নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্যারাস

৩১ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ৯:২১

বাঁশের লাঠিতে ভর করে আর তাকে হাঁটতে হবে না। এই খুশীতে গত দু’টি দিন লালু বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে। ‘আমার অহন একজোড়া ক্যারাস’! এই কথাটা ভাবতেই ভেতরে কেমন আচাকন সুরসুরি লাগে। লালুর কত দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন, এক জোড়া ক্র্যাচ।

দিন আর রাত নেই। শ্মশান কিংবা গোরস্থানে লাশ এলেই লালু তা দেখতে যায়। এই হলো আধাপাগলা লালুর এক অদ্ভুত নেশা। সেদিন বিকেলে লাশ দেখতে গেলে স্বর্গীয় কোমল পাল-এর ছেলে অনুক পাল তার বাবার এই ক্র্যাচ জোড়া লালুকে দান করে।

'ক্যারাস প্রাপ্তি'! আচমকা লালুর স্বপ্ন পূরণ। তাই, ক্র্যাচগুলো পাবার পর প্রথম দুই দিন লালু খুশিতে গরম পানির মতো টগবগ করে ফুটেছে। কিন্তু গত তিন দিন ধরে লালুর চোখে ঘুম নেই। চোখ দু’টো শুকনো কাঁঠাল পাতার মত ঘোলাটে রকম লালচে। ক্র্যাচ জোড়া নিয়ে সে কখনো শ্মশানঘাটে বসে থাকে, কখনো যায় সামনের গোরস্থানে। হাসি-খুশি লালু’র হাসি কোথায় উবে গেছে!

ক্র্যাচজোড়া পাবার দুই দিন পর রাতের বেলায় লালু একটা স্বপ্ন দেখে। দেখে, তার তাগড়া জোয়ান বয়স। সে যুদ্ধ করছে। মুক্তিযুদ্ধ। তার বাপ-ভাইদের হানাদারেরা ধরে নিয়ে গেছে। মা আর বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানী সেনাক্যাম্পে। জমি আর বাড়ি দখল করেছে রাজাকার ইনসাফ আলী।

দেখে, কালো বলদের মত ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে খোঁড়া পায়ে ক্র্যাচে ভর দিয়েই ঘর পালিয়ে এসে বন্ধু সুধীর লালুকে বারবার বলছে, “ আমিও যুদ্ধে যাইয়াম। তরা আমারেও লগে ল”। অনেক অনুরোধ-আকুতির পর লালু রাজি হলো। সুধীরকে দলে নেবে। কথা হলো আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় খালের পাড়ে তালতলায় ঝোপের পাশে ওদের গ্রুপের সাথে দেখা করবে সুধীর।

কিন্ত দেখা করা হয় নি। ভোররাতে সুধীরদের বাড়িতে হানাদার এলো। ঠাকুর্দা, বাবা, বড়দা, ছোট্‌দা, সুধীর সবাই মরলো। বেঁচে থাকলো অকাল বিধাব সুবলা দিদি। কিন্তু সুবলা দিদি আম্বিয়া খাতুন নাম নিয়ে কলেমা পড়ে মুসলমান হলো। একমাস থাকলো এক রাজাকারের দখলে। তারপর পালিয়ে মুক্তি পেলো।

সুবলা দিদি আম্বিয়া খাতুন হয়ে ফিরে আসে তার বাস্তুভিটায়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকে গৃহের ছাই-আগুনে। সেই দিদিই ঘরের পেছনের জঙ্গলে একদিন কুড়িয়ে পেলো সুধীরের একটা ক্র্যাচ এবং পরম যত্নে সেটি রেখে দেয় নিজের কাছে।

অনেক দিন পর। যুদ্ধ শেষ। লালু গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু তার বাম পা অচল, শক্তিহীন। বাঁশের লাঠিতে ভর করে সে একপায়ে হাঁটে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সুবলা দিদি একদিন লালুকে ক্র্যাচটা দিতে দিতে বলে, ‘‘এইডা আমার কইলজার টুকরা ছুডু ভাই, আমার দাদার স্মৃতি; তুইও তো আামর ছুডু ভাই, আমার দাদা; এই ল, এই ক্যারাস আমি তরেই দিলাম।”

সেই থেকে কত যত্ন করে ক্র্যাচটিকে লালু বুকের কাছে আঁকড়ে রেখেছে। নিজের পায়ে তেল দিক বা না দিক ক্র্যাচটিকে সে সুযোগ পেলেই জল দিয়ে ধুয়ে তেল দিয়ে মোছে। কাঠের কালচে ক্র্যাচের সাথে লালুও তখন ঝলমল করে। কিন্তু একদিন লালুর ঘরে চোর ঢোকে। টুকটাক জিনিষের সাথে চুরি করে নিয়ে যায় ক্র্যাচটিও। তারপর লালুর আবার সেই বাঁশের লাঠি।

প্রথম দিন লালুর স্বপ্ন এখানেই শেষ। সকালে ঘুম ভেঙে লালু কেমন স্মৃতিকাতর হয়ে যায়। এ-তো শুধু স্বপ্ন নয়। স্বপ্নের ভেতর দিয়ে কেন সে স্পষ্ট করে দেখলো তার বিগত জীবন!

স্মৃতি জর্জরিত লালু কিশোরের মত চুপিচুপি মোছে ঝাপসা চোখ। তারপর দিন। লালু আবার স্বপ্ন দেখে। কেমন যেনো ঘোর ঘোর লাগে স্বপ্নের চারপাশ। এবারের স্বপ্নে বন্ধু সুধীর এলো লালুর কাছে। প্রিয় বন্ধুর চোখে চোখ রেখে বললো, “আগের ক্যারাসটাই তো রাখতে পারস নাই। হেই সময় তো যেমনই হোক একটা ঘর আছিন। আর অহন এই বয়সে, এই চা স্টলের বারিন্দাত থাইক্যা একজোড়া ক্যারাস রাখতে পারবি ত?”

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে লালু। তার মনের মধ্যে সপাং সপাং করে চলে প্রশ্নের চাবুক। সে সারারাত পায়চারি করে রাস্তায়। কিন্ত উত্তর খুঁজে পায় না।

ছেলেবেলার কঠিণ ধাঁধাঁর মতো এই ক্র্যাচ লালুর কাছে একটা বিরাট ধাঁধাঁ। ছেলেবেলার মত লালু বরাবরই হেরে যায়। চেষ্টা করে। কিন্তু ধাঁধাঁর জট খোলে না। উত্তরের খোঁজে সে জেলের মত লম্বা জাল দিয়ে টান দেয় নিজের গাঙে। কিন্ত না, উত্তর আসে না।

নির্ঘুম লালু। এলোপাতাড়ি উত্তর খোঁজে। কিন্তু উত্তর শূণ্য জাল লালুর পিঠে বারবার চাবুকের মত আঘাত করে। লালুর ক্রোধ বাড়ে। উত্তেজনা বাড়ে। সে ফোঁস ফোঁস করে সাপের মতন।

আধাপাগলা লালুর ভেতর ভাংচুর চলে। সে দাঁত কিড়মিড় করে। মুঠো পাকিয়ে কার যেন মুখ লক্ষ্য করে শূন্যে ঘুষি মারে। শূন্য জাল। পিঠে চাবুকের জ্বালা। সে মনে মনে খিস্তি আওড়ায়, “চুতমারানির যুদ্ধ। বালের যুদ্ধ। সব খাইলি। সব নিলি। হালার পুত। অহন একটু ঘুমাইতেও দেয় না”।

লালুর মাথা ঝিম ঝিম করে। পা টলে। চোখের পাতা লেগে লেগে যায়। ঘুমের কাঁটা চোখে কচ কচ করে বেঁধে। কিন্তু ঘুম আসে না। বুকের ভেতর কাঁপে। হাত-পা কাঁপে। মাথা ভারী মনে হয়।

লালু শোয়। এপাশ-ওপাশ করে। চোখ বন্ধ করে থাকে। শিয়ালের ডাক শোনে। কুকুরের কান্না শোনে। রাতপোকাদের ডাক শোনে। শালার ঘুম আসে না।

সে আবার চোখ খোলে। হঠাৎ উঠে বসে। তারপর সোজা হেঁটে যায় শ্মশানঘাটে। ভাবে ক্যারাস জোড়া নদীর জলে ফেলে দেবে। কিন্তু ঘুরে সে আবার গোরস্থানে যায়। আম্বিয়া বুবু হয়ে যাওয়া সুবলা দিদির কবরে ডাকে- দিদি! দিদি! ভাবে কিছু জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু দিদি খুব চুপচাপ। নিরুত্তর। দিদির ঘুম ভাঙে না।

লালু আবারো ডাকে। ডেকে ডেকে অস্থির হয়। সে একবার শ্মশানে যায়, একবার গোরস্থানে। মাঝে মাঝে থ হয়ে বসে থাকে চা স্টলের বারান্দায়। আর ভাবে, “ শালার দিদি! কত ঘুমায়! ”

হাঁটতে হাঁটতে বা কোথাও বসে থাকতে থাকতে লালু আচমকা দাঁড়িয়ে যায়। বিকট শব্দে চিতকার করে ওঠে। বিভৎস চিতকারে বলে, “ সমন্ধির ভাই সুধীর‌্যা, আমি তর মুহ মুতি। শালার চুতমারানির ক্যারাস! আমি তর গোয়া মারি। আমার ঘুম গেলো কই? আমার ঘুম দিয়া যা ”।

লালুর মেজাজ বাড়ে। খিস্তি-খেউর বাড়ে। “হালার পুত; সমন্ধীর ভাই সুধীর‌্যা। চুতমারানির ক্যারাস। আমি তরার মুহ মুতি। আমি তরার গোয়া মারি। আমার চউক্ষের ঘুম কই? আমার চউক্ষের ঘুম দে।”

বি. দ্র: জাহাঙ্গীর আলম জাহান সম্পাদিত সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ক ছোটোকাগজ 'দৃশ্যপট'-এর বর্ষ-৩, সংখ্যা-৪, নিরঙ্কুশ গল্প সংখ্যা, অক্টোবর ২০০৬-এ 'ক্যারাস' গল্পটি প্রকাশিত হয়। গল্পটি লেখা হয়েছিল সম্ভবত ২০০৪ বা ২০০৫ সালে, কোন মাসে মনে নেই। আমার লেখা আর সকল গল্পের মতন এটিও হারিয়েই গেছিলো। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া যে কোনো কিছুই ফিরে পাওয়া আনন্দের।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৭

মামুন রশিদ বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.