নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইসলাম,রাজনীতি

আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি।

আল-মুনতাজার

আমি মুয়াবিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত পরিত্যাগকারী রাসুলের(সাঃ) শিয়া।শিয়া মানে অনুসারী।আমি আল্লাহর অনুসারী,রাসুলের(সাঃ) অনুসারী।ডঃ তিজানী সামাভী বলেন,শিয়ারা রাসুলের(সাঃ) সুন্নত পালন করছে।

আল-মুনতাজার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইসলামের পবিত্রতা সংরক্ষনে নবী পরিবারের (আঃ) ভুমিকা

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৬



অধ্যায় ১০

বেহেশতে আল্লাহর সান্নিধ্য



খলিফাদের মতাবলম্বীরা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন

বেহেশতে যে মুসলিমরা আল্লাহকে দেখতে পাবে, এ সম্পর্কে খলিফাদের মতাবলম্বীদের লেখা বইগুলোতে অনেক হাদীসের উল্লেখ আছে। আমরা এখানে সেই হাদীসগুলোর ভেতর থেকে কয়েকটা নিয়ে আলোচনা করবো।



এটা খুবই দুঃখজনক যে খলিফাদের মতাবলম্বীদের মধ্য থেকে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে এমনটাও বলেছেন যে মুসলিমরা বেহেশতের ভেতরে বাজারের মধ্যে আল্লাহকে দেখতে পাবে!



১. ইবনে মাজাহ ও তিরমিজি তাঁদের সুন্নান-এ নীচের কথোপকথনটি উল্লেখ করেছেন:



আবু হুরায়রা একবার সাইদ বিন আল মুসাইয়াব-কে বলেছিলেন: “আমি দোয়া করছি যাতে আমরা দু’জনেই বেহেশতের বাজারে মিলিত হতে পারি।”



সাইদ প্রশ্ন করলেন: “বেহেশতে কোনো বাজার আছে নাকি?”



আবু হুরায়রা বললেন: “অবশ্যই আছে! নবীজী (সঃ) আমাকে বলেছেন যে যখন মানুষ বেহেশতে প্রবেশ করবে, তখন তাদের ভালো কাজের পরিমানের হিসেবে তাদের অবস্থান নির্ণয় করা হবে। তখন তারা আল্লাহর সাথে একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য দেখা করার অনুমতি পাবে, যেটা হবে পৃথিবীর একটি শুক্রবারের সমান। তারপর তারা আল্লাহকে দেখতে যাবে। আল্লাহ তাঁর সিংহাসনের উপর বসে বেহেশতের বাগানের মধ্যে সবাইকে দেখা দেবেন।”



“তখন আল্লাহ তাদের জন্য বেদী বানিয়ে দেবেন আলো, মুক্তা, ইন্দ্রনীলমণি, গোমেদ এবং স্বর্ণ দিয়ে। যারা বেহেশতে সবচেয়ে নীচের স্তরে থাকবে, তারাও কস্তুরী আর কর্পূরের স্তুপের উপর বসে থাকবে। তাদের একথা মনেও হবেনা যে বেদীর উপরে যারা আছে, তারা তাদের চাইতে ভালো অবস্থানে আছে!”



আবু হুরায়রা তারপর আরো বললেন:

“তখন আমি নবীজী (সঃ)-কে প্রশ্ন করলাম: ‘হে আল্লাহর নবী! আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবো?’



নবীজী (সঃ) বললেন: ‘তোমরা যে সূর্য বা পূর্ণ চাঁদ দেখো, সেটা নিয়ে কোনো সংশয় আছে?’



আমরা বললাম: ‘না, কোনো সংশয় নেই।’



নবীজী (সঃ) বললেন: ‘সেরকম তোমার প্রতিপালক, যিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত, তাঁকে দেখার ব্যাপারেও কোনো সংশয় রেখোনা। সবাইকে এক এক করে বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে। তখন তিনি একজনের উদ্দেশ্যে বলবেন:



‘হে অমুক! তোমার কি মনে আছে যে যে তুমি অমুক দিকে অমুক কাজটা করেছিলে?’



সেই লোক তখন বলবে: ‘হে আমার প্রতিপালক, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করোনি?’



আল্লাহ বলবেন: ‘অবশ্যই ক্ষমা করেছি। আমার দয়ার কারনেই তুমি আজ এখানে এসেছো।’



সেসময় তাদের মাথার উপর একটি মেঘ এসে হাজির হবে। সেই মেঘ থেকে অবিরাম ধারায় সুগন্ধি বৃষ্টি হবে। এমন সুগন্ধ তারা আগে কখনো অনুভব করেনি।



আল্লাহ তখন বলবেন: ‘তোমরা এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার আশীর্বাদ উপভোগ করো, আর তোমাদের যা খুশি তাই নিয়ে নাও।’



তারপর আমরা একটি বাজারে আসবো, যেটা ফেরেশতাগণে পরিপূর্ণ। এই বাজারে এমন কিছু জিনিস থাকবে, যেগুলো আমরা আগে কখনো দেখিনি অথবা আগে তার নামও শুনিনি। সেখানে আমাদের যা খুশি সেটাই তুলে নেবো। কেনা বা বেচার কোনো প্রয়োজন থাকবেনা! একজন আরেকজনের সাথে দেখা করবে। উঁচু স্তরের মানুষ নীচু স্তরের মানুষের সাথে দেখা করবে। সত্যি বলতে, সেখানে নীচু স্তর বলে কিছুই থাকবেনা। কারন প্রত্যেকেই সবচেয়ে সুন্দর বেশভুষায় সজ্জিত থাকবে। সেখানে শোক বা দুঃখ করার কিছুই থাকবেনা।



তারপর আমরা সবাই আমাদের ঘরে যাবো। সেখানে আমরা আমাদের জীবনসঙ্গীর সাথে মিলিত হবো। তারা বলবে:

‘স্বাগতম! তুমি যখন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, এখন তার চাইতে আরো সুন্দর ও সুদর্শন হয়ে ফিরে এসেছো!’



আমরা তখন বলবো: ‘এই আশীর্বাদ আমাদের প্রাপ্য, কারন আজকে আমরা আমাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হয়েছি।”



আবু হুরায়রার এই বর্ণনাটা এসেছে কা’ব আল আহবার-এর বর্ণিত হাদীস থেকে। দারামি-ও তাঁর বইতে জামিয়াহদের যুক্তি খন্ডন করার জন্য কা’ব-এর এই বর্ণনাটার উদ্ধৃতি দেন।



কা’ব বলেছেন:

“আল্লাহ বেহেশতে প্রবেশ করার আগে বলবেন: ‘তোমার অধিবাসীদের জন্য সুগন্ধ ছড়াও।’ তখন চারিদিকে সুগন্ধের মাত্রা বেড়ে যাবে। তারপর পৃথিবীতে ঈদের দিনের সমান এক দিন সবাই বেহেশতের বাগানে ঘুরে বেড়াবে। আল্লাহ তখন আবির্ভূত হবেন, আর সবাই তাঁকে দেখতে পাবে। সুগন্ধি আর কস্তুরীর তীব্র সৌরভ বাতাসে ভেসে বেড়াবে। আল্লাহ তখন সবার ইচ্ছা পূরণ করবেন। তারা তাদের পরিবারের সাথে মিলিত হবে। আর তাদের সৌন্দর্য সত্তরগুণ বৃদ্ধি পাবে।” ৩৯



আবু হুরায়রা তাঁর উর্বর মস্তিষ্ক দিয়ে এই বর্ণনাটাকে আরো রঙ্গীন করেছিলেন। আমরা আরো দেখি যে এই হাদীসগুলি ছাড়াও খলিফাদের মতাবলম্বীরা কল্পনার রং মিশিয়ে পবিত্র কোরানের আয়াতগুলিকেও ব্যাখ্যা করেছেন।





২. পবিত্র কোরান বলছে:



“যারা মংগলকর কাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে মংগল পুরষ্কার এবং আরো অধিক। কালিমা ও হীনতা তাদের মুখমন্ডলকে আচ্ছন্ন করবেনা। তারাই বেহেশতের অধিবাসী, সেখানেই তারা স্থায়ী হবে।”

(সুরা ইউনুস: আয়াত ২৬)



এই আয়াতে ‘পুরষ্কার’ শব্দটার পরে যে ‘আরো অধিক’ শব্দটা আছে, খলিফাদের মতাবলম্বীরা ব্যাখ্যা করেছেন যে এই কথাটার অর্থ হলো আল্লাহর সাথে শারীরিকভাবে দেখা করা! তাবারি এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে নবীজী (সঃ)-এর চারজন সাহাবীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আর সুরতী-ও নয়জন সাহাবীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে নবীজী (সঃ) বলেছেন:



“আল্লাহ এই আয়াতে যে ‘আরো অধিক’ জিনিসের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, সেটা হলো আল্লাহ তাদের সামনে দর্শন দেবেন।”৪০



এছাড়াও আবু মুসা আশারি বর্ণনা দিয়েছেন যে নবীজী (সঃ) বলেছেন:

“শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ বেহেশতের অধিবাসীদের কাছে একজন ঘোষনাকারী পাঠাবেন। সেই ঘোষনাকারী উচ্চস্বরে বলবে যাতে সব অধিবাসী শুনতে পারে: ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য মঙ্গল পুরষ্কার এবং আরো অধিকের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। মঙ্গল পুরষ্কার হলো এই বেহেশত যেখানে তোমরা অবস্থান করছো। ‘আরো অধিক’ হলো তোমার প্রতিপালকের মহান মুখমন্ডল দর্শন করা।”



তায়ালাসি, আহমাদ হাম্বল, মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, তাবারি, সুরতী এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা সোহাইব-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন:



নবীজী (সঃ) কোরানের একটি আয়াত পড়লেন:



“যারা মংগলকর কাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে মংগল পুরষ্কার এবং আরো অধিক।”

(সুরা ইউনুস: আয়াত ২৬)



তারপর তিনি বললেন: “যখন মানুষ বেহেশতের বাগানে ঘুরে বেড়াবে, অথবা অনন্তকাল দোজখের আগুনে পুড়তে থাকবে, তখন এক ঘোষণাকারী এসে বলবে: ‘হে বেহেশতের অধিবাসীরা! একটা প্রতিশ্র“তি পূরণ করা হয়নি। আল্লাহ এখন সেটা পূরণ করবেন!”



“তখন বেহেশতের অধিবাসীরা প্রশ্ন করবে: ‘সেই প্রতিশ্র“তিটা কি? আল্লাহ কি আমাদের যথেষ্ট দেননি? আমাদের মুখকে কি উজ্জ্বল করেননি? তিনি কি আমাদের দোজখের আগুন থেকে দূরে রাখেননি?”



“একথা শোনার পর আল্লাহ তাঁর পর্দা উন্মোচন করবেন। তারা তাঁকে দেখতে পাবে। আল্লাহর নামে শপথ! আল্লাহর যতোগুলো আশীর্বাদ আছে, তার মধ্যে তাঁর মুখ দেখতে পারার মতো পরম সুখ আর আনন্দ কিছুতেই নেই।”৪১



ইবনে কাসির তাঁর তাফসিরে কোরানের এই আয়াতটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন: “যারা ভালো কাজ করেছেন, তারা বিভিন্ন পুরষ্কার পাওয়ার পাশাপাশি আশীর্বাদপুষ্ট হবেন আল্লাহর মহান মুখমন্ডল দেখার সুযোগ পেয়ে। আবু বকর সিদ্দিকী এবং আরো অনেকে এই কথাটাকে সমর্থন করেছেন .....”



তারপর তিনি পনেরোজন মানুষের তালিকা দিয়েছেন, যারা এই ধারণাকে সমর্থন করেন। এদের ভেতরে কয়েকজন নবীজী (সঃ)-এর সাহাবী, এবং বাকিরা তার পরবর্তী প্রজন্ম।



এমনকি ফখরুদ্দিন রাজি-ও এটা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে এখানে ‘আরো অধিক’ দিয়ে আল্লাহর দর্শনকে বোঝানো হয়েছে।৪২





৩. পবিত্র কোরানের এই আয়াতটি সম্পর্কেও নবীজী (সঃ)-এর উপর আরোপ করা কিছু হাদীসের প্রচলন আছে।



“সেদিন কোনো কোনো মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।”

(সুরা আল কিয়ামাহ: আয়াত ২২-২৩)



আনাস বিন মালিক বর্ণনা দিয়েছেন যে নবীজী (সঃ) বলেছেন:

“পুনরুত্থানের পরে, পুরুষ বিশ্বাসীরা আল্লাহকে প্রতি শুক্রবার দেখতে পাবে। আর নারী বিশ্বাসীরা তাঁকে দেখতে পাবে প্রতি ঈদ উল ফিতর বা ঈদ উল আযহা-র দিনে।”



এরকম আরেকটি হাদীসের বর্ণনায় আমরা দেখি যে আনাস বিন মালিক বলছেন:

“নবীজী (সঃ) উপরের আয়াতটি পাঠ করে বললেন: “শপথ আল্লাহর! এই আয়াতটিকে বাতিল করে দেয়া হয়নি। তারা অবশ্যই আল্লাহকে দেখতে পাবে। তাদেরকে প্রচুর খাবার ও পানীয় দেয়া হবে। সেখানে প্রচুর সুগন্ধি আর অলঙ্কারও থাকবে। তাদের ও তাদের প্রতিপালকের মধ্যকার পর্দাটি উঠিয়ে দেয়া হবে যাতে তারা তাদের প্রতিপালককে দেখতে পারে, আর প্রতিপালকও তাদের দেখতে পারেন। আল্লাহ ঠিক এই কথাটাই বুঝিয়েছেন যখন তিনি বলেছেন:



“এবং সেখানে সকাল-সন্ধ্যা তাদের জন্য থাকবে জীবনের বিভিন্ন উপকরণ।” ”

(সুরা মারইয়াম: আয়াত ৬২)



সুরতী তাঁর বইয়ে জাবির-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন:

“নবীজী (সঃ) বলেছেন: ‘আল্লাহ সব মানুষের সামনেই দেখা দেবেন, তবে আবু বকর সিদ্দিকী-র জন্য তিনি বিশেষভাবে আবির্ভূত হবেন।, ”৪৩



আবদুল্লাহ বিন ওমর বর্ণনা দিয়েছেন যে নবীজী (সঃ) বলেছেন:

“বেহেশতে যারা সবচেয়ে নীচের স্তরে থাকবে, তারা আল্লাহর আশীর্বাদ পাবে এক হাজার বছরের দূরত্ব থেকে। আর যারা সবচেয়ে উপরের স্তরে থাকবে, তারা প্রতি সকালে আর সন্ধ্যায় আল্লাহর মুখমন্ডল দেখতে পাবে।্”



তাবারি তাঁর তাফসিরে একই বিশ্বাসের কথা বলেছেন। ফখরুদ্দিন রাজি তাঁর তাফসির কাবীর-এ লিখেছেন:

“এই আয়াতটার ‘শারীরিকভাবে দর্শন দেয়া’ ছাড়া আর কোনো অর্থ হতে পারেনা।”



ইবনে কাসির বলেছেন: “এই আয়াতটা যখন বলছে ‘তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’- তার অর্থ তারা সত্যিকার অর্থেই আল্লাহকে দেখতে পাবে।”



আর সহী সিত্তাহ-এর মাধ্যমে এটা প্রতিষ্ঠিত যে বিশ্বাসীরা পরকালে আল্লাহকে দেখতে পাবে।



এমনকি সমসাময়িক কালেরও একজন বিশেষজ্ঞ, সাইয়্যিদ কুতুব (মৃত্যু ১৩৮৬ হিজরী), তাঁর লেখা “ফি জিলাল আল কুরআন” বইটিতে দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে শেষ বিচারের দিনে আল্লাহকে সশরীরে দেখা যাবে। তারপর তিনি সেই দর্শনের একটি আড়ম্বরপূর্ণ বর্ণনা দিলেন। তিনি লিখেছেন:

“এই আয়াতে এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে যেটা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না, মন যেটাকে উপলব্ধি করতে পারেনা। এই অভিজ্ঞতা তখন হবে, যখন ধার্মিক লোকেরা এক অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক উচ্চতার স্তরে অবস্থান করবে। তখন বেহেশতে এতো সম্পদ আর আনন্দের ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও তাকে তুচ্ছ আর ক্ষুদ্র মনে হবে। তখন উজ্জল মুখগুলি সরাসরি আল্লাহর গৌরবময় মুখমন্ডলের দিকে তাকাবে। সে কি এক উচ্চতায় অবস্থান! কি উঁচুস্তরের মর্যাদা!”



“নিজেকে সকল বাধা থেকে মুক্ত করে বিশুদ্ধ না হলে মানুষ সেই স্তরে যেতে পারবেনা। এ এক এমনই মহান স্তর, যে এটা যাবতীয় সংশয় আর কলঙ্ক থেকে মুক্ত। আকাঙ্খা শুধু একটাই, সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত আল্লাহকে দেখা।”



“কেনো কিছু মানুষ এই অভিভূত করা আলো আর ব্যাখ্যাতীত আনন্দের অভিজ্ঞতাটাকে প্রত্যাখ্যান করতে চায়? কেনো তারা নিজেদের মধ্যে পান্ডিত্যপূর্ণ আর যৌক্তিক আলোচনায় জড়িয়ে পড়তে চায় এমন একটা বিষয় নিয়ে, যেটা মানুষের বোধের বাইরে?”



“তাহলে আসুন আমরা এই অভিভূত করা বিশুদ্ধ আনন্দকে গ্রহণ করি। আর সত্যকে ঘিরে আমাদের কল্পনাশক্তিকে যতোদূর পারি ছড়িয়ে দেই। এই উচ্চাভিলাষটাই এক মহান বদান্যতা! এটাকে অতিক্রম করতে পারে শুধু সেদিনের অভিজ্ঞতা, যেদিন আল্লাহর ঐ মহান মুখ দেখতে পাবো।”৪৪



এবারে আমরা এই বিষয়ে আহলে বায়াত (আঃ)-এর শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করবো।







আহলে বায়াত (আঃ)-এর ব্যাখ্যা

১. আবু আল সালত আল হিরাওয়ি-এর উদ্ধৃতি দিয়ে আবদ-উস-সামাদ বিন সালেহ বর্ণনা করেছেন যে একবার হিরাওয়ি ইমাম রিজা (আঃ)-কে প্রশ্ন করলেন: “এই ধরনের হাদীস প্রচারকারীদের সম্পর্কে আপনি কি বলবেন যারা বলে যে বিশ্বাসীরা বেহেশতে আল্লাহর বাসস্থানে তাঁকে দেখতে যাবে?”



ইমমি (আঃ) বললেন: “হে আবু আল সালত, আল্লাহ তাঁর রাসুল (সঃ)-কে তাঁর সকল সৃষ্টির উপর সর্বাধিক মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, সকল নবী-রাসুল এবং ফেরেশতাদের চাইতেও বেশি মর্যাদায়। নবীজী (সঃ)-কে মান্য করা বোঝাতে তিনি তাঁকে মান্য করার কথা বলেছেন। ইহকালে আর পরকালে নবীজী (সঃ)-এর দর্শন বোঝাতে তিনি তাঁর দর্শনের কথা বলেছেন।”



আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন:



“কেউ রাসুলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করলো।”

(সুরা আল নিসা: আয়াত ৮০)



এরপরর আল্লাহ আবারো বলেছেন:



“যারা তোমার কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে, তারা তো আল্লাহর কাছেই আনুগত্য প্রকাশ করে।”

(সুরা আল ফাতহ: আয়াত ১০)



আর নবীজী (সঃ) নিজেই বলেছেন: “যারা আমার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরে আমাকে দেখতে আসে, তারা আল্লাহকে দেখার সমান পুরষ্কার পায়।”



“বেহেশতে নবীজী (সঃ) থাকবেন সবচেয়ে উপরের স্তরে। সেজন্য নবীজী (সঃ)-এর সাথে দেখা করা এখানে আল্লাহর সাথে দেখা করার সমার্থক।”



আবু আল সালত তখন বললেন: “হে নবীজী (সঃ)-এর বংশধর, তাহলে আমরা এই হাদীসটার ব্যাখ্যা কিভাবে করবো যেটা বলছে: ‘যে এটা প্রচার করে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, সে ই আল্লাহকে দেখতে পাবে’?”



ইমাম (আঃ) বললেন: “হে আবু আল সালত, যে আল্লাহর উপর কোনো শারীরিক মুখমন্ডল আরোপ করে, সে ধর্মের অবমাননা করে। এখানে আল্লাহর নবী-রাসুলদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা সবাই শান্তিতে থাকুন, কারন তাঁরাই আমাদের আল্লাহর পথে, তাঁর বিশ্বাসের দিকে নিয়ে এসেছেন।”



এই কথাটাই আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন:



(ক) “ভূ-পৃষ্ঠে যা কিছু আছে সমস্তই নশ্বর। অবিনশ্বর কেবল তোমার প্রতিপালকের মুখমন্ডল, যিনি মর্যাদা এবং মহিমায় পরিপূর্ণ।”

(সুরা আল রাহমান: আয়াত ২৭)





(খ) “আল্লাহর মুখমন্ডল ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল”

(সুরা আল কাসাস: আয়াত ৮৮)



“বিশ্বাসীদের জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও তৃপ্তিকর পুরষ্কার হলো তারা শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর নবী-রাসুলগণের সাথে সাক্ষাত করতে পারবেন।”



এরপর নবীজী (সঃ) বলেছেন: “যারা আমার আহলে বায়াত (আমার পরিবারের সদস্য) এবং আমার বংশধরদের ঘৃণা করে, শেষ বিচারের দিনে তারা আমার সাথে সাক্ষাত করবেনা, আমিও তাদের সাথে সাক্ষাত করবোনা।”



নবীজী (সঃ) একবার তাঁর সাহাবীগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন:

“তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছে, যাদের সাথে এই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর আমার আর কখনো সাক্ষাত হবেনা।”



“হে আবু আল সালত! আল্লাহ, যিনি সবচেয়ে উপরে অধিষ্ঠিত, তাঁর উপরে কোন স্থান বা অবস্থান আরোপ করা যায়না। দৃষ্টি বা কল্পনাশক্তি দিয়ে তাঁকে ধারণ করা যায়না।”৪৫





২. ইবরাহিম বিন আবু মাহমুদ বর্ণনা দিয়েছেন যে একবার ইমাম রিজা (আঃ)-কে কোরানের একটি আয়াত নিয়ে প্রশ্ন করা হলো:



“সেদিন কোনো কোনো মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।”

(সুরা আল কিয়ামাহ: আয়াত ২২-২৩)



ইমাম (আঃ) বললেন: “এর অর্থ হলো, সেই দিন বেহেশতের পুরষ্কারের আকাঙ্খায় সবার মুখ আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।”৪৬





৩. কোরানের আরেকটি আয়াত বলছে:



“যারা মংগলকর কাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে মংগল পুরষ্কার এবং আরো অধিক।”

(সুরা ইউনুস: আয়াত ২৬)



আমরা এখানে আহলে বায়াত (আঃ)-এর তিনজন ইমামের বর্ণনা তুলে ধরছি যেখানে ব্যাখ্যাগুলোর মূল কথাটা একই রকম।



(ক) আমিরুল মুমিনিন ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন:

“এখানে ‘মংগল পুরষ্কার’ বলতে বেহেশতকে বোঝানো হয়েছে, এবং ‘আরো অধিক’ বলতে পৃথিবীতে বেশি প্রাপ্তির কথা বোঝানো হয়েছে।’ ”



(খ) ইমাম আল বাকির (আঃ) বলেছেন:

“এই আয়াতটি যে অতিরিক্ত পরিমানের কথা বলছে, সেটা হলো পৃথিবীর জীবনে অতিরিক্ত পুরষ্কার। এখানে শেষ বিচারের দিনের পুরষ্কারের কথাকে বোঝানো হচ্ছেনা।”



(গ) ইমাম জা’ফর আল সাদিক বলেছেন:

“এই আয়াতে ‘আরো অধিক’ বলতে এই পৃথিবীতে পুরষ্কারের কথা বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ বিশ্বাসীদেরকে তাদের জীবদ্দশাতেই এই পুরষ্কার দেবেন। তবে পরকালের পুরষ্কার থেকেও তাদের বঞ্চিত করবেননা। আল্লাহ তাদের ভালো কাজের জন্য ইহকাল ও পরকাল, দুই জায়গাতেই পুর®কৃত করবেন।”









পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা

খলিফাদের মতাবলম্বীদের লেখা হাদীসের বিভিন্ন বই ও তাফসিরে আবু হুরায়রা এবং তাঁর মতো আরো অনেকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে আল্লাহ বেহেশতগুলো ভালো করে দেখবেন, এবং তাঁর উপস্থিতিতে সবাইকে এক এক করে বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে। তারপর বেহেশতের অধিবাসীরা প্রচুর পরিমানে সুগন্ধি আর অলঙ্কার নিয়ে এসে তাদের জীবনসঙ্গীর সাথে সাক্ষাত করবে।



আবু হুরায়রার এই বর্ণনাগুলি যারা বিশ্বাস করেন, তাদের নীচের প্রশ্নগুলি করা যেতে পারে:



১. এই সাক্ষাত কি প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে, অথবা অন্য কোনো নিয়ম মেনে হবে?



২. হাদীসের এই দুই বর্ণনাকারী, আবু হুরায়রা এবং কা’ব আল আহবার, কেনো আল্লাহর সাথে এমন ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাতকারীদের ভেতরে কোনো নারী বিশ্বাসীকে শামিল করেননি?



সর্বশক্তিমান আল্লাহর আরশ বা কুরসী-র বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন:

আল্লাহ আকারে এতো বিশাল যে তিনি তাঁর আসনের সবদিকেই চার আঙ্গুল বেশি বি¯তৃত থাকেন। তাঁর আসনটি যে আটটি পাহাড়ী ছাগল পিঠের উপর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তারা এতো বিশাল যে তাদের পায়ের ক্ষুরগুলি দুই বেহেশতের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান দূরত্বে ছড়ানো। এরকম বেহেশত আছে সাতটি, এদের প্রত্যেকের মধ্যে দূরত্ব সত্তর বছরের বেশি।



তাহলে আবু হুরায়রা এবং কা’ব আল আহবারের ইশ্বর, যিনি আকারে এতো বিশাল, তিনি কিভাবে এই ক্ষুদ্র দেড় মিটার উচ্চতার মানুষের সাথে সাক্ষাত করবেন?



রাগিব তাঁর লেখা “মুফরাদাত আল কুরআন”-এ লিখেছেন যে ‘নাদিরাহ’ শব্দটার দুটি অর্থ আছে। একটা হলো ‘দর্শক’। আরেকটা হলো ‘যে প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে।’



আর পবিত্র কোরানেও এই শব্দটা দিয়ে ‘প্রত্যাশা’ বোঝানো হয়েছে:



“আমি তাদের কাছে উপঢৌকন পাঠাচ্ছি। দেখি, দূতেরা কি নিয়ে ফিরে আসে।”

(সুরা নামল: আয়াত ৩৫)



আহলে বায়াত (আঃ) এটা খুব পরিষ্কাভাবেই বলেছেন যে এই আয়াতটা শারীরিকভাবে আল্লাহকে দেখার কথা বলছেনা। এখানে রূপক অর্থে বোঝানো হয়েছে পুরষ্কার পাওয়ার আশায় বিশ্বাসীদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।



একইভাবে যখন তাঁরা কোরানে উল্লিখিত ‘জিয়াদা’ বা ‘আরো অধিক’ শব্দটাকে ব্যাখ্যা করতে চান, তখন কোরানের আলোকেই সেই ব্যাখ্যাগুলি করেন।



আল্লাহ বলেছেন:



“যারা সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে এই পৃথিবীতে মংগল। এবং আখিরাতের বাসস্থান আরও উৎকৃষ্ট। এবং মুত্তাকীদের আবাসস্থল কতো উত্তম।”

(সুরা আল নাহল: আয়াত ৩০)





‘জিয়াদা’ শব্দটা নিয়ে আহলে বায়াত (আঃ)-এর দেয়া ব্যাখ্যাটা এখানে যোগ করে দেয়া যায়:



বিশ্বাসীরা পৃথিবীতে জীবদ্দশায় যে ভালো কাজগুলো করেছে, তার প্রতিদান হিসেবে তাদের পুরষ্কার দেওয়া হবে বেহেশত। কোরানের এই আয়াতের ব্যাখ্যাটা দুই পক্ষের বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে মেনে নেন। আল্লাহ উত্তম পুরষ্কার হিসেবে তাদের দেন বেহেশত। আর অধিক পুরষ্কার দেন পৃথিবীর জীবনে।



উদাহরণ হিসেবে আমরা একটা হাদীসের বর্ণনা দিতে পারি:



আমাদের নবীজী (সঃ) বলেছেন: “কেউ তার আত্মীয়-স্বজন ও জ্ঞাতিভাইদের যতœ নিলে সেটা শেষ বিচারের দিনে তার উপকারে আসবে।”



পরকালে বিশ্বাসীরা একটা পুরষ্কার পাবে। তবে সেই পুরষ্কারের অধিক, সেটা পাওয়া যাবে ইহকালে এই পৃথিবীতে। হতে পারে সেটা দীর্ঘায়ু এবং জীবনের পরিপূর্ণতা।

চলবে...

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.