ওমরাহ করতে চায় তার জন্য শর্ত হলো সে আগে নিজের হজ্জ-ওমরাহ করতে হবে।
পিতা-মাতা পক্ষ থেকে কুরবানী করা :
পিতা-মাতা পক্ষ থেকে কুরবানী করলে তার ছাওয়াব দ্বারা তারা উপকৃত হবে। এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি শিংযুক্ত দুম্বা উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন, যার পা কালো, চোখের চতুর্দিক কালো এবং পেট কালো। অতঃপর তা কুরবানীর জন্য আনা হলো। তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আস, তারপর বললেন, তুমি একটি পাথর নিয়ে তা দ্বারা এটাকে ধারালো কর। তিনি তাই করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাটিকে শুইয়ে দিলেন। পশুটি যবেহ করার সময় বললেন, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, হে আল্লাহ তুমি এটি মুহাম্মাদ, তাঁর বংশধর এবং সকল উম্মাতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থকে কবুল কর”। এভাবে তিনি তা দ্বারা কুরবানী করলেন। (সহীহ মুসলিম)
পিতা-মাতা ওয়াদা, মান্নত ও ওসিয়ত পূরণ করা :
পিতা-মাতা জীবিত অবস্থায় বিভিন্ন ব্যাপারে অনেক লোকের সাথে ওয়াদা করে থাকতে পারেন। মান্নত কিছু করতে পারেন। মৃত্যুর সময় কিছু ওসিয়ত করতে পারেন। পিতা-মাতা ইন্তেকালের পর সন্তানের জন্য তাঁদের সাথে সুন্দর বা নেক আচরণের একটি পথ অবশিষ্ট থাকে। তাহলো তাঁদের কৃত ওয়াদা, মান্নত ও ওসিয়তসমূহ পূরণ করা। আর এভাবেই তাঁদের রূহকে খুশী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু তাঁদের জায়েয বা বৈধ ওসিয়তই পূরণ করতে হবে। তাঁদের অবৈধ ওসিয়তও পূরণ করা যাবে না।
পিতা-মাতা ওয়াদা পূরণ করা :
পিতা-মাতা যদি কারোর সাথে আর্থিক সাহায্য দানের ওয়াদা করে থাকেন অথবা কাউকে কিছু দান করতে চেয়ে থাকেন। আর জীবনে যদি তার সুযোগ না পান অথবা তাঁরা কোন মানত করেছিলেন, কিন্তু তা পূরণের আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। অথবা তিনি ঋণী ছিলেন অথবা ওসিয়াত করার সুযোগ পাননি, অথচ আপনি বুঝেন যে, সুযোগ পেলে তিনি অবশ্যই এ ওসিয়াত করতেন অথবা তিনি কোন ওসিয়াত করেননি। আপনি যদি তাঁদের পক্ষ থেকে সাদকাহ করেন তাহলে এসবই তাঁদের সাথে নেক আচরণ হবে। আর এভাবেই তাঁদের ওফাতের পরও আপনি জীবনভর তাঁদের সাথে সুন্দর আচরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন।
১. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সাদ ইবনে আছ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি (মৃত্যুর পূর্বে) একটি অঙ্গীকার করেছিলেন, যা তার পালন করা উচিৎ ছিল। অথচ তিনি তা করেন নি। উত্তরে তিনি বললে, তার পক্ষ থেকে তুমি তা পালন কর। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
মান্নত পূরণ করা :
১. মা-বাবা কোন মান্নত করে গেলে সন্তান তার পক্ষ থেকে পূরণ করবে। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, কোন মহিলা রোজা রাখার মান্নত করেছিল, কিন্তু সে তা পূরণ করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করল। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলে তিনি বললেন, তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন কর। (সহীহ ইবনে হিববান)
২. ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। সা’আদ ইবনে উবাদাহ নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তার মায়ের মান্নত সম্পর্কে ফতোয়া চাইলেন যে মান্নত পুরা করার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফতোয়া দিলেন। তার পক্ষ থেকে মান্নত পুরা করে দাও। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
পিতা-মাতা ওসিয়ত পূর্ণ করা :
মা-বাবা শরীয়াহ সম্মত কোন ওসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা সন্তানদের উপর দায়িত্ব।
১. হযরত রাশীদ ইবনে সুয়াইদ আসসাকাফী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ডাকো, সে আসল, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে ? উত্তরে সে বলল, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে ? উত্তরে সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও; কেন না সে মু’মিনা। (সহীহ ইবনে হিববান)
কোন গুনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করা :
মা-বাবা বেচে থাকতে কোন গুনাহের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা বন্ধ করবে বা শরীয়াহ সম্মতভাবে সংশোধন করে দিবে। কেননা হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এবং যে মানুষকে গুনাহের দিকে আহবান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোন কমতি হবে না” (সহীহ মুসলিম)।
পিতা-মাতা পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া :
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জান নিঃস্ব ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (জামে আত-তিরমিযী)
পিতা-মাতা বেচে থাকতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো উপর জুলুম করে থাকলে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে পিতা-মাতা পক্ষ থেকে তার কাছ থেকে মাফ মাফ চেয়ে নিবেন অথবা ক্ষতি পূরণ দিয়ে দিবেন।
পিতা মাতার জন্য বেশী বেশী দোয়া করা :
মৃত্যুর পরে পিতা-মাতার অধিকার :
আসুন, জীবনের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই আল্লাহর কিতাবে শিখানো বাক্যে পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করি।
মৃত্যুর পরে পিতা-মাতার অধিকার :
আসুন, জীবনের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই আল্লাহর কিতাবে শিখানো বাক্যে পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করি।
মৃত্যুর পরে পিতা-মাতার অধিকার :
আসুন, জীবনের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই আল্লাহর কিতাবে শিখানো বাক্যে পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করি।
আমাদের নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, সন্তানদের জন্য এবং মুমিন নর-নারীদের জন্য দোয়া করতে হবে। পিতা-মাতার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে, শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে দয়াময় আল্লাহর আশ্রয় নিতে হবে।
কুরআন :
১. ‘বলুন, হে আমার পালনকর্তা! আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি’। (মুমিনূন-২৩ আয়াত : ৯৭)।
২. “হে আমার রব! তুমি আমাকে তাওফিক দাও, আমি যেন তোমার সেই সব নি’আমতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, বা তুমি আমাকে আর আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যেন এমন নেক ‘আমল করতে পারি যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও, আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কওে আমার প্রতি অনুগ্রহ করো, আমি অনুশোচনাভওে তোমার দিকে ফিওে আসছি, আর আমি অনুগত বান্দাদেও অর্ন্তভুক্ত।’ (সূরা আল আহক্বা-৪৬ আয়াত : ১৫)। পৃথিবীর এই জীবনে তারাই নেক সন্তান যারা পিতা-মাতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে দু’আ করে তাদের জীবদ্দশায় এবং তাদের মৃত্যুর পরও। এ কারণে, কৃতজ্ঞতা আদায়ে আসুন আমরাও আল্লাহর কাছে এভাবে দু’আ করি-
৩. “রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা।” “হে আমার রব! আমাদের পিতা-মাতাকে অনুগ্রহ করো, যেভাবে তারা আমাদের শৈশবে আমাদে প্রতি দয়া করেছেন।” (সূরা ইসরা-১৭ আয়াত : ২৪)।
৪. “রাব্বিগ ফিরলি ওয়ালি, ওয়ালি দাইয়া ওয়ালিল মু’মিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।” “হে আমাদের প্রতিপালক! হিসাব গ্রহণের দিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে আর মু’মিনদেরকে ক্ষমা করে দিও।” (সূরা ইবরাহীম-১৪ আয়াত : ৪১)।
হাদীস :
১.হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না- ১. সদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেকসন্তান- যে তার জন্য দোয়া করে। (সহীহ মুসলিম)
মায়ের জন্যে নূহ (আ.)-এর দোয়া :
হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে এবং মুমিন নারী পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি জালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না। (নূহ-৭১ আয়াত :২৮)
ইয়াহইয়া (আ.) ও তাঁর পিতা-মাতা :
হে ইয়াহইয়া! তুমি কিতাবটিকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধর। আমি তাকে শৈশবেই প্রজ্ঞা দান করেছি। আর আমার পক্ষ থেকে তাকে স্নেহ মমতা ও পবিত্রতা দান করেছি এবং সে মুত্তাকী ছিল। আর সে ছিল তার পিতা-মাতার সাথে সদাচারী, আর ছিল না অহংকারী, অবাধ্য। (মারাইয়াম-১৯ আয়াত : ১২-১৪)
ঈসা (আ.) ও তাঁর মা :
শিশুটি বলল, আমি তো আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। আর যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যতদিন আমি জীবিত থাকি তিনি আমাকে সালাত ও জাকাত আদায় করতে আদেশ করেছেন। আর আমাকে মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে অহংকারী, অবাধ্য করেন নি। (মারইয়াম-১৯ আয়াত : ৩০-৩২)
হযরত ইবরাহীম (আ.) এর দোয়া :
হে আমার পালনকর্তা! আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন এবং সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা! কবুল করুন আমার দো’য়া। হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন। (ইবরাহীম-১৪ আয়াত : ৪০ ও ৪১)
তৃীয়ত পর্ব : পিতা-মাতার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য আদায়ের পুরস্কার ও অনাদায়ের শাস্তি।
পিতা-মাতার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য আদায়ের পুরষ্কার :
মুফাচ্ছির-এ কুরআনেরা পিতা-মাতার আনুগত্য বলতে এই বুঝিয়েছেন-‘তাঁরা যাতে সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারেন সেদিকে সন্তানের সুদৃষ্টি রাখা এবং সন্তানের এমন কোনো কাজ না করা যার দ্বারা পিতা-মাতার মনে আঘাত আসে। এবং তাঁদের ইসলামসম্মত সমস্ত আদেশ-নিষেধ পালন করা। যদি তাঁরা ইসলাম বিরোধী কোনো আদেশ দেন অথবা শক্তি প্রয়োগ করেন তাহলে সন্তান পিতা-মাতার আদেশ অমান্য করে আল্লাহর বিধান মান্য করবে। কিন্তু এমতাবস্থায়ও তাঁদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায়ের পাশাপাশি পিতা-মাতার অবদানের জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে পবিত্র কুরআনে-
১. আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুবছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। (লোকমান-৩১ আয়াত : ১৪)
২. অতঃপর সুলাইমান তার কথায় মুচকি হাসল এবং বলল, হে আমার রব, তুমি আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছ তার জন্য আমাকে তোমার শুকরিয়া আদায় করার তাওফিক দাও। (আন-নামাল-২৭ আয়াত : ১৯)
৩. আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তার গর্ভ ধারণ ও দুধ পান ছাড়ানোর সময় লাগে ত্রিশ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং চল্লিশ বছরে উপণীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব, আমাকে সামর্থ দাও, তুমি আমার উপর ও আমার পিতা-মাতার উপর যে নিয়ামত দান করেছ, তোমার সে নিয়ামতের যেন আমি শুকর আদায় করতে পারি এবং আমি যেন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পছন্দ কর। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয় আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। এরাই যাদের উৎকৃষ্ট আমলগুলো আমি কবুল করি এবং তাদের মন্দ কাজগুলো আমি ক্ষমা করে দেই। (আল-আহক্বাফ-৪৬ আয়াত : ১৫- ১৬)
৪.শুধু রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথাই নয়। আল্লাহতায়ালা রাসুলের সাহাবীদের পরস্পরে রহম বা দয়া চর্চাকারী বলে প্রশংসা করেছেন। পবিত্র কোরানে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল এবং তার সঙ্গে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়।’ (আল ফাতহ-৪৮ আয়াত : ২৯)।
আল্লাহতায়ালার নিয়ামতরাজিকে যেমন কেউ গণনা করে শেষ করতে পারে না, তেমনিভাবে পিতা-মাতার অনুগ্রহকেও কেউ হিসেব করে শেষ করতে পারবে না। কুরআন মাজিদ তাই আমাদেরকে বলে-প্রথমত: আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এবং অত:পর পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অর্থ এই নয় যে, কেবল ধন্যবাদ (ঞযধহশ ুড়ঁ) বলবে। বরং তার অর্থ আমাদের এমন এক জীবনাচরণ পদ্ধতি ও মনোভঙ্গি যা আল্লাহতায়ালার প্রতি ও অতঃপর আমাদের পিতা-মাতার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধকে প্রতিফলিত করে।
এই আয়াতগুলি সেসব ঈমানদারের মনোভাবকে ব্যক্ত করে যাদের মন্দকর্মসমূহ আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাদের একটি গুণ হল যে, তারা তাদের উপর আল্লাহতায়ালার নিয়ামতসমূহের জন্যে শুকরিয়া আদায় করে এবং যুগপৎভাবে, তারা তাদের পিতা-মাতার উপর আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ সমূহের জন্যেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
হাদীস :
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মা-বাবা সম্পর্কিত আল্লাহর নাজিলকৃত নির্দেশ এবং হেদায়াত অবস্থায় দিন শুরু করল, সে যেন নিজের জন্য জান্নাতের দু’টি দরজা খোলা অবস্থায় দিন শুরু করল। যদি পিতা-মাতা মধ্যে কোনো একজন হয় তাহলে যেন জান্নাতের একটি দরজা খোলা অবস্থায় পেল। আর যে ব্যক্তি মা-বাবা সম্পর্কিত আল্লাহর নির্দেশ ও হেদায়াত অমান্য করল, তাহলে তার জন্য জাহান্নামের দু’টি দরজা খোলা হবে। যদি পিতা-মাতা মধ্যে কোনো একজন হয় তাহলে যেন জাহান্নামের একটি দরজা খোলা অবস্থায় পেল। সে ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি মা-বাবা তার সাথে বাড়াবাড়ি করে তাহলেও? তিনি বললেন, যদি বাড়াবাড়ি করে থাকেন তাহলেও। যদি বাড়াবাড়ি করে থাকেন তাহলেও। যদি বাড়াবাড়ি করে থাকেন তাহলেও। (মিশকাত)
২. নবী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। সৃষ্টির প্রতি রহম বা দয়া করলে ¯্রষ্টার দয়া-করুণা-রহমত লাভ করা যায়। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দয়াকারীদের প্রতি মহান দয়াময় আল্লাহ রহম ও দয়া করেন। দুনিয়াতে যারা আছে; তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন; তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (আবু দাউদ ওজামে আত তিরমিজি)
৩. ইমাম আহমাদ ও তাবারানি (রহ.) বর্ণিত বিশুদ্ধ সনদে ও নির্ভরযোগ্য সুত্রে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা মিম্বরে দাঁড়ানো অবস্থায় বলেন, তোমরা দয়া করো, দয়া পাবে। ক্ষমা করো, ক্ষমা পাবে’। (মুসনাদে আহমদ)।
৪. জারির ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি রহম করে না আল্লাহতায়ালা তার প্রতি রহম করেন না। (সহীহ মুসলিম)
৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতা-মাতার হকের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার অনুগত হয়ে যে ব্যক্তি ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, প্রভাতে তার জন্যে জান্নাতের দুটি দরজা খুলে যায়। আর যদি কেবল একজন বেচে থাকেন তখন তার জন্যে শুধু একটি দরজা খুলে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পিতা-মাতার হকের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার অবাধ্য হয় তার জন্যে জাহান্নামের দু’টি দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আর যদি কেবল একজন বেঁচে থাকেন তবে শুধু একটি দরজাই খুলে দেওয়া হয়। এক ব্যক্তি জানতে চাইল, যদি পিতা-মাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়, তবুও কি এরূপ হবে? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, যদিও পিতা-মাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। যদিও পিতা-মাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। যদিও পিতা-মাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। (বায়হাকী)
৬. হযরত যাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে আল্লাহতায়ালা তার মৃত্যুকে সহজ করবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর তা হল, দুর্বলদের প্রতি দয়া, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও দাস-দাসীদের (চাকর চাকরাণীদের) প্রতি ভাল আচরণ। (বায়হাকী)
৭. হযরত ছাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দোয়া ব্যতিত অন্য কিছুই ভাগ্যকে বদলাতে পারে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদাচার ব্যতিত অন্য কিছুই আয়ুকে প্রলম্বিত করতে পারে না। কোন ব্যক্তি তার পাপের কারণে তার রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাজাহ) জীবন প্রলম্বিত হওয়া সম্পর্কে বিজ্ঞজনেরা বলেন, এ থেকে উদ্দেশ্য জীবনে সৎকাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, বছরের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অনুগত সে জীবনে ভাল কাজ করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ লাভ করবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি পিতা-মাতার অবাধ্য হবে সে বিভিন্ন রোগ, শোক, দুঃখ বেদনা ও পেরেশানিতে আক্রান্ত হবে এবং জীবনে ভাল কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
৮. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতা-মাতার আনুগত্য কর এবং তাদের সাথে সদয় ব্যবহার কর। কেননা, যদি তুমি তেমনটি কর তবে তোমার ছেলেমেয়েরাও তোমার আনুগত্য করবে এবং তোমার সাথে সদয় ব্যবহার করবে। (তাবরানি)
৯. কথিত আছে, এক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ পিতার সেবা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাই সে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। একদিন সে তার পিতাকে কাপড়ে মুড়িয়ে একটি কূপের কাছে নিয়ে গেল। যখনই সে তাকে কূপে নিক্ষেপ করার উপক্রম হল, তখন তার পিতা তাকে বলল, তার একটি শেষ ইচ্ছা রয়েছে এবং সে যেন তা পূর্ণ করে। ছেলে তাকে তার শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলল, তার শেষ ইচ্ছা হল, সে যেন তাকে এই কুপে নিক্ষেপ না করে অন্য কোন কুপে নিক্ষেপ করে। ছেলে তার এ ইচ্ছার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে পিতা বলল, সে তার পিতাকে ইতোপূর্বে এই কুপটিতে নিক্ষেপ করেছিল। ছেলে এ থেকে একটি বার্তা পেল এবং তৎক্ষণাৎ পিতাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আর আমৃত্যু ভালভাবে তার সেবা যতœ করল।
১০. আল্লাহ পাক হযরত মুসা (আঃ)-কে ওহীর মাধ্যমে জানালেন, পিতা-মাতাকে সম্মান কর। কেননা যে ব্যক্তি পিতা-মাতাকে সম্মান করে, আমি তার হায়াত বাড়িয়ে দেই, তাকে এমন সন্তান দান করি যে তাকে সম্মান করে। আর যে পিতা-মাতাকে অসম্মান করে আমি তার হায়াত কমিয়ে দেই,তাকে অবাধ্য সন্তান দান করি।
১১. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি নিদ্রামগ্ন ছিলাম এবং স্বপ্নে দেখতে পেলাম যে, আমি বেহেস্তে প্রবেশ করেছি। তাতে কাউকে কুরআন তেলাওয়াত করতে শুনলাম এবং আমি জানতে চাইলাম, আল্লাহর কোন বান্দা বেহেস্তের মধ্যে কুরআন তেলাওয়াত করছে? আমাকে বলা হল, তিনি হচ্ছেন হারিছা ইবনে নুমান। পরে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হারিছা ইবনে নুমান তার মায়ের খুব অনুগত ছিল এবং তার খুব সেবা যতœ করত। (বায়হাকী)
১২. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন: একদা তিন ব্যক্তি পথিমধ্যে বৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ায় একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করল। একটি পাথর গড়িয়ে এসে গুহার মুখকে সম্পূর্ণরুপ বন্ধ করে দিলে তিন ব্যক্তিই গর্তের মধ্যে আটকা পড়ে গেল। তারা পরস্পর পরস্পরকে বলল, চল, আমরা আমাদের এমন কোন পূণ্য কাজের কথা স্মরণ করি যা আমরা একান্তভাবে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য করেছি এবং তার উসীলায় আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন তিনি গর্ত থেকে পাথরটি সরিয়ে দেন।
প্রথম : তাদের একজন বলল, হে আল্লাহ! আমার বৃদ্ধ ও দুর্বল পিতা-মাতা রয়েছে এবং ছোট ছেলেমেয়েও আছে। যাদের জন্য আমি ভেড়া পালন করি। যখন আমি রাতের বেলা ঘরে ফিরি প্রথমে পিতা-মাতাকেই আমি দুগ্ধ পান করতে দেই এবং অতঃপর ছেলেমেয়েকে দেই। একদিন আমি রাতের বেলা দেরীতে ঘরে ফিরে পিতা-মাতা উভয়কেই নিদ্রিত অবস্থায় পেলাম। আমি অন্যদিনের মত দুধ নিয়ে তাদের কাছে গেলাম এবং তাদের নিকটে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি তাদেরকে ঘুম থেকে জাগানো পছন্দ করলাম না এবং এও চাইলাম না যে, প্রথমে আমার ছেলেমেয়েকে দুধ পান করতে দেব। যদিও আমার ছেলেমেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় কান্নাকাটি করছিল। আমি ভোর হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজটি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি তবে আমাদের উপর থেকে পাথরটিকে সরিয়ে দিন। এতে আল্লাহতায়ালা গর্তের উপর থেকে পাথরটিকে কিছুটা সরিয়ে দিলেন।
দ্বিতীয় : লোকটি বলল, সে তার এক চাচাত বোনকে ভালবাসত এবং সে তার সাথে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যখন সে (চাচাত বোন) তাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিল সে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকল। অতঃপর সে দোয়া করে বলল, হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজটি কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যে করে থাকি তবে গর্তের উপর থেকে পাথরটিকে সরিয়ে দিন। আল্লাহতায়ালা তার দোয়া কবুল করেন এবং পাথরটি গর্তের মুখ থেকে আরও কিছুটা সরে গেল।
তৃতীয় : ব্যক্তি বলল, সে এক লোকের সাথে একটি অংশীদারী কারবার করত। লোকটি অন্যত্র চলে গেলে সে একাই তা দেখাশুনা করতে থাকে এবং তার অংশীদারের অংশের হিসাব রাখত। যখন অংশীদার ফিরে এল সে তার অংশ লাভসহ বুঝিয়ে দিল। অতঃপর সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলল, হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজ কেবলমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, আপনি এর উসীলায় গর্তের মুখ থেকে পাথরটি সরিয়ে দিন। আল্লাহতায়ালা তার প্রার্থনা কবুল করলেন এবং গর্তের মুখ সস্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হয়ে গেল। আর তারা তা থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হলো। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
১৩. হযরত আমর বিন মুররা আলজুহানী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে বললো,” হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি যদি পাচঁ ্ওয়াক্ত নামায পড়ি, রমযানের রোযা রাখি, যাকাত প্রদান করি এবং হজ্জ করি, তাহলে আমি কি পাবো? তিনি বললেন, ”সঠিকভাবে এগুলো আদায় করলে, সে নবীগণ, সিদ্দীকগণ শহীদগণ ও সৎকর্মশীলদের সাথী হবে। তবে পিতা-মাতার অবাধ্যচারী এ প্রতিদান হতে বাদ পড়বে। (মুসনাদে আহমদ, তিবরানী)
পিতা-মাতার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য অনাদায়ের শাস্তি :
পিতা-মাতার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করলে রয়েছে পুরষ্কার আর পিতা-মাতার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন না করলে রয়েছে শাস্তি। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন-
১. আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি আপন পিতা-মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করার। (আনকাবুত-২৯ আয়াত : ৮)
বিভিন্ন হাদীসে বারবার ঘোষণা করা হয়েছে যে, পিতা-মাতার অবাধ্যতা বা কোনভাবে তাদের মনে কষ্ট দেয়া কবীরা গুনাহ। শিরকেরভয়ংকরতম মহাপাপ হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা।
১. এক হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেও উপর পিতা-মাতার অবধ্য হওয়া, কন্যা শিশুদেও জীবন্ত কবর দেয়া, কারো প্রাপ্য অধিকার আদায়ে বিরত থাকা ও জোর পূর্বক কারো কিছু গ্রহন করা হারাম করে দিয়েছেন। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
২. রাসূল (সা.) বালেন, কঠিনতম কবীরা গুনাহ আল্লাহর সাথে শিরক করা, এরপর পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। (সহীহ আল বুখারী)
৩. অন্য হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের দিকে তাকাবেন না। যথা- ১.পিতা-মাতার অবাধ্য,২.পুরুষের পোশাক বা সাজগোজ পরিধানকারী মহিলা,৩. দাইউস-যে তার পরিবারের সদস্যদের অশ্লীলতা মেনে নেয়। (সুনানে আন-নাসায়ী)
৪. হযরত আবু বারকাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা ইচ্ছা করলে সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, পিতা-মাতার নাফরমানী ব্যতিত। আর তিনি পিতা-মাতার অবাধ্যতার শাস্তি মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। (বায়হাকী)
৫. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সে ব্যক্তি ধ্বংস হয়েছে, সে ব্যক্তি ধ্বংস হয়েছে, সে ব্যক্তি ধ্বংস হয়েছে। বলা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ সে কোন ব্যক্তি? তিনি বললেন যে ব্যক্তি বৃদ্ধাবস্থায় পিতা-মাতার একজনকে অথবা উভয়কে পেয়েও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না। (সহীহ মুসলিম)
৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : পিতা-মাতা সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতা অস্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত। (জামে আত তিরমিযী)
৭. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ঃ যে মা-বাবাকে গালি দেয় আল্লাহ তাকে লা’নত করেন। (ইবনে হাব্বান)
৮. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : উপকার করে খোটাদানকারী, পিতা-মাতা বিরুদ্ধাচরণকারী ও মদ পান কারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (আন নাসায়ী দারেমী)
৯. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কবিরা গুনা হল : আল্লাহর সাথে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, মানুষ হত্যা করা এবাং মিথ্যা কসম খাওয়া। (সহীহ আল বুখারী)
১০. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ঃ পিতা-মাতা অবাধ্য সন্তানের উপর আল্লাহ অভিশাপ করেছেন।
১১. হযরত বায়হাকী (রহঃ) এর এক রেওয়াতে বর্নিত আছে যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, "সমস্ত গুনাহ আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দেন, কিন্তু যে ব্যক্তি পিতা-মাতা নাফরমানী এবং তাদের মনে কষ্টদায়ক কাজ করে,তাকে আখেরাতের পূর্বে দুনিয়াতেই বিভিন্ন বিপদ আপদে লিপ্ত করে দেওয়া হয়।
১২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ঃ আল্লাহপাক সকল গুনাহের শাস্তি যত দিন ইচ্ছা বিলম্বে করেন, এমনকি তা কেয়ামত পযর্ন্ত বিলম্বিত করেন, কিন্তু পিতা-মাতা সাথে অবাধ্যতার শাস্তি মৃত্যুর পূর্বেই করে থাকেন। অর্থাৎ কিয়ামতের আগেই দুনিয়ার জীবনেই তার শাস্তি শুরু হয়ে যায়। (হাকেম)
১৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ঃ যে লোক পিতা-মাতার অবাধ্য কিংবা তাদের সাথে অসৎ ব্যবহার করে, তাকে দ্রুত শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তার হায়াত কমিয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি পিতা-মাতার বাধ্য, আল্লাহ তার হায়াত বাড়িয়ে দেন, যেন সে বেশী বেশী ভাল কাজ করে অধিক সওয়াব ও মঙ্গল লাভ করতে পারে। পিতা-মাতা প্রতি এভাবেও ভাল আচরণ করা যায় যে, তারা যখন অক্ষম হয়ে পড়েন তখন তাদের চাহিদা অনুযায়ী অভার পূরণ করে দেওয়া। (ইবনে মাজা)
১৪. হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এব কাছে প্রশ্ন করা হল, আ’রাফ কি? সেখানে কারা বাস করবে? তিনি বললেন : আ’রাফ জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী একটি পাহাড়। একে আ’রাফ নাম করন করা হয়েছে কারণ, এখান থেকে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখা যাবে এবং এতে ফলবান গাছ, র্ঝনা সব কিছুই থাকবে। পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতিত যারা জিহাদে গিয়ে শহীদ হয়েছে, তারা সাময়িকভাবে এখানে থাকবে। জিহাদে গিয়ে শহীদ হওয়ার কারণে জাহান্নামের পথ আর পিতা-মাতার অবাধ্যতার কারণে জান্নাতের পথ বন্ধ থাকবে। তাদের ব্যাপারে আল্লাহপাকের চুড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পযর্ন্ত তারা এখানে থাকবে। (ইবনে মাজা)
১৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : চার শ্রেণীর লোককে আল্লাহ বেহেশতে প্রবেশ করতে দিবেন না, (১) মদখোর (২) সুদখোর (৩) ইয়াতীমের মাল আত্মসাতকারী (৪) পিতা-মাতার অবাধ্যচারী। তবে তওবা করলে ভিন্ন কথা। (হাকেম)
১৬. আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন সাহাবী আলকামা নামাজ রোজার ক্ষেত্রে খুবই নিয়মানুবর্তী ছিলেন। যখন তার মৃত্যু নিকটবর্তী হল, লোকেরা তাকে কালেমার তালকীন করলেন। কিন্তু, তিনি তা পড়তে সমর্থ হলেন না। এই অবস্থা তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানোর জন্যে লোক পাঠালেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার পিতা-মাতা বেঁচে আছেন কিনা। তাঁকে জানানো হল, আলকামার মা বেঁচে আছেন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে হাজির হলেন। তিনি আলকামা সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, সে একজন দীনদার লোক। তবে তার উপর স্ত্রীকে বেশি প্রাধান্য দেয় এবং তাকে অমান্য করে। তাই তিনি তার উপর অসন্তুষ্ট। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিতে বললেন। কিন্তু তিনি তাতে সম্মত হলেন না। তিনি তখন বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে জ্বলন্ত আগুনে আলকামাকে নিক্ষেপ করতে বললেন। মা একথা শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বাস্তবিকই আলকামাকে আগুনে পোড়াতে ইচ্ছুক কিনা? তিনি তখন বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহতায়ালার শাস্তি এই শাস্তি থেকেও অনেক কঠিন। আল্লাহর কসম! আপনি যতক্ষণ আপনার ছেলের উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন, তার না কোন নামাজ আল্লাহর কাছে কবুল হবে আর না কোন দান। আলকামার মা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে এবং উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আলকামাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আলকামার অবস্থা দেখার জন্যে কাউকে তার কাছে পাঠালেন। তখন সে এই সুসংবাদ নিয়ে ফিরে এল যে, আলকামা কালেমা পাঠ করে মৃত্যুবরণ করেছে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তার জানাজায় গেলেন এবং বললেন, মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তার মায়ের অবাধ্য হবে কিংবা তাকে অসন্তুষ্ট করবে, তার উপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেস্তা ও সকল মানুষের অভিসম্পাত বর্ষিত হবে। আল্লাহতায়ালা তার কোন কাজ কিংবা নফল ইবাদত কবুল করবেন না, যতক্ষণ না সে অনুশোচিত হবে, মায়ের যথাযথ পরিচর্যা ও সেবা করবে এবং তাকে সন্তুষ্ট করবে।’ (তাবরানি)
এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসারদের সম্বোধন করেছেন। কেননা, তখন তার আশেপাশে কেবল তারাই ছিলেন। অধিকন্তু, তিনি কেবল মায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা, ঘটনাটি মায়ের সন্তুষ্টির সাথে সম্পর্কিত ছিল। যা হোক, এটি পরিষ্কার যে, এই নির্দেশনাটি সকল মুমিনের জন্যে এবং পিতা-মাতা উভয়ের সন্তুষ্টির কথা বলে, বিশেষতঃ মায়ের। আমাদের জেনে রাখা উচিৎ যে, আলকামা ছিলেন খুব ধার্মিপরায়ন ব্যক্তি লোক এবং তার নামাজ রোজার ব্যাপারে খুবই নিয়মানুবর্তী। তিনি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন সাহাবীও ছিলেন। এসব কিছুই মৃত্যুর সময় তাকে সাহায্য করতে পারে নি। তিনি মৃত্যুর সময় কালিমা শাহাদাত পাঠের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন কেবল তার মাকে অসন্তুষ্ট করার কারণে। আমাদের সেই হাদীস ও স্মরণ রাখতে হবে যাতে এসেছে, যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মৃত্যূবরণ করবে যে, তার শেষ কথা হবে কালেমা, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেউ বলতে পারে না কখন মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে। অতএব, আমাদেরকে শীঘ্রই আমাদের মাতা পিতার, বিশেষ করে মায়ের সন্তুষ্টি কামনা করতে হবে। অন্যথায় আমরাও মৃত্যুর সময় কালেমা পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে পিতা-মাতার সাথে সুন্দর আচরণ করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।
©somewhere in net ltd.