নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুর্নীতির ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের ও দশের প্রকৃত শত্রু সেই সমস্ত দুর্নীতিবাজ যারা ক্ষমতাকে উপার্জনের উপায় হিসাবে ব্যবহার করে অর্থ সম্পদ করেছেন। তাদের আয় অবৈধ। সম্পদ উপাজনের আইনসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে না পারায় তারা ঘৃণিত। যে সমস্ত দুর্নীতিবাজরা নিজেরা দুর্নীতি করে অন্যের উপর দোষ চাপান তারা পশুর চেয়ে নিৎকৃষ্ট। দুর্নীতি এমন একটি অপরাধ যা মানুষকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অপরাধ যখন সমাজে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না তখন সে সমাজকে অসুস্থ সমাজ বলতে হবে। ক্রমাগতভাবে দুর্নীতির এমন মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটেছে যে তা সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারাটাও অসম্ভব যেন।
সিঙ্গাপুরে ১৯৬৫ সালেও আমাদের চেয়ে বেশি দুর্নীতি ছিল। তারা পরিস্থিতির উত্তোরণ ঘটাতে পেরেছে। গত কয়েক দশকে সমাজে একটি নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগে যারা দুর্নীতি করতেন তাদের ছোট হয়ে থাকতে হতো; অনেকে এমন লোকের বাসায়ও যেতনা। আর এখন যারা দুর্নীতি করেনা, তারাই চুপেচাপে থাকে; তাদের ছেলে মেয়েরা ভালভাবে পড়াশুনাও করতে পারেনা। সমাজ জিম্মী হয়ে পড়েছে দুর্নীতিবাজদের হাতে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে ক্যান্সার আকার ধারণ করছে এ সমস্যা। দুর্নীতির কারণে অল্প সংখ্যক লোকের হাতেই দেশের সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি এত ব্যাপক যে দুর্নীতির কথা চিন্তা করেই এবং উদ্ভূত অতিরিক্ত ব্যয় জেনেই সকলে ব্যবসা বাণিজ্য করতে আসেন।
বাংলাদেশের সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তার এমনভাবে বাসা বেধেছে যে, এটি মানুষের জীবনে অপরিসীম ভোগান্তির জন্ম দিচ্ছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে এমন কোন স্থান নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। জাতীয় পর্যায়ে সরকার থেকে শুরু করে সরকার নিয়ন্ত্রিত সকল ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি বিরাজমান।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও দুনীতি ঢুকে গেছে। দুর্নীতি সমাজের জন্য মহামারী এবং অভিশাপতুল্য। দুর্নীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত¬ হয় সমাজের সাধারণ জনগণ এবং সৎ ও ভদ্র শ্রেণী। দুর্নীতির মাধ্যমে কাউকে অধিক সুবিধা দেয়া হয়, আবার ন্যায্য পাওনাদার হয় অধিকার বঞ্চিত। আবার দুর্নীতিবাজেরা অবৈধভাবে প্রভাব বিস্ত¬ার করে অন্যের প্রাপ্য অধিকার আত্মসাৎ করে। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তাদের মৌলিক প্রয়োজনটুকুও পূরণ থেকে বঞ্চিত হয়। সর্বোপরি সামাজিক দুর্নীতির জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমাজকল্যান দারুণভাবে ব্যাহত হয়। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করে এবং সমাজে সংঘাত বৃদ্ধি পায়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন বিপন্ন হয়। দুর্নীতি কোনো সমাজের বা কোনো পরিবেশের জন্যই কাম্য হতে পারে না।
দুর্নীতি সমাজের সুখ শান্তি নষ্ট করে অশান্তি ছড়ানোর ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করে। দুর্নীতির ফলে এক ধরনের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং উপকৃত হচ্ছে আরেক শ্রেনীর মানুষ, যারা মূলত অপরের অধিকার খর্ব করে থাকে। দুর্নীতির কারণে সমাজ তার গতি হারায়। পারস্পরিক দ্বন্ধ সংঘাত বাড়ে। সবকিছুকে গ্রাস করে অনাকাক্সিক্ষত এক স্থবিরতা। জনজীবনকে পর্যদুস্ত করে। বিরাজমান চরম হতাশা ও নৈরাজ্যের পেছনে দুর্নীতি দায়ী। দুর্নীতির কারণেই আমাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার সৃষ্টি। দুর্নীতি সব সফলতাকে ম্লান করে দেয়। সমাজের প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতি যেন মানুষের আষ্টেপৃষ্টে মিশে আছে। এটা দিনদিন আরো ব্যাপকতা লাভ করছে। দুর্নীতি সুন্দর ও শান্তিময় সমাজ বিনির্মানের প্রধান প্রতিবন্ধকতা দুর্নীতি আর্থসামাজিক উন্নতি রোধ করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে এবং অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
দুর্নীতি সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে দু’ধরণের মত দেখা যায়-প্রথমত-বিভিন্ন অনাচার ও অব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ অনেক ব্যক্তিদের দুর্নীতিবাজে পরিণত করে। দ্বিতীয়ত- অপরাধের জন্য সমাজ নয়, অপরাধীরাই দায়ী। গবেষকগণ দুর্নীতি কারণ স্বরূপ কয়েকটি জিনিসকে চিহ্নিত করেছেন- ১.রাতারাতি ধনী হওয়ার আকাঙ্খা। ২.নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। ৩.জবাবদিহিতার অভাব। ৪.অপর্যাপ্ত বেতন। দুর্নীতির পেছনে আরো নানাবিধ কারণ হচ্ছে, অর্থপ্রীতি (Lust for Money), প্রদর্শন-প্রভাব (Demonstration effect), স্যাটেলাইট কালচার (Satellite culture), দারিদ্র্য (Poverty), উন্নত জীবনযাপনের মোহ (Illusion for aristrocracy), রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা (Political patronage), সুশিক্ষার অভাব (Lack proper education), সামাজিক অবক্ষয় (Social degradation). অর্থনীতি বিশেজ্ঞরা দুর্নীতির অবাধ বিস্ত¬ৃতির অসংখ্য কারণ উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে মূল কারণ গুলো হচ্ছে- রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ঐক্যমতের অভাব, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্বল আমলাতন্ত্র, নিম্ন-মজুরী কাঠামো, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাব, সুশীল সমাজের উদাসীনতা, সুশাসন ও ন্যায়-বিচারের অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এবং দুর্নীতির কোন দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়া। তবে এর মধ্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই দুর্নীতির প্রধান কারণ।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধর্মগ্রন্থগুলোতে সুস্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। আল কুরআনে আছে, তোমরা একে অন্যের অর্থ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করবেনা, কিংবা তোমরা অন্যায়ভাবে অন্যদের অধিকারকে খর্ব করে কোন আধিকারিককে ঘুষ প্রদান করবে না, যখন তোমরা সে বিষয়ে জ্ঞাত থাক। ভগবত গীতা, অধ্যায় ২-তে আছে, তিনি ঘুষ চাইবার সাথে সাথে দুর্নীতিপরায়ণ হিসাবে বিবেচিত হলেন এবং তার সম্মান ও সুপরিচিতি হারালেন। বাইবেলে আছে, তোমরা ঘুষ গ্রহণ করবেনা, ঘুষের কারণে স্বচ্ছতা অন্ধকারে পর্যবসিত হয় এবং ন্যায়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। ত্রিপিটকে আছে, ঘুষ গ্রহণ করোনা, কাউকে ঠকাবেনা অথবা অসৎ কাজ করবেনা, হত্যা করোনা এবং আগ্রাসীভাবে খাদ্য সংগ্রহ করোনা।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অবাঙালিদের সম্পদ লুণ্ঠন দিয়ে দুর্নীতি শুরু হল। তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা দুর্নীতি শুরু করলেন। রাজাকার, আলবদর -এদের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ধরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অবাঙালিরা প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে একটা কাগজ সংগ্রহ করত, যেটা করতে হতো পয়সা দিয়ে। সেটা দিয়ে তারা নেপাল হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত চলে যেতে পারত। আর একটা দুর্নীতি হয় কোম্পানীগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করার সময়। শ্রমিক নেতারা কলকারখানার কলকব্জা একবার খুলে বিক্রি করে, আবার সেগুলোই বিক্রি করেছিল সরকারি মিলের কাছে। দুর্নীতির বিস্তার বাংলাদেশ আমলে এভাবেই শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ হওয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যবসার বিকাশ ঘটে। পরিত্যক্ত ছোট ব্যবসা থেকে বড় ব্যবসা দেখভালের জন্য যে ব্যবস্থা করা হয় সেখানেও দুর্নীতি হয়েছে।সার বিতরণের জন্য ডিলারশীপ নিয়োগে রাজনীতিকরণের কারণেও দুর্নীতি হয়েছে। সিগারেট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। সেখানেও দুর্নীতি ঘটেছে। ফেলে যাওয়া পেট্রোল পাম্প নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। লোক নিয়োগেও দুর্নীতি হয়েছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে বেসামরিক ও সামরিক বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির কথা শুনা গেছে। সামরিক সরকারগুলো বিভিন্ন কায়দায় দুর্নীতিকে ব্যাবহারও করেছেন। জিয়াউর রহমান শাসনক্ষমতায় এলে দুর্নীতির অন্য এক প্রকৃতির সাথে পরিচিত হই। জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল করতে গেলেন। রাজনৈতিক দল গঠন করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন হয়। সেই অর্থ সংস্থানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন কিছু মন্ত্রীকে যারা বিরাষ্ট্রীয়করণ ও ব্যবসায়িক সুবিধার মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। সিবিএ নেতাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন সাত্তার সাহেব। এইচ এম এরশাদ ব্যবসা করে বা ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেছেন এবং দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে এরশাদের অর্থলিপ্সার বহি:প্রকাশ পাওয়া যায়। এই অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে । দুর্নীতির সঙ্গে অর্থ পাচার করার প্রবণতা সরাসরি যুক্ত করেন তিনি। এরশাদের পতনের পরের অবস্থায় দেখা যায় প্রশাসন, প্রকল্প, ব্যবসায়ী সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত। গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলে আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ-এই তিনের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার কারণে দুর্নীতি আরো বাড়তে শুরু করল।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকার শুধু ঘুষই লেন - দেন হয়, বছরে যার পরিমাণ দাড়ায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমান। ১৯৮৪-৮৫ থেকে ১৯৯৩-৯৪ সালে এদেশে দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ মোট উন্নয়ন বাজেটের চেয়েও বেশি বলে TIB তাদের এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়, ঐ সময়ে দুর্নীতির কারণে এনজিও, ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের যে আর্থিক ক্ষতি হয় তার পরিমাণ ৫৪ হাজার কোটি টাকা।
রাজনীতকি, আমলা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকরাই এ দেশের সবচেয়ে র্দুনীতপিরায়ণ শ্রণেী। র্দুনীতির কূটকৌশল এবং এর অস্বাভাবিক বিস্তারর্কায সাধারণ মানুষরে বোধশক্তিকেও বিনষ্ট করছে।অনেকেইে আজ বুঝতেও সক্ষম নন কোনটি র্দুনীতি এবং কোনটি র্দুনীতি নয়। আপাত বৈধতার আবরণে চলছে লুণ্ঠনরে তাণ্ডব। বিভিন্ন সরকার তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ও সর্মথকদরে জন্য যসেব অনুগ্রহ বণ্টন করে থাক, তাও একধরনের বকশিশের কালচারে পরিণত হয়েছে। এবং এই কালচারের খেসারত দিতে হয় জাতিকে। বিভিন্ন সরকাররে আমলে সরকারি আনুকূল্যপ্রাপ্ত একটি শ্রেণীর প্রসার ও বিস্তৃতি লক্ষণীয়। আমলা থেকে শুরু করে রাজনতৈকি টাউট, তথাকথতি বুদ্বিজীবী, এমনকি দেশের এলিট সম্প্রদায় সরকারের অনুগ্রহভাজন এই শ্রেণীটির অর্ন্তভুক্ত। সামাজিক সংযোগ, কিছুটা জালিয়াতি এবং স্তাবকতা এসবই তাদরে ক্ষমতার বলয়ে টিকে থাকার আর্শ্চয শক্তি জোগায়।
দুর্নীতি সীমাহীন দুর্ভোগের কারণ। জেনেভা ভিত্তিক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম‘ বাংলাদেশের ৮১ টি কোম্পানীর ওপর এক জরিপ চালায়। এসব প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৯৭ জনই বলেন যে, রাজনীতিবিদদের সততার ওপর তাদের কোন আস্থা নেই। শতকরা ৬৮ জন বলেন যে, বিচার বিভাগও রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিমুক্ত নয়।
২০০৩ সালের জুলাই মাসে মার্কিন দূতাবাসের ট্রেড সেন্টার এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়-বাংলাদেশে ঘুষ ছাড়া কোন কাজই হয় না। কায়েমী স্বার্থবাদীদের চাপে নীতি বদলে যায়।এক সরকারের চুক্তি অন্য সরকার বাতিল করে এবং চাদাবাজদের পিছনে থাকে রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা।
২০০৩ সালের জুলাই মাসেই বিশ্ব ব্যাংকও বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্নীতিযুক্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ২০০৩ এ বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, দুর্নীতিই হলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম সর্বোচ্চ বাধা। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে জাপানী রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে বিভিন্ন মন্ত্রনালয় ও বিভাগের বিনিয়োগে খোলাখুলি ঘুষ গ্রহণ, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারী কে টমাস ২০০৩ সালের ২৭ অক্টোবর আমেরিকান ক্লাবের এক সমাবেশে বলেন, আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৩০ অক্টোবর ২০০৩ হোটেল শেরাটনে আয়োজিত এক সমাবেশে বৃটিশ হাইকমিশনার ডেভিড কার্টার বলেন, বিদ্যমান আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, ঘুষ-দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, লালফিতার দৌরাত্ব ইত্যাদিতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ঢাকাস্থ আবাসিক প্রতিনিধি শিবুইচি বলেছেন যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায়ই হলো আইন শৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ - দুর্নীতি ও অবকাঠামোগত সমস্যা।
যুক্তরাষ্ট্রস্থ ইউনাইটেড ট্রেড সেন্টারের ‘ কান্ট্রি কমার্শিয়াল গাইড ২০০৩‘ এ বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয় যে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ঘুষ দাবি করা বাংলাদেশে একটি সাধারণ বিষয় বা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
জাপান কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপ থেকে বেরিয়ে আসে যে, ঘুষ না দিলে জাপানী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে মাল্টিপল ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটই দেয়া হয়না।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ২০০২-২০০৩ এক অর্থ বছরেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কালো টাকা পাচারের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যার সিংহভাগই পাচার হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে।
জনাব আব্দুল আউয়াল লেখেন, বাংলাদেশে কাস্টমস বিভাগ প্রতি বছর যে দুর্নীতি করে তা দিয়ে এদেশের একশটি কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা সম্ভব।
ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম প্রথম থেকেই ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে এখন রাখা হয়েছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। মওলানা ভাসানীর নামও এভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার নভোথিয়েটারের নাম ভাসানী নভোথিয়েটারের পরিবর্তে রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পিতার নামে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করতে গিয়ে যে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রাসহ মোট অর্থ ব্যয় হয়েছে এটা বাংলাদেশের মতো একটি দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ ছাড়া আর কী? প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তার পিতা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ এবং প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এসব থেকে অন্যদের নাম মুছে ফেলার যে ‘কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছেন সেটা তাদের নানা ধরনের দুর্নীতিরই অন্যতম দৃষ্টান্ত।
দুর্নীতিমূলক কর্মকান্ডের ব্যাপারে আপোসের সাথে জড়িত থাকে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই নয় , ছাত্র রাজনীতিবিদরাও ধনী হয়ে যায়। কিন্তু কীভাবে ? রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে দুর্নীতি বিভিন্নভাবে আমলাতান্ত্রিক বিষয়ে পরিনত হয় ; আমলারা সুবিধাভোগ করে ? দুর্নীতিমূলক কর্মকান্ডের ব্যাপারে রাষ্ট্রের আপোস ও স্বীকৃতি প্রদানের পেছনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থই নয় ব্যক্তিগত স্বার্থও জড়িত থাকে । ২০০৪ সালে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাঙ্কের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর সরকারের কেনা কাটায় প্রায় ২৭০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করা হয়। নিয়ম বহির্ভূত ভাবে টেন্ডার ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়। টেন্ডার ছাড়া কাজ দেওয়ার কারো কোনো অধিকার নাই। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতেও টেন্ডার ছাড়া কাজ দেওয়া হয়।
গত ১২ ফেব্রুয়ারী ২০০৭ ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল টিআইবির এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদন অষ্টম জাতীয় সংসদে কোরাম সংকটের কথা উল্লেখ করে বলা হয়-‘সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতির জন্য সংসদ কার্যক্রমের ২২৭ ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়েছে, এর ফলে সংসদের ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা অপচয় হয়েছে। এ সংসদে ১৩ হাজার ১৫১ কোটি ৫৪ লাখ টাকার অডিট আপত্তির মধ্যে ১২ হাজার ৫৩৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা অনাদায়ী পড়ে আছে। ১৮৩ জন সংসদ সদস্যের টেলিফোন বকেয়া বিলের পরিমাণ ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। সংসদ যখন শেষ হয়ে যায় তখন দেখা যায় যে বিভিন্ন সংসদ সদস্যরা লক্ষ লক্ষ টাকার টেলিফোন বিল বাকি রেখে দেন। এটা কি দূর্নীতি নয়? সংসদে বসে যারা দূর্নীতি আইন প্রণয়ন করে অথচ যারা তাদের নানান বিল বকেয়া রেখে দেয় তাদের দ্বারা কি দূর্নীতি দমন সম্ভব? যারা নিজের ফোনের বিল বাকী রেখে অন্যকে ফোনের বিলের জন্য দূর্নীতিবাজ বলে arrest করেন, তাদের দ্বারা দূর্নীতি দমন সম্ভব নয়। একজন ব্যাক্তি যখন মূল্যবোধহীনতায় আক্রান্ত হয় তখন সংসদ এবং জাতিও আক্রান্ত হয়।
বেশকিছু এনজিও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে নিমজ্জ্বিত। এরকম ১৯ টি অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে, গভর্নিংবডির অকার্যকর ভূমিকা, এক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতি, ভুয়া ভাউচার, কর্মীদের বেতন আত্মসাত, সচেতনমূলক কর্মসূচীতে অর্থ আত্মসাত, এনজিও ব্যুরো ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে ঘুষ প্রদান, এনজিও কর্মকর্তাদের কর ফাকি, সাংগঠনিক ব্যবস্থায় অনিয়ম, কর্মী হয়রানি, কর্মী নিয়োগ ও পদোন্নতিতে দুর্নীতি, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অনিয়ম, সরকার ও দাতাদেও নিকট জবাবদিহিতা অভাব, কর্মসূচির অতিরঞ্জিত মূল্যায়ন ইত্যাদি। ৮৫ শতাংশ এনজিওর ক্ষেত্রে নির্বাহী প্রধানের সঙ্গে পরিচালনা বা সাধারণ পরিষদের সদস্যদের আতœীয়তার সম্পর্ক বিদ্যমান। তারা ৯৫ শতাংশ অগ্রগতি ও মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।
পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষক দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত নেই। উন্নত দেশের শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির কথা নয় বরং গবেষনার কথা, কঠোর পরিশ্রমের কথা ও অধিক কাজ করার কথা শোনা যায়। সবদেশের শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে রাজনীতিমুক্ত। শিক্ষক-ছাত্র যদি রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকে তাহলে তারা কস্মিনকালেও ভাল গবেষক, ভাল বিজ্ঞানী, ভাল দেশ গড়ার কারিগর, যোগ্য, নীতিবান মানুষ হয়ে গড়ে উঠার সুযোগ পায় না। এতে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়। এক শ্রেণীর শিক্ষক মুক্ত বুদ্ধির দোহাই দিয়ে দলীয় রাজনীতির লেজুরে পরিণত হয়েছে। বৈষয়িক ফায়দা হাসিলের নিমিত্তে ছাত্রদিগকে অহরহ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং রাজনীতিতে তাদের সক্রিয় করা হচ্ছে। এ ধরনের শিক্ষকদের মধ্যে অধিকাংশই মেধাহীন, অযোগ্য, চরিত্রহীন, শিক্ষকতা ও গবেষণায় অপারদর্শী। তবে চাপাবাজি ও গালবাজিতে পারঙ্গম। শুধু তাই নয় এ ধরনের রাজনীতির কারণে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে বাদ দিযে দলীয় রাজনীতির পরিচ্ছকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে সর্বত্রই। এতে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগতমান অচিরেই ধ্বংস হতে বাধ্য।
এদেশে প্রশাসনের সর্বত্রই রাজনীতির ছোয়া। ভাল মন্দের বিচার নেই। দলীয় ব্যক্তি অযোগ্য হলেও যোগ্য। মেধাও দক্ষতার কোন মূল্যায়ন নেই। যে স্বার্থউদ্ধারের জন্য দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয়তা প্রমাণ করতে পারে সেই সুযোগটি পাবে। এর সাথে আজকাল যোগ হয়েছে জেক, লবিং ইত্যাদি শব্দ। এমনকি দৌড়ের মহড়া দিয়ে, লবিং করে, পার্টি ধরে যিনি সর্বোচ্চ প্রশাসকের দৃষ্টিতে আসতে পারেন তিনিই হন ভাইস চ্যান্সেলর। সিনিয়রটি, মেধা, অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক যোগ্যতা ইত্যাদি কোন কিছু দেখার প্রয়োজন নেই। সরকারের অন্যান্য প্রশাসনিক পদগুলোতেও যোগ্য, মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তিবর্গ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে কর্মে উদ্দামতা হারিয়ে ফেলছে। কাজে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। নিরপেক্ষতা না থাকায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রশাসনের সর্বত্রই সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে নিরীহ ভাল মানুষগুলো। প্রশাসন পরিণত হয়েছে দুর্নীতির আখড়ায়।
সরকারী চাকরিজীবিরা সিংহভাগ সময় নষ্ট করে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায়। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের ন্যায় অবিলম্বে সরকারী-বেসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমুহের কর্মকর্তাদের কর্মে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে Code of conduct প্রবর্তন করা উচিত। এসব নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ না করায় বাংলাদেশের সব অফিস আদালত পরিণত হয়েছে কমিউনিষ্ট ও সমাজতান্ত্রিক দেশের অনুকরণে দলীয় রাজনীতির আখড়ায়। সেখানে হচ্ছেনা কোন কাজ। ১ ঘন্টার কাজ করতে লাগছে ১ মাস। এটাই এদেশের বাস্তব চিত্র। কোন উন্নত দেশেই বাংলাদেশের অনুরূপ কাজে স্থবিরতা দেখা যায় না।
মিল কারখানায় কোন কাজ হচ্ছে না। কাজ করার দরকারও সেখানে নেই। লাভ লোকসানের বালাই নেই। লোকসান হলে সরকারের হবে আমার কি? এ এক অদ্ভূত দেশ। সবাই হবে নেতা। নেতা হলে কাজ করতে হয়না। উপরন্তু বাড়তি ইনকাম। সে জন্যই নেতা হওয়ার প্রবণতা। ফলে মিল-কারখানা পরিণত হচ্ছে দুর্নীতির আখড়ায়। দুনিয়াব্যাপী Privatization এর মাধ্যমে উন্নয়নের জোয়ার বইছে আর বাংলাদেশে সব লোকসানী প্রতিষ্ঠান সরকার ধরে রাখছে। দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সব ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধ করে দিয়ে মিল-কারখানা রাজনীতিমুক্ত করা। তবেই দুর্নীতি কমবে, দেশ দারিদ্রতার সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের রেকর্ড আছে আন্তর্জাতিকভাবে। এমন কোন অফিস নাই যেখানে ঘুষ দুর্নীতি নেই। যারা সৎ তাদের চাকরি করাই এদেশে মহাসংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাষ্টমস, রাজস্ব, ট্রেজারী, সাবরেজিষ্ট্রারী, সেক্রেটারিয়েটসহ সব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা আনার জন্য সন্ত্রাস দমনের ন্যায় সেনাবাহিনীর সৎ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত করে টাস্কফোর্স গঠন করে অনতিবিলম্বে কাজ শুরু করা উচিত। তাহলে জনগণের আস্থা সৃষ্টি হবে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি। কাজে গতি সঞ্চার হবে এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধিপাবে। সরকারের জনসমর্থনও বাড়াবে ব্যাপকভাবে। ঘুষ দুর্নীতি উচ্ছেদের জন্য প্রয়োজন মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ ও কঠোর আইনের প্রয়োগ। যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রতনয় তাই এখানে কঠোর আইনের প্রয়োগই পারে প্রশাসনের সকল স্ত¬রে দুর্নীতিমুক্ত করতে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির বন্ধু পল উলফউইজ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়া সফর করার সময় বাংলাদেশে এসেছিলেন। সফর শেষে ঢাকা ত্যাগ করার আগে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে কোন রাখঢাক ছাড়াই বলেন, বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ খাত থেকে দুর্নীতি দূর করে তবে বিশ্বব্যাংক নতুন পাওয়ার স্টেশন করার জন্য অর্থ জোগাবে।
দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোই সাধারণত অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আমেরিকান ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন তার জুলাই-আগস্ট, ২০০৯ সংখ্যায় ১২টি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে ‘ফেইলড স্টেট ইনডেক্স’ বা অকার্যকর রাষ্ট্রের সূচক প্রকাশ করেছে। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। যা উদ্বেগের। দুর্নীতির কেন্দ্রে রাজনৈতিক দল চলে আসার মূল কারণ রাজনৈতিক দলের অপরিসীম ক্ষমতা । স্থানীয় বা জাতীয়ভাবে ক্ষমতাবান হতে হলে রাজনৈতিক দলের নেতা হতে হবে। মোটা অংকের চাদা দিয়ে সুবিধাজনক দলে ভিড়ে গেলেই সে ক্ষমতার উৎসের সাথে যুক্ত হয়ে যাওয়া যায়। দুর্নীতির শেকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত হচ্ছে সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে দুর্নীতি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে, যা একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা হিসেবে সমাজে স্থান করে নিয়েছে। এখন কেউই এব্যবস্থার বাইরে থাকতে পারছেনা।
আমাদের দেশের সব মানুষই সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির দৌরাত্ম্যের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে দুর্নীতির দায়ে অপদস্থ হওয়ায় দেশের সব সচেতন মানুষের মনে এক ব্যাপক গ্লানিবোধ সঞ্চারিত হয় কিংবা এরই মধ্যে হয়েছে। আমরা সবাই এক বাক্যে সমাজে দুর্নীতির সংক্রমণ স্বীকার করে নিয়েছি। দুর্নীতির এই সংক্রমণ আগেও ছিল, কিন্তু জনমনে এখন এই ধারণা দৃঢ় যে বর্তমানে দুর্নীতির বিস্তার হয়েছে কল্পনাতীতভাবে এবং জনজীবনের প্রায় কোনো অংশই এই প্রভাবের বাইরে নয়। পরিস্থিতি এতই নৈরাশ্যজনক যে রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ দুর্নীতির এই বিস্তার প্রতিরোধে ক্রমাগত উদ্যমহীন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতির কূটকৌশল এবং এর অস্বাভাবিক বিস্তারকার্য সাধারণ মানুষের বোধশক্তিকেও বিনষ্ট করেছে। অনেকেই আজ বুঝতেও সক্ষম নন কোনটি দুর্নীতি এবং কোনটি দুর্নীতি নয়। আপাত বৈধতার আবরণে চলছে লুণ্ঠনের তাণ্ডব। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই মূলত সেসবের হোতা। বিভিন্ন সরকার তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ও সমর্থকদের জন্য যেসব অনুগ্রহ বণ্টন করে থাকে, তাও একধরনের বকশিশের কালচারে পরিণত হয়েছে এবং এই কালচারের খেসারত দিতে হয় জাতিকে।
ধরুন, কোন কারণে কোন পুলিশ কর্মকর্তা কারো নিকট ঘুষ দাবী করলো। আমাদের সমাজে কতজনের এমন সাহস রয়েছে যে তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোন স্থানে স্বনামে লিখিত অভিযোগ করবেন? ফলে ভূক্তভোগীরা এ অত্যাচার সহ্য করে যায় এবং দুর্নীতি সমাজে সম্মান ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে পরিণত হয়। কিছু দুর্নীতি রয়েছে যাতে কোন ব্যক্তি এককভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় না, ফলে কেউ নিজ উদ্যোগে তার প্রতিকারের জন্য এগিয়ে আসবে - এমন সম্ভাবনা থাকে না। যেমন প্রধান বন রক্ষক বনভূমির মূল্যবান কাঠ পাচারের মাধ্যমে বনভূমি উজাড় করেছেন এবং রাষ্টের কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করেছেন। সবথেকে বিস্তৃত দুর্নীতিটি হচ্ছে ফাইল আটকে রেখে ঘুষ নেয়া।
টেলিফোন সংযোগ নেয়ার জন্য আবেদন করে তার পিছনে ঘুরে ঘুরে জীবন কেটে যাবার নজীর বাংলাদেশে রয়েছে। সারাজীবন চাকুরী করে অবসর নেয়ার পর পেনশনের টাকা তুলতে গিয়ে টেবিলে টেবিলে ঘুষ দেবার অভিজ্ঞতা হয়নি, এমন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকুরে খুব কম। জমি কিনেছেন, তার নামজারীর অনুমতি চেয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা রাজউকে আবেদন করলেন। সে ফাইল টাকা ছাড়া এক ইঞ্চিও নড়বে না।
বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা জনগণের মনে যে পরিমাণ হতাশার সৃষ্টি করেছে, তা তুলনাহীন। দুর্নীতি কেবল ওপর মহলে হয়, তা-ই নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণকে দুর্নীতির প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। এই অংশগ্রহণের কারণ সব ক্ষেত্রেই শুধু লোভ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে ন্যূনতম জীবনযাপনের প্রচেষ্টা। এই অসহায়ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃষ্টান্তের, যেখানে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির সুযোগ নেই, বরং কাউকে কাউকে মূল্য দিতে হয় সৎ থাকার জন্য। জনগণের কাছে এই ধারণা ক্রমেই দৃঢ় হয়েছে, সমাজে নীতিবান হয়ে থাকার মাঝে কোনো গৌরব নেই, বরং আছে বহু ভোগান্তি।
জবাবদিহিতার অভাব বেপরোয়া ভাবকে উত্সাহিত করছে প্রতিনিয়ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পদ উপাচার্য নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনাই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্ররাজনীতি এখন হয়েছে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের আঁতুড় ঘর। সংসদের বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেয়ে কীভাবে তহবিল গঠন করা যায়, সেদিকে ব্যস্ত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নিয়োগে যেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে নৈর্ব্যক্তিক ও রচনামূলক পরীক্ষার পাশাপাশি থাকে মৌখিক পরীক্ষা। বর্তমানে সমগ্র প্রক্রিয়াটি চরম কলুষিত এবং পরীক্ষার্থীদের মূল যোগ্যতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়। নিয়োগ পাওয়ার পরপরই রাজনৈতিক যোগ্যতায় উত্তীর্ণ এই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার দায়িত্ব পান এবং স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের চাইতে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণে তত্পর থাকেন বেশি।
এদেশে মেম্বার অব পার্লামেন্ট বা এমপি হওয়া একটি লাভজনক ব্যবসা| ব্যবসায় লোকসান আছে, প্রকল্প ব্যর্থ হতে পারে, আল্লাহ মোনাজাত কবুল নাও করতে পারেন; কিন্তু একবার এমপি হওয়া গেলে তিন পুরুষ ধরে অর্থ-বিত্তের আর কোনো অভাব হয় না। এই অসৎ অর্জনের সন্ধান পেয়ে বিদ্যুতের মিটার-রিডার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আমলা পর্যন্ত অর্জিত কালো টাকায়, ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী, খুনের মামলার ফৌজদারী আসামী- সবাই যার যার পেশা ছেড়ে মানিকমিয়া এভিনিউর ওই দালানটায় প্রবেশ করার জন্যে সর্বোচ্চ ইনভেস্টমেন্ট করতে কি রকম মরীয়া হয়ে উঠল? সেটা কি গণতন্ত্রের জন্যে? তিন-চার জন অধঃপতিত মানুষের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়ার বাধ্যকতার নাম কি নির্বাচন ? আন্তর্জাতিক সংস্থাও হিসেব দেয়, ১০ থেকে ২০ কোটি কালো টাকা ব্যয়িত হয় মূলত খুনখারাবি ও ভোট কেনার জন্যে, আর সরকারি কাগজে নির্বাচন ব্যয়-বিবরণ দেয়া হয় ৫ লাখ টাকার! অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি হবার মহান পেশার শুরুটাই হয় নিজের সম্পর্কে সত্য গোপন করার ফলস্ স্টেটমেন্ট দিয়ে। যার জন্যে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি অনুযায়ী শুরুতেই তাদের অধিকাংশের জেল হবার কথা ছিল। কিন্তু হাইকোর্টসহ দেশের সবকটি বিচারাদালত, স্বরাষ্ট্রসহ সকল মন্ত্রণালয়, পুলিশ প্রশাসনের সকল রাষ্ট্রীয় নেটওয়ার্ক এই ডাকাত এবং তাদের সহযোগীদের নির্লজ্জ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এবং সাধারণের দাঁড়াবার মতো কোনো জায়গা খোলা থাকে না।
আমরা একটি দুর্নীতিগ্রস্থ সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি, যেখানে বেচে থাকার প্রয়োজনে এবং জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে আমরা দুর্নীতির সাখে পরিচিত এবং আত্মিকৃত হচ্ছি। সমাজ জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ডের সাথে দুর্নীতির সংশ্রব রয়েছে। এ ব্যবস্থা যত বেশী শক্তিশালী হচ্ছে, যত বেশি প্রকাশিত হচ্ছে, আদর্শ ও মূল্যবোধ তত বেশী প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। ঘুষ দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়ে বিত্তবান হওয়াকে এক সময় লজ্জাস্কর মনে করা হলেও এখন অনেকে এটিতে আর লজ্জা পাচ্ছেনা, তারা যেন একটি সামাজিক অনুমোদন পেয়েই গেছে। আদর্শবান আর ন্যায়নিষ্ঠাবানরা সেকেলে এবং ঝামেলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্থ সিস্টেমে খাপখাওয়াতে না পেরে তারা ছিটকে পরছে মূল স্রোতধারা থেকে অথবা এক পর্যায়ে স্থবির হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজরাই প্রাতিষ্ঠানিক আর ব্যাক্তিগত জীবনে উৎকর্ষতর চূড়ায় যেতে পারছে। ফলে রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যারা আমাদের সামনে মডেল বা আদর্শ হিসেবে হাজির তাদের সাফল্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে সেখানে অন্যায় অত্যাচার আর মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই খুজে পাওয়া যায়না।
দুর্নীতির নানা অভিযোগ থাকার পরও তা স্বীকার না করে সংবাদপত্র কিংবা প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করার প্রবণতা এখানে সুস্পষ্ট হয়েছে। ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক র্স্বাথসিদ্ধি, উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাটাই তীব্রতর। আর ক্ষমতা ও অর্থের জোরে অপরাধ করেও পার পাওয়াটা যে সহজতর এটাও প্রমাণিত। ব্যক্তিগত ইমেজ ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন প্রশ্ন করাও বিপদজনক । নিজ কাজ, অবস্থানের ব্যাপারে যথেষ্ট যুক্তি দেয়ার প্রয়াস দৃশ্যমান। ইতিবাচক ব্যক্তিত্ব রুপে নিজেকে তুলে ধরতেই নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়, সম্পদের সুষম বন্টন হ্রাস পায়,সামাজিক বৈষম্য বাড়ে, মানব উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ হয়, অপরাধ প্রবণতা বাড়ে, সামাজিক নৈরাজ্য; বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকা মানুষ দুর্নীতির কারণে সমাজে প্রান্তিকতর অবস্থানে আছে। সমাজে জেন্ডার বৈষম্য দুর্নীতি বাড়ায়। দুর্নীতির কারণে মানুষ শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়।
দুর্নীতির দু:সহ প্রভাব পড়ে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে, দুর্নীতি দমনের জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান দরকার। সঙ্গে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা । বাংলাদেশের কোথায় দুর্নীতি নেই? প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুর্নীতি চলছে। এমনকি ডাক্তারের কাছে গেলেও আগে সিরিয়াল পেতে ১০০ টাকা বখশিশ দিতে হয়। সরকারি প্রশাসন এখন পুরোপুরি দুর্নীতিগ্রস্ত। এ অবস্থায় অল্প কিছু প্রয়োজনীয় পদ রেখে জনপ্রশাসনের বাকিটা বাদ দেয়া দরকার। আইন করে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য এমন জনস্বাথ বিরোধি দুনীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যেন দুর্নীতি রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি হয়।
©somewhere in net ltd.
১| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:২৩
এক নিরুদ্দেশ পথিক বলেছেন: দুর্নীতির সরব আলোচনা, লেখাটিকে প্রমোট করা হোক। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।