নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

i blog/therefore i exist

অচিন্ত্য

"জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ"

অচিন্ত্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’- দ্বিতীয় পাঠ

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৭:৪৪

বনফুলের ‘পাঠকের মৃত্যু’ পড়ার পর মনে হয়েছিল বিষয়টা নিছক কল্পনা। কিন্তু শওকত আলী’র ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এর দ্বিতীয় পাঠে বনফুলের বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণকে সালাম জানাই। প্রথম পড়েছিলাম বেশ আগে; গত সহস্রাব্দের কথা; তখন নাইন-টেনে পড়ি। কয়েক সপ্তাহ আগে এই অসামান্য উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করলাম। পাঠকের ঠিক মৃত্যু না হলেও রুচি-বুদ্ধি এবং অন্যান্য পরিবর্তন বেশ টের পেয়েছি।



‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ শওকত আলী’র একটি উপন্যাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে। বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়া পত্তনের সময়কার সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসটি ইতিহাস সচেতন এক অসাধারণ সৃষ্টি। ভাষার ব্যবহারে, মনোজাগতিক অনুসন্ধানে- উপন্যাসটির সৌন্দর্য কেবল মুগ্ধতাই জাগিয়ে তোলে।



গল্পটির শুরুতে মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ গুরুর তত্বাবধানে একটি মন্দির সজ্জার কাজ করতে করতে তাত্ত্বিক-দার্শনিক এবং বাস্তব কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। এসব প্রশ্ন ক্রমশ একটি গুরু-শিষ্য সংকট তৈরি করে। এক সময় গুরু তাকে ত্যাগ করেন। অবশ্য ত্যাগের মুহূর্তে জীবন-জীবিকা প্রহসনের কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথাও তিনি ইঙ্গিতে স্বীকার করেন। শ্যামাঙ্গ বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করে। কিন্তু তার বাড়ি যাওয়া হয় না। ঘটনাচক্রে তার জীবন জড়িয়ে যায় লীলাবতী নামের এক স্বামী-পরিত্যক্তা নারীর সাথে। ততদিনে চলমান রাজনৈতিক হাওয়া কিছুটা শ্যামাঙ্গের গায়েও লাগে। সামন্ত-মহাসামন্তদের অত্যাচার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কেবল প্রাণ নিয়ে পলায়ন। এই অনিশ্চিত যাত্রায় শ্যামাঙ্গ সঙ্গী হয় লীলাবতীর। তারা ঘর বাঁধতে চায় কিন্তু সামাজিক বাস্তবতায় তা সম্ভব নয়। অনেক পথ পেরিয়ে একটা ‘যবন কেন্দ্রে’ তারা আশ্রয় নেয়। লীলাবতী ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য শ্যামাঙ্গকে উদ্বুদ্ধ করতে চায়। শ্যামাঙ্গ রাজী হয় না।



সমান্তরালে আরো একটি ঘটনাপ্রবাহ বয়ে যায়। বসন্তদাস নামের এক সদ্যবিবাহিত ক্ষেত্রকর বাণিজ্য করতে বেরিয়ে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে দেখা পায় মিত্রানন্দ নামের এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর। নববধূ মায়াবতীর আকর্ষণ এড়িয়ে সে সঙ্গী হয় মিত্রানন্দের। তার বাণিজ্য যাত্রার দীর্ঘপথে একটি বিষয় ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল যে এই জনপদের কর্তাব্যক্তিবর্গ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর বিশেষ অসন্তুষ্ট এবং দিনে দিনে তাদের অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মিত্রানন্দের সাথে সাক্ষাতের পর বসন্তদাসের জীবনের লক্ষ্য অন্য মোড় নেয়। চেতনায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। সে বুঝতে শিখে চলমান শাসন ব্যবস্থা প্রজাপালনের পরিবর্তে প্রজাসংহারেই বেশি মনযোগী। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এর বিরুদ্ধাচার করছে বলেই তাদের উপর এই অত্যাচার। মিত্রানন্দ তাকে সঙ্গী হতে বলে; পরিবর্তনের সঙ্গী। বসন্ত সঙ্গী হয় ঠিকই। কিন্তু একটি বিষয় অমীমাংসিত থেকেই যায়। বিদ্যমান ব্যবস্থা যে অগ্রহণযোগ্য এ বিষয়ে মিত্রানন্দের সন্দেহ নেই, কিন্তু আসন্ন ব্যবস্থার রূপটি কেমন হবে এই প্রশ্নে সে নীরব।



এমনি আরো অনেক প্রশ্ন, আরো অনেক জীবন-নাটক অসমাপ্ত রেখেই ইতিহাসের মঞ্চে নতুন দৃশ্যের সূচনা হয়। তুর্কি আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বাংলার জনজীবন। অনিশ্চয়তার প্রদোষকালে বিভ্রান্ত প্রাকৃতজন অনাগত সময়ের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।



উপন্যাসটির যে বিষয়টি সবার আগে চোখে পড়ে তা হল এর ভাষার ব্যবহার। ঔপন্যাসিক এখানে অসামান্য সৃজনশীলতার সঙ্গে এক নতুন ভাষা-কায়দা প্রয়োগ করেছন। বাক্যগঠনে তিনি চলিত রূপ প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু যথাসম্ভব তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন। একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা যাকঃ



“একদা রাত্রে, প্রথম যামেই হবে তখন, হঠাৎ তার নিদ্রা ভঙ্গ হল। অনুভব করল কে একজন তার কটিবন্ধটি মোচন করতে চাইছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না, তবে অনুমান করল, পান্থশালাটি গ্রন্থিছেদকেরও নিদ্রার স্থান। অন্য সময় হলে কি করত বলা কঠিন। কিন্তু তখন তার অবস্থা মরিয়া। সামান্য কিছু অর্থ আছে সঙ্গে। ঐ অর্থটুকু চলে গেলে তাকে প্রকৃতঅর্থেই পথে বসতে হবে। সে বিলম্ব করলো না, ক্ষিপ্রগতিতে লোকটিকে ধরাশায়ী করে তার বক্ষে দেহভার এবং গলদেশে দু’হাত রেখে জানতে চাইল, কে তুই বল- কেন তুই আমার কটিদেশে হাত দিয়েছিস ? শীঘ্র বল, নতুবা এই তোর শেষ !”



ভাষার এই ব্যবহার প্রথম দিকে বেখাপ্পা লেগেছিল। কিন্তু এক সময় আবিষ্কার করলাম, পড়তে পড়তে ক্রমেই একটা অন্য জগতে ঢুকে যাওয়া যায়; বুঝিবা ঠিক সেই সময়, সেই স্থান। ভাষার এই ব্যবহারকে অন্যভাবেও দেখার সুযোগ আছে বলে মনে হয়। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ইতিহাসের এমন এক সংকটময় সময় যখন সংস্কৃতি, সামাজিক জীবন, রীতি-নীতি, আচার সবকিছুতেই মূল্যবোধের টানাপোড়েন। এক দিকে বাংলায় তুর্কি আক্রমণ অত্যাসন্ন। অন্যদিকে সামন্ত-মহাসামন্তদের অকথ্য অত্যাচার। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের পক্ষে বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। সেই যুগযন্ত্রণার শিল্পশরীরের উপাদান হিসেবে ভাষার এই মিশ্র অনুভবের ব্যবহার আমার কাছে অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে।



সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত হওয়ার পরও উপন্যাসটি বেশ কিছু জায়গায় মনোজাগতিক বিষয়াবলীকেও উপেক্ষা করেনি। স্বামী-পরিত্যক্তা লীলাবতীর রহস্যময় আচরণ, মন্দির দাসী ছায়া বা কৃষ্ণার আবেদনময় বাক্যালাপ কিংবা শ্যামাঙ্গকে দেখে যোগমায়ার পুত্রশোকের পুনর্জাগরণ আমাদের সেই সব সুপ্ত ইচ্ছার কথাই মূর্ত করে যা হয়ত জ্ঞাতসারে আমরা জানি না।



উপন্যাসটির দু’টি বিষয় তার সৌকর্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মনে হয়। প্রথমত- চরিত্রগুলোর মানসিকতা অবিকল বর্তমান সময়ের মত মনে হয়েছে। যখন বঙ্কিম পড়ি, শরৎ পড়ি, চরিত্রগুলো যে এই সময়ের নয় তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়। কিন্তু এই উপন্যাসে সেই অনুভূতি হয় না যা উপন্যাসটির একটি দারুণ অভাব বলে মনে হয়েছে। চরিত্রগুলো জীবন ও জগত নিয়ে যে ধরণের মানসিকতা প্রকাশ করে, তা যেন একেবারেই হাল আমলের। উপরন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মানসিকতার মধ্যে কীভাবে কোথায় যেন ‘কম্যিউনিজম’ এর আদল পাই। রাজনীতি সচেতনতার যে পর্যায়ে ‘কম্যিউনিজম’ এর জন্ম, তার আদল সেই সময়ে বেমানান মনে হয়েছে।



এই দু’টি বিষয় বাদ দিলে সামগ্রিকভাবে উপন্যাসটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য। অনেকেই ইতিহাসের সঙ্গে উপন্যাসের সম্পর্ককে শিথিল বলে থাকেন। আমার মনে হয় বিষয়টি তেমন নয়। ইতিহাস মানেই পুনরায় নির্মাণ। খুব নিকট সময় ছাড়া আমরা শুধু ইতিহাসের চিহ্নই হাতেনাতে পেয়ে থাকি; বাকিটা কল্পনা। অর্থাৎ, নিরপেক্ষভাবে দেখলে ইতিহাস শাস্ত্রটি প্রত্নতত্ত্ব এবং নৃতত্ত্বের ভিতের উপর নির্মিত একটি ফিকশনই বটে। এই দৃষ্টিতে ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসের আবেদন আমার কাছে উপন্যাসের চেয়ে বেশি। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক বড় যত্নের সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের এঁকেছেন। ইতিহাস বা উপন্যাস কাগজে থাকে, কিন্তু চরিত্রগুলো সত্যি সত্যিই এক সময় ছিল এবং এই মাটিকেই তারা প্রাত্যহিক আনন্দবেদনার ভিত করেছিল- ভাবতেই স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১২:০৫

সবুজসবুজ বলেছেন: ভালো লাগলো। উপন্যাসটি পড়ার কৌতুহলও জাগলো। :) :)


আমার একই রকম অনুভূতি হয়েছে ( সেই যুগ পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করা বা নিজে সেই যুগে পৌঁছে যাওয়া ) শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস গুলো পড়ার সময়ে। সম্ভব হলে পড়বেন।

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৮:৫০

অচিন্ত্য বলেছেন: ধন্যবাদ। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর শুধু গোয়েন্দাগল্পই পড়েছি। ঐতিহাসিক উপন্যাস বিষয়টি জানা ছিল না। পড়তে হয় দেখছি।

২| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:০৭

রেজোওয়ানা বলেছেন: রিভিউ সকালেই পড়েছিলাম,

চমৎকার লিখেছো ......

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৮:৫০

অচিন্ত্য বলেছেন: ধন্যবাদ আপু

৩| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৩০

ডাইস বলেছেন: :|

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৮:৫১

অচিন্ত্য বলেছেন: এটি কী প্রকাশক ?

৪| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:১৮

ডাইস বলেছেন: নির্বিকারত্ব,মন্তব্যহীনতা

৫| ০৩ রা আগস্ট, ২০১৩ রাত ৯:০৯

আরজু পনি বলেছেন:

আমাকে এই বইটি পড়তে বলা হয়েছে।
সার্চ দিয়ে আপনার ব্লগে পেয়ে গেলাম।
পুরো বই কৈ যে পাই...না পেলে শেষে কিনতে হবে আর কি।

৬| ০৩ রা আগস্ট, ২০১৩ রাত ৯:১০

আরজু পনি বলেছেন:

এখন প্রিয়তে নিয়ে রাখি।।

৭| ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৮

Sumiya Barkatullah বলেছেন: বইয়ে দুই ধরনের 'যবন' এর কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। 'দুর্বেশ আহমদ' নামক এই দরবেশ এবং তার শান্তিপ্রিয় শিষ্যরা যে 'তুরুক' নয়, সে ভালো করে বুঝা গেছে। কিন্তু তারা তাহলে কোন দেশের? তাদের পরিচয়টা কী?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.