নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও পরিবেশ সুরক্ষায় বৃক্ষরোপণ

২৬ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১০:৪৪

বরেণ্য সাহিত্যিক আহমদ ছফা লিখেছেন, “এই পুষ্প, এই বৃক্ষ, তরুলতা, এই বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, আমার মধ্যে কোনো একাকীত্ব কোনো বিচ্ছিন্নতা আমি অনুভব করতে পারিনে...” ব্যক্তির শুধু নয়, গাছের প্রাণ মানে দেশের প্রাণ। গাছের অস্তিত্ব মানে প্রাণের অস্তিত্ব, প্রাণীর অস্তিত্ব। যে অঞ্চলে যত গাছপালা, সেই অঞ্চল তত বেশি প্রাণবন্ত। গাছ ধৈর্যের প্রতীক, ধীরস্থির সাধনার প্রতীক, জীবনের সার্থকতার প্রতীক। শান্তি, সহিষ্ণুতা আর প্রশান্তির যে নিরব অভিব্যক্তি তা মানুষের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করে। অঙ্গার বাতাসে মিশে থাকে, গাছ তা নিগূঢ় শক্তি বলে শোষণ করে নিজের করে নেয়। গাছপালা মানব জীবন বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু। তাইতো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-

‘কত যুগ যুগান্তরে কান পেতে ছিল স্তব্দ

মানুষের পদশব্দ তবে নিবিড় গহন তলে

যবে এল মানব অতিথি দিল তারে ফুলফল

বিস্তারিয়া দিল ছায়াবীথি।’



একটি দেশের পরিবেশ রক্ষায় ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে শতকরা ২৫ ভাগ বৃক্ষাবৃত্ত রাখা অপরিহার্য। দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় বনভূমি আমাদের নেই। সরকারি হিসেবে ১৬ ভাগ, হলেও বাস্তবে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৭.৭০%। আর ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে মাত্র ৫ শতাংশ। দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৩.৫ শতাংশ। তাই সময়ের প্রয়োজনে গাছলাগানো এখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদশে প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের মতে, বিশ্বের বনভূমি উজার হতে হতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্ব পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন ব্রাজিলের রাজধানী শহর রিও-ডি- জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হয় পরিবেশ বিষয়ক বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলন। শিল্পোন্নত দেশসমূহ মোট ১৭০ টি দেশের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, বিশ্বজুড়ে যে সর্বনাশা বৃক্ষনিধন চলছে তা এ বিশ্বকে এক কঠিন সমস্যায় ফেলবে। প্রতি সেকেণ্ডে উজার হচ্ছে এক একর পরিমাণ বনভূমি। এ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে একই সঙ্গে বৃক্ষনিধন ও বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বিশ্বকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখতে হবে।সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই দেশকে বদলে দেয়া সম্ভব। কবির আহ্বান-

‘মানুষ তুমি গাছের পক্ষে দাঁড়াও

মানুষ তুমি বৃক্ষমুখী হও

গভীর নিঃসর্গ তোমাকে অভিবাদন জানাবে।’



পরিবেশ সংরক্ষণে গাছ বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিল্প, চিকিৎসা, বিনোদন, ভ্রমণ, যাতায়াত, অর্থ, কর্মসংস্থান, প্রতিরক্ষা, পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণ, সর্বক্ষেত্রেই গাছের ভূমিকা অপরিসীম। তাই জীবনের প্রয়োজনে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। গাছ ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক। যার ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাণিকুল আজীবন সর্বাংশে নির্ভরশীল। সুস্বাদু তৃপ্তিকর পানীয় তৈরিতে ব্যবহৃত হয় গাছের পাতা বা বীজ। কাঠ দগ্ধ হয়ে কয়লায় পরিণত হয় আমাদের রসনা তৃপ্তিকর উপাদেয় খাবার তৈরিতে। আভিজাত্যের পোশাক থেকে অতিসাধারণ পোশাকের যোগান দেয় গাছ। বাসগৃহ, উপাসনালয় থেকে রাজ-প্রাসাদের সৌন্দর্য আর ঐতিহ্য ধারণ করে গাছ তার জীবনাবসান করে। আমাদের অভিজাত আসবাবপত্র থেকে সাধারণ ব্যবহার্য নিত্য প্রয়োজনীয় সবই গাছজাত। সভ্যতার মাইলফলক কাগজ ও চাকা উৎপাদনের প্রাথমিক উপাদান গাছ। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের জরাব্যাধির নিরাময়ক হিসেবে ভেষজ গাছ-গাছড়ার ব্যবহার সর্বজনবিদিত। বৃক্ষ গুল্মের পুষ্প পল্লবের সৌন্দর্য নিয়ে এত যে উপমা তাতেও বৃক্ষরাজির অবদান অনস্বীকার্য। কবি বলেছেন-

‘ও অরণ্য! জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্রির প্রতীমা

রাশি রাশি পাতার মখমলে আমাকে আবৃত কর।

পোড়া পিঠে মেখে দাও মমতার সবুজ ভেষজ

ধুয়ে যাক দীর্ঘশ্বাস গুলো।’



ফলদ, বনজ, ভেষজ প্রতিটি বৃক্ষেরই সামগ্রিক পরিবেশের ওপর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, একটি বয়স্ক বৃক্ষ তার জীবদ্দশায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ও জীবজগতে যে অবদান রাখে তাহলো-ক) মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরতা বৃদ্ধি করে ৫ লাখ টাকার। খ) বায়ু দূষণমুক্ত করে প্রায় ১০ লাখ টাকার। গ) জীব ও জন্তুর খাদ্যের জোগান দেয় ৪০ লাখ টাকার।ঘ) বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে বৃষ্টিপাতের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রায় ৫ লাখ টাকার। ঙ) গাছপালা নির্ভর প্রাণীর আবাসন সংস্থান করে প্রায় ৫ লাখ টাকার। চ) জীব নির্ভর জীবনরক্ষাকারী অক্সিজেন সরবরাহ করে প্রায় ৫ লাখ টাকার।” বৃক্ষশূন্যতা যে কী ভয়াবহ তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফ্রিকার অঞ্চল। বৃক্ষশূন্য, পানিশূন্য এলাকার মানুষ চলে গেছে অন্য এলাকায়। বাংলাদেশে এর অশুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসতো লেগেই আছে। পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত ও হুমকীর সম্মুখীন। বর্তমান পরিবেশ দূষণ মানব সভ্যতার জন্যে বিরাট হুমকি স্বরূপ। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী Peter Walliston বলেছেন- Environmental pollution is a great threat to the existence of living beings on the earth. আধুনিক সভ্যতার কর্মনাশা স্রোতে আরণ্যক পরিবেশ আজ ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে।





আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় জীবনে গাছের অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। শান্তি ও সেবাধর্মের আদর্শ দীক্ষাগুরু হলো এই মূক ও মৌন গাছ।৬

গাছ গ্রামীণ জনগণের দুঃসময়ের বন্ধু। সাধারণত অর্থনীতিবিদদের কাছে এটি গৌণ হলেও গ্রামীণ মানুষটির কাছে তা অত্যন্ত মূল্যবান, মুখ্য ও দুঃসময়ের বন্ধু। দেশকে সুশীতল ও বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে গাছের অবদান অনস্বীকার্য।অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক মধুর নিকুঞ্জ পৃথিবীকে সবুজে-শ্যামলে ভরে দিয়েছে প্রাণ প্রদায়ী বৃক্ষরাজি। বাতাসের বিষ শুষে নিয়ে গাছ মানুষ সহ সমস্ত প্রাণিকুলকে দান করে নির্মূল বায়ু-যা তার বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত। গাছকে কেন্দ্র করেই প্রাণের অস্তিত্ব। কবি বলেছেন-

‘বৃক্ষ নেই প্রাণের অস্তিত্ব নেই,

বৃক্ষহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন মহাশশ্মান।’



অক্সিজেন গ্রহণের পাশাপাশি মানবদেহে একটি বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া বিদ্যমান। আর তা হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন। একজন মানুষ সাধারণ অবস্থায় ০.৭ ঘনফুট কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রতি ঘণ্টায় ত্যাগ করে। এ হিসেবে দিনে সে ১৬.৮ ঘনফুট এবং বছরে ৬০৪৮ ঘনফুট কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। একজন মানুষ যদি ৫৬ বছর বাঁচে তাহলে তার জীবদ্দশায় সে ৩৩৮৬৪৮ ঘনফুট এবং সেই হিসেবে পৃথিবীর ৫৭০ কোটি মানুষ ঘণ্টায় ৩৯৯ কোটি ঘনফুট কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে বাৎসরিক হিসেবে যার পরিমাণ বিশাল। আর এই মানবকুল কর্তৃক পরিত্যক্ত এবং ভয়াবহ গ্যাসটি গ্রহণ করে বৃক্ষাদি। পৃথিবীতে ক্রমান্বয়ে গাছ-গাছালির সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় হ্রাস পাবার ফলে এই গ্যাস পুরোপুরি শোষিত না হওয়ায় তা ক্রমশ: বায়ুমণ্ডল এবং ভূ-পৃষ্ঠে জমা হয়ে মানব সভ্যতা এবং প্রাণী জগতের জন্য এক বিরাট হুমকীর সৃষ্টি করেছে।



১৯৫০ সনের পর জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ ও কৃষি জমির সম্প্রসারণের জন্য বন উজাড় বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মতে, “Though there is no accurate estimates, sources say that closed to Rs.2000 million worth of wood is cut each year under the guide of catering to the industry which the state sells at a heavy subsidy-Rs.9 per wooden crate as against actual cast of Rs.30 per crate, thereby providing an incentive of Rs.21 per box to the states deforestation” আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ।



গাছ-খাদ্য দেয়, অক্সিজেন দেয়, জ্বালানি দেয়, আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণের সামগ্রী দেয়। আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে। জীবন রক্ষার নানা ওষুধ দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাসগৃহ রক্ষা করে। তাই বৃক্ষ ছাড়া জীবন কল্পনাও করা যায় না। পড়ার টেবিল থেকে খাওয়ার টেবিল, ক্লাস রুম থেকে শোবার ঘর, পাঠশালা কি বাসস্থান, কর্মস্থল, পার্ক, হাসপাতাল সর্বোপরি আমাদের আবাসস্থলটি তার চিরচেনা রূপটি হারিয়ে ফেলছে। অরণ্যে গাছ নেই, মাঠের সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে, এক সময়ের খরস্রোতা নদীগুলো বালুকাময়-প্রকৃতি হচ্ছে রুগ্নতর। চোখ বুঁজে কান চেপে বাস্তবতাকে পাশ কাটাবার সময়টি আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গাছলাগানোর প্রয়োজনীয়তা যে অত্যন্ত বেড়ে গেছে এ ব্যাপারে সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই।



পরিবেশ সংরক্ষণে গাছের অবদান অপরিসীম। ১.প্রতিদিন বাতাসে সঞ্চিত হওয়া ক্ষতিকর গ্যাস ও বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে বায়ু দূষণমুক্ত রাখে। ২.কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে অক্সিজেনে পরিণত করে। ৩.গ্রিনহাউসের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। ৪.নদ-নদীর উৎসগুলোর পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায়, ভূমিক্ষয়- রোধ করে এবং বন্যার প্রকোপ থেকে আমারদের রক্ষা করে। ৫.কৃষি জমির গুণাগুণ রক্ষা করে, জমির উর্বরতা সংরক্ষণ করে। ৬.তাপ ও প্রবল বাতাস থেকে ফসল, প্রাণী ও জনগণকে রক্ষা করে এবং আশ্রয়দান করে। ৭.প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়তা করে। ৮.মাটির তলদেশের পানির স্তর উপরে টেনে সেচযন্ত্রের নাগালে রাখতে সহায়তা করে। ৯.প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ায়।



গাছপালা ও বনভূমি নির্মূল করার ফলে প্রকৃতিতে প্রয়োজনের তুলনায় অক্সিজেন হ্রাস পাচ্ছে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধির ফলে বায়ুতে মিশ্রিত হচ্ছে ক্লোরোফ্লুরো কার্বন নামক অতীব ক্ষতিকর এক প্রকার গ্যাস। এ গ্যাস ধ্বংস করছে ছাকুনি হিসেবে অতিবেগুনী রশ্মি পরিশ্র“তকারী ওজন স্তরকে। আর এ অকস্মাৎ গ্রীণ হাউস প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। আর এর প্রতিক্রিয়ার ধ্বংসাত্মক প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের অস্তিত্ব আজ হুমকীর সম্মুখীন। গ্রীণ হাউস গ্যাস ও পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সাথে সাথে সূর্যের ক্ষতিকর বেগুনী রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে চলে আসছে। এতে ক্যান্সার রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফগলা শুরু হওয়ায় সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ভূপৃষ্ঠের নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে মরু অঞ্চলের সৃষ্টি হচ্ছে। বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়ছে।কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে বিগত শতকে পৃথিবীর গড় উত্তাপ বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ সে: যদি অব্যাহতভাবে গ্রীণ হাউস গ্যাসের নিঃসরণ বাড়তেই থাকে তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ১.৫০-৩০ সে:। খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিবে। আর এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ।



ভূমিক্ষয় রোধে গাছপালা বিশেষ অবদান রাখে। ভূমিক্ষয়ের প্রধান কারণ হলো বায়ুপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত। গাছপালা এ দুটির গতিকে কমিয়ে দিয়ে ভূমিক্ষয় রোধ করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টর বন থেকে প্রতিবছর ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ গড়ে প্রায় ১-২ টন। সেখানে সমপরিমাণ সমতল ভূমি থেকে ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ গড়ে প্রায় ৫০ টন। অর্থাৎ, বৃক্ষই এ ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার।পরিবেশ বিপর্যয় বাড়ছে। অথচ, পরিবেশ মানব সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিজয় গৌরবে মোহান্ধ মানুষ পৃথিবীর পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে। দূষিত পরিবেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করায় গোটা জীব জগতের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলাফল ভয়াবহ। বৃক্ষশূন্যতার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে দেশের নিচু এলাকা তলিয়ে যাবার আশঙ্কা। বর্তমানে বিশ্বে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪০৬.৮৫ কোটি হেক্টর বিশ্বে জনপ্রতি বনভূমির পরিমাণ ০.৬৪ হেক্টর। পৃথিবীর মোট আয়তনের বনভূমির দ্বারা আবৃত ৩১.১০ শতাংশ। বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ৫০ একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় মোট স্থলভাগের ৬৭.০৫% জাপানের ৬৬.৫৮% বনভূমি রয়েছে। বাংলাদেশের মোট বনভূমির পরিমাণ ২.৫৬ মিলিয়ন হেক্টর। কিন্তু নানাবিধ কারণে সকল বনভূমি বৃক্ষাচ্ছাদিত নয়। বৃক্ষাচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ ৮.৯৮%। ১৯৯৩ সালে বন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, যা ১৯৯৫ সালে অনুমোদিত হয়। বন মহাপরিকল্পনার উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূমির শতকরা ২০ ভাগ বনায়নের আওতায় আনা।



শব্দ তাপের মতো এক ধরনের এ্যানার্জি। বৃক্ষ এক্ষেত্রে শব্দ শোষক হিসেবে কাজ করে। বৃক্ষের সারি শব্দের চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং শব্দদূষণ রোধ করে। সে কোনো প্রকারের শব্দ সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে তার ৮৫% গাছপালা শোষণ করে শব্দ দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে।প্রকৃতিতে অনেক গাছপালার রয়েছে যাদের মধ্যে ক্ষতিকারক পোকা দমনের বিষের গুণাগুণ রয়েছে। যে সকল গাছের পাতা ও বীজের রস অথবা গুঁড়া দিয়ে ফসল ও খাদ্যশস্যের পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। যেমন-তামাক ও নিমগাছ। কৃষকেরা এটি ব্যবহার করতে পারে।বাংলাদেশ অধিক চাহিদার কারণে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অধিক ফল উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান এ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং বাড়বে। বাড়তি জনগণের খাদ্যের যোগান দিতে আমাদের অধিক খাদ্য ফলাতে হবে। কিন্তু অধিক খাদ্য ফলাতে গিয়ে ভূমির উর্বরতা হারিয়ে ফেললে ভবিষ্যতে এ জমি থেকে ভালো ফল আশা করা যাবে না। তাছাড়া আমাদের খাদ্য অভ্যাসও পরিবর্তন করতে হবে। কেবল ভাত বা রুটিকে খাদ্য হিসেবে না দেখে এর সাথে ফলমূল ও নানা শাক সবজির কথা ও ভাবতে হবে।



প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীব বৈচিত্র্য সুরক্ষায় এবং অথনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। মানুষের জীবনধারণের জন্য খাদ্যসহ যে সব মৌলিক চাহিদা রয়েছে বৃক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় সবগুলো পূরণ করে থাকে। মোটকথা বৃক্ষ আমাদের জীবন ও জীবিকার আধার। একটি দেশের ২৫% এলাকা বৃক্ষ আচ্ছাদিত থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে এর পরিমাণ ৭ থেকে ৯% মাত্র। তাইতো নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের করাল গ্রাসে বাংলাদেশ নিয়মিত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এর অবস্থানগত কারণ তার ভিতর উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মানুষের সৃষ্ট অন্যান্য কারন তো আছেই। অন্যান্য কারণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বৃক্ষ নিধন এবং বনভূমির ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়। ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই নিয়মিত আঘাত হানে এবং এর কোনো কোনোটি অত্যন্ত প্রলয়করী আকার ধারণ করে। ১৯৬০ সন থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত প্রায় ৪০ টি সাইক্লোন বাংলাদেশে আঘাত হানে। তন্মধ্যে প্রায় ১০ টি প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কয়েক লাখ মানুষ ও পশুর মৃত্যু ছাড়াও বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের মতে,“উপকুলীয় এলাকায় ব্যাপক বৃক্ষ রোপণ করে একটা বেষ্টনী তৈরি করতে পারলে ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য দুর্যোগ হতে আত্মরক্ষার একটা স্থায়ী ব্যবস্থা হবে।



অধিক হারে গাছ লাগানোর গুরুত্বকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়- ১) অর্থনৈতিক গুরুত্ব ২) পরিবেশগত গুরুত্ব ৩) জীববৈচিত্র্য ৪) চিত্তবিনোদন। এ গুরুত্বকে বিবেচনায় রেখে সরকার থেকে ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত বৃক্ষরোপনকে বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।বাংলাদেশে গ্রামীণ বনায়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পুষ্টি, পশুখাদ্য, জ্বালানী ও পরিবেশ সংক্রান্ত ভাবনা এই প্রয়োজনীয়তাকে আরো গুরুত্ববাহী করেছে। এছাড়া গ্রামীণ শিল্পের প্রসারকে সহায়তা দানের জন্যও বনায়ন অপরিহার্য।কোনো গাছই অপ্রয়োজনীয় নয়। ব্যাপক গাছ রোপণ গোটা গ্রামীণ নিঃস্বার্থ বদলে দিতে পারে। সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশে ২৫ ভাগ বন সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রধানত দু’টি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সামাজিক বনায়ন ও অংশীদারিত্বমূলক বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১) বনায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং ২) জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বনজ সম্পদ বৃদ্ধি এবং পরিবেশের উন্নয়ন।। এছাড়াও লাগসই প্রযুক্তি ও কলাকৌশল প্রয়োগ, জনগণের ভোগের অধিকার নিশ্চিতকরণ, সরকারি ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার, প্রকল্প প্রণয়ন ও সম্পাদনের যথোপযুক্ত প্রতিষ্ঠান।বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে কৃষি বনায়নকে কৃষকদের দোরগোড়ায় সহজসাধ্য ও সময়মত পৌঁছে দিতে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন।



বিজ্ঞানসম্মত কৃষিবন ব্যবস্থায় অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে উন্নতমান সম্পন্ন উপযুক্ত গাছের চারা অপরিহার্য। তাই কৃষিবন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য আদর্শ নার্সারির গুরুত্ব অপরিসীম।‘কৃষিবন উন্নয়নে করণীয় হচ্ছে- ১)গাছ রোপণে জনসচেতনতা সৃষ্টি ২) গাছের চারার সহজলভ্যতা সৃষ্টি ৩) চারার গুণগত মান উন্নয়ন ৪) বসতবাড়িতে শাকসবজি ও ফলমূলের উৎপাদন বৃদ্ধি ৫) কাঠ জাতীয় গাছ ও বাঁশের উৎপাদন বৃদ্ধি ৬) কৃষিবন বিষয়ক প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ৭) কৃষিবন বিষয়ক জ্ঞান সম্পদ ব্যবস্থাপনা ৮) গ্রামাঞ্চলে কৃষিবন বিষয়ক পরামর্শ সেবা ৯) কৃষিবন বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কাজের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে অবদান ১০) প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও সহযোগিতা জোরদার ১১) কৃষিবন পণ্যের বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন ১২) ওষুধি উদ্ভিদের চাষ সম্প্রসারণ’



যে সব স্থানে গাছ লাগানো যায় তার মধ্যে রয়েছে-১)‘পতিত জমি ও কালিময় উঁচু ও নিচু এলাকা ২) রাস্তা, রেলপথ ও বাঁধের ধার ৩) নদীর তীর ও পুকুর পাড় ৪) সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য স্থান ৫) অফিস, কল-কারখানা ও স্কুল কলেজ প্রাঙ্গণে ৬) সাধারণভাবে বসতবাড়ির এক চতুর্থাংশ বা অর্ধেক জায়গায় ৭) ফসলী জমির আইল বা ভিতরে’।গাছলাগানো কর্মসূচি সফল করতে বসতবাড়িতে গাছরোপণ ও পরিচর্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বসতবাড়ির কর্ত্রী হচ্ছেন নারী। এ কারণে বসতবাড়িতে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।একটি গাছ কাটলে দুইটি গাছ লাগাতে হবে। কেননা, গাছের বিনাশ মানে পরিবেশের ভারসাম্যের সর্বনাশ, মেঘ পালাবে, বৃষ্টি হবে না; বৃষ্টির অভাবে নতুন করে গাছ ফলবেনা, ফসল গুমরে মরবে, জলাশয়গুলো যাবে শুকিয়ে, ফলে মাছ জলজ কীটপতঙ্গ ধ্বংস হবে, পাখিরা চলে যাবে অন্য কোনো দেশে।



গাছ আমাদের জীবনের প্রতীক। পরিবেশ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি সরবরাহ, কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে গাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনকে স্বস্তি এবং শান্তিপূর্ণ করতে প্রয়োজন হয় গাছপালার। দোলনা থেকে কবর কিংবা চিতা সব জায়গায় গাছপালার অবাধ ব্যবহার। গাছপালা প্রাণিকুলের জীবন ধারণের প্রধান সহায়।প্রচুর গাছ লাগানোর মাধ্যমে দেশকে সবুজে-শ্যামলে, ফুলে-ফলে ভরিয়ে তুলতে চাই। ফিরে আসবে সেই হারানো রুপ। যে রুপে মুগ্ধ হয়ে জীবনানন্দদাশ লিখেছিলেন-

‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে-সবচেয়ে সুন্দর করুণ;

যেখানে সবুজ ডাঙ্গা ভম্বরে আছে মধুকুপী ঘাসে অবিরল;

যেখানে গাছের নাম; কাঠাল, অশ্বথ, বট, জারুল, হিজল;

সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙ্গের মতো জাগিছে তরুণ;



বৃক্ষরোপণ করবে হ্রাস ঝড়, ঝঞ্ঝা, জ্বলোচ্ছ্বাস।অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক মধুর নিকুঞ্জ পৃথিবীকে সবুজে-শ্যামলে ভরে দিয়েছে প্রাণপ্রদায়ী বৃক্ষরাজি। এ বিশ্বকে সুশীতল ও বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। বৃক্ষ আমাদের নীরব বন্ধু-আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে; অকৃপণ তার দান। কেবল পরিবেশ সংরক্ষণেই নয়, পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্যে বৃক্ষরোপণের ভূমিকার তাৎপর্য অনস্বীকার্য। মানুষের পরম উপকারী বন্ধু বৃক্ষ না থাকলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়তো। সে আমাদের যেমন অনেক উপকার করে তেমনি তার সৌন্দর্যে হৃদয়মন হয়ে ওঠে আপ্লুত। অথচ, “দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর।”-কবির এ রোদন আজ অরণ্যরোদনে পরিণত হয়েছে। কেননা অরণ্য দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষের কুঠারের আঘাতে। এ হচ্ছে মানুষের আত্মঘাতী কর্ম। কারণ বৃক্ষ পৃথিবীর আদিপ্রাণ। যা মৃত্তিকা থেকে তাদের প্রাণরস আহরণ করে, নিজেকে সঞ্জীবিত করে, পত্র, পুষ্প ও ফলে সমৃদ্ধ করে ভরে তুলেছে এ ধরণীকে। জীবনধারণের জন্যে অক্সিজেন দিয়ে বৃক্ষ প্রতিদানে নির্মমভাবে নিধন হচ্ছে। ফলে সবুজে-শ্যামলে ভরা পৃথিবীতে নেমে এসেছে পরিবেশ বিপর্যয়। যেহেতু বৃক্ষ রক্ষা মানে নিজেদের জীবনকে রক্ষা করা। তাই একটি সুখী ও সুন্দর জীবনের জন্যে সকলকে এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিৎ যে,“লাগাব বৃক্ষ, তাড়াব দুঃখ

চলো সবাই গাছলাগাই না হয় জীবন রক্ষা নাই।”



জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের ব্যাপক আবশ্যকতা রয়েছে। মানব জীবনের সাথে বৃক্ষের সম্পর্ক সুগভীর। তাই বৃক্ষকে মানব জীবনের ছায়াস্বরূপ বলা হয়। বৃক্ষ আমাদের নীরব বন্ধু। নিঃসন্দেহে বৃক্ষরোপণ একটি মহৎ প্রচেষ্টা। ‘বৃক্ষরোপণ একটা সাদকা-জারিয়ার ন্যায় সৎকাজ। আজ যে একটা বৃক্ষ রোপণ করলেন-ইহার ফুল, ছায়া, ফল, শোভা, কাঠ ইত্যাদির কথা বিবেচনা করলে ইহার মধ্যে একটা আনন্দের ছোঁয়া পাওয়া যায়।‘-কাশকাতার। বৃক্ষ থেকেই আমরা নানারকম ভেষজ ওষুধ, মোম, মধু, রবার, রজন, কুইনাইন ইত্যাদি পেয়ে থাকি।



বৃক্ষের এতসব উপকারী দিক থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞতার কারণে এবং অসচেতনতার অভাবে নির্দ্ধিধায় গাছপালা কেটে রান্না রান্নার কাজে ব্যবহার করছে। কখনো চাষাবাদের জন্য-গাছপালা কেটে সম্পূর্ণ বনকেই নিঃশেষিত করে ফেলেছে। তাই আমাদের পরিবেশ তথা আবহাওয়া, জলবায়ুর ভারসাম্য বজায় রাখা এবং খরার নিমিত্তে কারণে খাদ্যঘাটতির হাত থেকে দেশকে রক্ষার নিমিত্তে বনাঞ্চল সৃষ্টি ও বন সম্প্রসারণের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। দেশকে সবুজ ও শ্যামলে ভরে দিতে পারলে যে কি উপকার হবে তা সামান্য কথায় ব্যক্ত করা যাবে না। বৃক্ষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্ত রেখে, বৃষ্টিপাত হওয়ায় সাহায্য করে, ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে মানুষকে রক্ষা করে, ফলদান করে মানুষের পুষ্টি যোগায়, গৃহ নির্মাণে কাঠের যোগান দেয় এবং মানুষের আর্থিক সংকট মোচনসহ সহস্র প্রক্রিয়ায় মানুষকে উপকার করে। কাজেই জীবনের প্রশ্নেই বৃক্ষরোপণ কর্মকাণ্ডে মানুষকে সাড়া দেয়া উচিত।



যেখানেই প্রাণী আছে সেখানেই বৃক্ষের প্রয়োজন রয়েছে। রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘তুমি যদি নিশ্চিত জানতে পার যে, তোমার মৃত্যু আসন্ন আর তোমার হাতে কয়েক মুহূর্ত সময় আছে তাহলে তুমি একটি বৃক্ষরোপণ করে যাও। কেননা তা তোমার জন্য দোয়া করবে।” হাদিসে এসেছে, ‘দুদকায়ে জারিয়ার সওয়াব হিসেব নিকেশের আগ পর্যন্ত জারি থাকবে। বৃক্ষরোপণ একটি সদকায়ে জারিয়া। একজন মনীষী মরার আগে তার ভক্তদের বলেন, “আমি মরলে আমাকে একটি ফলদান বৃক্ষের নীচে কেন? হুজুর বললেন, আমার কোনো ভাল কাজ নেই। আমার দেহ পঁচে সার হবে ফলে গাছটি বেশি শক্তিলাভ করবে, বেশি ফল ধরবে এবং ঐ ফল মানুষ, পশু পাখি খাবে মহান আল্লাহ ঐ আসিলায় যদি আমাকে মাফ করে দেন। কুরআন এবং হাদিসের আলোকে বৃক্ষরোপণ একটি বড় ধরনের ইবাদতও বটে।



জীবধারণের জন্য পানির মতই গাছের প্রয়োজন অপরিসীম। মানুষের জীবনধারণে গাছ ব্যাপক নিরাপত্তা দান করে। গাছ ছায়া দান করে। ফুল সুবাস ও সৌন্দর্য দিয়ে মানুষের ব্যথিত মনকে জুড়িয়ে দেয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও সৌন্দর্য বর্ধনে গাছের বিকল্প নেই। মানব জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে গাছের থেকে বড় সহায়ক আর নেই। গাছপালা কমে গেলে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। ফলে খরার কারণে ফসলাদি ভাল হয় না। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সামুদ্রিক অঞ্চলে যতবেশি গাছপালা বৃদ্ধি করা যাবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকুলবাসীরা ততবেশি হেফাযতে থাকতে পারবে।



বৃক্ষ আমাদের প্রাচীন বন্ধু। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেক প্রাণী বৃক্ষের উপর নির্ভরশীল। মৌলিক চাহিদা পূরণে বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই। বৃক্ষ সভ্যতার অন্যতম বাহন। পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ ও প্রাণী একে অপরের সম্পূরক। গ্রামাঞ্চলে একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং সোয় ৬ কেজি অক্সিজেন ত্যাগ করে। একটি সাধারণ আমগাছ ৫ জনের একটি পরিবারের বার্ষিক অক্সিজেন চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। একটি আমগাছ ৫০ বছর জীবিত থাকলে যে অবদান রাখে তার আর্থিক মূল্য ১৫ লাখ ৭০ হাজার ভারতীয় রূপী বলে ভারতীয় বন গবেষণা থেকে জানা যায়।



মানব বসবাসের উপযোগী একটি পৃথিবীর জন্য থাকা চাই প্রয়োজনীয় বনভূমি। বিশ্ব পরিবেশ এবং জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ইহা এক অপরিহার্য উপাদান। পর্যাপ্ত বনভূমির অভাবে ১৮৫০-১৮৬০ সময়কালের তুলনায় বর্তমান পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। বর্তমানে বিশ্বের তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে আবহাওয়াতে মারাত্মক বিপর্যয় শুরু হয়েছে। পৃথিবীর জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় কমে যাচ্ছে শীতকালের স্থায়িত্ব। বাড়ছে ভূমি ও পাহাড়ধ্বস, ঘনঘন দাবানল হচ্ছে, দীর্ঘায়িত হচ্ছে খরা, ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা, টর্নেডো, সাইক্লোনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষতিকর প্রভাব, এদিকে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ আমাদের পরনির্ভর করে তুলতে চায়। আমাদের বন সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ শত্র“দের প্ররোচনায় বন কেটে সাফ করে উপার্জন করছে প্রচুর অর্থ।



বর্তমানের পরিবেশ দূষণ বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও বিপজ্জনক সমস্যা। ক্রমেই এ পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে উঠছে। ফলে মানব সভ্যতার অন্যান্য অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত সমস্যা। এ সমস্যার মোকাবিলা করতে না পারলে মানব বাসের এ পৃথিবীতে নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয় এবং বিপণœ হবে বিশ্ব। এ জন্য প্রয়োজন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং পরিবেশ বান্ধব কর্ম পরিকল্পনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা নিঃসন্দেহে অপরিসীম। এর যৌক্তিকতা নতুন করে আর বলার প্রয়োজন পড়ে না। এখন আমাদের দেশের ১৫ কোটি লোকের মধ্যে ৫ কোটি বাদ দিয়ে যদি ১০ কোটি লোকও ২ টি করে বৃক্ষরোপণ করে এবং ভালভাবে পরিচর্যা করে তবে বছরে প্রায়, ২০ কোটি বৃক্ষের আবাদ করা হবে। সে জন্য-‘নিজে বৃক্ষরোপণ করুন; অপরকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করুন।’



ঝড়, ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে দেশকে বনায়নের দিক থেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা দরকার। গাছপালা দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণ করে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে আবহাওয়াকে শীতল করে ও প্রচুর বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে। মূল ভূ-ভাগ নতুন সৃষ্ট চরাঞ্চলকে নদীভাঙন, বৃষ্টিপাত ও পানি-স্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করে। এতে মাটিতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। বৃক্ষাদি ঝড়-ঝঞ্ঝা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাসগৃহ রক্ষা করে। উদ্ভিদাদি জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে অধিক উৎপাদনে সাহায্য করে। অঞ্চল বিশেষে গাছপালা সেখানকার আদিপ্রবাহ অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে ভূমিকে ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। অঞ্চল বিশেষের পানি সংরক্ষণ, বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণে সেখানকার গাছপালা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। পৃথিবী থেকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে এবং অক্সিজেন দিয়ে এই বৃক্ষই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।



আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও অনেক গাছ বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে বৃক্ষের অভাবে আবহাওয়ার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, দেখা দিয়েছে অনাবৃষ্টি। গোটা দেশ আজ মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই বৃক্ষের অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজন বৃক্ষরোপণ। বৃক্ষের অভাবে মৃত্তিকা হয়ে উঠে শুষ্ক, রুক্ষ, অনুর্বর। শুরু হয় মরু প্রক্রিয়া। আর বৃক্ষ সূর্যের উত্তাপ শোষণ করে পরিবেশকে শীতল রাখে। সৌরতাপের বর্ষণ থেকে মৃত্তিকাকে রক্ষা করে। সুতরাং বৃক্ষরোপণকে গুরুত্ব দিতে হবে।পৃথিবী একটি, কিন্তু বৃক্ষ নিধনের কারণে সেই পৃথিবীটি যদি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে তাহলে পৃথিবীর মানুষ দাঁড়াবে কোথায়? তাইতো আজ প্রকৃতির ওপর আধিপত্য নয়,মানুষ গড়ে তুলতে চাইছে প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্বন্ধ। কেননা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবজাতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই।



বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখা ও এর সম্প্রসারণের জন্যে আমাদের দেশে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করা হয়। বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বনবিভাগ বৃক্ষের চারা উৎপাদন করে বিনামূল্যে তা জনগণের মাঝে সরবরাহ করে।বৃক্ষরোপণের জন্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বন অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮২ সালে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় গৃহীত ‘কমিউনিটি বনায়ন’ কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় ১২০০০ একর জ্বালানী কাঠের বাগান, ৩০০ একর বন বাগান, ৩০০০ একর স্ট্রিপ বাগান স্থাপন উল্লেখযোগ্য। ৭০০০ গ্রামকে এর কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। এ প্রকল্পের সফলতার ভিত্তিতে ১৯৮৭-১৯৮৮ সালে দেশের ৬১ জেলায় ‘থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয়। বনায়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে সর্বস্তরে ৮০ হাজার ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং জনগণের মধ্যে ৬ কোটি চারা বিতরণ করা হয়। এভাবে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি ইতোমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উপকুলীয় চরাঞ্চলে সবক’টি মহাসড়কের দুপাশে, রেল সড়কের উভয় ধারে এবং বাঁধ এলাকায় এই বনায়নে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে।



শুধু সরকারিভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করলেই দেশ সবুজ হয়ে যাবে না। একে সফল করতে হলে দেশব্যাপি ব্যাপক কর্মসূচি নিতে হবে। এ কার্যক্রমকে জোরদার করার লক্ষে গণসচেতনা এবং ‘বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশের ভারসাম্য শিরোনামে রেডিও-টিভিতে ব্যাপক প্রচার করতে হবে। পোস্টার, ব্যানার, স্লোগান দিয়ে জনগণকে জাগিয়ে তুলতে হবে এবং বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। গাছ লাগানোর জন্যে জনমনে চেতনা সঞ্চার করতে মিনিপর্দা, মাইকে প্রচার, সভাসমিতি ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রত্যেকে যদি কমপক্ষে একটা করে গাছ লাগায় তাহলে সহসাই এ অভিযান সফল হবে।উপকুলীয় বনায়নের মাধ্যমে ঝড়ের তীব্রতা কমানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও প্রভৃতি দাতাসংস্থা সহায়তা দিয়েছে। বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার জন্য আরো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। এক্ষেত্রে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। তবেই ক্ষতিকর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্রাস পাবে, মানুষ ও সম্পদ রক্ষা পাবে এবং বাংলাদেশ সোনার ফসলে ভরে ওঠবে।



বৃক্ষ নিধনের প্রতিক্রিয়া থেকে উদ্ভূত নানা সমস্যাবলি মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। এ ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য যে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যায়-ক) অবাধে গাছপালা নিধন ও বনভূমি উজাড় করা বন্ধ করতে হবে।খ) বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যতে নিমজ্জিত হওয়া থেকে ভূমিকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করে সেখানে বৃক্ষরোপণ।গ) প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বৃক্ষরোপণ অভিযান বাংলাদেশ সরকারের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। যা পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যাপক সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। বনবিভাগ ১৯৮১-১৯৮১ সালে এর আর্থিক সহায়তায় উত্তরাঞ্চলের ২৩ টি জেলায় জনগণকে জনগণকে অংশীদার করে প্রথম সামাজিক বনায়ন প্রকল্প(কমিউনিটি ফরেস্ট্রি উন্নয়ন প্রকল্প) বাস্তবায়ন করে। এ প্রকল্প চলে ১৯৮১-১৯৮২ থেকে ১৯৮৬-৮৭ পর্যন্ত। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৯-৯৫ সাল পর্যন্ত পার্বত্য তিনটি জেলা ব্যতীত দেশের ৬১ টি জেলায় এর অর্থায়নে থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এরপর সরকারের নিজস্ব তহবিলে ১৯৯৫-৯৭ সালে সম্প্রাসারিত সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ১৯৯৫-২০০২ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। সে সাথে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ৬২ টি জেলায় ফরেস্ট্রি, সেক্টর প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। সামাজিক বনায়নের আওতায় ২০০৫-০৬ সাল পর্যন্ত বনভূমির ৬৩৮৯৮.০০ হেক্টরে বিভিন্ন বাগান সৃজন করা হয়েছে। এছাড়া ১৯৮১-৮২ সাল থেকে ২০০৫-০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক বনায়নের আওতায় ৪৯৪১৩.০০ কিলোমিটার বিভিন্ন সড়কপথে বনায়ন সৃজন করা হয়েছে। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-’০৬ সাল পর্যন্ত সামাজিক বনায়নের আওতায় বাগান কর্তন করে বিপুল পরীক্ষা বনজদ্রব্য পাওয়া গেছে। যা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এসব বনজদ্রব্য বিক্রয় হয়েছে ২৩৭ কোটি ২ লাখ ৮ হাজার ৭৫৫ টাকা।



বনবিভাগ সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাসের বিপর্যয় ঠেকাতে উপকুলীয় ১০ জেলার বাঁধের উপর ১৯৬০ সাল থেকে বনায়ন কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৬৫-’৬৬ সাল থেকে উপকুলীয় অঞ্চলে জেগে উঠা চরে বনায়নের কার্যক্রম করে আসছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১.৫১ লাখ হেক্টর ভূমি উপকুলীয় বনায়নের মাধ্যমে সমুদ্রগর্ভ থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এতে দেশের প্রায় ১% ভূমি বৃদ্ধি পেয়েছে। বনবিভাগ দেশের উত্তরাঞ্চলে ১৯৮১-’৮২ সাল থেকে ২০০৫-’০৬ সাল পর্যন্ত ১৬ হাজার ৩০৭ কিলোমিটার স্ট্রীপ বাগান এবং ১৫ হাজার ৬৯৫ হেক্টর উডলট ও কৃষি বাগান করেছে। ১৯৯৭-’৯৮ সাল থেকে ২০০৬-’০৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগামে ২৪ হাজার ৪০১ হেক্টর শিল্প বনায়ন করেছে। দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে ৬ শ একর ভূমিতে ঔষধি বাগানের মডেল স্থাপন করেছে। ইতোমধ্যে ১ লাখ ঔষধি গাছের চারা জনগণের মাঝে বিক্রয় ও বিতরণ করেছে। বিশেষ কর্মসূচির আওতায় ২০০৩-’০৪ থেকে ২০০৫-’০৬ সাল সরকার ১ কোটি নারিকেলের চারা বিতরণ করেছে। এছাড়া ২০০৫-’০৬ সালে ১ কোটি নিম চারা সারাদেশে রোপণ করা হয়েছে।



বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম শুরু হয় চট্টগ্রামের বাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। দেশের মোট জনশক্তির মধ্যে বনজ সম্পদ খাতে নিয়োজিত ২%। জাতীয় বৃক্ষমেলার প্রচলন শুরু হয় ১৯৯৪ সাল থেকে। বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার প্রবর্তিত হয়-১৯৯২ সালে। বাংলাদেশে এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি ৫ জুন বিশ্বপরিবেশ দিবস পালন করে। বিশ্বব্যাপি পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে এ দিবসটি পালিত হয়। এ দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ জীবন এবং পরিবেশ এক ও অভিন্ন। বৃক্ষ হচ্ছে নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। পরিকল্পিত বনায়নের মাধ্যমে আমরা বৃক্ষ সম্পদ বাড়াতে পারি।



মানুষের কল্যাণে গাছ স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি। খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বেশি ঠাণ্ডা, বেশি গরম, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা, বায়ু দূষণ ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা বন্ধ করতে পারি না। কিন্তু অধিক সংখ্যক গাছ-গাছালিই এগুলোর আন্তবলীলা, ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে। তাই গাছ লাগানোকে আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। আসুন; যার যেখানে সুযোগ আছে গাছের চারা লাগাই, অন্যকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করি, পরামর্শ দেই গাছ লাগানোর। সুজলা, সুফলা হয়ে উঠুক পৃথিবীর মানচিত্রে ক্ষুব্ধ আমার এই জন্মভূমিটি! সুবজ শ্যামলিমায় ভরে উঠুক কানায় কানায়, কমে যাক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানুষের মনে আসুক চিরসুন্দর, অকৃত্রিম, অনাবিল হাসি। আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই-

‘গাছ লাগিয়ে ভরবো দেশ

বদলে দেব বাংলাদেশ।’



দেশ ও জাতির স্বার্থে বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। গাছের প্রতি মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। বৃক্ষও মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করার মাধ্যমে আমাদের দেশকে বদলে দিতে হবে। বৃক্ষ নিধন নয়, বরং বৃক্ষরোপণই আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। আর প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ রোপণকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশ হয়ে ওঠবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নয়নাভিরাম এক অকৃপণ ঔদার্য। বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব।কবি সুকান্ত বলেছিলেন,

‘‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের

চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।”





তথ্যসূত্র:

দে, তপন কুমার, ১৯৯৯, বৃক্ষরোপন অভিযান

মো: ওসমান গণী, ‘ নৈসর্গিক নান্দনিকতায় বৃক্ষরাজি’, কৃষিকথা, আগস্ট- সেপ্টেম্বর ২০০৪, পৃ. ১৬২-১৬৩

বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, দেরাদুন, ভারত

মো: আবদুল হামিদ আকন্দ, ‘গাছের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব’, কৃষিকথা, এপ্রিল- মে ১৯৯৩, পৃ.৪৭-৪৮

মো: সানোয়ারুল হক, বৃক্ষ গ্রামীণ জনগণের দু:সময়ের বন্ধু, কৃষিকথা, জুন-জুলাই, ১৯৯৩, পৃ. ১১৯-১২১

ড. সন্তোষকুমার সরকার, ‘গাছপালা অথবা অন্যান্য পদার্থের তৈরি বিষ দিয়ে পোকা দমন’, কৃষিকথা, ফেব্র“য়ারি-মার্চ ১৯৯৬, পৃ.৩৫১

কৃষিবিদ মো: আবদুস সালাম, ‘ফলবৃক্ষের গুরুত্ব’, কৃষিকথা, আগস্ট- সেপ্টেম্বর ২০০৪, পৃ.১৬৪-১৬৫

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, একে ওসমান হারুনী, ‘রাজশাহী অঞ্চলে কৃষি বনায়ন’, পৃ.১৪৪-১৪৫, কৃষিকথা, আগস্ট- সেপ্টেম্বর ২০০৫

কৃষিবিদ ড. মতিয়ার রহমান, ‘কৃষি ও সামাজিক বনায়ন’ পৃ. ১৫১-১৫২, কৃষিকথা, আগস্ট- সেপ্টেম্বর ২০০৫

মুহাম্মদ হাসান ইমাম, ‘গ্রামীণ ও বৃক্ষসম্পদের চালচিত্র; একটি তথ্যানুসন্ধানী জরিপ ও প্রসঙ্গ কথা, আই বি এস জার্নাল, রাবি, এপ্রিল ১৯৯৪

এবিএম জাওয়ায়ের হোসেন, ‘সামাজিক বনায়ন: ২৫ ভাগ বনসৃষ্টির উপায়’, কৃষিকথা, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০০৪, পৃ.২৭৩

ড. এম.নূরুল ইসলাম, ড.এফ.এম. আখতারুজ্জামান, কৃষি বনায়নে প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা’, কৃষিকথা, আগস্ট- সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃ.১৩১

কৃষিবিদ ড.সৈয়দ মো: জয়নুল আবেদীন, কৃষিবিদ ড. শহীদুল ইসলাম, ‘কৃষিবনের আদর্শ নার্সারি’, কৃষিকথা, আগস্ট- সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃ.১৩২

ড. মু. আব্দুল কুদ্দুস, ‘বাংলাদেশের কৃষিবন উন্নয়নে এসডিসি ও ইন্টার কো অপারেশনের অবদান, ‘কৃষিকথা আগস্ট- সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃ.১৩৭-১৪১

মো: ওসমান গণী, ‘জীবনের জন্য বৃক্ষ’, কৃষিকথা, জুন-জুলাই ২০০৩, পৃ.৬৬-৬৭

তাহমিনা ইসলাম, ‘বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় গ্রামীণ মহিলাদের ভূমিকা’, কৃষিকথা, জুন-জুলাই ২০০৩, পৃ.৮৪-৮৫

এক প্রকৃতিপ্রেমী সম্পাদকের সঙ্গে সরল সংলাপ, পরিবেশ পত্র, পৃ. ২৬-২৮

মো: আব্দুল গোফুর সরকার, ‘বন থেকে জীবন’ কৃষিকথা, জুন-জুলাই ২০০৩, পৃ.৬৮

ডা: অসিত কুমার চৌধুরী, বৃক্ষ নিধন বনাম প্রকৃতির প্রতিশোধ, কৃষিকথা, ফেব্র“য়ারি-মার্চ ২০০০, পৃ.৭২

মোহাম্মদ পারভেজ, বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা, কৃষিকথা, আগস্ট- সেপ্টেম্বর ২০০১, পৃ.১৪৮

মুহাম্মদ হাসান ইমাম, গ্রামীণ বৃক্ষ সম্পদের চালচিত্র, আই.বি.এস. জার্নাল ১৪০০:১, এপ্রিল ১৯৯৪, পৃ.১৬৫

এ.জেড.এম.শামসুল হুদা, বাংলাদেশে দুর্যোগ প্রতিরোধে বৃক্ষ ও বনায়ন, কৃষিকথা, জুন-জুলাই ১৯৯২, পৃ:১০৪

আমলেন্দ্র সাহা,গাছ সভ্যতার নিত্য সঙ্গী, কৃষিকথা, ৫২৩ তম বর্ষ, জুন-জুলাই ১৯৯২, পৃ.৯৪

রজব আলী, বৃক্ষ মানুষের পরম, সচিত্র বাংলাদেশ, ১-১৫ মে ২০০৪, পৃ:৪৪,৪৬

মোহাম্মদ পারভেজ, পরিবেশ ও বনায়ন, কৃষিকথা, জুন-জুলাই ২০০২, পৃ.৭৬



মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.