| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আহমেদ মাসুদ বিপ্লব
সত্য লিখতে বাঁধা কই, বাঁধা এলে মানবো কেন?
আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশটি যদি দুইটি ভৌগলিক অবস্থানের আওতায় ফেলি তাহলে সিংহভাগ পড়বে সমতলীয় আর সামান্য কিছু অংশের সাথে বিশেষণ যোগ করতে হবে পার্বত্য বা পাহাড়বেস্টিত অঞ্চল। অথছ এই সামান্য কিছু অংশকে নিয়ে যতখানি আলোচনা-সমালোচনার ঝড় দেশের মাটিতে বয়ে যায় তার বিন্দুমাত্রও সমতলীয় কোন অঞ্চলকে ঘিরে আলোচিত বলেতো মনেই হয়না। সত্য-মিথ্যা-গুজবের চমৎকার চাষাবাদের জন্য যদি দেশে খুব উপযুক্ত এলাকা থাকে তাহলে সেটা অবশ্যই পার্বত্য তিন জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি আর বান্দরবান। এতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু সুযোগ বুজে একটা কথা জায়গামত ছড়িয়ে দিন, এরপর কোন নিভৃতে কোনায় বসে খেলাটা দেখতে থাকুন। আপনি নিজেও কল্পনা করতে পারবেন না কি আপনি ঘটিয়ে এসেছেন! আর যদি অযৌক্তিক মিথ্যা কোন গুজব রটিয়ে আসতে সক্ষম হন তাহলে আপনার ছড়িয়ে অাসা গুজবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে হয়তো আপনার নিজেরই মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হবে। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে সবচেয়ে যে দুইটি কথা অধিকহারে আলোচিত হয়ে থাকে তার একটি হলো কথিত স্বাধীন জুম্মল্যান্ড নামে পৃথক একটি রাষ্ট্রের কথা আর অপরটি হলো পাহাড়ে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী থাকবে কি - থাকবে না। বাদবাকী কথা যা আলোচনা হয় তা কেবল কথার কথাই বলা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন সাধারণ আদিবাসী কখনো পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র (কথিত জুম্মল্যান্ড) চায়নি, চাইবার কথাও নয়। মানুষ চায় কখন? যখন পায়না। আর কাউকে যদি তার প্রকৃত প্রাপ্য থেকেই বঞ্চিত করা হয় সেক্ষেত্রে ক্রুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা চাইলেও কি দোষ দিতে পারবেন? যদি সেটা অপরাধের বা দেশদ্রোহীতার উদাহরণভুক্ত হয় তাহলেতো আমার বাবা, চাচা, আত্মীয়-স্বজনসহ রাষ্ট্রের সবাই-ই অপরাধী একশতভাগ। ১৯৭১ সালের কথা মাথায় রাখলেই হয়। অথছ আমাদের কিছু স্বার্থান্বেষীরা যাদের লক্ষ্যই হলো সুন্দর এই দেশটাতে আজীবন ঝামেলাই বাঁধিয়ে রাখা- তারা প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে যাচ্ছে বিষবাষ্প। বাঙালী-পাহাড়ী আদিবাসী উভয় পক্ষেই রয়েছে ক্ষমতার লোভী স্বার্থান্বেষী মহলের পদচারণা। এরা শান্ত পরিস্থিতি সুন্দর পরিবেশ কখনোই কামনা করতে পারেনা যেন স্রষ্টাপ্রদত্ত অদৃশ্য কোন কারণের বলে! সঠিক তথ্য যাচাই না করে কেবলমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোন ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়না। বরং তাতে জোর খাটাতে গেলে উল্টা ফলাফল আসতে বাধ্য। সত্যকে সত্য দিয়ে, মিথ্যাকে ‘মিথ্যাটা যে আসলেই মিথ্যে’ তা প্রমাণ করে আলোচনা-সমালোচনা করলে কোথাও আর কোন ঝামেলাই থাকবার কথা নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সাধারণ প্রতিটি আদিবাসী নাগরিক স্বাধীন বাংলাদেশকেই মনে-প্রাণে ভালবাসে, ভালবাসতে চায়। বাঙালীদের পাশাপাশি তারাও জাতীয় সংগীত গেয়েই স্কুলের কার্যক্রম আরম্ভ করেন, তারাও আমাদের মতই স্বাধীনতা দিবস বিজয় দিবস পালন করেন। আর সেটা আনন্দের সাথে উৎসবমুখর পরিবেশেই পালন করেন, কোন কৃত্রিমতা নিয়ে নয়। কিছু কিছু অতিরঞ্জিত কর্মকান্ডের মাধ্যমে আমরাই বরং তাদের মন থেকে দেশের প্রতি ভালবাসাটা তুলে ফেলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। হয়তো উল্লেখ করবার মত সংখ্যার দাবীদার তারা নন, তারপরও অনেক পাহাড়ীরও রক্ত ঝরেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীদের পাশাপাশি। শুধুমাত্র একজন রাজা ত্রিদিব রায়ের কারণে আজ যদি সকল পাহাড়ী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে ফেলি তাহলে ইতিহাসও একদিন আর ক্ষমা করবেনা আমাদের। ত্রিদিব রায়ের সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে; তবে তিনিও তার জাতির কথা ভেবেই পাকিস্তানীদের সমর্থণ করেছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালীর নিশ্চিত পরাজয় ঘটবে বা বাঙালীকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার মত কোন অপকর্মে লিপ্ত হননি। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় রাখাতে স্বীকৃতিসূচক বীরের পদবীধারী মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়ের বুকেও ছিলেন, এখনো আছেন। জাতির জনক বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রাখবার রেকর্ডও তাদের আছে। বাঙালী জাতির সাত শ্রেষ্ঠ সন্তান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ এর এক বীরশ্রেষ্ঠকে ভালবেসে তার লাশ তুলে এনে নিজেদের পার্বত্য অঞ্চলেই সমাহিত করেছিলেন পাহাড়ীরা। এখনো রাঙামাটির নানিয়ারচরে লেকপাড়ে চিরশান্তির ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ। এতকিছুর পরও শুধুমাত্র মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আজ যেন সবকিছুকে অস্বীকার করবার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চারপাশে। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ আমাদের সমতলে যেমন আছে তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামেও তার কমতি থাকবার কথা নয়। কারণ সেটাতো অার এই বাংলাদেশের বাইরে নয়। মূল দেশেই যে ক্ষত আছে তা দেশের অংশবিশেষে ক্ষতস্থান তৈরী করবেনা এটাতো আশা করাটাই ভুল। তাই সমতলে যেমন চিকিৎসা চলছে পার্বত্য অঞ্চলেও তেমন চিকিৎসাই চলবার কথা। তবে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন বলে চিকিৎসার ধরণেও ভিন্নতা রয়েছে।
সমতলে সাধারণত কোন ধরণের বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া ব্যাতীত কখনো সামরিক বাহিনী অাইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য সিভিল এলাকায় নামেন না। কিন্তু পার্বত্য পরিস্থিতি অনেক কাল আগে থেকে (স্বাধীনতা পরবর্তী নয় বরং স্বাধীনতা লাভের অনেক বছর আগে সেই বৃটিশদের সময় থেকেই) কিছুটা বৈরী থাকায় সেখানে সব আমলেই বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়েছিল। যার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশেও পার্বত্য তিন জেলায় স্বাভাবিক নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীকে বিশেষভাবে নিয়োজিত করা হয়েছিল। তাছাড়া সীমান্তের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের বহিরাগতদের ভয়তো আছেই।একটা সময় ছিল যখন বলতে গেলে প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তেই যুদ্ধ যুদ্ধ একটা ভাব সেখানে বিরাজ করতো। এখন সেটা নেই। তবে দীর্ঘদিনের লালন করা চর্চার রেশ কাটাতে না পেরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোন অংশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তৎক্ষণাত সেটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হয় বিধায় এখনো সেখানে সামরিক বাহিনীকে সদা সর্বদা প্রস্তুত রাখতে হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ আদিবাসীরা কখনো সেনাদের এই অবস্থানকে বিরক্তিকর বা ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনাই করেনি। বরং তাদের নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই স্বাগত জানিয়েছিল। সুনির্দিষ্ট দেশদ্রোহীতা বা তেমন মারাত্মক আকারের অপরাধের কোন অপরাধিকে সেনাবাহিনী আটক করলে বরং তারাও আনন্দিত হয়, হতো। তারা শুধু নয়, সেখানকার বসবাসরত আদি বাঙালীরাও যেটা অপছন্দ করেন সেটা হলো কথায় কথায় সাধারণ বিষয়গুলোতেও সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টা। যেটা পুলিশের কাজ সেটা সামরিক বাহিনী কেন করবে? তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে থানা-পুলিশ রেখে অযথা রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চাপ ফেলা কি যুক্তিতে?
পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানকার ইস্যু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে বাংলাদেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। এ অঞ্চলে কোন গ্রুপ বা গোষ্ঠীকে একক মনোপলি দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে কোনো বহিঃশক্তির কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা-সংগঠনের হস্তক্ষেপেরও অবকাশ নেই। যদি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে কারো ন্যায়সঙ্গত সহযোগিতা সরকার কামনা করে, কেবল তখনই নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে এবং যথানিয়মে বাইরের কেউ সহায়তা করতে পারে। কিন্তু তা কিছুতেই বাংলাদেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন করে নয়। সন্দেহ নেই, গত কয়েক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছিল। সেখানে অনেক রক্ত ঝরেছে। মরেছে অনেক নিরীহ প্রাণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন প্রয়োজন সহাবস্থান, শান্তি ও উন্নয়ন। এই অঞ্চলে আর যেন কোন রক্ত না ঝরে। নিঃশেষ হয় না যেন নিরীহ প্রাণ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারতো বাংলাদেশের শান্তির সুইজারল্যান্ড; হয়ে গিয়েছে তীব্র অশান্তির লেবানন। অশান্তি কাউকে রক্ষা করেনি; কোন পক্ষকেই বিজয়ী করেনি। বাড়িয়েছে হিংসা, রক্তপাত ও বিভেদ। সংঘাত নিরসনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনাও চলেছে পাশাপাশি এবং সে ধারায় ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। ‘শান্তিচুক্তি’ শান্তি আনতে পারেনি বরং জন্ম দিয়েছিল নতুন করে উত্তেজনার। ১৯৯৭ সালের চুক্তির পরও পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি ঘটেনি- এটা সঠিক এবং এই ইস্যুর সুষ্ঠু, স্থায়ী ও যথাযথ সুরাহার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ববোধ, আন্তরিক সততা ও সংযম অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পাহাড়ী-আদি বাঙালী- সেটেলার (স্থানান্তরিত) বাঙালী সকলেই সহযোগীরূপে ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু অন্যায় ও অযাচিত নাক গলানোর মাধ্যমে সীমা লঙ্ঘন করার অধিকার নেই কারো; সেটা বাঙালীই হোক, কি পাহাড়ী কিংবা আমাদের সামরিক বাহিনী। কিভাবে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মাঝে বৈষম্য-বিভ্রান্তি দূর হয়ে পার্বত্যাঞ্চলে প্রকৃত শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেটাই হতে হবে সবার অভীষ্ট। আর বাংলাদেশের উন্নয়ন আর নিরাপত্তার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি অত্যন্ত জরুরী। আর তার জন্য সর্বপ্রথম যেটা জরুরী সেটা হলো সেখানকার তথ্যগুলোকে প্রকৃতভাবে জনসন্মুখে উপস্থাপন করা। স্বার্থের কারণে অসত্য তথ্যের প্রবাহ কোন কালেই কোন শুভ ফলাফল বয়ে আনতে পারেনি, এখনো পারবেনা বলেই বিশ্বাস করি। 
©somewhere in net ltd.