নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঈমান, ইলম, আমল ও ইবাদত

০১ লা নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৪২

আমরা দুনিয়াতে শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি পেতে চাই । এ বিষয়টি আমাদের জীবনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আখিরাতের অনন্ত অসীম জীবনে যদি আমরা আল্লাহর রহমত না পাই তাহলে কোনো উপায় থাকবে না। বিষয়টা মোটেই হালকা করে দেখার বিষয় নয়। যদি আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে,আমরা দুনিয়ার অশান্তি থেকে বাঁচতে চাই এবং আখিরাতের শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে চাই, তাহলে আমাদেরকে এ কয়টি কাজ করতে হবে—
১. ঈমানকে মযবুত করতে হবে।
২. ওহীর ইলম হাসিল করতে হবে।
৩. নেক আমল করতে হবে।
৪. সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে।
কেউ যদি নিজেকে ঠিকভাবে গড়ে তুলতে চায় তাহলে তাকে চার দিক দিয়ে গড়ে উঠতে হবে। তার মন, মগজ ও চরিত্র গড়তে হবে। মনের সাথে ঈমানের সম্পর্ক, মগজের সাথে ইলম বা জ্ঞানের সম্পর্ক আর চরিত্রের সাথে আমল বা ইবাদতের সম্পর্ক। বাংলায় মন-মগজ-চরিত্র বললে আরবীতে ঈমান-ইলম-আমল বা ইবাদত বোঝায়। এ চারটি দিক দিয়েই আমাদেরকে গড়ে ওঠতে হবে। তাই সবার আগে ঈমান, এর পর ইলম, এর পর আমল ও ইবাদত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি

ঈমান
ঈমান একটি আরবী শব্দ। এর সাধারণ অর্থ হলো- বিশ্বাস করা। এছাড়াও আনুগত্য করা, অবনত হওয়া, নির্ভর করা ইত্যাদি অর্থেও ঈমান শব্দটি ব্যবহৃত হয়। শরীয়তের ভাষায় ঈমান হলো অন্তরে বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি ও কার্যে পরিণত করার নাম। অর্থাৎ কোন বিষয়েক গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও স্বীকৃতি দানই ঈমান। গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সদিচ্ছা না থাকলে মৌখিক স্বীকৃতির দ্বারা মু’মিন হওয়া যায়না। ১. যা দেখা যায়না বা সরাসরি যে বিষয়ে জ্ঞান নেই । ২. অথচ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। ৩. তাই পরোক্ষ জ্ঞান ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপায় নেই। ৪. পরোক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তার নাম ঈমান।
ক) ঈমান আনতে হবে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে।
খ) ঈমান হতে হবে খালেস ও শেরক মুক্ত।
গ) ঈমান হতে হবে ঘোষণার বাস্তবায়ন।
ঈমান হলো একটি ঘোষণা যা আমরা কালেমা তইয়্যেবার মাধ্যমে দিয়ে থাকি।
কালিমা তাইয়্যিবা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সার্বভৌমত্বের মালিক নয়, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল”।
এই কালেমার দুইটি অংশ আছে-
কালেমার প্রথম অংশ হলোঃ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, কোনো উপাস্য নেই। তিনি একক, অদ্বিতীয়। তিনি সব পারেন, সব করেন। সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব একমাত্র তারই অধীন। তিনি সব ধরণের দুর্বলতা, ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। সামান্য থেকে সামান্যতম বিষয়েও সবাই তার মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন- এমন বিশ্বাস লালন করা।
কালেমার দ্বিতীয় অংশ হলোঃ ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল। তিনি সর্বশেষ নবী। মানুষের হেদায়েতের জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ পয়গম্বর। তার পরে আর কোনো নবী অথবা রাসুল আসবেন না- এ কথাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং মেনে নেয়া।
ঈমান মূলত সাতটি বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত, আর সেগুলো হলো- ‘আমানতু বিল্লাহি ওয়ামালাইকাতিহী, ওয়াকুতুবিহী, ওয়ারুসূলিহী, ওয়াল ইয়াওমিল আখিরি, ওয়াল ক্বাদরি খাইরিহী, ওয়া শাররিহী, মিনাল্লাহি তা‘আলা ওয়াল বা‘অছি বা‘দাল মাউত।’ এর অর্থ হলো, আমি ৭টি বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি-
১. আল্লাহ, ২. তাঁর ফেরেশতাগণ, ৩. তাঁর কিতাবসমূহ, ৪. তাঁর রাসূলগণ, ৫. আখিরাতের দিন, ৬. তাকদীর-এর ভালো ও মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়, ৭. মৃত্যুর পর আবার জীবিত হওয়া।
ঈমানের ৭টি বিষয় তিনটি ভাগে ভাগ যায়। ১. তাওহীদ ২. রিসালাত ও ৩.আখিরাত
১. তাওহীদের মধ্যেঃ ক) আল্লাহ, খ) ফেরেশতা ও গ) তকদীর শামিল রয়েছে।
২. রিসালাতের মধ্যে আছেঃ ক) কিতাবসমূহ ও খ) রাসূলগণ।
৩. আখিরাতের মধ্যেঃ ক) মৃত্যুর পরের জীবন ও খ) বিচারের দিন।
ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় ঈমানের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমামগণের বিভিন্নধর্মী সংজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। সেগুলো হলো-
ক) ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, ‘আন্তরিক বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতিই হলো ঈমান’।
খ) ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, ‘রাসূল (সাঃ) - এর আনীত সকল বিধি-বিধানসহ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাই হচ্ছে ঈমান’।
গ) ইমাম শাফেয়ী, মালেক ও আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) - এর-মতে, অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং আরকানসমূহ (ইসলামের বিধি-বিধান) কাজে পরিণত করার নাম ঈমান।
দুর্বল ঈমানের লক্ষণঃ
 গুনাহ করার পর কোন অপরাধ বোধ কাজ করবে না।
 অন্তর কঠিন হয়ে যাবে ফলে কুরআন তিলাওয়াত করতে ইচ্ছা করবে না।
 ইবাদত করার ক্ষেত্রে অলসতা কাজ করবে।
 সুন্নত পালনে অবহেলা।
 অধিকাংশ সময় মন ও মেজাজ খারাপ এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত থাকবে।
 কুরআন তিলাওয়াত কিংবা আল্লাহর কথা শুনার পর কোন অনুভূতি আসবে না। যেমন আখিরাত তথা জাহান্নামের ভয়ের কথা শোনার পর চোখে পানি আসবে না।
 আল্লাহর নাম স্মরণ তথা জিকির করাকে কঠিন কাজ বলে মনে হবে।
 শরীয়ত বিরোধী কাজ করার পরে খারাপ অনুভব হবে না।
 সবসময় দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ আর সম্মানের ইচ্ছা হবে।
 নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।
 অন্যের ইসলাম পালনকে অবজ্ঞা এবং তিরস্কার করা।
মযবুত ঈমানের প্রধান শর্ত দুটোঃ
১। শিরকমুক্ত ঈমান বা নির্ভেজাল তাওহীদ।
২। ইমানের দাবিদারকে তাগুতের কাফির হতে হবে।
সুতারং মযবুত ঈমানের অধিকারীকে
১) তাওহীদ, ২) শিরক ও ৩) তাগুত সর্ম্পকে সুষ্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে ।
১। তাওহীদঃ তাওহীদ শব্দের অর্থ হলো অদ্বিতীয়তাবাদ। অদ্বিতীয় মানে যার কোন সমকক্ষ নেই, এমনকি যার সাথে তুলনা করার মতোও কেউ নেই।
২। শিরকঃ শিরক শব্দটির অর্থ হলো শরীক করা। যারা শিরক করে তারা আল্লাহকে অস্বীকার করে না। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে বটে, কিন্তু আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তা বা শক্তিকে বিভিন্নভাবে শরীক করে। আল্লাহর সাথে কী কী ভাবে শরীক করা হয় তা বুঝতে হলে শিরক সর্ম্পকে ধারনা থাকতে হবে তাহলেই শিরক থেকে বেচেঁ থাকাও সজহ হবে।
ক) শিরকুন ফিয-যাত অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা
খ) শিরকুন ফিস-সিফাত অর্থাৎ আল্লাহর গুনাবলি
গ) শিরকুন ফিল এখতিয়ারাত অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা
ঘ) শিরকুন ফিল হুকুক অর্থাৎ আল্লাহর অধিকার
তাওহীদকে বুঝতে হলে শিরককে বুঝতে হবে। শিরকের বিপরীতই তাওহীদ। ঈমান শিরকমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাওহীদের দাবী পূরণ হতে পারে না।
শিরকুন ফিয-যাতের উদাহরণঃ আল্লাহর সত্তাকে শরীক করা যেমন কাউকে আল্লাহর পুত্র, স্ত্রী মনে করা। ফেরেশতা, দেব-দেবী ইত্যাদিকে আল্লাহর বংশধর বলে বিশ্বাস করা।
শিরকুন ফিস সিফকাতের উদাহরণঃ যে সব গুন একান্তই আল্লাহর সে সবগুন কারোর মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ছাড়া কাউকে সকল রকম দুর্বলতা ও দোষক্রটি থেকে পাক মনে করা। যেমন-গায়েবী ইলম বা অদৃশ্য সর্ম্পকে জ্ঞান। কারো সর্ম্পকে এমন ধারণা করা যে, তিনি সবকিছু জানেন, দেখেন বা শুনেন এবং সব দোষ ত্রুটি থেকে মুক্ত।
শিরকুন ফিল এখতিয়ারাতের উদারহণঃ আলৌকিকভাবে উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা, প্রয়োজন পূরণ ও হেফাযত করার যোগ্যতা, মানুষের ভাগ্য গড়া ও ভাঙ্গা, দোয়া করা, মানব জীবনের জন্য আইন কানুন রচনা করা, সন্তান দান করা, রোগ ভাল করা, গুনাহ মাফ করা, হায়াত ও মওত দেয়া, রিযক দান করা ইত্যদি।
শিরকুন ফিল হুকুকের উদাহরণঃ কাউকে রুকু, সিজদা ও পূঁজা পাওয়ার অধিকারী বা হাত বেঁধে নত হয়ে দাড়িয়ে ভক্তি করার পাত্র মনে করা, কারো আস্তানাকে চুমু দেয়ার যোগ্য মনে করা, কুরবানী ক, নযর, নিয়য, মানত পেশ করার যোগ্য মনে করা। নিয়ামতের শুকরিয়া পাওয়ার অধিকারী বা আপদে বিপদে সাহায্যের জন্য আবেদন গ্রহনের যোগ্য, সব অবস্থায় যাকে ভয় করা যায় বা যার জন্য আর সব মহ্বত ত্যাগ করা যায় বলে মনে করা।
৩। তাগুতঃ
তাগুত শব্দের অর্থ সীমা লঙ্ঘন কারী। আল্লাহর নাফরমানীর দুটো সীমা রয়েছে-
ক) প্রাথমিক সীমা হলো পিসক
খ) আর চূড়ান্ত ও শেষ সীমা হচ্ছে কুফর
যে আল্লাহর হুকুম স্বীকার করে বটে কিন্তু পালন করে না সে ফাসিক। আর যে আল্লাহর হুকুমকে স্বীকারই করেনা সে কাফির। যে নাফরমানীর এ দুটো সীমা লঙ্ঘন করে সেই তাগুত।
১। যে নিজে কাসেক এবং অন্য মানুষকেও ফাসেক বানাবার চেষ্টা করে সেই তাগুত। সে নাফরমানীর প্রাথমিকম সীমা লঙ্ঘন করলো।
২। যে নিজে কাফির এবং অন্যকেও কাফির বানাবার চেষ্টা করে সে তাগুত। সে আল্লাহর নাফরমানীর শেষ সীমাও লঙ্ঘন করলো।
ঈমান মজবুত করার উপায়ঃ
ঈমান অনেক বড় সম্পদ। কিন্তু বর্তমান এই ফেতনা ফ্যাসাদের যমানায় এই ঈমান ঠিক রাখা অনেক বেশী কঠিন। প্রতিনিয়ত গুনাহের সাগরে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার অন্যতম উপায় হল নিজের ঈমান বৃদ্ধি করা। আবার এই ঈমান বৃদ্ধি করতে হলে অনুসরণ করতে হবে বেশ কিছু কাজ।
ঈমান বৃদ্ধির উপায় অনেক রয়েছে। তবে এই লেখায় আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করবো, যা ঈমান বৃদ্ধি এবং মজবুত করতে সহায়তা করবে। এসব উপায় গুলো দৈনন্দিন অভ্যাসের সাথে যুক্ত। আর সবগুলো কাজ ইসলামের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সব কথার অন্যতম একটি কথা হলো ঈমান মজবুত রাখার জন্য সবসময় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাতে হবে।
১. নিজের গুনাহের জন্য অনুশোচনা করাঃ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তার সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অনন্তর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং অধিক আমল কারীকে বেশী করে দেবেন আর যদি তোমরা বিমুখ হতে থাক, তবে আমি তোমাদের উপর এক মহা দিবসের আযাবের আশঙ্কা করছি। (হুদঃ ৩)
মানুষ হিসেবে যেকোন সময় গুনাহ হয়ে যেতে পারে তবে এজন্য হতাশ হওয়া যাবে না বরং এই গুনাহের জন্য তওবা এবং অনুশোচনা করতে হবে। তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই ক্ষমা করবেন। তবে কিছু শর্তের উপর নির্ভর করে আপনার তওবা কুবল হওয়া কিংবা না হওয়া। যথাঃ
প্রথমতঃ গুনাহ পরিত্যাগ করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ যে গুনাহ করা হয়ে গেছে তার জন্য অনুশোচনা করতে হবে।
তৃতীয়তঃ একই গুনাহ যেন পুনরাবৃত্তি না হয় এজন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।
চতুর্থতঃ যদি কোন ব্যক্তির ক্ষতি বা অধিকার হরণ করা হয় তবে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
একজন মুসলমান যখন তার গুনাহের জন্য তওবা করবে স্বাভাবিক ভাবে সে সর্বদা নেক আমলের জন্য উৎসাহী হবে আর নেক আমল তার ঈমানকে বৃদ্ধি করবে।
২. সময়মত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করাঃ নামাজ মানুষকে সকল পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এছাড়া ঈমান বৃদ্ধির জন্য নামাজের উত্তম বিকল্প আর কিছু নেই। রাসূল সাঃ এর হাদিস মোতাবেক প্রবাহমান নদীতে নিয়মিত ৫ বার গোসল করলে যেমন শরীরে কোন ময়লা থাকে না তেমনি নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে কোন গুনাহ থাকে না। পূর্বে বলা হয়েছে গুনাহ না করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়।
তবে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় অনুসরণ করতে হবে যথাঃ
o খুশু খুজু তথা আল্লাহর ধ্যান খেয়াল অন্তরে রেখে নামাজ আদায় করতে হবে।
o একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করতে হবে।
o নামাযের সূরা কিরাত সহীহ শুদ্ধ ভাবে আদায় করতে হবে।
o সর্বোপরি নামাজের সকল হুকুম আহকাম নিয়ম মাফিক আদায় করতে হবে।
৩. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতঃ কুরাআন হলো মানুষের আত্মার খোরাক, অন্তরের আলো এবং সরল পথের দিশারী। যখনই আপনি আপনার অন্তরের শক্তি হারিয়ে ফেলবেন, ঈমানের ঘাটতি অনুভব করবেন তখনই কুরআনের দিকে ফিরে আসুন আসল শান্তির খোঁজ পাবেন। কুরআন ব্যাখ্যা দিয়েছে কিভাবে আপনি আপনার ঈমানের রিচার্জ করবেন। আল্লাহ তায়লা বলেন, আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সূরা তোমাদের মধ্যেকার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করলো? অতএব যারা ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে।
(তওবাহঃ ১২৪)
৪. স্বেচ্ছায় রোযা রাখার অভ্যাস করুনঃ রোযা তাকওয়া অর্জনের অন্যতম উপায়। কেননা রোযা খুব কম মানুষ, লোক দেখানোর জন্য রাখে। আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্যে রোযা রাখা জরুরি। রোযা রাখার দ্বারা শয়তানের চক্রান্ত আর খারাপ ইচ্ছা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হয়। এছাড়া রোযা রাখার দ্বারা আল্লাহর সাথে আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়।
রোযা রাখার দ্বারা যেহেতু আল্লাহর সাথে আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয় এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকা যায় তাই রোযা ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক।
৫. সর্বদা আল্লাহর জিকির করাঃ জিকির বলতে মূলত সর্বদা আল্লাহর কথা অন্তরে স্মরণ রাখা বোঝায়। এখন সেটা হতে পারে সুবহানাল্লাহ কিংবা আলহামদুলিল্লাহ বলার দ্বারাও। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।( আর রা’দঃ ২৮)
জিকির করার দ্বারা আপনার অন্তরে সর্বদা আল্লাহর নাম জপতে থাকবে আর যার অন্তরে আল্লাহর নাম থাকবে তার ঈমান বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এছাড়া দৈনিক আপনি নিচের জিকির গুলো করতে পারেন,
• সুবহানাল্লাহ - প্রতিদিন ১০০ বার।
• সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী - প্রতিদিন ১০০ বার।
• আলহামদুলিল্লাহ
• আল্লাহু আকবার
• লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
• সুবহানআল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর
• সকাল-বিকাল দুরুদ পাঠ
৬. সর্বদা মৃত্যুর কথা স্মরণঃ প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুর স্বাদ নিবে। এক্ষেত্রে কে ধনী বা কে গরিব, কে বৃদ্ধ বা কে তরুণ এসব বিবেচনা করা হবে না প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করবে। যখন আমরা নিয়মিত এই মৃত্যুর কথা স্মরণ করবো তখন আমাদের অন্তর সর্বদা নেক আমল করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। জান্নাত লাভের আকাঙ্ক্ষা আমাদের অন্তরে আসবে। আর সর্বদা মৃত্যুর কথা স্মরণ করার দ্বারা আমাদের ঈমানও বৃদ্ধি পাবে।
৭. আলেমের সহবত এবং ইসলামী জ্ঞান অর্জন করাঃ আলেমের সাথে সম্পর্ক, তাদের সাথে ইসলামী আলোচনা এবং ইসলামী জ্ঞান অর্জনের দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান। (যুমারঃ ৯)
৮. আল্লাহর নিকট দোয়া করাঃ রাসূল সাঃ বলেছেন, দোয়া হলো মুমিনের হাতিয়ার। ঈমান হ্রাস পেয়েছে এরূপ ঘটলে যেমন আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে তেমনি সর্ব অবস্থায় আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে। বেশ কিছু সময় দোয়া কবুল হয় যথাঃ
• যখন আপনি মজলুম থাকবেন।
• আযান এবং ইকামতের মধ্যবর্তী সময়।
• আযানের সময়।
• অসুস্থতার সময়।
• তাহাজ্জুদ নামাজের সময়।
• রমজান মাসে বিশেষভাবে শবে কদরের রাত্রে।
• মুসাফির অবস্থায়।
• সিজদাহরত অবস্থায়।
• শুক্রবার আসর নামাজের পর।
• সন্তানের জন্য পিতা-মাতার।
যে মযবুত ঈমানের অধিকারী সে –
১. দীনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধায় ভোগে না। সব অবস্থায় মনে প্রশান্তি ভোগ করে এবং তৃপ্তি বোধ করে। এ প্রশান্তি ও তৃপ্তি এমন বেহেশতী নিয়ামত যার কোনো তুলনা নেই।
২. আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের সাফল্যের তীব্র কামনা এমন ভাবে অন্তর দখল করে রাখে যে দুনিয়ার কোনো বড় স্বার্থের লোভেও বিভ্রান্ত হয় না।
৩. আল্লাহ সবসময় সাথে আছেন এ চেতনার ফলে দুঃখ কষ্ট, আপদ বিপদ ও রোগ শোকে বিচলিত ও পেরেশান হয় না এবং তাওয়াক্কুল আলল্লাহ ও সবরের নিয়ামত লাভ করে।
৪. একমাত্র আল্লাহর ভয় ছাড়া মৃত্যভয়সহ সকল ভয় থেকে মুক্ত থাকে। মৃত্যকে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার মহাসুযোগ মনে করে এবং শহীদী মৃত্যই কামনা করে।
৫. দুনিয়ার যেসব জিনিসের ভালোবাসার দায়িত্ব আল্লাহ দিয়েছেন এসবের আকর্ষণ সত্ত্বেও আল্লাহ রাসুল (সা) ও জিহাদী ফী সাবীলিল্লহকে প্রাধান্য দেওয়ার যোগ্যতা হাসিল করে।
৬. সকল প্রকার শিরক থেকে ঈমানকে মুক্ত রেখে তাওহীদের দাবি পূরণ করতে সক্ষম হয়।
৭. সকল প্রকার তাগূতকে অস্বীকার করার হিম্মত রাখে এবং ঈমানের দাবি পূরণ করে তৃপ্তিবোধ করে।
ইলম
আরবী ‘ইলম’ শব্দের বাংলা হলো বিদ্যা বা জ্ঞান। কুরআন ও হাদীসে ইলম শব্দ দ্বারা ওহীর ইলম বোঝানো হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ইলম তালাশ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। এখানে ইলম অর্থ যদি সব বিদ্যাই হয় তাহলে কেউ এ ফরয আদায় করতে পারবে না। ডাক্তারী বিদ্যা, ইঞ্জিনিয়রিং বিদ্যা, কৃষিবিদ্যা ইত্যাদি শেখা সবার উপর ফরয হতে পারে না। তাই এ হাদীসে যে ইলম হাসিলের চেষ্টা করাকে ফর্‌য বলা হয়েছে তা অবশ্যই ওহীর ইলম। ইসলাম যেহেতু নিখুঁত মতাদর্শ এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, সে জন্যে জ্ঞান ছাড়া এ আদর্শ ও জীবন-ব্যবস্থার অনুসারী হওয়া যায় না। সহজ কথায় বলতে গেলে, ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যার অপরিহার্য দাবি হলো, তাকে জানা ও মানা। আর মুসলিম বলা হয় সেই ব্যক্তিকে যিনি ইসলামকে জানেন এবং মানেন। দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য আবশ্যক। দুনিয়াতে চলার জন্য ও ইবাদত করার জন্য দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করা ফরয। অপরপক্ষে দ্বীনের খেদমত করার জন্য এবং দ্বীনের প্রচার-প্রসারে জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। কারণ একজন প্রকৃত আলেম একটি জাতি বা দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। ইমাম বুখারী (রহঃ) সহীহ বুখারীতে ‘কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান অর্জন করা’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এবং তার প্রমাণে কুরআনুল কারীমের নিম্নোক্ত আয়াতটি নিয়ে এসেছেন। যে ব্যক্তি যত বেশী জানবে সে তত বেশী আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করতে সচেষ্ট হবে এবং অহংকার করা থেকে দূরে থাকবে। সাথে সাথে প্রত্যেকটি কাজে আল্লাহকে বেশী-বেশী ভয় করবে। এটাই একজন আলেমের বৈশিষ্ট্য।
বর্তমানে অনেক আলেম ও সাধারণ মানুষ তাদের সন্তান-সন্ততিকে দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিতে চান না। এটা অতি পরিতাপের বিষয় বৈ কি? কেননা দ্বীনি ইলম না থাকলে, দ্বীনের খিদমতে এগিয়ে আসবে কিভাবে? সেকারণ কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। ইলম অর্জন দ্বারাই ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ইলম অর্জন করা কল্যাণ লাভের উপায়। আল্লাহ যার কল্যাণ চান সে ব্যক্তিই এ পথের পথিক হয়। ইলম অর্জন করলে জান্নাতে যাবার পথ সহজ হয়। আর যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের জন্য পথ চলে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। ইলম অর্জনের মাধ্যমে নবীগণের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়। ইলম অর্জন করে অপরকে শিক্ষা দিলে, সে অনুযায়ী আমলকারী যে নেকী পাবে, শিক্ষাদাতাও অনুরূপ নেকী পাবে। জ্ঞান অর্জনকারীর উপর আল্লাহ রহম করেন। আর ফেরেশতাগণ, আসমান যমীনের অধিবাসীগণ, পিপিলিকা এমনকি সমুদ্রের মাছও দোয়া করতে থাকে। দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিয়ে গেলে মৃত্যুর পরেও তার ছওয়াব পাওয়া যায়। অবশ্য এই মূলনীতিটি সকল কার্যকরী ও নির্বাহী ব্যাপারেই প্রযোজ্য। আল্লাহতায়ালা মানব জীবনের সর্বস্তরে ইসলামকে মানার ও কার্যকর করার জন্যেই পাঠিয়েছেন। না জেনে, না বুঝে যেহেতু কোনো কিছুই মানা ও কার্যকর করা যায় না, ইসলাম তো বটেই, সেজন্যে ইসলামকে জানা বুঝা এবং ইসলামের সঠিক ও যথার্থ জ্ঞানার্জন করা অতীব জরুরি ও অপরিহার্য। মহাবিশ্ব ও এই পৃথিবীর মালিক মহান আল্লাহতায়ালা মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতি হিসেবে দ্বীন ইসলামকে শুধু পাঠিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং ইসলামকে জানা-বুঝারও নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ দিয়েছেন, ইসলামের জ্ঞানার্জন করার। ইসলামের বাস্তব শিক্ষা দেয়ার জন্যে তিনি রাসূলও পাঠিয়েছেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষক ও আদর্শ নেতা হিসেবে বাস্তবে শিক্ষা দানের মাধ্যমে তাঁর সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন।
কোন জ্ঞান অর্জন করা ফরয?
জ্ঞানের রয়েছে বিভিন্ন শাখা প্রশাখা। একজন মুসলিমের জন্যে কোন জ্ঞান এবং কতটুকু জ্ঞানার্জন করা ফরয? এ বিষয়টি জানা থাকা জরুরি। ইসলামের আলোকে গুরুত্বের দিক থেকে জ্ঞানকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
(ক) দ্বীন ও শরীয়া সংক্রান্ত জ্ঞানঃ এ জ্ঞান অর্জন করা ফরয। অর্থাৎ একজন মুসলিমকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঈমান-আকিদা সংক্রান্ত সঠিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। ইসলামের মৌল নীতিসমূহ তার জানা থাকতে হবে। শরীয়তের মৌলিক বিধি-বিধানসমূহ তার জানা থাকতে হবে। সর্বোপরি শরীয়তের মৌলিক বিধি-বিধানসমূহ পালন করা, প্রয়োগ করা এবং বাস্তবায়ন করার শরীয়তসম্মত পদ্ধতি তার জানা থাকতে হবে। নিজের জীবিকা উপার্জনের হালাল ও বৈধ প্রক্রিয়া তার জানা থাকতে হবে। এসব জ্ঞান অর্জন করা তার জন্যে ফরয।
(খ) দ্বীনের অনুসন্ধানী জ্ঞানঃ মুসলিমদের মধ্যে সর্বকালেই এমন এক গ্রুপ লোক ছিলেন এবং থাকতে হবে, যারা ইসলামের অনুসন্ধানী জ্ঞানার্জন করবেন এবং ইজতিহাদ করার যোগ্যতা অর্জন করবেন। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যুগ-সমস্যা ও নতুন নতুন বিষয়সমূহের সমাধান পেশ করা এ গ্রুপের দায়িত্ব। দীনের অনুসন্ধানী জ্ঞানার্জন করা ফরয না হলেও ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ একদল লোককে অবশ্যি এ জ্ঞানার্জনে এগিয়ে আসতে হবে।
(গ) মুস্তাহাব জ্ঞানঃ উপরোক্ত দুই ধরনের জ্ঞান ছাড়া মানব সমাজের জন্যে কল্যাণকর অন্যান্য জ্ঞানার্জন করা মুস্তাহাব বা পছন্দীয়।
(ঘ) ক্ষতিকর জ্ঞানঃ যেসব বিষয়ের জ্ঞানে ব্যক্তি বা মানব সমাজের কানো কল্যাণ নেই, বরং ক্ষতিকর ও সময় অপচয়কর, কোনো মুসলিমের উচিত নয় সেসব জ্ঞান অর্জন করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে দোয়া করতেনঃ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে পানাহ চাই সেই জ্ঞান থেকে যাতে কোনো কল্যাণ নেই এবং সেই অন্তর থেকে যার মধ্যে তোমার ভয় নেই।
ওহীর নফল ইলম হাসিলের মূল্য কী?
যে কাজ ফরয সে কাজ যদি ফরযের পরে আরো বাড়িয়ে করা হয় তাহলে তাকে নফল বলা হয়। নফল শব্দের অর্থ অতিরিক্ত। ওহীর যে ইলম ফরয নয় ঐ ইলম যদি কেউ শেখে তাহলে শরী‘আতে এর মূল্য কী? ইসলামী সকল বিধি-বিধানকে এক শব্দে আরবীতে ‘শরীআত’ বলা হয়।
যার ওপর হজ্জ ফরয নয়, সে যদি হজ্জের ইলম জেনে নেয় তাহলে কি সে কোনো বেহুদা কাজ করল? আমার ওপর দেশ শাসনের দায়িত্ব নেই; আমি এ বিষয়ে যেটুকু ইলম হাসিল করলাম, এর কি কোনো মূল্য নেই?
একটি হাদীস থেকে এর মূল্য জানা যায়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘রাতের কিছু সময় ইলম শেখা ও শেখানো সারা রাত অন্য নফল আমল করার চেয়ে ভালো।’
এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, ওহীর ইলম চর্চা করা অন্যসব নফল আমলের তুলনায় বেশি মূল্যবান। তাই আমাদের উচিত, সবসময় ইসলামী বই সঙ্গে রাখা। যখনই এমন হয় যে, হাতে কোনো কাজ নেই তখনই ইসলামের জ্ঞান অর্জন করে সময়টা এমন কাজে লাগাতে পারি, যা অনেক মূল্যবান।
শরী‘আতে অন্যান্য বিদ্যার মূল্য আছে কি?
মুসলমানের জীবনকে তো শরী‘আত মতোই চালাতে হবে। কেউ যদি ডাক্তারি বিদ্যা শেখে তাহলে শরী‘আতের হিসাবে এর কি কোনো মূল্য নেই? সে কি শরী‘আতের বাইরে চলে গেল?
একটি হাদীস থেকে এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। রাসূল বলেছেন, ‘হালাল কামাই করার চেষ্টা করা সব ফরযের পর ফরয।’ এতে জানা গেল, নামায, রোযা ও অন্যান্য যত ফরয আছে সেসব যেমন ফরয, হালাল রোজগারের চেষ্টা করাও তেমনি ফরয।
রুজি-রোজগার করতে হলে কোনো একটা পেশা বাছাই করে নিতে হয়। যে পেশাই বাছাই করা হোক, এর জন্য যে বিদ্যা দরকার তা শিখতেই হয়। যে চিকিৎসার পেশা গ্রহণ করে তাকে ডাক্তারি বিদ্যা শিখতে হয়। যদি সে হালালভাবে কামাই করতে চায় তাহলে তাকে ওই বিদ্যা ভালো করে শিখতে হবে। ডাক্তারি বিদ্যা ঠিকমতো না শিখে যদি চিকিৎসা করে রোগীর কাছ থেকে টাকা নেয় তাহলে তার আয় হালাল হবে না। তাই তার আয় হালাল করার জন্যই এ বিদ্যা শিখতে হবে। শরী‘আতের হিসাবে ডাক্তারি বিদ্যা ফরয নয়; কিন্তু যে চিকিৎসাকে পেশা বানিয়েছে তার রোজগারকে হালাল করার জন্যই ঐ বিদ্যা শেখা তার উপর ফরয।
এ উদাহরণ থেকে প্রমাণ হলো, মানুষের হালাল কামাই করার জন্য যেসব বিদ্যা শিখতে হয় তা সরাসরি ফরয না হলেও পরোক্ষভাবে ফরয। এসব বিদ্যা শেখা বেহুদা কাজ নয়। মানুষের খিদমতের জন্য যত রকমের পেশা দরকার সেসবের বিদ্যা পরোক্ষভাবে তাদের ওপর ফরয, যারা ঐসব পেশা গ্রহণ করে। যেসব পেশা হারাম সেসবের বিদ্যা শেখাও হারাম। যেমন- গণকি পেশা।
আমল
‘আমল’ আরবী শব্দ। এর বাংলা হলো কাজ। মানুষ কোনো কাজের চিন্তা করলে ঐ কাজের সূচনা হয়। সে কাজের জন্য ইচ্ছা ও চেষ্টা করা হলে তাকে আমল বা কাজ বলা হয়। ভাল কাজ করনেওয়ালার যদি ঈমান থাকে এবং ঐ ভাল কাজটা যদি সুন্নত তরীকায় করা হয় তবে ঐ ভাল কাজকে নেক আমল বলা হবে। অর্থাৎ ঈমানদার ব্যক্তি সুন্নত তরীকায় কোন ভাল কাজ করলে তাকে নেক আমল বলা হবে। আরবি শব্দের বৈশিষ্ট হলো একটি শব্দের অসংখ্য প্রতিশব্দ ব্যহার হয়ে থাকে। সে জন্য ‘আমল’ শব্দের বাংলা প্রতি শব্দ করতে গিয়ে দেখা গেছে ‘আমল’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘কাল’ বা সময়, যেমন জাহেলি আমল কিংবা আব্বাসীয় আমল। ‘আমল’ এর দ্বিতীয় অর্থ হলো ধনসম্পদ; যেমন সূরা নিসার ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এতিমের ধনসম্পদ তাদের কাছে দিয়ে দাও, ভালো জিনিসের সাথে খারাপ জিনিস বদল করিও না। এ আয়াতে ‘আমল’কে সম্পদ হিসেবে অর্থ করা হয়েছে। ‘আমল’ এর তৃতীয় অর্থ হলো,মূল্যায়ন বা গুরুত্ব দেয়া; যেমন বিষয়টাকে আপনি আমলেই নিলেন না? ‘আমল’ এর চতুর্থ অর্থ হলো, কাজ বা কর্তব্য। যেমন সূরা আসরে বলা হয়েছে ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে। এখানে সূরা আসরে যে ‘আমল’-এর কথা বলা হয়েছে, এই আমলের অর্থ হলো আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যা যা করতে বলেছেন, সেসব করা আর যা যা নিষেধ করেছেন, সেসব না করাকে বোঝানো হয়েছে।
তাকদীর সম্পর্কীয় আলোচনায় আমরা জেনেছি যে, কোনো কাজের ইচ্ছা ও চেষ্টা করা হলেই কাজটি সমাধা না হলেও তা কাজ করা হয়েছে বলে ধরা হবে। কারণ, কাজটি সমাধা করা আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, এটা মানুষের ইখতিয়ারে নেই। কাজটি সমাধা না হলেও কাজের ফল আখিরাতে দেওয়া হবে। কাজটি ভালো হলে পুরস্কার পাবে, মন্দ হলে শাস্তি পাবে।
আল্লাহ তা‘আলার বড়ই মেহেরবানী যে, যদি কেউ কোনো ভালো কাজ করার নিয়ত বা ইচ্ছা করে, কিন্তু এর জন্য চেষ্টা করার সময় বা সুযোগ না পায়, তবুও তিনি তাকে কিছু পুরস্কার দেবেন। আর যদি সে মন্দ কাজের নিয়ত করে, তাহলে চেষ্টা না করা পর্যন্ত তাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না, বরং চেষ্টা না করার কারণে তাকে কিছু পুরস্কার দেওয়া হবে বলে রাসূল (সাঃ) বলেছেন। মানুষের আমলের হিসাব মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয় না
আদালতে আখিরাতে যখন মানুষের আমলনামা (দুনিয়ায় যা করেছে তার হিসাব) দেওয়া হবে, তখন যারা নেক আমল করেছে তাদের ডান হাতে এবং যারা বদ আমল করেছে তাদের বাম হাতে দেওয়া হবে। যারা আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা মতো চলেছে তারা নেক আমল করেছে বলে গণ্য হবে। আর যারা এর বিপরীত চলেছে তারা বদ আমল করেছে বলে ধরে নেওয়া হবে।
আমলনামা হাতে পেয়ে নেক লোক ও বদ লোক সবাই দেখবে যে, দুনিয়ায় তারা যে পরিমাণ কাজ করেছে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি কাজের হিসাব সেখানে লেখা আছে। তখন সবাই আল্লাহকে ডেকে বলবে, আমরা তো এত কিছু করিনি, আমাদের হিসাবে এত আমল কেমন করে লেখা হলো? জবাবে আল্লাহ বলবেন, দুনিয়ায় বেঁচে থাকাকালে তোমরা যা কিছু করেছ তা তো লেখা আছেই; মৃত্যুর পরও তোমাদের আমল বন্ধ হয়নি। তোমরা অন্যদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছ, তোমাদেরকে করতে দেখে যারা করতে শিখেছে, তোমরা যাদেরকে করতে উৎসাহ দিয়েছ, তারা যা আমল করেছে তাও তোমাদের আমলনামায় যোগ হয়েছে। তোমাদের মৃত্যুর পরও তোমাদের আমলের হিসাব জারি ছিল। এ কথা নেক ও বদ উভয় রকমের আমলের বেলায়ই সত্য।
রাসূল (সাঃ)বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাজের পথ দেখায় সে তার মতোই, যে কাজ করে।’ যে কাজ করে তার আমলনামায় যেমন সওয়াব বা গুনাহ লেখা হবে, যে ওই কাজের পথ দেখায় তার আমলনামায়ও তা যোগ হবে। আমার চেষ্টায় যদি কোনো বেনামাযী নামাযী হয়ে যায়, তাহলে সারা জীবনে সে যত নামায আদায় করেছে, এর নেকী ওই লোকের আমলনামায় যা হবে, আমার আমলনামায়ও তা-ই লেখা হবে। তাই মৃত্যুর পরও আমল জারি থাকে।
সহীহ্ নিয়ত ছাড়া নেক আমলও কবুল হয় না
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই নিয়ত অনুযায়ীই আমলকে বিবেচনা করা হয়।’ কোনো আমল দেখতে যত ভালো বলেই মনে হোক, কী নিয়তে কাজটি করা হয়েছে এর হিসাব নিয়েই আল্লাহ ওই কাজটিকে কবুল করবেন।
হাদীসে আছে, হাশরের দিন এমন এক লোককে ডাকা হবে, যে জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছে। তাকে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, দুনিয়ায় আমার জন্য তুমি কী করেছ? সে বলবে, আমি তোমার দীনের জন্য জিহাদ করে আমার জান কুরবান করে দিয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। তুমি এ নিয়তে জিহাদ করেছ যে, লোকেরা তোমাকে বীর বলবে, বাহাদুর বলবে। তোমার ঐ নিয়ত আমি দুনিয়ায়ই পূরণ করে দিয়েছি। লোকেরা তোমাকে বীর বলেছে। আমার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার নিয়ত তোমার ছিল না। তাই তোমাকে দোযখে দেওয়া হলো।
এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? লোকটি জিহাদের ময়দানে জান দিয়ে দেওয়ার পরও তাকে দোযখে যেতে হলো। এর একমাত্র কারণ, তার নিয়ত সহীহ্‌ ছিল না। প্রমাণ হলো, খাঁটি নিয়ত ছাড়া জিহাদের ময়দানে শহীদ হলেও কোনো পুরস্কার পাওয়া যাবে না। তাই আমলের ব্যাপারে নিয়তের বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি। নিয়ত সহীহ্‌ না হলে বড় নেক আমলেরও কোনো দাম নেই। তাহলে সহীহ্‌ নিয়ত সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা দরকার।
রাসূল (সাঃ)বলেছেন, ‘ঐ লোকই বুদ্ধিমান, যে তার নাফ্‌সকে দমন করে এবং যে কোনো কাজ করলে এর ফল আখিরাতে কী পাবে সে হিসাব করেই করে।’ দুনিয়ায় নগদ কী ফল পাবে সে হিসাব করে কাজ করা একেবারেই বোকামি। যদি কেউ আখিরাতের হিসাব করে কাজ করে তাহলে-মিথ্যা কথা বলা, ওজনে কম দেওযা, ঘুষ নেওয়া ইত্যাদি কোনোটাই করতে সে সাহস করবে না।
নিয়তকে খাঁটি করতে হলে খেয়াল রাখতে হবে-আমি যে নেক আমলই করি, তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি (খুশি) ও আখিরাতের সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে করছি কি-না। নিয়ত সহীহ্‌ হলেই আল্লাহ আমাদের আমল কবুল করবেন ও পুরস্কার দেবেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত করার সাথে সাথে আখিরাতের সফলতার কথাও খেয়ালে রাখতে হবে। আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকলেই আখিরাতে সফল হওয়া যাবে বটে; কিন্তু যেহেতু আখিরাতের সাফল্যই আসল উদ্দেশ্য, সেহেতু নিয়তের বেলায় ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের সাফল্য’-এ দুটো কথা একসাথেই খেয়াল করা জরুরি।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, শুধু আমলের কারণেই নাজাত পাওয়া যাবে না। একমাত্র আল্লাহর রহমত হলেই মুক্তির আশা করা যায়। এতে বোঝা গেল- যত নেক আমলই করি না কেন, আল্লাহর দরবারে তা কবুল হওয়ার যোগ্য না হলে এবং তিনি দয়া না করলে উপায় নেই। তাই তাঁর দয়ার আশাই আসল ভরসা।
বান্দা যেহেতু জানে, অনেক আমলই রয়েছে যা বিভিন্ন কারণে গ্রহণযোগ্য হয় না। অতএব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমল কবুলের কারণ ও উপায় সম্পর্কে জানা। যদি কারণগুলি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তবে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে এবং ক্রমাগত তার উপর অটল থাকে ও আমল করে যায়। আর যদি তা বিদ্যমান না পায় তবে এ মুহূর্তেই যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলঃ ইখলাসের সাথে সেগুলোর মাধ্যমে আমল করায় সচেষ্ট হওয়া। আমলের জন্যে নানান পদ্ধতি ও প্রয়োগরীতি কোরআন-হাদীস এবং সাহাবি ও পূর্বসূরিদের জীবন থেকে সহজেই অনুমান করা যায় । যদিও এর জন্যে গভীর অধ্যয়নের বিকল্প নেই ।
শরিয়ত নির্দেশিত আমল সম্পর্কিত ছয়টি বিষয়কে বুঝতে পারলে আমল সম্পর্কে একটি ধারণা পূর্ণাঙ্গ লাভ করতে পারা যায়। যথা-
১.ইবাদত বা প্রার্থনাঃ যেমন সালাত, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি;
২. মুআমালাত বা লেনদেনঃ সততা, বিশ্বস্ততা, ওয়াদা রক্ষা করা, হারাম উপার্জন বন্ধ করা; ওজনে কম না দেয়া, অন্যের হককে সম্মান করা; আমানত নষ্ট না করা ইত্যাদি;
৩. মুআশারাত বা আচার-আচরণঃ শিষ্টাচার, সম্প্রীতি ও কল্যাণমূলক কাজ করা;
৪. সিয়াসাত বা রাষ্ট্রনীতিঃ কুরআন-হাদিস নির্দেশিত রাষ্ট্রনীতি প্রবর্তনে কাজ করা;
৫. ইকতিসাদিয়াত বা অর্থনীতিঃ কুরআন-হাদিস মোতাবেক অর্থব্যবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া এবং ব্যবসাবাণিজ্য নীতি অনুসরণ করা;
৬. দাওয়াত ও জিহাদঃ আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা ও শরিয়া পরিপন্থী সংস্কৃতি উৎখাত করতে প্রয়োজনে লড়াই সংগ্রাম করা। দুঃখের বিষয়, এসবকে রেখে ‘আমল’কে এখন তাসবিতে পরিণত করা হচ্ছে। তসবিতে যে উপকার নেই তা অস্বীকার করারও উপায় নেই। পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবে বলা রয়েছে, ‘হে ঐসব লোক, যারা ঈমান এনেছো বেশি বেশি করে আল্লাহর জিকির করো এবং সকাল-সন্ধ্যা তার তাসবিহ করতে থাকো’ (৪১-৪২ সূরা আহযাব)। তবে এই সব তাসবিহ নিয়ম করে পড়ার গুরুত্ব হাদিস দ্বারাও স্বীকৃত। এর গুরুত্ব বাড়ে সব প্রকার ফরজ আমল সম্পন্ন করার পর। মানুষ যখন নামাজ, রোজা ও হজের মতো ফরজ আমল করার পর অন্যান্য ফরজ আমল ব্যতিরেকে তাসবিহ পড়া আমলের গুরুত্ব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকবে তখন সমাজ থেকে অনাচার-ব্যভিচার, অবিচার, চুরি-ডাকাতি, জুলুম, অত্যাচার, দখলদারিত্ব, লুটপাট, খুন-যখমসহ নানাবিধ অপকর্ম মুসলিম সমাজ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরিবর্তে তা সমাজের বুকে আরো জেঁকে বসতে চাইবে। এরকম হতে দেয়া মুসলমানদের ঈমান পরিপন্থী। সমাজকে পরিচ্ছন্ন করে রাখার নিমিত্তে মুসলিমদের যে তৎপরতা দেখা যাবে সেটাও একটা বড় ‘আমল’। এই আমাল অতি গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই আল্লাহ সূরা আল ইমরান ১০৪ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন ‘তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে সত্য ও ন্যায়ের আদেশ করবে; অন্যায় আর অসত্য থেকে বিরত রাখবে; সত্যিকার অর্থে এরাই হচ্ছে সাফল্যমণ্ডিত’। এ প্রসঙ্গে সূরা নিসায় বলা হয়েছে ‘তোমাদের কি হলো যে, তোমরা ওই সব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশুর খাতিরে লড়াই করছ না, যাদেরকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে এবং যারা ফরিয়াদ করছে যে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে জালিমদের এ বস্তি থেকে উদ্ধার করো, আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারীর ব্যবস্থা করো’ (সূরা নিসা, আয়াত-৭৫)।
আমল কবুলেরকতিপয় উপায়ঃ
১। স্বীয় আমলকে বড় মনে না করা ও তার উপর গর্ব না করাঃ মানুষ যত আমলই করুক না কেন, আল্লাহ তার দেহ থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে যত নেয়ামত তাকে প্রদান করেছেন, সে তুলনায় আল্লাহর সে মূলতঃ কিছুই হক আদায় করতে পারে নি। সুতরাং একনিষ্ঠ ও খাঁটি মু’মিনের চরিত্র হল, তারা তাদের আমলসমূহকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে, বড় মনে করে গর্ব-অহংকার করবে না; যার ফলে তাদের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায় ও অলসতা এসে যায় সৎ আমল করার ক্ষেত্রে।
স্বীয় আমলকে তুচ্ছ জ্ঞান করার সহায়ক বিষয়ঃ (১) আল্লাহ তায়ালাকে যথাযথভাবে জানা ও চেনা (২) তাঁর নিয়ামতসমূহ উপলব্ধি করা ও (৩) নিজের গুনাহ-খাতা ও অসম্পূর্ণতাকে স্মরণ করা। যেমনঃ আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে গুরু দায়িত্ব অর্পণের পরে অসীয়ত করেনঃ “(নবুয়তের বোঝা বহন করতঃ) তুমি (তোমার রবের প্রতি) অনুগ্রহ প্রকাশ কর না যার ফলে বেশি কিছু আশা করবে।” (মুদ্দাসসিরঃ ৬)
২। আমলটি কবূল হবে কিনা, এ মর্মে আশঙ্কিত থাকাঃ সালাফে সালেহীন- সাহাবায়ে কিরাম আমল কবূল হওয়ার ব্যাপারটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন, এমনকি তাঁরা ভয় ও আশঙ্কায় থাকতেন। যেমনঃ আল্লাহ তাঁদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেনঃ “যারা ভীত-কম্পিত হয়ে দান করে যা দান করার, কেননা তারা তাদের রবের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। (মুমিনুনঃ ৬০)
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আয়াতের ব্যাখ্যা করেন যে, তারা রোযা রাখে, নামায আদায় করে, দান-খয়রাত করে আর ভয় করে যে, মনে হয় তা কবূল হয় না।
আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেনঃ তোমাদের পক্ষ হতে তোমাদের আমল সমূহ কবূল হওয়ার ব্যাপারে তোমরা খুব বেশি গুরুত্ব প্রদান কর। তোমরা কি আল্লাহর বাণী শ্রবণ কর না।
“নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের পক্ষ হতেই কবূল করে থাকেন।” (মায়েদাঃ ২৭)
৩। আমল কবুলের আশা পোষণ ও দু‘আ করাঃ আল্লাহর প্রতি ভয়ই যথেষ্ট নয় ; বরং অনুরূপ তাঁর নিকট আশা পোষণ করতে হবে। কেননা আশা বিহীন ভয় নিরাশ হওয়ার কারণ এবং ভয় বিহীন আশা আল্লাহর শাস্তি হতে নিজেকে মুক্ত মনে করার কারণ; অথচ উভয়টিই দোষনীয়, যা মানুষের আকীদা ও আমলে মন্দ প্রভাব বিস্তার করে। জেনে রাখুন! আমল প্রত্যাখ্যান হয়ে যাওয়ার ভয়-আশঙ্কার সাথে সাথে আমল কবুলের আশা পোষণ মানুষের জন্যে বিনয়-নম্রতা ও আল্লাহ ভীতি এনে দেয়। যার ফলে তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। যখন বান্দার মধ্যে আশা পোষণের গুণ সাব্যস্ত হয় তখন সে অবশ্যই তার আমল কবূল হওয়ার জন্য তার প্রভুর নিকট দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে। যেমন- করেছিলেন আমাদের পিতা ইবরাহীম খলীল ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আলাইহিমাস সালাম)। যা আল্লাহ তায়ালা তাদের কা’বা গৃহ নির্মাণের ব্যাপারটি উল্লেখ করে বর্ণনা করেন।
“যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আলাইহিমাস সালাম) বায়তুল্লাহর ভিত্তি বুলন্দ করেন (দু‘আ করেন) হে আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক তুমি আমাদের দু‘আ কবূল করে নিও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। (বাকারাঃ ১২৭)
৪। বেশি বেশি ইস্তেগফার-ক্ষমা প্রার্থনাঃ মানুষ তার আমলকে যতই পরিপূর্ণ করার জন্য সচেষ্ট হোক না কেন, তাতে অবশ্যই ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকেই যাবে। এজন্যেই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শিক্ষা দান করেছেন, কিভাবে আমরা সে অসম্পূর্ণতাকে দূর করব। সুতরাং তিনি আমাদেরকে ইবাদত-আমলের পর ইস্তেগফার-ক্ষমা প্রার্থনার শিক্ষা দান করেন। যেমনঃ আল্লাহ তায়ালা হজ্জের হুকুম বর্ণনার পর বলেনঃ “অতঃপর তোমরা (আরাফাত) হতে প্রত্যাবর্তন করে, এসো যেখান থেকে লোকেরা প্রত্যাবর্তন করে আসে। আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাক, নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা ক্ষমাশীল ও দয়াবান।” (বাকারাঃ ১৯৯)
আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক নামাযের পর তিনবার করে “আস্তাগফিরুল্লাহ” (আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি) বলতেন।
৫। বেশি বেশি সৎ আমল করাঃ নিশ্চয়ই সৎ আমল একটি উত্তম বৃক্ষ। বৃক্ষ চায় তার পরিচর্যা, যেন সে বৃদ্ধি লাভ করে সুদৃঢ় হয়ে যথাযথ ফল দিতে পারে। সৎ আমলের পর সৎ আমল করে যাওয়া অবশ্যই আমল কবুলের একটি অন্যতম আলামত। আর এটি আল্লাহর বড় অনুগ্রহ ও নেয়ামত, যা তিনি তার বান্দাকে প্রদান করে থাকেন। যদি বান্দা উত্তম আমল করে ও তাতে ইখলাস বজায় রাখে তখন আল্লাহ তার জন্য অন্যান্য উত্তম আমলের দরজা খুলে দেন। যার ফলে তার নৈকট্যের ও বৃদ্ধি পায়।
৬। সৎ আমলের স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখাঃ যে ব্যক্তি নেকী অর্জনের মৌসুম অতিবাহিত করার পর সৎআমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায়, তার জন্য জরুরী হল সে যেন সৎ আমলে স্থায়ী ও অটল থাকার গুরুত্ব, ফযীলত, উপকারিতা, তার প্রভাব, তা অর্জনের সহায়ক বিষয় ও এক্ষেত্রে সালাফে সালেহীনের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে।
সৎ আমলের উপর স্থায়ী ও অটল থাকার গুরুত্বঃ
ইসলামী শরীয়তে সৎ আমলের উপর স্থায়ী ও অটল থাকার গুরুত্ব নিন্মের বিষয়গুলি হতে ফুটে ওঠেঃ
১। আল্লাহ তায়ালার ফরযসমূহ, যা অবশ্যই ধারাবাহিতকতার ভিত্তিতেই ফরয করা হয়েছে এবং তা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল।
২। সৎআমলের স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অন্যতম তরীকা ও নীতি।
৩। ক্রমাগত আমল ও তার ধারাবাহিকতা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিকট উত্তম আমলের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল হল, যা নিয়মিতভাবে করে যাওয়া হয়, যদিও তা অল্প হয়।” (বুখারী-মুসলিম)
সৎ আমলের উপর স্থায়ী ও অটল থাকার প্রভাব ও উপকারিতাঃ
আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৎআমলের হেফাযতকারী বান্দাদেরকে বহুভাবে সম্মানিত ও উপকৃত করে থাকেন। যেমনঃ
১। স্রষ্টার সাথে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ; যা তাকে অগাধ শক্তি, দৃঢ়তা, আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক ও তার উপর মহা আস্থা তৈরি করে দেয়। এমনকি তার দুঃখ-কষ্ট ও চিন্তা-ভাবনায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। যেমনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করবে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।” (তালাকঃ ৩ )
২। অলসতা-উদাসীনতা হতে অন্তরকে ফিরিয়ে রেখে সৎ আমলকে আঁকড়ে ধরার প্রতি অভ্যস্ত করা যেন ক্রমান্বয়ে তা সহজ হয়ে যায়। যেমন কথিত রয়েছেঃ “তুমি তোমার অন্তরকে যদি সৎআমলে পরিচালিত না কর, তবে সে আমাকে গুনাহর দিকে পরিচালিত করবে।”
৩। এ নীতি অবলম্বন হল আল্লাহর মুহাব্বাত ও অভিভাবকত্ব লাভের উপায়। যেমন হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেনঃ “আমার বান্দা নফল ইবাদতসমূহ দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতেই থাকে, এমনকি তাকে আমি মুহাব্বাত করতে শুরু করি।” (বুখারী)
৪। সৎআমলে অবিচল থাকা বিপদ-আপদে মুক্তির একটি কারণ। যেমন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কে উপদেশ দেনঃ “আল্লাহকে হেফাযত কর (অর্থাৎ তার হুকুম-আহকামগুলো পালন কর) তবে তিনিও তোমাকে হেফাযত করবেন, আল্লাহকে হেফাযত কর তবে তুমি তাঁকে তোমার সামনে পাবে; সুখে-শান্তিতে তাঁকে চেন। তিনি তোমাকে বিপদে চিনবেন।” (মুসনাদে আহমদ)
৫। সৎ আমলে অবিচলতা অশ্লীলতা ও মন্দ আমল হতে বিরত রাখে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“নিশ্চয়ই নামায অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখে।” (আনকাবূতঃ ৪৫)
৬। সৎআমলে অবিচল থাকা গুনাহ-খাতা মিটে যাওয়ার একটি মাধ্যম। যেমনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “ তোমাদের কারো দরজায় যদি একটি নদী থাকে, আর সে তাতে প্রতিদিন পাঁচবার করে গোসল করে, তবে তার দেহে কি কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে? সাহাবাগণ বলেনঃ না, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ এমনই পাঁচ ওয়াক্ত নামায, আল্লাহ যার দ্বারা গুনাহ সমূহকে মিটিয়ে দেন।” (বুখারী-মুসলিম)
৭। সৎ আমলে অবিচল থাকা, শেষ পরিণাম ভাল হওয়ার মাধ্যম। যেমনঃ আল্লাহ বলেনঃ
“যারা আমার পথে চেষ্টা-সাধনা করবে অবশ্যই আমি তাদেরকে আমার পথ দেখিয়ে দিব, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎআমল কারীগণের সাথে আছেন।” (আনকাবূতঃ ৬৯)
৮। এটি কিয়ামতের দিন হিসাব সহজ হওয়া ও আল্লাহর ক্ষমা লাভের উপায়।
৯। এ নীতি মুনাফেকী হতে অন্তরের পরিশুদ্ধতা ও জাহান্নামের আগুন হতে পরিত্রাণের একটি উপায়। যেমনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন (ক্রমাগত) জামায়াতের সাথে প্রথম তাকবীর পেয়ে নামায আদায় করবে তার জন্য দু’প্রকার মুক্তির ঘোষণাঃ (১) জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি ও (২) মুনাফেকী হতে মুক্তি। (তিরমিযী-হাসান)
১০। এটি জান্নাতে প্রবেশের উপায়ঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “ যে ব্যক্তি কোন জিনিসের দু’প্রকার আল্লাহর রাস্তায় খরচ করল, তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ হতে আহ্বান করা হবে। জান্নাতের রয়েছে আটটি দরজাঃ সুতরাং যে ব্যক্তি নামাযী তাকে নামাযের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে, যে ব্যক্তি জিহাদী তাকে জিহাদের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে, যে ব্যক্তি দান-খয়রাত ওয়ালা তাকে দান-খয়রাতের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে এবং যে ব্যক্তি রোযাদার তাকে রইয়ান নামক দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে।” (বুখারী-মুসলিম)
১১। যে ব্যক্তি নিয়মিত সৎ আমল করে অতঃপর অসুস্থতা, সফর বা অনিচ্ছাকৃত ঘুমের কারণে যদি সে আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তার জন্য সে আমলের সওয়াব লিখা হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “বান্দা যখন অসুস্থ হয় বা সফর করে, তবে তার জন্য অনুরূপ সওয়াব লিখা হয় যা সে গৃহে অবস্থানরত অবস্থায় ও সুস্থ অবস্থায় করত।” (বুখারী) এবং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “যে ব্যক্তির রাতে নামায ছিল কিন্তু তা হতে নিদ্রা তার উপর প্রভাব বিস্তার করে, তবে আল্লাহ তার জন্য সে নামাযের সওয়াব লিখে দিবেন এবং তার সে নিদ্রা হবে তার জন্য সদকা স্বরূপ। (নাসায়ী ও মুয়াত্তা মালিক-সহীহ)
আমলের পাঁচটি অপূর্ণতাঃ
এ-ক্ষেত্রে পদ্ধতিগুলো বিপরীত থেকে আলোচনা করা উচিত। অর্থাৎ কী কী কারণে আমল অপূর্ণ থেকে যায়, সেটা জানলেই ইবাদত কেনো সঠিক হয় না সেগুলো বোঝা যাবে। পাঁচটি অপূর্ণতা এ যুগে ব্যাপক আকারে বিরাজ করছে।
১. শেখা ও আমল না করাঃ প্রথম কথা হলো, আমরা ইলম শিখি বটে, কিন্তু আমলের বেলায় ততটা চেষ্টা করি না। এ কারণে যার সঙ্গে কথা বলুন, সে বলে- জি, আমার জানা আছে।
এভাবে জানে সবাই, আল্লাহ তায়ালা শুধু দেখেন এটাই যে, মানা হয় না । যদি কেবল জানার ওপর নির্ভর করে মাফ পাওয়া যেতো, তাহলে শয়তান পেয়ে যেতো আমাদের আগেই। তার জ্ঞান সম্পর্কে আমাদের কারও তো কোনো সন্দেহ নেই। শুধু জানার ভিত্তিতে ক্ষমা করা হবে না। যেমনি জ্বালানো না হলে প্রদীপ কোনো উপকার করে না, তেমনি আমল করা না হলে জ্ঞান কোনো উপকারে আসে না।
২. নেয়ামতের শোকর না করাঃ দ্বিতীয় হলো, আমরা আল্লাহর নেয়ামত চাই বটে, ব্যবহারও করি, কিন্তু সেইসব নেয়ামতের শোকর আদায় করি না। আমাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা অগুণতি নেয়ামত পাঠিয়ে থাকেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, শেষ করতে পারবে না। [সুরা নাহল, আয়াত ১৮]
এত অসংখ্য নেয়ামত তার। কিন্তু আমরা আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করি না। যে প্রতিপালক এত নেয়ামত খাওয়ান, তবু পেট ভরলে উঠে যাওয়ার পরে খাওয়ার দোয়াও স্মরণে থাকে না। এ জন্যে এক বুজুর্গ বলেন— হে বন্ধু, আল্লাহর নেয়ামত খেয়ে খেয়ে তোমার দাঁত তো ক্ষয়ে গেছে। কিন্তু শোকর আদায় করার বেলায় তোমার জিহ্বা ক্ষয়ে যেতে দেখছি না।
৩. গোনাহের মাফি না চাওয়াঃ তৃতীয় হলো, আমরা গোনাহ করি বটে, কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনা করি না। কিছু মানুষ এ কারণে করে না, তারা ভাবে-করে ফেলবো। অর্থাৎ, তাদের নিয়ত আছে গোনাহ ছেড়ে দেবার। কিন্তু মুখে বলে— হ্যাঁ, এখনি ছেড়ে দেবো। ‘আকমালুশ শিয়াম’ গ্রন্থে একটা আশচর্য কথা লেখা আছে। গ্রন্থকার বলেছেন- হে বন্ধু, তাওবার আশায় তোমার গোনাহ করতে থাকা এবং বেঁচে থাকার প্রত্যাশায় তওবা করতে দেরি করা তোমার বিবেক-প্রদীপ নিভে যাওয়ার প্রমাণ। রাবেয়া বসরি বলেন-আমরা যেভাবে তওবা করি, যেভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, এতটা উদাসীনভাবে চাই যে, এইরূপ ক্ষমা চাওয়ার জন্যে আবার ক্ষমা চাওয়া উচিত।
৪. মৃতব্যক্তি থেকে শিক্ষা না নেয়াঃ এরপরের সমস্যাটা হলো, আমরা মৃতব্যক্তিকে দাফন করে আসি বটে, কিন্তু শিক্ষাটা নেই না। এক ব্যক্তি আশ্চর্য এক কাহিনী শুনিয়েছেন। তিনি বলেন- আমার পাশের বাড়িতে একটা লোক থাকতো, তার মৃত্যু হয়ে গেলো। আমাদেরও খুব দুঃখ হলো। আমি আমার ঘরে এসে বাচ্চাদের বললাম- আজ থেকে অন্তত একমাস টিভি অন করা উচিত হবে না। কেননা, আমাদের সামনের প্রতিবেশির সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে আমদের। তারা কত বড় আঘাত পেয়েছে এই মৃত্যুতে। তাদের বাবা জোয়ান বয়সী ছিলেন, কাজবাজের অবস্থাও ভালো ছিলো তার।
আমার কথা শুনে আমার ঘরের স্ত্রী-সন্তান সবাই আমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করলো যে, আমরা আগামি চল্লিশ দিন টিভি অন করবো না। লোকটি এরপরের ঘটনা শোনালো যে, চতুর্থ দিন অতিবাহিত হওয়ামাত্র যেই প্রতিবেশির ঘরে মৃত্যু হয়েছে, শুনলাম, সেই ঘর থেকেই টিভির আওয়াজ আসছে। অর্থাৎ- সে-ঘরের সন্তানেরা বাবাকে দাফন করেছে বটে, কিন্তু কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি।
হাসান বসরি (রহ.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, গোরস্থানে গেলেই তার ওপর এমন বিষণ্নতা ছেয়ে যেতো যে, কয়েকবার সেই খাটিয়ায় শুইয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে, যে খাটিয়ায় লাশ গোরস্থানে নেয়া হয়েছিলো। এমন অবস্থা হতো তার। আল্লাম আব্দুল ওহাব শিয়িররানির (রহ.) গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, পূর্ববর্তী বুজুর্গগণ যখন লাশবাহী মিছিলের সঙ্গে যেতেন, তখন প্রতিটি মানুষের চোখ থেকেই অশ্রু ঝরতো। বহিরাগত কেউ দেখলে ধন্দে পড়ে যেতো যে, মৃত ব্যক্তির স্বজন কারা? দেখা যেতো, মৃত্যুকে স্মরণ করে সবাই কাঁদছে। পরকালের কথা স্মরণ করে, নিজেদের গোনাহের কথা মনে করে তারা মৃতব্যক্তির জানাজা থেকে শিক্ষা নিতো।
৫. নসিহত শুনে বাস্তবায়ন না করাঃ আর পঞ্চম বিষয়টি হলো, আজকালকার যুগে আমাদের বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীরা দরবেশ ও বুজুর্গদের ওয়াজ-নসিহত ভালোই শোনে। কিন্তু তদানুযায়ী আমল করে না। কেবল শুনেই দায় মেটায়। তারপর নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করে। এটা একটা নতুন সমস্যা। সবাই বলাবলি করে-অমুকের বয়ান এমন এবং অমুকের ওয়াজ তেমন। অথচ এইসব নিয়ে পড়ে না থেকে একটু ভাবা উচিত। এসব বাদ দিয়ে কেনো চিন্তা করছি না যে, এই কথার মধ্যে আমাদের আমল করার মতো কী বার্তা দেয়া হয়েছে।

ইবাদত
ইবাদত শব্দটি আরবী। আব্‌দ শব্দ থেকে ইবাদত শব্দটি গঠন করা হয়েছে। আব্‌দ মানে দাস। দাসের কাজ হলো গোলামী বা দাসত্ব করা, আনুগত্য স্বীকার করা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায়, প্রকাশ্য কিংবা গোপনীয় যেসব কর্ম আল্লাহ পছন্দ করেন, সেগুলির সামগ্রিক সমষ্টিই হলো ইবাদত। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাঃ যা করতে বলেছেন ও যা নিষেধ করেছেন, সেসব করা না করাকেই ইবাদত বোঝায়। আবার এভাবেও বলা যায়, ইবাদত হচ্ছে শরিয়তের পন্থায় নিজেকে ও নিজের পরিবার-পরিজনকে পরিচালিত করার নামই ইবাদত। আল্লাহ গোলাম হিসেবে তাঁর হুকুম ও রাসূলের তরীকা মতো যা করা হয় সেসবই আল্লাহর দাসত্ব। শুধু নামায-রোযাই ইবাদত নয়। আল্লাহর হুকুম মতো করলে সব কাজই ইবাদত।
অবশ্য একটু পার্থক্য আছে। নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত হলো বুনিয়াদী ইবাদত। এসব ইবাদতের দ্বারা আল্লাহর দাসত্ব করার অভ্যাস করানো হয়; যাতে দুনিয়ার অন্য সব কাজ আল্লাহর পছন্দমতো করার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। ওই চারটি ইবাদত অন্য সব কাজকে ইবাদত বানিয়ে দেয়। যেমন উপরে লেখা হাদীসে জানা গেল, নামায ঘুমকেও ইবাদত বানিয়ে দিতে পারে। মুমিনের জীবনের দীনদারী ও দুনিয়াদারী আলাদা আলাদা নয়। গোটা জীবনই দীনদারী ও ইবাদত। মানুষের জীবন আল্লাহর দাসত্বের অধীন না হলে শয়তানের দাসত্বের অধীন হতে বাধ্য।
তাই যতসব কথা-বার্তা ও কাজ-কর্মকে আল্লাহ পছন্দ করেন, যেমনঃ- সালাত (নামায) ক্বায়িম করা, সিয়াম (রোযা) পালন করা, ক্বোরবানী, নয্‌র-মানত প্রদান করা, সাদাক্বাহ, যাকাত প্রদান করা, আল্লাহ্‌র নিকট প্রার্থনা (দু‘আ) করা, আল্লাহ্‌কে ডাকা, আল্লাহ্‌র প্রতি ভয় ও আশা পোষণ করা, আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করা, আল্লাহ্‌র তাছবীহ্‌ (মহিমা), তাহ্‌মীদ (প্রশংসা), তাকবীর (মহত্ব), তাহ্‌লীল (আল্লাহ্‌র একত্ব) বর্ণনা করা, ক্বোরআনে কারীম তিলাওয়াত করা, ক্বোরআন ও ছুন্নাহ্‌তে বর্ণিত ও নির্দেশিত দু‘আ ও যিকর-আযকার করা, রাছূলের প্রতি সালাত ও ছালাম পাঠ করা ইত্যাদি, এ সব প্রতিটি কাজ হলো একেকটি ‘ইবাদাত। রাছূলের অনুসৃত ও প্রদর্শিত পন্থানুযায়ী একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের উদ্দেশ্যে, তাঁরই (আল্লাহ্‌র) সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে, তাঁর (আল্লাহ্‌র) প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ ভয় ও সর্বোচ্চ ভালোবাসা নিয়ে, তাঁর প্রতি পূর্ণ বশ্যতা ও আনুগত্য প্রদর্শন পূর্বক তাঁর (আল্লাহ্‌র) মহত্বের সম্মুখে অবনত মস্তকে চূড়ান্ত বিনয়ের সাথে ছাওয়াবের (আল্লাহ্‌র নিকট উত্তম প্রতিদান লাভের) আগ্রহ ও সুদৃঢ় আশা নিয়ে উপরোক্ত যে কোন কর্ম সম্পাদন করাকে আল্লাহ্‌র ‘ইবাদাত বলা হয়।
নামাজ পড়া যেমন ইবাদত, তেমনি প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াও ইবাদত। হজ করা যেমন ইবাদত, তেমনি জুলুম, অত্যাচার ও বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করাও ইবাদত। জাকাত দেয়া যেমন ইবাদত, তেমনি দুর্বল মানুষকে আর্থিক ও মানবিক সাহায্য করাও ইবাদত। এসব ইবাদত একটি বাদে অন্যটি অসম্পন্ন।
সুতরাং, রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসৃত ও প্রদর্শিত পন্থা অনুযায়ী একমাত্র আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে গভীর আগ্রহ ও সুদৃঢ় আশা নিয়ে আল্লাহ্‌র পছন্দনীয় কোনো কর্ম সম্পাদন করাকে ইবাদত বলা হয়।
ইবাদতের গুরুত্বকে আমাদের সম্মুখে তুলে ধরতে করে আল্লাহ তা’আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন, “এবং প্রত্যেক জাতির কাছে আমি রাসূল পাঠিয়েছি এ নির্দেশ দিয়ে যে, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো।” (আল কুরআন-১৬ : ৩৬)

ইবাদতের মূলনীতি
সকল প্রকার ইবাদত হলো সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহ নির্ভর বিষয়। আল্লাহ কিভাবে কোন পদ্ধতিতে তাঁর দাসত্ব তথা ইবাদত পছন্দ করেন, তা কেবল কুরআন ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ ব্যতীত অন্য কোনো মাধ্যমে জানা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ইবাদাতের ক্ষেত্রে নব-উদ্ভাবন বা মনগড়া পদ্ধতির কোনো অবকাশ নেই। কেননা কিভাবে ইবাদত করলে আল্লাহ খুশি ও সন্তুষ্ট হবেন তা কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমেই আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরিপূর্ণরূপে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই কুরআন ও সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরণই হলো ইবাদতের মূলনীতি।
ইবাদত কিভাবে করবো
এ-ক্ষেত্রে নামাজকে আইকন ধরা যাক। ধরুন আমরা এই দশদিনে যে-সব নামাজ পড়া হবে, সেগুলো পরিপাটি করে পড়বো। প্রতিটি রোকন ধীরে সুস্থে আদায় করে পড়বো। অর্থাৎ, রুকু-সেজদা ধীরস্থিরভাবে থেমে থেমে আদায় করবো। ‘খুশু-খুজুর’ সহিত পড়ার চেষ্টা করবো। শান্ত হয়ে পড়বো। আপন প্রতিপালকের সামনে এইভাবে নামাজ পড়ার অুনশীলন করবো।
এই উদাহরণটি লক্ষ করুন- হযরত ইসমাইল শহিদ (রহ.) একবার তার শায়খ সাইয়েদ আহমদ শহিদ (রহ.)- এর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। শায়খ জিজ্ঞেস করলেন- ভাই কী চাও? তিনি বলেন- হযরত, আমাকে সাহাবিদের মতো কোনো নামাজ পড়িয়ে দেন। শায়খ শুনে চুপ হয়ে রইলেন। রাত হলো। তাহাজ্জুদের সময় আমি উঠে পড়লাম। শায়খ আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন- উঠে পড়েছো? বললাম- হ্যাঁ, উঠে পড়লাম। শায়খ বললেন- যাও, আল্লাহর জন্যে অজু করে এসো। এই কয়েকটি শব্দে জানা নেই কী দীপ্তি ভরে ছিলো। ‘আল্লাহর জন্যে অজু করে এসো’ শুনতেই আমার হৃদয়ে আল্লাহর ভয় ও বড়ত্বের বিস্ময়কর এক তরঙ্গ বয়ে গেলো। আমি যেইমাত্র অজু করা শুরু করলাম, আমার মনে হচ্ছিলো যে, আল্লাহ আমাকে লক্ষ করছেন আর আমি তার সামনেই অজু করছি। আমি অজু করে এলাম। শায়খ জিজ্ঞেস করলেন- অজু করেছো? বললাম- হ্যাঁ, করে নিয়েছি। বললেন- আল্লাহর জন্যে দুই রাকাত নামাজ পড়ো এবার। দুই রাকাত নামাজ পড়বো। যখন আমি শুনলাম-আল্লাহর জন্যে পড়ো। আমি তখন দুইরাকাতের জন্যে নিয়ত বাঁধলাম বটে। সঙ্গে সঙ্গে আমার ওপর কান্না এসে ভেঙে পড়লো। আমি তো দুই রাকাত পড়বো মাত্র, কিন্তু হঠাৎ আমার মনে হলো আমি তো সঠিকভাবে পড়িনি। তাই আবার দুইরাকাত পড়লাম। তারপর আবার দুই রাকাত। এভাবে রাতভর আমি একশ’ নফল পড়লাম। কিন্তু আমার ‘একটি’ দুইরাকাতেও তৃপ্তি হয়নি। এরপর শায়খ বললেন- সাহাবায়ে কেরাম এমন করেই নামাজ পড়তেন। নিজেদের পক্ষে যতদূর সম্ভব দৃঢ়ভাবে আদায় করতেন, তারপর বলতেন- আমরা যেভাবে উচিত সেভাবে তোমার ইবাদত করতে পারিনি। সেভাবে তোমাকে চিনতে পারিনি, যেভাবে চেনা উচিত। এই ছিলো সাহাবায়ে কেরামের নামাজ। আমরাও ধীরে সুস্থে প্রতিটি রোকন আদায় করে নামাজ পড়বো।
ইবাদত কবুল হওয়ার শর্তাবলী-
যে কোনো আমল বা ইবাদত আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত রয়েছে। যদি তন্মধ্যে একটি শর্তও না পাওয়া যায় তবে তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। শর্তগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
১) ঈমানঃ অর্থাৎ ইবাদতকারীকে আল্লাহ্‌র একত্ববাদে দৃঢ়বিশ্বাসী হতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানকে অস্বীকার করবে, নিঃসন্দেহে তার সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (আল কুরআন-৫ঃ৫)
২) ইখলাসঃ তথা বিশুদ্ধ নিয়ত বা সংকল্প। অর্থাৎ ইবাদত করতে হবে একনিষ্ঠভাবে, কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। এছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে করলে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না।
মোটকথা, ইবাদতকে সম্পূর্ণরূপে সকল প্রকার শির্‌ক তথা অংশীদারীমুক্ত রাখতে হবে এবং একনিষ্ঠভাবে এক আল্লাহ্‌র ইবাদত করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তাদেরকে এ নির্দেশ করা হয়েছে যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্‌র ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত আদায় করবে…” (আল কুরআন-৯৪ঃ৫)
৩) সুন্নতের অনুসরণঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে যেভাবে ইবাদত করতে শিখিয়েছেন ঠিক সেভাবেই আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। আল্লাহ বলেন, “(হে নবী) আপনি বলে দিন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমার অনুসরণ করো।” (আল কুরআন-৩ঃ৩১)
“তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” (আল কুরআন-৩৩ঃ২১)
অর্থাৎ, কোনো অবস্থাতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসৃত ও প্রদর্শিত পন্থা ব্যতীত অন্য কোনো পন্থায় আল্লাহর ইবাদত করা যাবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামও এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনের মধ্যে এমন কোনো নবউদ্ভাবন ঘটাবে যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।”
সুতরাং, যে কোনো আমল তথা ইবাদত আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য উপরোক্ত তিনটি শর্ত অবশ্যই থাকতে হবে। এগুলি ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহর নিকট কবুল হবে না।
ইবাদতের প্রকারভেদ
ইবাদতকে সাধারণভাবে দুই প্রকারে বিন্যস্ত করা যায়।১. কিছু ইবাদত বা আমল আছে যেগুলি আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত। এগুলিকে হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক বলে। ২. আর কিছু আমল আছে যেগুলি বান্দার সাথে সম্পর্কিত। এগুলিকে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক বলে।
১. সালাত, সিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত, আল্লাহর নিকট দু‘আ করা, আল্লাহর যিকির করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বাধিক ভালোবাসা, আল্লাহকে ভয় করা ও তাঁর নিকট তাওবা করা, কথা-বার্তায় সত্যবাদিতা অবলম্বন করা, কাফের ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ইত্যাদি ইবাদত আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত।
২. অনুরূপভাবে, আমানত আদায় করা, পিতামাতার সেবা করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, ওয়াদা বা অঙ্গীকার পূর্ণ করা, সৎকাজের আদেশ দেয়া ও অন্যায় কাজে বাধা দেয়া, ইয়াতীম, মিসকীন, অসহায়, মুসাফির ও দাস-দাসির প্রতি অনুগ্রহ করা, জীব-জন্তুর প্রতি ইহসান বা দয়া করা ইত্যাদি সবগুলোই আলাহর বান্দা বা সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। এগুলির কোনোটির মধ্যে কমবেশি করলে তা ইবাদতে ত্রুটি বলে গণ্য হবে।
পূর্বসূরিদের ইবাদতের প্রকৃতি
ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)- এর আমলঃ ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ছিলেন সেকালের চিফ জাস্টিস। তার সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে তিনি ছিলেন সবচে’ বড় বিচারপতি। দিনভর তিনি তো ইসলামের কাজেই মশগুল থাকতেন। তারপর যখন রাত নেমে আসতো, দেখা যেতো, প্রতিরাতেই তিনি দুইশ’ রাকাত নফল নামাজ পড়ছেন।
এত ব্যস্ত মানুষ, অথচ দেখুন, রাতে এত বেশি আল্লাহর ইবাদত করেছেন। দীনের জন্যে তারা নিজেদের জীবন কত সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিয়েছেন, দেখুন।
রাবেয়া বসরি (রহ.)- এর আমলঃ এক ব্যক্তি রাবেয়া বসরিকে (রহ.) দিয়ে দোয়া করাবে। কোনো এক দুশ্চিন্তায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে সে। সে বলছে- আমি ফজরের পরে গেলাম তার সাক্ষাতে, তিনি তখন নফল নামাজ পড়ছেন। আমি ভাবলাম- জোহরের পরে গেলেই ঠিক হবে। গেলাম আবার, তিনি নফল পড়ছেন। আমি ভাবলাম- আছরের পরে গেলেই ভালো। গেলাম আছরের পরে, দেখলাম তিনি কোরআন তেলাওয়াত করছেন। ঠিক আছে, তাহলে মাগরিবের পরে যাই। তখনও গিয়ে দেখি নফল পড়ছেন। এবার ভাবলাম- এশার পরেই যাই। গিয়ে দেখি, এশার পরেও তিনি নফলের নিয়ত বেঁধেছেন এবং পড়েই যাচ্ছেন, শেষই করছেন না। এভাবেই তিনি সারাটা রাত কাটিয়ে দিলেন। ফজরের সময় হলো। ফজর নামাজ পড়লেন। আমি ফজর পরে তাড়াতাড়ি গেলাম। ফজরের পরে ইশরাক আদায় করে ক্ষণিকের জন্যে চোখটা একটু বুজে এসেছে তার। আমি যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম, আমার পায়ের আওয়াজে তার চোখ খুলে গেলো। তিনি এমন ধড়মড় করে উঠে বসলেন, যেমন কেউ ‘খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে, জরুরি কোথাও যেতে হবে’ এমনভাবে উঠে বসে। উঠে তিনি দোয়া করলেন- হে আল্লাহ, আমি এমন চোখ থেকে তোমার পানাহ চাই, যা ঘুমিয়ে মোটে তৃপ্তই হয় না। দিনের অল্প একটু সময় ঘুমে ব্যয় হয়েছে, আর তার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন।


মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা নভেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০০

রাজীব নুর বলেছেন: বিশাল পোষ্ট।
পোষ্টের মূলভাব বুঝতে পেরেছি। তাই পোস্ট পড়ার প্রয়োজন অনুভব করছি না।

২| ০১ লা নভেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৭

জাফরুল মবীন বলেছেন: খুব সুন্দর পোস্ট।ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।

আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।

তবে রাবেয়া বসরি'র কাহিনিটা অতিরঞ্জন মনে হলো।

শুভকামনা রইলো আপনার জন্য।

৩| ০১ লা নভেম্বর, ২০২০ রাত ১১:২৭

মরুর ধুলি বলেছেন: আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দিন।
অনেক বড় পোষ্ট। খণ্ডাকারে ধারাবাহিকভাবে দিলে ভাল হতো।
আজকাল মানুষের চোখ ফ্রান্সের দিকে । দিন দিন দুনীয়ার অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে।
মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধারালো করার মতোও কিছু লিখুন।
ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.