নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গণমাধ্যমের ভেতরে ও বাইরে: অস্তিত্ব, প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ

০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৩০

গণমাধ্যম ইংরেজি Mass media। যে মাধ্যমগুলো প্রযুক্তিগতভাবে গণযোগাযোগ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সম্প্রচার মাধ্যম যা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নামে পরিচিত, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে তাদের তথ্যাবলী প্রেরণ করে। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, রেডিও বা বেতার, সিডি, ডিভিডি এবং অন্যান্য সুবিধাজনক ছোট ও সহায়ক যন্ত্রপাতি যেমনঃ ক্যামেরা বা ভিডিওচিত্রের সাহায্যে ধারণ করা হয়। পাশাপাশি মুদ্রিত মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র, সাময়িকী, ব্রোশিওর, নিউজলেটার, বই, লিফলেট, পাম্পলেটে বাহ্য বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়। এতে ফটোগ্রাফী বা স্থিরচিত্রও দৃশ্যমান উপস্থাপনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। টেলিভিশন কেন্দ্রে অথবা পাবলিশিং কোম্পানী গণমাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত হয়। মোবাইল বা সেল ফোন, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটকেও গণমাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইন্টারনেট এর মাধ্যমে অনেক প্রকার সেবা - বিশেষ করে ই-মেইল, ওয়েব সাইট, ব্লগিং, ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনের প্রচারকার্য পরিচালনা করছে। এ কারণে অনেক গণমাধ্যমের পদচারণা ওয়েব সাইটে দেখা যায়। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনচিত্রকে ওয়েবসাইটে সংযুক্ত করা হয়েছে কিংবা খেলাধূলাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রীড়াপ্রেমী দর্শকদেরকে তাদের ওয়েবসাইট দেখতে উদ্বুদ্ধকরণে ঠিকানা প্রকাশ করে। বাইরের মাধ্যম হিসেবে বিলবোর্ড, সাইন, প্লাকার্ডকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনের ভিতরে ও বাইরে যেখানে অধিক দোকান-পাট/বাসের ব্যস্তমূখর পরিবেশে উপস্থাপন করা হয়। জনসভা এবং বিশেষ ঘটনায় সমবেত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানও গণমাধ্যমের একটি ধরণ।

বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে গণমাধ্যমকে প্রধান ৮টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো - বই, সংবাদপত্র, সাময়িকী, ধারণ যন্ত্র, রেডিও, সিনেমা, টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট। একবিংশ শতকের শুরুতে গণমাধ্যমের প্রকারভেদ নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, গণমাধ্যমের বিভাজন সুস্পষ্টভাবে আরও বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যেই সেল ফোন, ভিডিও গেম এবং কম্পিউটার গেমসকে গণমাধ্যম হিসেবে উপস্থাপনা করায় বিতর্ক চলছে। বিংশ শতাব্দীতে সেভেন মাস মিডিয়া নামে গণমাধ্যম পরিচিত ছিল। সে ধারায় বর্তমান ৭টি গণমাধ্যম হলো -মুদ্রিত (বই, পাম্পলেট বা ক্ষুদ্র পুস্তক, সংবাদপত্র, সাময়িকী প্রভৃতি) মাধ্যম যা পঞ্চদশ শতক থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। ধারণ যন্ত্র বা রেকর্ডিং (গ্রামোফোন রেকর্ড, ম্যাগনেটিক ট্যাপ, ক্যাসেট, কার্ট্রিজ, সিডি, ডিভিডি ইত্যাদি) মাধ্যম যা উনবিংশ শতকের শেষদিকে প্রচলিত। সিনেমা যা উনবিংশ শতক থেকে প্রচলিত। রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে যা ১৯১০ সাল থেকে প্রচলিত। টেলিভিশন সম্প্রচার ব্যবস্থা যা ১৯৫০ সাল থেকে প্রচলিত। ইন্টারনেট ব্যবস্থা যা ১৯৯০ সাল থেকে প্রচলিত। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যা ২০০০ সাল থেকে গণমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

প্রত্যেকটি গণমাধ্যমই তাদের স্বতন্ত্রতা, সৃষ্টিশীলতা, প্রযুক্তিকৌশলসহ নিজস্ব ব্যবসায়িক গুরুত্ব ও আবেদন প্রয়োগ করেছে। যেমনঃ ইন্টারনেট ব্যবস্থায় ওয়েবসাইট, ব্লগ, পডকাস্টসহ আরো নানাবিধ প্রযুক্তিকৌশল প্রয়োগ করায় সাধারণভাবে নেটওয়ার্কিং জগতে শীর্ষস্থান দখল করেছে। ৬ষ্ঠ এবং ৭ম মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট এবং মোবাইলকে প্রায়শঃই ডিজিটাল মিডিয়ারূপে আখ্যায়িত করা হয়। ৪র্থ এবং ৫ম মাধ্যম হিসেবে যথাক্রমে রেডিও ও টেলিভিশনকে ব্রডকাস্ট মিডিয়া বা সম্প্রচার মাধ্যমরূপে বিবেচিত। কেউ কেউ ভিডিও গেমসকেও গণমাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। গণমাধ্যম ছাড়া আমাদের জীবন অসম্ভব অর্থাৎ বলা চলে এটি আমাদের জীবনকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করছে। গণমাধ্যম যেমন নিয়ন্ত্রণ করছে গণমানুষের জীবন যাপন তেমনি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে এর মালিক। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর মালিকরা মিডিয়াকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থকে হাসিল করে। মিডিয়ার মালিকানাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:ব্যক্তি মালিকানা, অংশীদারী মলিকানা, আইনগত মালিকানা, দলগত মালিকানা, কর্মচারী মালিকানা, উলম্ব মালিকানা, যৌথ মালিকানা।

১৯২৬ সালে জন বেয়ার্ডের টেলিভিশন আবিষ্কারের পরে ১৯৩০ সালে ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং করপোরেশন এবং বৃটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন যথাক্রমে নিউইয়র্ক এবং লন্ডনে টিভি স্টেশন স্থাপনের মধ্য দিয়ে টেলিভিশনের পথচলা শুরু হয়। ১৯৩৬ সালের নভেম্বর মাসে বিবিসি আলেকজান্দ্রা প্রসাদ থেকে সর্বসাধারণের জন্য সম্প্রচার শুরু করে। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম সার্থক টেলিভিশন সম্প্রচার। বাংলাদেশে প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে। তবে তার আগে ওই বছরের ১ এপ্রিল অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জামিল চৌধুরি। টিভির প্রথম অফিস ছিল অধ্যক্ষের কামরায় পরে তা ডিআইটি ভবনে স্থানান্তরিত হয়। তখন সম্বল ছিল একটি স্টুডিও, দুটি ক্যামেরা, দুটি ফিল্ম টিভি প্রজেকটর আর ৩০০ ওয়টের একটি ক্ষুদ্র ট্রান্সমিটার, যার ক্ষমতা ছিল মাত্র ১০ মাইল। এরপর ১৯৬৮ সালে ১৪ এপ্রিল রামপুরায় টেলিভিশন ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৯৭৫ সলে। ১৭ ডিসেম্বর থেকে এটি ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ নামে যাত্রা শুরু করে এবং ২১ ডিসেম্বর থেকে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশে নব্বই এর দশকে স্যাটালাইট আসার পর ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেল।

বাংলাদেশে মূলধারার সকল মিডিয়া মুক্তবাজার অর্থনীতিকে মতাদর্শ হিসাবে মেনে নিয়েছে; বাংলাদেশে একটি কর্পোরেট সংস্কৃতি গড়ে তোলার পক্ষে তাদের ওকালাতি। বাংলাদেশে মূলধারার টিভিগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠি, নারী, অন্য ধর্মাবলম্বী আর আদিবাসীদের অবস্থান কেন প্রান্তিক এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে টিভিগুলোর চরিত্র আর তার মালিকানা বিশ্লেষণ করলেই। সরকারি বা বেসরকারি কোন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত নাটকে নায়ক/নায়িকা বা অন্য কোন ভূমিকায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান চরিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে না কোন আদিবাসী চরিত্র। কারণ মিডিয়া মালিকানা তাদের হাতে নেই। গণমাধ্যমের অনুষ্ঠানে নারীর যে বিকৃত আর বিক্রিত ইমেজ প্রতিফলিত হয় তার কারণ পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়া মালিকানা, নারীর হাতে মিডিয়া মালিকানা নেই। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের কথা এখানে আসে না আসে শহুরে ধনিক আর এলিট শ্রেণীর কথকতা কারণ মালিকানা তাদের হাতে। তাই অনেকে বর্তমান বাংলাদেশের মিডিয়াকে ‘ম্যাস মিডিয়া’ না বলে ‘ক্লাস মিডিয়া’ বলেন আবার অনেকে বলেন ‘মেল মিডিয়া’।

বাংলাদেশে গত এক দশকে গণমাধ্যমের মালিকানা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন আর কোন ব্যক্তি বা একক সংস্থা নয়, রেডিও টিভির মালিক হচ্ছেন কোন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা গ্রুপ অব কোম্পানিজ। পশ্চিমের মতো একই হাউজ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, আর টিভি চ্যানেল বের হচ্ছে। ‘মহান’ পেশায় অবদান রাখা বা সমাজে উন্নয়নের চিন্তা নয় বরং মুনাফা অর্জন, রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ কিংবা কোম্পানির অন্য ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এখন কাগজ বেরুচ্ছে, টিভির চ্যানেল গজাচ্ছে। মিডিয়া পরিণত হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিতে। তবে যে বিষয়টি দুঃখজনক তা হলো আমরা দেখছি, মিডিয়ার মালিকানা চলে যাচ্ছে মাস্তান, দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক আর দুষ্ট লোকদের হাতে। নষ্ট রাজনীতিক আর দুষ্টু ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়িক আর রাজনৈতিক স্বার্থে সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলের মালিক হচ্ছেন।

মিডিয়ার কাজ সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তাদের ভুল-ত্রুটিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। মানুষ প্রত্যাশা করে সরকারি, বেসরকারি, বহুজাতিক বা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান- যাদের কাজের সঙ্গে জনগনের স্বার্থ জড়িত মিডিয়া তাদের কাজের উপর নজরদারি রাখবে, জনবিরোধী বা কোন অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতি হলে সেসবের সমালোচনা করবে। মিডিয়াকে তাই ‘আই অব গভর্নমেন্ট’ বলা হয় আবার অনেকে বলেন ‘ওয়াচ ডগ’। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা এর উল্টো। এখানে মিডিয়া মালিকের জন্য, মালিকের পক্ষে, এবং শুধুমাত্র সরকারের কথা বলে। বলা হয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন পঁচে গেছে তেমনি পঁচে গেছে মিডিয়া মালিকানা। প্রত্যাশা হচ্ছে, গণমাধ্যম হবে গণমুখী, এলিটদের স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে সাধারণ জনগনের দিকে নজর দিবে। টিভিতে আপামর জনসাধারণের কথা আসবে এবং তাদের চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে অনুষ্ঠান তৈরি করবে। দর্শকদের শুধু গৌণ বিবেচনা করবে না তাদের উপকার হয় এমন সব অনুষ্ঠান তৈরি করবে এবং প্রচার করবে। কমিউনিটি রেডিওর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের মিডিয়া মূলত ধনিক অভিমূখীন, শহর অভিমূখীন, এলিট ও পুরুষ অভিমূখীন; এবং এর কারণ মিডিয়া মালিকদের শ্রেণীচরিত্র, তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও লিঙ্গগত অবস্থান। এদের কাছে মুনাফা অর্জন, দ্রুত ব্যবসায়িক উন্নতি লাভ, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল, আর কর্পোরেট স্বার্থ তাদের কাছে মুখ্য আর জনস্বার্থের বিষয়টি তাদের কাছ গৌণ। কাজেই র্তৃণমূল মানুষের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় এরা কাজ করবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আমাদের দেশের টিভিগুলোতে খুব সামান্য পরিমান সময় বরাদ্দ করা হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য। নারীর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যাতে কোন ক্লাইমেক্স/সেন্সেশন নেই তা কখনো সংবাদ হয় না। কিন্তু হতদরিদ্র কুমারিটি মা হলে, সংগ্রামী নারী ধর্ষনের স্বীকার হলে, কারো মুখ এসিডে ঝলসে গেলে মুনাফালোভী চ্যানেলগুলো এই নারীদের চিত্র দিয়ে সংবাদের কাটতি বাড়ায়।

দেখতে হবে গণমাধ্যমে সাধারণ মানুষের বাস্তব প্রবেশাধিকার আসলে কতটুকু? কতজন মানুষ এদেশে খররের কাগজ পড়তে পারে, কতজন পত্রিকা পড়ে বুঝতে পারে, কতজনের সামর্থ আছে পত্রিকা কিনে পড়ার, দেশের কতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ আছে, কোন কোন জায়গায় ক্যাবল টিভি দেখার সুযোগ আছে, কতজনের সামর্থ আছে তা কিনে দেখার,আর রেডিও-টিভির অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের, সব মিলিয়ে মিডিয়ার ওপর জনগনের নিয়ন্ত্রণ আসলে কতখানি-গণমাধ্যমে জনগনের সত্যিকারের প্রবেশাধিকারের আলোচনায় এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। আর এর চেয়েও জরুরি যে প্রশ্ন তা হল গণমাধ্যমের পরিচালনা বা মালিকানায় জনগনের কোন অংশভাগ/অংশগ্রহণ আছে কিনা। জনগন যদি মিডিয়ার মালিক হয় তাহলে তারা তাদের সমস্যা ভালভবে বের করতে পারবে এবং তার সমাধান করতে পারবে। সমাজের সত্যিকার সত্যগুলো বের হয়ে আসবে,বের হয়ে আসবে তৃণমূল মানুষের কথা এবং দরিদ্র মানুষের বঞ্চনার কাহিনী। মিডিয়া মালিকরা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতা পছন্দ করে না। স্বতঃপ্রবর্তিত হয়ে মালিকরা কোনদিনই তথ্য নিশ্চিত করবে না। তারা চায়, সবকিছুই তাদের কারো না কারো নিয়ন্ত্রণে থাকুক ।

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, যে দেশে সংবাদপত্র স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না- ‘No substantial famine has ever occurred in any independent and democratic country with a relatively free press.’ এ উদ্ধৃতির তাৎপর্য হলো, একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গণমাধ্যম ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। আমাদের দেশে এখনো সাড়ে ৪ কোটির ওপর লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। দরিদ্র লোকের বঞ্চনা অনেক বেশি, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ খুব কম। কেননা তারা সংগঠিত নয়। উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম শর্ত হচ্ছে জ্ঞান সম্প্রসারণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হলে আমাদেরকে আগে তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং এর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। যাদের তথ্যভাণ্ডার যত সমৃদ্ধ, তাদের ক্ষমতায়ন তত বেশি। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তই যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত হয়। অবাধ তথ্যভিত্তিক সমাজ সে কারণেই হয় উন্নত।

মিডিয়াকে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ জরুরি। প্রথমত, গণমাধ্যম হবে স্বাধীন; দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম মানসম্পন্ন তথ্য সরবরাহ করবে; এবং তৃতীয়ত, এর পরিসর বড় হতে হবে, মানে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে গণমাধ্যমের সঙ্গে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অর্থ হলো, ভয়হীনভাবে সত্যনিষ্ঠ কোনো তথ্য প্রকাশ করার ক্ষমতা এবং বিশেষ কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের কিংবা গোষ্ঠীর পক্ষ বা নিয়ন্ত্রিত হয়ে কাজ না করা। যদিও গণমাধ্যমের গুণগত মান পরিমাপ করা কঠিন, তথাপি মানসম্পন্ন তথ্য সরবরাহ করার অর্থ হলো, বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ ও তথ্য উপস্থাপন করা। তথ্য বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে এবং সব মত উপস্থাপন করতে হবে, যাতে পাঠককুল সত্য উদ্ঘাটন করতে পারে। কতগুলো বিষয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন-গণমাধ্যমের মালিকানার কাঠামো, অর্থনৈতিক কাঠামো ও অর্থায়নের সহজলভ্যতা, তথ্যে প্রবেশের জন্য একটি দেশের প্রচলিত বিধান এবং মিডিয়াবিষয়ক নীতিমালা। অন্যদিকে গুণগত মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে নৈর্ব্যত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ নিজ স্বার্থ দ্বারা বিবেচনাবোধ তাড়িত হবে না। তৃতীয় শর্তটি হচ্ছে, মিডিয়া কত লোকের কাছে পৌঁছাচ্ছে; মিডিয়ার ওপর লোকজনের প্রবেশ (access ) কতটুকু আছে। সংবাদপত্র যদি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে না পারে মনে করা হয়, লোকে তা পড়বে না। তবে স্বল্প শিক্ষিত স্বল্পোন্নত দেশে হলুদ সাংবাদিকতা অবশ্যই জনগণের কোনো কোনো অংশকে বিভ্রান্ত করতে পারে। যে দেশে মাথাপিছু গ্রস ন্যাশনাল প্রডাক্ট (জিএনপি) যত বেশি, সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে তত অ্যাকসেস বেশি।

গণমাধ্যম মানুষের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। এ প্রেক্ষাপটে মিডিয়া অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফল বদলে দিতে পারে। স্বাধীন দেশে মিডিয়া কতটুকু জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে, তা নির্ভর করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর। কেননা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর মুক্ত গণমাধ্যম একে অন্যের পরিপূরক। দুটোই একে অন্যকে প্রভাবিত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে মিডিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। স্বাধীনতার প্রারম্ভিক কয়েক বছর পর পুনরায় মিডিয়া বিকশিত হতে শুরু করে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর থেকে। অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও ব্যক্তি খাতের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের ব্যাপক সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল। বিগত দশকে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও এফএম রেডিওর সূচনার মাধ্যমে মিডিয়ার ল্যান্ডস্ক্যাপ বা ভূমিতলের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে যাদের সংবাদপত্র বা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সুবিধা নেই, তারা এখন এফএম রেডিওর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সংবাদ জানতে পারছে।সাবেক মাকিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বলেছেন, যদি কখনও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খব করা সম্ভব হয় তবে জনসাধারণের বাক স্বাধীনতা, শিক্ষার স্বাধীনতা, বক্তব্য, সভা-সমাবেশের মতো মৌলিক অধিকারগুলো অথহীন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশে মিডিয়ার সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত দুর্নীতি বিষয়কে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা। তাছাড়া বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে সাধারণভাবে মিডিয়া সোচ্চার। স্টক মার্কেট কিংবা হল-মার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা আজ আমাদের আর্থিক খাতে অসঙ্গতির বিষয়টি তুলে ধরেছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি ও এর ভয়ানক প্রভাব সম্পর্কে প্রিন্ট মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ফলে সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষত ইউনিসেফ, ডব্লিওএইচও ও বিশ্বব্যাংক এগিয়ে এসেছিল। পরিবেশ ও নদী রক্ষার আন্দোলনেও গণমাধ্যম জোরালোভাবে এগিয়ে এসেছে। আজকে বুড়িগঙ্গা বা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন হোক কিংবা নদী রক্ষার, মিডিয়া যদি কার্যকর ভূমিকা পালন না করে তাহলে সরকারের উদ্যোগ ফলপ্রসূ ও এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে না। অবৈধ স্থাপনা ও নদী দখলের বিরুদ্ধে আমাদের প্রিন্ট মিডিয়া প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সহজ হচ্ছে। এসিড সন্ত্রাস, গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিয়ে ও ফতোয়া জারির বিরুদ্ধে মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক জনসমর্থন ও জনসচেনতা বেড়েছে। ফলে এসিড সন্ত্রাস এখন অনেকাংশে কমে এসেছে। এটাও সত্য, মিডিয়া যদি আরো বলিষ্ঠভাবে ভূমিকা পালন করত তাহলে তাজরীন ফ্যাশনস বা রানা প্লাজার মতো এত বড় দুর্ঘটনা হয়তো পরিহার করা যেত। এ বিষয়ে গভীর ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যথেষ্ট ছিল না।

বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা হলো, এখনো গ্রামাঞ্চলের সিংহভাগ লোকের কাছে প্রিন্ট মিডিয়া পৌঁছে না। সে কারণে সেখানে সে ধরনের কোনো পাঠকসমাজ গড়ে ওঠেনি। ফলে বিজ্ঞাপনের বাজারটা ঢাকার বাইরে এত বড় নয়। তদুপরি গ্রামাঞ্চলের সমস্যাগুলো মিডিয়ায় সেভাবে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয় না। আমাদের দেশে মিডিয়ার একটা নেতিবাচক দিক হলো, তারা সেসব খবরই বেশি প্রচার করে যেগুলো খামখেয়ালি পাবলিকের বেশি পছন্দ। সে খবর কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বিষয় নয়। গণমাধ্যমের কর্মীরা সহিংস ঘটনা বেশি প্রচার করার ফলে দুষ্কৃতকারীরা সাংবাদিকদের ডেকে এনে বিস্ফোরণ ঘটায়। সহিংস ঘটনার পাশাপাশি ভালো খবরগুলো তুলে আনতে পারলে তা সহিংসতাকে উসকে দিত না হয়তো। কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়ার কোনো বিষয়কে নিয়ে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ির ফলে গণমানুষের মনে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়।

প্রচুর মিডিয়া এখন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তদুপরি আমাদের গণমাধ্যম বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাকসেস স্টোরির জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ‘দি ইকোনমিস্ট’, দ্য গার্ডিয়ান’ এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতের ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ কিংবা অমর্ত্য সেনের মতো ব্যক্তিদের লেখনীর ওপর। গোল্ডম্যান স্যাকস বাংলাদেশকে নেক্সট ইলেভেন হিসেবে চিহ্নিত করে অথচ আমাদের সংবাদমাধ্যম নেতিবাচক দিক বেশি তুলে ধরার প্রবণতা দেখায়। অথচ ইতিবাচক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে গণমাধ্যম হতে পারে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।

যেকোনো দেশের জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে চায়, তাদের প্রচারযন্ত্র হিসেবে। কিন্তু গণমাধ্যমের পক্ষে তো কারও প্রচারযন্ত্র হওয়া সম্ভব না। চূড়ান্তভাবে গণমাধ্যমের কাজ নির্মোহভাবে ঘটনাকে তুলে ধরা। যদিও কেউ কেউ বলেন, গণতন্ত্র, মানুষ ও সমাজের স্বার্থে গণমাধ্যম নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। আবার নিরপেক্ষতার নামে সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থন করা গণমাধ্যমের কাজ হতে পারে না। আসলে সাংবাদিকদের কোনো রাজনীতিবিদের প্রতি সমর্থন বা বিদ্বেষ থাকা ঠিক নয়। সাংবাদিকেরা একটিভিস্টও নন, ন্যাশনালিস্টও নন। সাংবাদিকেরা কেবলই জার্নালিস্ট।

বর্তমান সময়ে এই গণমাধ্যমই যেন আমাদের জীবনকে সচল বা গতিময় করে রেখেছে। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, রেডিও, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটারসহ নানারকম মিডিয়া বা গণমাধ্যম আজ আমাদের নিত্যসঙ্গী। এক মুহুর্তের জন্যও এগুলোর অনুপস্থিতি আমাদের জীবনকে স্থবির করে দেয়। তাই ইদানিংকালে গণমাধ্যমের চাহিদা, প্রচার ও প্রসার পূর্বের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেড়েছে। আমাদের সার্বিক জীবন যাত্রার ওপর গণমাধ্যমের সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবখানেই এর বিস্তার লক্ষণীয়। বর্তমান সময়ে অনেকক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ফলে আমাদের শান্তি-সুখের আশ্রয়স্থল এই পরিবারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পুরো পরিবার তথা সামাজিক ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ব জুড়েই সন্ত্রাসের পক্ষে মিডিয়ার ভূমিকা জারি রয়েছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র যে ব্যবস্থায় সরাসরি সন্ত্রাসবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রমোট করে, সেখানে মিডিয়া তার অর্থনীতি ও কালচারাল শ্রেণী চরিত্রের দিক থেকে গণবিরোধী হতে বাধ্য। যদিও এর নাম দেয়া হয়েছে ‘গণমাধ্যম’।

পশ্চিমে যোগাযোগ অধ্যয়ন বেশ পরিণত অবস্থায় পৌঁছেছে। যোগাযোগ ও মিডিয়া অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বাইবেলতুল্য বই মার্শাল ম্যাকলুহানের প্রস্তাবনার নাম, ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিডিয়া : এক্সটেনশন অব ম্যান’। মিডিয়াকে পশ্চিমা সমাজ মানুষের ক্রমবিকাশের ধারার আলোকে বুঝতে চাইছে, বুঝেছে। আমাদের ওরাল ধারা এখনও বজায় আছে। আপনি এমন একজন কৃষকও পাবেন না যার সকাল বেলার আরামদায়ক টয়লেটের সাথে পত্রিকার কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু শহরের অনেক লোকের এই সমস্যা দেখবেন। পত্রিকা ছাড়া টয়লেটে সমস্যা হয়। প্রিন্টিং প্রক্রিয়া শুধু মিডিয়ার সম্ভাবনাই পরিষ্কারভাবে হাজির করেনি, হাজির করেছে জাতীয়তাবাদের সম্ভাবনাও। দেশের ক্রিকেট টিম জিতে গেলে লাল টকটকা কালিতে পত্রিকার হেডিং হয় ‘বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব’। এর সাইকোলজিক্যাল ইমাজিনেশন ও ইমপেক্ট ভয়াবহ। যাহোক প্রিন্টিং টেকনলোজিই হাজির করেছে রাষ্ট্রের আধুনিক পরিগঠনের পসিবিলিটি। প্রিন্ট মিডিয়াম/মাধ্যমকে বলা হয় জাতীয়তাবাদের আর্কাইভ।

নিরপেক্ষভাবে কাজ করার বৈশিষ্ট্য সাংবাকিদেরকে গুপ্তচর, প্রচারক ও প্রপাগান্ডিস্টদের থেকে পৃথক করেছে। অসহনীয় বা অপ্রিয় সত্য বলতে পারার ক্ষমতা সাংবাদিকদের পৃথক করেছে বিনোদনকর্মী থেকে। নিজস্ব বিশ্বাসকে চাপা দিয়ে কোনো ঘটনা বা ইস্যুর বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা সাংবাদিকদের পৃথক করেছে ধর্মবেত্তা বা রাজনীতিকদের থেকে। আর যথার্থতা ও জবাবদিহিতার গুণটি সাংবাদিকদের পৃথক করেছে গল্পকথকদের কাছ থেকে। মিডিয়া আলোচনায় মার্ক্সিস্ট বুদ্ধিজীবিরা মিডিয়াকে সব আধিপত্য কায়েমের যন্ত্র আকারে হাজির হতে দেখেন। শ্রেণী, কর্পোরেট, সংস্কৃতি, হেজিমনি -নানা বিষয় যুক্ত করে মিডিয়ার তর্কটা হাজির করেন। তারা জানান যে, মিডিয়া হল ‘মাধ্যম’, মানে প্রচার যন্ত্র। এইটা কোনোভাবেই গণমাধ্যম না। ‘গণ’ নিয়া গণবিতর্ক আছে। সেখানে নানা জনগোষ্ঠীর ‘গণ’ হয়ে হয়ে ওঠার রাজনীতি ও সংস্কৃতির যে পাঠ তা খুব নিষ্ঠার সাথে না করলে ‘গণ’ ব্যাপারটা রেটরিক বা মুখের কথাই থেকে যাবে। ফলে মিডিয়ার সরল বাংলা হল প্রচারযন্ত্র।

আত্মমগ্ন প্রজন্ম ফেসবুক বা টুইটের মতো মাধ্যমকে আত্ম্প্রচার বা দ্রুত নিজেকে জনপ্রিয় করার জন্য এমন সব কাজ করে বসে, যার জন্য রক্তারক্তি পর্যন্ত ঘটে যায়। কনজ্যুমার জাতীয় চেতনার আন্ডারেই হাজির হয় ফেসবুক/টুইটার/ব্লগ ব্যবহারকারীরা। জনগণের এথিক্যাল ঐক্যের প্রতি কোনো বিবেচনা না রেখে দ্রুত জনপ্রিয় ও নিজেকে নিয়ে বিতর্ক উপভোগ করবার মানসিকতার অসুখে পেয়ে বসে নয়া মিডিয়া ব্যাবহারকারী ভোক্তা প্রজন্মকে। জন্ম হয় ‘থাবা বাবা’র মতো ক্যারেক্টারের। মিডিয়া কালচার বলে যে ব্যাপারটা আছে তা তো মিডিয়াকে কোন ভাবেই গণমাধ্যম হয়ে উঠতে দিবে না। কিছু সিভিল বুদ্ধিজীবিরা মিডিয়ায় ইস্যুভিত্তিক আলাপে ব্যস্ত থাকে। বিভিন্ন ইস্যুর টেনশন মিনিমাইজ করাই হল এদের কাজ। এরা তাই জন্মগতভাবেই গণবিরোধী। মিডিয়ায় যে এলিট-আধিপত্য গড়ে ওঠে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের এমনভাবে কোনঠাসা করে দেয়া হয়, আর তা এতো স্বাভাবিকভাবে ঘটে যে, মিডিয়ার সাংবাদিকেরা কতগুলো পেশাগত সংবাদমূল্যের ভিত্তিতে ‘বস্তুনিষ্ঠভাবে’ কাজ করেন বলে নিজেদের বোঝাতে সক্ষম হন। কিন্তু বাধাগুলা এতটা শক্তিশালী, এমন মৌলিকভাবে সিস্টেমের মধ্য থেকে গড়ে-ওঠা যে, সংবাদ-পছন্দের বিকল্প ভিত্তির কথা কল্পনা করাও কঠিন।’

মার্শাল ম্যাকলুহান ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিডিয়া’ বইয়ের প্রথম অধ্যয়েই বলছেন, ‘মিডিয়াম ইজ দ্যা মেসেজ’। মাধ্যমই সংবাদ। আমরা সাধরণত মনে করি মিডিয়া হবে সত্য প্রকাশের হাতিয়ার, ন্যায় আর বিবেকের পরাকাষ্ঠা। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন মিডিয়া বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নাই। মিডিয়াম নিজেই একটা চরিত্র ধারণ করে তার পরে সে তাঁর চরিত্রের বাজারজাত করে। কালচারাইজ করে তার চরিত্রকে। এটা বাজারের স্বার্থে না করে রাজনীতি সংষ্কৃতি ও অন্য নানা কারণে করতে পারে। ফলে মিডিয়াকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাববার আর কোন সুযোগ নাই। ঘটনা সংবাদ হতে যে কারণে পৃথক ঠিক একই কারণে প্রচারযন্ত্র সার্বজনীন সত্য থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য। আমাদের প্রতিটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বহুপক্ষীয় ব্যাবসার স্বার্থে জড়িত। সাধারণত বড় বড় ব্যাবসায়ীর কাছে মিডিয়া হল অন্য ব্যাবসা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার। যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারে কিছুটা নিজের ব্যাবসার অনুকূলে রাখতে একটা মিডিয়া প্রতিষ্ঠান কোটি টাকার চাঁদা সেভ করে দিতে পারে। সরকারও সহজেই এদের বাধ্য করে ফেলতে পারে নগ্ন প্রপাগান্ডায় নেমে যেতে। আর বাড়াবাড়ি করলে সহজেই বন্ধ করে দেয়া হয়।

আধুনিকতার মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে মিডিয়া তারই মুরুব্বি হিসেবে নিজেরে হাজির করে। যখন কোন কমিউনিটি হাজির হয় তখন প্রচারযন্ত্র কেবল হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তাদেরকে কেন্দ্র করে সমাজে যে উত্তেজক অবস্থার সৃষ্টি হয় মিডিয়া তখন তার চরিত্রের সীমাব্ধতা সত্ত্বেও নিরপেক্ষতার ভনিতা করে। কিন্তু পারসেপশনের বেলায় প্রচার যন্ত্রের গোমরটা ফাঁস হয়ে যায়। মিডিয়ার পারসেপশন আর জনসমাজের পারসেপশনের মধ্যে যে ফারাক তা অতিগুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মিডিয়ার হাজির করা বাস্তবতা প্রায়ই শিক্ষিত বা বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিত্তকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ফলে তাঁদের রাজনৈতিক বিকাশ হয় খুব নিম্নশ্রেণীর। অনেক মানুষের জন্য অবস্থাটা এ রকম যে, কোন ইস্যু মিডিয়ায় আসার আগ পর্যন্ত সেটা আর ইস্যুই মনে করছে না। আমরা দেখছি মিডিয়া মিথ্যা বলছে তার পরেও আমরা সেই খবরই পড়ছি। এর মধ্যেই রাজনীতির কর্তব্য কর্ম খুঁজছি। চমস্কি যেমন বলেন, যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট আমলাতন্ত্র থাকে সেই সব দেশে মিডিয়া আধিপত্যশীল এলিটদের হয়ে কাজ করে। মানে মিডিয়া প্রচারযন্ত্র হিসেবে উলঙ্গ প্রতিযোগিতায় নামে। বিনোদন ও কিছু ব্যালেন্সিং রিপোর্ট করে গণমাধ্যম মিথটাও জারি রাখে। যাতে জনগনের সাথে প্রতারণাটা ধারাবাহিক ভাবে করা যায় এবং লসপ্রজেক্ট না হয়। পাবলিক মুখ ফিরিয়ে নিলে তো আমছালা সবই যাবে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু সাংবাদিকতা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবেই রয়ে গেছে। গণমাধ্যম স্বাধীনতার অবনতি হয়েছে। আর সাংবাদিকতা জড়িয়ে যাচ্ছে ব্যবসা স্বার্থের সঙ্গে। নিউ ইয়র্কভিত্তিক সাংবাদিক সুরক্ষা কমিটি, সিপিজে তাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছে, বাংলাদেশে রাজনীতি ও সাংবাদিকতার মধ্যে যে পৃথকীকরণ রেখা রয়েছে তা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি অস্পষ্ট। গণমাধ্যম স্বাধীনতার অবনতি ঘটেছে এ রকম ৯টি দেশকে চিহ্নিত করেছে সিপিজে। বাংলাদেশ দেশগুলোর মধ্যে একটি। পর্যবেক্ষণমূলক ওই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালের রাজনৈতিক গোলযোগের সময় বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ওপর সব দিক থেকে আঘাত এসেছে। গত দশকে বাংলাদেশের বড়মাপের বেসরকারি করপোরেশনগুলো মিডিয়া বাজারে প্রবেশ করেছে এবং বর্তমানে জাতীয় গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ দেশের শীর্ষ সব করপোরেট গ্রুপের হাতে। আফসান চৌধুরীর লেখা ‘মিডিয়া ইন টাইমস অব ক্রাইসিস’ বইয়ের উদ্ধৃতি করে এশিয়া বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক পত্রিকা দ্য ডিপ্লোম্যাটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লেখকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, প্রিন্ট মিডিয়া অনেকখানি অংশ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো হস্তগত করে নিয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নানা আর্থিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় জড়িয়ে গেছে। অন্য সমালোচকরা বলছেন, মিডিয়া ক্রমেই করপোরাটাইজড হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ ব্যবসা ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নানা মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। উদাহরণস্বরূপ প্রতিবেদনে ট্রান্সকম গ্রুপের কথা বলা হয়। ইলেকট্রনিক, মোবাইল ফোন, ফার্মাসিউটিক্যাল, খাদ্য ও পানীয়- এ রকম বিস্তৃত খাতে ট্রান্সকমের পদচারণার বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি সব থেকে বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং সর্ববৃহৎ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশ করে। এ ছাড়াও তাদের রয়েছে এফএম চ্যানেল এবিসি রেডিওর মালিকানা। চলমান এ ধারা সুস্থ গণমাধ্যমের পরিপন্থি।

ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নানামুখী মিডিয়ার একত্রীকরণ এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যেখানে সৃষ্টিশীলতা এবং বহুমুখিতার বদলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সাধারণ একটি মানদন্ড এবং সমজাতীয় বা সমমাত্রিক এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ। বাংলাদেশে এ ধারা লক্ষণীয়। বলতে গেলে প্রতিটি টিভি চ্যানেলেই একই ধরনের অনুষ্ঠানমালা দেখা যায়। নিম্নমানের ধারাবাহিক নাটক, অসার টক শো আর পক্ষপাতমূলক, অসম্যক সংবাদ প্রচার অনুষ্ঠানের সংমিশ্রণ। ২০০৫ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্টের সংলাপ টক শো’র প্রথম সম্প্রচার হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো টক শো ধারণাকে আপন করে নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু অনুষ্ঠান দুর্নীতি, নীতিমালা সংস্কার, শিল্প এবং কৃষির মতো ক্ষেত্রগুলোতে নানা ইস্যু খতিয়ে দেখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এফএম রেডিও চ্যানেলের দ্রুত বিকাশ তরুণ প্রজন্মের খোরাক মেটাচ্ছে; বিশেষ করে শহুরে এলাকাগুলোতে। এফএম স্টেশনগুলো বহুমাত্রিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এর মধ্যে রয়েছে টক শো, গান, সংবাদ ও চিত্তবিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে ওঠা কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের সংখ্যা এখন ১৪। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদনসহ অনুপ্রেরণামূলক নানা অনুষ্ঠান এসব স্টেশনে প্রচারিত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীনতায় রয়েছে নানা হুমকি। সাতক্ষীরা অভিযান সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো বাংলা দৈনিক ইনকিলাব ১৬ই জানুয়ারি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। ইনকিলাব কার্যালয় থেকে প্রতিবেদনটির প্রধান প্রতিবেদক আহমেদ আতিকসহ চার সাংবাদিক গ্রেপ্তার হন। বিরোধীপন্থি আমার দেশ পত্রিকাটির ছাপাখানা ২০১৩’র এপ্রিলে সিলগালা করে দেয়া হয়। এর আগে গ্রেপ্তার করা হয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। ২০১৩’র ৬ই মে সংবেদনশীল ধর্মীয় সংবাদ প্রচারের অভিযোগে দিগন্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার প্রস্তাবিত খসড়ায় সম্প্রচার লাইসেন্স, বিজ্ঞাপন এবং অনুষ্ঠানের ধরনসংক্রান্ত দিকনির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৪০টি নিয়মকানুন বিধিমালার আওতায় রয়েছে অনুমোদনপ্রাপ্ত ৪৬টি সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেল। নতুন এ নীতিমালায় সমপ্র্রচারযোগ্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়াও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বাড়ানো হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সম্প্রচার লাইসেন্স অনুমোদন প্রদানের সিদ্ধান্ত। স্পষ্টত, বাংলাদেশী গণমাধ্যমে চলমান চ্যালেঞ্জগুলো অব্যাহত থাকছে।

অথচ যে কোন দেশের শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসন নিশ্চিত করার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো মিডিয়া বা গণমাধ্যম। একটি স্বাধীন, দায়িত্বশীল এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম জনগণ এবং নীতি নির্ধারকদের তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মতামত প্রদান করে থাকে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করে। তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলো হলো -প্রথমতঃ সরকার এবং এর কার্যাবলী সম্পর্কে সে সকল তথ্য প্রদান করে সেগুলো স্বচ্ছ কিংবা দায়িত্বশীল নয়। দ্বিতীয়তঃ পেশাগত সুযোগ সুবিধা এবং পর্যাপ্ত সম্পত্তির অভাবের কারণে মিডিয়াগুলো মানসম্মত, পেশাজীবী এবং উদ্দমী কর্মী পায় না। তাছাড়া স্বল্প বেতনের কারণে মিডিয়াগুলো দূর্নীতিগ্রস্থ এবং রাজনৈতিক ও ব্যবসা মূখী হয়ে উঠছে। তৃতীয়তঃ আভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং তাদের পেশাকে রাজনীতিকরণ করার ফলে মিডিয়াগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। মিডিয়াগুলো শাসন সংকটে ভূগছে কারণ বেশিরভাগ মিডিয়ার মালিক হলেন রাজনৈতিক দলের সদস্য। যারা মিডিয়াকে রাজনৈতিক এবং ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে যা শাসনকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।

মিডিয়া সাধারণত শাসনের (Governance ) সাথে সম্পর্কিত বিষয় যেমন সরকার এবং বিরাধী দলের নীতি, সংসদীয় কার্যক্রম, ব্যর্থতা, অর্জন ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচনামূলক তথ্য প্রদান করে থাকে। তবে মিডিয়ার কিছু সমস্যা আছে তা হলো এর জবাবদিহিতার তেমন কোন ব্যবস্তা নেই। তাছাড়া অনেক মিডিয়া নিজেরাই দূর্নীতিগ্রস্থ, পেশাদারিত্বের অভাব এবং দূর্বল ক্যাপাসিটি। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো সরকারের নীতি প্রনয়ণ, বাস্তবায়ন এবং এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে না, যদিও এটি সম্ভব হয় না কারণ সরকার যে সকল নীতি গ্রহণ করে তার অনেকটাই বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে না। আর তাই মিডিয়াগুলোর নীতি বিষয়ে আলোচনা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। শহরের শিক্ষিত সধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে মিডিয়া সহজলভ্য। কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে এই মিডিয়া তেমন একটা পৌঁছায়নি। তাই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মিডিয়ায় প্রচারিত তথ্য পায় না। বাংলাদেশের বাহিরে যারা থাকেন তারা স্যাটেলাইট TV এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে প্রবেশ করছে। মিডিয়া দূর্নীতির খবর এবং প্রভাব, রাজনৈতিক ঘটনা, নীতি নির্ধারণে বিতর্ক, নির্বাচন প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণGovernance, আইন শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ে খবর প্রদানের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে।

মিডিয়াগুলোর সম্পত্তির অভাব, টেকনিক্যাল জ্ঞানের অভাব, উপযুক্ত মানব সম্পদের অভাব, পেশাগত প্রশিক্ষণের অভাব, সীমিত সম্পদের কারণে কর্মীদের উপযুক্ত বেতন দিতে পারেনা। কিন্তু যদি মিডিয়াগুলো অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল না হয় তাহলে তারা স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে সংবাদ দিতে পারবে না এবং দূর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়বে। বেশিরভাগ মিডিয়াগুলোর মালিক হলো রাজনৈতিক দলের নেতারা। এই মিডিয়াগুলো স্ব স্ব রাজনৈতিক দলের খবর প্রচার করে। মিডিয়াগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যা, প্রাতিষ্ঠানিক দূর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, পেশাগত দক্ষতার অভাব, অনেক সাংবাদিক সংগঠন আছে যা রাজনৈতিক ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত, প্রেস কাউন্সিল আছে যার উদ্দেশ্য হলো প্রেসকে স্বাধীন ও নিরাপদ রাখা। কিন্তু সেই প্রেস কাউন্সিল রাজনৈতিক ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এই মিডিয়াগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে গিয়েছে মুনাফা অর্জন করা যার ফলে মিডিয়ার ভূমিকার সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বর্তমানে তাদের প্রায় ৪ হাজার প্রিন্ট কপি রয়েছে। এটি শেষ হলে নতুনভাবে আর কোনও সংস্করণ প্রকাশ করা হবে না। ১৭৬৮ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় সর্বপ্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ছাপানো সংস্করণ প্রকাশিত হয়। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস অথবা ‘আরব বসন্ত’ এর কথাই ধরুন। রাজনীতির পাঠ উল্টোপাল্টে ক্ষমতার মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছেন কয়েকজন ব্লগার! সরকার টিকে থাকতে পারেনি সেই কম্পনে। ধসে পড়েছে সিংহাসন।

আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক (বেতার ও টেলিভিশন) মিডিয়াগুলো নিজেদের গণমাধ্যম হিসেবে দাবি করলেও সত্যিকার অর্থে সেগুলোর কতোটুকু শুধু ‘মাধ্যম’ এবং কতোটুকু ‘গণ-মাধ্যম’ তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। একটি মিডিয়া বা মাধ্যম মানুষের কিছু বিষয় নিয়ে কথা বললেই সেটি গণমাধ্যম হয়ে যায় না। গণমাধ্যম হতে হলে মিডিয়ার সঙ্গে মানুষের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকতে হয়; জনমানুষের নিজস্বতা, স্থানীয় ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতি গণমাধ্যমের চরিত্রের মূল উপকরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়। পণ্যের চেয়ে মানুষকেই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে হয়। চাপিয়ে দেয়া দর্শন, পণ্য বা তথ্য প্রচার করে; নাগরিক সমাজের স্ট্যান্ডার্ডকে সারাদেশের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে বা অন্য সংস্কৃতিকে নিজ সংস্কৃতিতে জোরপূর্বক প্রবেশ ঘটিয়ে একটি মাধ্যম নিজেকে গণমাধ্যম বলে দাবি করতে পারে না-- যদিও আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে মূলত তাই দেখা যাচ্ছে। জনমানুষের মিথস্ক্রিয়া এবং মাধ্যমের যাবতীয় কাজকর্মে জনমানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো মিডিয়া নিজেকে গণমাধ্যম বলে দাবি করতে পারে না। ব্লগ এখন পর্যন্ত যে চরিত্র ধারণ করেছে, তাতে তার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে নিজেকে গণমাধ্যম হিসেবে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠা করার-- যেখানে সত্যিকার অর্থেই মানুষ নিজেদের বিষয় নিয়ে কথা বলবে। নিজের কথা অপরের মুখ দিয়ে বলানোর চেয়ে নিজের কথা বলবে নিজেই। নিজেদের চিন্তাভাবনা অন্যের সঙ্গে নিজেই শেয়ার করবে এবং পরস্পরের যুক্তিতর্কগুলো উঠে আসবে সরাসরি।

সত্যিকার গণতন্ত্র সচেষ্ট থাকে নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণ করতে, আর সরকারের ক্ষমতা কমিয়ে আনতে। মানুষ যেন জাতি, বর্ণ, ধর্ম, সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে বৈষম্যের শিকার না হয়, তার প্রাপ্যটুকু বঞ্চিত না হয়। সংবাদকর্মীরা এসবকিছু নজরে রাখে। সমাজে নীতি-নৈতিকতা, ন্যায্যতা নিশ্চিত করার অনেক বড় দায়িত্ব গণমাধ্যম আর সংবাদকর্মীরদের উপর।অনেকেই বলেন এদেশের গণমাধ্যম ইতিবাচক নয় কেন? কেন তারা মানুষের সাফল্য দেখে না, কেন তারা শুধু পত্রিকার পাতা জুড়ে কিংবা টিভি পর্দা জুড়ে নেতিবাচক খবরে পূর্ণ করে রাখে? আমাদের তো অনেক সাফল্য আছে। কথাটা অনেকাংশেই সত্য। প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে গণমাধ্যম শুধু খারাপ খবরই দিবে না, নিশ্চয় ভাল খবর, সাফল্যের খবরও প্রচার করবে। কোন বিষয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করাই সংবাদকর্মীর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়।

বিজ্ঞাপন দাতারা অনেক ক্ষেত্রেই গণমাধ্যমকে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধ্য করছে। অনেক সীমাবদ্ধতার পরও এদেশের গণমাধ্যম নাগরিক সচেতনতা তৈরীতে ভূমিকা রাখছে। এদেশে যেটুকু গণতন্ত্র এখনো অবশিষ্ট আছে, তা আছে গণমাধ্যমের জন্যই। যোগাযোগের কাল্টিভেশন তত্ব বলে –“The media tells us not what to think but what to think about”. জাতীয় উন্নয়নে কিংবা নীতি নির্ধারনে গণমাধ্যমের ভূমিকা নির্ভর করে তথ্যের মাধ্যমে মানুষকে শেখানো, উদ্বুদ্ধ করা ও সচেতন করায় সংবাদকর্মীদের দক্ষতার উপর। গণমাধ্যম সমাজ ও জাতির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরীতে ভূমিকা রাখে, যদি সে সমাজে বা রাষ্ট্রে তার জানার অধিকার নিশ্চিত হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার হলো আরেকটি বিষয় যা গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশিত। মিডিয়া মানে কোন ঘটনা বা বিষয় তুলে ধরবে, প্রকাশ বা প্রচার করবে, তা নয়, বরং সে ঘটনা বা বিষয়ের বিশ্লষণ দেবে যেন সমষ্টির কল্যাণে নীতি প্রণীত হয়। যেমনটা বলেছেন. আফ্রিকার উন্নয়ন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ Dr. Stanley Machebu. তার মেত the press "are subordinate to a far higher goal: the goal of ensuring that public and private conduct is directed towards the greatest possible measure of justice, in society".

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামীম রেজা বলেছেন, কোনো ঘটনা মানুষকে জানানোই গণমাধ্যমের কাজ। তবে বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম তাদের সেই ভূমিকা পালন করছে না। গণমাধ্যমগুলো কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের টেলিভিশন সরকারি প্রচার মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। তখন থেকেই মানুষের মনে ধারনা জন্মে যে, টেলিভিশন শুধু সরকারের পক্ষে কথা বলে। কিন্তু বর্তমানে অনেক বেসরকারি গণমাধ্যম তৈরি হয়েছে। গণমাধ্যম নিয়ে মানুষের ধারনা একটু হলেও পরিবর্তন হয়েছে। তবে এখনও গণমাধ্যম রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নয় তা বলা মুশকিল। কিছু গণমাধ্যম কাজ করছে সরকারের পক্ষে। মিডিয়া লিটারেসি তথা মিডিয়া সম্পর্কে সব ধরনের মানুষ যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছে কিনা এটা দেখার বিষয়। গণমাধ্যমে কথা বলার কারণে জনগণের কাছে যান না রাজনৈতিক নেতারা। নেতারা এখন টেলিভিশন নির্ভর হয়ে পড়ছেন। এতে নেতার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার বাড়লেও সামগ্রিকভাবে জনগণের উপর এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

আজ থেকে দুই শতাধিক বছর আগে, ঔপনিবেশিক শাসনামলে ১৭৮২ সালে সরকারবিরোধী সমালোচনার দায়ে এই উপমহাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয়, প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা Heckys Bengal Gezzete বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, কারাগারে প্রেরণ করা হয় ওই পত্রিকার প্রকাশক আইরিশ নাগরিক জেমস অগাস্টাস হিকিকে। বাজেয়াপ্ত করা হয় অনেক বই-পত্রিকা। এরপর বহুযুগ কেটে গেছে। ভারত বিভক্ত হয়েছে। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে কতটুকু পেয়েছি তা গণমাধ্যমের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বন্ধ হয় পত্রিকা। বন্ধ করা হয় টিভি চ্যানেল। বন্ধ করা হয় টকশো। দৃষ্টির বাইরে সরিয়ে নেয়া হয় ইউটিউব। ব্যবহার করা হয় নানা রকম সেন্সরশিপের টেকনিক।

২০১২-এর মানবাধিকার রিপোর্টগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই শুধু তিন বছরে সাংবাদিক হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে। আক্রমণের শিকার হয়েছে ১৮১ জন সাংবাদিক। নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে ২৩৮ জন সাংবাদিককে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মানবাধিকার রিপোর্ট বলছে- শুধু ২০১২তে মোট ৪৪২ জন সাংবাদিক নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। যেখানে ২০১১তে নিপীড়িত হয়েছে ৩০৬ জন সাংবাদিক অর্থাৎ সাংবাদিক নিপীড়নের পরিমাণ দিনের পর দিন বেড়ে গেছে। বহুল আলোচিত সাগর-রুনির হত্যার বিচার আজও হলো না। এই যখন গণমাধ্যমের চিত্র তখন শেষ খবর হলো কয়েকদিন আগে কয়েকটি টিভি চ্যানেলে ককটেল ফোটানো হয়েছে। একটি বেসরকারি টিভির একজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। গণমাধ্যম গণমানুষের কথা বলে.. কিন্তু গণমাধ্যম কর্মীদের কথা বলবে কে…..? বেতন বৈষম্যসহ নানা অনিয়ম আর মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কথা কে তুলে ধরবে..? আর তাতে গণমাধ্যম কর্মীদের চাকরির নিরাপত্তার দিকটাই বা কে দেখবে…? সরকার.. তথ্য মন্ত্রণালয় না গণমাধ্যম কর্মীদের সংগঠন…? যদিও গণমাধ্যম কর্মীদের নিজস্ব কোনো প্লাটফর্ম সেই অর্থে নেই, যারা নিজেরা এক হয়ে নিজেদের জন্য কাজ করবে।

মিডিয়া বিশেষ করে বৈদ্যুতিক গণমাধ্যম বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া সংস্কৃতির একটা নবাবী স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর, নাটক, গান, যাত্রা, ব্যান্ড, রকমারি বিজ্ঞাপন প্রতি মুহূর্তে আমাদের চেতনাকে আঘাত হানছে। বাংলাদেশের বহুজাতিক ও বড় পুঁজির কোম্পানিগুলোর মার্কেটিং কম্যুনিকেশন এবং দশাসই বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর ক্রিয়েটিভ হেডগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কলকাতার হিন্দি মগজধারী বাঙালি তরুণরা। মালিকদের মেয়ে-ছেলের সঙ্গে বিয়ে করে মোটামুটি তারা এখানে সেটেলড। সম্প্রতি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আশপাশে বেশ ক’দিন এদের লক্ষণীয় সমাগম দেখা গেছে।বাংলা ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় জানাচ্ছেন, গণযোগাযোগ বা mass communication-এর ছাত্র হিসেবে বিশ্বাস করি, গণমাধ্যম সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে না। অনুকূল পরিবেশ পেলে তা জনমানসে ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়। অবশ্য মার্শাল ম্যাকলুহানের মতো যোগাযোগবিদ এও বলে রেখেছেন, ‘মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ, মিডিয়াম ইজ দ্য ম্যাসাজ।’ অর্থাত্ গণমাধ্যম কি প্রকৃতির তার ওপরেই তার বার্তা প্রভাব ফেলে এবং মনকে মালিশ করে।

ফ্রান্সের অগ্রগণ্য সম্পাদক, সেরা পত্রিকা ‘ল্য মোন্দ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উব্যের দ্য ব্যোভ মেরি বলেছিলেন, সংবাদপত্র এমনই এক স্বপ্ন যা আমরা সমবেতভাবে দেখি দিনের পর দিন। অর্থাত্ মিডিয়ার রিপোর্টার, সাব এডিটর, এডিটর প্রতিটি খবর নির্মাণে, উপস্থাপনে এক ধরনের স্বপ্ন দেখেন এবং তাদের পরিবেশিত খবর পড়ে দেখে পাঠক-দর্শকও এক ধরনের স্বপ্নে ধরা পড়ে। কিন্তু মিডিয়ার কোন খবর কীভাবে পরিবেশিত হবে বা আদৌ দর্শক-পাঠকের কাছে যাবে কিনা, নির্ধারণ করেন সম্পাদক বা বার্তা প্রধান। পুলিশের ওপর আক্রমণ চলছে শুধু এ খবরই যাবে, পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহতদের বৃত্তান্ত যাবে না—সেটা বার্তা নিয়ন্ত্রকেরা সিদ্ধান্ত নেন। এই জানানো এবং না জানানোর টানাপড়েনে বা গোধূলি অঞ্চলে (grey area) জন্ম নেয় অর্ধসত্য। দর্শক জিজ্ঞেস করতে পারেন, শুধু রবীন্দ্রনাথের নাটক দেখানো হচ্ছে, নজরুলের নাটক কই? ধর্মশিক্ষা বা কোরআনের তাফসিরের অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি দর্শক থাকলেও তাদের জন্য সময় কম বরাদ্দ করা হয় কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর মিডিয়া মালিক বা হেড অব প্রোগ্রামাররাই দিতে পারবেন।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম আজও ‘ন্যাশনাল মিডিয়া’ হতে পারল না। বিএসএফ বাংলাদেশে অহরহ গুলি করে মানুষ মারছে, কিন্তু আমাদের কাগজে আমরা ভারতীয়দের অভিযোগমূলক বক্তব্য ছাপি। বাংলাদেশের বক্তব্য কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া কস্মিনকালেও প্রচার করে না। বিএসএফ গুলি করলে আমরা শিরোনাম করি, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে আমাদের লোকজন নাকি পালিয়ে গেছে। এটা জাতীয় মনস্তত্ত্বকে কতখানি দুর্বল করে ভেবে দেখেছেন? ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের ঘরে ঘরে জনপ্রিয়। অথচ ভারত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোকে সেখানে দেখাতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশের পত্রিকা, বই ভারতে ঢুকতে পারে না। অবৈধভাবে বাংলাদেশে টাটা ডিশ বিক্রি হচ্ছে যার মাধ্যমে কেবল অপারেটর ছাড়াই ভারতীয় চ্যানেলগুলো সরাসরি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে ভারতীয় ছবি দেখানো এবং ভারতীয় বিনিয়োগে ২শ’ সিনেমা হল বানানোর প্রস্তাব হাসিনা সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায়। হিন্দি ছবির এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে যে, অভিনব হত্যা, চাঁদাবাজির মিডিয়া প্রতিবেদনে আকছার বলা হয়, হিন্দি ফিল্মের স্টাইলে দুর্বৃত্তরা এই অপরাধটি ঘটিয়ে গেছে।

ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলোর দৌলতে আমাদের অভিজাত শ্রেণীর পোশাক-আশাক, বিয়ে অনুষ্ঠান ইত্যাদির অনুকরণ তো রমরমা। বিয়ের চেয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানই বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হচ্ছে। ভারতীয় পাঞ্জাবির সঙ্গে উত্তরীয় পরা—এসব তো আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল না। এক সময় বিটিভি’র সিদ্ধান্ত ছিল, দেশীয় মডেল অভিনীত না হলে বিজ্ঞাপন চিত্র ছাড়পত্র পাবে না। তা আর এখন নেই। দেশীয় মডেলদের বদলে ইন্ডিয়ান মডেল ব্যবহার এবং পুরো বিজ্ঞাপনটা ভারত থেকে বানিয়ে আনা হচ্ছে। যুক্তি, খরচ কম। বিশ্বায়নের কারণে আরেক বিপদ হলো আন্তর্জাতিক বা ভারতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের গণমাধ্যমে হুবহু প্রচারিত হচ্ছে। শুধু বাংলায় ডাবিং করে। ফলে স্থানীয় শিল্পী, ডিজাইনারদের করণীয় কিছু নেই। এ নিয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট অধিকর্তাদের মাথা ব্যথা নেই। আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু যারা এক সময় মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির দূত ছিলেন, তাদের বিজ্ঞাপনী ব্যবসার মাধ্যমে এখন ভিন সংস্কৃতি ঢুকছে।

গ্রামীণ ফোন একবার ‘ডিজিটাল জুস’ অর্থাত্ ‘ডিজুস জেনারেশন’ বানানোর অপচেষ্টায় সারাদেশে তরুণ-তরুণীদের অবাধ উদ্দামতার ছবি ও আহ্বানে ভরা বিলবোর্ড ছড়িয়ে দিল। আমাদের সাংস্কৃতিক ধাঁচের পরিপন্থী। অবশ্য গণআপত্তিতে সরকার সেটি বন্ধ করতে বাধ্য হলো। আরেকবার ‘আলো চাই’ গোছের এক বিজ্ঞাপন চিত্র দেখানো হলো, একঘরে সামান্য আলোতে ছেলেরা কোরআন শরিফ পড়ছে। হঠাত্ বাইরে আলোর ছটা দেখে তারা কোরআন পড়া ছেড়ে বাইরে দৌড় দিল। পবিত্র কোরআনের আলোর চেয়ে বড় আলো কি আছে? আপত্তির মুখে তাও গ্রামীণ ফোন স্থগিত করল। এখন বাংলা লিংকের এক ‘সহি মোবাইল-নামা’ বিজ্ঞাপন চিত্র প্রচার হচ্ছে বাংলাদেশে, যা সহি আমলনামার প্রতি ব্যাঙ্গাত্মক। ঢাকায় কোনো এক ক্রিকেটের আসর উপলক্ষে বানানো বিজ্ঞাপন চিত্রে দেখানো হলো, জাতীয় সঙ্গীতের সময় বাংলাদেশের মানুষেরা খ্রিস্টানদের মতো বুকে ডান হাত উঁচিয়ে রেখেছে। অথচ আমরা দু’হাত লম্বা করে নিচে রেখে সটান দাঁড়াই যখন জাতীয় সঙ্গীত বাজে। তারপর বিজ্ঞাপনে ‘ধামাকা’র মতো অহরহ হিন্দি শব্দ জুড়ে দেয়া হচ্ছে।

মফিদুল হক এক প্রবন্ধে (সম্প্রচারের পরিবর্তমান ভাষা : বাংলাদেশ) বলছেন, বাংলাদেশে গ্রামীণ ফোন প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল গ্রামীণ নারীর সঙ্গে বাইরে যোগাযোগ ঘটাবার, তার স্বনির্ভরতা অর্জনের অবলম্বনের প্রতীক হিসাবে বিজ্ঞাপনেও ছিল সেই আমেজ। ক্রমে বিজ্ঞাপনের গ্রামীণ আবহ কমে আসতে লাগল, আধুনিক যুবা ও আধুনিক তরুণীর হাতে গ্রামীণ ফোনের শোভা প্রকাশ পেতে লাগল। এরপর দশ লাখ গ্রাহক সংখ্যা অর্জনের পর গ্রামীণ ফোন তার বিজ্ঞাপন নীতিতে বড় রকম বদল আনল। কেননা বাজার জরিপ করে তারা বুঝে গেছে, আগামী দিনের সম্ভাব্য ব্যবহারকারী হচ্ছে শহুরে উঠতি বয়সী ছেলে-ছোকরার দল। তাদের মুখের ভাষা, অর্থাত্ বাংলা-ইংরেজি বোলচাল এখন গ্রামীণ ফোনের বিজ্ঞাপনের নিত্যকার ভাষা হয়ে উঠেছে। তাদের জন্য চলছে ‘এক্সট্রা খাতির’, বের হয়েছে ‘ডিজুস’ নামে অদ্ভুত শব্দ। আওয়াজে শ্রুতিময় হলেই হলো, অর্থ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবার নেই। এর সঙ্গে আবার মাঝে-মধ্যে ফোঁড়া হিসেবে যোগ হচ্ছে মাতৃপ্রেম, দেশপ্রেম ইত্যাদি উচ্চভাবের বাণিজ্যিক ব্যবহার।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সবসময়ই আলোচনার বিষয়৷ নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে এখনো বাধা রয়েছে৷ এই সীমাবদ্ধতার কারণে শক্তিশালী হয়ে উঠছে বিকল্প ‘সোশ্যাল মিডিয়া’৷ মিশর, লিবিয়া, টিউনিশিয়ার মতো দেশগুলোর গণমাধ্যম ঠিক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতো না৷ এসব দেশের সাধারণ মানুষ হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিল ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব’কে৷ এসব সোশ্যাল মিডিয়া আরব বিশ্বের সাধারণ মানুষকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ করে দিল৷ ইন্টারনেটে যে স্বাধীনতা তারা পেয়েছে, সেটির প্রতিফলন ঘটেছে রাজপথে৷ হোসনি মুবারক, বেন আলী কিংবা গাদ্দাফিরা আজ আর ক্ষমতায় নেই৷ পতন ঘটেছে স্বৈরতন্ত্রের, এখন গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে মিশর, টিউনিশিয়া এবং লিবিয়ায়৷

বর্তমানে মিডিয়ায় নারীদেরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা কিছুতেই তাদের মর্যাদা ও শালীনতার জন্য সহায়ক নয়। নারীকে খোলামেলা করে উপস্থাপনের অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মোহনীয় ভঙ্গির নারীদেহ বর্তমান মিডিয়ার প্রধান উপজীব্য। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া কোনোটিই। পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের পাতাগুলো নারীদেহের অবাধ প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। স্টলগুলোতে ঝুলতে থাকা পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের দিকে নির্দিধায় তাকানো যায় না। বিনোদনের পাতা জুড়ে প্রায়ই নায়ক-নায়িকাদের যে ছবি ছাপা হয় তাতে সুস্থ রুচির মানুষেরা ঘরে রেখে পত্রিকা পড়ার সাহস হারিয়ে ফেলছেন। যে অনুষ্ঠানে নারীদেরকে যত খোলামেলা উপস্থাপন করা যাবে সে অনুষ্ঠান তত জনপ্রিয়তা পাবে। মিডিয়া জগতে প্রতিভা অন্মেষণের নামে নারীদেরকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের নতুন খেলা শুরু হয়েছে। অমুক দীপের নায়িকা খুঁজছি, অমুক পেস্টের তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ, অমুক সাবানের ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতা, অমুক চ্যানেলের গানরাজ অন্বেষণ, গাও বাংলাদেশ গাও ইত্যাদি আকর্ষণীয় নামে তরুণদের সঙ্গে তরুণীদেরকেও ব্যাপকভাবে উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে বিনোদনের দিকে। চিত্রজগত, গ্লামার ও শোবিজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণীরা আগপিছ না ভেবে উপছে পড়ছে এসব কর্মসূচীতে। লাজুকতা ও শালীনতার জন্য বিখ্যাত বাংলাদেশের মফস্বলের তরুণীরাও এখন তাদের অস্তিত্ত্ব , অবয়ব ও সৌন্দর্য নিয়ে হাটতে বসতে কুন্ঠিত হচ্ছে না।

সামান্য ব্লেডের বিজ্ঞাপনেও রূপসী নারীর খোলামেলা প্রদর্শনী করা হয়। যে যত মোহনীয় ভঙ্গিমায় নারী দেহের প্রদর্শনী করতে পারবে তার বিজ্ঞাপন তত সার্থক। বিজ্ঞাপনের এই প্রতিযোগিতা শুধু মিডিয়াতেই থেমে থাকেনি। বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার, লিফলেট, বিলবোর্ড ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। আবেদনময়ী, রূপবতী নারীর খোলামেলা দেহ শোভা পাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, মাথার উপরে, চোখের সামনে নারীর দেহ, অনুভূতি ও আচরণ তুলে ধরা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ভাষার অশ্লীলতার গণ্ডি অনেক ক্ষেত্রে অতিক্রম করেছে। মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনে নারীকে নগ্নভাবে উপস্থাপনের ফলে বহু যুবক নারীদেহের বিচিত্র রূপ ও বিবিধ আহবান গভীরভাবে রেখাপাত করছে। মূলত এ কারণেই সমাজে হত্যা, সন্ত্র্রাস, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, নেশাগ্রস্ততা, নারীদেরকে উত্তক্তকরণ ইত্যাদি সামাজিক অপকর্মসমূহ উত্তেজনকভাবে বেড়ে চলেছে।

মিডিয়ার সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু সেই হারে বাড়ছে না এই মাধ্যমের জন্য দক্ষজন শক্তি। তাহলে চলছে কিভাবে? চলছে আমার টাকা আছে তাই চলে এবং কি আমি চালাই বলেই চলে। নতুন গুলো এসেই মোটা অংকের বেতনে মাধ্যমে কিনে নেয় পুরো মিডিয়ার কর্মীদের। পুরোনো গুলোর মান কমতে থাকে। তাই বলে কিন্তু নতুন গুলোর মান বাড়ে না। কেননা ১০ জনের কাজ তো আর একজনকে দিয়ে হয় না। এভাবেই নতুন পুরাতন সবার মান কমে যাচ্ছে। তাহলে উপায়। বড় বড় কোম্পানী যখন নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য বানিয়ে ফেলছে মিডিয়া তখন সেই মিডিয়া দিয়ে আমি আমজনতার কিইবা হবে। এতো আমার আপনার কথা না বলে তার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। বতর্মান যুগ তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগ। তথ্যের অবাধ প্রবাহ আছে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই প্রবাহ কে তৈরি করছে এবং কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। পশ্চিমারা যেমন সারা বিশ্বের তথ্য ছেঁকে পরে প্রকাশ করে, প্রয়োজনে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের পক্ষে প্রচারণা চালায়। যেমনটা আমরা ইরাক, আফগানিস্তানে দেখেছি।ঠিক তেমনি করে আমাদের মতো রাষ্ট্রে এই কাজ করে সরকার, সরকারের স্বার্থ না থাকলে তো কথাই নেই। ছাপাও কোন সমস্যা নেই। তোমার স্বাধীনতা দেয়াই তো আমার কাজ। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যদি নিজেই তার স্বার্থ রক্ষার জন্য জনগণকে সঠিক তথ্য না দেয় তাহলে সাধারণের অবস্থা কি?

নাগরিকদের অসম্মান করাটা মিডিয়ার কাজ না! কোনো পত্রিকাই কোনো নাগরিককে অসম্মানিত করতে পারে না। সে এখতিয়ার পত্রিকাদের নাই। বিচারকদেরও না। কোনো নাগরিক যে সাজাই পান বা না পান, তার যে পেশা বা আকাম-কুকামই থাকুক না কেন, সমাজের চোখে তার অবস্থান যাই হউক না কেন কোনো মিডিয়া, এমনকি কোনো বিচারকও–কোনো সাজাপ্রাপ্ত নাগরিককেও–অসম্মানিত করতে পারেন না। কারও অপরাধের শাস্তি তাকে অসম্মান করা নয়। বিভিন্ন ব্যক্তির মানহানি ও চরিত্রহননের কালেও মিডিয়া সম্বোধনের বেলায় সম্মান রাখতে বাধ্য।

স্বাধীনতা পরবর্তি তৈরি করা নতুন আইনের আওতায় জেলা প্রশাসন যে কোন অজুহাতে ডিক্লারেশন বাতিল করে দিতে পারতেন। সেই থেকে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সাংবাদিকদের লড়াই। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের এক পর্যায়ে ১৯৯০ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সাংবাদিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোগ নেয়া হয় আইনটি পরিবর্তনের। এজন্য তিনি একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন আইনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিমিত্তে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে মিডিয়ার স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গতিহীন ধারাগুলো বাতিল করে দেন। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার অধ্যাদেশটি জাতীয় সংসদে অনুমোদন করে। এতে জেলা প্রশাসন হারায় মিডিয়া বন্ধের এখতিয়ার। সরকার হারায় আইনি নিয়ন্ত্রণ। এরপরই মূলত বাংলাদেশে মিডিয়া প্রকাশে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সাংবাদিক নেতাদের কেউ রাষ্ট্রীয় পদ-পদবীর লোভে, কেউ সরকারি সুযোগ সুবিধার লোভে, কেউ দলীয় মতাদর্শের অন্ধত্ব থেকেই মূলত মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সহযোগিতা করছেন।

আমাদের দেশে যত গুলো গণমাধ্যম আছে তাঁর মধ্যে এফ এম রেডিও অন্যতম। বর্তমানে আমাদের দেশে একাধিক রেডিও ষ্টেশন আছে। রেডিও ষ্টেশন গুলোতে নানা রকম লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বলতে গেলে এই ধরনের অনুষ্ঠান গুলোতে সাধারন মানুষের আগ্রহ বেশি। এই অনুষ্ঠান গুলোতে অংশগ্রহণ করতে আসা আক্রান্ত ছেলে বা মেয়ে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ব্যাক্তিগত কিছু ঘটনা শেয়ার করে। এই আক্রান্ত ব্যাক্তি দের সাথে আবার দর্শকরা সরাসরি কথা বলতেও পারে, তাদের মতামত প্রকাশ করতেও পারে। এই অনুষ্ঠান গুলোতে যারা তাদের ব্যাক্তিগত ঘটনাবলি শেয়ার করে তাদের বেশির ভাগই আবেগের তাড়নায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জীবনের ঘটনা গুলো বলে। ছোট-বড়,শিশু-কিশোর, তরুন-তরুণী এমনকি বয়স্ক লোকেরাও এর শ্রোতা। তাই এই ঘটনা গুলো প্রায় অনেক মানুষই জানতে পারে। এতে করে আক্রান্ত ছেলে বা মেয়ে বিশেষ করে মেয়েদের কোন লাভ তো হয়ই না বরং তাদের আরও ক্ষতি হয়। তারা আবেগের তাড়নাই খোলাখুলি ভাবে অনেক গোপন বিষয় শেয়ার করে ফেলে এবং তা সব শ্রোতা তা সরাসরি শোনে। সেজন্য মেয়েটির প্রতি বেশির ভাগ শ্রোতারই নেতিবাচক ধ্যন ধারণা সৃষ্টি হয়।

ড্যানিয়েল লার্নার বলেন, ‘গণমাধ্যমে তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে মানসিক গতিশীলতা বাড়ায়। এই মনস্তাত্বিক গতিশীলতা উন্নয়নের আবশ্যক উপাদান। এ কারণে গণমাধ্যমকে বলা হয়েছে মবিলিটি মাল্টিপ্লায়ার, এমনকি ম্যাজিক মাল্টিপ্লায়ার’। জাতীয় উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে উইলবার শ্র্যাম তাঁর Mass Media and National Development গ্রন্থে উন্নয়নে গণমাধ্যমের সহায়ক ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। এই গ্রন্থে তিনি পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, নীতি নির্ধারণ এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের কার্যকারিতার ওপরে বিশেষভাবে আলোকপাত করেছেন। অবাধ তথ্যপ্রবাহ উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে উল্লেখ করে উইলবার শ্র্যাম বলেন, The amount of information available and the wideness of its distribution is thus a key factor in the speed and smoothness of development| ড. শ্র্যাম বলেন, গণ-যোগাযোগের সঙ্গে আন্তঃ-বাহ্যিক যোগাযোগ যুক্ত হয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক বিল্পব অর্থাৎ বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে আমরা একথা বলছি না যে, কেবলমাত্র গণযোগাযোগের মাধ্যমে এ কাজ করা সম্ভব।

ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তথা রেডিও টিভি চলচ্চিত্রের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমের কথা চিন্তা করে উন্নয়ন যোগাযোগের ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিলো। ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের দ্বারা সার্থক যোগাযোগ বার্তা প্রচারের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক অতীত থেকেই কিছু ইতিবাচক উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন জনস্বার্থে প্রচারিত বিভিন্ন টিভিস্পট বিজ্ঞাপন, জিঙ্গেল, নাটিকা, জীবন্তিকা, কার্টুনসহ বিভিন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এর পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়া যেমন সংবাদপত্র, জার্নাল, বুলেটিন, সহজ ভাষায় লেখা নানা ধরণের বই, সচিত্র পুস্তিকা, ফোল্ডার, পোস্টার, কার্ড, লিফলেট, স্টিকার, ফ্লিপচার্ট ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিতদের সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কাজে এমনকি এখন বাস, সিএনজি অটোরিক্সা বা রিক্সার গায়ে কিংবা বিলবোর্ডে সাল্যাইন, এইডস, ধূমপান ইত্যাদির বিরুদ্ধে সচেতনামূলক স্লোগান দেখা যাচ্ছে। জীবন্ত বা লাইভ মিডিয়া যেমন পথনাটক, গান, যাত্রা পালাও যুক্ত হচ্ছে এ কাজে। এছাড়াও দেশের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন লোক-সংস্কৃতির উপাদানগুলো যেমন পটচিত্র, গম্ভীরা, পুতুল, নাচ, জারি-সারি, বাউল গান, কবিগান ইত্যাদি উন্নয়ন যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর বলে বিবেচিত হচ্ছে। এসব জনপ্রিয় লোকজ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সাধারণ দর্শক শ্রোতার কাছে উন্নয়ন বার্তা সহজেই পৌঁছে দেয়া যায়।

গণমাধ্যমের কল্যাণে মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে অবগত হচ্ছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে গোটা বিশ্ব ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এ পরিণত হয়েছে। মানুষ ঘরে বসে কম্পিউটারের বোতাম টিপে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেন হচ্ছে ঘরের মধ্যে অথবা অফিসের টেবিলে বসে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, অর্ডার গ্রহণ সর্বোপরি উৎপাদন-পুনরুৎপাদন হচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব এখন গণমাধ্যমের কল্যাণে ধনতন্ত্রের বাজারে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর ফলে কল্যাণ-অকল্যাণ দু’টি দিকই বিশ্ববাজারে কার্যকর হয়েছে।

সংবাদপত্র যে প্রকৃত পক্ষে 'ফোর্থ স্টেট' এ ধারণাটিও মূলত শতাব্দী পুরোনো। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্যালারিতে উপস্থিত সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের লক্ষ্য করে রাষ্ট্র কাঠামোতে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বুঝাতে এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন, তারা এই রাষ্ট্রের 'ফোর্থ স্টেট'।চলমান জীবনে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। সংবাদপত্র পৃথিবীকে মানুষের মুঠোর মধ্যে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতা-স্বার্বভেীমত্ব, জাতীয় স্বার্থ, মানবাধিকার উন্নয়নে ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে,গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করণে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের ভুমিকা সবচেয়ে বেশী। সংবাদপত্রের গুরুত্ব সম্পকে আমেরিকার দু'বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেফার এক সাংবাদিককে লিখেছিলেন যে, তাঁকে যদি সংবাদপত্রহীন সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্র বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রের জগত্ই বেছে নেবেন। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি বলেন, 'সংবাদপত্র যেখানে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে এবং জনসাধারণ যেখানে পড়তে জানে সেখানে সবকিছুই নিরাপদ।'

‘সাংবাদিকতা‘ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সম্মানজনক পেশা। সেজন্যই সাংবাদিকদের সমাজের অতন্দ্র প্রহরী বা ‘গেট কীপারস‘ বলা হয়। সাংবাদিক সমাজ জাতির বিবেক হিসেবে চিহ্নিত; যারা রাষ্ট্র,সমাজ ও মানুষকে নিরলসভাবে সেবা দেয়। “Were it left to me to decide whether we should have a government without newspapers or newspapers without a government, I should not hesitate for a moment to prefer the latter. ” টমাস জেফারসন আক্ষরিক অর্থে এই কথাটি বলেননি। কিন্তু একটি দেশে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও ভূমিকা বোঝাতে তার এই উক্তিটি প্রাতঃস্মরণীয় বলে বিবেচিত হয়। জেফারসন দু’শ বছর আগে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে সরকারের ওপর স্থান দিয়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন,'পত্রিকার দিন শেষ৷ কাগজ বিক্রির হিসাব কমছে৷ হালফিলের কাগজগুলো টিমটিম করে টিকে আছে৷ কিন্তু পড়তি কারখানার মতো এই টিকে থাকার সঙ্গে কখনওই স্বর্ণযুগের সংবাদপত্রের দাপটকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না৷' সংবাদপত্রে মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে ইন্টানেটের রমরমাকেই দায়ী করেছেন ওবামা৷ কিন্তু সিনেমার জন্মের পরও তো সমানভাবেই ছিল বইয়ের আকর্ষণ? মানুষ তো ভুলে যায়নি বই পড়তে? তবে কেন ইন্টারনেট কেড়ে নেবে সংবাদপত্রের গুরুত্ব? ওবামার ছোটো-হাসি জবাব, 'কারণটা সহজ৷ ব্যবসা৷ তার মন্তব্য, 'দেখুন, মধ্যবিত্তের সুখের দিন গিয়েছে৷ রোদে পিঠ দিয়ে বসে খবরকাগজ পড়াটা এখন বিলাসিতা৷' আমেরিকার একের পর এক সংবাদপত্র দপ্তরগুলির দরজায় তালা ঝুলছে৷

আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রকাশনা 'ওয়াশিংটন পোস্ট'-এর উপর গ্রাহাম পরিবারের ৮০ বছরের আধিপত্য শেষের পথে। ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে এই সংবাদপত্রের মালিকানা হাতে নিতে চলেছেন 'আমাজন ডট কম'-এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ বিজো। ইন্টারনেট রিটেল ব্যবসায় সফল জেফ জানিয়েছেন, এই বহুল প্রচলিত প্রকাশনাটির 'সাংবাদিকতার ঐতিহ্য' আগের মতই বজায় থাকবে। মিডিয়ার দুনিয়ায় সাম্প্রতিক ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাণ বজায় রাখা ও পাঠককে ধরে রাখা জেফের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ভারতে তিন শতাধিক চ্যানেল আছে। অথচ সেই ভারতে সংবাদপত্রের পাঠকসংখ্যা হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৮ সালের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত বছর ভারতে সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ১১ ভাগ। অথচ আমাদের দেশে এ সংখ্যা বাড়ছে না। রেডিও সংবাদ, টেলিভিশনের সংবাদ, আর পত্রিকার সংবাদের স্বাদ ভিন্ন। অধুনা তিনটি মাধ্যম তিন রূপে হাজির হয়েছে। এ তিন মাধ্যমের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে না তা নয়, তবে তার চেয়ে বেশি সমন্বয় হচ্ছে। রেডিও-টেলিভিশন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর প্রচার করছে। অপরদিকে সংবাদপত্রের বুকে স্থান পেয়েছে রেডিও-টেলিভিশনের প্রকাশিত সংবাদ, অনুষ্ঠানসূচি ইত্যাদি।

অনলাইনের প্রবল আধিপত্যের মুখে পশ্চিমা দুনিয়ায় সংবাদপত্র সংকটের মুখে পড়েছে। একদা মার্কিন পত্রিকা নিউজ উইক ৮০ বছর দাপটের সঙ্গে চলেছে, এখন তার মুদ্রণ মাধ্যম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। নিউজ উইক বলতে এখন কেবল অনলাইন ভার্সনই বোঝাবে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন-সংবাদের কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং আরও খোলামেলাভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সংবাদের শিরোনাম, সংবাদের বিজ্ঞাপন-বিরতি, খেলার সংবাদ, বাণিজ্য-সংবাদ ইত্যাদি নানা স্লট একেকটি কোম্পানির সৌজন্যে প্রচারিত হয়। এভাবে দেখা যাবে, সংবাদের কোনো অংশই আর টেলিভিশনের নিজের নয়, অন্যের সৌজন্যে সেসব প্রচারিত হচ্ছে। বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো যেমন বিজ্ঞাপন প্রদানের মাধ্যমে পত্রিকার ব্যবসায় সহায়তা করে, তেমনি পত্রিকাও তাদের একেবারে সংবাদমূল্যহীন কর্মকাণ্ডকে পত্রিকায় ছেপে দায়বদ্ধতা পূরণের কাজটি করে থাকে। যেমন: জন প্লেয়ারের সমুদ্রসফর অবলীলায় সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠায় রঙীন ছবিসহ স্থান করে নেয়। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে দায়বদ্ধতার কারণেই লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ফেয়ার এন্ড লাভলি বেনসন এন্ড হেজেস স্টার সার্চ, নেসক্যাফে সঙ্গীত সন্ধ্যা, পেপসি কনসার্ট ইত্যাকার বিষয়গুলো যেকোনো পৃষ্ঠায় সবচেয়ে বড়ো সংবাদ আকারে ছাপা হয়ে থাকে।

সেলিম রেজা নিউটন বাংলাদেশের মূলধারার কর্পোরেট মিডিয়ার সাংবাদকিতার ৫টি ‘কর্মসূচি’র কথা উল্লেখ করেছেন।এই কর্মসূচিগুলো হলো:১. নিজ নিজ বিজনেস-গ্রুপের পুঁজি-মুনাফা-ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা;২. সাধারণভাবে বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরের বা ব্যবসায়িক খাতের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করা;৩. দেশী-বিদেশী কর্পোরেট পুঁজির অনুকূল সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ গঠন করা, তথা মার্কিন কায়দায় পুরোপুরি একটা ‘ভোগবাদী সমাজ’ গঠন করা;৪. ব্যবসার অনুকূল রাজনৈতিক ‘স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করা অর্থাৎ পশ্চিমা ঢঙের দ্বি-দলীয় ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে চালু করার চেষ্টা করা, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তির বাইরে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণ করা; এবং৫. আমাদের দেশে শক্তিশালী বুর্জোয়া শ্রেণীর ঐতিহাসিক অনুপস্থিতিতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-বেসরকারী পরিসরের এলিটদের নিয়ে রাজনীতিবিদগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের পাল্টা সামাজিক শক্তি হিসাবে ব্যবসায়ীদের পরিচালনাধীন একটা ‘সুশীল সমাজ’ গঠন করা এবং তার নেতৃত্ব ঐ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসাবে সংবাদপত্রের বা মিডিয়ার হাতে রাখা।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাফল্য-সম্ভাবনা ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা দরকার। তৃণমূলের খবরা খবর ওঠে না আসলে তাতে পরিপূণতা পায়না। দেশ জাতি এবং সমাজের কল্যাণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতপূর্বক পত্রিকার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে একদিন তা বৃহত্তর মডেল হয়ে উঠতে পারে।পাঠক সংবাদপত্রে আশার আলো দেখতে চায়, চায় ভরসা। তাই সেই ভরসা, আশার আলো যারা দেখাচ্ছে পাঠকরা তাদের প্রত্যাখ্যান করে নি। তাদের পাঠকপ্রিয়তা বাড়ছে।জ্ঞানী ও গুণীজনেরা সংবাদপত্রে এলে সমাজ পরিবর্তন হয়। অন্যায়, দুর্নীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সাংবাদিকদের। লেখনীর মাধ্যমে দেশের ভেতরের সব অন্যায়, অপকর্ম, কুকর্মের বিরুদ্ধে লেখা আমাদের কাজ। সকল বিবেচনায় সংবাদপত্র এখনো সমাজের দর্পণ। সংবাদপত্র জাতিকে জাগাতে পারে, দুঃসময়ে সাথি হতে পারে। তরুণ-যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করাই হওয়া উচিত গণমাধ্যমের কাজ। শুধু নেতিবাচক সংবাদ জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে না। নিরপেক্ষ, সঠিক ও দ্রুত সংবাদ পরিবেশন করলে খুব অল্প সময়ে কোন পত্রিকা ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা লাভ করতে পারে। একজ়ন দক্ষ ও বিচক্ষন সাংবাদিক তার দেশ ও জাতিকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারেন। দেশ ও জাতিরও উচিত এদেরকে সঠিক মূল্যায়ন করা ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড• দিলারা চৌধুরী বলেছেন, অনেক গণমাধ্যম ও মিডিয়া কর্মী আমাদেরকে বলেন- আওয়ামী লীগ গণমাধ্যম ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। এজন্য তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে। কারণ এই সরকারের কোনো জবাবদিহীতা নেই। অবাধে যেকোন আইন এই সরকার পাশ করতে পারে।বাংলাদেশের প্রধান ও সম্মুখ মিডিয়াগুলোতে কেমন “নিরপেক্ষ” সংবাদ-কলাম প্রকাশিত হয়ে থাকে তা জানেন না এমন মানুষ এখন কমই আছে। কোনটা আওয়ামীপন্থী, কোনটা জামাতপন্থী, অথবা বিএনপিপন্থী, নয় সুশীলপন্থী। বামপন্থীদের প্রকাশিত কাগজ কখনই সেভাবে জনপ্রিয় হয় নি। জনগন জানার জন্য অনেক সময়ই প্রায় বাধ্য হয়ে আবার অনেক সময় অভ্যাসের বসে, মাঝে মাঝে প্রকৃত রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবে কিনে যায় কালেরকন্ঠ, প্রথমআলো, নয়াদিগন্ত, আমারদেশ, যুগান্তর এর মত সংবাদপত্র। ফলত প্রকৃত সংবাদ আর মত প্রকাশের মাধ্যমের অভাব মনেই হয় এই সংবাদ মাধ্যমগুলোর হাউস পলিসির কারণে।

বাংলাদেশে পত্রিকা অসংখ্য। কেবল ঢাকাতেই সাড়ে ৩শ’র বেশি। বাংলাদেশে এখন একটি কাগজও সংবাদ নিরপেক্ষ নয়। প্রত্যেক কাগজই নিজের স্বার্থ ও দৃষ্টিকোন থেকে সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। কাগজ পড়েই পাঠক বলে দিতে পারে পাঠক কাগজটা কোন পথে চলছে। এখনতো সাংবাদিকের নাম শুনেই পাঠক বলে দেয় তিনি কোন পথের পথিক। সংবাদপত্রের মূল দায়িত্ব ও কতব্য হলো, দেশ জাতির বৃহত্তর স্বাথে কথা বলা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মূখপত্র হিসাবে কাজ করা। সংবাদপত্রের এমন একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হওয়া আবশ্যক যা কারো ক্ষতির কারণ হবে না বরং মানুষের কল্যাণে তা নিবেদিত হবে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সমতাভিত্তিক সমাজ নিমাণের জন্য সংবাদপত্র কাজ করতে পারে। বস্তুনিষ্ঠ, সুষ্ঠু এবং সত্য সংবাদ প্রকাশ করে সমাজ, রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করবে সংবাদপত্র। সংবাদপত্রের দায়িত্ব অনেক। দুর্নীতিকে না, মাদককে না, ধুমপানকে না বলতে সংবাদপত্র বলিষ্ট ভুমিকা রাখতে পারে। সমাজে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করার দরকার সংবাদপত্র তা করতে পারে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৫৩

অন্ধবিন্দু বলেছেন:
আপনার ধৈর্য আছে মশাই। পুরোটা লেখাই পড়লাম। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাখানা বাঁধবে কে ! আমারাতো সব দৌড়াচ্ছি ...

২| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৫৩

লেখোয়াড় বলেছেন:
আপনার লেখাটি অনেক বড়, কিন্তু অনেক ভাল লেখা মনে হচ্ছে।
তাই এখন না পড়ে সাথে করে নিয়ে গেলাম। পরে মানে রাত্রে পড়তে হবে।

একটু সময় দিবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.