![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মুয়াবিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত পরিত্যাগকারী রাসুলের(সাঃ) শিয়া।শিয়া মানে অনুসারী।আমি আল্লাহর অনুসারী,রাসুলের(সাঃ) অনুসারী।ডঃ তিজানী সামাভী বলেন,শিয়ারা রাসুলের(সাঃ) সুন্নত পালন করছে।
অধ্যায় ৫
আল্লাহর “পা” এবং তাঁর “পায়ের গোছা”
ইবনে খুজাইমাহ তাঁর ‘তাওহিদ’ বইটিতে বেশ কিছু হাদীসের বর্ণনা করেছেন যেখানে আল্লাহর ‘পা’ এবং ‘পায়ের পাতা’-র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই হাদীসগুলির বেশির ভাগই বর্ণনা করেছেন আবু হুরায়রা। এছাড়াও সহী বুখারী, সহী মুসলিম, তিরমিজি-র সুন্নান, আহমাদের মসনদ এবং তাবারি, ইবনে কাসির ও সুরতী-র তাফসিরেও এই হাদীসগুলি উল্লেখ করা হয়েছে।
আবু হুরায়রা বর্ণনা দিয়েছেন যে নবীজী (সঃ) বলেছেন:
“বেহেশত ও দোজখের মধ্যে বিবাদ চলছিলো। দুই পক্ষই একে অন্যের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের চেষ্টা করছিলো।
তখন দোজখ বললো: ‘আমি জানিনা কেনো শুধু উদ্ধত আর অত্যাচারী লোক আমার ভেতরে প্রবেশ করে।’
তারপর বেহেশত বললো: ‘আমি জানিনা কেনো শুধু দুর্বল আর নিরীহ লোক আমার ভেতরে প্রবেশ করে।’
আল্লাহ তখন বেহেশতকে উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘তুমি হলে আমার করুণা। তোমার মাধ্যমে আমি আমার ভৃত্যদের মাঝে করুণা বর্ষণ করি।’
তারপর তিনি দোজখকে উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘তুমি হলে আমার ক্রোধ। তোমার মাধ্যমে আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেই। তোমরা দু’জনেই পরিপূর্ণ হবে।’
কিন্তু দোজখ পরিপূর্ণ হবেনা। তখন আল্লাহ তাঁর নিজের পা দোজখের মধ্যে প্রবেশ করাবেন।
দোজখ তখন চিৎকার করে উঠবে: ‘যথেষ্ট হয়েছে! যথেষ্ট হয়েছে!’
এভাবে দোজখ পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। কারন আল্লাহ কখনো ভুল করেননা।
বেহেশতকে তিনি বিশেষ ভাবে সৃষ্টি করা এক নতুন প্রজন্ম দিয়ে পরিপূর্ণ করবেন।”
আল্লাহর ‘পায়ের গোছা ’
আমরা সহী বুখারী, হাকিম-এর মুসতাদরাক এবং তাবারি, ইবনে কাসির ও সুরতী-র তাফসিরে বেশ কিছু হাদীস দেখতে পাই যেখানে আল্লাহর ‘পায়ের গোছা’ বা ‘পায়ের নীচের অংশ’ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরান বলছে:
“স্মরণ করো সেই দিনের কথা, যেদিন পায়ের গোছা উন্মুক্ত করা হবে। সেইদিন তাদেরকে আহবান করা হবে সিজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবেনা।”
(সুরা আল কালাম: আয়াত ৪২)
নবীজী (সঃ)-এর একজন সাহাবী, আবু সাইদ বর্ণনা করেছেন যে তিনি নবীজী (সঃ)-কে বলেেত শুনেছেন:
“আমাদের প্রতিপালক তাঁর পায়ের গোছা উন্মুক্ত করবেন। তখন সকল বিশ্বাসী পুরুষ ও নারী তাঁর সামনে সিজদা দেবে। তবে যারা পৃথিবীতে অন্যের সামনে দম্ভ দেখানোর জন্য অথবা শ্রদ্ধা পাওয়ার জন্য আল্লাহর ইবাদত করতো, তারা সিজদা দিতে পারবেনা। তারা সোজা হয়ে থাকবে।”
সহী বুখারী-র ‘তাওহিদ’ অধ্যায়টিতে এই হাদীসটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আমরা তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি:
“শেষ বিচারের দিনে ঘোষণা করা হবে: ‘তোমরা যে যে ইশ্বরের উপাসনা করতে, তার পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াও।’ তখন সবাই তাদের ইশ্বরের পেছনে দাঁড়ানোর জন্য ছুটোছুটি শুরু করে দেবে। শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতকারীরা তখনো দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে।
তখন আল্লাহ তাদের সামনে এসে বলবেন: “আল্লাহ এবং তোমাদের মাঝে কি এমন কোনো সনাক্তকরণ চিহ্ন আছে, যেটা দেখে তোমরা তাঁকে চিনতে পারবে?”
তখন তারা বলবে: “হ্যা, তাঁর পায়ের গোছা।”
তখন আল্লাহ তাঁর পায়ের গোছা উন্মুক্ত করবেন। সেটা দেখে বিশ্বাসীরা সবাই তাঁকে সিজদা করবে, এবং তাঁর পেছন পেছন বেহেশতে প্রবেশ করবে।”
এই হাদীসটি পড়ার পরে আমাদের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হয়। আশা করি খলিফাদের মতাবলম্বীদের মাঝে বিশেষজ্ঞরা নীচের এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্তোষজনকভাবেই দিতে পারবেন।
১. এই সনাক্তকরণ চিহ্ন বা প্রতীকটা কি, যেটার উত্তরে সবাই আল্লাহর তথাকথিত পায়ের গোছাকে নির্দেশ করবে?
২. খলিফাদের মতাবলম্বীরা প্রথম কবে এই পায়ের গোছা দেখেছেন, যাতে করে শেষ বিচারের দিন সেটা দেখার সাথে সাথেই তাঁরা চিনে ফেলবেন?
৩. আর তাঁরা যদি পৃথিবীতে এটা দেখে থাকেন, তাহলে সেটা দেখতে কেমন?
৪. এটার আকার কেমন?
আহলে বায়াত (আঃ)-এর অনুসারীদের ব্যাখ্যা
আসুন আমরা কোরানের এই আয়াতটি আরেকবার দেখে:
“স্মরণ করো সেই দিনের কথা, যেদিন পায়ের গোছা উন্মুক্ত করা হবে। সেইদিন তাদেরকে আহবান করা হবে সিজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবেনা।”
(সুরা আল কালাম: আয়াত ৪২)
ওবাইদা বিন জাহরা বর্ণনা দিয়েছেন:
“আমি ইমাম জা’ফর সাদিক (আঃ)-কে এই আয়াতটা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি তক্ষুণি তাঁর হাত তাঁর নিজের পায়ের গোড়ালির উপর রাখলেন, সেখান থেকে ঢেকে রাখা কাপড়টা সরালেন, তারপর তাঁর হাত নিজের মাথার উপর রেখে বললেন: ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত।’ ”
শেখ সাদুক বলেছেন যে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর এমনটা করার অর্থ হলো সবাইকে এটা জানানো যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ, যিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত, তিনি পা অথবা পায়ের গোছার অধিকারী হওয়ার চাইতে অনেক উপরে।
ইমাম জা’ফর সাদিক (আঃ)-এর অন্য আরেকজন সহচর, মুহাম্মদ বিন আলী হালাবি-ও তাঁকে পায়ের গোছা উন্মুক্ত করার এই আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তখন ইমাম (আঃ) বিস্তারিত উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “সমস্ত প্রশংসা সর্বশক্তিমান আল্লার্হ”
তারপর তিনি সুরা কালাম-এর এই আয়াতটি এবং তার পরের আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন।
“স্মরণ করো সেই দিনের কথা, যেদিন পায়ের গোছা উন্মুক্ত করা হবে। সেইদিন তাদেরকে আহবান করা হবে সিজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবেনা।”
(সুরা আল কালাম: আয়াত ৪২)
“তাদের দৃষ্টি অবনত থাকবে। হীনতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে। অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিলো, তখন তো তাদেরকে সিজদা করতে আহবান করা হয়েছিলো।”
(সুরা আল কালাম: আয়াত ৪৩)
“ইমাম (আঃ) তারপর বললেন: ‘ শেষ বিচারের দিনের কঠিন অবস্থা বোঝানোর জন্য এই রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে বোঝানো হচ্ছে যে শেষ বিচারের দিনে মানুষ নিজে থেকেই লজ্জায় আর অপমানে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। তাদের করা কাজগুলির পক্ষে কোনো অজুহাত দেখাতে পারবেনা। এই আয়াত দুইটি একসাথে পড়লে এর রূপক অর্থটা বোঝা যায়।“
শেখ সাদুক তাঁর ‘তাওহিদ’ বইটিতে ব্যাখ্যা দিয়েছেন:
“যখন ইমাম সাদিক (আঃ) বললেন: ‘সমস্ত প্রশংসা সর্বশক্তিমান আল্লাহর’, এবং তারপর তাঁর নিজের পায়ের কাপড় সরালেন, এটা দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে আল্লাহ কোনো পা ধারণ করার থেকে অনেক উপরে অবস্থান করেন। ‘আল্লাহ পায়ের গোছা উন্মুক্ত করলেন’- এই কথাটার আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ না করে রূপক অর্থটা গ্রহণ করতে হবে।
আরবী সাহিত্যে ‘পায়ের গোছা উন্মোচিত করা’
নবীজী (সঃ)-এর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন: “যদি কোরানের কথা বুঝতে না পারেন, তাহলে আরবী সাহিত্য থেকে সাহায্য নিন। সাহিত্যে শব্দের বিভিন্ন ব্যবহার দেখে আপনি অর্থটা বুঝতে পারবেন। আপনারা কি সেই আরব কবি-র কথা শোনেননি যিনি বলেছিলেন: “কামাতিল হারবু বিনা আলা সাকিন”। অর্থাৎ “যুদ্ধ তার সকল প্রচন্ডতা আর কাঠিন্য নিয়ে শুরু হয়েছে”। একইভাবে ‘পায়ের গোছা উন্মোচন করা’-র মাধ্যমে এখানে শেষ বিচারের দিনের তীব্র ভয়, লজ্জা আর কষ্টকে বোঝানো হয়েছে।২৪
রাগিব ইস্পাহানি তাঁর বিখ্যাত বই “মুফরাদাত আর-কুরআন”-এ ইবনে আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে একই ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এছাড়াও “মু’জাম আলফাদহ আল কুরআন আল কারিম”-এ মিশরীয় বিশেষজ্ঞরাও এই ব্যাখ্যাটির সাথে একমত হয়েছেন।
এই ধরনের রূপক শব্দ ও বাক্যালঙ্কারের সাথে আরবভাষী এবং বিশেষজ্ঞরা গত চৌদ্দশো বছর ধরেই খুব ভালোভাবে পরিচিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, খলিফাদের মতাবলম্বীরা এক্ষেত্রে আবু হুরায়রা এবং তাঁর মতো আরো অনেকের বর্ণনা গ্রহণ করেছেন, যেখানে আল্লাহর উপর শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আরোপ করা হচ্ছে।
ব্যাকরণের দৃষ্টিতে এই আয়াতটিতে যে ক্রিয়াটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা কর্মবাচ্যমূলক ক্রিয়া। এখানে বলা হয়েছে: “পায়ের গোছা উন্মোচিত করা হবে”। তারপরেও আমরা দেখি কিছু বিশেষজ্ঞ এই ক্রিয়াটিকে কর্তৃবাচ্যমূলক ক্রিয়া হিসেবে বদলে নেন। তারপর সেটার অর্থ করেন: “আল্লাহ তাঁর পায়ের গোছা উন্মোচিত করবেন”।
অন্য কথায় বললে, এইসব বিশেষজ্ঞরা এই আয়াতটিতে শব্দের ব্যবহারটি ভালোভাবে লক্ষ্য করেননি। আরবী “ইয়োকশাফ” শব্দটার অর্থ “উন্মোচিত করা হবে”। আর তাঁদের গ্রহণ করা অর্থটি মেনে নিলে এখানে বলা হতো “ইয়েকশেফ”, যার অর্থ “তিনি উন্মোচিত করেছেন”।
উপরের এই আলোচনার সারমর্ম করলে আমরা বলতে পারি:
নবীজী (সঃ)-এর উপর আরোপ করা এরকম কিছু হাদীস এবং বর্ণনার কারনে যেটা হয়েছে:
১. পবিত্র কোরানের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
২. হাদীসের বিজ্ঞানসম্মত রূপটিকে দুর্বল ও ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে।
৩. মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে।
আমরা আহলে বায়াত (আঃ)-এর কাছে সবসময়েই কৃতজ্ঞ। কারন তাঁরা সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ইসলামের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, কোরান ও হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যাগুলি আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর! আমরা এখন নিশ্চিতভাবে জানি যে আল্লাহর কোনো আকার নেই, কোনো শরীর নেই, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। এসবের তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই। কারন তাঁর যদি শরীর থাকতো, তাহলে অবশ্যই তাঁর একটি বাসগৃহ বা বাসস্থান থাকতো।
অধ্যায় ৬
আল্লাহর “সিংহাসন” (আরশ) এবং “চেয়ার” (কুরসী)
খলিফাদের মতাবলম্বীরা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন
স্বাভাবিকভাবেই খলিফাদের মতাবলম্বীরা মনে করেন যে আল্লাহর অবশ্যই একটি বাসস্থান রয়েছে! যখন তাঁরা কল্পনা করেছেন যে আল্লাহর শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে, তখন অবশ্যই সেই শরীরকে ধারণ করার জন্য তাঁকে একটি বাসস্থান দেয়া প্রয়োজন। সেজন্যই আমরা দেখতে পাই যে যারা আল্লাহর এই শরীর ধারণ করার ব্যাপারটি বিশ্বাস করেন, তাঁদের অন্যতম নেতা মুহাম্মদ বিন উসমান দারামি (মৃত্যু ২৮০ হিজরী) তাঁর লেখা বই “আল রাদ আলা আল জামিয়াহ”-এ উল্লেখ করেছেন:
“অবশ্যই সপ্তম বেহেশতের উপরে স্পষ্টভাবে এবং নির্ধারিত স্থানে আল্লাহর সিংহাসন রয়েছে, যেটা ফেরেশতাগণ বহন করে। আল্লাহ, তিনি যেভাবে তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন, তাঁর কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন।”
এরপর তিনি একই বইয়ের ত্রয়োদশ অধ্যায়ের শিরোনামে লিখলেন:
“সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত আল্লাহর দৃঢ়ভাবে সিংহাসনে অবস্থান, বেহেশতে আরোহণ এবং তাঁর সৃষ্টির চাইতে অনন্য হওয়ার বৈশিষ্ট্য”
একইভাবে ইবনে খুজাইমাহও তাঁর লেখা ‘তাওহিদ’ বইটিতে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন:
“সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত আমাদের সৃষ্টিকর্তার দৃঢ়ভাবে সিংহাসনে অবস্থান। তিনি সিংহাসনের উপরে এবং সবার উপরে।”
আমরা দেখতে পাই যে দারামি প্রবলভাবে তাদের যুক্তি খন্ডন করছেন, যারা বিশ্বাস করে যে আল্লাহ সব জায়গায় আছেন। তিনি নবীজী (সঃ)-এর একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:
“বীর্য জরায়ুতে চল্লিশ রাত অবস্থান করে। তখন একজন ফেরেশতা মানুষের আত্মা আনতে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রশ্ন করে: ‘হে আল্লাহ! আপনার এই ভৃত্যের নিয়তি কি পুরুষ অথবা নারী হওয়া?’
এরপরে দারামি যুক্তি খন্ডণ করতে গিয়ে বলেন: “যদি আপনাদের বিশ্বাসটা সত্যি হয়, তাহলে আল্লাহ জরায়ুতে ঐ বীর্যের মাঝে অবস্থান করতেন। আর তাহলে আল্লাহর কাছে সেই ফেরেশতার যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো?”
এরপরে তিনি আরো বলেন: “আল্লাহ অবস্থান করেন এবং তিনি তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা জায়গায বাস করেন। তিনি কেনো তাঁর বাসস্থান এই নোংরা জায়গায় রাখবেন, যে জায়গাটা মানুষ আর পশু-পাখির বর্জ্যে ভর্তি? কেনো তাঁকে সব জায়গাতেই থাকতে হবে?”
দারামি, ইবনে খুজাইমাহ এবং খলিফাদের মতাবলম্বীদের মাঝে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা কোরান ও হাদীসের মাধ্যমে তাঁদের এই বিশ্বাসটাকে প্রমান করার চেষ্টা করেছেন যে আল্লাহর সত্যিকারের “সিংহাসন” বা “আসন” আছে। নীচে এরকম কিছু উদাহরণ দেয়া হলো:
খলিফাদের মতাবলম্বীরা যেভাবে “আরশ” এবং “কুরসী”-এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন
বুখারী, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, আহমাদ হাম্বল, তাবারি, ইবনে কাসির এবং সুরতী তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছেন:
“নবীজী (সঃ)-কে প্রশ্ন করা হলো: ‘এই বিশ্বজগত সৃষ্টির আগে আল্লাহ কোথায় অবস্থান করতেন?’
নবীজী (সঃ) উত্তর দিলেন: “তিনি ছিলেন অন্ধকার, ভারী মেঘের মধ্যে। সেখানকার নীচে বাতাস ছিলোনা, উপরেও বাতাস ছিলোনা। আর তখন অন্য কোনো সৃষ্টিও ছিলোনা। তাঁর ‘সিংহাসন’ ছিলো পানির উপরে।”
কোরানে উল্লেখ করা আছে:
“তখন তাঁর আরশ ছিলো পানির উপরে।”
(সুরা হুদ: আয়াত ৭)
এই বিশেষজ্ঞরা ধরে নিয়েছেন যে সেটা সত্যিকারের একটা সিংহাসন, যেটা পানির উপরে ভেসে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও তাঁরা আরো কিছু হাদীসের বর্ণনা দিয়েছেন:
“নবীজী (সঃ) বলেছেন: ‘পৃথিবী থেকে বেহেশতের দূরত্ব হলো একাত্তর, বাহাত্তর অথবা তিয়াত্তর রাত। প্রথম বেহেশত থেকে দ্বিতীয় বেহেশত, এভাবে সপ্তম বেহেশত পর্যন্ত প্রত্যেকটার মধ্যেকার দূরত্বও একই রকম। সপ্তম বেহেশতের পরে আছে একটি সমুদ্র, যার গভীরতা দুই বেহেশতের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। সেই সমুদ্রের উপরে আছে আটটি পাহাড়ী ছাগল। ছাগলগুলির প্রত্যেকের পায়ের ক্ষুরগুলি এমনভাবে ছড়ানো, যার দূরত্ব দুই বেহেশতের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। এদের পিঠের উপরে রয়েছে আল্লাহর সিংহাসন (আরশ), যার উচ্চতা দুই বেহেশতের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। সেখানেই অধিষ্ঠিত রয়েছেন আল্লাহ, সর্বশক্তিমান, সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত।”২৫
“সিংহাসন”-এর অবিরাম শব্দ
আমরা ইবনে খুজাইমাহ, আবু দাউদ, ইবনে আসীর এবং আলুসি-র বর্ণনায় দেখতে পাই যে:
“একদিন নবীজী (সঃ) তাঁর হাতের আঙুলগুলো একত্রিত করে গম্বুজের মতো একটি আকার বানালেন এবং বললেন: ‘বেহেশতের উপরে আল্লাহর সিংহাসন (আরশ) দেখতে এরকম। কেউ উটের পিঠে চড়লে যেরকম শব্দ হয়, এই সিংহাসনও সেরকম শব্দ করে।”
আবু দাউদ তাঁর সুন্নান-এ ইবনে বাশার-এর উদ্ধৃতি দিয়ে একটি হাদীসের বর্ণনা দিয়েছেন:
“আল্লাহ তাঁর সিংহাসনে (আরশ) বসে আছেন, এবং সেই সিংহাসন বেহেশতের উপরে। এই সিংহাসন অবিরাম শব্দ করছে, কেউ উটের পিঠে চড়লে যেরকম শব্দ হয়।”
তাবারি, ইবনে কাসির ও সুরতী তাঁদের তাফসিরে খলিফা ওমরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন:
“এক মহিলা নবীজী (সঃ)-এর কাছে এসে অনুরোধ করলো: ‘আমার জন্য দোয়া করবেন, যেনো আমি বেহেশতে প্রবেশ করতে পারি।’
নবীজী (সঃ) তখন উচ্চস্বরে আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন: ‘আল্লাহর আসন পৃথিবী থেকে বেহেশত পর্যন্ত বি¯তৃত। মানুষ কোনো ঘোড়া বা উটের পিঠে উঠলে যেমন শব্দ হয়, এই আসনও অবিরাম সেরকম শব্দ উৎপন্ন করে। তিনি তাঁর আসনের সবদিকেই চার আঙ্গুল বেশি বি¯তৃত থাকেন।”
তাহলে এখানে বলা হচ্ছে যে আল্লাহ এতো মোটা যে সেই আসন তাঁকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারেনা। আল্লাহ আমাদের এই অনিষ্টকর বিশ্বাসের ধারণা থেকে রক্ষা করুন। আসুন এবারে আমরা এই হাদীসের উৎসটা পর্যালোচনা করি।
কা’ব আল আহবারের বর্ণনা
“কা’ব আল আহবার বলেছেন: ‘আল্লাহ সাতটি বেহেশত সৃষ্টি করলেন, এবং তাদের মতো করে পৃথিবীও সৃষ্টি করলেন। তারপর পৃথিবী আর প্রথম বেহেশতের মধ্যবর্তী দূরত্বের মতো বেহেশতগুলির মধ্যেও একই দূরত্ব বজায় রাখলেন। এবং তিনি এদেরকে ঘনীভূত করলেন। তারপর এগুলোর উপরে তিনি তাঁর সিংহাসন (আরশ) বানালেন এবং সেই সিংহাসনের উপর অবস্থান করলেন। সেজন্য কোনো মানুষ নতুন ঘোড়া বা উটের পিঠে চড়লে যেমন শব্দ হয়, আল্লাহর ওজনের কারনে প্রত্যেকটা বেহেশত সেরকম শব্দ করে।”
এই হাদীসটাই অন্য সব বর্ণনার উৎস যেখানে ‘আতীত’ (যার অর্থ অবিরাম শব্দ করা) শব্দটা উল্লেখ করা হয়েছে। এই হাদীসটা বানিয়েছিলেন প্রাক্তন ইহুদী ধর্মযাজক কা’ব আল আহবার।
এই “কুরসী” কি এবং তার বাহক কারা?
মাকাতিল তাঁর বিবরণীতে কোরানের একটি আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছেন:
“তাঁর কুরসী আকাশ ও পৃথিবীময় বি¯তৃত।”
(সুরা আল বাকারা: আয়াত ২৫৫)
মাকাতিল বলেছেন: “এই কুরসী বা আসন বহন করছে চারজন ফেরেশতা।
একজন ফেরেশতার মুখ মানুষের মতো, এবং সে আল্লাহর কাছে মানুষের জীবিকার জন্য প্রার্থণা করছে।
দ্বিতীয় ফেরেশেতার মুখ পশুর মতো, ষাঁড়ের মুখের মতো। সে আল্লাহর কাছে পশুদের জীবিকার জন্য প্রার্থণা করছে।
তৃতীয় ফেরেশতার মুখ পাখির মতো, ইগলের মুখের মতো। সে আল্লাহর কাছে পাখিদের জীবিকার জন্য প্রার্থণা করছে।
তৃতীয় ফেরেশতার মুখ সিংহের মতো, এবং সে আল্লাহর কাছে বন্য প্রাণীদের জীবিকার জন্য প্রার্থণা করছে।”২৬
খলিফাদের মতাবলম্বীদের বিভিন্ন বর্ণনা এরকম কাল্পনিক গল্পে ভর্তি। এ প্রসঙ্গে শেষ বিচারের দিন আল্লাহর শারীরিক উপস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের বিশ্বাস নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ইবনে খুজাইমাহ তাঁর লেখা ‘তাওহিদ’ বইটিতে কোরানের বিভিন্ন আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমান করার চেষ্টা করেছেন যে, আল্লাহ নিজেই তাঁর বাসস্থান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন!
ক) “পরম দয়ালু আল্লাহ তাঁর আসনে দৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠিত।”
(সুরা তা-হা: আয়াত ৫)
খ) “অতঃপর তিনি তাঁর আসনে দৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠিত হন”
(সুরা আল ফুরকান: আয়াত ৫৯)
গ) “আর তিনিই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর আসন ছিলো পানির উপরে।”
(সুরা হুদ: আয়াত ৭)
ইাবনে খুজাইমাহ বিশ্বাস করেন যে এই আয়াতগুলিতে এক ধরনের আসবাবপত্রের কথা বলা হচ্ছে, যেটাকে আল্লাহ আসন হিসেবে ব্যবহার করেন! আর খুজাইমাহ একাই নন। অনেক বিশেষজ্ঞই তাঁর পথ অনুসরণ করেছেন। তাঁরা এটা ভুলে গেছেন যে আয়াতগুলিতে এই শব্দগুলি রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, আল্লাহর রাজত্ব ও কর্তৃত্ব বোঝানোর জন্য।
আহলে বায়াত (আঃ)-এর ব্যাখ্যা
শেখ সাদুক তাঁর লেখা ‘তাওহিদ’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন:
“ইমাম জা’ফর সাদিক (আঃ)-কে কোরানের এই আয়াতটা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো:
“তাঁর কুরসী আকাশ ও পৃথিবীময় বি¯তৃত।”
(সুরা আল বাকারা: আয়াত ২৫৫)
ইমাম (আঃ) বললেন: “এখানে ‘কুরসী’ শব্দটা দিয়ে আল্লাহর জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে। এই আয়াতটার অর্থ হলো: ‘তাঁর জ্ঞান আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীময় বি¯তৃত।’ ”
ইমাম জা’ফর সাদিক (আঃ)-এর আরেকটি বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই:
“আকাশমন্ডলী এবং পৃথিবী, এর সবকিছুই তাঁর ‘কুরসী’২৭, অর্থাৎ তাঁর জ্ঞান।”
আরেকবার একজন লোক ইমাম জা’ফর সাদিক (আঃ)-এর কাছে জানতে চাইলেন যে, “আল্লাহর আরশ পানির উপরে”-এই কথাটার অর্থ কি?
ইমাম (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন: “মানুষজন কি বলে?”
লোকটি বললো: “মানুষজন বলে যে আল্লাহর আসন পানির উপরে, এবং তিনি সেই আসনের উপর বসে আছেন।”
ইমাম (আঃ) উত্তর দিলেন: “এটা অবশ্যই মিথ্যা কথা! কেউ যদি বিশ্বাস করে আল্লাহকে কিছু একটা ধারণ ও বহণ করে, তারা আল্লাহর সাথে তাঁর সৃষ্টির তুলনা করে। আর যে জিনিসটা তাঁকে ধারণ বা বহণ করে, সেটা তো তাঁর চাইতে শক্তিশালী হবে!”
লোকটি কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তারপর ইমাম (আঃ)-কে বললো: “আমাকে আপনি মুক্ত করুন! আপনার কাছ থেকে আমাকে সঠিক অর্থ জানার সুযোগ দিন।”
ইমাম (আঃ) বললেন: “কোরানের অনেক আয়াতে এই ‘আরশ’ শব্দটা উল্লেখ করা হয়েছে। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই শব্দটার অর্থ ‘রাজত্ব’, ‘কর্তৃত্ব’ অথবা ‘জ্ঞান’।”
আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন:
“তিনি মহান আরশের অধিপতি।”
(সুরা আল তওবা: আয়াত ১২৯)
এখানে আল্লাহর মহিমা বোঝানোর জন্য ‘আরশ’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ হলো তাঁর জ্ঞান।
আরেকটি আয়াতে আছে:
“পরম দয়ালু আল্লাহ তাঁর আসনে দৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠিত।”
(সুরা তা-হা: আয়াত ৫)
“এর অর্থ হলো আল্লাহর কর্তৃত্ব তাঁর রাজত্বকে পরিব্যপ্ত করে আছে।”
“যখন আল্লাহ বলছেন যে ‘তাঁর আরশ পানির উপরে’, তিনি বোঝাতে চাইছেন যে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার আগে পানি সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এবং এটাই ছিলো আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি।
শেখ সাদু ক তাঁর ‘তাওহিদ’ বইটিতে লিখেছেন যে আব্বাসীয় খলিফা মামুন একবার ইমাম রিজা (আঃ)-এর কাছে একটি আয়াতের অর্থ জানতে চাইলেন।
“আর তিনিই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর আসন ছিলো পানির উপরে, তোমাদের মধ্যে কে কাজে শ্রেষ্ঠ সেটা পরীক্ষা করার জন্য।”
(সুরা হুদ: আয়াত ৭)
“ইমাম (আঃ) বললেন: ‘এই আয়াতটার অর্থ হলো ‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী আর পৃথিবী বানানোর আগে তাঁর আরশ, পানি আর ফেরেশতাগণকে সৃষ্টি করেছিলেন।’ ”
বর্ণনাগুলির মধ্যে পারষ্পরিক তুলনা এবং তাফসিরগুলির পর্যালোচনা
আমাদের গবেষণা থেকে আমরা এটা জানতে পারলাম যে খলিফাদের মতাবলম্বীরা পবিত্র কোরানের যে ব্যাখ্যা করেছেন, আর নবীজী (সঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে যে কথাগুলো গ্রহণ করেছেন, তা হলো:
১. তাঁরা বলেন, নবীজী (সঃ) বলেছেন যে বিশ্বজগত সৃষ্টির আগে আল্লাহ মেঘের ভেতরে তাঁর আরশ বা আসনে অবস্থান করতেন।
২. তাঁরা বলেন, পৃথিবী হলো প্রথম বেহেশতের নীচে। প্রথম বেহেশতটা দ্বিতীয় বেহেশতের নীচে। এভাবে একটার উপরে আরেকটা করে সাতটা বেহেশত আছে। সপ্তম বেহেশতের উপরে আছে এক সমুদ্র। এই সমুদ্রের উপরে আটটি ছাগল আল্লাহর আরশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর এই আরশের উপর বসে আছেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ।
৩. তাঁরা বলেন, নবীজী (সঃ) বলেছেন: ‘এই আরশ রয়েছে আকাশমন্ডলীর উপরে। আর উটের পিঠে নতুন আরোহী উঠলে যেমন শব্দ হয়, আল্লাহর ওজনের ভারে তাঁর আরশও সেরকম শব্দ করে।
৪. তাঁরা বলেন, আল্লাহ তাঁর আসনের সবদিকেই চার আঙ্গুল বেশি বি¯তৃত থাকেন।
এখন যারা এধরনের বিশ্বাস পোষণ করেন, তাঁদের কাছে এই প্রশ্নগুলি করা খুব একটা অযৌক্তিক হবেনা:
১. যদি আল্লাহ তাঁর আসনের সবদিকেই চার আঙ্গুল বেশি বি¯তৃত থাকেন, তাহলে তাঁর আকারও কি যেকোনো একটা সাধারণ চেয়ারের মতো বর্গাকার?
২. যে চার আঙ্গুলের কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়, সেটাকে কি আমরা সৃষ্টিকর্তার আঙ্গুল বলে ধরে নেবো? নাকি তাঁর সৃষ্টির আঙ্গুল বলে ধরে নেবো?
খলিফাদের মতাবলম্বীদের লেখা বিভিন্ন বইতে উল্লেখ করা আছে যে নবীজী (সঃ) বলেছেন আল্লাহর আরশ রয়েছে একটা সমুদ্রের উপরে আটটি ছাগলের পিঠে। সেই সমুদ্র রয়েছে সপ্তম বেহেশতের উপরে। তার নীচে আছে আরো ছয়টি বেহেশত, আর সবার নীচে পৃথিবী।
এই হাদীসটি প্রাচীন কিছু ধর্মবিশ্বাসের ধারণাকে গ্রহণ করেছে, যেখানে মনে করা হতো যে এই বিশ্বজগতটা একটা দালানের মতো, যেটা সাত-আটতলা উঁচু, আর পৃথিবী একেবারে নীচতলায় অবস্থিত। কিন্তু এখন আমরা কিভাবে এই হাদীসগুলির ব্যাখ্যা করবো, যখন আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের বলে যে পৃথিবী গোলাকার, আর সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, আর এই সূর্য অন্যান্য নক্ষত্রের মতো এই বিশাল ছায়াপথের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
সত্যি বলতে ইবনে খুজাইমাহ সহ খলিফাদের মতাবলম্বীদের মাঝে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা কোরানের যে আয়াতগুলিতে “আরশ” শব্দটা দেখেছেন, সেখানে উল্লিখিত “ইসতাওয়া” শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁরা এই শব্দটার আক্ষরিক অর্থ করেছেন, যার মানে হলো “বসা” বা “অবস্থান করা”। পবিত্র কোরানে মোট ছয় জায়গায় এই শব্দটা উল্লেখ করা হয়েছে।
রাগিব ইস্পাহানি তাঁর বিবরণীতে বলেছেন:
“যখনই এই ‘ইসতাওয়া’ ক্রিয়াটির সাথে ‘আলা’ যোগ করে একে সকর্মক ক্রিয়া বানানো হয়, তখন সেটা হয় ‘ইসতিলা’- যার অর্থ ‘নিয়ন্ত্রণ’, ‘অধিকার’, ‘ক্ষমতা’ বা ‘বিজয়’। যেমন এই আয়াতটিতে বলা হচ্ছে: “পরম দয়ালু আল্লাহ সম্পূর্ণভাবে তাঁর আরশকে নিয়ন্ত্রণ করেন।”
আরবী সাহিত্যেও আমরা একই ধরনের শব্দের ব্যবহার ও বাক্যালঙ্কার দেখতে পাই। একবার এক কবি উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক-এর ভাই বুশর বিন মারওয়ান-এর প্রশংসা করতে গিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন:
“বুশর তরবারি না চালিয়েই বা রক্তপাত না ঘটিয়েই ইরাক জয় করলেন।” (কাদ ইসতাওয়া আলাল ইরাকি)
খলিফাদের মতাবলম্বীরা অন্য যে শব্দটা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন, সেটা হলো “কুরসী”। তাঁরা এটার আক্ষরিক অর্থ করেছেন “আসন” বা “চেয়ার”। তাবারি তাঁর তাফসিরে লিখেছেন যে “কুরসী”-র অর্থ “জ্ঞান”ও হতে পারে। আর সেজন্যই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইকে বলা হয় “কুরাসাহ”, এবং জ্ঞানী মানুষকে বলা হয় “কুরাসাইয়ি”। পবিত্র কোরানে এই “কুরসী” শব্দটার পরিবর্তে অনেক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে “ইলম”। উদাহণস্বরূপ:
১. “সবকিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানের আয়ত্বে।”
(সুরা আল আনআম: আয়াত ৮০)
২. “সবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের জ্ঞানের আয়ত্বে।”
(সুরা আল আরাফ: আয়াত ৮৯)
৩. “হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী।”
(সুরা আল গাফির: আয়াত ৭)
৪. “তোমাদের ইলাহ তো কেবলমাত্র আল্লাহই, যিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই। তাঁর জ্ঞান সর্ববিষয়ে ব্যাপ্ত”
(সুরা তা-হা: আয়াত ৯৮)
উপরে উল্লিখিত এই আয়াতটিতে “ইলম” শব্দটার সাথে “ওয়াসিয়া” শব্দটাও উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি সুরা বাকারা’র যে আয়াতটিতে “কুরসী”-র কথা বলা হচ্ছে, তার প্রথম অংশেই আয়াতটি আল্লাহর সর্বব্যাপী জ্ঞানের কথা বলছে। আসুন আমরা এই আয়াতের প্রথম অংশটা দেখি:
“তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ অবগত। তিনি যা কিছু ইচ্ছা করেন, সেটা ব্যতীত তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারেনা। তাঁর কুরসী আকাশ ও পৃথিবীময় বি¯তৃত।”
(সুরা আল বাকারা: আয়াত ২৫৫)
উপসংহার
আরবী “আরশ” শব্দটার আক্ষরিক অর্থ “সিংহাসন”, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই শব্দটা দিয়ে “শাসন” বা “ক্ষমতা”কে বোঝানো হয়। সুতরং “আল্লাহর আরশ” শব্দটা দিয়ে সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহর ক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে।
“ইসতাওয়া”-এই শব্দটার সাথে “আলা” যোগ করলে তার অর্থ দাঁড়ায় “ক্ষমতা”।
“রাহমান”- এটা একটা ইসলামিক বাগধারা। এটা আল্লাহর একটি নাম যার অর্থ “যে তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দয়াময়”।
এই আয়াতটিতে বলা হচ্ছে:
“হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী।”
(সুরা আল গাফির: আয়াত ৭)
যার অর্থ হলো আল্লাহর জ্ঞানের মতো তাঁর দয়াও পৃথিবীতে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে ঘিরে রেখেছে। মিশরের ফেরাউন তাঁর দয়ায় বেঁচে থাকে। নবী মুসা (আঃ) তাঁর সাহায্য ছাড়া নিরুপায়। সেজন্য যখন বলা হয়: “আল্লাহ, পরম দয়াময়, তাঁর আরশে পরিব্যাপ্ত”, এর অর্থ হলো আল্লাহর দয়া তাঁর সমগ্র রাজত্বে পরিব্যাপ্ত।
এরপর বলা হয়েছে:
“তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও তাদের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করলেন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনিই রাহমান ....”
(সুরা আল ফুরকান: আয়াত ৫৯)
এর অর্থ হলো “আল্লাহ, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ছয়টি পর্যায়ে, তিনি শাসন করেন দয়ার সাথে”।
আরবী “কুরসী” শব্দটার একটা অর্থ হলো “জ্ঞান”।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আরবী সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে সামান্য ধারণা থাকলে যে কেউ এই ‘আরশ’, ‘কুরসী’ অথবা ‘ইসতাওয়া’ শব্দগুলির অর্থ বুঝতে পারবেন। কিন্তু আমরা দেখি যে খলিফাদের অনুসারীরা এই অর্থগুলোর সবগুলোকেই বাদ দিয়ে শুধু এর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করেছেন। আর নবীজী (সঃ)-এর যে দুই-একজন সাহাবী এভাবে বর্ণনা করেছেন, তাঁদের কথার উপর ভিত্তি করেই তাঁরা পবিত্র কোরানের ব্যাখ্যা করেছেন।
চলবে.........
©somewhere in net ltd.
১|
২৯ শে আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৩
শয়ন কুমার বলেছেন: পোষ্টে++++++++++++ ।
দেখবার আমন্ত্রণ রইলোঃ
Click This Link