নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লেখালেখি

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১০)

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:২৫


আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৯)

চাও নাহি চাও, ডাকো নাহি ডাকো,
কাছেতে আমার থাকো নাহি থাকো,
যাবো সাথে সাথে, রব পায় পায়, রব গায় গায় মিশি-

পরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ির ভেতর হৈ হুলস্থূল চলছে। উঠানে ঢেঁকিছাঁটা আলো চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠেপুলি তৈরি করা হচ্ছে। ভোরবেলায় পদ্মপুকুরে জাল ফেলে কয়েকটা রুই কাতলা মাছ ধরা হয়েছে। উঠানের এক পাশে মাছগুলোর আঁশ ছাড়িয়ে নাড়ীভুঁড়ি বের করা হচ্ছে। এরপর মাছগুলো একটা মাটির হাঁড়িতে ভরে বড় বড় মান কচুর পাতা দিয়ে হাঁড়ির মুখ বাঁধা হবে।
বারান্দায় কাঁচাপাকা আম ভরে ছালার মুখ সেলাই করা হচ্ছে। বড় চাচীমার ঘরে দুটো টিনের সুটকেসে প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় ভরা হচ্ছে। চাকর বাকররা মহা ব্যস্ত। তাদের কথা বলার সময় নেই। বাড়ির বাইরে দুটো ছই তোলা গরুর গাড়ি প্রস্তুত। গাড়োয়ানদের খতে দেওয়া হয়েছে। দাদাজানের ঘরের বারান্দায় বসে তারা ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খাচ্ছে। মুখে তাদের তৃপ্তির হাসি।

টিউবওয়েলে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে দেখি, বড় চাচীমা আমার লুঙ্গি গামছা ভাঁজ করে সুটকেসে ভরার জন্য আলেয়ার হাতে দিচ্ছেন। আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার মা?’
‘আলেয়ার নানীর বাড়ি যাচ্ছি আমরা। কেন, ও তোমাকে কিছু বলেনি?’
‘না তো!’
আলেয়া মাথা নিচু করে বললো, ‘কাল তো মেজভাইয়ের সাথে সারাদিন দেখাই হয়নি। বলবো কখন?’
‘বাহ্! বলবি কখন মানে? রাতে দেখা হলো না?’
‘বলতে ভুলে গেছি। রাতে তুমি আর মেজভাই গাল মন্দ করে যেভাবে আমার মাথা গরম করে দিলে তাতে এসব কথা মনে থাকে নাকি?’
বড় চাচীমা বললেন, ‘বদমাশ মেয়ের কথা শোন। এখন ওকে চড়াতে ইচ্ছা করে কিনা বলো।’
আমি হেসে বললাম, ‘আচ্ছা থাক। এখন বলো, হঠাৎ ওর নানীর বাড়ি যাওয়া হচ্ছে কেন? আর আমি না গেলে হয় না? আমার যাওয়ার দরকার কী?’

বড় চাচীমা যা বললেন সংক্ষেপে তা’ এইরকম ঃ আলেয়ার নানা বেঁচে নেই। বৃদ্ধা নানী চলৎশক্তিহীন। আমাকে একবার চোখে দেখার তাঁর খুব ইচ্ছা। মধুপুর থেকে চার ক্রোশ দূরে আলমডাঙ্গা গ্রামে আলেয়ার নানীর বাড়ি। আমার মা-বাবা, ভাই বোন সবারই সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পথ ঘাট খুব খারাপ। গরুর গাড়িতে ঝাঁকুনি খাওয়ার ভয়ে একে একে সবাই না করে দিয়েছে। বড়ভাই তাসের নেশা ছেড়ে যাবেন না। ইদানিং তাঁর তাসের সাথে সাথে দাবার নেশাও দেখা দিয়েছে। রুচি পরিবর্তনের জন্য চাচাদের সাথে তিনি মাঝে মাঝে দাবা খেলছেন। এমন জমজমাট আসর ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আব্বা বিবিসির মায়া ছাড়তে পারছেন না। সরকার বাড়ির বড় বউ হিসাবে এ গাঁয়ে মায়ের ভীষণ দাপট। পান খাওয়া আর পাড়া বেড়ানো তাঁর দৈনন্দিন কাজ। মহিলা মহলে তিনি গালগল্পের মধ্যমনি। এসব ছেড়ে তাঁর যাওয়ার ইচ্ছা নাই। আমার অন্যান্য ভাইবোনদের জন্য ভাঙ্গাচোরা রাস্তা মহা আতংকের বিষয়। অতএব, একমাত্র আমি ছাড়া রাজ্য উদ্ধারের মতো আর কেউ নেই। আলেয়ার সাথে আমার ভাব সাব আছে। ওর নানীবাড়িতেই যাওয়া হচ্ছে। আমি নিশ্চয় রাজী হয়ে যাবো বলে আমার মা এসে ইতিমধ্যে বড় চাচীমার কানে কানে মন্ত্র পড়ে দিয়ে গেছেন।

আউড়ের পালা বিছিয়ে দুটো গরুর গাড়ির ছইয়ের ভেতর গদি করা হয়েছে। সেই গদির ওপর মোটা করে দুটো কাঁথা বিছিয়ে বালিশ ও তাকিয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ শুয়ে বসে যেভাবে ইচ্ছা আমরা যেতে পারবো। কোন কষ্ট হবে না। আলমডাঙ্গার যাত্রী বলতে আমি, আলেয়া, আলেয়ার মা আর একজন চাকর।
বড় চাচীমা আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘আপত্তি করো না বাবা। আমার মা বুড়ো মানুষ, আজ আছে কাল নাই। তোমাকে একবার দেখার তার খুব ইচ্ছা। তার আসার ক্ষমতা থাকলে নিজেই চলে আসতো। পঙ্গু মানুষ, চলা ফেরার ক্ষমতা নাই। একটু কষ্ট হলেও তার ইচ্ছাটা পূরণ করো বাবা।’
আমি বললাম, ‘বেশ যাবো, কিন্তু আমরা কয়দিন থাকবো সেখানে?’
‘তোমার যে কয়দিন থাকতে ইচ্ছা করে সে কয়দিনই। একদিনও বেশি থাকবো না বাবা।’
আমি রাজী হয়েছি, এতেই বড় চাচীমার চোখ ভিজে উঠেছে। আমার কপালে চুমো দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
গোসল সেরে নাস্তাপানি খাওয়া হলো। প্যান্ট শার্ট পরে ঘরের দেয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে ফিট ফাট করছি। চুল আঁচড়ানোর জন্য চিরুনিটা হাতে নিতেই আমার পেছন থেকে সেটা কে যেন কেড়ে নিল। ফিরে তাকিয়ে দেখি আলেয়া।
‘বলেছি না এই কাজটা আমার! মাথা নিচু করো, হাতে পাচ্ছি না।’
আমি ওর হাত থেকে চিরুনি কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘যা ভাগ! তুই চুল আঁচড়ে দিলে আমাকে শকুনের মতো দেখায়।’
‘আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। তুমিই আঁচড়াও। তবে একটু তাড়াতাড়ি করো। আমরা সবাই রেডি।’
‘এই শোন, শোন!’
আলেয়া ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও আবার ফিরে এলো। বললো, ‘কী কথা, তাড়াতাড়ি বলো।’
‘এই যে বললি তোরা সবাই রেডি। রেডি মানে কী?’
আলেয়া ঝটপট জবাব দিল, ‘রেডি মানে তৈরি। মানে আমরা সবাই এখন গাড়িতে উঠবো। তুমি কলেজের ছাত্র, অথচ এই সহজ ইংরেজিটা জানো না?’
‘তা’ তুই এত সুন্দর ইংরেজি জানিস, অথচ......।’
‘মেজভাই!’ আলেয়া কটমট করে তাকালো আমার দিকে। আমি জিভে কামড় দিয়ে বললাম, ‘সরি!’
‘সরি মানে কী?’
‘সরি মানে দুঃখিত। মানে আমি দুঃখ পেয়ে ক্ষমা চাচ্ছি।’
হেসে ফেললো আলেয়া। বললো, ‘তাহলে আর একবার সরি বলো।’
‘কেন, আর একবার বলবো কেন?’
আলেয়া মাথা নিচু করে বললো, ‘যে লোক নিজের বউকে ভালো করে দেখে না, তাকে ক্ষমা চাইতে হয়। কারণ চোখ থেকেও সে কানা, দেখতে পায় না।’

হায় আল্লাহ! আলেয়া তো ঠিকই বলেছে! এতক্ষণ তো আমি খেয়ালই করিনি! বললাম, ‘থাম, থাম।’ ঘরের জানালা খুলে দিয়ে বাইরের আলোয় ওকে দেখে চমকে গেলাম আমি। লাল রঙের সালোয়ার আর সাদা জমিনের ওপর লাল রঙের ফুলের নকশা কাটা ছিট কাপড়ের নতুন কামিজ। গাঢ় কমলা রঙের লিলেনের ওড়না। দুই কানে সোনার দুল। গলায় সোনার সীতাহার। দুই হাতে দুই জোড়া সোনার বালা। কপালে টিকলির নিচে লাল টিপ। কমলার কোয়ার মতো পাতলা দুই ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। লালচে ফর্সা টকটকে মুখে পাউডারের প্রলেপ। কাজল পরা টানা টানা দুই চোখে খুশির ঝিলিক। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ময়ূরের পেখম মেলা কালো চুলে সুগন্ধী তেলের মিষ্টি ঘ্রান। দুই পায়ে রূপার নূপুর। আমার সামনে যেন দাঁড়িয়ে আছে রোমানদের পৌরাণিক সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস।
আমার মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে গেল ‘সরি!’
চোখের পলক না ফেলে আমি কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়েছিলাম, জানি না। ওর ‘মেজভাই’ ডাক শুনে হুঁশ হলো। বললাম, ‘কী রে কিছু বলবি?’
‘আব্বাকে একটু বলে দাও না আমি বোরখা পরবো না। তুমি বললে শুনবে।’
আমি একটু ভেবে বললাম, ‘বোরখা পরতে বলছে, পর। মধুপুর পার হয়ে একটু দূরে গিয়ে খুলে ফেলিস।’
‘ইশ্ মেজভাই, তোমার কী বুদ্ধি! এ কথা তো আমার মাথায় আসেনি! এতে দুই কূলই রক্ষা হয়। আসলে তুমি কলেজে পড়ো তো, তাই তোমার অনেক বুদ্ধি।’

আলেয়া নূপুরের আওয়াজ তুলে নাচতে নাচতে চলে গেল। আমি চুল আঁচড়ানো ভুলে গিয়ে থ’ মেরে বসে রইলাম বিছানার ওপর। মেয়েটা বউয়ের সাজ সেজেছে। যেন সত্যি সত্যিই সদ্য বিবাহিত বউ স্বামীর সাথে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এক মুহূর্তের জন্য আমাকে মনে করিয়ে দিল আলেয়ার নিজেরই বলা সেই কথাটা ‘হবে কিনা আল্লাহই ভালো জানে’। কথাটা তো সত্যি। ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ ছাড়া আর কে জানে?
খোলা জানালা দিয়ে সুদূর নীল আকাশে আমার অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে ঈশ্বরকে। কিন্তু তাঁকে তো খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি মানুষের মন সৃষ্টি করেন, কিন্তু সেই মনে জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর দেন না।

মা মেয়ে দু’জনের পরনে কালো বোরখা। বাড়ির চাকরটাকে সাথে নিয়ে বড় চাচীমা উঠে বসলেন সামনের গাড়িতে আর পেছনের গাড়িতে আমি ও আলেয়া। মালপত্র ভাগাভাগি করে দুই গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। চাকরের নাম জালাল। বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। গ্রামের লোকের বয়স বোঝা যায় না। দেখতে চল্লিশ বছরের লোককে বয়স জিজ্ঞেস করলে বলে আঠাশ, আবার আঠাশ ত্রিশ বছর মনে হওয়া লোককে জিজ্ঞেস করলে বলে দুই কুড়ি দুই। জালাল আলমডাঙ্গারই লোক। এতিম মানুষ, বউ ছেলে নাই, চরম অভাবী। বড় চাচা তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। সরকার বাড়িতে সে গরু চরায়, আউড় কাটে, চাড়িতে পানি দিয়ে খৈল ভুষি মেশায়, গোয়াল ঘর সাফ সুতরো রাখে, ফুট ফরমাশ খাটে। এ ছাড়া আলমডাঙ্গায় যাওয়া আসার সময় তাকে দরকার হয়। বিশ্বাসী লোক। পাঁচ পয়সা পড়ে পেলেও বড় চাচীমার হাতে দিয়ে যায়।
মধুপুর পার হয়ে দক্ষিণে আলমডাঙ্গার রাস্তায় গাড়ি ওঠার সাথে সাথে বোরখা খুলে ফেললো আলেয়া। আর ভয় নাই। বছরে কয়েকবার নানীবাড়ি যাতায়াত করায় এসব পথ ঘাট আলেয়ার খুব ভালো করে চেনা। আমাদের সামনের গাড়িতে বসে থাকা বড় চাচীমা আলেয়ার বোরখা খোলা দেখেও না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আলেয়া একটা তালপাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে করতে বললো, ‘বোরখার মধ্যে ঘেমে গেছি। আগে আমি একটু বাতাস খেয়ে নিই, তারপর তোমাকে বাতাস করবো।’
আমি বললাম, ‘লাগবে না।’
আলেয়া তৎক্ষণাত নিজেকে বাতাস করা বন্ধ করে আমাকে বাতাস করা শুরু করে দিল। আমি ওর হাত চেপে ধরে বললাম, ‘তুই কী রে? আমার বড়ভাই যে তোকে পাগলি বলে সেটা এমনি না। আসলেই তোর বুদ্ধি সুদ্ধি ঘোলা। নিজে ঘেমে গোসল করে উঠেছিস আর আমাকে করছিস বাতাস! বেকুব মেয়ে কোথাকার!’
আলেয়া খিল খিল করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। গাড়োয়ান লোকটা পেছনে তাকাতে গিয়েও তাকালো না। সরকার বাড়ির নাতি নাতনি। তারা হাসুক কাঁদুক, যা ইচ্ছা তাই করুক, চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে। চাকর বাকর, কামলা কিষান, গাড়োয়ান কোচোয়ান সবার প্রতি এটাই না বলা নির্দেশ। এই নির্দেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সরকার বাড়ির দানা খাওয়ার জন্য মেনে চলতে হয়। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সংস্কৃতির ধারা।

আলেয়া হেসেই চলেছে। সে হাসতে হাসতে বললো, ‘তোমার কথা শুনে হাসছি।’
‘কেন, আমি হাসির কথা কী বললাম?’
‘এই যে তুমি আমাকে বেকুব বললে না, সেই কথা শুনে হাসছি। শোন, আমাদের স্কুলের হেডমাস্টারের নাম ইয়াকুব আলি। তাকে সবাই আড়ালে বেকুব আলি বলে ডাকে। হি, হি, হি।’
আমিও হেসে ফেললাম। বললাম, ‘তাহলে আমাদের কলেজের আসলাম স্যারের কথা শোন। ছাত্র ছাত্রীদের সময়মতো ক্লাসে আসার ব্যাপারে তিনি খুব কড়াকড়ি করতেন। তিনি প্রায়ই কে কখন ক্লাসে এসেছে, জানতে চাইতেন। কেউ বলতো, এখনই আসলাম স্যার, কেউ বলতো, এই তো দুই মিনিট আগে আসলাম স্যার, কেউ বলতো, আপনার সাথে সাথেই আসলাম স্যার। ছেলেদের দুষ্টামি বুঝতে পেরে আসলাম স্যার শিখিয়ে দিলেন, বলো এখনই এলাম স্যার। ছেলেরা ‘ঠিক আছে’ বলে মেনে নিলেও বলার সময় বলে, এখনই আসলাম স্যার। শেষ পর্যন্ত আসলাম স্যার দেরিতে ক্লাসে আসার জন্য ছেলেদের বকাঝকা করা ছেড়ে দিলেন।’
মধুপুরে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত ডেলিভারি দেওয়া আমার সবচে’ বড় সংলাপটি মাঠে মারা গেল। আমি যে এতক্ষণ ধরে বক বক করলাম তার মধ্যে হাসির কী আছে আলেয়া বুঝতে পারলো না। সে না হাসি, না কান্না-এমন একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব মুখে ফুটিয়ে বসে রইল। বুঝলাম, ওকে হাসানোর চেষ্টায় এতক্ষণ আমার ফালতু বকায় কোন কাজ হলো না।
এবার একটু সিরিয়াস কথাবার্তা বলার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘আচ্ছা আলেয়া, আমাকে বল তো এত সেজে গুজে তোর নানীবাড়ি যাবার কারণ কী?’
‘সাজ গোজের আর কী দেখেছ মেজভাই?’ আমার বিয়ের জন্যে মা যে কত গহনা বানিয়ে রেখেছে না! একদিন দেখাবো তোমাকে।
আমি বললাম, ‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না। এত সেজে গুজে নানীবাড়ি যাচ্ছিস কেন সেই কথা বল।’
‘ও আচ্ছা, এই কথা? শোন মেজভাই, আমার নানী শুধু জামাই দেখবে, বউ দেখবে না?’
এই মেয়ে বলে কী? ওর উত্তর শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত হাবা কালা মেয়ের মুখে এত ঝটপট বুদ্ধিমানের মতো জবাব! লেখাপড়া না জানলেও মেয়েরা বোধহয় জন্মগতভাবেই এসব ব্যাপারে ছেলেদের চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে।

‘আমি তোমার সাথে আর বক বক করতে পারছি না বাবা। ফজরের আজান হওয়ার আগে থেকে উঠে সাজ গোজ করছি। এখন আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমালাম।’ বলেই আমার কোলে মাথা রেখে গুটি সুটি মেরে শুয়ে পড়লো আলেয়া। আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম, ‘এই, এই, কী করছিস? সামনের গাড়ি থেকে মা দেখে ফেলবে তো! তখন কী লজ্জার ব্যাপার হবে বল তো!’
‘উঁহু, মা দেখতে পাবে না।’ আলেয়া হাই তুলতে তুলতে বললো, ‘আমাদের সামনে দুটো সুটকেস রাখা আছে। ওগুলোর আড়ালে আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি, মায়ের চোখে পড়বে না।’
হিসাব ঠিক আছে। পাগলি প্রেমে মাতাল হলেও তালে ঠিক। তবু শেষ চেষ্টা করে বললাম, ‘সামনে থেকে কেউ দেখবে না বুঝলাম, কিন্তু পেছন থেকে তো লোকে দেখতে পাবে।’
আলেয়া বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আরে বাবা এ কী তোমাদের শহরের রাস্তা পেয়েছ? সারাদিন লোকজন কিলবিল করে! এ হলো গ্রামের কাঁচা রাস্তা। এসব রাস্তায় লোকজন তেমন চলে না। আর দেখলো তো কী হয়েছে? আমি আমার স্বামীর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছি, তাতে কার বাপের কী? আমাকে জ্বালিয়ো না তো, ঘুমাতে দাও।’
মোক্ষম উত্তর। এরপর আর কথা চলে না। তবু একবার মিন মিন করে বললাম, ‘গাড়িতে বালিশ ছিল। বালিশে মাথা দিয়ে শুলে আরাম হতো না?’
‘মেজভাই, ফুলিশ টপ!’
এরপর আমি সত্যি সত্যিই ফুল স্টপ হয়ে গেলাম।

সেজে গুজে গয়নাগাঁটি পরে আমার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে আলেয়া। আমি হাতপাখা দিয়ে মৃদু মৃদু বাতাস করছি ওকে। বাতাসে ওর ঘন কালো চুলগুলো উড়ে এসে মুখের ওপর পড়ছে। সাবধানে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ওর নিস্পাপ মায়া ভরা মুখটা আমি প্রাণ ভরে দেখছি। যেন দুনিয়ার সবচেয়ে মনোলোভা দৃশ্য আমার চোখের সামনে। এ দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো প্রায় অসম্ভব।
রাস্তাটা সত্যিই জনবিরল। গরুর গাড়ির চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ ছাড়া অন্য কোন শব্দ কানে আসে না। রাস্তার দু’পাশে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত। প্রায় দৃষ্টিসীমার বাইরে দু’একটা জন বসতি। অনেকক্ষণ পর পর দু’একজন লোককে গরুর গাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়। তাদের কারো মাথায় আউড়ের পালা, কারো কাঁধে কাঁচামালের ভারা। গরুর গাড়ির ভেতর কে আছে দেখার সময় নেই তাদের। গা পোড়ানো ঠা ঠা রোদে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে ফিরতে চায় তারা। ছইয়ের ভেতর থেকে এক টুকরো নির্মেঘ নীল আকাশ ভেদ করে সৃষ্টিকর্তাকে হয়তো খুঁজে ফিরছে আমার চোখ। মন বলছে, সারাদিনের খেলা শেষে আমাদের নিস্পাপ দুটি জীবনকে নিশ্চয় এক করে দেবেন তিনি। ভালোবেসে আমরা কোন পাপ করিনি প্রভু। আমাদের তুমি দয়া কর।
*********************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১১)

মন্তব্য ১৩ টি রেটিং +৮/-০

মন্তব্য (১৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:৫২

ইসিয়াক বলেছেন: ভালো লাগছে...।

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৭:১৬

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই ইসিয়াক।

২| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৫০

করুণাধারা বলেছেন: সবকিছুর বর্ণনাই চমৎকার- গ্রামের রাস্তা, গরুর গাড়িতে খড় বিছানো, কুটুমবাড়িতে যাওয়ার সময় খাবার নিয়ে যাওয়া, এবং আলেয়ার সাজগোজ... ভালো লাগলো পড়ে!

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:২৭

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ বোন করুণাধারা।

৩| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:৩৭

মা.হাসান বলেছেন: ১৯৭১ এর মে মাসের কোন এক সকালে ভাবি কি পরেছিলেন তা আপনি ২০১০ সালে হুবহু লিখে ফেললেন! ভাবির কাছ থেকে পরে এর জন্য কোন মেডেল আদায় করেন নি? :P

আউড় মানে মনে হয় খড়। আমাদের এলাকায় কাড়ি বলে।

যদিও ডিসেম্বরে পিঠার মূল মৌসুম, বড় গৃহস্থের ঘরে মৌসুম লাগে না, তা ছাড়া বাড়ির বউ (আপনার বড় চাচি) নাইওর গেলে এরকম উৎসব হবেই। অবস্থা সম্পন্ন বাড়িতে এই কালচার এখনো আছে। ফিরে আসার সময় মেয়ের বাপের বাড়িতেও প্রতিযোগিতা থাকবে, মেয়ে আসার সময়ে যত বড় মাছ এনেছিলো তার চেয়ে বড় মাছ যেন নিয়ে যায় এরকম।

ভালোবেসে কেউ কোন পাপ করে না।


তিনি মানুষের মন সৃষ্টি করেন, কিন্তু সেই মনে জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর দেন না ।
সত্য। তবে বয়সের সাথে এটাও যেনে গিয়েছেন যে উত্তর না দেয়াটাই আমাদের জন্য ভালো। আমরা যতটা ভাবি, এই ভাগ্য নিয়ন্ত্রক তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসেন আমাদের।

আপাতত আমি ফুলিশ টপ। পরের পর্বের অপেক্ষায়।

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৪:৪৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: হাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। এই এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় খড়কে আউড় বলা হয়। সচ্ছল গৃহস্থ পরিবারে পিঠে পুলির সত্যিই কোন নির্দিষ্ট মৌসুম ছিল না সে যুগে। তবে শীতকালে আমন মৌসুমে নতুন ধান উঠলে পিঠে বানানোর ধুম পড়ে যেত। মধুপুর থেকে আমাদের শহরের বাড়িতে যে পিঠে পুলি পাঠানো হতো, তার প্রায় সবই শীতকালে।


ধন্যবাদ ভাই মা, হাসান।

৪| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:৫৭

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: সময়কে যেন থির দিয়ে দাড় করিয়ে রেখেছেন কলমের আঁচড়ে!

যখন যেভাবে খুশী টেনে নিচ্ছেন কাহিনীর প্রয়োজনে!
মুগ্ধতা, কষ্ট, শংকা, স্বপ্ন মিলেমিশে যাপিত জীবনের সাতকাহন!

হওয়া না হওয়া েক দারুন সম্পর্কের বাঁধন, প্রেম আর প্রকাশ....মুগ্ধ পাঠ :)

+++++

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৫:০০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: সময়কে যেন থির দিয়ে দাড় করিয়ে রেখেছেন কলমের আঁচড়ে!


এই সময়টার কথা মানুষ ভুলে যাবে এক সময়। কিন্তু যারা সেই সময় জন্মাননি, তারাও সেই দিনগুলোর কথা ভুলতে পারবেন না, যদি তারা স্বপ্ন বাসর পড়েন। আর সত্যি বলতে কী, ২০১১ সালে যখন এই উপন্যাসটি আমি লিখি তখন কোন ঘটনাই আমাকে ভেবে বা কষ্টকল্পিত আয়োজন করে লিখতে হয়নি। কারণ, সত্য ঘটনা ভিত্তিক এই উপন্যাসের সকল ঘটনাই আমার মাথার ভেতর রেকর্ডেড অবস্থায় ছিল। আমাকে শুধু মাথা থেকে বের করে কলমের সাহায্যে কাগজে লিপিবদ্ধ করতে হয়েছে।

ধন্যবাদ ভাই বিদ্রোহী ভৃগু।

৫| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৩০

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: আল্লাহ তাদের উভয়ের মঙ্গল করুন, তারা তাদের প্রেমের প্রথম সফরে রয়েছে ।
ভ্রমণ উপভোগ করুন ।সত্যিকারের ভালবাসায় পাপ হয় না ।

আল্লাহ আপনাদের দু'জনকে মিলনের জন্য সাহায্য করবেন ।

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৫:০৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: এ যুগের মতো সে যুগে প্রেমিক প্রেমিকারা শারীরিক সম্পর্কের জন্য এত লালায়িত ছিল না। সেই কারণে তখনকার ভালোবাসা ছিল নিস্পাপ। তাই আপনি যথার্থই বলেছেন যে সত্যিকারের ভালোবাসায় পাপ হয় না।

ধন্যবাদ ভাই মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।

৬| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৫:১৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: গতকাল আমার আইএসপি-তে কী একটা সমস্যা হয়েছিল, যে কারণে প্রায় সারাদিনই নেট পাইনি। পরের পর্বটি আজ পোস্ট দিতে পারবো কী না এ নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম। কেননা প্রোভাইডার অফিস থেকে জানানো হয়েছিল যে আজও নেট না থাকার সম্ভাবনা বেশি। মেরামতি কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নেট বন্ধ থাকবে। যারা উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত পড়ছেন, তাদের অসুবিধার কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছিল। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে সমস্যার সমাধান হয়েছে।

৭| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৭:০০

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: সমস্যা সমাধানের কথায় খুশি হলাম ।
এ পর্বের শুরুতেই পিঠাপুলির কথায় মনে পরে গেল রাজশাহীর পিঠাপুলির কথা । বিশ্ব ব্যংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী অঞ্চলের প্রত্যন্ত গায়ে ঘুরে ভিলেজ স্টাডি করার কিছুটা সৌভাগ্য হয়েছিল এককালে । তখন শীতের সকালে গ্রামে কোন না কোন গৃহস্তবাড়ীতে চোখে পরেছে পিঠা বানানোর দুম । একেতো ঘরে নতুন অগ্রানী ধান সে সাথে রাজশাহীর বিখ্যাত খেজুরের গুড় । ডেকি ছাটা চালের গুড়ার কাই এর ভিতর নারিকেলের কুচকি মাখা গুরের হালুয়া পুর ভরে প্রান্তটুকু কাঠি দিয়ে মোরে দেয়া হয় আলতো হাতে । দল বেধে পিঠা বানানোর এই আয়োজন রাজশাহীর গ্রামীণ জীবন ধারার চিরন্তন এক ঐতিহ্য বলেই জানা যায় গ্রামের মানুষের কাছে । আজো মনে হয় এটা চালু আছে একই ভাবে ।

এ পর্বের কাহিনীও ভাল লেগেছে ।
শুভেচ্ছা রইল

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:৫০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: হাঁ, পিঠে পুলির ঐতিহ্য এ অঞ্চলে অনেক প্রাচীন। তবে এই উপন্যাসে যে সময়ের (প্রায় ৫০ বছর আগের) কথা বলা হয়েছে, সেই সময়ের তুলনায়, আমার জানামতে, এখন সেই ঐতিহ্য অনেকটাই ম্রিয়মাণ। এখন গ্রামেও ফাস্ট ফুড পাওয়া যায়। ফলে পিঠেপুলির কদর অনেকটাই কমে এসেছে। তা' ছাড়া হাই ব্রিড ধানের কারণে পিঠে পুলির সেই স্বাদ এখন আর পাওয়া যায় না। আগে গ্রামের সচ্ছল পরিবারগুলোতে শুধু শীতের সময় নয়, প্রায় সারা বছরই এই খাবারটি তৈরি করা হতো। যেমন এই উপন্যাসে কুটুম বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পিঠেপুলি তৈরির সময়টা ছিল মে মাস।

মন্তব্যের সাথে সুন্দর একটা ছবি দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ডঃ এম এ আলী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.