নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী

মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আল্লাহর সানিধ্যের শ্রেষ্ঠ ইবাদাত তাহাজ্জুদ

১৪ ই জুন, ২০২১ সকাল ৮:৪৯

তাহাজ্জুদের অর্থ হল ঘুম থেকে ওঠা। মধ্যরাতের পর ঘুম থেকে জেগে নামাজ পড়াকে তাহাজ্জুদের নামাজ বলা হয়। কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকার অর্থ নামাজ পড়া। এ কারণেই রাত্রিকালীন নামাজকেই তাহাজ্জুদের নামাজ বলা হয়। তবে বেশির ভাগ মুফাসসিরের মতে, শয্যা পরিত্যাগ করে কুরআন তেলাওয়াত, জিকির ও দোয়ায় আত্মনিয়োগ করা এবং নফল নামাজ, যা গভীর রাতে ঘুম থেকে ওঠার পর পড়া হয় তাহাই তাহাজ্জুদ। ফরজ নামাজের পর অন্যান্য সুন্নাত ও নফল সব নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত সবচেয়ে বেশি। ফরজ নামাজের পর অন্যান্য সুন্নাত ও নফল সব নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নাত। বান্দা ও তাঁর প্রভূর মাঝে প্রেম বন্ধন সৃষ্টির এক বিশেষ মাধ্যম। রাত্রির শেষভাগে পৃথিবীর সমস্ত কিছু উজাড় করে নিঃস্ব কপর্দকশূন্য বান্দা যখন তার স্রষ্টার পায়ে লুটিয়ে পড়েন, তখন আল্লাহ খুশি হন। গুনাহর কলঙ্কে কলুষিত বান্দাকে তিনি ক্ষমা করে দেন। তার রহমতের বারিধারায় তখন প্রস্রবণ হয় মাফির, রহমত ও করুণার। রাসূল (সাঃ) সবসময় এ নামাজ নিজে নিয়মিত আদায় করতেন। তাঁর সাহাবীদেরকেও সর্বদা এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। রাসূল (সাঃ) যে আমল সর্বদা করেছেন তাঁর উম্মতের জন্য যে, এটা মহা গণিমত। পবিত্র কুরআনে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। বছরের বিশেষ রাতগুলো ছাড়াও প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের সময়ে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার নিকটতম প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের ফরিয়াদ শোনেন। রাসূল (সাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা প্রতিদিন শেষ রাতে প্রথম আসমানে এসে বলেন, তোমরা কে আমাকে ডাকবে! আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে কিছু চাইবে! আমি তাকে তা দেব। কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে! আমি তাকে ক্ষমা করে দেব (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত) । তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের ব্যাপারেই আল্লাহ কুরআনে বলেন, “এ সমস্ত লোকেরা মুহসিন তথা সৎকর্মপরায়ণশীল ও মুত্তাকী। তাদের জন্য রয়েছে চিরন্তন সুখ ও অনাদিকালের আনন্দ এবং আল্লাহর রহমত।” তাহাজ্জুদ নবীজি (সাঃ) সব সময় পড়তেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ইসলামের প্রাথমিক যুগে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে এ নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেন। প্রিয়নবির প্রতি কিছু সময় নামাজ পড়ার নির্দেশ ছিল না বরং রাতের কিছু অংশ ছাড়া সারারাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়ের নির্দেশ ছিল। রাসূল (সাঃ)-এর মে’রাজে ৫ (পাঁচ) ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পর তা নফল হয়ে যায়। কেয়ামতের ভয়াবহ বিপর্যয় ও কঠিন হিসাব-নিকাশের দিবসে কোন ব্যক্তি যদি সহজ হিসাব কামনা করে, তবে তার উচিত হবে নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সূরায় এ নামাজের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে। যারা বিনা হিসেবে জান্নাতে যেতে পারবেন, তাদের মধ্যে একশ্রেণির মানুষ হলেন তারা, যারা যত্নের সঙ্গে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন।

তাহাজ্জুদ সর্ম্পকে কুরআনের ভাষ্যঃ
১. পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবিব (সাঃ)-কে উদ্দেশ করে বলেন: ‘“রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে (মাকামে মাহমুদে)।”(বনি ইসরাঈল : ৭৯)
২. পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, "নিশ্চয়ই মুত্তাকী লোক-বাগ বাগিচায় এবং ঝর্ণার আনন্দ উপভোগ করতে থাকবে এবং যে নিয়ামত তাদের প্রভূ পরোয়ারদিগার তাদেরকে দিতে থাকবেন সেগুলো তাঁরা গ্রহণ করবে। (কারণ) নিঃসন্দেহে তাঁরা এর পূর্বে দুনিয়ার জীবনে নেক আমলওয়ালা ছিল। তারা রাতের খুব অল্প অংশই ঘুমাত এবং শেষ রাতে ইস্তেগফার করত।” (জারিয়াত : ১৫-১৮)
৩. পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তাঁরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা, যারা তাদের প্রতিপালকের দরবারে সেজদা করে এবং দাড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়”। (ফুরকান : ৬৩-৬৪)
৪. পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রিতে দণ্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশি এবং কোরআন আবৃত্তি করুন সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে। আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয় ইবাদতের জন্য রাতে ওঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয় দিবাভাগে রয়েছে আপনার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। আপনি আপনার পালনকর্তার নাম স্মরণ করুন এবং একাগ্রচিত্তে তাতে মগ্ন হোন।” (মুয্যাম্মিল : ১-৮)
৫. পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে চাদরাবৃত! উঠুন, সতর্ক করুন, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করুন, আপন পোশাক পবিত্র করুন এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন। অধিক প্রতিদানের আশায় অন্যকে কিছু দেবেন না এবং আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে সবর করুন।” (মুদ্দাচ্ছির : ১-৭)
৬. পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সেজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে এবাদত করে, পরকালের আশঙ্কা রাখে এবং তার পালন কর্তার রহমত প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান? যে এরূপ করে না”। (জুমার : ৯)
৭. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে।” (সাজদা : ১৬)
৮. কোরআনে বলা হয়েছে, "তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থী"। (ইমরান : ১৭)

তাহাজ্জুদ সম্পর্কে হাদীসের ভাষ্য:
তাহাজ্জুদের নামাজকে মহানবী (সাঃ) শ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওপর তাহাজ্জুদ নামাজ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই তিনি জীবনে কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া থেকে বিরত হননি। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এশার পর দুই বা ততধিক রাকায়াত নামাজ পড়ে নেয়, সে হবে তাহাজ্জুদের ফজিলতের অধিকারী। তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সব নফল ইবাদত অপেক্ষা অধিক এবং এটি আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। এতে সালাতের মহত্ত্ব, মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটে। রব ও স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অভিপ্রায়ী একজন মুসলমানের কর্তব্য হলো, সে এ মহান ইবাদতটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করবে এবং তার যথার্থতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে। এ ছাড়াও সালাতের অনেক লাভ ও ফজিলত আছে।
১.হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, "আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি। আফজালুস সালাতি বাদাল মাফরুদাতি সালাতুল লাইলি’ অর্থাৎ ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।" (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ)
২. মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, ‘রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।’ (মুসলিম)
৩. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের শেষাংশে দুনিয়ার আকাশে বিরাজমান হন এবং ঘোষণা দেন যে, কোনো প্রার্থনাকারী আছ কি? যার প্রার্থনা আমি কবুল করব। প্রয়োজন প্রার্থনার কোনো লোক আছ কি? যার প্রয়োজন আমি পূর্ণ করে দেব। এবং কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ কি? যাকে আমি ক্ষমা করে দেব।’(বুখারী, মুসলিম)
৪. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) বলেন: ‘আল্লাহ তা’আলা সেই স্বামীর প্রতি রহম করেছেন, যে নিজে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার স্ত্রীকে জাগায়। যদি সে উঠতে অস্বীকার করে, তবে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটা দেয়। আল্লাহ তা’আলা সেই স্ত্রীর প্রতি রহম করেছেন, যে নিজে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার স্বামীকে জাগায়। যদি সে উঠতে অস্বীকার করে, তবে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটা দেয়।’ (আবু দাউদ, নাসায়ী, আলফিয়্যাহ)
৫. নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিয়তের সঙ্গে সওয়াবের আশায় মাহে রমজানের রোজা পালন করেন, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় মাহে রমজানের রাতে কিয়াম বা রাত জেগে ইবাদত করেন, তার বিগত দিনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে কিয়াম বা রাত জেগে ইবাদত করে, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
৬. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মুসলমানদের মধ্যে কুরআনে অভিজ্ঞ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি সম্মানের অধিকারী হবেন।” (বায়হাকি)
৭. হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন: ‘ওয়া মান তলাআল উলা ছাহারাল লায়ালি,’ অর্থাৎ যাঁরাই ইবাদতে আধ্যাত্মিক জগতে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ঊর্ধ্বারোহণ করেছেন; তাঁরাই রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়েছেন। (দিওয়ানে আলী, নাহজুল বালাগা)
৮. রাসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে এবং সে তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে নামাজ পড়ায়, এমনকি সে যদি জেগে না ওঠে, তবে তার মুখে খানিকটা পানি ছিটিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করে থাকেন। অনুরূপ কোনো মহিলা যদি রাতে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে এবং সে তার স্বামীকে নামাজের জন্য জাগায়, এমনকি স্বামী না জাগলে স্ত্রী তার মুখে পানি ছিটিয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, তাহলে তার প্রতিও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে ”। (আবু দাউদ, নাসায়ী, মিশকাত)
৯. ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “মে’রাজের রাত্রিতে পঞ্জেগানা নামাজ ফরজ হওয়ার আদেশ এলে তাহাজ্জুদের ফরজের আদেশটি রহিত হয়ে যায়। তবে এরপরও তাহাজ্জুদ সুন্নাত হিসেবে বহাল থেকে যায়। কারণ রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামগণ নিয়মিতভাবে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন”। (তাফসিরে মা’আরিফুল কোরআন, ক্বিয়ামুল লাইল)
১০. শ্রেষ্ঠতম মুফাসিসরে কোরআন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি হাশরের ময়দানে সহজ হিসাব কামনা করে, তার উচিত হবে আল্লাহ যেন তাকে রাত্রির অন্ধকারে সেজদারত ও দাঁড়ানো অবস্থায় পান। তার মধ্যে পরকালের চিন্তা ও রহমতের প্রত্যাশাও থাকা দরকার”। (তাফসিরে কুরতুবি, মা’আরেফুল কোরআন, ক্বিয়ামুল লাইল)
১১. হযরত আবু মালেক আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন, “জান্নাতে এমন কক্ষ থাকবে যার ভিতরের অংশ বাহির থেকে এবং বাইরের অংশ ভিতর থেকে দৃষ্টিগোচর হবে।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এসব কক্ষ কাদের জন্য? উত্তরে রাসূল (সাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি সালাম করে, ক্ষুধার্তকে আহার করায় এবং রাত্রে যখন সবাই নিদ্রিত থাকে, তখন সে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে”। (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী, তিরমিজি (তাফসিরে মাজহারি, মা’আরেফুল কোরআন)
১২. হযরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ হতে বর্ণিত আছে যে, “রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন যখন আল্লাহ পাক পূর্ববর্তী মানবমন্ডলীকে একত্রিত করবেন, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আহ্বানকারী (যার আওয়াজ সমগ্র সৃষ্টিকুল শুনতে পাবে) দাঁড়িয়ে আহ্বান করবেন, “হে হাশরের মাঠে সমবেত মানবমন্ডলী, আজ তোমরা জানতে পারবে যে, আল্লাহপাকের নিকট সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী কে? অনন্তর সে ফেরেশতা ‘যাদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে পৃথক থাকে’ এরূপ গুণের অধিকারী লোকগণকে দাঁড়াতে আহ্বান জানাবেন। এই আওয়াজ শুনে এসব লোক (তাহাজ্জুদগুজার) দাঁড়িয়ে পড়বেন, যাদের সংখ্যা হবে খুবই নগণ্য। এদের হিসাব গ্রহণ ব্যতিতই বেহেশতে প্রেরণ করা হবে। অতঃপর অন্যান্য সমগ্র লোক দাঁড়াবে এবং তাদের হিসাব গ্রহণ করা হবে”। (তাফসিরে ইবনে কাসির, মাজহারি, মা’আরিফুল কোরআন)
১৩. হযরত আবু উমামা বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়। কেননা এটি তোমাদের পূর্ববর্তী সব নেক বান্দাহর অভ্যাস ছিল। এটা তোমাদেরকে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্যদানকারী, মন্দ কাজের কাফফারা এবং গুনাহ থেকে নিবৃত্তকারী”। (মাজহারি, মাআরেফুল কোরআন) ।
১৪. ইমাম বাগবী (রহ.) বলেন, “এই আদেশ পালনার্থে রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামগণ অধিকাংশ রাত্রি তাহাজ্জুদ নামাজে ব্যয় করতেন। ফলে তাদের পদদ্বয় ফুলে যায় এবং আদেশটি কষ্টসাধ্য প্রতীয়মান হয়। পূর্ণ এক বছর পর ওই সূরার শেষাংশের ‘কোরআনের যতটুকু তোমাদের সহজ মনে হয় ততটুকু আবৃত্তি কর’ আয়াতটি নাজিল হলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার বাধ্যবাধকতা রহিত হয়ে যায় এবং বিষয়টি নিজের ইচ্ছর ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। যতক্ষন নামাজ পড়া সহজ মনে হয় ততক্ষণ নামাজ পড়া তাহাজ্জুদের জন্য যথেষ্ট”।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়, রাকাআত
সময়ঃ
তাহাজ্জুদের সময় হলো মধ্যরাতের পর বা রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে তথা রাত দুইটার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত আরম্ভ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। সাহ্‌রির সময় শেষ হলে তথা ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শেষ হয়। তবে সালাতুল লাইল বা তাহাজ্জুদ এশার নামাজ আদায়ের পর থেকে ও পাড়া যায়। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা সর্বোত্তম। রাসূল (সাঃ)-এর জমানায় তাহাজ্জুদের জন্য আলাদা আজান দেওয়া হতো। এখনো মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফে এই নিয়ম প্রচলিত আছে। ‘তাহাজ্জুদ নিয়মিত আদায় করতে পারলে তা অতি উত্তম।
রাকাতঃ
তাহাজ্জুদ নামাজ ২ থেকে ১২ রাকাআত পর্যন্ত পড়া বর্ণনা পাওযা যায়। সর্ব নিম্ন ২ রাকাআত আর সর্বোচ্চ ১২ রাকাআত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৮ রাকাআত তাহাজ্জুদ পড়তেন। সম্ভব হলে ১২ রাকাআত তাহাজ্জুদ আদায় করা। সম্ভব না হলে ৮ রাকাআত আদায় করা । তা সম্ভব না হলে ৪ রাকাআত আদায় করা। যদি তাও সম্ভব না হয় তবে ২ রাকাআত হলেও তাহাজ্জুদ আদায় করা ভালো। তবে তাহাজ্জুদ নামাজের কোনো কাজা নেই। মহানবী (সাঃ) দুই দুই রাকাত করে এ নামাজ আদায় করতেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত ও সূরাঃ
নিয়ত: দুই রাকাআত তাহাজ্জুদের নিয়ত করছি.. অতঃপর তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত বাঁধা; অতঃপর ছানা পড়া; সূরা ফাতেহা পড়া; অন্য একটি সূরা মিলানো তথা কেরাত পড়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক লম্বা কেরাত পড়তেন। অতঃপর অন্যান্য নামাজের ন্যায় রুকু, সেজদা আদায় করা। এভাবেই দ্বিতীয় রাকাত আদায় করে তাশাহহুদ, দরূদ ও দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করা। এভাবে দুই দুই রাকাত করে ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা উত্তম। তাহাজ্জুদ একাকী পড়াই উত্তম; জামাতে পড়া অনেক মুজতাহিদ ফকিহ মকরুহ বলেছেন। তাই অন্য সব সুন্নত ও নফলের মতো তাহাজ্জুদ নামাজের কিরাআতও সিররি; অর্থাৎ তাহাজ্জুদে সূরা কিরাত নিম্ন স্বরে পড়তে হয় এবং এর জন্য ইকামাতেরও প্রয়োজন হয় না।
কুরআন তেলাওয়াতঃ
তাহাজ্জুদের আগে-পরে কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করা উপকারী আমল। এ সময় সূরা মুয্যাম্মিল, সূরা মুদ্দাচ্ছির, সূরা মুলক, সূরা ওয়াকিআহ, সূরা দুখান, সূরা আর রহমান, সূরা ইয়াসিন, সূরা হাশর ও সূরা কাহাফ এবং অন্যান্য সূরা তিলাওয়াত করা বরকতময় ও ফলপ্রসূ।
তাহাজ্জুদ নামাজে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে দোয়া পড়তেন:
১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের জন্য ওঠে কুরআনের এ আয়াতসহ সূরা আল-ইমরানের শেষ পর্যন্ত পড়তেন। (বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত) “রাব্বানা মা খালাক্বতা হাজা বাত্বিলান, সুবহানাকা ফাক্বিনা ‘আজাবান্নার। রাব্বানা ইন্নাকা মাং তুদখিলিন্নারা ফাক্বাদ্ আখঝাইতাহু, ওয়া মা লিজজ্বালিমিনা মিন্ আংছার। রাব্বানা ইন্নানা সামি’না মুনাদিআই ইউনাদি লিল ইমানি আন আমিনু বিরাব্বিকুম ফাআমান্না; রাব্বানা ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া কাফ্‌ফির আন্না সাইয়্যেআতিনা ওয়া তাওয়াফ্ফানা মাআ’ল আবরার।” অর্থ: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। পবিত্রতা তোমারই জন্য। আমাদেরকে তুমি জাহানড়বামের শাস্তি থেকে বাঁচাও। হে প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি যাকে জাহানড়বামে নিক্ষেপ কর তাকে অপমানিত কর। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান আনার জন্য একজন আহবানকারীকে আহবান করতে শুনে ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদের সকল গোনাহ মাফ করে দাও। আমাদের সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে দাও। আর নেক লোকদের সঙ্গে আমাদের মৃত্যু দাও।’
২. হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে তাহাজ্জুদের উদ্দেশে যখন দাঁড়াতেন, তখন এ দোয়া পড়তেন:- “আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু আংতা কায়্যিমুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না ওয়া লাকালহামদু। লাকা মুলকুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না। ওয়া লাকাল হামদু আংতা নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। ওয়া লাকাল হামদু আংতাল হাক্কু। ওয়া ওয়া’দুকাল হাক্কু। ওয়া লিক্বাউকা হাক্কু। ওয়াল ঝান্নাতু হাক্কু। ওয়ান নারু হাক্কু। ওয়ান নাবিয়্যুনা হাক্কু। ওয়া মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হাক্কু। ওয়াস সাআতু হাক্কু। আল্লাহুম্মা লাকা আসলামতু। ওয়াবিকা আমাংতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু। ওয়া ইলাইকা আনাবতু। ওয়া বিকা খাসামতু। ওয়া ইলাইকা হাকামতু। ফাগফিরলি মা কাদ্দামতু ওয়া মা আখ্খারতু। ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লাংতু। আংতাল মুকাদ্দিমু ওয়া আংতাল মুআখ্খিরু। লা ইলাহা ইল্লা আংতা। লা ইলাহা গাইরুকা।” অর্থ: ‘হে আল্লাহ! সব প্রশংসা আপনারই, আপনিই আসমান-জমিন ও উভয়ের মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর নিয়ামক এবং আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আসমান-জমিন এবং এর মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর কর্তৃত্ব আপনারই। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের নুর। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের মালিক, আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনিই চির সত্য। আপনার ওয়াদা চির সত্য। (পরকালে) আপনার সাক্ষাৎ সত্য। আপনার বাণী সত্য। আপনার জান্নাত সত্য। আপনার জাহান্নাম সত্য। আপনার (প্রেরিত) নবিগণ সত্য। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য, কেয়ামত সত্য।
হে আল্লাহ! আপনার কাছেই আমি আত্মসমর্পণ করলাম, আপনার ওপর ঈমান আনলাম, আপনার ওপরই ভরসা করলাম, আপনার দিকেই রুজু করলাম, আপনার (সন্তুষ্টির জন্যই) শত্রুতায় লিপ্ত হলাম, আপনাকেই বিচারক মেনে নিলাম। তাই আপনি আমার আগের-পরের প্রকাশ্য ও গোপন সব পাপ/অপরাধ ক্ষমা করুন। আপনিই শুরু এবং আপনিই শেষ মালিক। আপনি ব্যতিত সত্য কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই অথবা আপনি ব্যতিত (ইবাদতের উপযুক্ত) অন্য কেউ নেই।’ (বুখারী)
তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে আরো অনেক সুস্পষ্ট আয়াতে কারিমা ও হাদীস শরীফ রয়েছে যা সীমিত পরিসরে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস শরীফসমূহ থেকে এটি পরিষ্কার হয় যে, তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহর সাথে বান্দার কথোপকথনের এক মহান অবলম্বন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করে। তাহাজ্জুদের বদৌলতে মানুষ মহান মর্যাদার অধিকারী হয়। শেষ রাতে মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে, তখন তাহাজ্জুদ আদায়কারীরা মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তা’আলার ভালোবাসায় নিদ্রা ত্যাগ করে জেগে ওঠে।
এ নামাজ মন ও চরিত্রকে নির্মল ও পবিত্র করা এবং সত্য পথে অবিচল রাখার জন্য অপরিহার্য ও অত্যন্ত কার্যকর পন্থা। রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ হলো সব আম্বিয়াদের সুন্নত, আল্লাহ তা’আলার মাহবুব বান্দাদের অভ্যাস আর আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপন তথা নৈকট্য ও সন্তোষ অর্জনের অন্যতম পন্থা। যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যেতে পারবেন, তাদের মধ্যে একশ্রেণির মানুষ হলেন তারা, যারা যত্নের সঙ্গে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। কুরআনের বিভিন্ন সূরায় এ নামাজের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িসহ সব যুগের ওলি ও বিদ্বানরা তাহাজ্জুদ নামাজে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। তাই আমাদের উচিৎ তাহাজ্জুদের নামাজে রাত কাটানো। আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করার তাওফিক দিন।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.