নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গুনাহ ও শিরক

০৭ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:৪২

গুনাহঃ
আল্লাহর ও আল্লাহর রাসূল যেসব কাজ করতে বলেছেন তা না করা এবং যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা করা হলো গুনাহ। খারাপ কথা, খারাপ কাজ ও খরাপ আচরণও গুনাহ। কারো হক নষ্ট করা, কাউকে গালি দেয়া, কাউকেও কষ্ট দেয়া, কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করা, আল্লাহর দেয়া সিমা লংঘন করাও গুনাহের কাজ। গুনাহ আল্লাহর সাথে ও বান্দার সাথে জড়িত। আল্লাহর সাথে জড়িত গুনাহ আল্লাহ ইচ্ছা করলে মাপ করে দিতে পারেন কিন্তুু বান্দার সাথে গুনাহ বান্দা যতক্ষন পর্যন্ত মাপ না করে দিবেন ততক্ষন পর্যন্ত আল্লাহও মাপ করতে পারবেন না।
গুনাহের প্রকারঃ
গুনাহ সাধারণত তিন প্রকারের হয়ে থাকে।
১. ফরয ইবাদত ছেড়ে দেড়া : আল্লাহতায়ালা বান্দার উপর যে সকল ইবাদত ফরয করেছেন সে গুলোকে ছেড়ে দেয়া। যেমন নামায, রোজা, যাকাত ইত্যাদি। সালাত আদায় না করা কবীরা গুনাহ অনুরূপভাবে সওম এবং যাকাত আদায় না করাও কবীরা গুনাহ। এ ধরনের গুনাহ হতে মাপ পাওয়ার জন্য করণীয় হল, যে সকল ইবাদত ছুটে গিয়াছে তা যথা সম্ভব ক্বাযা আদায় করা। আর যদি ক্বাযা আদায় করা সম্ভব না হয় তার বিকল্প যেমন রোজার ক্ষেত্রে ফিদয়া আদায় করা। আর যদি তাও সম্ভব না হয় তবে তার জন্য আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতে হবে এবং আল্লাহর নিকট হতে মাপ করিয়ে নিতে হবে।
২. নিষিদ্ধ কাজ করা : আল্লাহ এবং বান্দার মাঝে সংঘটিত গুনাহসমুহ। যেমন : মদ পান করা, গান বাজনা করা, সুদ খাওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের গুনাহের কারণে অবশ্যই লজ্জিত হতে হবে এবং মনে মনে প্রত্যয়ী হতে হবে যে এ ধরনের গুনাহ ও অপরাধ আর কখনো করবে না।
৩. গুনাহ বান্দার সাথে সর্ম্পকিত : গুনাহের সর্ম্পক বান্দার সাথে। এ ধরনের গুনাহ সবচেয়ে কঠিন ও মারাত্মক। এ ধরনের গুনাহ আবার কয়েক ধরনের হতে পারে-
(ক) মালের সাথে সর্ম্পকিত : ধন সম্পদের সাথে সম্পর্কিত, এ বিষয়ে করণীয় হল যে লোকের কাছ থেকে কর্জ নিয়েছেন অথবা যার হক্ব নষ্ট করেছেন কিংবা যার ক্ষতি করেছেন, আপনাকে অবশ্যই তার পাওনা পরিশোধ করতে হবে এবং তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদি পরিশোধ বা ফেরত দেয়া সম্ভব না হয়, হয়ত যে সম্পদটি আপনি নষ্ট করেছিলেন তা এখন আর আপনার নিকট অবশিষ্ট নাই, কিংবা আপনি নি:স্ব হয়ে গিয়েছেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত লোকটি হতে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তার থেকে অনুমতি নিয়ে তা হালাল করে নিতে হবে। আর যদি এ রকম হয় যে লোকটি মারা গিয়েছে অথবা অনুপুস্থিত। যার কারণে ক্ষতিপূরণ দেয়া কিংবা মাফ নেওয়া এর কোনটিই সম্ভব নয় তাহলে তার পক্ষ হতে তা দান করে দিতে হবে। আর যদি তাও সম্ভব না হয়, তবে তাকে অবশ্যই বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে, আল্লাহর দরবারে বেশী বেশী তাওবা ও কান্নাকাটি করতে হবে যাতে আল্লাহ ক্বিয়ামত দিবসে লোকটিকে আপনার উপর রাজি করিয়ে দেয়।
(খ) মানুষের সাথে সর্ম্পকিত : মানুষের জীবনের সাথে সম্পর্কিত, যেমনÑহত্যা করা বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট করা, তাহলে আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি অথবা তার অবিভাবককে ক্বিসাস বা প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ দিতে হবে অথবা তারা আপনাকে ক্ষমা করে দিবে এবং কোনো বদলা নেবে না মর্মে একটি সমঝতায় পৌঁছতে হবে। আর যদি তাও সম্ভব না হয়, তবে অবশ্যই আল্লাহর দরবারে বেশী বেশী তাওবা ও কান্নাকাটি করতে হবে, যাতে আল্লাহ ক্বিয়ামত দিবসে লোকটিকে আপনার উপর রাজি করিয়ে দেন।
(গ) মানুষের সমভ্রম হরণ করা : গীবত করা, কারো বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া অথবা গালি দেয়া ইত্যাদি। তখন আপনার করণীয় হল, যার বিপক্ষে এ সকল কথা বলেছিলেন, তার নিকট গিয়ে নিজেকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করা এবং বলা যে ভাই আমি মিথ্যুক, আমি আপনার বিরুদ্ধে যে সব অপবাদ বা বদনাম করেছি তা ঠিক নয় আমি মিথ্যা বলেছি। আর যদি ঝগড়া বিবাদ বা নতুন কোন ফাসাদ কিংবা লোকটির ক্রোধ আরো প্রকট আকার ধারণ করার সম্ভাবনা না থাকে তবে তার নিকট সব কিছু প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অন্যথায় আল্লাহর নিকট অধিক হারে তাওবা করতে হবে। যাতে আল্লাহ তাকে আপনার উপর রাজি করিয়ে দেন। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা আল্লাহ যেন লোকটির জন্য এর বিপরীতে তার জন্য অশেষ কল্যাণ নিহিত রাখে এবং তার জন্য বেশী বেশী প্রার্থনা করবেন।
(ঘ) ইজ্জত হরণ করা : যেমন কারো অনুপস্থিতিতে তার পরিবারের ইজ্জত হরণ অথবা সন্তান-সন্তুতির অধিকার নষ্ট বা খিয়ানত করা।
গুনাহের খারাপ পরিণতি ও ক্ষতিকর দিকসমূহঃ
গুনাহ মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের জন্যই ক্ষতিকর। গুনাহের কারণে মানুষ দুনিয়াতে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, অপমান-অপদস্থের শিকার হয়। দুনিয়ার জীবনে তার অশান্তির অন্ত থাকে না। অনেক সময় দুনিয়ার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ফলে দুনিয়াতেও গুনাহের কারণে তাকে নানাবিধ শাস্তি ও আজাব-গজবের মুখোমুখি হতে হয় এবং আখেরাতে তো তার জন্য রয়েছে অবর্ণনীয়-সীমাহীন দুর্ভোগ। এ ছাড়া গুনাহ কেবল মানুষের আত্মার জন্যই ক্ষতিকর নয় বরং আত্মা ও দেহ দুটির জন্যই ক্ষতিকর। গুনাহ মানুষের জন্য কঠিন এক ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনে। গুনাহ মানুষের আত্মার জন্য এমন ক্ষতিকর যেমনিভাবে বিষ দেহের জন্য ক্ষতিকর।
১.ইলম তথা দ্বীনি জ্ঞান লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়া : ইলম হল নূর যা আল্লাহ মানুষের অন্তরে স্থাপন করেন কিন্তু গুনাহ-পাপাচার এ নূরকে নিভিয়ে দেয়। সুতরাং গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কখনো ইলম তথা শরিয়তের জ্ঞান লাভে ধন্য হতে পারে না। ইলম হল, আল্লাহর নূর আর গুনাহ হলো অন্ধকার। আর এ কথা স্পষ্ট যে, আলো ও অন্ধাকার কখনো এক হতে পারে না।
২.রিযিক থেকে বঞ্চিত হওয়া : বান্দা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে রিযিক হতে বঞ্চিত হয়। মানুষের রিযিকে সংকীর্ণতা দেখা দেয়। সুতরাং, রিযিকের স্বচ্ছলতা কামনাকারীদের জন্য গুনাহের কাজ ছেড়ে দিতে হবে।
৩.গুনাহ দেহ ও আত্মাকে দুর্বল করে দেয় : নেক আমলের কারণে মানুষের চেহারা উজ্জ্বল হয়, অন্তর আলোকিত হয়, রিযিক বৃদ্ধি পায়, দেহের শক্তি ও মনোবল চাঙ্গা হয়, মানুষের অন্তরে মহব্বত বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে খারাপ কাজে মানুষের চেহারা কুৎসিত হয়, অন্তর অন্ধকার হয়, দেহ দুর্বল হয়, রিযিক সংকীর্ণ হয় এবং মানুষের অন্তরে তার প্রতি ঘৃণা জন্মায়।
৪.গুনাহ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য হতে বঞ্চিত করে : গুনাহ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য হতে বঞ্চিত করে। যদি গুনাহের কারণে তাকে কোন শাস্তি নাও দেয়া হয়, কিন্তু সে আল্লাহর বিশেষ ইবাদত বন্দেগী হতে বঞ্চিত হবে।
৫.গুনাহকে ঘৃণা বা খারাপ জানার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে : ফলে গুনাহের কাজে সে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং সমস্ত মানুষও যদি তাকে দেখে ফেলে বা তার সামলোচনা করে এতে সে লজ্জাবোধ বা গুনাহ করাকে খারাব ও অন্যায় মনে করে না। এ ধরনের মানুষকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না এবং তাদের তাওবার দরজাও বন্ধ হয়ে যায়।
৬.গুনাহর গোষণা না দেয়া : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন ‘‘আমার সকল উম্মতকে ক্ষমা করা হবে একমাত্র ঘোষণা দানাকারী ছাড়া। আর ঘোষণা হল, কোন ব্যক্তি রাতে কোন পাপ করল আর আল্লাহ তার অপকর্মকে গোপন রাখলেন কিন্তু লোকটি সকালে লোকদের ডেকে ঘোষণা করতে লাগল, হে অমুক আমি রাতে এই এই কাজ করেছি। রাতে তার রব তাকে গোপন করল আর সকালে সে আল্লাহর গোপন করা বিষয় প্রকাশ করে দিল। (সহীহ মুসলিম)
৭.গুনাহকে কিছু মনে না করা : বান্দা গুনাহ করতে করতে গুনাহ তার জন্য সহজ হয়ে যায়, অন্তরে সে গুনাহকে ছোট মনে করতে থাকে। তার মধ্যে অপরাধ বোধ অবশিষ্ট থাকে না। ফলে সে কোন অপরাধকে অপরাধ মনে করে না। আর এটাই হল একজন মানুষের জন্য ধ্বংসের নিদর্শন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-“মু’মিন নিজ গুনাহগুলোকে এমনভাবে দেখে যে, যেন একটি পাহাড়ের পাদদেশে বসে আছে আশঙ্কা করছে যে সেটি তার উপর পতিত হবে আর পাপী নিজ গুনাহসমূহকে মাছির মত মনে করে যা তার নাকের উপর পড়েছে একটু পর উড়ে গিয়েছে। (সহীহ মুসলিম)
৮.গুনাহ লাঞ্ছনা ও অপমানের কারণ হয়ে থাকে : সকল প্রকার ইজ্জত একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আল্লাহর আনুগত্যের বাহিরে কোথাও ইজ্জত সম্মান পাওয়া যাবে না। তিনি যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করেন আর যাকে ইচ্ছা বেÑইজ্জত করেন। আল্লাহ বলেন-‘‘কেউ ইজ্জতের আশা করলে মনে রাখতে হবে যে, সমস্ত ইজ্জত আল্লাহরই।’’ (ফাতের : ১০) অর্থাৎ ইজ্জত আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমেই তালাশ করা উচিত, কারণ, আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া কোথাও ইজ্জত খুঁজে পাওয়া যাবে না। আল্লাহর আনুগত্যের বাহিরে যে ইজ্জত তালাশ করবে তাকে অবশ্যই বেÑইজ্জত হতে হবে। তাকে ভোগ করতে হবে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা আর হতাশার গানী। তাই আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমেই ইজ্জত তালাশ করতে হবে।
৯.গুনাহ মানুষের জ্ঞান বুদ্ধিকে ধ্বংস করে দেয় : কারণ মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির জন্য একটি আলো বা নূর থাকে আর গুনাহ ঐ নূর বা আলোকে নিভিয়ে দেয়, ফলে জ্ঞান বুদ্ধি ধ্বংস হয়ে যায়।
১০.গুনাহ অন্তরকে কাবু করে ফেলে : গুনাহ গুনাহকারীর অন্তরকে কাবু করে ফেলে এবং সে ধীরে ধীরে অলসদের অর্ন্তভুক্ত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন-অর্থাৎ ‘‘কখনো না, বরং তারা যা করে তাই তাদের হৃদয়ে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে।’’ (মুতাফফিফীন : ১৪)
এ আয়াত সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম বলেন, বার বার গুনাহ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে। তখন তার অন্তর আর ভাল কিছু গ্রহণ করে না। ভাল কাজ, ভাল কোন উপদেশ এবং মনীষীদের বাণী সবই তার কাছে অসহনীয় ও বিরক্তিকর মনে হয়। ফলে সে তার মনের ইচ্ছা ও খেয়াল খুশি মত যা ইচ্ছা তাই করতে থাকে। কোন অন্যায় অপরাধ তার নিকট অন্যায় মনে হয় না। গুনাহ তার নিকট আর গুনাহ বলে বিবেচিত হয় না। এ ধরনের লোকের সংখ্যা বর্তমান সমাজে অসংখ্য রয়েছে। তারা সালাত আদায় করে না, সওম পালন করে না, যাকাত প্রদান করে না। কিন্তু এ সব যে প্রতিটিই মারাত্মক অপরাধ তা তাদের মনে একটুও রেখাপাত করে না। তারা যে অপরাধী, গুনাহগার ও পাপী এ ধরনের কোন অনুভূতি তাদের মনষ্পটে জাগ্রত হয় না এবং তাদের বিবেক বিন্দু পরিমাণও নাড়া দেয় না। ফলে তাদের অন্তর পাথরের চেয়ে বেশি কঠিন হয়ে যায়। তাদের অন্তরসমূহ হককে গ্রহণ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। ফলে এক পর্যায়ে ঈমান হারা হয়ে মারা যায়। আল্লাহ আমাদেরকে এ ধরনের পরিণতি হতে হেফাজত করুন।
১১.গুনাহ বান্দাকে অভিশাপের অর্ন্তভুক্ত করে : গুনাহ বান্দাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অভিশাপের অর্ন্তভুক্ত করে। কারণ, তিনি গুনাহগারদের ওপর অভিশাপ দিয়েছেন। যেমন সুদ গ্রহীতা, দাতা, লেখক ও সাক্ষী-সকলের উপর অভিশাপ করেছেন। এমনিভাবে অভিশাপ করেছেন চোরের উপর। গাইরুল্লাহর নামে জবেহকারী, জীবের ছবি অংকনকারী, মদ্যপানকারীসহ বিভিন্ন গুনাহের উপর তিনি অভিশাপ করেছেন। সুতরাং, মনে রাখতে হবে, যে গুনাহের কারণে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিশাপ করেছেন সে সব গুনাহে লিপ্ত হলে তাকে অবশ্যই আল্লাহ ও তার রাসূলের অভিশাপের ভাগীদার হতে হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের অভিশাপের ভাগীদার হয় তার পরিণতি যে কী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১২.গুনাহ দু’আ হতে বঞ্চিত করে : গুনাহ আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার ফেরেশতাদের দু’আ হতে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হয়। কেননা, আল্লাহ তার নবীকে বান্দা বান্দীদের জন্য দু’আ করার আদেশ দিয়েছেন।
ইবাদত, আনুগত্য ও খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্য মহান আল্লাহ আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। বাঁচিয়ে রেখেছেন নানা নেয়ামতরাজী দ্বারা। সুতরাং আনুগত্য করাই আমাদের কাজ। কল্যাণ ও কামিয়াবির পথ এটিই। তার পরও নফস-শয়তানের প্রবঞ্চনায় অন্যায়-অপরাধ হতে পারে, হয়ে যায়। কিন্তু রহমানুর রাহীম মহান আল্লাহর করুণা সীমাহীন। তিনি বান্দাকে অপরাধ মুক্ত হিসাবে হাশরে উপস্থিত দেখতে চান। তাই অন্যায় হয়ে গেলেও তার প্রতিকারের সুন্দর ব্যবস্থা রেখেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, পাপ থেকে তাওবাকারী এমন হয়ে যায় যেন সে পাপই করেনি। তিনি আরো বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ মৃত্যুর লক্ষণ শুরু হওয়া অবধি বান্দার তাওবা কবুল করেন। তাই সুবিবেচনা ও নিজের প্রতি ইনসাফের পরিচয় হবে, সর্বদা পাপমুক্ত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। যদি পাপ হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই তাওবা সুযোগ গ্রহণ করা। তাওবাতে আল্লাহ অনেক খুশি হন।
গুনাহ সর্ম্পকে কুরআনের ভাষ্যঃ
১. হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজের আত্মার উপর জুলুম করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই, আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করেন। নি:সন্দেহে তিনি অধিক ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। (যুমার : ৫৩)
এ আয়াত অনুযায়ী আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া নিষিদ্ধ বা কুফরী।
২. যারা অশ্লীল কাজ করে ফেললো কিংবা নিজেদের আতœার উপর জুলূম করে ফেললো, নিজেদের গুনাহর জন্য আল্লাহ কে স্মরণ করলো; আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যিনি গুনাহ মাফ করেন এবং তারা জেনে-শুনে কৃত গুনাহর পুনারাবৃত্তি করে না। তাদের পুরস্কার হলো, আল্লাহ ক্ষমা এবং এমন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত তারা সেখানে চিরদিন থাকবে। আমলকারীদের পুরস্কার কতই না উত্তম! (ইমরান : ১৩৫ ও ১৩৬)
৩. আপনি যাদের মধ্যে মওজুদ থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে আজাব দেবেন না, যারা গুনাহ মাফ চায়, আল্লাহ তাদের উপরও আজাব দেন না। (আনফাল : ৩৩)
৪. অত:পর আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টি ধারা ছেড়ে দেবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য বাগান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী-নালা প্রবাহিত করবেন। (নুহ : ৯-১২)
৫. নিশ্চয়ই নেক কাজ পাপ ও গুনাহ দূর করে দেয়। (হুদ : ১১৪)
৬. জেনে রাখুন, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। ক্ষমা প্রার্থনা করুন, আপনার ক্রটির জন্যে এবং মু’মিন পুরুষ ও নারীদের জন্যে। আল্লাহ, তোমাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত। (মুহাম্মদ : ১৯)
৭. হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যারা মু’মিন হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করে-তাদেরকে এবং মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীদেরকে ক্ষমা করুন এবং যালেমদের কেবল ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন। (নূহ : ২৮)
৮. তারা উভয়ে বলল : হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব। (আ’রাফ : ২৩)
৯. আপনি আমার বান্দাদের জানিয়ে দিন যে, নিশ্চয় আমিই একমাত্র ক্ষমাকারী দয়ালু। (হিজর : ৪৯)
১০. তোমরা তোমাদের প্রভূর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন (তাওবা) কর। (হুদ : ৩)
১১. এবং তোমরা আল্লাহ কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (মুযযাম্মিল : ২০)
১২. হে ঈমানদারগণ, তোমরা সবাই তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসো, যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (নূর : ৩১)
১৩. তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মু’মিন নারী-পুরুষদের ক্রটি-বিচ্যুতির জন্য। (মুহাম্মদ : ১৯)
১৪. আর তুমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালূ । (নিসা : ১০৬)
১৫. হযরত মূসা (আঃ) বললেন, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের উপর যুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু। (কাসাস : ১৬)
গুনাহ সর্ম্পকে হাদীসের ভাষ্যঃ
১. আল্লাহ দিনে গুনাহকারীদের গুনাহ মাফ করার জন্য রাত্রে নিজ ক্ষমার হাত সম্প্রসারিত করেন এবং রাত্রে গুনাহকারীদের গুনাহ মাফ করার জন্য দিনের নিজ ক্ষমার হাত সম্প্রসারিত করেন। কেয়ামতের আগে পশ্চিমে সূর্যোদয় পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে। আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফের জন্য রীতিমত অপেক্ষা করেন। বান্দা মাফ চাইলেই মাফ পেতে পারে।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: সেই ব্যক্তির নাক ধূলামলিন হোক, যে রমযান পেয়েছে কিন্তু তার গুনাহ মাফ করাতে পারেনি। (জামে আত তিরমিযী, হাকেম)
৩. হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত আছে : আল্লাহ বলেন, হে বনি আদম! তুমি আমার কাছে যা আশা করো এবং চাও, আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম এবং এ জন্য আমি কোন পরোয়া করি না। (জামে আত তিরমিযী)
৪. হাদীসে কুদসীতে আরো এসছে : আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দা! তোমরা দিনে রাতে গুনাহ করে থাকো, আর আমি সকল গুনাহ মাফ করি। তোমরা আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেব। (সহীহ মুসলিম)
গুনাহ মাফের জন্য এর চাইতে বড় প্রতিশ্রুতি আর কি হতে পারে?
৫. হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ বলেন, হে বনি আদম! তুমি আমার নিকট যা যা দোয়া ও প্রত্যাশা করো, আমি তোমার সকল গুনাহ মাফ করে দেবো এবং এ ব্যাপারে আমি কোন কিছুর পরোয়া করবো না। হে বনি আদম! যদি তোমার গুনাহ আকাশের মেঘমালার মতো বিপুল পরিমাণও হয়, তারপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমার সে গুনাহ মাফ করে দেবো এবং সে জন্য আমি কোন পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! যতি তুমি জমীন পরিমাণ বিশাল গুনাহরাশি নিয়েও আমার দিকে ফিরে আসো এবং আমার সাথে আর কাউকে শরীক না করো, তাহলে আমিও তোমার প্রতি জমীন পরিমাণ বিশাল ক্ষমা নিয়ে হাজির হবো। (জামে আত তিরমিযি)
বন্ধুগন! ক্ষমার জন্য এর চাইতে বড় আহবান আর কি হতে পারে?
৬.হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ, তোমরা যদি গুনাহ না করতে তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে উঠিয়ে নিতেন এবং যারা গুনাহ করে এমন জাতি তৈরী করতেন। তার পর তারা আল্লাহ কাছে ক্ষমা চাইত, তিনি তাদেরকে ক্ষমা কতে দিতেন। (সহীহ মুসলিম)
গুনাহ করার পর গর্ব-অহংকার না করে আল্লাহ কাছে বিনীতভাবে গুনাহ মাফ চাওয়া ও তাওবা করা দরকার। তাওবা করলে আল্লাহ গুনাহ মাফ করেন। বান্দা গুনাহ করবে, আল্লাহ তা জানেন।
৭. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি নিজ আমলনামা দেখে খুশি হতে চায় সে যেন বেশী করে গুনাহ মাফ চায়। (সুনানে বায়হাকী)
৮. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : নিশ্চয়ই শয়তান বলেছে, হে আমার রব, আপনার ইজ্জতের শপথ করে বলছি, আমি আপনার বান্দাদেরকে তাদের শরীরে প্রাণ থাকা পর্যন্ত গোমরাহ করতে থাকবো। তখন রব বলেন, আমার ইজ্জত ও শ্রেষ্ঠত্বের শপথ করে বলছি, তারা যে পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে থাকবে, আমি তাদেরকে ক্ষমা করতে থাকবো। (মুসনাদে আহমদ)
৯. মোমেনের প্রতিটি বিষয়ই কল্যানকর। ক্রুটি করাও কল্যাণকর হতে পারে যদি মানুষ এরপর তাওবা করে বিনীত হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।
১০.হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : আমার বান্দা যখন নেক কাজের ইচ্ছা করে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমল করেনি, আমি তার জন্য একটি সওয়াব লিখি। আর যদি আমল করে তাহলে, ১০ থেকে ৭শ গুন সওয়াব লিখি। যদি গুনাহর কাজের ইচ্ছা করে, কিন্তু এখন ও তা করেনি, আমি তা লিখি না। কিন্তু যদি কাজটি করে ফেলে, তাহলে, আমি কেবল ১টি গুনাহ লিখি। (সহীহ মুসলিম)
১১.রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : মোমেনের বিষয় আশ্চর্যজনক। তার প্রত্যেকটি জিনিসই কল্যাণকর। আর এটা মোমেন ছাড়া আর কারো জন্য নয়। সে সুখ ও আনন্দ পেলে শুকরিয়া আদায় করে, সেটা তার জন্য কল্যাণকর। আর দু:খ ও কষ্ট পেলে ধৈর্য ধারণ করে; সেটাও তার জন্য কল্যানকর।’ (সহীহ মুসলিম)
গুনাহ ও ক্রটি তখন কল্যাণকর হবে, যখন তা মানুষকে অধিক সওয়াবের কাজ এবং তাওবা-এস্তেগফারের জন্য উদ্ধুদ্ধ করে। এ জন্য কোন গুনাহ সংঘটিত হয়ে গেলে তাওবার সাথে সাথে আরো কিছু নেক কাজ করা কর্তব্য। তা সেই গুনাহর কাফফারা হয়ে যাবে।
১২.হযরত আবু মুসা আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস আল আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহতায়ালার দিনের অপরাধীদের ক্ষমা করার জন্য রাতে এবং রাতের অপরাধীদের ক্ষমা করার জন্য দিনে ক্ষমার হাত প্রসারিত করে রাখেন। (সহীহ মুসলিম)
১৪.হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের লক্ষ্য করে বলেন, আমি যুলুমকে আমার উপর হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের মাঝেও যুলুম করাকে হারাম করে দিয়েছি। অতএব, তোমরা একে অপরে উপর যুলুম করো না। হে আমার বান্দাহগণ! তোমরা হেদায়াত প্রাপ্তির জন্যে দোয়া করো। আমি তোমাদেরকে হেদায়াত দান করবো হে আমার বান্দাহগণ! আমি যাকে খাদ্য দান করেছি, সে ছাড়া তোমাদের প্রত্যেকেই ক্ষুধার্থ। অতএব তোমরা আমার নিকট খাদ্য প্রার্থনা করো আমি তোমাদের খাদ্য দান করব। হে আমার বান্দাহগণ! তোমাদের মধ্য হতে যাকে আমি বস্ত্র পরিধান করিয়েছি সে ছাড়া আর সকলেই উলঙ্গ। অতএব তোমরা আমার নিকট বস্ত্র পরিধানের জন্য দোয়া করো, আমি তোমাদেরকে পরিধান করাবো। হে আমার বান্দাহগণ! তোমরা রাতে ও দিনে গুণাহ করে থাকো এবং আমি সকল গুণাহ ক্ষমা করতে পারি। অতএব তোমরা আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবো। (সহীহ মুসলিম)
১৫.হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : আল্লাহ তায়ালা বলেছেন; হে আদম সন্তান! যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমাকে ডাকবে এবং আমার কাছে (ক্ষমা) প্রত্যাশা করবে, তুমি যাই প্রকাশ হোক না কেন আমি তা ক্ষমা করে দেব-আর আমি কোন কিছুর পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তোমার গোনাহ যদি আকাশ সমান হয়ে যায় আর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, তাহলে আমি তোমাদে ক্ষমা করে দেব। হে আদম সন্তান! যদি তুমি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার কাছে আস এবং আমার সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক না করে (আখেরাতে) সাক্ষাত কর, তাহলে আমি সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার সঙ্গে সাক্ষাত করবো। (জামে আত তিরমিযি)
১৬.হযরত আসরার ইবনে ইয়াসার আল মাজানী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে লোক সকল, তোমরা আল্লাহ কাছে তাওবা কর এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আমি প্রতিদিন একশত বার তাওবা করে থাকি। (সহীহ মুসলিম)
শিরকঃ
‘শিরক’ হলো আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ সমকক্ষ করা, মিলানো, সংমিশ্রণ করা, একত্রীকরণ, অংশীদার, ভাগাভাগি, সমান করা, সম্পৃক্ত করা। শিরক মানে বিশ্ব প্রভু আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার বা সমকক্ষ বানানো। এটা এমনসব বিশ্বাস, কাজ, কথা বা অভ্যাসকে বোঝায় যা দ্বারা মহান আল্লাহর রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত এবং সিফাতে অপর কারও অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়। * আল্লাহর ‘রুবুবিয়াতে’ কাউকে শরিক বানানোর অর্থ লালন-পালন, সৃষ্টি, জীবন-জীবিকা, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদিতে অন্যকে অংশীদার করা। * তাঁর ‘উলুহিয়াত’ বৈশিষ্ট্যে কাউকে সমকক্ষ করার অর্থ সালাত, সাওম, কোরবানী, মান্নত প্রভৃতিতে অন্য কারও উপাস্য মেনে নেয়া। * আর আল্লাহর ‘সিফাতে’ কাউকে শরিক বানানোর অর্থ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির গায়েব জানা, নিজকে অমুখাপেক্ষী ভাবা, অভাবমুক্ত মনে করা প্রভৃতি।
যারা শিরক করে তারা আল্লাহকে অস্বীকার করে না। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে বটে, কিন্তু আল্লাহ সাথে অন্যান্য সত্তা বা শক্তিকে বিভিন্নভাবে শরীক করে। আল্লাহর সাথে কী কী ভাবে শরীক করা হয় তা বুঝতে হলে শিরক সর্ম্পকে ধারণা থাকতে হবে তাহলেই শিরক থেকে বেঁচে থাকাও সজহ হবে। শিরকমুক্ত আকিদা-বিশ্বাসই পরকালে সৎকর্মের প্রতিদান পাওয়ার পূর্বশর্ত। আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয়ভাজন হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনেকটা কড়া ভাষায় সম্বোধন করে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন। তুমি যদি শিরক কর, তাহলে তোমার আমল নিষম্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (যুমার : ৬৫)। যুগে যুগে মানুষ শয়তানের কবলে পড়ে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, দেব-দেবী, গাছ, পাথর প্রভৃতির পূজা করতে শুরু করে দিত। তারা তাদের হৃদয়-মনের সব আবেগ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আকুতি-মিনতি দিয়ে এদের ডাকত। এ পথহারা পাপিষ্ঠ বনি আদমগুলোকে সরল-সঠিক দ্বীন তথা তাওহীদি জিন্দেগীতে নিয়ে আসার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছে অসংখ্য নবী-রাসূল। তারা প্রত্যেকেই শিরকের পথ পরিহার করে খাঁটি ঈমানের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতেন।
শিরকের প্রকারভেদঃ
ইমাম ইযযাহাবী তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘আল-কাবায়ের’ (কবীরা গোনাহ) নামক গ্রন্থে লিখেছেন শিরক দুই প্রকার : (১) আকিদগত শিরকঃ
আকিদাগত শিরক অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহ সমকক্ষ মনে করা এবং তার ইবাদত করা।
আকিদাগত শিরক ৪ (চার প্রকার)ঃ
ক) শিরকুন ফিয-যাত অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা
খ) শিরকুন ফিস-সিফাত অর্থাৎ আল্লাহর গুনাবলি
গ) শিরকুন ফিল এখতিয়ারাত অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা
ঘ) শিরকুন ফিল হুকুক অর্থাৎ আল্লাহর অধিকার
তাওহীদকে বুঝতে হলে শিরককে বুঝতে হবে। শিরকের বিপরীতই তাওহীদ। ঈমান শিরকমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাওহীদের দাবী পূরণ হতে পারে না।
ক) শিরকুন ফিয-যাত অর্থাৎ আল্লাহর সত্তার উদাহরণ : আল্লাহ সত্তাকে শরীক করা যেমন কাউকে আল্লাহ পুত্র, স্ত্রী মনে করা। ফেরেশতা, দেব-দেবী ইত্যাদিকে আল্লাহ বংশধর বলে বিশ্বাস করা।
খ) শিরকুন ফিস-সিফাত অর্থাৎ আল্লাহর গুনাবলির উদাহরণ : যে সব গুন একান্তই আল্লাহ সে সবগুন কারোর মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ছাড়া কাউকে সকল রকম দুর্বলতা ও দোষক্রটি থেকে পাক মনে করা। যেমন-গায়েবী ইলম বা অদৃশ্য সর্ম্পকে জ্ঞান। কারো সর্ম্পকে এমন ধারণা করা যে, তিনি সবকিছু জানেন, দেখেন বা শুনেন এবং সব দোষ ত্রুটি থেকে মুক্ত।
গ) শিরকুন ফিল এখতিয়ারাত অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতার উদারহণ : আলৌকিকভাবে উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা, প্রয়োজন পূরণ ও হেফাযত করার যোগ্যতা, মানুষের ভাগ্য গড়া ও ভাঙ্গা, দোয়া করা, মানব জীবনের জন্য আইন কানুন রচনা করা, সন্তান দান করা, রোগ ভাল করা, গুনাহ মাফ করা, হায়াত ও মওত দেয়া, রিযক দান করা ইত্যদি।
ঘ) শিরকুন ফিল হুকুক অর্থাৎ আল্লাহর অধিকারের উদাহরণ : কাউকে রুকু, সিজদা ও পূঁজা পাওয়ার অধিকারী বা হাত বেঁধে নত হয়ে দাড়িয়ে ভক্তি করার পাত্র মনে করা, কারো আস্তানাকে চুমু দেয়ার যোগ্য মনে করা, কুরবানী করা, নযর, নিয়ত, মানত পেশ করার যোগ্য মনে করা। নিয়ামতের শুকরিয়া পাওয়ার অধিকারী বা আপদে বিপদে সাহায্যের জন্য আবেদন গ্রহনের যোগ্য, সব অবস্থায় যাকে ভয় করা যায় বা যার জন্য আর সব মহ্বত ত্যাগ করা যায় বলে মনে করা।
(২) রিয়াঃ
লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘তোমরা ছোট শিরক থেকে দূরে থাক। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন : ছোট শিরক কী? তিনি বললেন : রিয়া অর্থৎ লোক দেখিয়ে সৎ কাজ করা। যেদিন আল্লাহ বান্দাদের কর্মফল দেবেন সেদিন তাদের বলবেন, যাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তোমরা নেক কাজ করতে, তাদের কাছে চলে যাও। দেখ তারা তোমাদের কী প্রতিদান দেয়? (মুসনাদে আহমাদ ও সুনানে বায়হাকী)। ফজল ইবনে ইয়াজ বলেন : ‘লোকের ভয়ে খারাপ কাজ বর্জনকারী রিয়াকারী এবং মানুষকে খুশি করার জন্য ভালো কাজ করা শিরক। আর ইখলাস হচ্ছে এই উভয় রোগ থেকে মুক্ত থাকার নাম’।
শিরকে লিপ্ত হওয়ার কারণঃ
মানুষ নানাবিধ কারণে শিরকে লিপ্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ যে কত মহান, কত ক্ষমতাধর, তার কর্তৃত্বের পরিধি যে কত বিশাল বিস্তৃত ও প্রসারিত, তিনি যে কত নিকটতম; তার যথার্থ মূল্যায়নের অভাবে মানুষ শিরকে লিপ্ত হয়। আবার অনেকে তাদের বাপ-দাদার কৃষ্টি রেওয়াজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে ফেলে। কখনও কখনও অতি ভক্তি কিংবা অতি আবেগের বশীভূত হয়ে মানুষ মানুষের পায়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে, চুমু খায়, পায়ের ধুলা গায়ে মাখে যা সুস্পষ্ট শিরকের শামিল। আমাদের দেশে প্রচলিত শিরকগুলোর মধ্যে পীরপূজা, মাজারপূজা, কবরপূজা, মাজারের পার্শ্ববর্তী গাছের শিকড়, ছাল-বাকল ইত্যাদিতে রোগ আরোগ্য হয় বলে বিশ্বাস, মাজার থেকে আনা সুতা, তাগা, দড়ি প্রভৃতি আরোগ্য দান করে, মাজার পুকুরের পানি, কুমির, কাছিম, গজার মাছ, কবুতর প্রভৃতিকে খাবার দিলে মনের আশা পূর্ণ হয়, মৃত ওলীরা জীবিতদের সাহায্য করতে পারেন, দুর্ঘটনা রোধের জন্য মাজারে টাকা দেয়া, নবী-ওলীরা গায়েব (অদৃশ্য) জানেন, নানাবিধ ফায়েজ-বরকত হাসিলের জন্য মাজারের গিলাপে চুমু খাওয়া, টিয়া পাখি কিংবা বানরের মাধ্যমে ভাগ্য গণনা করা, কোনো বুযুর্গ একই সময় অনেক স্থানে অবস্থান করতে পারা প্রভৃতি। এগুলো সবই অজ্ঞতা ও বাড়াবাড়িরই নামান্তর। মানুষ অজ্ঞতা ও ভুল বিশ্বাসের কারণে তার যবান, বিশ্বাস, অভ্যাস, আচার-আচরণ প্রভৃতি দ্বারা শিরক করে থাকে। সতর্ক থাকার পরেও কখনও কখনও মনের অজান্তে এ মারাত্মক পাপ কর্মটি সংঘটিত হয়ে যায়। আখেরী জামানার দুর্বল মু’মিন হিসেবে আমাদের যতসামান্য নেক আমলগুলো সংরক্ষণের জন্য শিরক ও তাওহীদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করা সময়ের অনিবার্য দাবী।
শিরক নেক আমল নষ্ট করে দেয়ঃ
শিরক নেক আমলকে সম্পূর্ণরুপে বিনষ্ট করে দেয় এবং ব্যক্তিকে নিশ্চিত জাহান্নামের উপযোগী করে গড়ে তোলে। মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও কল্যাণকর জীবনযাপনের মহৎশক্তি হলো ঈমান। ঈমান এক অচলায়তন পর্বতের ন্যায়, যা চির অবিচল, সদা সমুন্নত। ইহা একটি দিগন্ত উজ্জ্বলকারী সূর্যশক্তি, যা জীবনের সবগুলো দিক ও আনাচ-কানাচ আলোকম-িত ও উজ্জ্বল করে দেয়। শিরক এমন একটি অন্ধকার জগত, যেখান থেকে আল্লাহর আক্রোশ আর গজবের হাওয়াই নির্গত হয়ে থাকে। আর যারা তাওবা করে না, আল্লাহ তাদের জালেম বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহতায়ালা মু’মিনদের দুটি ভাগে ভাগ করেছেন-
(এক) যারা তাওবা করেঃ যারা তাওবা করে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, তারাই সফলকাম।
(দ্বিতীয়) যারা তাওবা করে নাঃ যারা তাওবা করে না, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, তারাই অত্যাচারী ও জালিম। এ দুই ভাগের মধ্যে কোনো তৃতীয় ভাগ নাই। আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, আমরা কোন ভাগের অন্তর্ভূক্ত হবো? বান্দা যখন কোনো অপরাধ করে আল্লাহর নিকট ফিরে যায় এবং তাওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন আল্লাহতায়ালা তার প্রতি অধিক খুশী হন।
শিরক সর্ম্পকে কুরআনের ভাষ্যঃ
১. আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থির করে আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নামে।’ (মায়িদা : ৭২)।
২. তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা তাদের অপকার করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। এটাই চরম বিভ্রান্তি যে, তারা এমন কিছুকে ডাকে, যার অপকার উপকারের আগে এসে পৌঁছে। কত নিকৃষ্ট এ বন্ধু কত নিকৃষ্ট এ সঙ্গী। (হজ্ব : ১২-১৩)।
শিরক সর্ম্পকে হাদীসের ভাষ্যঃ
১. যে ব্যক্তি শিরকমুক্ত অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি শিরক করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করবে সে জাহান্নামে যাবে। (সহীহ আল বুখারী)
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি বলে যে, আমি আল্লাহ কাছে গুনাহ মাফ চাই, তিনি ছাড়া আর কোন সত্যিকার মা‘বুদ নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও ধারক এবং আমি তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করবো। তাহলে, তার গুনাহসমুহ মাফ করে দেয়া হবে। যদিও সে জেহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে আসুক না কেন। (আবু দাউদ)
আল্লাহ আমাদের সবাইকে গুনাহ ও শিরক থেকে বেচেঁ থাকার তাওফিক দিন আমিন।



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:০৭

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: মহান আল্লাহপাক রাববুল আলআমিন আমাদের কে সকল প্রকার গুনাহরাশি থেকে ও শিরকের হাত থেকে হেফাযত করুন এবং ধর্মের সকল বিদি-বিধান মেনে চলার তওফিক দান করুন।

২| ০৭ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ২:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: গুনাহ আর শিরক এর উপর জাতি চলছে আজ।

৩| ০৭ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:২৫

নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: গুনাহ না করলে আমাদের সরিয়ে অন্য জাতি সৃষ্টি করতেন।
হাদিস নং ২৭৪৯ সহীহ মুসলিম।

৪| ০৮ ই মার্চ, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:০৮

চাঁদগাজী বলেছেন:



আপনি কি কোন ভালো কাজ করেননি জীবনে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.