নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

তৃষ্ণা

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:২৩

শিথানে-পৈথানে কাঠি। শিথানে-পৈথানে জীয়ন-মরণ পাশাপাশি। সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি রইলো পড়ে। কেউ করেনি বদল। এইভাবে রাজকন্যা অনন্ত জীবন ঘুমাচ্ছন্ন অথবা জীবন্মৃত। জীবন্মৃত কন্যার আধজাগা মন ঘুমের ভেতর প্রতীক্ষায়। এই বুঝি কেউ আসে। কেউ বুঝি পাল্টায় সোনা-রুপার কাঠি।

কিন্তু কেউ আসেনি। অনন্ত জীবন প্রতীক্ষায়। অনন্ত-ঘুমে আধজাগা চেতনায় ঘুমের মধ্যে মাথার ভেতর একদিন রাজকন্যা একটা গল্প তৈরি করে। গল্পটাকে স্বপ্নের মতন করে সে নিজেকে দেখায়। তার স্বপ্নে একটা রাখাল। কম্পিউটারের লুপ-এ বাজতে থাকা গানের মতন রাখালের স্বপ্নটাই সে দেখে ঘুম-জীবন ধরে।

দূর এক মাঠে রাখাল বাজায় বাঁশি। বাঁশিতে মোহন মায়া। বাঁশিতে জাদু। এক রাতে জোছনায় বিলের পাড়ে কদমগাছের তলায় মাঝরাতে রাখাল যখন বাঁশিতে তোলে জগতের নারীদের হৃদয়ে প্রলয় ডাকা সুর, সেসময় মোহাচ্ছন্ন এক পরী এসে বসে রাখালের কাছে। কিন্তু রাখাল তাকে করেনি খেয়াল। নয়ন মুদে সে বাজায় বাঁশি। নয়ন মুদে ফুলেরা আত্মস্থ করে সুর-মূর্ছনা। জাত-কূল-মান ভুলে, ডাগর-কাজল-আঁখি মেলে পরী দেখে রাখালের মুখ।

রাখালের চোখ বন্ধ। তার জোড়া ভ্রু। ভ্রু’র মাঝখানে একটু উপরের দিকে কপাল ও ভ্রু-এর মাঝামাঝি একটা কুচকুচে কালো তিল। রাখালের ডান চোখের নিচে কালো একটা কাটা দাগ। রাখালের বাম কানের লতি ডান কানের চেয়ে একটুখানি ছোটো। রাখালের চুল কেমন রেশমি; কেমন কালো আর খয়েরি রঙের মিশেল তার চুল। রাখালের চোখ বন্ধ। তার গায়ের রং শ্যামলা। ঠিক যেমন শ্যামল বুড়ো থানকুনি পাতা, ঠিক যেমন শ্যামল মন্দিরের গায়ে গজানো শ্যাওলার ঝাঁক, তেমনি শ্যামল এই রাখাল। বন্ধ নয়নে রাখাল বাজায় বাঁশি। খোলা নয়নের দরজা দিয়ে পরীর হৃদয় বেরিয়ে এসে রাখালকে করে আলিঙ্গন।

এমনি মধুর লগ্নে একটা পাতার খুব মরে যেতে সাধ হয়। মনে হয়, এরচেয়ে মোহময় মুহূর্ত আর বুঝি এ জীবনে হতে পারে না। তাই একটা পাতা, প্রায় সবুজ বয়সেই, জীবনের পরিতৃপ্তি বুকে নিয়ে বেছে নেয় ইচ্ছেমৃত্যু এবং টুপ করে ঝরে পড়ে রাখালের নাকের ডগায়। আচমকা পরশে রাখাল আঁতকে উঠলে খুলে যায় চোখ। চমকে উঠায় বাঁশির সুরে খায় সামান্য টাল।

নাক বেয়ে, বুক বেয়ে পাতাটা গড়িয়ে পরে রাখালের কোলে। রাখাল পাতাটাকে করে না খেয়াল। সে দেখে অপরূপা এক নারী তার দিকে তাকিয়ে তন্ময়।

তন্ময় সেই চোখের দিকে চেয়ে রাখালের ভেতরের বাঁশবাগানে উঠে ঝড়। চিরল-চিরল বাঁশের পাতায় ঝড়ের মাতম। কাঁপে পাতা। শব্দ উঠে শনশন। ঝড়ের তাণ্ডবে রাখালের পায়ের তলা কেমন নিশপিশ করে। রাখালের তলপেটে কেমন মোচড় দিয়ে খালি হয়ে যায় জগত। তার বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ ঢিপঢপ করে। ঢিপঢিপ বাড়তে-বাড়তে মনে হয়, যেনো বুকের ভেতর ঢং ঢং বাজছে মন্দিরের ঘন্টা। যেনো পাড়াশুদ্ধ লোক শুনছে সেই তুমুল তীব্র নাদ। বুঝি এই আওয়াজে এক্ষুনি ভাঙবে পাড়ার লোকের ঘুম।

এমনি সময়ে একটা রাতপাখি ডাকে অকস্মাৎ। সহসা পরীর ফেরে হুশ। রাখালের ঝড় একটু যেনো থামে। ওরা কেউ কাউকে বলে না কিছু। কিন্তু রাখাল বোঝে, তার হৃদয় চোখে করে নিয়ে গেছে পরী। পরীর চোখ বোঝে, নয়নের খিড়কি দিয়ে তার হৃদয় পালিয়ে রাখালের বুকে বেঁধেছে ঘর।

চোখে চোখে সময় যায়। সময়ের হিসেব থাকে না। তিলেকদণ্ড পল-কে লাগে বুঝি এক মহাকাল। মহাকালকে লাগে যেনোবা একটি মুহূর্তমাত্র। এমনি এক ঘোরের ভেতর চরাচর-কে জাগিয়ে দিয়ে দূর থেকে ভেসে আসে ভোরের আযান। পরীর যাবার সময় হয়।
কিন্তু পরী আবার আসে। আবার। আবার। বারবার। বারংবার। আর রাখাল বসে থাকে। থাকে। থাকে। তারপর পরী আসে। আসে। আসে।

দিনে দিনে রাখালের বাঁশিতে এমনি জাগে মায়া, এমনি উছলে উঠে সুখ, সেই সুরে পাতাদের কেবলি মরে যেতে সাধ হয়। সুরের মায়ায় তারাদের কেবলি ঝরে যেতে মন চায়। মোহময় মুহূর্তে কোনো পাতা স্বেচ্ছায় টুপ করে ঝরে যায়। স্বেচ্ছায় ঝরে যায় কোনো একটা তারাও। সানন্দ মৃত্যুতে পাতা ও তারাদের জীবন যেনো পায় পূর্ণতা।

কিন্তু রাখাল ও পরীর জীবনে হঠাৎই নামে বিষাদ।

টগ-বগ-টগ ঘোড়ায় চড়ে এক রাজপুত্তুর পথে যেতে যেতে দেখে পরিত্যাক্ত এক নগর। নগরের পথে পথে পাথর হয়ে যাওয়া নির্জীব ফুলের বাগান। নগরীর বাঁকে বাঁকে জনশূন্য ঘর। নগরীর মাঝখানে এক বিরাট প্রাসাদ। সাদা মর্মর পাথরে গড়া সেই প্রাসাদের ভেতর প্রাণ নেই। গান নেই। তোতা-ময়না-টিয়ে পাখি নেই। শুধু কারো গভীর নিশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে। নিশ্বাসের শব্দ গভীর থেকে গভীরতর হয়। ঘন থেকে ঘনতর হয়। আবার কখনোবা থেকে-থেকে হয় দ্রুত। দ্রুত থেকে হয় দ্রুততর। আবার কখনোবা নিশ্বাসের সঙ্গে কেমন এক মোহাচ্ছন্ন, সুখময় গোঙানির হালকা আভাস ভেসে আসে প্রাসাদের গভীর থেকে।

রাজপুত্তুর কোমড় থেকে তরবারি খুলে নিয়ে সতর্ক পদক্ষেপে সেই নিশ্বাস করে অনুসরন। সুখময় গোঙানি অনুসরন করে-করে রাজপুত্তুর যায় এক রঙীন ঘরে। সেই ঘরের কাছে যেতে না যেতেই সোনালী এক আলো যেনো প্রায় ঝলসে দেয় তার চোখ। আলো চোখে স’য়ে এলে যুবক দেখে সেই ঘরে রূপোর খাটে মাথায় সোনার তাজ পরে ঘুমিয়ে আছে এক পরী! তার চোখে লাগা আলো সেই পরীর রূপেরই বিচ্ছুরন! কিন্তু নাহ! রাজপুত্তুরের ভুল ভাঙে। পরী নয়, এক রাজকন্যা ঘুমায়। মাথায় তার হীরা-জহরতে মোড়া এক তাজ। তার ঠোঁটের কোণে কেমন এক আবেশ ছড়ানো আবছা হাসি। তার শিথানে-পৈথানে সোনা-রূপার কাঠি।

রাজকন্যার স্বপ্নের রাখাল আর পরীর পৃথিবীতে তখন রাত। রাতের আকাশ ভরা লক্ষ কোটি তারা। তারাভরা আকাশের নিচে রাজকন্যার স্বপ্নের ভেতর পরী ও রাখাল যেনো একটা সুর। যেনো দুইয়ে মিলে একটা গান। যেনো দু’টো দড়ি পাকিয়ে বানানো একটা সলতে। সেই সলতে থেকে আসে একটা মোহাচ্ছন্ন সুখময় আবছা গোঙানি। সেই গোঙানিতে যেনো এক গভীর প্রার্থনার ভাষা খুঁজে পেয়ে একটা পাতা সানন্দে ঝরে যায়। একটা তারা এই গোঙানির গান শুনে নেমে আসে মাটির পৃথিবীতে।

কিন্তু, স্বপ্নের ভেতর, পাতাটা ঝরতে গিয়েও মাটি খুঁজে পায় না। স্বপ্নের ভেতর, তারাটা ঝরতে গিয়েও শূন্যে ভেসে থাকে। স্বপ্নের ভেতর, গোঙানির সঙ্গীত অকস্মাৎ থেমে যায়।

সোনার কাঠি রূপার কাঠি ততক্ষণে শিথানে-পৈথানে অদল-বদল করে দিয়েছে রাজপুত্তুর। যেনো অনন্ত জীবন পানির নিচে থেকে বাতাসের জন্য বুক ভরা তৃষ্ঞা নিয়ে ভুস করে জলের তল থেকে মাথা তোলে রাজকন্যা। অবাক চোখে উসে তাকায়। কিন্তু জেগেও না জাগার মতন হাত দিয়ে কাকে সে নিজের দিকে তীব্র টেনে নেয়! রাজপুত্তুর বোঝে না!

রাজপুত্তুর বোঝে না স্বপ্ন থেকে জেগে রাজকন্যা কেন রাখাল রাখাল করে! কেন সে সোনা-রুপার কাঠির দিকে তাকিয়ে বড় ব্যাথাতুর হয়! পৈথানের কাঠির দিকে চেয়ে কেন সে অস্ফুটে প্রায় কেঁদে বলে, রাখাল!

০৩.০৮.১৬

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:৪৯

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন:
সুন্দর। সহজ। সরল। সাবলীল। মুগ্ধকর। একটা গল্প।
রাজকন্যার প্রতি মায়া হচ্ছে। :(

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১১

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, দিগন্ত। একটা ছোট্ট কমেন্ট যে কত প্রেরনাদায়ী হতে পারে! এতো সুন্দর করে লেখার জন্য অাবারো অণেক ধন্যবাদ। অনেক শুভকামনা রইলো।

২| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:৩৭

রাবেয়া রাহীম বলেছেন: ভালো লেগেছে ।

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১১

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, রাবেয়া রাহীম। ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.