নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইসলাম,রাজনীতি

আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি।

আল-মুনতাজার

আমি মুয়াবিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত পরিত্যাগকারী রাসুলের(সাঃ) শিয়া।শিয়া মানে অনুসারী।আমি আল্লাহর অনুসারী,রাসুলের(সাঃ) অনুসারী।ডঃ তিজানী সামাভী বলেন,শিয়ারা রাসুলের(সাঃ) সুন্নত পালন করছে।

আল-মুনতাজার › বিস্তারিত পোস্টঃ

আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাহ ও তার কল্প কাহনিী

১৮ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:১৬

আগের লেখার লিঙ্কঃ

Click This Link

মালেক ইবনে নুওয়াইরাহ্র কাহিনী

মালেক ইবনে নুওয়াইরাহ্ ছিলেন বানু তামীমের ইয়ারবূ‘ উপগোত্রের লোক। তাঁর ডাকনাম ছিলো আবু হানযালাহ্ এবং উপাধি ছিলো জাফূল্।

নির্ভরযোগ্য সূত্রের বর্ণনায় মালেকের ঘটনা

র্মায্বানী বলেন ঃ তিনি ছিলেন উঁচু শ্রেণীর কবি। তিনি ইয়ারবূ‘ গোত্রের যোদ্ধাদের মধ্যে অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি জাহেলিয়্যাতের যুগে এ গোত্রের একজন শীর্ষস্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হতেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁকে সেখানকার কর আদায়ের দায়িত্ব প্রদান করেন। কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ইন্তেকাল করলে তিনি তাঁর নিকট জমা হওয়া করের অর্থ সমকালীন সরকারকে প্রদানে অস্বীকৃতি জানান এবং তা স্বীয় লোকজনদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন ঃ

“বললাম ঃ তোমাদের সম্পদ নিয়ে নাও ভয়-উদ্বেগ ছাড়া

কারণ এর এমন কোনো তদারককারী নেই যে আসবে কাল

অতঃপর এ বিপর্যস্ত দ্বীনের জন্যে কোন অভ্যুত্থানকারী উত্থিত হলে১

তার আনুগত্য করবো ও বলবো ঃ দ্বীন তো মুহাম্মাদের (সাঃ) দ্বীন।”

ত্বাবারী২ আবদুর রহমান বিন্ আবু বকরের সূত্রে বর্ণনা করেন ঃ খালেদ বাত্বাহ্ ভূখণ্ডে উপনীত হবার পর একদল সৈন্য সহ Ñ আবু ক্বাতাদাহ্৩ ছিলেন যাদের অন্যতম Ñ যেরার বিন্ আল্-আয্ওয়ারকে পাঠালেন। তারা রাতের বেলা মালেকের গোত্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরবর্তী কালে আবু ক্বাতাদাহ্ বলতেন ঃ “আমাদের সৈন্যরা যখন রাতের বেলা তাদেরকে ঘিরে ফেললো তখন তা মালেকের গোত্রকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে এবং তারা অস্ত্র ধারণ করে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলো।”

আবু ক্বাতাদাহ্ বলেন ঃ আমরা বললাম ঃ “আমরা মুসলমান।” তারা বললো ঃ “আমরাও মুসলমান।” বাহিনীর সেনাপতি বললেন ঃ “তাহলে তোমরা যুদ্ধাস্ত্র ধারণ করেছো কেন?” তারা বললো ঃ “তোমরা কেন যুদ্ধাস্ত্র ধারণ করেছো?” আমরা বললাম ঃ “তোমরা যদি সত্য বলে থাকো যে, তোমরা মুসলমান তাহলে তোমরা তোমাদের অস্ত্র যমিনে রাখো।”

আবু ক্বাতাদাহ্ বলেন ঃ তখন তারা তাদের অস্ত্র যমিনে রাখলো। অতঃপর আমরা নামায আদায় করলাম এবং তারাও নামায আদায় করলো।

এ ব্যাপারে ইবনে আবিল হাদীদ বলেন ঃ তারা অস্ত্র রাখার সাথে সাথে তাদেরকে বন্দী করা হলো এবং রশি দিয়ে বেঁধে খালেদের কাছে নিয়ে এলো।

কানযুল্ ‘উম্মাল্৪ ও তারীখে ইয়াকুবী৫তে এ ঘটনাটি এভাবে উল্লিখিত হয়েছে ঃ

মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ আলোচনার জন্যে খালেদের নিকটে এলেন। তাঁর স্ত্রীও তাঁর পিছন পিছন এলেন। উক্ত মহিলার প্রতি খালেদের দৃষ্টি পড়লে তিনি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং (নুওয়াইরাহ্কে) বলেন ঃ “আল্লাহ্র শপথ, তুমি আর তোমার গোত্রের কাছে ফিরে যেতে পারবে না; তোমাকে হত্যা করবো।”

কান্যুল্ ‘উম্মাল্-এ আরো বলা হয়েছে৬ ঃ খালেদ বিন্ ওয়ালীদ্ দাবী করেন যে, মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ মুরতাদ হয়ে গেছেন। এ দাবীর সপক্ষে তাঁর দলীল ছিলো তাঁর কানে পৌঁছা মালেকের কথা। মালেক এ দাবী প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন ঃ “আমি আগের মতোই মুসলমান আছি এবং স্বীয় দ্বীনকে পরিবর্তন করি নি বা তাতে কোনো পরিবর্তন আনি নি।” আবু ক্বাতাদাহ্ ও আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমরও তাঁর কথার সত্যতার সাক্ষ্য দেন। কিন্তু খালেদ মালেককে তাঁর নিজের দিকে টেনে নেন এবং যেরার বিন্ আযওয়ারকে তার শিরচ্ছেদের জন্যে আদেশ দেন এবং যেরার মালেকের শিরচ্ছেদ করেন। এরপর খালেদ মালেকের স্ত্রী উম্মে তামীমকে নিজের কাছে নিয়ে নেন এবং শয্যসঙ্গিনী করেন।

তারীখে আবূল ফিদায় বলা হয়েছে৭ ঃ আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর ও আবু ক্বাতাদাহ্ আনছারী উভয়ই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন এবং মালেক সম্পর্কে খালেদের সাথে কথা বলেন। কিন্তু খালেদ তাঁদের কথায় অসন্তুষ্ট হন। মালেক বলেন ঃ “খালেদ! তুমি আমাকে আবু বকরের নিকট পাঠাও যাতে তিনি নিজে আমার ব্যাপারে ফয়সালা করেন।” জবাবে খালেদ বলেন ঃ “আমি যদি তোমাকে রেহাই দেই তাহলে আল্লাহ্ আমাকে রেহাই দেবেন না।” এরপর তিনি যেরার বিন্ আল্-আয্ওয়ারের দিকে ফিরে বললেন ঃ “মালেকের শিরচ্ছেদ করো।” তখন মালেক দুঃখিতভাবে তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন এবং এরপর খালেদের দিকে ফিরে বললেন ঃ “এই নারী আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো, আর সে একজন পরমা সুন্দরী নারী।” খালেদ বললেন ঃ “বরং আল্লাহ্ তোমাকে হত্যা করেছেন। কারণ, তুমি ইসলাম থেকে ফিরে গিয়েছো।” মালেক বললেন ঃ “আমি মুসলমান এবং ইসলামের অনুসারী।” খালেদ বললেন ঃ “যেরার! ওর শিরচ্ছেদ করো।” তখন সে মালেকের শিরচ্ছেদ করলো।৮

আল-ইছাবাহ্ গ্রন্থে৯ ছাবেত বিন্ ক্বাসেম থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, “আদ্-দালায়েল্” গ্রন্থে বলা হয়েছে ঃ মালেকের স্ত্রীর দিকে খালেদের চোখ পড়ে, আর সে ছিলো সমকালীন নারীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী। মালেক তাঁর স্ত্রীকে বললেন ঃ “তুমি আমাকে হত্যা করলে।” এর মানে ছিলো এই যে, আমি তোমার কারণে নিহত হতে যাচ্ছি।

এছাড়া ইছাবাহ্ গ্রন্থে যুবাইর বিন্ বাক্কার থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং যুবাইর ইবনে শিহাব থেকে বর্ণনা করেন ঃ মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ যখন নিহত হন তখন তাঁর মাথায় প্রচুর চুল ছিলো। খালেদ মালেকের কর্তিথ শির পাতিলের নীচে রাখার আদেশ দিলেন এবং তারা (তাঁর অধীনস্থ সৈন্যরা) তা-ই করলো। তাঁর চুল পুড়ে শেষ হয়ে আগুন তাঁর মাথার চামড়ায় পৌঁছার আগেই পাতিলের খাবার রান্না হয়ে গেলো।১০

খালেদ সেদিন রাতেই মালেকের স্ত্রী উম্মে তামীম বিন্তে মিন্হালের সাথে শয্যা গ্রহণ করেন।১১

এ ব্যাপারে আবু নুমাইর সা‘দী তাঁর কবিতায় বলেন ঃ

“বলো সেই অশ্বারোহী বাহিনীকে যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তোমার ’পরে

মালেকের পরে এ রজনী সীমাহীন দীর্ঘ হয়ে গেছে

খালেদ পাপের ফয়সালা করেছে তার বিরুদ্ধে তার স্ত্রীর কারণে

আর তার প্রতি এর আগেই তো তার লালসার দৃষ্টি পড়েছিলো

আর খালেদের প্রবৃত্তি তাকে বানিয়েছে চরম নিষ্ঠুর

ঐ নারীর তরে তার প্রবৃত্তি বিদ্রোহী; পারে নি তাকে লাগাম পরাতে

প্রভাতে সে হলো তার স্ত্রীর অধিকারী যবে মালেকের ভোর হলো

তার স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিহত অবস্থায় তোমার প্রবৃত্তির কারণে।”

আল্-ইছাবাহ্ গ্রন্থে১২ বলা হয়েছে যে, খালেদ মালেককে হত্যা করলে মেনহাল্ তাঁর মাথা বিহীন ধরকে একটি জামা দিয়ে কাফন পরিয়ে দেন।

এই হলো মালেকের পরিণতি। এখন দেখা দরকার সমকালীন সরকার খালেদকে এ কাজের জন্যে কী পুরস্কার প্রদান করে।

তারীখে ইয়াকুবীতে বলা হয়েছে ঃ আবু ক্বাতাদাহ্ আবু বকরের নিকট গিয়ে এ ঘটনা জানান এবং বলেন ঃ “আল্লাহ্র কসম, আমি আর কখনোই খালেদের পতাকার নীচে ও তার অধিনায়কত্বে কোথাও যাবো না। কারণ, সে মালেককে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও হত্যা করেছে।”

আর ত্বাবারী ইবনে আবু বকর থেকে বর্ণনা করেন ঃ “যারা মালেকের মুসলমান হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন তাঁদের মধ্যে আবু ক্বাতাদাহ্ অন্যতম। তিনি স্বীয় রবের সাথে অঙ্গীকার করেন যে, আর কখনোই খালেদের অধিনায়কত্বে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে যাবেন না।”

তারীখে ইয়াকুবীতে বলা হয়েছে ঃ ওমর বিন্ খাত্তাব আবু বকরকে বলেন ঃ “হে রাসূলুল্লাহ্র খলীফাহ্! নিঃসন্দেহে খালেদ একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে এবং সেদিনই তার স্ত্রীর সাথে শয্যা গ্রহণ করেছে।” তখন আবু বকর খালেদকে পত্র লিখেন এবং খালেদকে তাঁর নিকট ডেকে পাঠান। খালেদ বলে ঃ “হে রাসূলুল্লাহ্র খলীফাহ্! আমি মালেককে হত্যার ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণা করে পদক্ষেপ নিয়েছি এবং তাতে সদুদ্দেশ্যই ছিলো, কিন্তু তাতে ভুল হয়ে গিয়েছে।”

ইয়াকুবী আরো বলেন ঃ সে যুগের অন্যতম কবি মুতাম্মিম বিন্ নুওয়াইরাহ্ তাঁর ভাইয়ের স্মরণে অনেক শোক কবিতা লিখেন এবং শোক প্রকাশের অনুষ্ঠান করেন। তিনি মদীনায় এসে আবু বকরের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর পিছনে ফজরের নামায আদায় করেন। আবু বকর নামায শেষ করলে মুতাম্মিম তাঁর জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ান এবং তাঁর ধনুকে ভর দিয়ে এ কবিতাটি পাঠ করেন ঃ

“কেমন উত্তম ব্যক্তিকে নিহত করলে যবে প্রভাতের বায়ু

বাড়ীঘরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো, হে ইবনুল আয্ওয়ার!

তাকে আল্লাহ্র নামে আহ্বান করলে তারপর করলে বিশ্বাসঘাতকতা

সে তোমাকে তাঁর নামে ডাকলে বিশ্বাসঘাতকতা করতো না কভু।”

তারীখে আবূল ফিদায় বলা হয়েছে ঃ এ খবর আবু বকর ও ওমরের নিকট পৌঁছলে ওমর আবু বকরকে বললেন ঃ “নিঃসন্দেহে খালেদ যিনা করেছে; আপনার উচিৎ তাকে সঙ্গে সার করা।” আবু বকর বললেন ঃ “আমি তাকে সঙ্গে সার করবো না। কারণ, সে নিজের জন্যে কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। তবে মনে হচ্ছে, সে তার করণীয় নির্ধারণে ভুল করেছে।” ওমর বললেন ঃ “সে একজন হত্যাকারী এবং একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে। তাই কিছাছ হিসেবে তাকে হত্যা করুন।” জবাবে আবু বকর বললেন ঃ “আমি কখনোই তাকে হত্যা করবো না। কারণ, আমি এইমাত্র যেমন বললাম, সে তার কর্তব্য নির্ধারণে ভুল করেছে।” ওমর বললেন ঃ “অন্ততঃ তাকে পদচ্যুত করুন।” আবু বকর বললেন ঃ “আল্লাহ্ তাদের ওপর যে তরবারী কোষমুক্ত করেছেন আমি কখনোই সে তরবারীকে কোষবদ্ধ করবো না।”

ত্বাবারী ইবনে আবু বকর থেকে বর্ণনা করেছেন ঃ মালেককে হত্যার ব্যাপারে খলেদের ছাফাই ছিলো এই যে, মালেক যখন আমার নিকট আসে তখন তার কথার মধ্যে এ রকম বলেছিলো ঃ “আমি মনে করি না যে, তোমাদের বন্ধু Ñ রাসূলুল্লাহ্ Ñ এরূপ ও ঐরূপ ব্যতীত কিছু বলে থাকবেন।” খালেদ বলে ঃ “তুমি কি তাঁকে তোমার বন্ধু বলে মনে করো না যে, বলছো “তোমাদের বন্ধু”?” অতঃপর সে মালেককে কাছে টেনে নেয় এবং তার শিরচ্ছেদ করে, এছাড়া তার সঙ্গীসাথীদেরও শিরচ্ছেদ করে। মালেক ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিহত হওয়ার খবর এসে পৌঁছলে ওমর এ ব্যাপারে আবু বকরের সাথে অনেক আলোচনা করেন এবং বলেন ঃ “আল্লাহ্র দুশমন এই লোকটি মুসলমানের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন মূলক হস্ত প্রসারিত করেছে এবং তাকে হত্যা করেছে। অতঃপর সাথে সাথেই পশুর ন্যায় তার স্ত্রীর ওপর চড়াও হয়েছে।”

খালেদ সফর থেকে ফিরে আসেন ও মসজিদে গমন করেন। তখন তাঁর গায়ে একটি আলখেল্লা ছিলো যাতে লোহার মরিচা লেগে ছিলো। তাঁর মাথায় পাগড়ী জড়ানো ছিলো এবং ইসলামী সৈনিকের নিদর্শন স্বরূপ তাতে কয়েকটি তীর গাঁথা ছিলো। খালেদ মসজিদে প্রবেশ করলে ওমর রাগের কারণে তাঁর স্থান থেকে দাঁড়িয়ে যান এবং খালেদের পাগড়ীর মধ্য থেকে তীরগুলো টেনে বের করে ভেঙ্গে ফেলেন। এরপর তিনি খালেদকে তিরস্কার করেন এবং বলেন ঃ “তুমি রিয়াকারিতা ও মুনাফেকীর আশ্রয় নিয়ে একজন মুসলমানকে হত্যা করেছো এবং এতেই সন্তুষ্ট না থেকে পশুর ন্যায় তার স্ত্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছো। আল্লাহ্র কসম, তোমাকে সঙ্গে সার করবো; এটাই তোমার উপযুক্ত শাস্তি।” খালেদ একইভাবে নীরব থাকেন। যেহেতু মনে করেছিলেন যে, ওমরের মতো আবু বকরও তাঁকে অপরাধী গণ্য করবেন সেহেতু ওমরের কথার কোনো জবাব দিলেন না। এরপর তিনি আবু বকরের কাছে এসে স্বীয় অভিযানের ফলাফল জানালেন এবং স্বীয় কাজের সপক্ষে ছাফাই গাইলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে আবু বকর তাঁর কৈফিয়ত গ্রহণ করলেন এবং তাঁর এ অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।

বর্ণনাকারী বলেন ঃ খালেদ আবু বকরের সন্তুষ্টি হাসিলে সক্ষম হবার পর পরই তাঁর নিকট থেকে বাইরে চলে গেলেন। ওমর তখনো মসজিদে বসে ছিলেন। খালেদ হুঙ্কার দিয়ে ওমরকে বললেন ঃ “ওহে উম্মে শাম্লাহ্র বেটা! এখন যদি তোমার কোনো কথা থাকে তো বলতে পারো।” ওমর তাঁর দূরদৃষ্টির কারণে বুঝতে পারলেন যে, আবু বকর খালেদের ওপর সন্তুষ্ট আছেন। এ কারণে তিনি খালেদের সাথে কোনো কথা বললেন না, বরং নিজের বাড়ীর দিকে চলে গেলেন।

সংক্ষেপে এই হলো খালেদ ও মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্র ঘটনা যা নির্ভরযোগ্য সকল ইতিহাস গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু সাইফ এ কাহিনী অন্যভাবে বর্ণনা করেছে।

সাইফের বর্ণনা অনুযায়ী মালেকের ঘটনা

সাইফ মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্র ঘটনা সম্পর্কে সাতটি রেওয়াইয়াত পেশ করেছে এবং তাতে তাঁকে মুরতাদ হিসেবে অভিহিত করেছে। এ রেওয়াইয়াতগুলো নিম্নরূপ ঃ

১) ত্বাবারী বানী তামীম ও সাজাহ্ সম্পর্কিত ঘটনাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে সাইফ থেকে উদ্ধৃত করেন ঃ

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিয়োজিত কর্মচারীরা বানূ তামীমে যাকাত সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইন্তেকাল করায় যাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারীদের মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয় এবং মারাত্মক ধরনের দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়। তাদের মধ্য থেকে এক দল তাঁদের আদায়কৃত সব কিছু আবু বকরকে দিলেন। কিন্তু অপর দল তা প্রদানের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন এবং করণীয় সুস্পষ্ট হওয়ার অপেক্ষায় তাঁরা তা (আদায়কৃত যাকাত) আবু বকরকে প্রদানে বিরত থাকেন। মালেক বিন নুওয়াইরাহ্ ছিলেন সেই লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা আবু বকরকে যাকাত প্রদানের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন এবং এ কারণে তাঁকে যাকাত প্রদানে বিরত থাকেন ও পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।

এ সময় বানূ তামীমের ভূখণ্ড ও সেখানকার অধিবাসীরা এ মতদ্বৈধতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। যারা এভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলো মুসলমানরা তাদের মোকাবিলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সহসা সাজাহ্র আবির্ভাব ঘটে যে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর পর নবুওয়াত দাবী করে। সে, তার গোত্রের কিছু লোক এবং বিভিন্ন আরব গোত্রের আরো কিছু লোক আবু বকরের বিরুদ্ধে হামলা চালানো ও যুদ্ধ করার লক্ষ্যে মাথা তুলে দাঁড়ায়।

সাজাহ্ মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্কে একটি পত্র লিখে। মালেকও তার প্রস্তাব মেনে নেয় এবং ওয়াকী‘ ও সাজাহ্র সাথে মিলে তিন সদস্যের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এ সংগঠনের আওতায় তারা একটি অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করে যাতে তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে পরস্পরের সাথে সহযোগিতার ধারাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

২) বাহ্রাইনের লোকদের মুরতাদ হওয়া ও তাদের উদ্দেশে ‘আলা’ বিন্ হায্রামীকে পাঠানোর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সাইফ বলে ঃ ‘আলা’ বিন্ হায্রামী তাদের উদ্দেশে রওয়ানা হবার পর ইয়ামামাহ্ পৌঁছলে, তাদের (বাহ্রাইনের লোকদের) মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয় এবং তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়। অতঃপর তাদের একটি অংশ ‘আলা’র সাথে যোগদান করে। বর্ণনাকারী থেকে সাইফ বর্ণনা করেছে যে, তিনি (‘আলা’) বলেন ঃ মালেক ও তার সমর্থকরা বুত্বাহ্-য় ছিলো। আর সে আমাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে এবং আমরা তার সাথে তর্ক-বিতর্ক করি।

৩) এ প্রসঙ্গে সাইফ আরো বলে ঃ সাজাহ্ জাযিরায় ফিরে গেলে মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ অনুতপ্ত হয় এবং স্বীয় কর্মের জঘন্যতা সম্বন্ধে সচেতন হয়। তাই সে তার কৃতকর্মের কথা চিন্তা করে দিশাহারা হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ওয়াকী‘ ও সামা‘আহ্ স্বীয় কৃতকর্মের স্বরূপ বুঝতে পারে এবং পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে স্বীয় সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে ও কোনো রূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই স্বীয় বকেয়া যাকাত প্রদান করে, আর খালেদকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে ছুটে যায় ও তাঁর সাথে যুক্ত হয়। বানী হানযালাহ্র ভূখণ্ডে একমাত্র অস্বস্তিকর যা ছিলো তা হচ্ছে মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ ও তাকে ঘিরে থাকা লোকজন; সে আগের মতোই দিশাহারা অবস্থায় ছিলো এবং কখনো ভালো আচরণ করছিলো এবং কখনো মন্দ আচরণ করছিলো।

৪) এরপর সাইফ বলে ঃ খালেদ বানূ আসাদ ও বানূ গাত্ফানের এলাকাকে মুরতাদমুক্ত করার পর বুত্বাহ্র উদ্দেশে রওয়ানা হন। মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ সেখানে ছিলো এবং সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলো। আনছাররা খালেদের কাজে এবং বুত্বাহ্ অভিমুখে তাঁর অভিযাত্রার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, এ কারণে তাঁরা তাঁর সঙ্গী হওয়া থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা বললেন ঃ “খলীফাহ্ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, বাযাখার যুদ্ধ শেষ হলে আমরা যেন আমাদের কাছে খলীফাহ্র পত্র এসে না পৌঁছা পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করি।” খালেদ বললেন ঃ “সেনাপতি আমি এবং ফরমান আমার নিকটই পৌঁছে। এখন মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ আমাদের সামনে আছে; আমি নিজে এবং যারা আমার সঙ্গী হয়েছে (কতক মুহাজির ও তাবে‘ঈন) আমরা তার দিকে এগিয়ে যেতে চাই। এছাড়া আমি তোমাদের কাউকেই আমার সাথে যেতে বাধ্য করবো না।” তিনি এ কথা বললেন ও যাত্রা করলেন। খালেদের রওয়ানা হয়ে যাবার পর আনছাররা অনুতপ্ত হলেন এবং তিনি যেদিকে রওয়ানা হয়েছিলেন তাঁরাও সেদিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন ও তাঁর সাথে এসে যুক্ত হলেন। খালেদ একইভাবে এগিয়ে চললেন এবং বুত্বাহ্-য় উপনীত হলেন, কিন্তু তিনি সেখানে কাউকে পেলেন না।

৫) ত্বাবারী সাইফ থেকে এরপর বর্ণনা করেন ঃ

খালেদ বিন্ ওয়ালীদ বুত্বাহ্ পৌঁছার পর সেখানে কাউকে পেলেন না এবং দেখলেন যে, মালেক স্বীয় কৃতকর্মের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগার কারণে স্বীয় গোত্রকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে। মালেক স্বীয় জমায়েতকে (সৈনদেরকে) ভেঙ্গে দেয় ও তাদেরকে বলে ঃ “হে বানী ইর্য়াবূ‘র লোকেরা! তোমরা জানো যে, শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ ও সেনাপতিগণ আমাদেরকে দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তখন শুধু আমরা নিজেরাই তাঁদের ফরমান অমান্য করি নি, বরং তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছি এবং অন্যদেরকে খুব শীঘ্র তাঁদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হতে দেই নি। কিন্তু এ সংগ্রামে আমরা পরাজিত হয়েছি; জয়লাভ করতে পারি নি। আমি এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে যে উপসংহারে উপনীত হয়েছি তা হচ্ছে, তোমাদেরকে বলবো যে, সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়াই এ ব্যাপারটি এগিয়ে যাচ্ছে। অতএব, কালের প্রবাহ যে লোকদের অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছে তোমরা যাতে তাদের সাথে শত্র“তায় জড়িয়ে না পড়ো, সেহেতু তোমাদের নিজেদের ভূখণ্ডে ফিরে যাও এবং কোনো রূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই ফিরে যাও।” তার এ ভাষণের পর লোকেরা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো এবং স্বয়ং মালেকও তার বাড়ীতে ফিরে এলো।

খালেদ বুত্বাহ্ পৌঁছার পর ইসলামের প্রচারের জন্যে স্বীয় লোকজনকে আশেপাশে পাঠালেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, যে ব্যক্তিই তাঁদের দাওয়াত গ্রহণ না করবে তাঁরা যেন তাকে বন্দী করে তাঁর নিকট নিয়ে আসেন। আর কেউ যদি আসতে প্রস্তুত না হয় তাহলে যেন তাকে হত্যা করেন। আর আবু বকর খালেদকে যে সব ফরমান দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলো এই ঃ “তোমরা যে কোনো মনযিলে উপনীত হবে সেখানেই আযান দেবে। সেখানকার লোকেরাও যদি আযান ও ইক্বামাহ্ বলে তাহলে তাদের ওপর চড়াও হয়ো না। আর তারা যদি তা না করে তাহলে তোমাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে তাদের ওপর সহসা ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া হলো যে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই তোমরা তাদেরকে হত্যা করবে, এমন কি প্রয়োজন হলে আগুনে পুড়িয়ে বা অন্য যে কোনো পন্থায়। আর তারা যদি তোমাদের দেয়া ইসলামের দাওয়াত কবুল করে তাহলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরীক্ষা করো। জিজ্ঞাসাক্ষাদে তারা যদি যাকাত প্রদানে সম্মতি প্রকাশ করে তাহলে তাদের ইসলামকে গ্রহণ করে নাও। আর তারা যদি যাকাত প্রদানের কথা স্বীকার না করে তাহলে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই হচ্ছে তাদের একমাত্র শাস্তি।”

খালেদের সৈন্যরা ফিরে এলো এবং মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্কে তার গোত্রের কিছু লোক ও তার চাচাতো ভাইদের সহ খালেদের নিকট নিয়ে এলো। সৈন্যদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলো; আবু ক্বাতাদাহ্ সহ কয়েক জন সাক্ষ্য দিলেন যে, মালেক ও তার সঙ্গীসাথীরা আযান ও ইক্বামাহ্ বলেছে ও নামায আদায় করেছে। এ মতপার্থক্য দেখা দিলে খালেদ মালেক ও তার সঙ্গী-সাথীদেরকে কারারুদ্ধ করার জন্যে আদেশ দিলেন। ঘটনাক্রমে তখন রাত ছিলো খুবই ঠাণ্ডা এবং কারো পক্ষে সে ঠাণ্ডার মোকাবিলায় টিকে থাকা সম্ভব ছিলো না। আর রাত যত গভীর হচ্ছিলো ঠাণ্ডাও ততই তীব্রতর হচ্ছিলো। তখন খালেদ এই বলে আদেশ দিলেন যে, “তোমরা তোমাদের বন্দীদেরকে গরম করো।” তিনি এ জন্যে যে বাক্য ব্যহার করেন তা হচ্ছে ঃ ادفئوا اسراکم Ñ যাতে ব্যবহৃত ادفئوا শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে “তোমরা গরম করো” এবং আরেকটি ইঙ্গিত বাচক অর্থ হচ্ছে “তোমরা হতা করো”। সৈন্যরা এ আদেশ শোনার পর ধারণা করে যে, খালেদ বন্দীদেরকে হত্যা করার জন্যে আদেশ দিয়েছেন। তাই তারা বন্দীদেরকে হত্যা করে। আর মালেকের হত্যাকারী ছিলেন যেরার বিন্ আয্ওয়ার। আর্তনাদ ও চীৎকার কানে গেলে খালেদ তাঁর ঘর থেকে বের হলেন। তিনি দেখলেন যে, যা হবার তা হয়ে গেছে। তিনি বললেন ঃ “আল্লাহ্ যখন কোনো কাজ সম্পাদনের ইচ্ছা করেন তখন তিনি তা সম্পাদন করেন।”

ঘটনা সংঘটিত হয়ে যাবার পর খালেদের সাথের লোকেরা নিহতদের ব্যাপারে আলোচনা ও বিতর্কে লিপ্ত হলেন। আবু ক্বাতাদাহ্ খালেদের দিকে ফিরে বললেন ঃ “এটা তোমারই কাজ।” তখন খালেদ তাঁকে ধমক দেন। তাই আবু ক্বাতাদাহ্ ক্রুদ্ধভাবে বেরিয়ে পড়লেন এবং (মদীনায় এসে) আবু বকরের নিকট গেলেন। কিন্তু আবু বকর আবু ক্বাতাদাহ্র ওপর ক্রুদ্ধ হলেন, তবে ওমর তাঁদের মধ্যে মধ্যস্থতা করলেন। কিন্তু আবু বকর তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হলেন না যতক্ষণ না তিনি খালেদের নিকট ফিরে গেলেন। তিনি ফিরে গেলেন এবং খালেদের সাথে মদীনায় ফিরে এলেন। আর খালেদ মালেকের স্ত্রী উম্মে তামীম বিন্তে মেনহাল্কে বিবাহ করেন, তবে ইদ্দত পূর্ণ হবার আগে তিনি তার সাথে শয্যাগ্রহণ করেন নি।

ওমর আবু বকরকে বললেন যে, খালেদের তরবারীতে বিদ্রোহ আছে এবং সর্বত্র যাতে তিনি এরূপ না করেন এ উদ্দেশ্যে তাঁকে মালেক হত্যার দায়ে কিছাছ করা প্রয়োজন। তিনি এজন্য খুবই পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু আবু বকর তাঁর কোন কর্মচারী ও দায়িত্বশীলের বিরুদ্ধেই কিছাছের বিধান কার্যকর করতেন না। তাই তিনি বললেন ঃ “থামো তো ওমর! খালেদ তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী চিন্তা-ভাবনা করে এ কাজ করেছে। অতএব, এ ব্যাপারে আর কথা বলো না।” অতঃপর আবু বকর মালেকের রক্তমূল্য প্রদান করেন এবং খালেদকে পত্র লিখে ডাকিয়ে আনেন।

খালেদ মদীনায় আসার পর আবু বকরের নিকট ঘটনা খুলে বলেন। আবু বকর খালেদের কৈফিয়ত গ্রহণ করলেন, তবে তিনি যেভাবে বিবাহ করেছেন তা আরবদের দৃষ্টিতে দোষের ছিলো বিধায় এজন্য তিনি খালেদকে তিরস্কার করেন।

৬) সাইফ তার বর্ণিত অপর এক রেওয়াইয়াতে এ ব্যাপারে বলে ঃ খালেদের একদল সৈনিক সাক্ষ্য দেন যে, আমরা আযান দিয়ে ও ইক্বামাহ্ বলে নামায আদায় করি; মালেকও তা-ই করলো। কিন্তু অপর কতক সৈনিক সাক্ষ্য দেন যে, এ ধরনের কোনো ব্যাপারই ছিলো না; এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

মালেকের ভাই মুতাম্মিম বিন্ নুওয়াইরাহ্ এলো এবং কবিতা পড়ে মালেকের রক্তের প্রতিদান দাবী করলো ও বন্দীদের মুক্তি দাবী করলো। তখন আবু বকর পত্র লিখে পাঠালেন যাতে বন্দীদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। ওমর খালেদকে পদচ্যুত করার জন্যে আবু বকরকে খুবই পীড়াপীড়ি করেন। তিনি বলেন যে, তার (খালেদের) তলোয়ারে বিদ্রোহ আছে (তাই তার আর তলোয়ার হাতে নেয়ার অধিকার নেই এবং তার হাতে আর সেনাপতিত্বের এখতিয়ার রাখা ঠিক নয়)। জবাবে আবু বকর বললেন ঃ “না, ওমর! আল্লাহ্ যে তরবারীকে কাফের হত্যার জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন আমি কখনোই তাকে কোষবদ্ধ করবো না।”

৭) সাইফ তার সর্বশেষ রেওয়াইয়াতে বলে ঃ মালেকের চুলের পরিমাণ ছিলো অনেক বেশী। সৈন্যরা যখন নিহতদের মাথাগুলোকে (জ্বলন্ত চুলায়) পাতিলের নীচে দিলো তখন এমন কোনো মাথা ছিলো না আগুন যার চামড়ায় পৌঁছে নি, কেবল মালেকের মাথা ছাড়া। খাবার রান্না হয়ে গেলো এবং তা পরিবেশনের উপযোগী হয়ে গেলো, কিন্তু চুলের কারণে তখনো মালেকের মাথা পোড়ে নি।

মুতাম্মেম মালেকের প্রশংসা করে যে কবিতা রচনা করে তাতে তার পেটের অ-স্থূলতার Ñ যা বীর যোদ্ধাদের গৌরবের নিদর্শন রূপে পরিগণিত হতো Ñ প্রশংসা করে। ওমর এর আগে দেখেছিলেন যে, মালেক কীভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট এসেছিলো। এ কারণে তিনি বললেন ঃ “এমনটিই ছিলো, মুতাম্মেম?” মুতাম্মেম বললো ঃ “আমার দৃষ্টিতে তা-ই।”

এই হলো মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্র ঘটনা সম্বন্ধে সাইফের বর্ণনা।

সাইফের রেওয়াইয়াতের উৎস

সাইফ বিন্ ওমর তার বর্ণিত উপরোক্ত প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় রেওয়াইয়াত, তার দাবী অনুযায়ী ছা‘ব্ বিন্ ‘আত্বিয়াহ্ থেকে বর্ণনা করেছে। তার দাবী অনুযায়ী ছা‘ব্ তা তাঁর পিতা ‘আত্বিয়াহ্ বিন্ বিলাল থেকে বর্ণনা করেছেন। আর তার দাবী অনুযায়ী, সে পঞ্চম ও সপ্তম রেওয়াইয়াত দু’টি ওসমান্ বিন্ সুওয়াইদ্ বিন্ মাছ্‘আবাহ্ থেকে বর্ণনা করেছে।

‘আত্বিয়াহ্ ও ছা‘ব্ Ñ এই দুই পিতা ও পুত্র সম্বন্ধে এবং ওসমান বিন্ সুওয়াইদ্ সম্বন্ধে ‘ইল্মে রিজালের গ্রন্থাবলীতে যথেষ্ট অনুসন্ধান করেছি, কিন্তু এ ধরনের কোনো গ্রন্থেই ‘আত্বিয়াহ্ ও ছা‘ব্-এর কোনো নাম-নিশানা খুঁজে পাই নি। অন্যদিকে ইসলামের ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থাবলীতে সুওয়াইদ বিন্ মাছ্‘আবাহ্র কথা উল্লেখ থাকলেও তাঁর ওসমান নামে কোনো পুত্রসন্তান ছিলো বলে উল্লেখ নেই। অতএব, ‘ইলমে রিজালের বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বর্ণনাকারী নিছক কল্পিত চরিত্র Ñ বাস্তবে যাদের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না।

বস্তুতঃ সাইফ বিন্ ওমর বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তির জন্যে বহু কল্পিত সন্তান তৈরী করে তাদেরকে স্বীয় কল্পকাহিনীর বর্ণনারকারী হিসেবে উল্লেখ করেছে। যেমন ঃ সে হাওয়াবের কুকুরদের কাহিনীতে উম্মে র্ক্বিফাহ্র উম্মে যামাল্ নামে একটি কন্যা সন্তান কল্পনা করেছে। তেমনি সে র্হোমোযানের জন্যে কুম্মায্বান্ নামে একটি পুত্র সন্তান বানিয়েছে। এভাবে সে দেড়শ’ জন কল্পিত ছাহাবী তৈরী করেছে যাদের সম্পর্কে অন্য কোনো সূত্রেই Ñ কোনো গ্রন্থেই উল্লেখ নেই এবং যাদের কাল্পনিকতা আমরা এতদসংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছি।

সাইফের রেওয়াইয়াত কল্পকাহিনী কেন?

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আমরা কোন্ দলীলের ভিত্তিতে সাইফের রেওয়াইয়াত সমূহকে কল্পকাহিনী বলছি?

এ প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে, হাদীছ শাস্ত্রের মনীষীদের দৃষ্টিতে হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে ঃ

প্রথম স্তরে রয়েছেন তাঁরা যারা কোনো মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তাঁদেরকে ছাহাবী বলা হয়।

দ্বিতীয় স্তরে রয়েছেন ঐ সব বর্ণনাকারী যারা সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)কে দেখেন নি, তবে তাঁর ছাহাবীদের মধ্য থেকে অন্ততঃ একজনের হলেও সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তাঁদেরকে তাবে‘ঈ বলা হয় (যার বহু বচন তাবে‘ঈন্)। যে সব তাবে‘ঈ অন্ততঃ দশজন ছাহাবীর নিকট থেকে রেওয়াইয়াত করেছেন তাঁদেরকে “বুযুর্গানে তাবে‘ঈন্” বলা হয়।

তৃতীয় স্তরে রয়েছেন ঐ সব তাবে‘ঈ যারা খুব কম সংখ্যক (দশের কম সংখ্যক) ছাহাবীর নিকট থেকে রেওয়াইয়াত করেছেন। এদের যুগ উমাইয়াহ্ খলীফাহ্ ওয়ালীদের শাসনামলে হিজরী ১২৬ সালে সমাপ্ত হয়।

চতুর্থ স্তরে রয়েছেন সর্বশেষ তাবে‘ঈগণ এবং তাঁদের সমসাময়িক বর্ণনাকারীগণ। এ স্তরের বর্ণনাকারীগণ সাধারণতঃ প্রথম স্তরের তাবে‘ঈগণ থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো কোনো ছাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন। এদের যুগ বানী উমাইয়্যাহ্র খেলাফতের শেষ অর্থাৎ হিজরী ১৩২ সাল পর্যন্ত।

পঞ্চম স্তরে রয়েছেন সেই সব ছাহাবী যারা চতুর্থ স্তরের বর্ণনাকারীদের পরে বেঁচে ছিলেন। আব্বাসী খলীফাহ্ মানছূরের শেষ সময় পর্যন্ত এদের যুগ।

ষষ্ঠ স্তরের বর্ণনাকারীদের যুগ আব্বাসী খলীফাহ্ মামূনের খেলাফতের শেষে গিয়ে শেষ হয়ে যায়।১৩

এভাবে বর্ণনাকারীদের স্তর চৌদ্দ পর্যন্ত পৌঁছেছে।

কতক মনীষী অবশ্য ভিন্নভাবে বর্ণনাকারীদের স্তর বিন্যাস করেছেন। তাঁদের বিন্যাস অনুযায়ী, যারা হিজরতের দশ বছরের মধ্যে ইন্তেকাল করেন তাঁরা হলেন প্রথম স্তর। যারা হিজরতের দ্বিতীয় দশকে ইন্তেকাল করেন তাঁরা দ্বিতীয় স্তর। তাঁরা এভাবেই স্তর সংখ্যা ওপরের দিকে নিয়ে গেছেন।

যেহেতু হিজরী প্রথম শতাব্দীর প্রথম দিকে দ্বীনী ‘ইল্ম্ শুধু কোরআন পাঠ ও হাদীছ বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো এবং এর পরবর্তী সময়ে শুধু হাদীছ বর্ণনা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী ‘ইল্মে পরিণত হয়, এ কারণে যে কোন ছাহাবী বা তাবে‘ঈ অথবা পরবর্তী স্তরের যে সব লোক হাদীছ বর্ণনা করতেন তাঁরা আলেম হিসেবে পরিগণিত হতেন, আর যার নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করা হতো তাঁকে শায়খ বলা হতো।

হাদীছ শিক্ষাদানকারী যে কোনো শায়খের কয়েক জন শিষ্য থাকতেন। অন্যদিকে কোনো কোনো বর্ণনাকারী-শিষ্য কয়েক জন শায়খের নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করতেন। তাই হাদীছ শাস্ত্র বিশেষজ্ঞদেরকে এ প্রশ্নের সমাধান বের করতে হয় যে, এরূপ শিষ্য-বর্ণনাকারীর শায়খ কে? এরপর তাঁরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে একজন বর্ণনাকারীর (راوی) অবস্থা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন যার মধ্যে এসব তথ্য থাকে যে, তিনি কোন্ শহরে বসবাস করতেন, তাকওয়ার অধিকারী ছিলেন কিনা, তাঁর ‘আক্বিদাহ্-বিশ্বাসে গলদ ছিলো কিনা, তিনি কি শিয়া ছিলেন নাকি সুন্নী ছিলেন, খারেজী১৪ বা গ¦ালী১৫ ছিলেন কিনা, র্মাজী১৬ বা ক্বাদরী১৭ বা মু‘তাযিলী১৮ বা আশ‘আরী১৯ মতের অনুসারী ছিলেন কিনা, কোরআন মজীদকে সৃষ্ট মনে করতেন নাকি চিরন্তন মনে করতেন, সমকালীন শাসকদের দরবার থেকে দূরে ছিলেন নাকি দরবারী ছিলেন, স্মরণশক্তি প্রবল ছিলো নাকি দুর্বল ছিলো, সত্যবাদী ছিলেন নাকি মিথ্যাবাদী, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর বিচারবুদ্ধি সুস্থ ছিলো নাকি জীবনের শেষ দিকে এসে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন তা কি অন্যরাও বর্ণনা করেছেন নাকি কেবল একা তিনিই বর্ণনা করেছেন। এভাবে তাঁরা হাদীছ বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীছ নির্ণয় করেছেন।২০ কোনো কোনো স্তরের বর্ণনাকারীগণ তাঁদের শিষ্যদের নামে হাদীছ বর্ণনার অনুমতিপত্র লিখে দিতেন এবং শিষ্যের জন্যে এ মর্মে সনদ লিখে দিতেন। হাদীছ শাস্ত্রের মনীষীগণ এসব অনুমতিপত্র সংকলিত করেছেন এবং শুধু এসব অনুমতিপত্রেই ডজন ডজন খণ্ড গ্রন্থ তৈরী হয়েছে।২১

হাদীছ শাস্ত্র বিশারদগণ হাদীছ বর্ণনাকারীদের এসব এবং আরো ডজন ডজন গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। ‘ইল্মে হাদীছ এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে, তা শিক্ষা করার জন্যে অনেকেই এক শহর থেকে অন্য শহরে সফর করতেন। আজকের দিনে যেভাবে অনেকে পড়াশুনার জন্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সফর করে ঠিক সেভাবেই তখনকার দিনে খোরাসান থেকে সুদূর মদীনায়, ইয়ামান থেকে মিসরে, রেই থেকে বাগদাদে, নিশাপুরে, কূফায়, বছরায়, বাল্খে ও সমরকন্দে সফর করতেন।

হাদীছ বর্ণনাকারীদের সংক্রান্ত বৃত্তান্ত মূলক গ্রন্থাবলী বিভিন্ন বিন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে; কতক গ্রন্থ বর্ণানুক্রমিকভাবে এবং কতক গ্রন্থ বর্ণনাকারীদের ওফাতের সনের ভিত্তিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে।

কোনো হাদীছের গ্রহণযোগ্য না হওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে বক্তব্যের অসামঞ্জস্য অন্যতম। ক্ষেত্র বিশেষে একজন বর্ণনাকারী ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তার পক্ষে বা তার নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করা হতে পারে। কিন্তু সাইফ এমন সব বর্ণনাকারীর নামে হাদীছ তৈরী করে চালিয়ে দিয়েছে যাদের আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিলো না, কারণ ‘ইল্মে রিজালের গ্রন্থাবলীতে ‘আত্বিয়াহ্, ছা‘ব্ ও ওসমান বিন্ সুওয়াইদ নামের কোনো ব্যক্তির কথা উল্লিখিত নেই; কেবল সাইফের পুস্তকেই এদের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেহেতু এদের কল্পিত চরিত্র হওয়ার ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই।

সাইফের কল্পকাহিনীর তুলনামূলক পর্যালোচনা

সাইফের বর্ণনার মূল পাঠ অন্যান্য বর্ণনার মূল পাঠের সাথে তুলনা করলে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে বাধ্য যে, সাইফ তার এ রেওয়াইয়াত সমূহের মধ্য থেকে কতগুলো পুরোপুরি নিজে তৈরী করেছে এবং কতগুলোকে তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী বিকৃত করেছে ও তাতে নিজস্ব কথা যোগ করেছে। এভাবেই সে, খালেদ বিন্ ওয়ালীদের ছাফাই গাওয়ার এবং তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ থেকে তাঁকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছে। এ লক্ষ্যে প্রথমে সে একটি ক্ষেত্র তৈরী করেছে, তা হচ্ছেমালেক ইবনে নুওয়াইরাহ্র কাহিনী

মালেক ইবনে নুওয়াইরাহ্ ছিলেন বানু তামীমের ইয়ারবূ‘ উপগোত্রের লোক। তাঁর ডাকনাম ছিলো আবু হানযালাহ্ এবং উপাধি ছিলো জাফূল্।

নির্ভরযোগ্য সূত্রের বর্ণনায় মালেকের ঘটনা

র্মায্বানী বলেন ঃ তিনি ছিলেন উঁচু শ্রেণীর কবি। তিনি ইয়ারবূ‘ গোত্রের যোদ্ধাদের মধ্যে অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি জাহেলিয়্যাতের যুগে এ গোত্রের একজন শীর্ষস্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হতেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁকে সেখানকার কর আদায়ের দায়িত্ব প্রদান করেন। কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ইন্তেকাল করলে তিনি তাঁর নিকট জমা হওয়া করের অর্থ সমকালীন সরকারকে প্রদানে অস্বীকৃতি জানান এবং তা স্বীয় লোকজনদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন ঃ

“বললাম ঃ তোমাদের সম্পদ নিয়ে নাও ভয়-উদ্বেগ ছাড়া

কারণ এর এমন কোনো তদারককারী নেই যে আসবে কাল

অতঃপর এ বিপর্যস্ত দ্বীনের জন্যে কোন অভ্যুত্থানকারী উত্থিত হলে১

তার আনুগত্য করবো ও বলবো ঃ দ্বীন তো মুহাম্মাদের (সাঃ) দ্বীন।”

ত্বাবারী২ আবদুর রহমান বিন্ আবু বকরের সূত্রে বর্ণনা করেন ঃ খালেদ বাত্বাহ্ ভূখণ্ডে উপনীত হবার পর একদল সৈন্য সহ Ñ আবু ক্বাতাদাহ্৩ ছিলেন যাদের অন্যতম Ñ যেরার বিন্ আল্-আয্ওয়ারকে পাঠালেন। তারা রাতের বেলা মালেকের গোত্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরবর্তী কালে আবু ক্বাতাদাহ্ বলতেন ঃ “আমাদের সৈন্যরা যখন রাতের বেলা তাদেরকে ঘিরে ফেললো তখন তা মালেকের গোত্রকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে এবং তারা অস্ত্র ধারণ করে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলো।”

আবু ক্বাতাদাহ্ বলেন ঃ আমরা বললাম ঃ “আমরা মুসলমান।” তারা বললো ঃ “আমরাও মুসলমান।” বাহিনীর সেনাপতি বললেন ঃ “তাহলে তোমরা যুদ্ধাস্ত্র ধারণ করেছো কেন?” তারা বললো ঃ “তোমরা কেন যুদ্ধাস্ত্র ধারণ করেছো?” আমরা বললাম ঃ “তোমরা যদি সত্য বলে থাকো যে, তোমরা মুসলমান তাহলে তোমরা তোমাদের অস্ত্র যমিনে রাখো।”

আবু ক্বাতাদাহ্ বলেন ঃ তখন তারা তাদের অস্ত্র যমিনে রাখলো। অতঃপর আমরা নামায আদায় করলাম এবং তারাও নামায আদায় করলো।

এ ব্যাপারে ইবনে আবিল হাদীদ বলেন ঃ তারা অস্ত্র রাখার সাথে সাথে তাদেরকে বন্দী করা হলো এবং রশি দিয়ে বেঁধে খালেদের কাছে নিয়ে এলো।

কানযুল্ ‘উম্মাল্৪ ও তারীখে ইয়াকুবী৫তে এ ঘটনাটি এভাবে উল্লিখিত হয়েছে ঃ

মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ আলোচনার জন্যে খালেদের নিকটে এলেন। তাঁর স্ত্রীও তাঁর পিছন পিছন এলেন। উক্ত মহিলার প্রতি খালেদের দৃষ্টি পড়লে তিনি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং (নুওয়াইরাহ্কে) বলেন ঃ “আল্লাহ্র শপথ, তুমি আর তোমার গোত্রের কাছে ফিরে যেতে পারবে না; তোমাকে হত্যা করবো।”

কান্যুল্ ‘উম্মাল্-এ আরো বলা হয়েছে৬ ঃ খালেদ বিন্ ওয়ালীদ্ দাবী করেন যে, মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ মুরতাদ হয়ে গেছেন। এ দাবীর সপক্ষে তাঁর দলীল ছিলো তাঁর কানে পৌঁছা মালেকের কথা। মালেক এ দাবী প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন ঃ “আমি আগের মতোই মুসলমান আছি এবং স্বীয় দ্বীনকে পরিবর্তন করি নি বা তাতে কোনো পরিবর্তন আনি নি।” আবু ক্বাতাদাহ্ ও আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমরও তাঁর কথার সত্যতার সাক্ষ্য দেন। কিন্তু খালেদ মালেককে তাঁর নিজের দিকে টেনে নেন এবং যেরার বিন্ আযওয়ারকে তার শিরচ্ছেদের জন্যে আদেশ দেন এবং যেরার মালেকের শিরচ্ছেদ করেন। এরপর খালেদ মালেকের স্ত্রী উম্মে তামীমকে নিজের কাছে নিয়ে নেন এবং শয্যসঙ্গিনী করেন।

তারীখে আবূল ফিদায় বলা হয়েছে৭ ঃ আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর ও আবু ক্বাতাদাহ্ আনছারী উভয়ই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন এবং মালেক সম্পর্কে খালেদের সাথে কথা বলেন। কিন্তু খালেদ তাঁদের কথায় অসন্তুষ্ট হন। মালেক বলেন ঃ “খালেদ! তুমি আমাকে আবু বকরের নিকট পাঠাও যাতে তিনি নিজে আমার ব্যাপারে ফয়সালা করেন।” জবাবে খালেদ বলেন ঃ “আমি যদি তোমাকে রেহাই দেই তাহলে আল্লাহ্ আমাকে রেহাই দেবেন না।” এরপর তিনি যেরার বিন্ আল্-আয্ওয়ারের দিকে ফিরে বললেন ঃ “মালেকের শিরচ্ছেদ করো।” তখন মালেক দুঃখিতভাবে তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন এবং এরপর খালেদের দিকে ফিরে বললেন ঃ “এই নারী আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো, আর সে একজন পরমা সুন্দরী নারী।” খালেদ বললেন ঃ “বরং আল্লাহ্ তোমাকে হত্যা করেছেন। কারণ, তুমি ইসলাম থেকে ফিরে গিয়েছো।” মালেক বললেন ঃ “আমি মুসলমান এবং ইসলামের অনুসারী।” খালেদ বললেন ঃ “যেরার! ওর শিরচ্ছেদ করো।” তখন সে মালেকের শিরচ্ছেদ করলো।৮

আল-ইছাবাহ্ গ্রন্থে৯ ছাবেত বিন্ ক্বাসেম থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, “আদ্-দালায়েল্” গ্রন্থে বলা হয়েছে ঃ মালেকের স্ত্রীর দিকে খালেদের চোখ পড়ে, আর সে ছিলো সমকালীন নারীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী। মালেক তাঁর স্ত্রীকে বললেন ঃ “তুমি আমাকে হত্যা করলে।” এর মানে ছিলো এই যে, আমি তোমার কারণে নিহত হতে যাচ্ছি।

এছাড়া ইছাবাহ্ গ্রন্থে যুবাইর বিন্ বাক্কার থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং যুবাইর ইবনে শিহাব থেকে বর্ণনা করেন ঃ মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ যখন নিহত হন তখন তাঁর মাথায় প্রচুর চুল ছিলো। খালেদ মালেকের কর্তিথ শির পাতিলের নীচে রাখার আদেশ দিলেন এবং তারা (তাঁর অধীনস্থ সৈন্যরা) তা-ই করলো। তাঁর চুল পুড়ে শেষ হয়ে আগুন তাঁর মাথার চামড়ায় পৌঁছার আগেই পাতিলের খাবার রান্না হয়ে গেলো।১০

খালেদ সেদিন রাতেই মালেকের স্ত্রী উম্মে তামীম বিন্তে মিন্হালের সাথে শয্যা গ্রহণ করেন।১১

এ ব্যাপারে আবু নুমাইর সা‘দী তাঁর কবিতায় বলেন ঃ

“বলো সেই অশ্বারোহী বাহিনীকে যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তোমার ’পরে

মালেকের পরে এ রজনী সীমাহীন দীর্ঘ হয়ে গেছে

খালেদ পাপের ফয়সালা করেছে তার বিরুদ্ধে তার স্ত্রীর কারণে

আর তার প্রতি এর আগেই তো তার লালসার দৃষ্টি পড়েছিলো

আর খালেদের প্রবৃত্তি তাকে বানিয়েছে চরম নিষ্ঠুর

ঐ নারীর তরে তার প্রবৃত্তি বিদ্রোহী; পারে নি তাকে লাগাম পরাতে

প্রভাতে সে হলো তার স্ত্রীর অধিকারী যবে মালেকের ভোর হলো

তার স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিহত অবস্থায় তোমার প্রবৃত্তির কারণে।”

আল্-ইছাবাহ্ গ্রন্থে১২ বলা হয়েছে যে, খালেদ মালেককে হত্যা করলে মেনহাল্ তাঁর মাথা বিহীন ধরকে একটি জামা দিয়ে কাফন পরিয়ে দেন।

এই হলো মালেকের পরিণতি। এখন দেখা দরকার সমকালীন সরকার খালেদকে এ কাজের জন্যে কী পুরস্কার প্রদান করে।

তারীখে ইয়াকুবীতে বলা হয়েছে ঃ আবু ক্বাতাদাহ্ আবু বকরের নিকট গিয়ে এ ঘটনা জানান এবং বলেন ঃ “আল্লাহ্র কসম, আমি আর কখনোই খালেদের পতাকার নীচে ও তার অধিনায়কত্বে কোথাও যাবো না। কারণ, সে মালেককে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও হত্যা করেছে।”

আর ত্বাবারী ইবনে আবু বকর থেকে বর্ণনা করেন ঃ “যারা মালেকের মুসলমান হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন তাঁদের মধ্যে আবু ক্বাতাদাহ্ অন্যতম। তিনি স্বীয় রবের সাথে অঙ্গীকার করেন যে, আর কখনোই খালেদের অধিনায়কত্বে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে যাবেন না।”

তারীখে ইয়াকুবীতে বলা হয়েছে ঃ ওমর বিন্ খাত্তাব আবু বকরকে বলেন ঃ “হে রাসূলুল্লাহ্র খলীফাহ্! নিঃসন্দেহে খালেদ একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে এবং সেদিনই তার স্ত্রীর সাথে শয্যা গ্রহণ করেছে।” তখন আবু বকর খালেদকে পত্র লিখেন এবং খালেদকে তাঁর নিকট ডেকে পাঠান। খালেদ বলে ঃ “হে রাসূলুল্লাহ্র খলীফাহ্! আমি মালেককে হত্যার ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণা করে পদক্ষেপ নিয়েছি এবং তাতে সদুদ্দেশ্যই ছিলো, কিন্তু তাতে ভুল হয়ে গিয়েছে।”

ইয়াকুবী আরো বলেন ঃ সে যুগের অন্যতম কবি মুতাম্মিম বিন্ নুওয়াইরাহ্ তাঁর ভাইয়ের স্মরণে অনেক শোক কবিতা লিখেন এবং শোক প্রকাশের অনুষ্ঠান করেন। তিনি মদীনায় এসে আবু বকরের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর পিছনে ফজরের নামায আদায় করেন। আবু বকর নামায শেষ করলে মুতাম্মিম তাঁর জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ান এবং তাঁর ধনুকে ভর দিয়ে এ কবিতাটি পাঠ করেন ঃ

“কেমন উত্তম ব্যক্তিকে নিহত করলে যবে প্রভাতের বায়ু

বাড়ীঘরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো, হে ইবনুল আয্ওয়ার!

তাকে আল্লাহ্র নামে আহ্বান করলে তারপর করলে বিশ্বাসঘাতকতা

সে তোমাকে তাঁর নামে ডাকলে বিশ্বাসঘাতকতা করতো না কভু।”

তারীখে আবূল ফিদায় বলা হয়েছে ঃ এ খবর আবু বকর ও ওমরের নিকট পৌঁছলে ওমর আবু বকরকে বললেন ঃ “নিঃসন্দেহে খালেদ যিনা করেছে; আপনার উচিৎ তাকে সঙ্গে সার করা।” আবু বকর বললেন ঃ “আমি তাকে সঙ্গে সার করবো না। কারণ, সে নিজের জন্যে কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। তবে মনে হচ্ছে, সে তার করণীয় নির্ধারণে ভুল করেছে।” ওমর বললেন ঃ “সে একজন হত্যাকারী এবং একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে। তাই কিছাছ হিসেবে তাকে হত্যা করুন।” জবাবে আবু বকর বললেন ঃ “আমি কখনোই তাকে হত্যা করবো না। কারণ, আমি এইমাত্র যেমন বললাম, সে তার কর্তব্য নির্ধারণে ভুল করেছে।” ওমর বললেন ঃ “অন্ততঃ তাকে পদচ্যুত করুন।” আবু বকর বললেন ঃ “আল্লাহ্ তাদের ওপর যে তরবারী কোষমুক্ত করেছেন আমি কখনোই সে তরবারীকে কোষবদ্ধ করবো না।”

ত্বাবারী ইবনে আবু বকর থেকে বর্ণনা করেছেন ঃ মালেককে হত্যার ব্যাপারে খলেদের ছাফাই ছিলো এই যে, মালেক যখন আমার নিকট আসে তখন তার কথার মধ্যে এ রকম বলেছিলো ঃ “আমি মনে করি না যে, তোমাদের বন্ধু Ñ রাসূলুল্লাহ্ Ñ এরূপ ও ঐরূপ ব্যতীত কিছু বলে থাকবেন।” খালেদ বলে ঃ “তুমি কি তাঁকে তোমার বন্ধু বলে মনে করো না যে, বলছো “তোমাদের বন্ধু”?” অতঃপর সে মালেককে কাছে টেনে নেয় এবং তার শিরচ্ছেদ করে, এছাড়া তার সঙ্গীসাথীদেরও শিরচ্ছেদ করে। মালেক ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিহত হওয়ার খবর এসে পৌঁছলে ওমর এ ব্যাপারে আবু বকরের সাথে অনেক আলোচনা করেন এবং বলেন ঃ “আল্লাহ্র দুশমন এই লোকটি মুসলমানের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন মূলক হস্ত প্রসারিত করেছে এবং তাকে হত্যা করেছে। অতঃপর সাথে সাথেই পশুর ন্যায় তার স্ত্রীর ওপর চড়াও হয়েছে।”

খালেদ সফর থেকে ফিরে আসেন ও মসজিদে গমন করেন। তখন তাঁর গায়ে একটি আলখেল্লা ছিলো যাতে লোহার মরিচা লেগে ছিলো। তাঁর মাথায় পাগড়ী জড়ানো ছিলো এবং ইসলামী সৈনিকের নিদর্শন স্বরূপ তাতে কয়েকটি তীর গাঁথা ছিলো। খালেদ মসজিদে প্রবেশ করলে ওমর রাগের কারণে তাঁর স্থান থেকে দাঁড়িয়ে যান এবং খালেদের পাগড়ীর মধ্য থেকে তীরগুলো টেনে বের করে ভেঙ্গে ফেলেন। এরপর তিনি খালেদকে তিরস্কার করেন এবং বলেন ঃ “তুমি রিয়াকারিতা ও মুনাফেকীর আশ্রয় নিয়ে একজন মুসলমানকে হত্যা করেছো এবং এতেই সন্তুষ্ট না থেকে পশুর ন্যায় তার স্ত্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছো। আল্লাহ্র কসম, তোমাকে সঙ্গে সার করবো; এটাই তোমার উপযুক্ত শাস্তি।” খালেদ একইভাবে নীরব থাকেন। যেহেতু মনে করেছিলেন যে, ওমরের মতো আবু বকরও তাঁকে অপরাধী গণ্য করবেন সেহেতু ওমরের কথার কোনো জবাব দিলেন না। এরপর তিনি আবু বকরের কাছে এসে স্বীয় অভিযানের ফলাফল জানালেন এবং স্বীয় কাজের সপক্ষে ছাফাই গাইলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে আবু বকর তাঁর কৈফিয়ত গ্রহণ করলেন এবং তাঁর এ অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।

বর্ণনাকারী বলেন ঃ খালেদ আবু বকরের সন্তুষ্টি হাসিলে সক্ষম হবার পর পরই তাঁর নিকট থেকে বাইরে চলে গেলেন। ওমর তখনো মসজিদে বসে ছিলেন। খালেদ হুঙ্কার দিয়ে ওমরকে বললেন ঃ “ওহে উম্মে শাম্লাহ্র বেটা! এখন যদি তোমার কোনো কথা থাকে তো বলতে পারো।” ওমর তাঁর দূরদৃষ্টির কারণে বুঝতে পারলেন যে, আবু বকর খালেদের ওপর সন্তুষ্ট আছেন। এ কারণে তিনি খালেদের সাথে কোনো কথা বললেন না, বরং নিজের বাড়ীর দিকে চলে গেলেন।

সংক্ষেপে এই হলো খালেদ ও মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্র ঘটনা যা নির্ভরযোগ্য সকল ইতিহাস গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু সাইফ এ কাহিনী অন্যভাবে বর্ণনা করেছে।

সাইফের বর্ণনা অনুযায়ী মালেকের ঘটনা

সাইফ মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্র ঘটনা সম্পর্কে সাতটি রেওয়াইয়াত পেশ করেছে এবং তাতে তাঁকে মুরতাদ হিসেবে অভিহিত করেছে। এ রেওয়াইয়াতগুলো নিম্নরূপ ঃ

১) ত্বাবারী বানী তামীম ও সাজাহ্ সম্পর্কিত ঘটনাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে সাইফ থেকে উদ্ধৃত করেন ঃ

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিয়োজিত কর্মচারীরা বানূ তামীমে যাকাত সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইন্তেকাল করায় যাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারীদের মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয় এবং মারাত্মক ধরনের দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়। তাদের মধ্য থেকে এক দল তাঁদের আদায়কৃত সব কিছু আবু বকরকে দিলেন। কিন্তু অপর দল তা প্রদানের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন এবং করণীয় সুস্পষ্ট হওয়ার অপেক্ষায় তাঁরা তা (আদায়কৃত যাকাত) আবু বকরকে প্রদানে বিরত থাকেন। মালেক বিন নুওয়াইরাহ্ ছিলেন সেই লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা আবু বকরকে যাকাত প্রদানের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন এবং এ কারণে তাঁকে যাকাত প্রদানে বিরত থাকেন ও পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।

এ সময় বানূ তামীমের ভূখণ্ড ও সেখানকার অধিবাসীরা এ মতদ্বৈধতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। যারা এভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলো মুসলমানরা তাদের মোকাবিলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সহসা সাজাহ্র আবির্ভাব ঘটে যে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর পর নবুওয়াত দাবী করে। সে, তার গোত্রের কিছু লোক এবং বিভিন্ন আরব গোত্রের আরো কিছু লোক আবু বকরের বিরুদ্ধে হামলা চালানো ও যুদ্ধ করার লক্ষ্যে মাথা তুলে দাঁড়ায়।

সাজাহ্ মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্কে একটি পত্র লিখে। মালেকও তার প্রস্তাব মেনে নেয় এবং ওয়াকী‘ ও সাজাহ্র সাথে মিলে তিন সদস্যের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এ সংগঠনের আওতায় তারা একটি অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করে যাতে তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে পরস্পরের সাথে সহযোগিতার ধারাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

২) বাহ্রাইনের লোকদের মুরতাদ হওয়া ও তাদের উদ্দেশে ‘আলা’ বিন্ হায্রামীকে পাঠানোর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সাইফ বলে ঃ ‘আলা’ বিন্ হায্রামী তাদের উদ্দেশে রওয়ানা হবার পর ইয়ামামাহ্ পৌঁছলে, তাদের (বাহ্রাইনের লোকদের) মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয় এবং তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়। অতঃপর তাদের একটি অংশ ‘আলা’র সাথে যোগদান করে। বর্ণনাকারী থেকে সাইফ বর্ণনা করেছে যে, তিনি (‘আলা’) বলেন ঃ মালেক ও তার সমর্থকরা বুত্বাহ্-য় ছিলো। আর সে আমাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে এবং আমরা তার সাথে তর্ক-বিতর্ক করি।

৩) এ প্রসঙ্গে সাইফ আরো বলে ঃ সাজাহ্ জাযিরায় ফিরে গেলে মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ অনুতপ্ত হয় এবং স্বীয় কর্মের জঘন্যতা সম্বন্ধে সচেতন হয়। তাই সে তার কৃতকর্মের কথা চিন্তা করে দিশাহারা হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ওয়াকী‘ ও সামা‘আহ্ স্বীয় কৃতকর্মের স্বরূপ বুঝতে পারে এবং পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে স্বীয় সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে ও কোনো রূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই স্বীয় বকেয়া যাকাত প্রদান করে, আর খালেদকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে ছুটে যায় ও তাঁর সাথে যুক্ত হয়। বানী হানযালাহ্র ভূখণ্ডে একমাত্র অস্বস্তিকর যা ছিলো তা হচ্ছে মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ ও তাকে ঘিরে থাকা লোকজন; সে আগের মতোই দিশাহারা অবস্থায় ছিলো এবং কখনো ভালো আচরণ করছিলো এবং কখনো মন্দ আচরণ করছিলো।

৪) এরপর সাইফ বলে ঃ খালেদ বানূ আসাদ ও বানূ গাত্ফানের এলাকাকে মুরতাদমুক্ত করার পর বুত্বাহ্র উদ্দেশে রওয়ানা হন। মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ সেখানে ছিলো এবং সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলো। আনছাররা খালেদের কাজে এবং বুত্বাহ্ অভিমুখে তাঁর অভিযাত্রার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, এ কারণে তাঁরা তাঁর সঙ্গী হওয়া থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা বললেন ঃ “খলীফাহ্ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, বাযাখার যুদ্ধ শেষ হলে আমরা যেন আমাদের কাছে খলীফাহ্র পত্র এসে না পৌঁছা পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করি।” খালেদ বললেন ঃ “সেনাপতি আমি এবং ফরমান আমার নিকটই পৌঁছে। এখন মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্ আমাদের সামনে আছে; আমি নিজে এবং যারা আমার সঙ্গী হয়েছে (কতক মুহাজির ও তাবে‘ঈন) আমরা তার দিকে এগিয়ে যেতে চাই। এছাড়া আমি তোমাদের কাউকেই আমার সাথে যেতে বাধ্য করবো না।” তিনি এ কথা বললেন ও যাত্রা করলেন। খালেদের রওয়ানা হয়ে যাবার পর আনছাররা অনুতপ্ত হলেন এবং তিনি যেদিকে রওয়ানা হয়েছিলেন তাঁরাও সেদিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন ও তাঁর সাথে এসে যুক্ত হলেন। খালেদ একইভাবে এগিয়ে চললেন এবং বুত্বাহ্-য় উপনীত হলেন, কিন্তু তিনি সেখানে কাউকে পেলেন না।

৫) ত্বাবারী সাইফ থেকে এরপর বর্ণনা করেন ঃ

খালেদ বিন্ ওয়ালীদ বুত্বাহ্ পৌঁছার পর সেখানে কাউকে পেলেন না এবং দেখলেন যে, মালেক স্বীয় কৃতকর্মের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগার কারণে স্বীয় গোত্রকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে। মালেক স্বীয় জমায়েতকে (সৈনদেরকে) ভেঙ্গে দেয় ও তাদেরকে বলে ঃ “হে বানী ইর্য়াবূ‘র লোকেরা! তোমরা জানো যে, শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ ও সেনাপতিগণ আমাদেরকে দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তখন শুধু আমরা নিজেরাই তাঁদের ফরমান অমান্য করি নি, বরং তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছি এবং অন্যদেরকে খুব শীঘ্র তাঁদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হতে দেই নি। কিন্তু এ সংগ্রামে আমরা পরাজিত হয়েছি; জয়লাভ করতে পারি নি। আমি এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে যে উপসংহারে উপনীত হয়েছি তা হচ্ছে, তোমাদেরকে বলবো যে, সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়াই এ ব্যাপারটি এগিয়ে যাচ্ছে। অতএব, কালের প্রবাহ যে লোকদের অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছে তোমরা যাতে তাদের সাথে শত্র“তায় জড়িয়ে না পড়ো, সেহেতু তোমাদের নিজেদের ভূখণ্ডে ফিরে যাও এবং কোনো রূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই ফিরে যাও।” তার এ ভাষণের পর লোকেরা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো এবং স্বয়ং মালেকও তার বাড়ীতে ফিরে এলো।

খালেদ বুত্বাহ্ পৌঁছার পর ইসলামের প্রচারের জন্যে স্বীয় লোকজনকে আশেপাশে পাঠালেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, যে ব্যক্তিই তাঁদের দাওয়াত গ্রহণ না করবে তাঁরা যেন তাকে বন্দী করে তাঁর নিকট নিয়ে আসেন। আর কেউ যদি আসতে প্রস্তুত না হয় তাহলে যেন তাকে হত্যা করেন। আর আবু বকর খালেদকে যে সব ফরমান দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলো এই ঃ “তোমরা যে কোনো মনযিলে উপনীত হবে সেখানেই আযান দেবে। সেখানকার লোকেরাও যদি আযান ও ইক্বামাহ্ বলে তাহলে তাদের ওপর চড়াও হয়ো না। আর তারা যদি তা না করে তাহলে তোমাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে তাদের ওপর সহসা ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া হলো যে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই তোমরা তাদেরকে হত্যা করবে, এমন কি প্রয়োজন হলে আগুনে পুড়িয়ে বা অন্য যে কোনো পন্থায়। আর তারা যদি তোমাদের দেয়া ইসলামের দাওয়াত কবুল করে তাহলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরীক্ষা করো। জিজ্ঞাসাক্ষাদে তারা যদি যাকাত প্রদানে সম্মতি প্রকাশ করে তাহলে তাদের ইসলামকে গ্রহণ করে নাও। আর তারা যদি যাকাত প্রদানের কথা স্বীকার না করে তাহলে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই হচ্ছে তাদের একমাত্র শাস্তি।”

খালেদের সৈন্যরা ফিরে এলো এবং মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্কে তার গোত্রের কিছু লোক ও তার চাচাতো ভাইদের সহ খালেদের নিকট নিয়ে এলো। সৈন্যদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলো; আবু ক্বাতাদাহ্ সহ কয়েক জন সাক্ষ্য দিলেন যে, মালেক ও তার সঙ্গীসাথীরা আযান ও ইক্বামাহ্ বলেছে ও নামায আদায় করেছে। এ মতপার্থক্য দেখা দিলে খালেদ মালেক ও তার সঙ্গী-সাথীদেরকে কারারুদ্ধ করার জন্যে আদেশ দিলেন। ঘটনাক্রমে তখন রাত ছিলো খুবই ঠাণ্ডা এবং কারো পক্ষে সে ঠাণ্ডার মোকাবিলায় টিকে থাকা সম্ভব ছিলো না। আর রাত যত গভীর হচ্ছিলো ঠাণ্ডাও ততই তীব্রতর হচ্ছিলো। তখন খালেদ এই বলে আদেশ দিলেন যে, “তোমরা তোমাদের বন্দীদেরকে গরম করো।” তিনি এ জন্যে যে বাক্য ব্যহার করেন তা হচ্ছে ঃ ادفئوا اسراکم Ñ যাতে ব্যবহৃত ادفئوا শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে “তোমরা গরম করো” এবং আরেকটি ইঙ্গিত বাচক অর্থ হচ্ছে “তোমরা হতা করো”। সৈন্যরা এ আদেশ শোনার পর ধারণা করে যে, খালেদ বন্দীদেরকে হত্যা করার জন্যে আদেশ দিয়েছেন। তাই তারা বন্দীদেরকে হত্যা করে। আর মালেকের হত্যাকারী ছিলেন যেরার বিন্ আয্ওয়ার। আর্তনাদ ও চীৎকার কানে গেলে খালেদ তাঁর ঘর থেকে বের হলেন। তিনি দেখলেন যে, যা হবার তা হয়ে গেছে। তিনি বললেন ঃ “আল্লাহ্ যখন কোনো কাজ সম্পাদনের ইচ্ছা করেন তখন তিনি তা সম্পাদন করেন।”

ঘটনা সংঘটিত হয়ে যাবার পর খালেদের সাথের লোকেরা নিহতদের ব্যাপারে আলোচনা ও বিতর্কে লিপ্ত হলেন। আবু ক্বাতাদাহ্ খালেদের দিকে ফিরে বললেন ঃ “এটা তোমারই কাজ।” তখন খালেদ তাঁকে ধমক দেন। তাই আবু ক্বাতাদাহ্ ক্রুদ্ধভাবে বেরিয়ে পড়লেন এবং (মদীনায় এসে) আবু বকরের নিকট গেলেন। কিন্তু আবু বকর আবু ক্বাতাদাহ্র ওপর ক্রুদ্ধ হলেন, তবে ওমর তাঁদের মধ্যে মধ্যস্থতা করলেন। কিন্তু আবু বকর তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হলেন না যতক্ষণ না তিনি খালেদের নিকট ফিরে গেলেন। তিনি ফিরে গেলেন এবং খালেদের সাথে মদীনায় ফিরে এলেন। আর খালেদ মালেকের স্ত্রী উম্মে তামীম বিন্তে মেনহাল্কে বিবাহ করেন, তবে ইদ্দত পূর্ণ হবার আগে তিনি তার সাথে শয্যাগ্রহণ করেন নি।

ওমর আবু বকরকে বললেন যে, খালেদের তরবারীতে বিদ্রোহ আছে এবং সর্বত্র যাতে তিনি এরূপ না করেন এ উদ্দেশ্যে তাঁকে মালেক হত্যার দায়ে কিছাছ করা প্রয়োজন। তিনি এজন্য খুবই পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু আবু বকর তাঁর কোন কর্মচারী ও দায়িত্বশীলের বিরুদ্ধেই কিছাছের বিধান কার্যকর করতেন না। তাই তিনি বললেন ঃ “থামো তো ওমর! খালেদ তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী চিন্তা-ভাবনা করে এ কাজ করেছে। অতএব, এ ব্যাপারে আর কথা বলো না।” অতঃপর আবু বকর মালেকের রক্তমূল্য প্রদান করেন এবং খালেদকে পত্র লিখে ডাকিয়ে আনেন।

খালেদ মদীনায় আসার পর আবু বকরের নিকট ঘটনা খুলে বলেন। আবু বকর খালেদের কৈফিয়ত গ্রহণ করলেন, তবে তিনি যেভাবে বিবাহ করেছেন তা আরবদের দৃষ্টিতে দোষের ছিলো বিধায় এজন্য তিনি খালেদকে তিরস্কার করেন।

৬) সাইফ তার বর্ণিত অপর এক রেওয়াইয়াতে এ ব্যাপারে বলে ঃ খালেদের একদল সৈনিক সাক্ষ্য দেন যে, আমরা আযান দিয়ে ও ইক্বামাহ্ বলে নামায আদায় করি; মালেকও তা-ই করলো। কিন্তু অপর কতক সৈনিক সাক্ষ্য দেন যে, এ ধরনের কোনো ব্যাপারই ছিলো না; এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

মালেকের ভাই মুতাম্মিম বিন্ নুওয়াইরাহ্ এলো এবং কবিতা পড়ে মালেকের রক্তের প্রতিদান দাবী করলো ও বন্দীদের মুক্তি দাবী করলো। তখন আবু বকর পত্র লিখে পাঠালেন যাতে বন্দীদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। ওমর খালেদকে পদচ্যুত করার জন্যে আবু বকরকে খুবই পীড়াপীড়ি করেন। তিনি বলেন যে, তার (খালেদের) তলোয়ারে বিদ্রোহ আছে (তাই তার আর তলোয়ার হাতে নেয়ার অধিকার নেই এবং তার হাতে আর সেনাপতিত্বের এখতিয়ার রাখা ঠিক নয়)। জবাবে আবু বকর বললেন ঃ “না, ওমর! আল্লাহ্ যে তরবারীকে কাফের হত্যার জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন আমি কখনোই তাকে কোষবদ্ধ করবো না।”

৭) সাইফ তার সর্বশেষ রেওয়াইয়াতে বলে ঃ মালেকের চুলের পরিমাণ ছিলো অনেক বেশী। সৈন্যরা যখন নিহতদের মাথাগুলোকে (জ্বলন্ত চুলায়) পাতিলের নীচে দিলো তখন এমন কোনো মাথা ছিলো না আগুন যার চামড়ায় পৌঁছে নি, কেবল মালেকের মাথা ছাড়া। খাবার রান্না হয়ে গেলো এবং তা পরিবেশনের উপযোগী হয়ে গেলো, কিন্তু চুলের কারণে তখনো মালেকের মাথা পোড়ে নি।

মুতাম্মেম মালেকের প্রশংসা করে যে কবিতা রচনা করে তাতে তার পেটের অ-স্থূলতার Ñ যা বীর যোদ্ধাদের গৌরবের নিদর্শন রূপে পরিগণিত হতো Ñ প্রশংসা করে। ওমর এর আগে দেখেছিলেন যে, মালেক কীভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট এসেছিলো। এ কারণে তিনি বললেন ঃ “এমনটিই ছিলো, মুতাম্মেম?” মুতাম্মেম বললো ঃ “আমার দৃষ্টিতে তা-ই।”

এই হলো মালেক বিন্ নুওয়াইরাহ্র ঘটনা সম্বন্ধে সাইফের বর্ণনা।

সাইফের রেওয়াইয়াতের উৎস

সাইফ বিন্ ওমর তার বর্ণিত উপরোক্ত প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় রেওয়াইয়াত, তার দাবী অনুযায়ী ছা‘ব্ বিন্ ‘আত্বিয়াহ্ থেকে বর্ণনা করেছে। তার দাবী অনুযায়ী ছা‘ব্ তা তাঁর পিতা ‘আত্বিয়াহ্ বিন্ বিলাল থেকে বর্ণনা করেছেন। আর তার দাবী অনুযায়ী, সে পঞ্চম ও সপ্তম রেওয়াইয়াত দু’টি ওসমান্ বিন্ সুওয়াইদ্ বিন্ মাছ্‘আবাহ্ থেকে বর্ণনা করেছে।

‘আত্বিয়াহ্ ও ছা‘ব্ Ñ এই দুই পিতা ও পুত্র সম্বন্ধে এবং ওসমান বিন্ সুওয়াইদ্ সম্বন্ধে ‘ইল্মে রিজালের গ্রন্থাবলীতে যথেষ্ট অনুসন্ধান করেছি, কিন্তু এ ধরনের কোনো গ্রন্থেই ‘আত্বিয়াহ্ ও ছা‘ব্-এর কোনো নাম-নিশানা খুঁজে পাই নি। অন্যদিকে ইসলামের ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থাবলীতে সুওয়াইদ বিন্ মাছ্‘আবাহ্র কথা উল্লেখ থাকলেও তাঁর ওসমান নামে কোনো পুত্রসন্তান ছিলো বলে উল্লেখ নেই। অতএব, ‘ইলমে রিজালের বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বর্ণনাকারী নিছক কল্পিত চরিত্র Ñ বাস্তবে যাদের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না।

বস্তুতঃ সাইফ বিন্ ওমর বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তির জন্যে বহু কল্পিত সন্তান তৈরী করে তাদেরকে স্বীয় কল্পকাহিনীর বর্ণনারকারী হিসেবে উল্লেখ করেছে। যেমন ঃ সে হাওয়াবের কুকুরদের কাহিনীতে উম্মে র্ক্বিফাহ্র উম্মে যামাল্ নামে একটি কন্যা সন্তান কল্পনা করেছে। তেমনি সে র্হোমোযানের জন্যে কুম্মায্বান্ নামে একটি পুত্র সন্তান বানিয়েছে। এভাবে সে দেড়শ’ জন কল্পিত ছাহাবী তৈরী করেছে যাদের সম্পর্কে অন্য কোনো সূত্রেই Ñ কোনো গ্রন্থেই উল্লেখ নেই এবং যাদের কাল্পনিকতা আমরা এতদসংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছি।

সাইফের রেওয়াইয়াত কল্পকাহিনী কেন?

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আমরা কোন্ দলীলের ভিত্তিতে সাইফের রেওয়াইয়াত সমূহকে কল্পকাহিনী বলছি?

এ প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে, হাদীছ শাস্ত্রের মনীষীদের দৃষ্টিতে হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে ঃ

প্রথম স্তরে রয়েছেন তাঁরা যারা কোনো মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তাঁদেরকে ছাহাবী বলা হয়।

দ্বিতীয় স্তরে রয়েছেন ঐ সব বর্ণনাকারী যারা সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)কে দেখেন নি, তবে তাঁর ছাহাবীদের মধ্য থেকে অন্ততঃ একজনের হলেও সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তাঁদেরকে তাবে‘ঈ বলা হয় (যার বহু বচন তাবে‘ঈন্)। যে সব তাবে‘ঈ অন্ততঃ দশজন ছাহাবীর নিকট থেকে রেওয়াইয়াত করেছেন তাঁদেরকে “বুযুর্গানে তাবে‘ঈন্” বলা হয়।

তৃতীয় স্তরে রয়েছেন ঐ সব তাবে‘ঈ যারা খুব কম সংখ্যক (দশের কম সংখ্যক) ছাহাবীর নিকট থেকে রেওয়াইয়াত করেছেন। এদের যুগ উমাইয়াহ্ খলীফাহ্ ওয়ালীদের শাসনামলে হিজরী ১২৬ সালে সমাপ্ত হয়।

চতুর্থ স্তরে রয়েছেন সর্বশেষ তাবে‘ঈগণ এবং তাঁদের সমসাময়িক বর্ণনাকারীগণ। এ স্তরের বর্ণনাকারীগণ সাধারণতঃ প্রথম স্তরের তাবে‘ঈগণ থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো কোনো ছাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন। এদের যুগ বানী উমাইয়্যাহ্র খেলাফতের শেষ অর্থাৎ হিজরী ১৩২ সাল পর্যন্ত।

পঞ্চম স্তরে রয়েছেন সেই সব ছাহাবী যারা চতুর্থ স্তরের বর্ণনাকারীদের পরে বেঁচে ছিলেন। আব্বাসী খলীফাহ্ মানছূরের শেষ সময় পর্যন্ত এদের যুগ।

ষষ্ঠ স্তরের বর্ণনাকারীদের যুগ আব্বাসী খলীফাহ্ মামূনের খেলাফতের শেষে গিয়ে শেষ হয়ে যায়।১৩

এভাবে বর্ণনাকারীদের স্তর চৌদ্দ পর্যন্ত পৌঁছেছে।

কতক মনীষী অবশ্য ভিন্নভাবে বর্ণনাকারীদের স্তর বিন্যাস করেছেন। তাঁদের বিন্যাস অনুযায়ী, যারা হিজরতের দশ বছরের মধ্যে ইন্তেকাল করেন তাঁরা হলেন প্রথম স্তর। যারা হিজরতের দ্বিতীয় দশকে ইন্তেকাল করেন তাঁরা দ্বিতীয় স্তর। তাঁরা এভাবেই স্তর সংখ্যা ওপরের দিকে নিয়ে গেছেন।

যেহেতু হিজরী প্রথম শতাব্দীর প্রথম দিকে দ্বীনী ‘ইল্ম্ শুধু কোরআন পাঠ ও হাদীছ বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো এবং এর পরবর্তী সময়ে শুধু হাদীছ বর্ণনা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী ‘ইল্মে পরিণত হয়, এ কারণে যে কোন ছাহাবী বা তাবে‘ঈ অথবা পরবর্তী স্তরের যে সব লোক হাদীছ বর্ণনা করতেন তাঁরা আলেম হিসেবে পরিগণিত হতেন, আর যার নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করা হতো তাঁকে শায়খ বলা হতো।

হাদীছ শিক্ষাদানকারী যে কোনো শায়খের কয়েক জন শিষ্য থাকতেন। অন্যদিকে কোনো কোনো বর্ণনাকারী-শিষ্য কয়েক জন শায়খের নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করতেন। তাই হাদীছ শাস্ত্র বিশেষজ্ঞদেরকে এ প্রশ্নের সমাধান বের করতে হয় যে, এরূপ শিষ্য-বর্ণনাকারীর শায়খ কে? এরপর তাঁরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে একজন বর্ণনাকারীর (راوی) অবস্থা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন যার মধ্যে এসব তথ্য থাকে যে, তিনি কোন্ শহরে বসবাস করতেন, তাকওয়ার অধিকারী ছিলেন কিনা, তাঁর ‘আক্বিদাহ্-বিশ্বাসে গলদ ছিলো কিনা, তিনি কি শিয়া ছিলেন নাকি সুন্নী ছিলেন, খারেজী১৪ বা গ¦ালী১৫ ছিলেন কিনা, র্মাজী১৬ বা ক্বাদরী১৭ বা মু‘তাযিলী১৮ বা আশ‘আরী১৯ মতের অনুসারী ছিলেন কিনা, কোরআন মজীদকে সৃষ্ট মনে করতেন নাকি চিরন্তন মনে করতেন, সমকালীন শাসকদের দরবার থেকে দূরে ছিলেন নাকি দরবারী ছিলেন, স্মরণশক্তি প্রবল ছিলো নাকি দুর্বল ছিলো, সত্যবাদী ছিলেন নাকি মিথ্যাবাদী, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর বিচারবুদ্ধি সুস্থ ছিলো নাকি জীবনের শেষ দিকে এসে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন তা কি অন্যরাও বর্ণনা করেছেন নাকি কেবল একা তিনিই বর্ণনা করেছেন। এভাবে তাঁরা হাদীছ বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীছ নির্ণয় করেছেন।২০ কোনো কোনো স্তরের বর্ণনাকারীগণ তাঁদের শিষ্যদের নামে হাদীছ বর্ণনার অনুমতিপত্র লিখে দিতেন এবং শিষ্যের জন্যে এ মর্মে সনদ লিখে দিতেন। হাদীছ শাস্ত্রের মনীষীগণ এসব অনুমতিপত্র সংকলিত করেছেন এবং শুধু এসব অনুমতিপত্রেই ডজন ডজন খণ্ড গ্রন্থ তৈরী হয়েছে।২১

হাদীছ শাস্ত্র বিশারদগণ হাদীছ বর্ণনাকারীদের এসব এবং আরো ডজন ডজন গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। ‘ইল্মে হাদীছ এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে, তা শিক্ষা করার জন্যে অনেকেই এক শহর থেকে অন্য শহরে সফর করতেন। আজকের দিনে যেভাবে অনেকে পড়াশুনার জন্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সফর করে ঠিক সেভাবেই তখনকার দিনে খোরাসান থেকে সুদূর মদীনায়, ইয়ামান থেকে মিসরে, রেই থেকে বাগদাদে, নিশাপুরে, কূফায়, বছরায়, বাল্খে ও সমরকন্দে সফর করতেন।

হাদীছ বর্ণনাকারীদের সংক্রান্ত বৃত্তান্ত মূলক গ্রন্থাবলী বিভিন্ন বিন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে; কতক গ্রন্থ বর্ণানুক্রমিকভাবে এবং কতক গ্রন্থ বর্ণনাকারীদের ওফাতের সনের ভিত্তিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে।

কোনো হাদীছের গ্রহণযোগ্য না হওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে বক্তব্যের অসামঞ্জস্য অন্যতম। ক্ষেত্র বিশেষে একজন বর্ণনাকারী ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তার পক্ষে বা তার নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করা হতে পারে। কিন্তু সাইফ এমন সব বর্ণনাকারীর নামে হাদীছ তৈরী করে চালিয়ে দিয়েছে যাদের আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিলো না, কারণ ‘ইল্মে রিজালের গ্রন্থাবলীতে ‘আত্বিয়াহ্, ছা‘ব্ ও ওসমান বিন্ সুওয়াইদ নামের কোনো ব্যক্তির কথা উল্লিখিত নেই; কেবল সাইফের পুস্তকেই এদের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেহেতু এদের কল্পিত চরিত্র হওয়ার ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই।

..............চলবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.