নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

মহামারীর দিনগুলি-৭: লেট দেয়ার বি ডার্ক

১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৭:৩৩

নিদ্রাভঙ্গের পর নিজেকে পতঙ্গরূপে পেয়েছিল গ্রেগর সামসা। কে আমি? মানুষ না পতঙ্গ? ঘুম কি ভেঙেছে? নাকি তলিয়ে আছি গভীর নিদ্রায়? এটা কি নিদ্রা নাকি তন্দ্রা নাকি জাগরণ? এখন কি রাত না দিন? এই আলো কোথা থেকে আসছে?

সুবেহ সাদিকের হাওয়া খুব প্রশান্ত হয়। শীতল পরশে জুড়িয়ে যায় প্রাণ।

ক্রমে আলো ফুটছে। পাখি ডাকছে। বাড়ছে কূজন।

ছোটোবেলায় আমরা জানতাম, ঊষালগ্নে বেহেশতের দরজা খুলে যায়। তখন স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আসে হাওয়া। ভোরের হাওয়ার পরশ, তাই, এতো কোমল হয়।

ছোটোবেলায়, ফজরের আযানের ঠিক আগের সময়টাকে আমরা জেনেছিলাম ‘কালি আন্ধার’। ‘কালি আন্ধার’ মানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এসময়ে ঘর থেকে বের হতে মানা। এসময়ে জ্বীন-ভূত-প্রেতেরা সব ব্যাস্ত-ত্রস্ত ডানায় উড়াউড়ি করতে থাকে। তাদের ঘরে ফেরার তাড়া। ফযরের আজানের আগে-আগেই তাদেরকে লুকিয়ে পড়তে হয়। যেতে হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে। যেতে হয় আলো ফুটবার আগেই। ফযরের আযান একটা সীমারেখা। আযানটা হয়ে গেলে তাদের শক্তি হারিয়ে যায়। তাই, কালি আন্ধার মানে বিপজ্জনক সময়। এসময়ে মানুষের একা বের হতে মানা। অগত্যা বের হতেই হলে হাতে আগুন থাকতে হয়। হোক তা কূপি বা হারিকেন বা দিয়াশলাই। আগুনকে জীন-ভূতে ভয় পায়।

বড়বেলা ভালো নয়। ঘোর কেটে যায়। বিশ্বাস জলো হয়ে আসে। প্রত্যুষে এখন আর খোলে না স্বর্গের দ্বার। এখন মগজ জানে, মানুষেরা ঘরবন্দী থাকলে প্রকৃতির দূষণ ঘটে কম। তাই, রাতের দীর্ঘ বিরতি শেষে প্রত্যুষে এই দূষিত ঢাকার বায়ুও গায়ে শীতল পরশ দেয়।

বড়বেলা ভালো নয়। সব ঘোর কেটে যায়। কালি আন্ধারে দেও-দানো-জীনেরা এখন আর করে না ছোটাছুটি। এখন আর হাতে রাখতে হয় না কূপি কি দিয়াশলাই। বিদ্যুৎ বাতির আলোয় এখন চারদিক ফকফকা।

এই ফকফকা আলোর ভারে মাঝে মাঝে খুব দমবন্ধ লাগে। বাতাস না পেলে বুক যেমন ভার হয়ে আসে, বুকে যেমন চেপে বসে ভারী পাথর, তেমনি লাগে আমার। মাঝে মাঝে এত আলো, এত রোশনাইয়ে চোখ আর কপালের মাঝেখানটা পাথরের মত ভার হয়ে আসে। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ বলতে এখন আর ভালো লাগে না। এখন প্রার্থনার ভাষা, লেট দেয়ার বি ডার্ক।

গৃহবন্দীত্বের দিনগুলোতে ভোরবেলায় জাগবার তাড়া নেই। তাই, রাতের বেলায় ঘড়ি ধরে ঘুমুতে যাবার তাড়া নেই। গভীর রাতে বারান্দায় চুপচাপ বহুক্ষণ বসে থাকবার এখনই সময়। আকাশের দিকে চোখ রেখে একটি-দুটি তারা খুঁজবার এখনই লগ্ন বয়ে যায়।

কিন্তু হায়! বিজলি বাতির রোশনাইয়ে চারদিক ভেসে যায়। আলোকের অত্যাচারে চোখের মণি সময়ে-সময়ে টনটনিয়ে ওঠে।

আলো ও আঁধারের সাথে মানুষের সম্পর্কের ধরণের সাথে প্রাণী জগৎ ও বৃক্ষকূলের সম্পর্কটা মিলবে না। আলো জ্বালতে শেখার ঘটনা মানুষের ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে। আলো মনুষ্য সমাজকে দিয়েছে শক্তি। দিয়েছে মুক্তি। দিয়েছে সাহস। দিয়েছে রাতের অভেদ্য অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা আদিম ভয়কে জয় করবার মোক্ষম অস্ত্র। মনুষ্য সমাজে তাই আলো মানে মুক্তি। মনুষ্য সমাজে জ্ঞানকেও আলোর রূপকে প্রকাশ করা হয়।

বৃক্ষকূলের জিনের ভেতর সূর্যের আলোই বান্ধব হিসেবে সংকেত জমা আছে। দিনমণির আলোয় পাতায় রান্না-বান্না শেষে আহারাদি সেরে রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এলে গাছেরা করে বিশ্রাম। তখন তারা গা এলিয়ে দেয়। কিন্তু মনুষ্যকূল রাতের বেলাতেও শহরে এত বাতি জ্বেলে রাখে যে, দিনের মতন রাতও ফকফকা হয়ে যায়।

খুঁজে পাওয়া যায়না এক পশলা অমল অন্ধকার। অন্ধকারের অভাবে গাছগুলোর দেহঘড়ি উল্টাপাল্টা হয়ে যেতে থাকে। আলোক দূষণে ওদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়। বিদ্যুৎ বাতির ধমকে অন্ধকার এতো দূরে পালায় যে, রাতের আকাশে আর খুঁজে পাওয়া যায় না নক্ষত্রের ঝিলিক।

আমি গাছ নই। তবে, গাছের সাথে মিল আছে। আমার সূর্যালোকও চাই, আঁধারও চাই।

এই ঢাকা শহরে একটুখানি অকৃত্রিম অন্ধকার দেখার জন্য কী না করেছি! বেডরুমের দরজার নিচ দিয়ে সিঁড়িঘরের বাতি থেকে আলো আসা বন্ধ করতে ওই বাতি নিভিয়ে দিয়েছি। বারান্দার দরজায় পর্দা এমনভাবে দিয়েছি যেনো লাগোয়া প্রতিবেশির বাতির আলো আমার ঘরে ঢোকার পথ না পায়। তবু, আসে আলোর আভা। কাঁচের জানালায় ঝোলানো পর্দা ভেদ করে আলোর আভা ঘরের মধ্যে খেলা করে।

একটুখানি অন্ধকারের খোঁজে বেডরুম ছেড়ে স্টাডিতে এসে দরজা, জানালা, বাতি সব বন্ধ করে দিয়ে মিনিট কয়েক বসে থেকেছি। তবু এই চোখকে দিতে চেয়েছি একটুখানি অমলিন অন্ধকারের ঘোর।

একসময় অন্ধকার দেখতে ধানমন্ডি লেকে যেতাম। সন্ধ্যার পর। ছোপ ছোপ অন্ধকার। গাছের তলায় তলায়। গাঢ় নয় যদিও।

পার্কের বাতি, সড়ক বাতি, সাইঁ করে চলে যাওয়া গাড়ির আলোর ঝিলিকে অখন্ড অন্ধকার কোথাও নেই। তবু, কিছু অন্ধকার ছিল। সেই আন্ধারের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ধানমন্ডি লেকে যেতাম। কিন্তু গত বছর কয়েক আগে লেকে এমন কড়া বাতি লাগিয়েছে যে, মনে হয় চোখে কেউ আয়না ধরেছে। আয়না ধরা আলোর পথে হাঁটতে-হাঁটতে মনে বাজে ডিপজলের গান: ‘কী বাত্তি জ্বালাইলি ওরে ও মাইনক্যা’!

শহরের গাছগুলোর জন্য খারাপ লাগে। পার্কের গাছগুলোর সামনে অপরাধবোধ হয়। মানুষের হাতে তারা নিপীড়িত। তাদের ঘাড়ের উপর রাতভর জ্বালিয়ে রাখা হয় উৎকট আলো। তাদের পাতা মেলতে, ফুলের পাপড়ী মেলতে কষ্ট হয়।

স্বার্থপর মানুষ! নিজেরটা ষোলো আনা বোঝা ছাড়া সংসারের আর কোনো ধর্ম শেখেনি।

ঢাকা শহরে রাত নেই। চরাচরে রাত নেমে এলে এ শহরে যেনো শুরু হয় আরেকটা নতুন দিনের কোলাহল। বাতি জ্বলে ওঠে। শহুরে রোশানাইয়ে রাত হয় নির্বাসিত। কেবল ঢাকা শহর নয়। ভোগবাদী মানুষের গ্রহে সব বড় শহরের একই দশা।

নগরের কথাইবা শুধু বলি কোন মুখে! আমার বাড়ি তো মফস্বলে। সেই বাড়িতে কি আর আছে অমল অন্ধকার? প্রতিবেশীদের বাড়িতে প্রহরী হিসেবে জ্বলতে থাকে বিজলি বাতি। আমাদের বারান্দা ও উঠোনের বাতি বন্ধ করে গিয়ে উঠোনে দাঁড়াই। বাড়ি গেলে, ফিরে পেতে চাই সেই তারা ভরা রাত। রাতের আকাশ। আকাশের বুকে জমা অনেক কথা। কিন্তু সেখানেও আর নেই ঘন অন্ধকার।

মানুষের মিথে আলো মানে মুক্তি। মানুষের রূপকে অন্ধকার মানে বন্দীত্ব। অজ্ঞান মানে অন্ধকার। জ্ঞান মানে আলো। মানুষকে স্বর্গ থেকে আগুন এনে দিয়েছিলেন প্রমিথিউস।

মানুষেরা তাদের ঘরে জন্ম নেয়া শিশু মানুষদের বিভিন্ন পশুর নামে ভয় দেখায়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, একটা মা কুকুর তার বাচ্চাকে কী বলে ভয় দেখায়? সে কি বলে, 'বাবা মানুষের মতন হইয়ো না! ওরা সন্ত্রাসী! ওরা নিপীড়নকারী'।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, একটা দোলনচাপা গাছ তার শিশু দোলনচাপা গাছটাকে কী বলে ভয় দেখায়? সন্ধ্যা নামার মুখে ঘুম পাড়ানোর সময় মা দোলনচাপাটা কি শিশু দোলনচাপাকে বলে, 'ঘুমিয়ে যাও! নইলে এক্ষনি টর্চ লাইট হাতে নিয়ে মানুষ আসবে কিন্তু'!

আমাদের বাড়ির উঠোনের ঠিক মাঝ বরাবর থাকতো কৃত্তিকা। তখন অবশ্য এই নামের সাথে পরিচয় হয়নি। শুধু অবাক বিস্ময়ে দেখতাম, কয়েকটা তারা একসাথে জটলা পাকিয়ে আছে। যেনো তারা বেবুঝ মানবশিশু। গোল্লাছুট খেলবে বলে জড়ো হয়েছে মাঠে।

রাতের বেলায় উঠোনের কোণায় কোণায় বাঁশ ঝাড়ের পাতার ফাঁকে ঝোঁপে-ঝাড়ে জোনাক পোকা জ্বলত। আমরা সেই পোকা হাতে নিয়ে খেলতাম। জোনাকীর উদরে কেমন করে আলো জ্বলে তা দেখতে চেয়ে থাকতাম বোকা হয়ে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ জোনকীদের ভরে রাখতাম সাদা কাঁচের বৈয়ামের ভেতর।

আলোর অত্যাচারে শহুরে জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে অন্ধকার। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ বলার দিন আর নেই। এখন প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলি, লেট দেয়ার বি ডার্ক। রাতের বাদুড়টা ভালো থাকুক। রাতের পাখিটা ভালো থাকুক। গাছটা ভালো থাকুক। রাতে পাপড়ী মেলে দেবার সময় ভালো থাকুক গন্ধরাজ ফুল। আসুক আমার দুটি চোখের তারা ভরে নিকষ কালো আঁধার দেখার দিন।

১৮.০৪.২০

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৮:২০

রাফা বলেছেন: চমৎকার কাব্যিক ভাষায় চমৎকৃত হইলাম। এখন আর লেট দ্যায়ার বি লাইট নয়।শ্লোগানটা হোক লেট দ্যায়ার বি ডার্ক।

চলেন আফ্রিকার আমাজানে গিয়ে সত্যিকারের ঘুট ঘুটে অন্ধকারের খেলা দেখে আসি।

ধন্যবাদ,আ.সোমা।

১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:১৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: আমাজানে ক'টা দিন থাকতে পারলে কী একটা দারুন ব্যাপারই না হতো! অনেক ধন্যবাদ, রাফা। ভালো থাকবনে।

২| ১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:৫৪

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: আপনার লেখা ভালো লেগেছে।

১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:১৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, সাড়ে চুয়াত্তর। ভালো থাকবেন।

৩| ১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:১৮

নেওয়াজ আলি বলেছেন: ঘরে ঘরে থাকতে থাকতে এখন মন চায় গোল্লাছুট খেলতে

১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:১৮

আফরোজা সোমা বলেছেন: হুমমম... সেটাই...
ভালো থাকবেন।

৪| ১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:০১

রাজীব নুর বলেছেন: সহজ সরল ভাবে নিজের মনের কথা গুলো লিখে গেছেন।

আমি তো ঘুমাতে যাই ভোর চারটায়। ঘুম থেকে উঠি একটায়। কত দিন সকালের নাস্তা খাই না।

১৮ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:১৮

আফরোজা সোমা বলেছেন:
ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.