![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মুয়াবিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত পরিত্যাগকারী রাসুলের(সাঃ) শিয়া।শিয়া মানে অনুসারী।আমি আল্লাহর অনুসারী,রাসুলের(সাঃ) অনুসারী।ডঃ তিজানী সামাভী বলেন,শিয়ারা রাসুলের(সাঃ) সুন্নত পালন করছে।
অধ্যায় ৩
আল্লাহর “চোখ”
খলিফাদের মতাবলম্বীরা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন
খলিফাদের মতাবলম্বীদের মধ্যে যেসব বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁরা বিভিন্ন তাফসির ও হাদীসের বর্ণনায় আবু হুরায়রা-র উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আবু হুরায়রা বলেছেন;
“যখন নবীজী (সঃ) এই আয়াতটা তেলাওয়াত করছিলেন:
“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে যাবতীয় আমানত তার হকদারের কাছে সোপর্দ করে দাও। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকাজ পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়নতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দেন তা কতো উৎকৃষ্ট! নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু দেখেন এবং সবকিছু শোনেন।”
(সুরা আল নিসা: আয়াত ৫৮)
তখন আমি দেখলাম যে নবীজী (সঃ) তাঁর নিজ কানের পাশে এবং চোখের সামনে আঙ্গুল রেখে আল্লাহর শোনা এবং দেখা-কে বোঝাচ্ছেন।”
আবু হুরায়রা যখন এই গল্পটা বলছিলেন, তখন তিনিও নিজের কানের পাশে এবং চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে ব্যাপারটা সবাইকে বোঝাচ্ছিলেন। এই অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তিনি এটা বোঝাতে চাইছিলেন যে, আল্লাহ কানের সাহায্যে শোনেন এবং চোখের সাহায্যে দেখেন।
“জামিয়াহ” নামে মুসলিমদের মধ্যে একটি দল এ প্রকারের ধারণাগুলির বিরোধিতা করে এবং এগুলো প্রত্যাখ্যান করে। আবু দাউদ তাঁর বিখ্যাত বই “সুন্নান”-এ লিখেছেন:
“আবু হুরায়রার বর্ণিত হাদীসগুলি জামিয়াহদের (যারা বিশ্বাস করে আল্লাহর কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই!) বিশ্বাসের যুক্তিকে খন্ডন করেছে।”
আবু হুরায়রার বর্ণিত এইসব হাদীসের প্রভাবে খলিফাদের মতাবলম্বীরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, কোরানে যখনই আল্লাহর কথা বলতে গিয়ে ‘আইন’ শব্দটা উল্লেখ করা হবে, তখন ধরে নিতে হবে যে সেটা আল্লাহর চোখ - তাঁর শরীরের একটি অংশ যার সাহায্যে কোনো কিছু দেখা যায়। সেজন্যই আমরা দেখি যে ইবনে খুজাইমাহ, যাকে খলিফাদের মতাবলম্বীরা বলেন ‘ইমামগণের ইমাম’, তিনি তাঁর লেখা ‘তাওহিদ’ বইটিতে একটা আলাদা অধ্যায়ই লিখেছেন শুধু এটা প্রমান করার জন্য যে আল্লাহ, যিনি সর্বশক্তিমান, তাঁর চোখ আছে।
তিনি লিখেছেন:
“আমরা এখন দেখবো আল্লাহর যে চোখ আছে, এ ব্যাপারে কিভাবে আল্লাহ তাঁর প্রেরিত কিতাব-এ এবং তাঁর প্রেরিত নবী (সঃ) বিভিন্ন কথাবার্তায় নিশ্চিত করেছেন।”
এরপর তিনি কোরান থেকে কয়েকটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেন:
১. [আল্লাহ নবী নূহ (আঃ)-কে বলছেন]
“এবং আমার চোখের সামনে একটি নৌকা তৈরীর কাজ শুরু করো .....”
(সুরা হুদ: আয়াত ৩৭)
২. [নূহ (আঃ)-এর নৌকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে]
“নৌকাটি চলবে আমার চোখের সামনে”
(সুরা আল কামার: আয়াত ১৪)
৩. [নবী মুসা (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে]
“আমি আমার নিকট হতে তোমার উপর ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম, যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও”
(সুরা তা-হা: আয়াত ৩৯)
৪. [নবীজী মুহাম্মদ (সঃ)-কে উদ্দেশ্য করে]
“ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়। কারন তুমি আমার চোখের সামনেই রয়েছো।”
(সুরা তুর: আয়াত ৪৮)
ইবনে খুজাইমাহ বলেছেন:
“কোরানের এই আয়াতগুলি বিবেচনা করে সব বিশ্বাসীদের এটা বিশ্বাস করা কর্তব্য যে আল্লাহর চোখ আছে। তিনি নিজেই কোরানে একথাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।”
“আর আল্লাহ তার অবতীর্ণ কিতাবে যা কিছু বলেছেন আর নিজের উপর যে বৈশিষ্ট্যগুলি আরোপ করেছেন, এগুলো যে বিশ্বাস করেনা, নিশ্চয়ই সে মুসলিম নয়।”
“নবীজী (সঃ) নিজেই অনেকবার কোরানের বিভিন্ন আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন। কারন আল্লাহ তাঁকে পবিত্র কোরানে নির্দেশ দিয়েছেন:১৯
“আমি তোমার প্রতি কোরান অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিলো, যাতে তারা চিন্তা করে।”
(সুরা আল নাহল: আয়াত ৪৪)
এরপর ইবনে খুজাইমাহ বলেছেন:
“নবীজী (সঃ) তাঁর ব্যাখ্যায় পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে আল্লাহর দুইটি চোখ আছে! তাঁর এই ব্যাখ্যা কোরানের কথার সাথে মিলে যায়। সেই একই কোরান যেটা দুইটা মলাটের মধ্যে আবৃত, আর যে বইটি বিভিন্ন মসজিদ আর স্কুলে পড়ানো হয়।”
এই যুক্তি দেয়ার পর তিনি হাদীসেরও উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে আছে আবু হুরায়রার বর্ণনা দেয়া এই হাদীসটি। সবশেষে তিনি আবদুল্লাহ বিন ওমর-এর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন:
“নবীজী (সঃ) বলেছেন, “আল্লাহর এক চোখ অন্ধ নয়, দাজ্জাল যেরকম ডান চোখে দেখতে পায়না, যেটা আঙ্গুরের বীজের মতো ভাসমান।”
আহলে বায়াত (আঃ)-এর মতাবলম্বীরা যেভাবে এই “চোখ”-এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন
আহলে বায়াত (আঃ)-এর ইমামগণ কোরানের এই আয়াতগুলির সঠিক ব্যাখ্যাটাই দিয়েছেন। তবে, তার আগে আমরা কোরানের এই আয়াতগুলি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করবো।
ইবনে খুজাইমাহ কোরানে উল্লিখিত ‘আইন’ বা ‘আইউনিয়া’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থটাই গ্রহণ করেছেন এটা প্রমান করার জন্য যে এখানে আল্লাহর চোখকেই বোঝানো হচ্ছে। সত্যি বলতে আরবী ‘আইন” শব্দটির অনেকগুলি অর্থ হতে পারে। বিস্তারিত জানার জন্য পাঠকগণ বিখ্যাত আরবী অভিধান “লিসানুল আরব” পড়তে পারেন। মুজামুল উদাবা (২/১১)-তে ইবনে ফারিস আহমেদ বিন জাকারিয়া (মৃত্যু ৩৬৯ হিজরী)-এর লেখা আল্লাহর প্রশংসামূলক বচনে আমরা দেখি যে প্রতিটি শ্লোক শেষ হয়েছে ‘আইন’ শব্দটা দিয়ে, আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তার অর্থ ভিন্ন। সৈয়দ মুহসিন আল-আমিনও এরকম একটি প্রশস্তি বচন লিখেছেন যেখানে ৬০টি শ্লোক রয়েছে।
পবিত্র কোরানে এই শব্দটি আক্ষরিক ও রূপক, দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কোরানে মোট ২১ জায়গায় এই ‘আইন’ শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে পানির প্রবাহ বা নদী।
ইবনে খুজাইমাহ কোরানের যে শব্দগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, আসলে তার সবগুলোই রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যখন আমরা বলি ‘কোনো কিছুর উপর চোখ রাখছি’, তার অর্থ হলো ‘কোনো কিছুর তত্ত্বাবধান করছি’। ‘আইনের চোখে’, এর অর্থ হলো ‘আইনের বিচারে বা মত অনুযায়ী’। ‘গম্বুজের চোখ’-এর অর্থ হলো ‘তার কেন্দ্রীয় অংশ’। অবশ্যই এই শব্দগুলোর অর্থ আক্ষরিক নয়। আসলে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে রূপক অর্থে।
মিশরে প্রকাশিত হওয়া বিখ্যাত মাজমা আল লুগাত আল আরাবিয়াহ-এ আমরা দেখি:
“পবিত্র কোরানে ‘আইন’ শব্দটি আক্ষরিক ও রূপক, দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নীচের আয়াতগুলির কথা বলা যায়:
১. “ফিরআওনের স্ত্রী বললো, এই শিশু তোমার ও আমার নয়ন-প্রীতিকর .....”
(সুরা আল কাসাস: আয়াত ৯)
২. [মরিয়ম (আঃ)-এর প্রতি]
“সুতরাং আহার করো, পান করো ও চোখ জুড়াও”
(সুরা মারইয়াম: আয়াত ২৬)
এখানে এটা পরিষ্কার যে এই আয়াতগুলিতে ‘আইনান’ বা ‘আইনিন’ শব্দটি দিয়ে আনন্দ ও সন্তষ্টির কথা বোঝানো হয়েছে।”
কিন্তু এই একই মাজমা আল লুগাত আল আরাবিয়াহ-এ আমরা দেখতে পাই, কোরানের কিছু আয়াতে এই শব্দগুলো রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু ইবনে খুজাইমাহ সেগুলোর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করেছেন, সেসব ক্ষেত্রে মিশরীয় বিশেষজ্ঞরা কোনো কথাই বলছেননা।
রাগিব ইস্পাহানি আরবী সাহিত্য ও কোরানের বৈজ্ঞানিক বিষয়ের উপর একজন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ। তাঁর লেখা তাফসিরটি সব মুসলিম বিশেষজ্ঞ বিনা বাক্যে মেনে নেন। তিনি সেখানে লিখেছেন যে ইবনে খুজাইমাহ যে চারটি জায়গায় ‘আইন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘চোখ’ গ্রহণ করেছেন, তার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আসলে রূপক অর্থটি গ্রহণ করতে হবে।
পবিত্র কোরান আমাদের বলছে যে আল্লাহ নবী মুসা (আঃ)-এর মা’কে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে (মুসাকে) নদীর মধ্যে ফেলে দিতে। নদীতে ভাসতে ভাসতে শিশু মুসা (আঃ) ফেরাউনের প্রসাদে গিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে ফেরাউনের ছেলে হিসেবে তিনি বড়ো হয়ে উঠলেন। এখানে সম্পূর্ণ আয়াত হলো:
“ফিরআওনের স্ত্রী বললো, এই শিশু তোমার ও আমার নয়ন-প্রীতিকর । একে হত্যা কোরোনা। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে। আমরা একে সন্তান হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি।.”
(সুরা আল কাসাস: আয়াত ৯)
“তুমি দুঃখ কোরোনা। তোমার পায়ের নীচে প্রতিপালক এক পানির প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন। তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের গোড়া ধরে নাড়া দাও। গাছটি তোমাকে পাকা খেজুর দান করবে। সুতরাং আহার করো, পান করো ও চোখ জুড়াও”
(সুরা মারইয়াম: আয়াত ২৪-২৬)
এখন ইবনে খুজাইমাহ-এর উদ্ধৃতি দেয়া আয়াতগুলি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। প্রথম আয়াতটিতে নবী নূহ (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিলো। আয়াতটির অর্থ হলো: “আমার তত্ত্বাবধান ও আশ্রয়ে নৌকা বানানোর কাজ শুরু করো।”
দ্বিতীয় আয়াতটির অর্থ হলো, নূহ নবীর নৌকাটি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে ভেসে চলেছে।
তৃতীয় আয়াতটিতে আল্লাহ নবী মুসা (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলছেন। আয়াতটির সঠিক অর্থ হলো:
“আমি আমার নিকট হতে তোমার উপর ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম, যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হও”
আর চতুর্থ আয়াতটি বলা হয়েছে আমাদের নবীজী মুহাম্মদ (সঃ)-কে উদ্দেশ্য করে। আয়াতটির অর্থ হলো:
“ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়। কারন তুমি আমার প্রিয় এবং আমার আশ্রয়েই আছো।”
এছাড়াও আবদুল্লাহ বিন ওমর একটি হাদীসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে আল্লাহ দাজ্জাল বা খ্রীষ্টবিরোধীর মতো এক চোখ অন্ধ নন। এই কথা থেকে বোঝা যায় যে আবদুল্লাহ বিন ওমর বলতে চাইছেন, আল্লাহর দুইটা চোখই আছে, সুস্থ এবং সবল!
উপরের আলোচনার উপর ভিত্তি করে আমরা এটা বলতে পারি যে, আবু হুরায়রা এবং তাঁর মতো আরো অনেকে ইহুদী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যেগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এভাবে বিকৃত হওয়া তাওরাত এবং অনৈসলামিক বিভিন্ন বইয়ের ধারণার প্রভাবে ইসলামের বিশুদ্ধ বিশ্বাসের ধারাটি দূষিত হয়ে পড়েছে।
অধ্যায় ৪
আল্লাহর “হাত”
খলিফাদের মতাবলম্বীরা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন
খলিফাদের মতাবলম্বীদের মধ্যে থেকে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের লেখা বইয়ে আবু হুরায়রা-র উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছেন যে নবীজী (সঃ) বলেছেন:
“আদম (আঃ) ও মুসা (আঃ)-এর ভেতরে কথোপকথন হয়েছিলো:
মুসা (আঃ) বললেন: ‘হে আদম! আল্লাহ আপনাকে তাঁর নিজের হাতে বানিয়েছেন। ... কিন্তু আপনার পাপের কারনে আল্লাহ মানুষ জাতিকে বেহেশতের বাগান থেকে নামিয়ে এনেছেন।’
আদম (আঃ) উত্তর দিলেন: ‘হে মুসা! আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে সম্মানিত করেছেন এবং আপনার জন্য তাওরাত তাঁর নিজের হাতে লিখেছেন।”
আবু হুরায়রা বর্ণিত এরকম আরেকটি হাদীসে আমরা দেখি:
“আল্লাহ প্রথম আসমানের বেহেশতে নেমে আসলেন। এবং তাঁর দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আঙ্গুল’। ”
পবিত্র কোরানে আল্লাহর কথা বলতে গিয়ে কোথাও ‘আঙ্গুল’ শব্দটা উল্লেখ করা হয়নি। তাই ইবনে খুজাইমাহ যখন প্রমান করছেন যে আল্লাহর আঙ্গুল আছে, তখন তাঁকে শুধু এই হাদীসটার উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। এই হাদীসগুলির বর্ণনা তাওহীদ এ ইবনে খুজাইমাহ সহ সহী বুখারী, সহী মুসলিম, সুন্নান এ তিরমিজি, সুন্নান এ ইবনে মাজাহ, এবং তাবারি, ইবনে কাসির ও সুরতীর বিভিন্ন তাফসিরে রয়েছে।
এরকম একটি হাদীস হলো:
“আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন যে একবার এক ইহুদী ধর্মযাজক নবীজী (সঃ)-এর কাছে এসে বললো: হে মুহাম্মদ! আমরা তাওরাতে পড়েছি যে ইশ্বর স্বর্গকে রাখেন এক আঙ্গুলের উপর, গাছগুলিকে এক আঙ্গুলের উপর, পানিকে এক আঙ্গুলের উপর, পৃথিবীকে এক আঙ্গুলের উপর এবং তাঁর সব সৃষ্ট জীবকে এক আঙ্গুলের উপর! এবং তারপর তিনি বলেন, “আমিই রাজা!”
নবীজী (সঃ) সেই ইহুদী ধর্মযাজকের দিকে তাকিয়ে সম্মতির হাসি দিলেন। তারপর তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে কোরানের একটি আয়াত বললেন:
“তারা আল্লাহকে যথোচিত সম্মান করেনা। কেয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী তাঁর হাতের মুষ্ঠিতে থাকবে এবং আকাশন্ডলী ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে থাকবে। ”
(সুরা আল যুমার: আয়াত ৬৭)
আবু হুরায়রা এবং তাঁর মতো আরো অনেকের বর্ণিত হাদীসের প্রভাবে খলিফাদের মতাবলম্বীদের মাঝে বিশেষজ্ঞরা যখনই কোরানের কোথাও ‘ইয়াদুল্লাহ’ শব্দটা দেখেছেন, তখনই সেটার আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করেছেন।
ইবনে খুজাইমাহ তাঁর লেখা বই ‘তাওহিদ’-এ একটা অধ্যায়ের শিরোনাম হলো: “সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর যে হাত আছে, তার প্রমান।” সেখানে তিনি লিখেছেন:
“অবশ্যই আল্লাহর দুইটি হাত আছে। আমার পবিত্র কোরানের আয়াত থেকেই এই কথাটা জানতে পারি।”২০
এরপর তিনি তাঁর বক্তব্যের পক্ষে কোরানের কয়েকটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেন:
১. “ইহুদীগণ বলে, ‘আল্লাহর হাত রুদ্ধ। আসলে তারাই রুদ্ধহস্ত। এবং তারা যা বলে, সেজন্য তারা অভিশপ্ত। আল্লাহর দুই হাতই প্রসারিত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা দান করেন.....”
(সুরা মায়িদা: আয়াত ৬৪)
২. “অতএব পবিত্র ও মহান তিনি, যার হাতে প্রত্যেক বিষয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব। এবং তাঁর কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।”
(সুরা ইয়াসীন: আয়াত ৮৩)
৩. হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও। যাকে ইচ্ছা পরাক্রমশালী করো, আর যাকে ইচ্ছা তুমি হীন করো। কল্যাণ তোমার হাতেই। নিশ্চয়ই তুমি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।”
(সুরা আলে ইমরান: আয়াত ২৬)
এবারে আমরা আহলে বায়াত (আঃ)-এর মতাবলম্বীদের দৃষ্টিভঙ্গিটা পর্যালোচনা করবো।
আহলে বায়াত (আঃ)-এর ব্যাখ্যা
(ক) মুহাম্মদ বিন মুসলিম কোরানের একটি আয়াত সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মদ বাকির (আঃ)-এর কাছে জানতে চাইলেন:২১
“.... হে ইবলিস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হতে তোমাকে কিসে বাধা দিলো? ...”
(সুরা সাদ: আয়াত ৭৫)
ইমাম বাকির (আঃ) উত্তর দিলেন: ‘ এখানে আরবী ‘ইয়াদ’ (হাত) শব্দটা দিয়ে ক্ষমতা এবং উদারতার কথা বোঝানো হয়েছে।
তারপর তিনি পবিত্র কোরানের বাক্যালঙ্কারে ব্যবহৃত আরো কিছু শব্দের উদাহরণ দিলেন, যেগুলোর রূপক অর্থ গ্রহণ করতে হবে। তাঁর দেয়া উদাহরণগুলোর কয়েকটা নীচে দেয়া হলো:
১. “স্মরণ করো আমার বান্দা দাউদের কথা, যার ছিলো হাত ....”
(সুরা সাদ: আয়াত ১৭)
ইমাম বাকির (আঃ) এখানে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এখানে ‘হাত’ শব্দটা রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ এখানে বোঝাতে চাইছেন যে তিনি দাউদ (আঃ)-কে অনেক শক্তিশালী করে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর তিনি দাউদ (আঃ)-এর শক্তিমত্তার বর্ণনা দিয়েছেন।
২. “আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার হাতে ...”
(সুরা যারিয়াত: আয়াত ৪৭)
ইমাম বাকির (আঃ) বলেছেন: এখানে ‘হাত’-এর অর্থ হলো ‘ক্ষমতা’।
৩. “এবং তাদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন রূহ দ্বারা ....”
(সুরা আল মুজাদালা: আয়াত ২২)
এই আয়াতে ‘হাত’ শব্দটা দিয়ে কাউকে শক্তিশালী করাকে বোঝানো হচ্ছে।
আরবী সাহিত্য থেকে উদাহরণ দিয়ে ইমাম বাকির (আঃ) বললেন:
১. কেউ হয়তো বললো, ‘তার অনেক হাত আমার সাথে আছে।’
এই কথাটার অর্থ হলো ‘তার অনুগ্রহের জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ’।
২. এছাড়াও আরবীতে একটা কথা প্রচলিত আছে: ‘আমার উপরে তার সাদা হাত আছে।’
এর অর্থ হলো: ‘সে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে’। এখানে ‘হাত’ বলতে ‘বদান্যতা’-কে বোঝানো হয়েছে।
(খ) মুহাম্মদ বিন উবাইদাহ সুরা সাদ-এর ঐ একই আয়াত নিয়ে ইমাম রিজা (আঃ)-এর কাছে প্রশ্ন করেছিলেন। ইমাম উত্তর দিয়েছিলেন: “এখানে ‘নিজের হাত’ বলতে আল্লাহ বুঝিয়েছেন তাঁর শক্তি এবং ক্ষমতাকে।”২২
(গ) সুলেইমান বিন মাহরান বর্ণনা দিয়েছেন যে তিনি ইমাম জা’ফর সাদিক (আঃ)-কে কোরানের একটি আয়াতের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যেখানে আল্লাহ বলেছেন:
“কেয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী তাঁর হাতের মুষ্ঠিতে থাকবে ............. ”
(সুরা আল যুমার: আয়াত ৬৭)
ইমাম সাদিক (আঃ) উত্তর দিলেন: “এখানে সর্বময় নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্বের কথা বলা হয়েছে, যেখানে তাঁর কোনো অংশীদার নেই।”
মুহাম্মদ বিন উবাইদাহ তারপর আয়াতটির বাকি অংশের অর্থ জানতে চাইলেন:
“..... এবং আকাশন্ডলী ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে থাকবে..... ”
(সুরা আল যুমার: আয়াত ৬৭)
ইমাম সাদিক (আঃ) ব্যাখ্যা করলেন: “ আল্লাহ এখানে ব্যবহার করেছেন আরবী শব্দ ‘ইয়ামিন’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘হাত’। এখানে হাত দিয়ে তাঁর শক্তি ও ক্ষমতাকে বোঝানো হচ্ছে। আকামন্ডলী ভাঁজ হয়ে যাবে তাঁর শক্তিতে।
এই আয়াতে ‘হাতের মুষ্ঠি’ অথবা ‘ডান হাত’-এই শব্দগুলো দিয়ে আল্লাহর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বোঝানো হচ্ছেনা, খলিফাদের মতাবলম্বীরা যেভাবে এর ব্যাখ্যা করে থাকেন।
আল্লাহর শরীর এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কথা কল্পনা করাটাও এক ধরনের শিরক। সেজন্যই ইমাম সাদিক (আঃ) তাঁর উত্তর শেষ করার পর আয়াতটির বাকি অংশটা পড়েছেন:
“....আল্লাহ পবিত্র ও মহান! তারা যাকে শরীক করে, তিনি তার উর্ধ্বে।”২৩
(সুরা আল যুমার: আয়াত ৬৭)
পর্যালোচনা
আহলে বায়াত (আঃ) তাওহিদের সঠিক অর্থের উপর ভিত্তি করেই তাদের যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। এছাড়াও তাঁরা আরবী সাহিত্যে শব্দ ব্যবহারের রীতির উপরেও গুরুত্ব দিয়েছেন।
রাগিব ইস্পাহানি তাঁর বিখ্যাত বই “মুফরাদাতুল-কুরআন”-এ বলেছেন:
“আরবী ‘ইয়াদ’ শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘হাত’ বা ‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’। তবে এই শব্দটার অর্থ ‘নিয়ন্ত্রণ’, ‘ক্ষমতা’ বা ‘বিচক্ষণতা’ও হতে পারে।
মিশরীয় বিশেষজ্ঞরা ‘হাত’ বাদেও ‘ইয়াদ’ শব্দটার আরো নয়টা আলাদা অর্থ বর্ণনা করেছেন। উদারহরণ হিসেবে নীচের আয়াতটার কথা বলা যায়:
“তাঁর হাতেই প্রত্যেক বিষয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব ....”
(সুরা ইয়াসীন: আয়াত ৮৩)
এই আয়াতটার অর্থ হলো: “তাঁর নিয়ন্ত্রণেই প্রত্যেক বিষয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব।”
এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, এই সব বিশেষজ্ঞরা আল্লাহর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা আয়াতগুলির আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যখন নবীজী (সঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, সেই আয়াতগুলির ক্ষেত্রে রূপক অর্থ গ্রহণ করছেন।
উদাহরণ হিসেবে নীচের আয়াতটার কথা বলা যায়:
“তুমি তোমার হাত তোমার গলায় আবদ্ধ করে রেখোনা, অথবা সেটা সম্পূর্ণ প্রসারিত কোরোনা। তাহলে তুমি তির®কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।”
(সুরা আল ইসরা: আয়াত ২৯)
এখানে সবাই একমত যে ‘হাত’ শব্দটা রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যখন এই শব্দগুলি আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন তাঁরা এর আক্ষরিক অর্থটাকে গ্রহন করছেন, রূপক অর্থটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেননা।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে খলিফাদের মতাবলম্বীরা কোরানে ‘আল্লাহর হাত’ শব্দটাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে প্রভাবিত হয়ে অনেকেই কোরানের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কাহিনী এখানেই শেষ নয়। সামনের অধ্যায়গুলোতে আমরা আরো চমকপ্রদ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
চলবে...........।
©somewhere in net ltd.
১|
২৯ শে আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৬
ভোরের সূর্য বলেছেন: আপনার এই লেখাটি পড়ে আমি আমার লেখা একটি ব্লগ পড়তে আপনাকে অনুরোধ করছি এবং আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি।