নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঘমারা গ্রামে এক রাত

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:২৯

‘আজকে রাইতে সোনারযৌবন তোমায় করবো দান ভাইগ্না রে’ ...

‘রে’ কথাটায় গিয়ে উনি একটা লম্বা টান দিচ্ছেন। বেশ প্রলম্বিত হচ্ছে সুর। রাতের অন্ধকারের সুনসান নীরবতায় উত্তাল এই সুর পৌঁছে যাচ্ছে পাড়ার একেবারে দূরতম কোণেও। আর শুধু তো গানের কথামালা নয়। আছে নানাবিধ মন্ত্র। মন্ত্র পড়ে-পড়ে ‘ছু’ বলে উনি পাড়া কাঁপিয়ে ‘ফু’ দিচ্ছেন আব্বাস-এর বুকে ও মুখে। ‘ছু’ শব্দটা এমনই উচ্চকিত, একেবারে গগন বিদীর্ণ করছে যেনো।

কামারবাড়ীর উঠোনে বসেছে আশর। আশরের মাঝখানে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে আব্বাসকে। আব্বাসের অবস্থা খুব খারাপ। গত মাস তিনেক দুষ্টু দেও মানে একটা খারাপ পিশাচ ভূত আব্বাসকে ধরেছে। এরপর থেকে রাত-বিরেতে আব্বাস ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বিলের মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে থাকে। একা একা হাসে। একটানা এক-দুইদিন না ঘুমিয়ে বাঁশঝাড়ের তলায় নিরিবিলি থাকে। তার চোখগুলো মাঝে-মাঝে ‘সিন্দুরের মতন লাল টকটকা হইয়া থাকে’।

একমাত্র ছেলেটাকে সুস্থ্য করার জন্য কত তাবিজ-কবচই-না নিয়েছেন আব্বাসের মা। আব্বাসের বাপ কালু কামার-ও কম তো চেষ্টা করে নাই। ১৬/১৭ বছরের যুবক ছেলেটাকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য কত দান-খয়রাতই সে করেছে। সদকা দিয়েছে। এতিম-মিছকিন খাইয়েছে। গত শুক্রবারের আগের জুম্মাহর নামাযের পর সবাই যখন চলে আসে তখনো কালু কামার মসজিদে। সে একা একা নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ছেলের কল্যাণ কামনা করেছে। সেই রাতেই ‘নিশি-নিগুম-রাইতে ঘুম থাইক্যা উইঠ্যা রাত তিনটা কি চাইরটার সময় সালাতুল হাজতের নামাজ পড়ছে’। নামাজ পড়ে মোনাজাত পড়তে গিয়ে অঝোরে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে কালু কামার। প্রয়োজনে সে নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আল্লাহর কাছে তার ছেলের জীবনের সুস্থ্যতা ভিক্ষা চায়।

কিন্তু কই কী! ছেলে তার যেমন ছিল তার চেয়ে খারাপ ছাড়া ভালো হয় নাই। ছেলেটা ‘নিশি-রাইতে একলা একলা কথা কয়। ভরদুপুরে বরাক বাঁশের ঝাড়ের তলায় গিয়া কান্দে। তিন-চাইর দিনেও মুখে নেয় না একদলা ভাত। চোখ দুইটা তার কিমুন জ্বলজ্বল করে।’ সেই জ্বলজ্বল করা চোখ দেখে মাঝে-মাঝে নিজেই ভয় পেয়ে যায় কালু কামার।

একটা মাত্র সন্তান তার। তাও সেই ছেলেরেই ধরলো এমন একটা খারাপ দেও! দেও ছাড়ানোর বহু চেষ্টা করেও না পেরে শেষে খবর পেলো যে, হাওর এলাকায় অষ্টগ্রামের বারোঘরিয়া গ্রামে এক মহিলা কবিরাজ আছে। ব্যাপক তার নাম-ডাক; বিরাট তার কেরামতি। দুইটা জ্বীন-ও নাকি তার পোষা। ‘এই জ্বীনদের দিয়াই একবার নাকি এক মন্দ দেও-রে উনি ধরাইয়া আনাইছিলেন কলিকাতা থেইক্কা’। এই কবিরাজের খবর পাওয়ার পর তারে আনার জন্য উতলা হয়েছিল আব্বাসের মা কুলসুম।

কুলসুম বলেছে, ‘যত ট্যাহাই লাগুক, আমার ছ্যাড়ারে আমনে ভালা কইরা দেইন। লাগে আমার রুপার চেইন, কানের ফুল, হাতের চুড়ি সব বেইচ্যা দেইন। তারপরেও যদি ট্যাহায় না কুলায় তে বাড়ির সামনের আমগাছটা বেইচ্যা দেইন। কিন্তু বেডি কবিরাজরে আমনে আনুইন।”

কুলসুমের কান্দনে কালু কামার এই কবিরাজের বাড়ি গেছে। বাড়ির সামনের গাছটা বিক্রি করে টাকা নিয়ে বড় কবিরাজের বিরাট খরচা জোগাড় করেছে। ‘তবু যদি তার আব্বাস ভালা হইয়া যায়।’

আব্বাসকে ভালো করার জন্যই বাড়ির উঠোনে বসেছে আশর। কৃষ্ণপক্ষের রাতে, মাসের তৃতীয় মঙ্গলবারে রাত দশটা তেরো মিনিটে বসেছে আশর। বাঘমারা গ্রামে রাত দশটা মানে গভীর রাত। এশার আজানের সাথে সাথেই এই গ্রামে সবাই রাতের খাবার খেয়ে নেয়। আর রাত করে যারা বাজার থেকে ফেরে তারাও সর্বোচ্চ নয়টা। ফলে, রাত দশটা অনেক রাত।

কিন্তু আজ রাত অন্য রকম। আজ মন্দ দেও-কে কাবু করার রাত। আজকে রাতে যে কালু কামারের বাড়িতে ‘বেডি কবিরাজের আশর বইবো’ এই কথা আগেই বাজারে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। তাই, সন্ধ্যার পর থেকেই এই গ্রাম সেই গ্রামসহ ‘সাত গেরামের মানুষ আইস্যা জমছে’ কালু কামারের বাড়ির উঠানে। এশার আযানের পর-পর বাড়িতে আর পিপড়া ধারণের ঠাঁই নাই। ‘বেডি কবিরাজের নাম সবাই শুইন্যা আসছে এতো কাল। তারে আজ চোক্ষে দেহনের বাসনায়’ এসেছে সকলে।

কৃষ্ণপক্ষের রাত। শরতের আকাশে অগুন্তি তারা। লালচে-নীলচে-ফ্যাকাশে তারারা কেমন ঝিলমিল-ঝিলমিল করে। উঠোনের পশ্চিম পাশের দেওড়ির পিছনেই বাঁশের ঝাড়। ঝাড়ের ভিতর মিটি-মিটি জ্বলে জোনাকী পোকা। তার মাঝে বসেছে ‘দেও তাড়ানি আশর’।

বাচ্চা-বুড়া-বিবাহিতা-অবিবাহিতা-যুবক-যুবতী-বিধবা-সধবা মিলিয়ে শত লোকের উপস্থিতি। তারা ভরা রাত, জোনাকি পোকার আলো, বাঁশঝাড়ে পাতাদের শনশন, দুইটা হারিকেনের চিমনির চারিধারে গোল হয়ে জ্বলতে থাকা মৃদু আলোর আভার মধ্যে হাতলওয়ালা চেয়ারে রাজার মতন সিনা টান করে বসা আব্বাস। এই সব মিলিয়ে বাঘমারা গ্রামে যেনো আজ রাতে রূপকথা নামে।

বেডি কবিরাজ মন্ত্র পড়ে। তার বুকের ভেতর থেকে এমনি গম্ভীর সুরে বের হয় সেই মন্ত্রের আওয়াজ, মনে হয়, বুঝিবা মেঘ ডাকে গুড়ুম-গুড়ুম। আকাশ কাঁপানো মন্ত্রের ফাঁকে ফাঁকে আব্বাসের বুকে ও মুখে ‘ছু’ বলে ফুঁ দিচ্ছেন তিনি। ‘ছু’ বলার সাথে সাথে তীব্রবেগে একদলা গরম বাতাস আর তার সাথে জর্দা মেশানো পানের গন্ধ ও থুথুর ছিটে-ফোটা এসে পড়ছে আব্বাসের বুকে ও মুখে।

মন্ত্রের ফাঁকে-ফাঁকে মন্ত্রের অংশ হিসেবেই গানের মতন সুরে আরেকটা কী যেনো মন্ত্র পড়ছেন বেডি কবিরাজ। গানের মতন সুরে গাওয়া মন্ত্রের কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না স্পষ্ট। শুধু, ‘আজকে রাইতে সোনার যৌবন তোমায় করবো দান ভাইগ্না রে’ লাইনটা বোঝা যাচ্ছে। কারন এই লাইনটা বলার সময় বেডি কবিরাজ পরপর তিনবার করে বলে।

প্রথমে এই লাইনের কথাটা বুঝতে পেরে পাশের বাড়ির যুবতী লুদুনি তার পাশে থাকা দুঃসম্পর্কের চাচীকে কনুইয়ে ধাক্কা দিয়ে বলেছে, ‘হায়! হায়! হায়! কাকী, এই বেডি এইতা কী-তা আকথা-কুকথা কয়!’

লুদুনিকে ধমক দিয়ে চাচী বলছে, ‘ধুর ছেড়ি! বেশি বুঝস! বেডি মন্ত্র পড়তাসে। মন্দ দেওরে ডাকতাসে। লোভ দেহাইতাসে। লোভে পইড়া মন্দ ভূত আইবো। আইলেই হেরে বান্ধবো। বাইন্ধা দিবো ছ্যাঁচা। হের পরে আব্বাস ভালা অইবো।’

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। এতোক্ষণ মন্ত্র পড়ার পরেও আব্বাসের কোনো হেল-দোল নাই দেখে বেডি কবিরাজ তার সাগরেদ-এর সাথে কী জানি আলাপ করে নিচু গলায়। আলাপের পরেই, সাগরেদ বলে, ‘এই যে ভাই-বইন সকল, আপনেরা একটু দূরে যান। আরেকটু জায়গা ছাড়েন। জায়গা ছেড়ে দাঁড়ান। মন্দ দেও আশেপাশেই আছে। কিন্তু সে এইখানে প্রবেশের রাস্তা পাইতাসে না। আপনেরা দূরে যান। রাস্তা ছাড়েন।’

আচম্বিতে সাগরেদের এমন ঘোষণায় কেমন যেনো একটা চাঞ্চল্য তৈরি হয়। সবাই একটু পিছিয়ে সরে দাঁড়ায়।

সাগরেদ আবার বলে, ‘মাতা-হুজুর এখন গরম মন্ত্র পড়বেন। আপনেরা সাবধান। আর যারা যারা নাপাক শরীরে আছেন তারা তারা চলে যান। না গেলে মাতা-হুজুরের গরম মন্ত্রে কারো কোনো ক্ষতি হইলে আমরা কিছু জানি না।’

এই ঘোষণার পর নীরবতা নামে উঠান জুড়ে। কারো মুখে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। এমনকি একটা বাচ্চা ছেলে যে কি-না খুক্কুর-খুক্কুর করে কাশছিল শুরু থেকেই, তার কাশিও বন্ধ।

এমন সময় মাতা হুজুর তার চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে মাঝখানে দাঁড়ায়। সকলকে উদ্দেশ্য করে কেমন ঐশ্বরিক স্বরে সুরেলা ভাষায় ঘোষণা করে,

‘ভাইসব, লুঙ্গি যারা পিন্ধা আছেন তারা আবার উল্টাইয়া পড়েন;
তারা আবার উল্টাইয়া পড়েন, ভাই গো।’

এই কথার সঙ্গে সঙ্গে সবাই জায়গায় দাঁড়িয়েই লুঙ্গির ভাঁজ খুলে অদ্ভুত এক দক্ষতায় চোখের পলকে লুঙ্গির কোমরের দিক পায়ে আর পায়ের দিক কোমরের দিকে দিয়ে উল্টিয়ে পড়ে।

একদিকে পরুষেরা লুঙ্গি উল্টিয়ে পড়ায় ব্যাস্ত। আরেকদিকে, বেডি কবিরাজ ভুবনভোলানো সুরে ও স্বরে নাটকীয় কায়দায় বলতে থাকে,

‘মা-বইনেরা শোনেন,
মনও দিয়া শোনেন,
মন্দ দেও আসবে এখনি।
কুচি দিয়া কাপড় যারা পিইন্ধা আছেন,
কাপড় খুইল্যা আপনেরা একপ্যাচে পিন্ধেন।
আপনেরা কাপড় খুইল্যা একপ্যাচে পিন্ধেন।
মা-বইনেরা শোনেন,
চুলের খোঁপা, বেনীর বান্ধন খুইল্যা এইবার দেন।
খুইল্যা এইবার দেন।
মন্দ দেও আসবে এখনি।’

বেডি কবিরাজের কথার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা বেণী খুলে দেয়, মহিলারা খোঁপা খুলে খোলা চুলে মাথায় ঘোমটা টেনে দাঁড়ায়।
বেডি কবিরাজ আবার মন্ত্র পড়া শুরু করে। এবার মন্ত্রের সাথে বাজনা-ও বাজছে। ঢোলের মতই একটা যন্ত্র বাজাচ্ছে বেডি কবিরাজের আরেক সাগরেদ। মন্ত্র পড়তে পড়তে কবিরাজ আবার ওই গানের মতন মন্ত্রটা বলেন এবং তিনবার করে উচ্চারণ করেন,

‘আজকে রাইতে সোনার যৌবন তোমায় করবো দান ভাইগ্নারে’।

কিন্তু এই মন্ত্রটা ধ্যান ধরে বারবার শোনার কারণে এইবার লুদুনি আরো কয়টা লাইন বেশি বুঝতে পেরেছে। মন্ত্রের মাঝখানে কয়টা লাইন এইরকম:

‘তোমার মামু গৃহে নাই গো, গেছে বন্দরে;
আইসো তুমি নিগুম রাইতে,
টোকা দিও কাঠের দরজাতে’।

কিন্তু এই কথাগুলো বলে খুব দ্রুত। আর তারপর একটু বিরতি দিয়ে প্রলম্বিত সুরে বলে, ‘আজকে রাইতে সোনার যৌবন তোমায় করবো দান ভাইগ্না রে’।

লুদুনী আবার তার চাচীরে বলে, ‘ও চাচী, বেডিতো খারাপ কথা কইতাসে! এইডা আবার মন্ত্র অয় কেমনে!’

লুদুনিরে ঝাড়ি দিয়ে চাচী বলে, ‘ধুর যা! তোরে না কইছি! আব্বাসরে ধরছে একটা মন্দ ভূত। একটা পিশাচ। একটা খারাপ দেও। হেরে ভালা করনের লাইগ্যা মন্দ দেওরে লোভ দেহাইয়া ডাকতাসে বেডি কবিরাজে। এই ডাকে মন্দ দেও আইলে তারে বান্ধবো, বেডি কবিরাজ।’

বেডি কবিরাজ একটা বড় বোতল থেকে নিজের মুখের মধ্যে কেরোসিন ঢেলে দিচ্ছে। এই দেখে দর্শকেরা বিস্ময়ে বোবা। বেডি কবিরাজের হাতে একটা মশাল। সেই মশালের দিকে বেডি কবিরাজ মুখ থেকে করোসিন ছাড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে, বেডি কবিরাজের মুখ থেকে বেরুচ্ছে আগুনের হল্কা। সেই মশাল নিয়ে আব্বাসের চারিধারে গুণেগুণে সাতপাক ঘুরেছে বেডি কবিরাজ। আব্বাসের মাথায় সাত-পাকে দিয়েছে সাতটা চাটি। প্রতি পাকেই মশালটা প্রায় আব্বাসের মুখের কাছে চোখের কাছাকাছি নিয়ে তার চোখের মধ্যে ছু বলে ফু দিয়েছে বেডি কবিরাজ। তারপর দুই সাগরেদ আব্বাসকে ধরে গায়ের জামা খুলে দিয়েছে। তার কপালে দিয়েছে সিন্দুরের টিপ। তার গলায় দিছে বকুল ফুলের একটা মালা।

তারপর হঠাত দুই সাগরেদ সমস্বরে বলা শুরু করলো, ‘সরেন, সরেন, উত্তরদিকে যারা আছেন আপনেরা সরেন। আইতাসে আইতাসে আইতাসে দেও আইতাসে।‘ এই কথা শোনার পর আব্বাস হঠাত উঠে একটা দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করতেই তাকে খপ করে ধরে ফেলে দুই সাগরেদ।

হাছর-পাছর করে আব্বাসের সঙ্গে দুই সাগরেদ প্রায় হেরে যাচ্ছে দেখে বেডি কবিরাজ এসে দাঁড়ায় হাছর-পাছররত আব্বাসের সামনে। দাঁড়িয়ে বাম হাতে আব্বাসের গালে কষে একটা থাপ্পর দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী-রে মাঙ্গির পুত! না আইয়া থাকতে পারলি না! বাঁচতে চাইলে এই চেয়ারের উপরে সিধা অইয়া ব।’

কবিরাজের কথা শুনে, লুদুনি তার চাচীকে আবার কুনইয়ে গুঁতো দিয়ে বলে, ‘চাচী, এই বেডির মুখ তো খুব খারাপ।’

বিরক্ত হয়ে চাচী বলে, ‘ধুর ছেড়ি, তুই ঝিম মার।’

এদিকে বেডি কবিরাজের কথা শুনে আব্বাস শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

বেডি কবিরাজ এইবার আগত দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দেহুইন, আমনেরা দেহুইন। এই মন্দ দেওরে দেহুইন! কিমুন মাথা নিচা কইরা অহন রইছে বইয়া!’

তারপর আব্বাসের দিকে ফিরে বাম হাতে আরো একটা থাপ্পড় মারে আব্বাসের ডান গালে। থাপ্পড় দিয়ে আবার ঘোষণার মতন চিতকার করে বলে,

‘উপরে আল্লাহ, নিচে মাটি,
মধ্যিখানে আমি কবিরাজ!
এইবার ক’ আমারে কী তুই চাস?’

আব্বাস তবু কথা বলে না। এইবার আব্বাসের ঘেটির মধ্যে বাম হাতে একটা ঝাঁকি দিয়ে বেডি কবিরাজ বলে,

‘উপরে আল্লাহ, নিচে মাটি,
মধ্যিখানে আমি বেডি কবিরাজ!
ভালোয় ভালোয় ক’ আমারে কী তুই চাস?
নাইলে তোর ইহলীলা সাঙ্গ হইব আজ।’

এইবার আব্বাস মুখ খুলে। কিন্তু আব্বাসের গলার স্বর অন্য রকম। অচেনা একটা গমগমে কণ্ঠস্বর বেরোচ্ছে আব্বাসের গলা দিয়ে। এই শুনে আব্বাসের মা মুখে আঁচল দিয়ে ডুকরে বলে, ‘ও মা-তা হুজুর গো, আপনে আমার ছ্যাড়ারে আইন্যা দেইন!’

বেডি কবিরাজ একটা ধমক দিয়ে বলে, ‘চুপ! দেখ তোর ছ্যাড়া কেমনে ভালা হয়। আর দেখ, এই বেত্তমিজ দেওটারে আমি কী করি!’

তার পর আব্বাসের দিকে তাকিয়ে কবিরাজ জিজ্ঞেস করে, ‘বল, তুই ব্যাডা না বেডি?’

আব্বাস একটা পুরুষালি স্বরে বলে,
-আমি বেডি।
-কী চাস?
-কিছু চাই না।
-না চাইলে তুই আমার রোগীরে ধরছস কেরে?
-আপনের রোগী আমার মাথার চুলের উপরে পাড়া দিছিল।
-কস কী তুই? কেমনে হে তোর মাথার চুলে পাড়া দিল?
-কয়েকমাস আগে, দুপুর বেলা বজলুর দিঘীত গোসল কইরা আমি আশকান বাড়ির মাঠে শুইয়া চুল শুকাইতাসিলাম। আপনের রোগী, আমারে পাড়াইয়া গেছে। আমার মাথার চুলে পাড়া দিছে। আমি তারে ছাড়তাম না। আমি তারে ভোগাইবাম।

ভোগাইবাম কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বাম হাতে চটাস করে আব্বাসের গালে একটা চড় মারে কবিরাজ। মেরে বলে, ‘তুই হেরে ভোগাইবি! শাওয়ার দেও! তুই আমার সামনে কস তুই হেরে ভোগাইবি! দেখ, তোরে আমি কী করি! তোরে আমি শিশির ভিতরে ভরবাম।’

এইটুকু বলে উনি একটা হাঁক দেন সাগরেদদের উদ্দেশ্যে, ‘এই আমার শিশি আন!’

বলা মাত্রই একজন সাগরেদ বাক্স খুলে আতরের শিশির মতন ছোটো সাদা একটা শিশি এনে কবিরাজের হাতে দেয়। বেডি কবিরাজ সাগরেদদের নির্দেশ দেয়, ‘বাজা বাদ্য’। কিন্তু বাদ্য বেজে উঠার আগেই আব্বাস লাফ দিয়ে কবিরাজের পায়ে ধরে বলে,

-মাতা-হুজুর, আমারে ছাইড়া দেন। আমারে শিশির ভিতরে ভইরেন না। আমি আপনের রোগীরে ছাইড়া দিতাসি।

-না, রোগীরে তো ছাড়লে অইতো না। তুই আমার মুখের উপরে কথা কইছস! তুই আমার লগে বেয়াদ্দবি করছস। শাস্তি তো তোর অইবই।

এই কথা শুনে আরো শক্ত করে আব্বাস কবিরাজের পা প্যাঁচিয়ে ধরে বলে,

-আমারে ছাইড়া দেন। বলেন, আমি আপনের লাইগ্য কী করতে পারি।
-আইচ্ছা, ঠিকাছে তোরে ছাড়বাম। কিন্তু তুই একটা নতুন তাঁতের শাড়ি, এক কেজি মিষ্টি, একটা সিন্দুরের কৌটা আর এক কেজি আপেল আইজ রাইতে থুইয়া যাইবি কালু কামারের বাঁশঝাড়ের তলে।
-জ্বী আইচ্ছা, আব্বাস জবাব দেয়।
-তুই ওয়াদা কর, এই পাড়ায় আর কোনোদিন আইবি না। আশকান বাড়ির মাঠে আর কোনো দিন চুল শুকাইতে দিবি না। গোসল কইরা চুল যদি শুকাইতেই হয় শুকাইবি গাছের ডালে বইয়া। যাতে মাইনষে আর তোর চুল পাড়াইতে না পারে।
-জ্বী আইচ্ছা, আব্বাস জবাব দেয়।

বেডি কবিরাজ গরবিনী বেশে বলে, যাওনের আগে আব্বাসের মা আর বাপের কাছে মাফ চা। আব্বাস দাঁড়িয়ে অচেনা এক পুরুষের কণ্ঠস্বরে কালু কামার আর কুলসুম বিবির কাছে ক্ষমা চায়।

কবিরাজ আদেশ করে, যাওনের আগে সবাইরে সালাম দে।

আব্বাস, ডান হাত ডান দিকে কপালে তুলে চারদিকে ফিরে চারবার বলে, আস্সালামু আইলাইকুম। আস্সালামু আলাইকুম। আস্সালামু আলাইকুম। আস্সালামু আলাইকুম।

সালাম দেওয়া শেষ হতেই খাড়া থেকে আব্বাস ধুম করে মাটিতে পড়ে অচেতন হয়ে যায়। কবিরাজ তারমুখে পানি ছিটাইয়া দিতে দিতে বলে, ‘ভয় পাইয়েন না। ভয় পাইয়েন না। পিশাচ দেও গেছে। ছ্যাড়া এক্ষনি জাইগ্যা উঠবো।’ বলতে-বলতে সে আব্বাসের মাথায় কোমল করে হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকে, ‘বাপজান, আর বিপদ নাই। শইলডা ঝাড়া দিয়া উইঠ্যা পড়ো।’

মাটিতে শয়ানে থাকা আব্বাসের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ে বিমুঢ় জনতা। জনতার চোখ একবার আব্বাসকে দেখে একবার দেখে বেডি কবিরাজের দিকে। এমন সময় আব্বাস চোখে মেলে তাকায়।

আব্বাস চোখ মেলে তাকালে দুই সাগরেদ তাকে উঠিয়ে চেয়ারের পায়ের সাথে হেলান দিয়ে বসায়। আব্বাস মৃদু স্বরে ডাকে, ‘মা’!

ছেলের এই ডাকে কুলসুম বিবি দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে ধরে। আব্বাসের এই ডাকে উপস্থিত জনতার মধ্যে একটা কেমন চাঞ্চল্য তৈরি হয়। অবিশ্বাস ভরা চোখে জনতা পরস্পরের মুখ চেয়ে থাকে। আর লুদুনি তার চাচীর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ও চাচী! আব্বাইচ্ছা তো ভালা অইয়া গেলো গা! অত মাস পরে কিমুন মা কইয়া ডাক দেয়! বেডি তো খুব গরম কবিরাজ!’


০৭.০৯.১৬

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৫৭

সাহসী সন্তান বলেছেন: গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের কর্মকান্ডের নমুনা বহুত দেখতে পাওয়া যায়! গল্পটা পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল, দৃশ্যটা যেন স্বয়ং দাঁড়িয়ে দেখছি। আপনার গল্প বলার ভঙ্গী, লেখার ধরন এবং সর্বপরি আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারটা খুবই চমৎকার!

'আজকে রাইতে সোনার যৌবন তোমায় করবো দান, ভাইগ্না রে......' কিন্তু শেষ-মেষ ভুতটা ভাগ্নীই হয়ে গেল? ;)

সুন্দর গল্পে ভাল লাগা! শুভ কামনা জানবেন!

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৪২

আফরোজা সোমা বলেছেন: সময় নিয়ে গল্পটা পড়ার জন্য এবং আপনার মতামত জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ, সাহসী সন্তান। ভালো থাকবেন। অনেক শুভকামনা।

২| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৪

নেক্সাস বলেছেন: খুব সুন্দর লিখেছেন। শহীদুল্লাহ কায়সার, ওয়ালিউল্লয়াহ ঊনারা এমন ধাচে লিখতেন। ভাল লাগ্লো

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৪৫

আফরোজা সোমা বলেছেন: নেক্সাস, গল্পটা পড়ে আপনার মন্তব্য জানানোয় অশেষ কৃতজ্ঞতা। কিন্তু আপনি যাঁদের নাম নিলেন তাদের নাম শুনে তো আমি রীতিমতন দ্বিধান্বিত হয়ে গেছি; বুঝতেই পারছি না যে আপনি কি এই লেখার প্রশংসা করলেন না অপ্রশংসা করলেন। উনারা নমস্য ব্যক্তি। নমস্য নাম।

ভালো থাকবেন। অনেক শুভকামনা রইলো।

৩| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:৪৩

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন:



ওয়াও! আমি বাকশূণ্য গল্প পড়ে।

অনেক দিন পর। আসলেই অনেকদিন পর আমি কোন গল্প তৃপ্ত হইলাম।

আপু, ++++++++++++++++++++++++++++++++++++

সেই পরিচিত অনুভূতি, সরল ভাবটা যেন আরো একবার পেলাম কারো লেখা পড়ে।
লেখার ভাষায় আঞ্চলিকতা আমার বেশি রকমের প্রিয়। তারপর আবার আঞ্চলিক ভাষায় হালকা ময়মনসিংহের ভাষা মিশ্রিত।

আরো প্রশংসা পড়ে করবো। বেশি তৃপ্ত হয়ে গেছি। প্রশংসা জ্যামে আটকা পড়ছে। :|

প্রিয়তে রেখে দিচ্ছি।

আরো গল্প চাই এমন। :)

(প্রতিমন্তব্যে খবরদার আমাকে 'আপনি' করে বলা যাবে না। আগেই সতর্কতা দিয়ে দিলাম। :P )

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৫০

আফরোজা সোমা বলেছেন: ভালোবাসা বড় ভয়ানক ফাঁদ, দিগন্ত! এই যে লগইন করেই এতো এতো ভলোবাসা আমি সকালবেলাতেই পেলাম তোমার কাছ থেকে এ-ও তো এক ফাঁদই বটে। এমন ভালোবাসা পাবার লোভে আমি যদি আরো লিখতে থাকি কিন্তু আর যদি তোমার মন না ভরে, তখন?

আপনি বাদ দিয়ে সোজা তুমিতেই ডাকলাম। কেমন? খুশী তো?

ভালো থেকো। অনেক ভালোবাস।

৪| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৮

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: অসম্ভব ভালো লাগলো গল্প!

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৩

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, সাধু। ভালো থাকবেন। অনেক শুভকামনা।

৫| ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ২:২৪

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:
গ্রামের এই সনাতন জীবনপথ আজ আর আগের মত নেই। ভুলেই গেছিলাম কবিরাজদের কবিরাজি কেমনে করে। আপনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। যেমন তেমন করে নয়, একে বারে চোখের সামনে।

গল্পে চারটা প্লাস ++++

০৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৭

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, ভ্রমরের ডানা। ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.