নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইসলাম,রাজনীতি

আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি।

আল-মুনতাজার

আমি মুয়াবিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত পরিত্যাগকারী রাসুলের(সাঃ) শিয়া।শিয়া মানে অনুসারী।আমি আল্লাহর অনুসারী,রাসুলের(সাঃ) অনুসারী।ডঃ তিজানী সামাভী বলেন,শিয়ারা রাসুলের(সাঃ) সুন্নত পালন করছে।

আল-মুনতাজার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইসলামের পবিত্রতা সংরক্ষনে নবী পরিবারের (আঃ) ভুমিকা

২৫ শে আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৩:৩১

সূচনা (১)

মুসলিমদের উপর খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের সংস্কৃতির প্রভাব



খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের ধর্মবিশ্বাস, বিশেষ করে ইহুদীদের বিভিন্ন সংস্কৃতি মুসলিমদের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে দুইটি পদ্ধতিতে।

ক) খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের প্রচারণার মাধ্যমে।

খ) কিছু মুসলিমের মাধ্যমে।




এবারে আমরা এই দুইটা পদ্ধতিকেই একটু বিস্তারিতভাবে দেখবো।



(ক) খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রচারণার মাধ্যমে মুসলিমদের মাঝে তাদের বিভিন্ন সংস্কৃতির বিস্তার:

খ্রীষ্টান ও ইহুদী বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে ইসলামের বিভিন্ন ঐতিহ্যকে বিকৃত করার ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। আমরা জানি যে বিভিন্ন সময়ে খলিফাগণ নবীজী (সঃ)-এর ঐতিহ্যগুলি প্রচারে বাধা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়। এসময় যেসব খ্রীষ্টান ও ইহুদী পন্ডিতরা ইসলাম গ্রহণ করতো, তাদের মতামতগুলোকে খলিফাগণ উদারভাবে মুসলিমদের মাঝে প্রচার করার অনুমতিও দিয়েছিলেন।



উদাহরণ হিসেবে তামিম দারি’র কথা বলা যায়। ইসলাম গ্রহণ করার আগে তিনি ছিলেন একজন খ্রীষ্টান সন্ন্যাসী। খলিফা ওমর এই তামিম দারি-কে রাসুল (সঃ)-এর মসজিদে প্রতি শুক্রবার জুমা’র নামাজের খুতবার আগে ভাষণ দেয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। খলিফা উসমানও এই তামিম দারি-কে সপ্তাহে দুইবার ভাষণ দেয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।



একইভাবে কা’ব আল-আহবার (যার প্রথম নাম ছিলো ম্যাটি)-এর নামও বলা যায়। ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি ছিলেন একজন ইহুদী ধর্মযাজক। তিনি সেসময় মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন “কা’ব আল হবর” বা “কা’ব আল আহবার” নামে। আরবী “হাবর” শব্দটার অর্থ গুনী ও শিক্ষিত লোক। খলিফা ওমরের শাসনামলে কা’ব আল-আহবার বিচার কাজ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। খলিফা উসমানও তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গিয়েছিলেন। কোরানের বিভিন্ন মূলনীতি আর ব্যাখ্যা জানার জন্য মুসলিমরা তখন তাঁর কাছেই যেতো।১ কা’ব সেসময় বিকৃত তাওরাতের বিভিন্ন বর্ণনা আর ইহুদীদের অন্যান্য ধারণাগুলি মুসলিমদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। সমসাময়িক অন্যান্য মুসলিম, যারা আহলে বায়াত (আঃ)-দের অনুসরন করতেন, তাঁরা কা’ব-এর এই বিদ্বেষমূলক আচরন সম্পকে সচেতন ছিলেন।



আল তাবারি তার বিবরণীতে লিখেছেন: “ইবনে আব্বাসকে বলা হয়েছিলো: কা’ব বলেছেন যে, কেয়ামতের দিন সূর্য ও চাঁদকে নিয়ে আসা হবে হতবুদ্ধি ষাঁড়ের মতো এবং তাদের দোজখে নিক্ষেপ করা হবে।”



“একথা শুনে ইবনে আব্বাস ক্রুদ্ধ হলেন, এবং সাথে সাথে তিনবার বললেন: ‘কা’ব একজন মিথ্যাবাদী! কা’ব একজন মিথ্যাবাদী! কা’ব একজন মিথ্যাবাদী!’ ”



“এটা হলো ইহুদীদের ধারণা, আর কা’ব এটা ইসলামের সাথে জুড়ে দিতে চাইছে। তারা যে অপবাদগুলো দেয়, আল্লাহ সেগুলো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহকে যারা মেনে চলে, তিনি তাদের কখনোই শাস্তি দেননা। তোমরা কি শোনোনি, আল্লাহ কোরানে বলেছেন:



“তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চাঁদকে, যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী।”

(সুরা ইবরাহিম: আয়াত ৩৩)



”ইবনে আব্বাস বলেছেন: এই আয়াতে ‘দাইয়িবানি’ শব্দটার অর্থ হলো সবসময় আল্লাহকে মেনে চলা।”



“তারপর ইবনে আব্বাস আরো বললেন: কিভাবে আল্লাহ আকাশমন্ডলীর এই দুই সৃষ্টিকে শাস্তি দেবেন, যাদের বাধ্যতার প্রশংসা তিনি নিজেই করে থাকেন? আল্লাহ এই ইহুদী পন্ডিত ও তার জ্ঞানকে অভিশাপ দিন! আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করা আর এই দুই বাধ্য সৃষ্টিকে দোষারোপ করার কি নির্লজ্জ ধৃষ্টতা!”



“একথা বলার পরে ইবনে আব্বাস তিনবার বললেন: ‘আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাবো’।”



“তারপর ইবনে আব্বাস সূর্য আর চাঁদ সম্পর্কে নবীজী (সঃ) যা বলেছেন, সেটা বলা শুরু করলেন। নবীজী (সঃ) বলেছেন: ‘আল্লাহ দুইটা আলোর উৎস সৃষ্টি করেছেন। তিনি যেটার নাম দিয়েছেন সূর্য, সেটা দেখতে পৃথিবীর মতো। সেটা উদিত হয় ও অস্ত যায়। আর যেটা তাঁর আদেশে মাঝেমধ্যে ঔজ্জ্বল্য কমায়, সেটার নাম দিয়েছেন চাঁদ। এটাকে তিনি সূর্যের চাইতে ছোট করে সৃষ্টি করেছেন। এই দুইটাই অনেক উপরের আকাশে এবং পৃথিবী থেকে দূরে থাকে বলে এদের আকারে ছোট দেখায়।”২





পর্যালোচনা

এখানে কা’ব আল-আহবার এবং ইবনে আব্বাসের কথাগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে:



১) আল্লাহর উপর কা’ব যা কিছু আরোপ করেছেন, ইবনে আব্বাস সেগুলো খন্ডন ও প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন:



“তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চাঁদকে, যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী।”

(সুরা ইবরাহিম: আয়াত ৩৩)



তিনি এখানে যুক্তি দেখিয়েছেন যে সূর্য ও চাঁদের এই অধ্যাবসায় আসলে সম্পূর্ণ বাধ্যতার সমতুল্য। আর যারা আল্লাহকে মেনে চলে, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেননা।



২) কা’বের এই উপমা প্রত্যাখ্যান করে ইবনে আব্বাস বলেন যে পৃথিবীর মতো সূর্য আর চাঁদও আকাশমন্ডলীর উপাদান। তাঁর এই কথাকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি নবীজী (সঃ)-এর হাদীসের সাহায্য নেন, যেখানে নবীজী (সঃ) বলেছেন: ‘ আর দুইটাই অনেক উপরের আকাশে এবং পৃথিবী থেকে দূরে থাকে বলে এদের আকারে ছোট দেখায়।’



সে সময়ের প্রেক্ষাপটে ইবনে আব্বাস হাদীসের সবচেয়ে সেরা ব্যাখ্যাটাই দিয়েছিলেন। তবে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আমরা এই হাদীসের আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারি।



ক) সূর্যের উদয় হওয়া আর অস্ত যাওয়ার ব্যাপারটা পৃথিবীর সাথে সংশ্লিষ্ট। এখানে পরোক্ষভাবে আকাশের জ্যোতিষ্কমন্ডলীর আবর্তন ও চলাচলের কথা বলা হয়েছে।

খ) এটা আরো নির্দেশ করছে যে এই জ্যোতিষ্কগুলি বর্তুলাকার এবং এক এক সময়ে এক এক জায়গায় উদিত হয় আর অস্ত যায়। জ্যোতিষ্কগুলি সমতল হলে এমনটা কখনোই হতোনা।

গ) এখানে এটা খুবই স্পষ্ট যে কা’ব আল-আহবার হাদীসের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ইবনে আব্বাস সেটা মেনে নিতে রাজি ছিলেননা।



এমন বেশ কিছু হাদীসের বর্ণনায় ইহুদী ধর্মবিশ্বাসের ছোঁয়া আছে, আর দাবী করা হয় যে ইবনে আব্বাস এই হাদীসগুলি কা’ব-এর মুখে শুনেছিলেন। উপরের পর্যালোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে এই দাবীটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন ও অসত্য। আব্বাসীয় শাসনামলে এই হাদীসগুলির বিকৃতি হয়, কারন আব্বাসীয়রা তাদের পূর্বপুরুষ ইবনে আব্বাসের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দিতো। আব্বাসীয় বিভিন্ন সভায় লোকজন জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য ইবনে আব্বাসের নামে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতো। এভাবে ইবনে আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বহু অশুদ্ধ হাদীস প্রচলিত হয়ে গেলো, আর ইহুদীদের বিভিন্ন বিশ্বাস আর সংস্কার ইসলামী বইয়ের ভেতরে জায়গা করে নিলো।



ইবনে আব্বাস নবীজী (সঃ)-এর বিভিন্ন হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা এবং হাদীস সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন। বর্তমান সময়ের বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাহায্যে আমরা এই হাদীসগুলি থেকে আরো কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ভবিষ্যতে বিজ্ঞান আরো এগিয়ে গেলে তখনকার বিশেষজ্ঞরা আরো বেশি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তবে কা’ব-এর বর্ণনাগুলো হলো ইহুদীদের ভিত্তিহীন গল্প। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এগুলো তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।



পরবর্তী পর্যায়ে আমরা কা’ব আল আহবার-এর কার্যকলাপের বর্ণনা দিয়ে এটাই প্রমান করবো যে কিভাবে তিনি তাঁর এই ক্ষতিকর উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়ন করেছিলেন।



এটা দুঃখজনক যে, সূর্য আর চাঁদকে শেষ বিচারের দিনে হতভম্ব ষাঁড়ের মতো হাজির করা হবে, কা’ব-এর দেয়া এই বর্ণনাটি আবু হুরায়রা ও অন্যান্য সাহাবীদের মাধ্যমে বিভিন্ন ইসলামী বইয়ের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছে। ইবনে আব্বাস ক্রুদ্ধভাবে এই বর্ণনাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার পরও অন্যরা তাতে গুরুত্ব দেননি।



ইবনে কাসিরের তাফসির এবং ‘কানজুল উম্মাল’-এ আবু হুরায়রার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে: “শেষ বিচারের দিনে সূর্য এবং চাঁদ দুইটি হতভম্ব ষাঁড়ের মতো দোজখে থাকবে।”



“একজন তাঁকে প্রশ্ন করলো: তাদেরকে কোন পাপের জন্য শাস্তি দেয়া হবে?”



“আবু হুরায়রা উত্তর দিলেন: ‘নবীজী (সঃ) যা বলেছেন, আমি সেই কথাগুলোই আপনাদের বলছি। আর আপনি তাদের পাপের প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইছেন?”



এছাড়া আনাসের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে কাসির বলেছেন: “শেষ বিচারের দিনে সূর্য ও চাঁদ দুইটি হতভম্ব ষাঁড়ের মতো দোজখের ভেতরে থাকবে।”





“দুইটি হতভম্ব ষাঁড়”-এর গল্পটি নিয়ে পর্যালোচনা

আবু হুরায়রা এবং আনাসের বর্ণনাগুলোর উৎস আসলে কা’ব-এর বানানো গল্প। এই বর্ণনার মাধ্যমে তাঁরা নবীজী (সঃ)-এর উপর মিথ্যা আরোপ করেছেন।



যদি আমরা কোরানের আয়াত এবং রাসুল (সঃ)-এর নির্ভরযোগ্য হাদীসগুলো পড়ি, তাহলে দেখতে পাবো যে সেগুলো কা’ব-এর বর্ণনার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।



আমরা দেখতে পাই যে কা’ব-এর বর্ণনাগুলো নবীজীর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে, আর ইবনে আব্বাসও এগুলিকে ইহুদীদের বানানো সংযোজন বলে নিন্দা করেছেন। তাহলে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই বর্ণনাগুলোর উৎস কা’ব আল-আহবার নিজেই, নবীজী (সঃ)-এর কোনো সাহাবী নন।



ইসলাম ধর্মের গবেষকদের একথাটা মনে রাখতে হবে, কা’ব যে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ কিছু ইহুদী ধারণা ইসলামী পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, সেটা আবিষ্কার করার ব্যাপারে আমরাই প্রথম নই।



নবীজী (সঃ)-এর সহচরদের ভেতরেও অনেকে এটা বুঝতে পেরেছিলেন। ইবনে আব্বাস হলেন তাদের একজন, যিনি কা’ব-এর এইসব ইহুদী ধারণার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

যেহেতু কা’ব নবীজী (সঃ)-এর সাহাবী ছিলেননা, সেজন্য তিনি এই ইহুদী ধারণাগুলি সরাসরি নবীজী (সঃ)-এর উপর আরোপ করতে পারেননি। আবু হুরায়রাসহ বেশ কিছু সাহাবীর দেয়া বর্ণনার মাধ্যমে এই ধারণাগুলি ইসলামে প্রবেশ করানোটা কা’ব-এর জন্য সবচেয়ে সহজ ছিলো।



হাদীসের উপর বিশেষজ্ঞরা যারা সাহাবীদের দেখেছেন, কিন্তু নবীজী (সঃ)-কে দেখেননি বা তাঁর কথা শোনেননি, তাঁরা তখন কোনো একজন সাহাবীর উদ্ধৃতি দিয়ে এই ইহুদী ধারণাগুলি ইসলামী সংস্কৃতির উপর আরোপ করলেন।



আনাসের বর্ণনাগুলো দুর্বল বলে ধরা হলেও একই বিষয়ের উপর আবু হুরায়রার বর্ণনাগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরা হতো। এতে করে কা’ব-এর বানানো তথ্যগুলো আরো জোরালো ভিত্তি পেলো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু উৎসাহী লোকের কারনে এই বর্ণনাগুলি মানুষজন কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিতে লাগলো। এই কাজটা সবাই একসাথে করেছেন, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে। এদের মধ্যে ছিলেন মুসলিম হয়ে যাওয়া কিছু খ্রীষ্টান ও ইহুদী বিশেষজ্ঞ, নবীজী(সঃ)-এর কিছু সাহাবী এবং এমন কিছু মানুষ যারা সাহাবীদের দেখেছেন।



খলিফাদের মতাবলম্বীদের মাঝে বিশেষজ্ঞরা কা’ব এবং আবু হুরায়রার দেয়া এই বর্ণনাগুলি মেনে নিয়ে নিজেরাও সেভাবে বর্ণনা করতে লাগলেন। ফলে এই বর্ণনাগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো।





খ) মুসলিমদের প্রচারণার মাধ্যমে মুসলিমদের মাঝেই খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের বিভিন্ন সংস্কৃতির বিস্তার:

আমাদের আলোচ্য বিষয়ের উপর পরিষ্কার ধারণা দেয়ার জন্য আমরা নবীজী (সঃ)-এর দুইজন সাহাবীর দেয়া হাদীসের বর্ণনা এবং একটি তাফসির থেকে উদ্ধৃতি দেবো।



১. আবু হুরায়রা, নবীজী (সঃ)-এর একজন সাহাবী

ইতিহাসে এই সাহাবীর তিনটা আলাদা নাম উল্লেখ করা আছে। তবে তিনি কুনিয় নাম (নামের প্রথম অংশ, যেমন: আবু বা উম্মে) আবু হুরায়রা বা ‘বিড়ালের বাবা’ নামেই বেশি পরিচিত। তিনি ইয়েমেন-এর বনু দস গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। আবু হুরায়রা ইয়েমেন-এ তিরিশ বছর বসবাস করেন। খাইবারের যুদ্ধের পর তিনি মদিনায় আসেন। বুখারী, ইবনে সা’দ এবং অন্যান্য সাহাবীর ভাষ্যমতে আবু হুরায়রা রাসুল (সঃ)-এর জীবনের শেষ তিন বছর তাঁর সাথে ছিলেন। তবে ইতিহাস আরো বলে আবু হুরায়রা ৮ম হিজরীতে আলা হাদরামি-র নেতৃত্বে তার সৈন্যদলের সাথে বাহরাইনে যান। এই তথ্য থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তিনি রাসুল (সঃ)-এর সাথে তিন বছরেরও কম সময় ছিলেন। তিনি মদীনায় গরীব মুসলিমদের সাথে রাসুল (সঃ)-এর মসজিদে ‘সুফফাহ’ নামে পরিচিত আড়াআড়িভাবে রাখা একটি পাথরের উপর রাত্রিযাপন করতেন।



মুয়াবিয়া যখন সিরিয়া আর ইয়েমেনে তিরিশ হাজার নিরীহ মুসলিমকে গণহত্যার জন্য দায়ী কুখ্যাত কসাই বুশর-কে পাঠান, তখন আবু হুরায়রা এই বুশর-এর বদান্যতাতেই মদীনার গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।৩ মুয়াবিয়ার শাসনামলেও তিনি কিছু সময়ের জন্য সেখানকার গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন।৪



এই সময়টা ছিলো আবু হুরায়রার পক্ষে তাঁর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনা দেয়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময়। নবীজী (সঃ)-এর সাহাবীদের মধ্যে কয়েকজন পড়া আর লেখার ব্যাপারে পারদর্শী ছিলেন। তবে আবু হুরায়রা এই দলের মধ্যে ছিলেননা। বুখারী বর্ণনা দিয়েছেন, যে আবু হুরায়রা বলছেন: “আবদুল্লাহ বিন আমরু আস জানেন কিভাবে লিখতে হয়। কিন্তু আমি সেটা জানিনা।” যাদের কাছ থেকে আবু হুরায়রা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন, তাঁদের একজন হলেন কা’ব আল-আহবার। আবু হুরায়রার প্রশংসা করতে গিয়ে কা’ব বলেছেন:



“যারা তাওরাত না পড়েও এটা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন, তাঁদের মধ্যে আবু হুরায়রা সবচেয়ে সেরা।”৫



যেহেতু কা’ব আগে ইহুদী ধর্মযাজক ছিলেন, তিনি তাওরাত পড়েছেন এবং সে ব্যাপারে জ্ঞান রাখতেন। তাঁকে বাদ দিয়ে তাওরাত সম্পর্কে জানার দিক থেকে আবু হুরায়রা সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন।



ইবনে কাসির তাঁর বিবরণীতে বলেছেন: “আবু হুরায়রা ছিলেন প্রতারক। তিনি নবীজী (সঃ) আর কা’ব-এর কাছ থেকে যা শুনেছিলেন, সেগুলো প্রতারণামূলকভাবে একটার সাথে আরেকটাকে মিশিয়ে বলতেন। আলাদা করে বলতেননা।”



ইবনে কাসির আরো বলেছেন: “আমাদের সাথী আর বন্ধুরা আবু হুরায়রার বর্ণনা দেয়া হাদীসগুলোকে বাতিল করে দিয়েছেন।”



তিনি আরো বলেছেন: “তাঁরা আবু হুরায়রার বর্ণিত কোনো হাদীসই গ্রহণ করতেননা।”৬



আরো দুঃখের বিষয় হলো, আবু হুরায়রা নির্লজ্জভাবে নবীজী (সঃ)-এর বেশ কিছু হাদীসের বর্ণনা দিয়েছেন, যেগুলো আসলে পরষ্পরবিরোধী।



বুখারী তাঁর কিতাব আল তিব-এ আবু হুরায়রার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন: “নবীজী (সঃ) বলেছেন: ‘রোগ সংক্রমিত হয়না বা ছড়ায়না।’



তখন একজন আরব দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো: ‘হে নবী, মরুভূমিতে আমাদের অনেকগুলো সুন্দর উট আছে। সেখানে যখন একটি উটের কোনো ক্ষত বা ফোঁড়া হয়, সেটা অন্যান্য উটের ভেতরেও সংক্রমিত হয়।’



নবীজী (সঃ) তখন তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন: ‘প্রথম উটটা কিভাবে সংক্রমিত হয়েছিলো?’ ”



এই বর্ণনার পরে বুখারী আবারো আবু হুরায়রার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন: “আবু হুরায়রা বলেছেন: ‘নবীজী (সঃ) নির্দেশ দিয়েছেন যে, যারা অসুস্থ ও রোগাক্রান্ত, তাদের সুস্থ মানুষের কাছে যাওয়া উচিত না।’



তখন আবু হুরায়রার এক জ্ঞাতি ভাই আবু সালমাহ প্রশ্ন করলেন: ‘হে আবু হুরায়রা, আপনিই কি বলেননি যে নবীজী (সঃ) সংক্রমণে বিশ্বাস করতেননা?’



উত্তরে আবু হুরায়রা ইথিওপিয়ার ভাষায় কিছু একটা মন্তব্য করলেন। তখন সেই জ্ঞাতিভাই আবু হুরায়রাকে সমর্থন করে বলেন: ‘আজকের এই ব্যাপারটি বাদে আমি আবু হুরায়রাকে কখনো কোনো কিছু ভুলে যেতে দেখিনি।’ ”



নিশ্চিভাবে আবু সালমাহ এখানে আবু হুরায়রার বলা এই পরষ্পরবিরোধী কথাগুলোর পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে চাইছিলেন।



সেসময় একটি প্রবাদ চালু হয়েছিলো: “যদি কেউ আবু হুরায়রার মতো হন, তাঁর মধ্যে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা থাকবে।”





আবু হুরায়রার স্বীকারোক্তি

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে আবু হুরায়রা নিজে থেকেই এমন কিছু হাদীসের বর্ণনা দিয়েছেন, যেগুলো তিনি রাসুল (সঃ)-এর কাছ থেকে শোনেননি।

ইমাম আহমাদ হাম্বল তাঁর মসনদে এমন একটা বিষয়ের বর্ণনা দিয়েছেন: “..... আবু হুরায়রা একটি হাদীসের বর্ণনা দেয়ার পর শ্রোতারা তাঁকে প্রশ্ন করলো: ‘এটা কি নবীজী (সঃ) বলেছেন, নাকি আপনি নিজ থেকে বলছেন?’



আবু হুরায়রা বললেন: ‘এই হাদীসটা আমি নিজ থেকে বলছি।’ ”



বুখারীও এমন একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন: “আবু হুরায়রা এমনভাবে একটা বর্ণনা দিচ্ছিলেন যেনো তিনি সেটা নবীজী (সঃ)-এর মুখে শুনেছেন। তবে এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করলেন যে তিনি সেটা নিজ থেকেই বলেছেন।”



২. আবদুল্লাহ বিন আমর আস, ইহুদী ঐতিহ্যের ব্যাখ্যাকারী

আবদুল্লাহ বিন আমর আস (মৃত্যু ৬৫ হিজরী) ছিলেন রাসুল (সঃ)-এর একজন সাহাবী। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে মিশরীয় স্বর্ণের ভান্ডার পেয়েছিলেন। তিনি খুব ধনী একজন সাহাবী হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তাওরাত যে ভাষায় লেখা হয়েছে, সেই সিরিয়াক বা সুরিয়ানি ভাষা তিনি জানতেন।



ইয়ারমুকের যুদ্ধে তিনি তাঁর বাবার সেনাবাহিনীর পতাকা বহন করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে গনীমতের মাল হিসেবে তিনি দুই উট বোঝাই করা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় বই পেয়েছিলেন।৭



জাহাবী বলেছেন: “আবদুল্লাহ আহলে কিতাবদের বই থেকে বর্ণনা দিতেন। তিনি সবসময় এই বইগুলো পড়তেন, আর এগুলো পড়ার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিলো।”



ইবনে হাজার সহী বুখারীতে বর্ণনা করেছেন: “দামাস্কাস বিজয়ের সময় আবদুল্লাহ গনীমতের মাল হিসেবে উট বোঝাই করা ইহুদী আর খ্রীষ্টানদের বই পেয়েছিলেন। তিনি খুব যতেœর সাথে সেগুলো পড়তেন, আর এগুলোর উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিতেন। এ কারনে প্রখ্যাত তা’বীনগণ তাঁকে বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করতে বাধা দিতেন।”



আহমাদ হাম্বলের মসনদে আমরা দেখতে পাই: “আবদুল্লাহর কাছে এক লোক এসে বললো: ‘নবীজী (সঃ) -এর কাছে যেটা শুনেছেন, সেটা আমাকে বলেন। তাওরাত বা ইনজিলের কোনো গল্প বলবেননা।’ ”



আরেকটা বর্ণনায় আছে: “আবদুল্লাহকে বলা হলো: ‘নবীজী (সঃ)-এর কাছ থেকে যা শুনেছেন, সেটা বলেন। ইয়ারমুকে উটের পিঠে যা পেয়েছেন, সেগুলোর গল্প শোনাবেননা।’ ”৮



ইসলামী বিশেষজ্ঞরা এইসব বর্ণনার নাম দিয়েছেন ‘ইসরাইলিয়াত’, কারণ এগুলোর উৎস হলো তাওরাত এবং অন্যান্য ইহুদী গ্রন্থ।



যেসব মুসলিমরা আহলে বায়াত (আঃ)-এর শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেননা, তারা এমন অনেক হাদীস গ্রহণ করেছিলেন যেগুলো আল্লাহর দৈহিক অস্তিত্বের কথা বলছে। এই ধারণাটা ইহুদী বিশ্বাস থেকে এসেছে। আর এই ধরনের বর্ণনাগুলো দিয়েছেন কা’ব আল আহবার অথবা আবু হুরায়রা। পরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।





৩. মাকাতিল বিন সুলাইমান বলখি:

মাকাতিল বিন সুলাইমান বলখি জন্মগ্রহণ করেন বলখ নামক অঞ্চলে। ‘আজদ’ গোত্রের লোকজন তাঁকে মুক্ত করেছিলো। তারপর তিনি আবুল-হাসানের কুনিয়া নাম (আরবী নামের প্রথম অংশ। যেমন: আবু বা উম্মে) গ্রহণ করেন। তিনি বসরা ও বাগদাদে থাকাকালীন সময়ে নবীজী (সঃ)-এর অনেক হাদীসের বর্ণনা দিয়েছিলেন। খলিফাদের শাসনামলে তাঁকে কোরানের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্যের ব্যাপারে একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ বলে ধরা হতো।



তিনি যে বইগুলো লিখেছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে

১. তাফসির কবির (হাতে লেখা একটি বই, যেটা এখন মিশরে রয়েছে)।

২. নাওয়াদির অভ তাফসির।

৩. আল-আয়াত আল-মুতাশাবিহাত।

৪. আল-নাশিখ ওয়াল-মানসুখ।

৫. আল ক্বিরাত।

৬. আল-আসবাহ ওয়া আল-নাজাইর ফিল-কুরআনি আল-করিম।

৭. আল-জাওয়াবাত ফিল কুরআন।



মাকাতিল-এর জীবনী লিখতে গিয়ে ইবনে খাল্লিকান বর্ণনা করেছেন ইবনে হাব্বানের উদ্ধৃতি দিয়ে: “ইহুদী আর খ্রীষ্টানরা তাদের ধর্মগ্রন্থের উপর ভিত্তি করে যেভাবে কোরানের ব্যাখ্যা করতো, মাকাতিল সেগুলো গ্রহণ করেছিলেন।”



এরপর ইবনে খাল্লিকান আরো বলেছেন: “মাকাতিল হলেন তাঁদের মধ্যে একজন যারা আল্লাহর উপর মানুষের বৈশিষ্ট্য আর উপমা আরোপ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি হাদীসের বর্ণনা দেয়ার সময় মিথ্যা কথা বলতেন।”৯



খতিব বাগদাদী তাঁর তারিক এ বাগদাদ-এ উল্লেখ করেছেন: “একদিন মুহাম্মদ বিন সাইদ কলবি (মৃত্যু ১৪৬ হিজরী) মাকাতিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি শুনলেন যে মাকাতিল তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে একটা হাদীস বলছেন। তিনি তখন বললেন: হে মাকাতিল! আমি মুহাম্মদ বিন সাইদ কলবি, আর আপনি যেটা বলছেন এমন কথা আমি কখনোই বলিনি!’



মাকাতিল বললেন: ‘আমরা আমাদের হাদীসের বর্ণনার সাথে বিখ্যাত লোকদের নাম জুড়ে দেই।’ ”



তাহলে মাকাতিল বলেছেন যে তিনি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য তাঁর বর্ণনা করা হাদীসের সাথে বিখ্যাত লোকদের নামে জুড়ে দিতেন!



মুহাম্মদ বিন সাইদ কলবি আরো বলেছেন: “মাকাতিল আমার উদ্ধৃতি দিয়ে অনেক হাদীসের মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছেন, যেগুলো আমি কখনো বলিনি। তিনি তাঁর তাফসিরেও সেগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করেছেন।”



মাকাতিল সম্পর্কে বলতে গিয়ে খতিব বাগদাদী দুইজন লোকের মন্তব্য উদ্ধৃত করেন: “আমরা মাকাতিলের বলা একটা হাদীসের উৎস সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি বললেন: ‘আমি এটা জাহাকের কাছে শুনেছি।’



কয়েকদিন পরে আমরা আবার হাদীসটার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন: ‘আমি এটা আতা-র কাছে শুনেছি।’



আরো কয়েকদিন পরে বললেন: ‘এটা ঈসা-র কাছে শুনেছি।’ ”



“এই ঘটনার পরে, খতিব বাগদাদী বর্ণনা দিয়েছেন যে, একজন লোক মাকাতিলকে জিজ্ঞাসা করলো যে মাকাতিল এটা যার কাছে শুনেছেন বলে দাবী করছেন, সেই জাহাক-কে তিনি কখনো দেখেছেন কিনা। মাকাতিল বললেন: ‘হ্যা!’ তারপর আরো বললেন: ‘তাঁর এবং আমার মাঝে একটা বন্ধ দরজা ছিলো!’ ”



বাগদাদী ব্যাখ্যা করেছেন যে ‘বন্ধ দরজা’ বলতে মাকাতিল মদীনার দরজাকে বুঝিয়েছিলেন। জাহাক মদীনায় ছিলেন, আর মাকাতিল কখনোই মদীনায় যাননি।”



ইবনে খাল্লিকান বলেছেন: “মাকাতিল যার কাছ থেকে হাদীসগুলো শুনেছেন বলে দাবী করেন, সেই জাহাক বিন মাহাজিম মারা গিয়েছেন মাকাতিল জন্মানোর চার বছর আগে, আর তাঁকে মদীনায় কবর দেয়া হয়েছিলো!”



এরপরে তিনি আরো বলেছেন: “মুজাহিদের সাথে কখনো সাক্ষাত না করেই মাকাতিল তাঁর বর্ণনায় মুজাহিদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।”



খতিব বাগদাদী আরো একটা বর্ণনা দিয়েছেন: “এক লোক মাকাতিলকে বললো: ‘আমার এক বন্ধু আমার কাছে আসহাব-এ-কাহফের কুকুরের রংটা জানতে চেয়েছিলো। আমি উত্তর দিতে পারিনি।’



মাকাতিল তখুনি সেই লোককে বললেন: ‘বলে দেন কুকুরটার শরীরে ফুটকি দাগ আছে। কেউ একথার বিরোধিতা করবেনা।’ ”



এছাড়াও খতিব বাগদাদী আব্বাসীয় খলিফা মনসুর ও মাহদি-র উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে মাকাতিল একবার তাঁদের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে তাঁরা চাইলে তিনি তাঁদের পূর্বপুরুষ ইবনে আব্বাসের প্রশংসা করে কিছু হাদীস বানাবেন। কিন্তু তাঁরা দু’জনেই মাকাতিলের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।”১০



মাকাতিলের জীবন কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, এমন বিভিন্ন বইয়ে আমরা অনেক প্রতারণা আর প্রবঞ্চণার উদাহরণ দেখতে পাই। সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি, মাকাতিল এই ধারণাটার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন যে, ‘আল্লাহর আকার মানুষের মতো।’ তিনি তাঁর ইহুদী আর খ্রীষ্টান শিক্ষকদের কাছ থেকে কোরনের ব্যাখ্যা শিখেছিলেন, আর তাঁর লেখা তাফসিরে তাঁদের বিশ্বাসটাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন করা সত্ত্বেও এটা খুব আশ্চর্যজনক যে খলিফাদের শাসনামলে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা মাকাতিলের তাফসিরের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে: “তাফসির লেখার ক্ষেত্রে অন্য সবাই মাকাতিল বিন সুলাইমানের কাছে নগণ্য!”





খলিফাদের (১ম ৩ খলিফা)সমর্থনে মাকাতিল-এর বানানো গল্পের উদাহরণ

খতিব বাগদাদী তাঁর লেখা তারিক এ বাগদাদীতে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন: “মাকাতিল বলেছেন: ‘জাহাক আমাকে ইবনে আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে নবীজী (সঃ)-কে সাহাবীগণ তাঁর একজন উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে বললেন, যাতে করে মানুষ সেই উত্তরাধিকারীকে চিনতে পারে ও বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যার জন্য তাঁর কাছে যেতে পারে। তাঁরা নবীজী (সঃ)-কে বললেন: ‘আমরা জানিনা আপনি চলে গেলে কি ঘটবে।’



নবীজী (সঃ) উত্তর দিলেন: ‘যদি আমি তোমাদের আল্লাহর পথে পরিচালিত করার জন্য কাউকে মনোনীত করি, আর তোমরা তাকে অমান্য করো, তাহলে তোমরা আমার কথাকে অমান্য করবে, পাশাপাশি আল্লাহকেও অমান্য করবে। আর যদি এমন মনোনীত ব্যক্তি তোমাদের পাপের পথে পরিচালিত করে আর তোমরা তাকে মান্য করো, তাহলে শেষ বিচারের দিন তোমরা সবাই তার বলা কথার উদ্ধৃতি দেবে। না, আমি এমন কাজ কখনোই করবোনা। আমি বরং তোমাদের আল্লাহর হেফাজতে রেখে যাবো।’ ”







উপরে উল্লিখিত হাদীসটির মূল্যায়ন

উপরের হাদীসটি মাকাতিল খলিফাদের সমর্থনে উদ্ভাবন করেছিলেন, যারা দাবী করেন যে নবীজী (সঃ) কোনো উত্তরাধিকার মনোনীত করে যাননি, আর এমন কাউকে মনোনীত করার অধিকার মুসলিম জনসাধারণের আছে।



খতিব বাগদাদী মাকাতিল-এর জীবনী লিখতে গিয়ে তাঁর (মাকাতিল) অবিশ্বস্ততা ও প্রতারণাকে প্রমান করার জন্য এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তিনি যুক্তি দেখান যে মাকাতিলের ধৃষ্টতা এমন যে তিনি জাহাকের সাথে সাক্ষাত না করেই তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে হাদীসের বর্ণনা দিয়েছেন। জাহাক মদীনায় থাকতেন, অন্যদিকে মাকাতিল কখনোই খোরাসান থেকে মদীনায় ভ্রমণ করেননি। আর প্রকৃত সত্যটা হচ্ছে, মাকাতিলের জন্মের চার বছর আগেই জাহাক ইন্তেকাল করেন।



মুসলিমদের ধর্মবিশ্বাসে ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধারনার অনুপ্রবেশের এই উদাহরনটির সাথে আমরা তাওরাতের দুইটি গল্প উল্লেখ করাকে এখানে অপরিহার্য বলে মনে করছি। এই গল্পগুলোর সাহায্যে আমরা খলিফাদের লালন করা বিভিন্ন বিশ্বাস, বিশেষ করে ঐশ্বরিক বিভিন্ন বিষয়গুলিকে মূল্যায়ন করবো।



১. আদমের সৃষ্টি:

জেনেসিস-এর প্রথম অধ্যায়ের ২৭ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে: “তারপর ইশ্বর তাঁর নিজের আকৃতিতে মানুষ সৃষ্টি করলেন। ইশ্বরের আকৃতিতে তাকে সৃষ্টি করলেন। তিনি পুরুষ ও স্ত্রী সৃষ্টি করলেন।”



এরপরে গল্পটিতে বলা হয়েছে যে আদম ও হাওয়াকে (ইভ) তারপর স্বর্গের বাগানে রাখা হলো। তারপর আল্লাহ তাঁদের “ভুল পথে পরিচালিত করলেন”।



“কিন্তু ভালো আর মন্দের এই যে জ্ঞানবৃক্ষ, তোমরা এর ফল খাবেনা। কারন যদি এই ফল খাও, তাহলে তোমরা নিশ্চিতভাবে মারা যাবে।”১১



তখন সাপ, “ইশ্বর যাকে তাঁর সৃষ্ট জীবের মধ্যে সবচেয়ে ধূর্ত করে সৃষ্টি করেছেন”, সে বললো: “তোমরা অবশ্যই মারা যাবেনা। আসল কারন হলো ইশ্বর জানেন যে তোমরা যদি ঐ ফল খাও, তাহলে তোমাদের চোখ খুলে যাবে। তোমরা ইশ্বরের মতো হয়ে যাবে, আর ভালো-মন্দ বিচার করতে পারবে।”



“তারপর স্ত্রীলোকটি দেখলো যে গাছের ফল খাদ্য হিসেবে ভালো, আর সেটা চোখের জন্য আনন্দদায়ক, এবং গাছের ফলটি খেলে জ্ঞানী হওয়া যাবে। তাই সে একটি ফল তুলে নিলো আর খেয়ে ফেললো। তারপর সে তার স্বামীকে ফলটা খেতে দিলো, এবং সে ও ফলটা খেলো।”



“তখন তাদের দু’জনেরই চোখ খুলে গেলো, আর তারা বুঝতে পারলো যে তারা নগ্ন।”



“একদিন স্বর্গের বাগানে হেঁটে বেড়ানোর সময় তারা ইশ্বরের গলার আওয়াজ পেলো। আদম ও ইভ তখন ইশ্বরের কাছ থেকে পালিয়ে থাকার জন্য বাগানের গাছগুলির পেছনে লুকালো।”



“তখন ইশ্বর আদমকে ডাক দিলেন এবং তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তুমি কোথায়?’ ”



“তখন সে বললো, ‘আমি বাগানে আপনার কন্ঠ শুনেছি। আর আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি, কারন আমি নগ্ন অবস্থায় আছি। সেজন্য নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি।’”



“তখন ইশ্বর বললেন, ‘তোমাকে কে বলেছে যে তুমি নগ্ন? তুমি কি সেই গাছের ফল খেয়েছো, যে ফল খেতে তোমাদের নিষেধ করেছিলাম?’”



“আদম কথাটা স্বীকার করলো। ইশ্বর তখন আদম, ইভ ও সাপকে অভিশাপ দিলেন, এবং পৃথিবীতে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করার নির্দেশ দিলেন।”



“তারপর ইশ্বর বললেন, ‘দেখো, এই মানুষ এখন আমাদের একজন যে ভালো-মন্দের প্রভেদ জানে! এখন সে জীবনের গাছের দিকে হাত বাড়িয়ে তার ফলটাও খাবে, এবং সারাজীবন বেঁচে থাকবে’ ”



“তিনি আদমকে তাড়িয়ে দিলেন, এবং স্বর্গের উদ্যানের পূর্ব পাশে এক দেবদূতকে পাহারায় বসালেন যার হাতে একটি জ্বলন্ত তরবারি যেটা সবদিকে চলাচল করতে পারে। আদমকে তিনি পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্য পাঠালেন।”১২





২. ইশ্বরের সাথে জ্যাকব (ইয়াকুব)-এর মল্লযুদ্ধ

এক রাতে জ্যাকব ইশ্বরের সাথে মল্লযুদ্ধ করলেন ভোর পর্যন্ত, কিন্তু ইশ্বর তাকে পরাভূত করতে পারলেননা।



“জ্যাকব সেখানে একা ছিলেন, এবং একজন মানুষের সাথে ভোর পর্যন্ত মল্লযুদ্ধ করলেন।”



“ইশ্বর বললেন, ‘আমাকে যেতে দাও, এখন ভোর হয়ে গেছে।’ জ্যাকব বললেন, ‘ আপনাকে যেতে দেবোনা, যতোক্ষণ না আমাকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন।”



“তখন ইশ্বর বললেন, 'তোমাকে এখন থেকে আর জ্যাকব বলে ডাকা হবেনা। তোমাকে ডাকা হবে ইসরায়েল বলে, কারণ একজন রাজপুত্র হয়ে তুমি ইশ্বরের সাথে ও মানুষের সাথে লড়াই করে টিকে রয়েছো।”



“এবং জ্যাকব সেই স্থানটির নাম দিলেন পেনিয়েল। কারন এখানেই আমি ইশ্বরকে মুখোমুখি দেখেছি, এবং আমার জীবন সুরক্ষিত।”১৩





এই গল্পগুলোর অর্খ

এখানে এটা স্পষ্ট যে ইহুদীদের ইশ্বর নগন্য ও সাধারণ। তিনি মিথ্যা বলেন এবং যেকোন স্বার্থপর মানুষের মতো তিনি প্রতারণা আর প্রবঞ্চনা করেন।



তিনি আদমকে মিথ্যা বলেছিলেন যে ঐ গাছের ফল খেলে সে মারা যাবে। তারপর সাপ আদমের কাছে এই ভাওতাবাজিটা প্রকাশ করে দেয় এবং তাকে ফলটি খেতে প্রলুব্ধ করে। তখন আদম ইশ্বরের মতো হয়ে গেলেন, ভালো-মন্দের প্রভেদ বুঝতে পারলেন, আর উপলব্ধি করলেন যে তিনি নগ্ন। তারপর নিজেকে ইশ্বরের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলেন। সেজন্য আদম, ইভ ও সাপ, এই তিনজনকে ইশ্বর পৃথিবীতে পাঠালেন দুর্ভোগ আর পরিশ্রমের জন্য।



তাওরাতের কথা অনুযায়ী, ইশ্বর বা আল্লাহর শরীর আছে,এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যান, মল্লযুদ্ধ করেন, আর কেউ লুকিয়ে থাকলে তাকে খুঁজে পাননা।



তাওরাতের গল্পগুলি এমনই হাস্যকর।







তাওরাতের প্রভাব

বর্তমানের বিকৃত তাওরাতের কথাগুলো আমাদের উপর যে সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলেছে, তাতে পৃথিবীর মানুষ প্রধানত দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে।



১. কিছু মানুষ এটা দেখে শঙ্কিত হয়ে যায় যে এই বইগুলো মহান পয়গম্বর মুসা (আঃ) এবং ঈসা (আঃ)-এর উপর নাজিল হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে প্রচুর ভুল রয়েছে। অনেক গল্প রয়েছে, যেগুলো ব্যবহারিক বিজ্ঞানের সাথে পরষ্পরবিরোধী। এছাড়াও সেই কথাগুলো অনৈতিক আর অযৌক্তিক। এতে করে তারা সব ধর্মগ্রন্থকেই ত্যাগ করে, আর চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে বস্তুবাদী হয়ে যায়।



২. আর এক দল মানুষ এইসব অযৌক্তিক কথায় কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও তাদের নিজ নিজ ধর্মে অবিচলিত থাকে। এদের মধ্যে তিনটা শ্রেণীবিভাগ আছে।



(ক) ইহুদী:

ইহুদীরা তাওরাতে বিভিন্ন কথার বিকৃতি আর সংযোজনের জন্য দায়ী। তাদের জীবন যাপন আর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এই বিকৃতি প্রতিফলিত হয়। তারা তাদের সন্তানদেরও ছল-চাতুরি, মিথ্যা বলা আর প্রতারণা করা শেখায়। তারা নিজেদের ইসরায়েলের সন্তান মনে করে, সেই ইসরায়েল যে ইশ্বর আর মানুষের সাথে মল্লযুদ্ধ করেছেন। এছাড়াও তারা মনে করে যে তারাই হলো মনোনীত জাতি। তারা যে কোনো উপায়ে নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়, হোক সেটা প্রতারণা বা গণহত্যা। এছাড়াও তারা সেই রাসুলকে বিশ্বাস করে যিনি “তরবারি দিয়ে সবাইকে আঘাত করেছেন। সবাইকে ধ্বংস করেছেন, যাতে সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলার জন্যও কেউ বেঁচে না থাকে।”১৪



(খ) খ্রীষ্টান:

এটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে ইশ্বর বা আল্লাহর মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে আসার যে ধারণাটা তাওরাতে আছে, সেটা খ্রীষ্টানদের বিশ্বাসকেও প্রভাবিত করেছে যে ইশ্বর একজন পিতা এবং তাঁর পুত্র আছে। ইউরোপে বেশির ভাগ লোকই খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থকে তারা তাদের বাইবেলের প্রথম অংশ বানিয়েছে। তাদের ধর্মে বস্তুবাদের উত্থান আর প্রচারণা এইসব অযৌক্তি ধারণা থেকে এসেছে, যা বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদনে সাড়া দিতে অক্ষম।



(গ) মুসলিম

খলিফাদের শাসনামলে মুসলিম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ইহুদী সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের বিস্তারের ফলে আল্লাহর দৈহিক অস্তিত্বের ধারণাটা মুসলিমদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহর উপর আরোপ করা হয়েছে মানুষের আকৃতি। খলিফাদের সময়ে এইসব বিকৃত ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন ধারণাগুলো গ্রহণ করার পর কোরানের বেশ কিছু অংশের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বইগুলোর মাধ্যমে। এমনকি ইসলামের প্রধান মতবাদ তাওহিদের ধারণাকেও অনুমানের উপর ভিত্তি করে সংকুচিত করা হয়েছে।



যখন আল্লাহর সত্যিকারের ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করে তাকে অপবিত্র করা হয়, তখন সত্যিকারের বিশ্বাসেরও অবনতি হয়।



এবারে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন বর্ণনার আক্ষরিক ও রূপক অর্থ নিয়ে আলোচনা করবো।

চলবে..................

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.