নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলাউল হোসেন

আলাউল হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা বানানের প্রায়োগিক কিছু ভুল: প্রয়োজন সাধারণ সতর্কতা

১১ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:৪৭



ভাষার জন্যে একদিন আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, এই গর্ব ও সম্মানের ইতিহাস দুঃখজনকভাবে আমরা বিস্মৃত হতে চলেছি। যে চেতনাবোধে প্রাণিত হয়ে সালাম, রফিক, জব্বার বুকের রক্ত ঢেলে বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই উত্তুঙ্গ চেতনার কিছুই আর পরবর্তীকালে অবশিষ্ট থাকে নি। বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে বাংলা ভাষা ও বাংলা বানান নিয়ে যে ক্রমাগত উল্লম্ফন চলছে, তাতে আশাহত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ভুল বাংলা বানানের যে উৎসব চলছে, তাতে করে আমাদের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, যেকোন বানানে বাংলা লিখলে চলে। এভাবে চলতে থাকলে শুদ্ধ বাংলা বানান ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হবে। অথচ একটু সতর্ক ও যত্নবান হলে শুদ্ধ বানানে বাংলা লেখা খুব কঠিন কিছু নয়। তাই যারা মাতৃভাষাকে ভালোবাসেন, কর্মক্ষেত্রে বাংলা না লিখে যাদের উপায় নেই, স্কুল-কলেজের শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীসহ যে কোনো পেশার ব্যক্তিবর্গ আসুন বাংলা বানান সম্পর্কে আমরা সচেতন হই। এ পর্যায়ে বাংলা বানানের প্রায়োগিক কিছু ভুল নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই। যেমন:



০১. ‘অত্র’ শব্দের অর্থ এখানে। তাই ‘অত্র’ বললে কখনো ‘এই’ বুঝায় না। অথচ অফিস আদালতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখালেখির ক্ষেত্রে এই অফিস/ এই বিদ্যালয় অর্থে অত্র অফিস/ অত্র বিদ্যালয় লেখা হয়ে থাকে, যা ভুল।

০২. ‘কাল’ শব্দের বিশেষণ হলো ‘কালীন’। এর অর্থ- সময়ে। অথচ, অনেকেই অধ্যয়নকালীন, যুদ্ধকালীন, চলাকালীন প্রভৃতি শব্দের পরে সময় লিখে থাকেন। ফলে, ‘চলাকালীন সময়ের’ অর্থ দাঁড়ায় চলার সময়ে সময়ে। তাই ‘কালীন’ এর পরে সময় লেখা বাহুল্য ও অর্থহীন।

০৩. আমরা মোহাম্মদ/মুহাম্মদ/ ডাক্তার/ডক্টর প্রভৃতি শব্দের সংক্ষেপণের সময় মোঃ / মুঃ / ডাঃ / ডঃ প্রভৃতি লিখে থাকি। আসলে বিসর্গ (ঃ) একটি বর্ণ, সংক্ষেপচিহ্ন নয়। ইংরেজির মতো বাংলাতেও একবিন্দু (.) কে সংক্ষেপণের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই সংক্ষেপনের সময় বিসর্গ ব্যবহার করা ভুল। বিসর্গ ব্যবহার করলে এগুলোর উচ্চারণ হয়- মোহ্/মুহ্/ডাহ্/ডহ্। সুতরাং বিসর্গ পরিহার করে লেখা উচিত মো./ মু./ ডা./ ড. প্রভৃতিরূপে।

০৪. বাংলাদেশি,বাঙালি, ইংরেজি, আরবি, জাপানি, ইহুদি প্রভৃতি বানান অনেকেই বাংলাদেশী, বাঙালী, ইংরেজী, আরবী, জাপানী, ইহুদী প্রভৃতিরূপে লিখে থাকেন, যা ভুল। কেননা, জাতি ও ভাষার নামের শেষে ই-কার ব্যবহৃত হয়। তাই হ্রস্ব ই-কার দিয়েই উল্লিখিত বানানগুলি লিখতে হবে।

০৫. প্রাণী, শ্রেণী, মন্ত্রী, শশী প্রভৃতি বানানে ঈ-কার ব্যবহার করা হলেও এগুলো যখন সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে বসে তখন ঈ-কার স্থলে ই-কার হয়। যেমন : প্রাণিবিজ্ঞান, মন্ত্রিসভা, শশিকর, শ্রেণিসমেত প্রভৃতি।

০৬. ‘তা’ প্রত্যয় যুক্ত হলে পদের শেষে ঈ-কার স্থলে ই-কার হয়। যেমন : প্রতিযোগী + তা = প্রতিযোগিতা, উপকারী + তা = উপকারিতা।

০৭. বিদেশি শব্দে ‘ন’ ও ‘স’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : ট্রেন, জাপান, জার্মানি, কোরান, পাকিস্তান, টেন্ডার, কিন্ডার, মাস্টার, স্টুডিও, স্টুডেন্ট, ফটোস্ট্যাট প্রভৃতি।

০৮. নিঃ, দুঃ, বহিঃ, আবিঃ, চতুঃ, প্রাদৃঃ এগুলোর পরে ক, খ, প, ফ থাকলে ঃ (বিসর্গ) স্থানে ষ হয়। যথা : নিঃ + কাম = নিষ্কাম, দুঃ + কর = দুষ্কর, আবিঃ + কার = আবিষ্কার, নিঃ + কণ্টক = নিষ্কণ্টক।

০৯. সমাসবদ্ধ পদের ক্ষেত্রে প্রথম পদের শেষে ই, উ, বা ঋ এবং ও থাকলে পরবর্তী পদের আদ্যে ষ হবে। যথা : যুধিষ্ঠির, সুষমা, গোষ্ঠী, সুষম ইত্যাদি।

০৮. প্র, পরা, পূর্ব ও অপর -এই চারটির পরবর্তী অন্য শব্দের দন্ত্য ‘ন’ মূর্ধন্য ‘ণ’ হয়। যথা : প্রহ্ণে, পরাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ, অপরাহ্ণ ইত্যাদি।

০৯. পর, উত্তর, চান্দ্র, নার, রাম শব্দের পর আয়ন শব্দের দন্ত্য ‘ন’ মুর্ধন্য ‘ণ’ হয়। যথা : পরায়ণ, উত্তরায়ণ, চন্দ্রায়ণ, নারায়ণ, রামায়ণ ইত্যাদি।

১০. অনেকেই ভর্ত্তি কার্য্য, সূর্য্য, শর্ত্ত, কর্ম্ম প্রভৃতি বানান লিখে থাকেন। অথচ রেফের পর কখনও ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হয় না। তাই লিখতে হবে- ভর্তি, কার্য, সূর্য, শর্ত, কর্ম প্রভৃতিরূপে।

১১. বিশেষণবাচক ‘আলি’- প্রত্যয়যুক্ত শব্দের শেষে ই-কার হবে।

যেমন : সোনালি, রূপালি, বর্ণালি।

১২. অর্থভেদ বোঝাবার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বর ব্যবহার করতে হবে। যেমন : কি (অব্যয়), কী (সর্বনাম), তৈরি (ক্রিয়া), তৈরী (বিশেষণ), নিচু (নিম্ন অর্থে), নীচু (হীন অর্থে), কুল (বংশ অর্থে), কূল (তীর অর্থে)।

১৩. অনেক জায়গায়ই ক্রমশ, প্রধানত, মূলত, সাধারণত প্রভৃতি বানান এভাবে (ক্রমশঃ , প্রধানতঃ , মূলতঃ , সাধারণতঃ) লেখা হয়ে থাকে। মূলত পদান্তে বিসর্গ বসে না।

১৪. ব্যঞ্জনবর্ণে উ-কার ( ু ), ঊ-কার ( ূ ) ও ঋ-কারের একাধিক রূপ পরিহার করে এই কারগুলি বর্ণের নিচে যুক্ত করে লিখতে হবে। যেমন : শুভ, রূপ, হৃদয়।

১৫. বিশেষণবাচক পদ (গুণ, সংখ্যা বা দূরত্ব ইত্যাদি বাচক) হলে আলাদা বসবে। যেমন : এক জন, কত দূর, সুন্দর ছেলে।

১৬. নঞর্থক শব্দ পৃথকভাবে বসবে। যেমন : ভয়ে নয়, হয় না, আসে নি, কাছে নেই।

১৭. টা, টি, খানা, খানি, গুলি, গুলো, রা, এরা, গণ, বৃন্দ, সমূহ- প্রভৃতি শব্দগুলো কোনো বচনের পরে আমরা অনেক সময় আলাদা করে লিখে থাকি। অর্থাৎ বই গুলি, গ্রন্থ সমূহ, শিক্ষক গণ প্রভৃতিরূপে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো সবই জোড়া লাগবে। তাই লিখতে হবে- বইগুলি, গ্রন্থসমূহ, ছেলেরা, শিক্ষকগণ, অতিথিবৃন্দ প্রভৃতি।

১৮. ‘আগামী’ ও ‘গত’ শব্দের পরের শব্দ সব সময় পৃথক বসবে। যেমন : আগামী কাল, আগামী দিন, গত কাল, গত বছর প্রভৃতি।

১৯. ‘বিশেষ’ শব্দে যদি প্রকার বা ভেদ বুঝায়, তা হলে পূর্ববর্তী শব্দের সাথে জোড়া লাগবে। যেমন : অবস্থাবিশেষ, পুষ্পবিশেষ, গ্রন্থবিশেষ প্রভৃতি ।

২০. ‘ভাবে’ শব্দটি পূর্ববর্তী শব্দের সাথে জোড়া লাগবে। যেমন : ভালোভাবে, অদৃশ্যভাবে, ঘনিষ্টভাবে প্রভৃতি।

২১. ‘মতো’ শব্দ দ্বারা যদি অনুযায়ী/অনুসারে বুঝায়, তবে পূর্ববর্তী শব্দের সাথে জোড়া লাগবে। যেমন : ইচ্ছেমতো, কথামতো প্রভৃতি।

২২. ‘সব’ এবং ‘সারা’ উভয়ই সমগ্র/সমস্ত/সর্বত্র ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে। শব্দ দুটি সাধারণত পৃথক বসে। যেমন : সব অশান্তি, সব ঘটনা, সব লোক, সারা অঙ্গ, সারা দিন। ব্যতিক্রম : সবশেষে, সবকিছু, সারাক্ষণ প্রভৃতি।

২৩.‘মাত্র’ শব্দের অর্থ প্রত্যেক/শুধু/পর্যন্ত/তখনই প্রভৃতি বোঝালে এর পূর্ববর্তী শব্দের সঙ্গে জোড়া লাগবে। যেমন : আসামাত্র, এইমাত্র, একমাত্রা, একটিমাত্র, কিছুমাত্র, বলামাত্র প্রভৃতি। ব্যতিক্রম : দশ টাকা মাত্র, একটা কলম মাত্র প্রভৃতি।

২৪. ‘প্রতি’ শব্দ দ্বারা যদি ব্যাপ্তি বোঝায়, তবে এর পূর্ববর্তী বা পরবর্তী শব্দ পৃথক বসবে না। যেমন : প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত, প্রতিবছর, প্রতিমুহূর্ত, ছাত্রপ্রতি, জনপ্রতি ইত্যাদি। ব্যতিক্রম : আমাদের প্রতি, জনতার প্রতি প্রভৃতি।

২৫.‘পর’ শব্দ দ্বারা যদি পরের/পরবর্তী/অন্য/ভিন্ন প্রভৃতি অর্থ প্রকাশ করে, তবে পরবর্তী শব্দটির সঙ্গে জোড়া লাগবে। যেমন : পরকাল, পরদিন, পরনারী, পরজীবী, পরদেশ প্রভৃতি।

২৬. ‘নানা’/‘নানান’ শব্দ পরবর্তী শব্দ থেকে পৃথক বসবে। যেমন : নানা অসুবিধা, নানা ঝামেলা, নানান পথ প্রভৃতি।

২৭. ‘কাল’ ও ‘ক্ষণ’ শব্দের পূর্ববর্তী বিশেষণ আলাদা না বসে একসঙ্গে বসবে। যেমন : একাল, এতকাল, বহুকাল, কতকাল, কতক্ষণ, বহুক্ষণ ইত্যাদি।

২৮. ‘উদ্দেশ’ শব্দ দ্বারা হদিস, লক্ষ্য, খোঁজ বুঝায়। আর ‘উদ্দেশ্য’ শব্দ দ্বারা অভিপ্রায় বা মতলব, তাৎপর্য, প্রয়োজন প্রভৃতি বুঝায়। যেমন :

কার উদ্দেশে একথা বলা হল কেউ বুঝতে পারল না।

লোকটা উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজ করে না।

২৯. লক্ষ হলো ১০০ হাজার। আল লক্ষ্য অর্থ উদ্দেশ্য বা দেখা। তবে লক্ষ্য বানানের সাথে যদি ‘ই’ যোগ হয়, তখন (্য) য-ফলা উঠে গিয়ে ‘লক্ষই’ হয়। যেমন :

আমার পাঁচ লক্ষ টাকা দরকার।

আমাদের লক্ষ্য উন্নতি করা।

নিজের শরীরের দিকে সে লক্ষই করে না।

৩০. ‘বোধ হয়’ শব্দের অর্থ মনে হয় এবং ‘বোধহয়’ অর্থ সম্ভবত। যেমন :

আমার বোধ হয় সে পৌঁছে গেছে।

সে বোধহয় আজ অফিসে যাচ্ছে না।



বাংলা বানানের ক্ষেত্রে এরকম আরও অনেক ছোটখাট প্রায়োগিক ভুল শুধু আমাদের সামান্য সচেতনতার অভাবে হয়। আমাদের রক্তে কেনা ভাষার প্রতি আমরা যদি আর একটু সচেতন ও যত্নশীল হই তাহলে ভুল বাংলা বানানের ভুল থেকে আমরা সহজেই মুক্তি পেতে পারব।



আলাউল হোসেন

বি.এ (অনার্স) এম.এ

প্রধান শিক্ষক,

স্কাইলার্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

কাশিনাথপুর, পাবনা-৬৬৮২।

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:৫৪

লিপিকার বলেছেন: অনেক বানান শিখলাম। ধন্যবাদ

২| ১২ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:০৫

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: চমৎকার কাজ। কিছু আলোচনা ছিল, সময় করে অন্য সময়ে বলবো।
আপনি এই লেখাটা দেখতে পারেন প্লিজ।
শুভেচ্ছা।

১২ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:১৭

আলাউল হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে...

৩| ১২ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:০৯

মহাকালর্ষি বলেছেন: আপনার মত দরদী ও পরিশ্রমী শিক্ষক বাংলার প্রতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ুক! সার্থক হোক আপনার সকল মহান প্রয়াস।

ধন্যবাদের সাথে রেখে দিলাম। ভালো থাকুন।

৪| ১২ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:১০

বিডি আইডল বলেছেন: এই পোষ্ট না কয়েকঘন্টা আগে একবার দিলেন?!?

৫| ১২ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ২:৩৪

জোবাইর বলেছেন: ভালো পোস্ট। ধন্যবাদ।

৬| ২৮ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ১১:৪০

নািহদুল বলেছেন: অনেক কিছু জানতে পারলাম।++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.