নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

এক জিম্মির প্রার্থনা

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:২৬

বিলাপের সুর নিয়ে একেকটা সকাল আসে। একেকটা সকাল আসে শোকমুখে; কাঁধে নিয়ে স্বজনের লাশ।

এই সব লাশের দিকে, ক্ষত-বিক্ষত শরীরের দিকে তাকাতে পারি না। স্বজন যারা বেদনায় নিথর হয়ে বসে থাকে প্রিয়জনের লাশের পাশে, যাদের আর্তনাদ আহাজারির ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়, উঠে আসে টিভি'র পর্দায় তাদের দিকে তাকাতে পারি না।

কারো কান্নাভেজা ফোলা-ফোলা লাল চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর অজান্তেই ভিজে যায় আমার চোখ। আমার কী যেনো নাই-নাই লাগে। আর কেমন একটা বেদনা ও অসহায়ত্ব ভর করে আত্মায়।

হয়তো আমারই দুর্বল চিত্ত। কারো হাত কেটে গেলে, রক্ত দেখলে আমার কেমন যেনো লাগে। সিনেমায় যখন খুব বেশি সহিংসতা দেখানো হয় তখনো, কখনো-কখনো শিশুদের মতনই চোখ বন্ধ করে ফেলি আমি। তারপর হয়তো সেই দৃশ্য সময় নিয়ে কখনো সাহস সঞ্চয় করে দেখি। হয়তো তা একবারে হয় না। হয়তো কয়েকবারের চেষ্টায় আমি মুখোমুখি হতে পারি সেই দৃশ্যের।

হয়তো এ আমারই অসুখ। অতি স্পর্শকাতরতা। কিন্তু রংপুরে বাসের আগুনে পুড়ে যারা মারা গেলো, ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঙ্গার হলো যে মা-- তারা তো সিনেমার দৃশ্য নয়। তাদের দিকে তবে কী করে তাকাই!

তাই, আমি চোখ সরিয়ে নিই। চোখ বন্ধ করে নিই। কিন্তু চোখ সরিয়ে নেয়ার পরও, চোখ বন্ধ করার পরও কিচ্ছার সেই বিবেকের মতন আমার ভেতর থেকে আরেকটা কেউ বলে উঠে: তুমি অন্ধ হলেই প্রলয় কি বন্ধ হবে?

হবে না। হয় না। তবু, কাকের মতন আমি চোখ বুজে থাকি। কিন্তু প্রলয় বন্ধ থাকে না।

নিথর যে মুখটা আমি দেখেছি পত্রিকার পাতায়, নিথর যে মুখের পাশে ছলছল চোখ নিয়ে মুহ্যমান যে স্বজনকে দেখেছি বসে থাকতে শোকাতুর-- আমার মনের চোখে কেবল তাদেরই ভেসে ওঠে। আর ভেসে উঠে আমার ভাইটির মুখ।

আমার ভাই! বাইক নিয়ে যে অবিমৃশ্যকারীর মতন যেদিন-সেদিক ঘোরা-ঘুরি করে, রাজনীতি'র 'র' বিষয়ে যার কোনো ধারণাই নাই আমার খালি তার কথা মনে হয়।

নিজেরই অজান্তে মুহূর্তের জন্য আমি একবার সেই স্বজনের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে নেবার পর আমার বুকটা ধরফর করতে থাকে। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। বুক ফেটে ঘরের ভেতর একা আমি হু হু করে কাঁদতে থাকি!

তবু স্বান্তনা! আমার ভাই আজ ভালো আছে। এই আজকের জন্যই আমি প্রভুকে ধন্যবাদ দিই।

কিন্তু যার বুক খালি হয়ে গেছে! কী হবে তার স্বান্তনা! কোন অপরাধে ছেলেটি তার লাশ হয়ে ফিরলো? কোন অপরাধে ভাইটির সোনার বদন পুড়ে অঙ্গার হলো তার!

নিজেকে জিম্মি মনে হয়। যারা রাষ্ট্রের জিম্মাদার, যারা রক্ষাকর্তা, তাদেরই হাতে আজ জিম্মি হয়ে আছি!

ছোটো বেলায় দেখতাম কালবৈশাখীর রাতে মাঝে মাঝে বিশেষ এক প্রকারের খুব ঝড় হতো। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের সেই ঝড়। কিন্তু ভীষণ তীব্র। মুহূর্তেই খড়ের বাড়ি-ঘড়, টিনের চালা, দো-চালা ঘর সব ভেঙে, বড় বড় গাছ উপড়ে ফেলে আবার মুহুর্তেই চলে যেতো সেই ঝড়।

আমার দাদু এবং দাদুর বয়সীরা এই ঝড়কে ডাকতো 'জলাত্তি'। বলতো: গাঙ্গে পাক দিসে। গাঙ্গের থাইক্যা উইঠ্যা আইসে তুফান। এই তুফান কড়া। ঘরের ভিতরে এই বাতাস ঢুকলে একটা টানে ঘর ফালাইয়া দিব এই তুফান।

তখন সেই কড়া তুফানের মধ্যে প্রত্যেক ঘরে ঘরে সবাই দরজা আটকে রাখতো শক্ত করে। আর নারী পুরুষ সবাই সমস্বর খুব জোরে জোরে চিতকার করে বলতে থাকতো: দোহাই আল্লা-নবী! দোহাই আল্লা-নবী! দোহাই আলী। দোহাই আলী।

আলীর দোহাই শুনে হয়তো ঝড় থামতো। অথবা হয়তো ঝড় থামতো তার নিজেরই শক্তিক্ষয় শেষে।

কিন্তু এই যে ঝড় উঠেছে বাংলাদেশে, এই যে ভেঙে যাচ্ছে একেকটা সাজানো সংসার, এই ঝড় কোন দোহাইয়ে থামবে?

পত্রিকার ছবির দিকে চেয়ে, টিভিতে একটানা বিলাপের কান্না শুনে যখন বিষাদ লাগে তখন মাঝে মাঝে টিভি বন্ধ করে দিই, মাঝে মাঝে চলে যাই ডিসকভারিতে।

আমি সেই বিলাপকে ছাড়লেও বিলাপ আমাকে ছাড়ে না। তাই টিভি বন্ধ করার পরেও এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা আঁকড়ে রাখে আমাকে। আর মনে হয়, জিম্মি হয়ে আছি; জিম্মি হয়ে আছি; জিম্মি হয়ে আছি।

মনে হয়, ভীষণ তুফান উঠেছে। এই তুফানে কার ঘর ভাঙবে, কার ঘর ভাঙবে না আমার মত সাধারণ মানুষদের কারো তা জানে নেই। পেটের দায়ে আমাদের কাজে যেতে হয়। তাই, ঘরে দরজা আটকে রেখে আমরা ঘরে থাকতে পারি না।

কিন্তু আমাদের কি এখন তাই করা উচিত? ঘরের দরজা আটকে কেবলি 'দোহাই আলী' বলা ছাড়া আর কি কিচ্ছু আমাদের করার নেই?

আমার খুব অসহায় লাগে। এই অসহায়ত্ব আমার ভাইয়ের মুখ। এই অসহায়ত্ব আমার প্রিয় মানুষ-- যে দূরে থাকে, যাকে বাসে করে দূরের শহর পাড়ি দিয়ে উপনীত হতে হয় এই নগরে-- তার কথা মনে হয়। আর তাদের কথা মনে হলেই আমার অসহায়ত্ব আমাকে বলে তুমিও দমে দমে বলো: দোহাই আলী! দোহাই আলী! ওদের যেনো কারো কিছু না হয়।

আজ হয়তো হয় না। আজ হয়তো আমার বদলে কাঁদে অন্য আরেক বোন। অন্য আরেক স্ত্রী। কিন্তু এইভাবে আর কতদিন!

এই দেশে যেখানে রক্ষাকর্তাদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে দেশ সেখানে কার নামে দোহাই দিলে শান্তি ফিরে আসবে, সে কথা কি আপনি বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রী? না-কি আপনি বলতে পারেন, বিরোধী দলের চেয়ারপার্সন?

হয়তো আমারই দুর্বল চিত্ত। তাই, সিনেমার দৃশ্য-ও অনেক সময় কান্না এনে দেয় আমার চোখে। আমার মত দুর্বল চিত্তের কথা না হয় নাই বা ভাবলেন আপনারা। কিন্তু যেই মা, যেই বোন, যেই স্ত্রী, যেই সন্তান হারাচ্ছে তাদের প্রিয় স্বজনদের আপনাদেরকে তাদের দোহাই দেই। আপনারা, রাজনীতিবিদেরা-- দেশের রক্ষাকর্তারা-- দয়া করে এই তুফান থামান।

স্বজন হারানোর ব্যাথা কতটা তীব্র হয় সেই কথা আপনাকে স্ববিস্তারে বলতে হবে না, প্রধানমন্ত্রী। আপনি নিজেই আজো বুকে বয়ে বেড়ান রাসেল-কে হারানোর শোক।

স্বজন হারানোর ব্যথা আপনাকেও নতুন করে মনে করিয়ে দেবার কিছু নেই, বিরোধী দলের চেয়ারপার্সন। তাই, এই তুফানের দিনে আপনাদের কাছেই আমরা করুণা প্রার্থনা করছি।

বাবাকে হারিয়ে, ভাইকে হারিয়ে আর যেনো কাউকে সারা জীবন কাঁদতে না হয় সেই বিহিত আপনি করুন প্রধানমন্ত্রী। স্বামীকে হারিয়ে আর কোনো নারী যেনো শোকে না হয় পাথর সেই বিহিত আপনি করুন, মাননীয় খালেদা জিয়া।

আমার মত দুর্বল চিত্তের, ভীতু এক মানুষের কথা ভেবে নয়, আপনাদের বুকে পুষে রাখা ব্যাথা, কান্না ও শোকের কথা মনে করে আমাদের উপর আপনারা দয়াপরবশ হোন।

১৫.০১.১৫

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৫

এহসান সাবির বলেছেন: কিন্তু এই যে ঝড় উঠেছে বাংলাদেশে, এই যে ভেঙে যাচ্ছে একেকটা সাজানো সংসার.........

২| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:৫৩

স্বপ্নবাজ অভি বলেছেন: বাংলাদেশের গল্প :(

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.